- প্রণব ভট্টাচার্য
যখন একা থাকি একা ভাবি, একা একা লিখি; একা পড়ি তখন নিজেকে খুব জ্ঞানী মনে
হয় আমার। এতদ্কারণে কিছুটা অহঙ্কার-ও গ্রাস করে।
যখন কোনো সূত্রে প্রকৃত বিদ্বান ও জ্ঞানী মানুষের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ আসে
,আলাপ-আড্ডার সুযোগ হয়; বুঝতে পারি নিজের অপরিসীম সীমাবদ্ধতা। জ্ঞানী
বিদ্বান বন্ধুদের তুলনায় স্বীয় জানা-বোঝার পরিধির ক্ষুদ্রতায় সংকোচে
বিহ্বল হয়ে পড়ি। তখন অনুশোচনায় নিজেকে দগ্ধ হতে হয় এই ভেবে যে ---
পড়াশোনা জ্ঞান চর্চার অনেক সুযোগ কেন সময়ে হেলায় হারিয়েছি! এই আফসোস
যাওয়ার নয়।
গতকাল 'কার্তিকের কুয়াশা' আয়োজিত একটি ওয়েব আড্ডায় যোগ দেওয়ার সুযোগ
হয়েছিল।
২০০৬ সাল থেকে চলে আসা ওয়েব পেজটি পরিচালিত হয় কানাডা থেকে। প্রত্যেক
মাসের শেষ রোববার সাহিত্য আলোচনার আসর বসে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
থাকা বাংলা ভাষায় কথা বলেন, গল্প কবিতা প্রবন্ধ লিখেন, সর্বোপরি বাংলা
ভাষা নিয়ে ভাবেন বাংলা ভাষায় আড্ডা দিতে ভালবাসেন এমন সব গুণী মানুষজন
ভার্চুয়ালি মিলিত হন এই ওয়েব পেজে।
ভাগ্যক্রমে আমারও ইনভাইট এসেছিল কানাডার অন্টারিও প্রবাসী প্রিয় বন্ধু ড.
Saiduz Zaman চঞ্চল-এর তরফ থেকে কয়েক দিন আগে। ইতোমধ্যে বার কয়েক তিনি
রোববারের আড্ডার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
আমার কাছে অপরিজ্ঞাত আধুনিক প্রযুক্তির অনেক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে আড্ডার
আসরে প্রবেশ করা আর জলে প্রতিবিম্ব দেখে আকাশে রক্ষিত মৎস্য চক্ষুবিদ্ধ
করার মতো দুরূহ ছিল।
অনেক টেপাটিপির পর আড্ডায় প্রবেশ করা গেল যদিও; প্রাযুক্তিক দৈন্যদশা
পুরোপুরি জয় অধরা থেকে গেল। ছবি আসে তো কথা হয় না। কথা শোনা যায় তো ছবি
আসে না। লক্ষ্মী-সররস্বতী দুই বোনের মতো, দৃশ্য-শ্রাব্য দুটোকে একসঙ্গে জয়
করা অসম্ভব বুঝে শ্রবণ-সরস্বতীকে বেছে নিতে বাধ্য হলাম।
জীবনের সকল ক্ষেত্রের মতো এক্ষেত্রেও দৃশ্য-লক্ষ্মীর কৃপা বঞ্চিত হয়ে
প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে শুনলাম; ঢাকা থেকে আড্ডায় অংশগ্রহণকারী বিশিষ্ট কবি
ও কথা সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয়া ফিরোজা হারুন-এর অনবদ্য আলোচনা।
অন্যদিকে টরন্টোর নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে সূত্রধর ছিলেন প্রিয় বন্ধু
সাইদুজ্জামান চঞ্চল।
চার চারটি দশক ঢাকার বাইরে তিনি। তৎকালীন সোভিয়েত ও পরবর্তীতে কানাডা ও
আমেরিকা থেকে স্থাপত্য-প্রকৌশলে পিএইচডি ডিগ্রিধারী এই মানুষটি চল্লিশ বছর
তাঁর মাতৃপিতৃভূমি ছেড়ে প্রবাস-জীবন কাটালেও মাতৃভাষার জন্য বিনম্র
ভালোবাসা দেখে-শুনে অবাক হলাম।
আলোচনা ছিল বিচিত্র ও বহুমুখী।
নজরুল থেকে তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি থেকে ম্যাক্সিম গোর্কি, ঘুরে ফিরে আসছিল
রুশ ও জার্মান ভাষায় সংস্কৃত ভাষার প্রভাব সম্পর্কে। এই বিষয়ে মি.
