অশ্লীল
✍ রত্না চক্রবর্তী
২.৯.২২
প্রভাত নাকি ছোট থেকেই সন্ন্যাসী টাইপের ছিল।সংসারে তেমন মন কোনদিনই
ছিল না।ছোটবেলায় স্কুল পালিয়ে নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকত। ছোটবেলায় পৈতের
সময় মা যখন জিজ্ঞেস করল -"বাবা তুমি গৃহী হবে না সন্ন্যাসী?"ভ্যাবাচাকা
খেয়ে বেচারী চুপ করে রইল। একটু বড় হতে একবার মেলায় আসা সার্কাস দলের
সাথে ভেগেছিল।অনেক খোঁজ করে কোন রকমে ফিরিয়ে আনা হয়।প্রভাতের মা ভয়ে
ভয়েই থাকত।কোনদিন ছেলে আবার পালায়।সংসারে যাতে মন হয় তাই মাত্র ২১
বছরেই প্রভাতের বাবার বন্ধুর পরমা সুন্দরী মেয়ে ষোড়শী মালার সাথে ঘটা
করে বিয়ে দিল প্রভাতের বাপ মা।বিয়ের পর প্রভাত যেন পাল্টেই গেল।বেশ
সংসার করল।বছর ঘুরতেই ছেলে হল। প্রভাত চটকলে ক্যশিয়ারের চাকরীটাও মন
দিয়ে করছিল।ছেলে যখন দুবছরের বৌ এর আবার ছেলেপুলে হবে,বাড়ির লোকের ভয়
যখন কেটে গেছে প্রভাতকে নিয়ে ঠিক তখনই একদিন প্রভাত হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ
হল।অনেক খোঁজাখুঁজি করা হল।প্রায় বছরখানেক চোখের জল ফেলল মালা।প্রভাতের
মা সেই যে বিছানা নিলেন আর উঠলেন না। প্রভাত চলে যাবার কয়মাস পর মালার
মেয়ে হল।প্রভাতের চলে যাওয়া নিয়ে মালাকে কেউ দোষারোপ করেনি,বা কথাও
শোনায় নি।বরং মালার বাবা আক্ষেপ করেছিলেন ছেলে সন্ন্যাসী ধরনের জেনেও
বন্ধুর অনুরোধে সোনার প্রতিমা মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য। কত বয়েস মালার?
এখনো কুড়ি পেরোয়নি মালা। মালা কিন্তু কোনদিনও কাউকে দোষারোপ করেনি। সে
সবটাই নিজের ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছিল।আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সবাই
ভিতরে ভিতরে ভয় পেয়েছিল,কাঁচা বয়েস এমন রূপ, কি জানি এই মেয়ে কোন অনর্থ
না ঘটায়। কিন্তু সবাইকে অবাক করে মালা সংযম তিতিক্ষা কাকে বলে দেখিয়ে
দিল। শ্বাশুড়ি শ্বশুরের সেবা, ছেলে মেয়ে মানুষ করা তার জীবনের
ব্রত।প্রভাতের বাবার টাকাকড়ি ভালোই ছিল। তাই খাওয়া পরার চিন্তা করতে
হয়নি মালাকে। মালাকে মেয়ে হবার পর আর কেউ কখন কাঁদতে দেখেনি। তবে
প্রভাতের উপর যে একটা জমা অভিমান আছে সেটা বোঝা যেত।প্রভাত চলে যাবার
পর বিশেষ করে মৌ হবার পরই নিজের সাজগোজ বেশ পাল্টে ফেলেছিল মালা। আগে
সিঁথি ভরে সিঁদুর পরত, কপালে সূর্যের মত লাল টিপ। বিয়েতে পাওয়া বেশীর
ভাগ শাড়ী ছিল লাল ঘেঁষা। পায়ে নুপূর ছিল।সিঁদুর পরা সে ছাড়ে নি। কিন্তু
তা আগের থেকে সরু হয়ে যায়।লাল সিঁদুরের টিপের জায়গা নেয় খয়েরিটে আঠা
দেওয়া টিপ। নুপূর যেন কবে আর বাজে না।
একটু বড় হতে ছেলে মেয়েরাও বোঝে মায়ের কষ্ট। তাদের মা তাদের দেবী। ছেলে
শুভের মনে হয় মায়ের যেন একটা আলাদা ক্ষমতা আছে,একটা আলাদা তেজ আছে।নইলে
এত নির্বিকার মুখে এত দু:খ সয়ে কি করে দশভূজার মত সব সামলায়? মৌ জানে
তার মাএর দৃঢ় চরিত্রের কথা। পাড়ার কাকীমা জ্যেঠিমারা কেউ যখন
বলেন-"মালা একটা ভালো ঠাকুরবাড়ি আছে। একবার চল, এমন জল পড়ে দেয় দেখবে
প্রভাত যেখানেই থাকুক,তোমার পায়ে এসে পরবে।"
মা তখন চোয়াল শক্ত করে বলেন-"আমি ওসবে বিশ্বাস করি না।"
পাড়ায় নিন্দে হয়।।কিন্তু মৌএর চোখে মা আর শুধু মা থাকে না।দেবী হয়ে
ওঠে।সত্যি তো লোকটা যখন ছেড়ে যেতে পেরেছে হ্যাংলার মত তাকে ফিরিয়ে আনতে
তাবিজ কবজ করতে হবে? ছি:... প্রভাত চলে যাওয়ার বারো বছর পর পাড়ার
ঠাকুরমশাইএর থেকে বিধান নিয়ে মালা বৈধব্য নেয়।এই বারো বছরে শ্বাশুড়ী
শ্বশুর চলে গেছেন।মালার কচি মুখে বয়সের ভার এসেছে।কিন্তু তা তাকে আরো
সুন্দর করেছে। এনেছে স্মিত ব্যাক্তিত্ব।
শুভ এখন হায়ার সেকেন্ডারি । আর মৌ মাধ্যমিক। শুভের ইচ্ছে করে মায়ের
জন্য পৃথিবীর সব সুখ সে কিনে আনে।
এমনই একদিন দুপুরে ফিরে আসে প্রভাত।মুখের এতটুকু পরিবর্তন হয়নি তার।
শুধু রগের কটা চুলে রুপোলী আভা। পাড়ার লোকের চিনতে অসুবিধা হয় না।
প্রভাতকে দেখে বহুক্ষণ দরজায় স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকে মালা। নরম গলায়
প্রভাত বলে -"মালা তোমার অপরাধী স্বামীকে দরজা থাকেই ফিরিয়ে দেবে?
ভিতরে ঢুকতে দেবে না?" মালা বলে-"এসো।"
তারপর বন্ধ দরজার ওপারে কি কথা হয় জানা নেই।কেউ কেউ কান্নার শব্দ
পায়।কুড়ি বছরের জমা বরফ অভিমান গলেছিল হয়ত। শোনা যায় প্রভাত জাহাজে কাজ
নিয়েছিল। যার সূত্রে কাজ পায় সে বলেছিল আটমাস জলে আর দুমাস স্থলে কাজ।
প্রচুর টাকা। দেশ দেখার সুযোগ।লোভে পরে গিয়েছিল প্রভাত। বাড়িতে বললে
যেতে দিত না। তাই না বলেই গিয়েছিল। ভেবেছিল দশমাস পর এসে সব জানাবে।
কিন্তু ওই জাহাজে নেশার জিনিষ চালান হচ্ছিল। বন্দরে তা ধরা
পরে।চালানকারী ঠিক কায়দা করে পার পেয়ে যায়। ফেঁসে যায় প্রভাতরা।
হাজতবাস হয় তার । তারপর ছাড়া পেয়ে একটু একটু করে কাজ করে টাকা জমিয়ে
কাগজপত্র তৈরী করিয়ে সে ফিরতে পেরেছে।
পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন একবাক্যে স্বীকার করে যে এ শুধু মালার
সতীত্ব আর তার তপস্যার পুন্যফল। রাতে ছেলে মেয়ে বাড়ি ফিরে স্তম্ভিত হয়ে
যায়।খুশী হয় বলা যায় না।কেমন যেন অস্বস্তিতে পরে। মৌএর কেমন একটা