সাইদুজ্জামান চঞ্চল একজন বিশেষজ্ঞ। হওয়ারই কথা। ইংরেজি বাংলা ও সংস্কৃত
জানা একজন বাঙালি চল্লিশ বছর রুশ ভাষার মধ্যে থাকলে সেই ভাষার মধ্যে তাঁর
মাতৃভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত সংস্কৃত শব্দের বহুল ব্যবহার ও তার সুরভী খুঁজে
পেয়ে চমৎকৃত হবেন; সেটাই তো স্বাভাবিক। তাঁর অসাধারণ সঞ্চালনায় তা বোঝা
যাচ্ছিল পরিষ্কার।
আড্ডায় ফিরে ফিরে আসছিল বাংলাদেশর জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলামের
প্রসঙ্গ।
আসছিল নজরুলের প্রেমেরগান-গজল-শ্যামাসঙ্গীত-ইসলামি-গানের কথা। ভাঙার গান ,
সাম্যবাদী নজরুলের মানসপটে হিন্দু মুসলিম ঐক্য ও মিলনের একই দেহে দুটি
ধারাকে তনুমন মস্তিষ্কে ধারণ করার অনন্য কীর্তি নজরুলের বৈশিষ্ট্য, এই
বিষয়ে ভারি চমৎকার আলোচনা করলেন কবি ফিরোজা হারুন আমি অবাক বিস্ময়ে শুধু
শুনে গেলাম-- ফিরোজা ম্যাডামের সুভাষিতাবলি।
যতক্ষণে আমার বলার পালা এলো ততক্ষণে আমি ম্যাডামের পাণ্ডিত্যে এবং
সাইদুজ্জামান চঞ্চলের বহুমাত্রিক দার্শনিক দক্ষতার পরিচয় পেয়ে বিমূঢ়
নির্বাক।
আজ প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি, মিলনের কবি মানবতার কবি সাম্যের কবি কাজী
নজরুল ইসলামের ৪৬তম প্রয়াণ দিবস।
তাঁর চলে যাওয়ার দিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে কিছু লিখব বলে একসপ্তাহ ধরে
তথ্যপঞ্জি ও বইপুস্তক সংগ্রহ করছিলাম। ভেবেছিলাম ভালোভাবে পড়াশোনা করে
একটি পোস্ট করব। প্রয়াণ দিবসে সেটাই হবে কবির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন।
অথচ নানা ব্যস্ততায় অসমাপ্ত থেকে গিয়েছে লেখাটি।
লেখাটি শেষ করার আগেই চলে এসেছে উপমহাদেশের কাব্যের আকাশ থেকে নজরুল নামের
মহানক্ষত্রের খসে পড়ার সেই দিন----
রণক্লান্ত চির বিদ্রোহীর চিরতরে থেমে যাওয়ার ৪৬তম বর্ষ ।
এই অবেলায় আর কিছু লেখার সময় নেই । অতএব, গতরাতে 'কার্তিকের কুয়াশা'
ওয়েব পেজ আড্ডায় শোনা আলোচনাটি লিখতে চেষ্টা করলাম অপটু হাতে।
চঞ্চল দাদা আর কবি ফিরোজা হারুন মিলে যেভাবে প্রায় সত্তর জন দর্শক শ্রোতার
( আজ ভিডিয়োয় দেখলাম এই লেখাটি লেখার সময় পর্যন্ত ভিউয়ার ৬৭) মাসিক
আলোচনাটি মনোজ্ঞ করে তুলেছিলেন। ভাষাগত দীনতার কারণে এখানে তার পরিপূর্ণ
প্রকাশ সম্ভব হলো না।
এই সীমাবদ্ধতার দায় একান্তই আমার নিজের।
হে প্রেমের কবি দ্রোহের কবি সাম্যের কবি,
প্রয়াণ দিবসে প্রণমি তোমায়। 🙏