বিদ্বেষ বোধ হয়। এই লোকটা তার আগমন বার্তা জেনেও দায়িত্ব এড়িয়ে
পালিয়েছিল। প্রভাত কিন্তু মেয়েকে দেখে চোখের জল রাখতে পারে না। মালাকে
পাড়ার সেন দিদা আগেই বৈধব্যবেশ ছাড়িয়ে সধবার সাজ সাজিয়েছিলেন।শুভর বড়
চোখে লাগে।এত চওড়া করে সিঁদুর পরার কি ছিল?এতদিন শুভ বাইরের ছোট ঘরে
শুত। ভিতরের ঘরে শুতো মৌ মায়ের সাথে।আজ দেখল মা ঠাকুমা ঠাকুরদার ঘরটা
পরিষ্কার করেছে।শুভ আশা করেছিল আগন্তুক লোকটা সেখানে শোবে। কিন্তু অবাক
হয়ে দেখল মালা মৌএর পড়ার আর শোবার ব্যবস্থা করেছে সেখানে।কেমন একটা
বিচ্ছিরি অনুভূতি হয়। মা মৌকে যেন কৈফিয়েত দেয়, "অনেকদিন ধরে বলছিলি
পড়ার ঘর চাই পড়ার ঘর চাই। নে গুছিয়ে দিলুম।"
মৌ সত্যি ঠাম্মার ঘরটায় থাকার জন্য বায়না করছিল কিছুদিন হল। কিন্তু আজ
নিজের একার ঘরের স্বাধীনতা পেয়েও কেমন যেন তেতো হয়ে রইল মনটা। মাকে যেন
কেমন অচেনা অচেনা লাগে শুভদের।
পাড়া প্রতিবেশী কিন্তু বেজায় খুশী হয়।তারা ঠাট্টা তামাশা করে। যে মা
কঠিন চোয়ালে উত্তর দিত, তাকে খুঁজে পায় না মৌ। মৌ দুপুরে কোচিঙ থেকে
তাড়াতাড়ি ফিরল সেদিন।বেল বাজিয়ে যাচ্ছে। কেউ দরজা খোলে না।প্রায় মিনিট
পাঁচেক পর মা এসে দরজা খোলে। চুল উস্কোখুস্কো।কপালে সিঁদুর ঘেঁটে আছে।
শাড়ী অগোছালো। মৌ নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে। মা নিশ্চয় ঘুমিয়ে গিয়েছিল।
তাই এমন অগোছালো হয়ে আছে। তাই হয়ত বেলের শব্দ শুনতে পায় নি। কিন্তু
ভিতরে ভিতরে কেমন একটা অশ্লীল অনুভূতি হয়।কেন জানি না মৌ এর ইচ্ছে করে
না মায়ের মুখের দিকে তাকাতে। পলি পিসি বিকেলে একটা ডিজাইন সেলাই তুলতে
এসে ঠাট্টা করে বলে-"কি গো কি ব্যাপার? নাকে যে সিঁদুর মাখামাখি।প্রভাত
দাদা কি বিশ বছরের ভালোবাসা একদিনেই পুরণ করে দেবে?"
মৌ ভাবে মায়ের চোয়াল হয়ত শক্ত হবে।কিন্তু না তো! মা তো দিব্বি হাসছে
লাজুক মুখে।শুভ বই থেকে চোখ না তুলেও বুঝতে পারে মায়ের চিরচেনা মুখটা
অচেনা দেখাচ্ছে।শুভ নিজেকে অনেক সমালোচনা করে। কেন সে বিরক্ত হচ্ছে।তার
জন্ম দুখিনী মা এখন যদি নিজের স্বামীর সাথেই সুখী হয় তাতে তার খারাপ
লাগছে কেন?সে তো চেয়েছিল তার মায়ের জন্য সারা পৃথিবীর সুখ কিনতে। কেন
এমন ঘৃণ্য অনুভূতি হয়। মৌ অনুভূতিকে বিশ্লেষণ করতে পারে না শুভর মত।
কিন্তু এটা বোঝে তার শ্বেত শুভ্র স্মিত হাস্যমুখ ব্যক্তিত্বের
অধিকারিনী মা যেন আর নেই।যে আছে সে মানবী। রক্ত মাংস আশা আকাঙ্ক্ষা
নিয়ে তৈরী মানবী। তার দেবী নয়। শ্রদ্ধাটা যে কবে কেন কখন করুণা হয়ে
গেছে সেটা সে নিজেও বোঝে না।।
প্রভু, আছো?
✍ সাইদুজ্জামান
দু'সপ্তাহ আগের কথা। কড়া রোদে পার্ক করা গাড়িতে
উঠতে গিয়েও পিছিয়ে গেলাম। উচ্চতায় আর বাড়ছি না বটে, তবে কোমরের মাপটা
ঠিক বাড়ছে। বাইরে থেকে অতটা বোঝা যায় না, ভুঁড়ো এক বুড়ো এখনো মনে হয় না
বটে, তবু দু'আঙুলে পেটে চিমটি কেটে বুঝতে পারি একটু হাঁটাহাঁটি করাই
ভালো।
মাথায় পরেছি আমার টমি হিলফিগার হ্যাট, গায়ে রঙিন টিশার্ট, জিন্স, পায়ে
স্নিকার্স। এইতো সেদিন লিখেছিলাম 'টেন গ্লেন এভারেস্ট রোড' নামে একটি
ছোট গল্প। টেন গ্লেন এভারেস্ট রোডে আমার সহকর্মী নন্দিতা থাকে। ইচ্ছে
তারই সাথে দেখা করার।
পায়ে চলা পথে হেঁটে গেলে মিনিট পনেরোর পথ। লম্বা পায়ে হাঁটলে মিনিট
দশেক। টরন্টো বেশ পরিচ্ছন্ন শহরই বলতে হয়। এখানে রাস্তায় খানাখন্দ নেই,
ফুটপাতে সিগারেটের বাট পড়ে থাকে না। রাস্তার দুপাশে গাছগুলোর পাতা এখনো
সবুজ। নীল আকাশে এক ঝাঁক পাখিও উড়ে গেলো। দোতলা বাড়িগুলোর ফ্রন্ট
ইয়ার্ডে রাশ রাশ ফুল। দেখতে দেখতে এসে পড়েছি গ্লেন এভারেস্ট রোডে। এ
রাস্তা ধরে একটু হাঁটলেই ডাউন হিল। হাঁটা তো নয়, ছোটা। ছুটতে ছুটতে এসে
পড়লাম টেন গ্লেন এভারেস্ট রোড। দুপুর প্রায় হয়ে এসেছে। এন্ট্রিওয়ের
সিঁড়িতে বেশ কয়েকজন বসে আছে, আড্ডা দিচ্ছে ভেবেছি। র্যাম্প ধরেই লবিতে
ঢুকেছি। ইন্টারকমের ঠিক সামনে যে কাচে ঘেরা ছয় ফুট বাই ছয়ফুট মেঝে
সেখানে দেখলে মনে হয় কে যেন এক বালতি লাল রং ঢেলে দিয়েছে, ভাবলাম মদের
বোতল ভেঙেও এরকম হতে পারে। আমার জুতোর তলা ভিজে লাল।যে দরজা দিয়ে আমি
ঢুকেছি সেটা আমার পিছনে, সামনে আরেকটা বদ্ধ দরজা। দুটোই কাচের। আমি
বহিরাগত ভেবেই বোধ হয় লম্বা চওড়া এক ভদ্রলোক তাঁর কী-ফব হাতে ওই রঙের
উপর দিয়ে ছপ-ছপ করে হেঁটে এসে ভেস্টিবুলের দরজাটা খুলে দিলেন। আমি হেসে
ধন্যবাদ জানালাম। ভদ্রলোক হাসলেন না। ভেতরে সবে পা ফেলেছি, আমার দু হাত
দূরে মেঝেয় গোঙাচ্ছে বছর আটত্রিশের এক কৃষ্ণাঙ্গ, সি পি আর করছেন
শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার। আমার পা আটকে গেলো। নড়তে পারছি না। দাঁড়িয়ে
আছি। অফিসার খুব মনোবল দিয়ে চলেছেন - "ইউ আর গনা বি ওকে - ইউ আর গনা বি
ওকে। ........." কতক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠিক মনে করতে পারছি না। অন্য
একজন অফিসার এসে আমাকে ওখান থেকে চলে যেতে বললেন। এলিভেটরে আমার সাথে
উঠলেন এক শ্বেতাঙ্গিনী ভদ্র মহিলা। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, " জানেন
কিছু, কী হয়েছে লোকটার?" উত্তরে তিনি বললেন তিনি জানেন না এবং জানতেও
চান না। আমি বললাম লোকটি অনেক রক্ত হারিয়েছে - বাঁচবে তো? এতো রক্ত আমি
জীবনে দেখিনি। আমার হিসেবে বাঁচার কথা নয়। পরে খবরের কাগজে দেখেছি
লোকটি বাঁচেননি। আজ খবরের কাগজে দেখলাম খুনী ধরা পড়েছে। নাম ও ছবিও
ছাপা হয়েছে।২০২২ সালে টরন্টো শহরে এটা ৪৩ তম হত্যাকান্ড।
টরন্টো, ৩রা সেপ্টেম্বর ২০২২
বিচার ( অন্য রহস্য)
রত্না চক্রবর্তী
১৪.৯.২২
এই ঘটনাটা একটু অন্য ধরনের ঘটনা।আমার অতি পরিচিত মামনি বলে একটি মেয়ের
ঘটনা এটি। কিন্তু এতদিন অন্য রহস্য যে ঘটনাগুলো বলে এসেছি তার মধ্যে
ঠাকুরের অপার করুণার কথাই বলেছি। এই গল্পটার মধ্যে ঠাকুরের যেন একটা
বিচারের আমি আভাস পাই। জানিনা কেমন লাগবে আপনাদের। কিন্তু আমার মনে
হয়েছিল যে ঈশ্বর সঠিক বিচার করেন। ভগবান ভক্তের কষ্ট বোঝেন।
আমার পরিচিত মামনি বলে একটি মেয়ের কথা। মেয়েটি তার বাবা-মার খুব আদরে
ছিল কিন্তু বিয়ের পরে তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। কিছুদিন শ্বশুর
বাড়ি ছিল। শ্বশুর বুকে করে আগলে রেখেছিলেন। তারপর শ্বশুর মারা গেলেন।
শ্বাশুড়ি খুব খারাপ ব্যবহার করতেন,তা তিনি ও মেয়ের বাড়ি চলে গেলেন।
তখন মেয়েটি বাপের বাড়ি ফেরত আসে। মা-বাবারও মনোকষ্টে কষ্টে শরীর ভেঙে
গিয়েছিল। তারা এক ভাই এক বোন। বাবা বেঁচে থাকতে থাকতে সম্পত্তি মেয়ে
আর ছেলের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। মেয়ে এখন আর চাকরি বাকরি করতে পারবে
না, তেমন পড়াশোনায় মেধাবী ছিল না। বাবার বাড়িটা ছোটই তবু ভালো
জায়গায়। মাথা গোঁজার ঠাঁইটা থাকল। সেলাইফোঁড়াই করেই হোক বা দুটো বাচ্চা
পড়িয়েই হোক একটা মানুষের পেট চলে যাবে। ছেলে দিদির দায়িত্ব নেবে না আর
তিনি সেটা ছেলের উপর চাপাবেন ও না। সেটা অন্যায় হবে। তবে যাতে ভবিষ্যতে
ঝগড়াঝাটি অশান্তি ভাইবোনে না হয় তাই ব্যবস্থা করে দিলেন। পাশাপাশি
থাকবে তবে আলাদা আলাদা। ভাব থাকলে ভালো, না থাকলেও ক্ষতি নেই।
বাড়িটা খুব ভালো জায়গায় কাজেই যদি পেইংগেস্ট রাখে তাহলে একটা পেট
ভালোমতোই চলে যাবে। কোন মহিলা নার্স বা স্কুল কলেজে পড়ে এমন মেয়ে তো
কলকাতা শহরে কতই আসে। তাই জন্য ভাগের ব্যবস্থা তিনি তাড়াতাড়ি করে
দিলেন। অবশ্য খুব ভালোই করেছিলেন। এক বছরের মাথায় স্বামী-স্ত্রী পর পর
মারা গেলেন। মেয়েটা একা হয়ে গেল। যাই হোক কাজকর্ম নিয়ে মোটামুটি চলে
গেল আশপাশে দু-একটা বাড়ি খুব ছোট বাচ্চাদের পড়াতো। মামনি খুব একটা
রাস্তাঘাটে একা যাতায়াত করতে পারত, না, একা একা দূরে যেতে পারত না।
তাই আত্মীয়স্বজনের বাড়ি নিজে যেত না, আর পাছে কোন দায়দায়িত্ব নিতে হয়
বা ঘাড়ে এসে পড়ে তাই কেউ বিশেষ খোঁজখবরও নিত না। ওই ফোনে যোগাযোগ।
বাবা মা তো মামনির জন্য ভালো ব্যবস্থাই করে গেলেন কিন্তু মামনির
ভাইয়ের বউয়ের ভীষণ রাগ হল। নিঃসন্তান মধ্যবয়সী ননদ ছিল বাড়িতে
থাকতো, আর যখন থাকবে না তখন তো তারাই পুরো সম্পত্তিটা পেত। এই যে আলাদা
করে দিয়ে গেল এখন ইচ্ছা হলে তো অন্য কাউকে দিয়ে দিতে পারে! বলা
যায়না তখন হয়তো আত্মীয়স্বজন কেউ এসে শেষ বয়সে তাকে বেশি দেখাশোনা করে
আদর আহ্লাদ করে সম্পত্তি ভুগিয়ে নিল। সে ভারি বিরক্ত ছিল এই
ব্যবস্থায়। সে ভাইকেও বোঝালো যে তার বাবা ছেলেকে বিশ্বাস বা ভরসা
করলেন না। দিদিই কায়দা করে সম্পত্তি ভাগাভাগি করিয়ে নিল।
ভাইবৌয়ের সম্পত্তির আশা ছিল অথচ মেলামেশাটা সেভাবে করত না। পাছে কোন
কারণে ঘাড়ে এসে পড়ে, বিপদে-আপদে দেখতে হয় সেই ভয়ে এড়িয়ে চলত। তাই ভাই
বোনের মেলামেশাটা নানা রকম অশান্তি করে প্রায় বন্ধ করে দিল। অবশ্য ভাই
তার বৌকে সাপোর্ট করতো বলেই তার পক্ষে সম্ভব হল। ওই প্রতিবেশীর মতোই
কথাবার্তাটা ছিল,মুখোমুখি ঝগড়া অশান্তি ছিল না, উপর উপর দিনান্তে দুটো
কথা তাও মামনি টিভি সিরিয়াল নিয়েই গল্প করত যাতে কোন স্বার্থ সংক্রান্ত
ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা, লাগালাগি অশান্তি না হয়। আর দেওয়ানেওয়াটা ছিল না।
বউ বাপের বাড়ি গেলে কখনও কখনও চাবিটা দিয়ে যেত মামনির কাছে।কাজের লোক
এসে ঘরদোর পরিষ্কার করবে বলে কিংবা গ্যাস এলে নিয়ে নেওয়ার জন্য। এই
ধরনের সম্পর্কটা টুকিটাকি ছিল মুখে কোন ঝগড়াঝাটি ছিল না। মামনি এমনিতে
তার মার মতো খুব ঠাকুর ভক্ত ছিল। তার খুব ইচ্ছে ছিল তারকেশ্বরে বেড়াতে
যাবে। অনেককাল ধরে তার মনোগত ইচ্ছা। তার মাও বলতেন তারকেশ্বরে যাবেন
একবার গিয়েছিল ছোটবেলায়, মা কি একটা মানত করে এসেছিলেন। পরে আর
যাওয়া হয়ে ওঠেনি। মা তো মরে গেছে, মার সেই মানতের পূজো দেওয়া হয় নি।
তাই খুব ইচ্ছে মামনির তারকেশ্বরে যায়, সে পাড়ার মধ্যে ছাড়া কোথাও যায়
না। একা যাবে কি করে? এমন সময় কানে এলো ভাই বৌ আলোচনা করছে তারা
তারকেশ্বর যাবে। ভাইয়ের শালীও সঙ্গে যাবে। ওরা গেলে তো গাড়ি ভাড়া করেই
যাবে। মামনি বড় একটা ভীড় গাড়িতে, বাসে চড়তে পারে না। তাই তার এই ফাঁকে
যাওয়া হয়ে যাবে। তারকনাথ দর্শন হয়ে যাবে।
জীবনে এই প্রথম মামনি ভাইকে ধরে পড়ল। ভাইকে বলল, " দেখ আমার অনেক দিনের
ইচ্ছে ছিল যাবার, মার সেই মানতের পুজোটাও দিয়ে আসব, মার আত্মা শান্তি
পাবে। তোরা তো যাচ্ছিস আমায় সঙ্গে নিয়ে চল। আমি যাব দর্শন করে আবার
তোদের সাথে ফিরে আসবো। এমন সুযোগ বার বার হয় না ভগবানের টান, নিয়ে চল
ভাই। " কিন্তু ভাইয়ের বৌয়ের সে কথা পছন্দ হলো না। এই ছুতোয় ভাই বোনের
বেশি মেলামেশায় যদি বোনের উপর ভাইয়ের আবার টান পড়ে যায় সেই চিন্তায় সে
অস্থির। প্রথমে এককথায় ভাই কিন্তু রাজি হয়ে গিয়েছিল। "তা গাড়িতে
জায়গা আছে তুই গেলে আর অসুবিধেটা কি? তাহলে চল। আমরা যাবো সোমবার।
বাবার পূজো সোমবারেই হয়। "
যেতে এখনও দু চার দিন দেরি আছে। মামনি সব গুছাতে লাগল পৈতে কিনে আনল,
একখানা নতুন গামছা বার করল, বাকি জিনিসপত্র সেখান থেকে কিনে নেবে। তার
খুব আনন্দ দুচার জন পাড়া-পড়শিকে বলেও রাখল যে এবার তারকেশ্বর যাওয়া
হচ্ছে। তার পরের দিনই তার ভাইয়ের বউ বলল যে, "আমরা তো বাসে যাচ্ছি।
তোমার অসুবিধা হবে নাতো? তোমার তো আবার বাসে বমি হয়। "
অবাক হয়ে গেল মামনি কথাটা শুনে। এরা বাসে কোথাও যায় না। কদিন আগে ওরা
নিকো পার্ক গেল গাড়ি বুক করে। ভাইবৌয়ের বোনের বাড়ি গেল গাড়ি করে আর এখন
বাসে যাবে বলছে!
মামনি কেমন ভয় পেয়ে গেল। সত্যি যদি শরীর খারাপ লাগে। আন্তরিকতা এত
কমে গেছে যে ভারি পর পর লাগে, যদি তার জন্য কারো যদি অসুবিধা হয় খুব
অস্বস্তিতে পড়বে। আবার ভাবল এই সুযোগ আর পাবে না মোড়ের মাথায় ওষুধের
দোকান থেকে এভোমিন বা অন্যকোন বমির ওষুধ কিনে নেবে। একটা খেয়ে যাবে
যদি ওখানে অসুবিধা হয় তাহলে ফেরার সময় একটা খাবে। তাই বলল, " আচ্ছা
আমি ওষুধ খেয়ে যাব তোমার চিন্তা নেই। "
মনে মনে অবশ্য খুবই দুশ্চিন্তায় রইল বমির ওষুধ খেলে তার বড় ঘুম পায়।
তার পরদিন ভাইয়ের বউ ডেকে বলল," দেখ আমরা তো যাদবপুর থেকে যাব, তুমি
যদি যাও, যাদবপুরে আমার বোনের বাড়ি পৌঁছে যেও , ওখান থেকেই যাব সবাই।
আমরা আজই চলে যাচ্ছি। পরশু ওখান থেকেই আমার বোনকে নিয়ে বেরিয়ে যাব।"
অবাক হয়ে গেল মামনি সে তার ভাইয়ের শালীর বাড়ি কখনো যায়নি। তাই যদি
যেতে পারবে তো একাই চলে যেতে পারত দক্ষিণেশ্বর, তারকেশ্বর যেখানে মন
চায়। আর এটা তো সবাই জানে। তবে এভাবে বলার মানে কি? এবার সে বুঝতে পারল
সে যাতে না যায় তাই জন্যেই এই ব্যবস্থা করা। প্রথমে বাসে করে যাওয়া
প্ল্যান, তারপর দুদিন আগে বোনের বাড়ি চলে যাওয়া তার যাওয়াটা বন্ধ
করার জন্য। সে খুবই লজ্জায় সংকোচে পড়ে গেল। সে মুখে কিছু বলল না
পাশাপাশি থাকে অশান্তি করা যায় না।
ভাইও যখন শালীর বাড়ি যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে তখন হাসিমুখেই মামনি
ভাইকে বলল," যা রে তোরা সাবধানে ঘুরে আয়, আমার শরীরটা খারাপ খারাপ
লাগছে, পূর্ণিমা সামনে শরীর রসস্থ হয়েছে, পা ফেলে হাঁটতেই পারছি না,
আমার যাওয়া হবে না। বাবা তারকনাথ না টানলে দর্শন হয় না। "
ভাই ঈষৎ প্রসন্নমুখে বলল," হ্যাঁ আমরা বাসে যাব, তোর অসুবিধাই হত। "
মামনি আঁচলের গেট খুলে এগারো টাকা বার করে ভাইয়ের সামনে রেখে বললো কোন
কিছু কিনে কেটে দিতে হবে না এটা মন্দিরের কোন পান্ডাকে দিয়ে দিস অথবা
ঠাকুরের সামনের বাক্স ফেলে দিস বলিস মনে মনে আমার দিদির পুজো নাও বাবা।
তাহলেই হবে। "
ভাই হাসিমুখেই ঘাড় নেড়ে সায় দিল। তার মনে একটা বোঝা ছিল সেটা কেটে
গেছে, সে স্বস্তি পেয়েছে। এই নিয়ে কোনো অশান্তি করতে হবেনা ভাইয়ের বউ
অন্তত খুশি হবে। ওরা কিন্তু তখন আর গেল না সন্ধের দিকে ওরা রওনা দিলো।
জানলায় দাঁড়িয়ে মামনি দেখতে পেল একটা ট্যাক্সি ডেকে ওরা বোনের বাড়ি
গেল। মামনি দুর্গা দুর্গা বলল যেন কারো কোনো ক্ষতি না হয়। কিন্তু বুক
থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। যাওয়ার ইচ্ছে ছিল সে গেলে এমন
কি ক্ষতি হতো! যাইহোক জানে যখন পছন্দ করে না তার বলাটাই ভুল হয়েছে।
ওরা মঙ্গলবার দিন ফিরে এলো দুপুর দুপুর। পাড়ার প্রায় সবাই মামনিকে
ভালোবাসত। অনেককাল আছে এখানে। ভাইয়ের অবস্থা খুব ভালো,তাই ভাইয়ের বৌয়ের
সাথে সবাই হাসিমুখে কথা বললেও মামনির সাথে ওদের ব্যবহারটার
কথা জানত। মামনি অবশ্য কখনও বলে নি। পাশের বাড়ির পিসিমার সাথে
রাস্তায় দেখা হতে তিনি মামনিকে গল্প করে বললেন, " দেখ দেখি কান্ড!
কপালে না থাকলে দেবদর্শন হয় না। তুই গেলি না শরীর খারাপ বলে আর ওরা
গিয়েও দর্শন পায় নি। গাড়ি করে গিয়েছিল, মাঝপথে গাড়ি খারাপ হয়ে যায়। সে
এক বিপত্তি। সেখান থেকে রিক্সা করে স্টেশন গেছে। তারপর ভীড়ে গাদাগাদি
করে মাঝপথ থেকে ট্রেনে উঠে পৌঁছেচে। কিন্তু এত শরীর খারাপ লাগছে তখন
ভীড়ে ওই মস্ত লাইন ঠেলে পূজো দিতে পারে নিন। দর্শনও হয় নি। শেষে এক
পান্ডা ঠাকুরের হাতে ডালা দিয়ে আর দক্ষিণা দিয়ে পূজো দিয়ে দিতে বলে।
ফেরার সময়ও খুব কষ্ট হয়েছে হাওড়া অবধি আসতে। ট্রেনে গন্ডগোল ছিল,
প্রচন্ড ভীড়। ওদের তো আবার গাড়িতেই যাওয়া অভ্যেস। হাওড়া থেকে অবশ্য
ট্যাক্সি নিয়ে শান্তিতেই ফেরে। তাই তো বলি ঠাকুর না টানলে দেখা হয় না
রে। "
মামনির সঙ্গে আমার আত্মার আত্মীয়তা। মামনির যেতে না পারার ব্যথাটা আমি
নিজের হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলাম। পিসিমা রাস্তায় দাঁড়িয়েই মামনির সাথে
গল্প করছিলেন। আমি সবটাই শুনলাম। আমার মনে হল একজন ভক্তের আকাঙখাকে অমন
ভাবে পায়ে দলে চলে যাবার জন্যই বাবা দর্শন দেন নি।
আর আশ্চর্য সেদিনই আমার বাড়ির কাজের দিদি কিন্তু তারকেশ্বর গিয়েছিল, সে
স্নান করেছে, পূজো দিয়েছে,দর্শন করেছে আমার জন্য প্রসাদও এনেছে। আমি
মামনিকে প্রসাদ দিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছে এ বাবার বিচার, তারও বুঝি
ভক্তের অপমান বুকে বেজেছে।।