রত্না চক্রবর্তী
২৩.৬.২২
অনুর সঙ্গে মাধবীর সম্পর্কটা নামেই ননদ আর বৌদির। আসলে অনু মাধবীর কাছে
মেয়ের চেয়েও বেশী কিছু।অনুর পাঁচ বছরে তার শ্বাশুড়ি মা যখন চোখ বুজলেন তখন
থেকেই সে অনুর মা হয়ে উঠেছিল। শ্বাশুড়ির শেষ বয়সের সন্তান অনু। নিজের
সন্তান তার ছিল না।তারপর অল্প বয়েসেই হার্ট এটাকে স্বামীও চলে গেল।সারা
পৃথিবীতে একা হয়ে যাওয়া মাধবীর সব অপত্যস্নেহ গিয়ে পড়ল অনুর উপর।শুধু স্নেহ
বললে হয়ত ভুল বলা হবে।জীবনে বার বার হারাতে হারাতে মাধবী এতটাই ভীতু হয়ে
পরেছিল যে অনুকে নিয়ে সবসময় ভয় পাওয়াটা যেন মাধবীর স্বভাব হয়ে উঠেছিল।অনুও
তো মাধবীকেই মা বলে মনে করে।মাধবীকে ছেড়ে একটা দিনও সে থাকে নি।মাধবীর
বাপের বাড়ি দাদাদের কাছে পর্যন্ত সে যেতে দেয় না মাধবীকে।বাড়িতে মাধবী না
থাকলে তার নাকি কান্না কান্না পায়।
মাধবী যখন অনুর বিয়েও দিল তখনও ননদকে চোখের আড়াল করতে পারবে না বলে ঘর
জামাই দেখেই দিল।ছেলেটি অবশ্য খুব ভালো।মেদিনীপুরে নিজেদের বাড়ি ঘরও
আছে।কলকাতায় একটা মেসে থেকে চাকরী করত।অনেক খুঁজে পেতে মাধবী এর সাথেই অনুর
বিয়ে দেয়।অতনু মানে অনুর বরকে নিজেদের বাড়িতে এনে রাখে।যাতে অনুকে চোখের
আড়াল না করতে হয়।
আসলে কি করবে মাধবী।তার যে সব সময় মনে হয় অনু ঠিক ঠাক সব পারবে না।না
দেখলেই ঠান্ডা দুধ খেয়ে নেবে,নিজের জামাকাপড় গুছিয়ে রাখবে না।কুয়োর জলে
স্নান করে সর্দি বাঁধাবে,ভাত নিজে বেড়ে খেলে পরিমান বুঝতে পারবে না,কমই
খাবে।তাই সব সময় পিছনে লেগে থাকে।কম বকাঝকাও করে না অনুকে। অনু আর অতনু
দুজনেই প্রাইভেট জব করে।সকালে উঠে হুলুস্থুলুস করতে থাকে ওরা।মাধবী
তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে হাতে হাতে এগিয়ে দেয়।অনুকে জোর করে ভাত মেখে খাইয়ে
দেয়।অতনু হাসে।বলে বৌদির আহ্লাদী। অনু আর অতনুর ফিরতে ফিরতে আট টা বাজে
রোজই।কোনদিন আট টা পাঁচ হবার জো নেই।ফোন করে করে বৌদি অস্থির করে তোলে।রেগে
যায় অনু।সে কি বাচ্চা একটা মেয়ে?আঠাশ বছর বয়স হয়েছে তার।অফিসের পর বন্ধুর
সাথে তার সালোয়ারের ম্যাচিং ওড়না কিনতে গিয়েছিল সে। তাতে রেগে মেগে বাড়ি
মাথায় করার কি আছে! কিন্তু বৌদিকে মুখে কিছু বলে না।মুখটা হাঁড়ি করে
রাখে।মাধবীর মাথা ঠান্ডা হলে ভাবেন পুচকি মেয়ের বকা খেয়ে অভিমান
হয়েছে।সেদিন পায়েস বানান মান ভাঙানোর জন্য।
ননদ ভাজের এই মান অভিমান ভালোই চলছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছিল অতনুর।কেমন মনে
হচ্ছিল অনু যেন তার নয়, অন্যের অধিকারের বস্তু তার কাছে গচ্ছিত আছে
মাত্র।সে যেন কোনভাবেই অনুর নাগাল পায় না। যেদিন কালবৈশাখী এল এতদিনের
তীব্র গরমের পর অতনু টানতে টানতে নিয়ে গেল অনুকে ছাদে। খুব ভিজল ওরা।
কিন্তু বৌদি ভীষণ রেগে গেল। অনুর ঠান্ডা লাগার ধাত।কেন সে এই বিকেলে
বৃষ্টিতে ভিজল। অনু গলা জড়িয়ে বলে -"ও বৌদি রাগ কোরো না। আমার কিচ্ছু হবে
না দেখ।" মাধবী ঠান্ডা হয়। কিন্তু অতনুর মনে অস্বস্তির কাঁটা বেঁধে। সেই
অনুকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল।
আর একদিনের ঘটনা।অতনু অনুর জন্য জুইএর মালা নিয়ে এল খোঁপায় জড়াবে বলে।
চুপিচুপি এসে অনুর চুলে পিছন থেকে জড়িয়ে দিল। অনু বিহ্বল হয়ে কিছু বলতে
যাবার আগেই জুঁইএর সুগন্ধে বৌদি এসে বলল-"একি অতনু!শীঘ্রি খোল ওটা।কি
কান্ড!!!..তুমি জানো না বোধহয় ভাই,অনুর যেকোন ফুলে এলার্জী। ছোট থেকেই।তাই
ওর ফুল লাগাতে ইচ্ছে হলে ও প্লাস্টিকের ফুল লাগায়।" এটুকু বলেই থামল
না।মালাটা খোঁপা থেকে খুলে দিল। ছিঁড়ে গেল মালাটা।দারুণ অপমান লাগল অতনুর।
সে মুখে কিছু বলল না।রাতে শোবার সময় অনু অতনুর গলা জড়িয়ে ধরতে গেলে অনুকে
বলল-"মাঝে মাঝে মনে হয় তোমাকে কাছে পাবার আগেও আমার বৌদির অনুমতির
প্রয়োজন।" কঠিন হয়ে যায় অনুর মুখ। বলে-"কেন বৌদি কি এমন করেছে যে তোমার
এরকম মনে হয়?"
অতনু বলে-"কি করেন!তুমি দেখতে পাও না? না দেখতে চাও না? ইচ এন্ড এভরী
প্রাইভেট ম্যাটারে ইন্টারফেয়ার করেন। আমি না হয় জবের সুবিধার জন্য এখানে
থাকছি,তাই এগুলো বলতে পাচ্ছেন। নইলে তোমার শ্বশুরবাড়ি গিয়েও এই কাজটা করতে
পারতেন উনি। অনু বিরক্ত হয়ে বলে-"উনি আমাকে মায়ের মত মানুষ করেছেন।তাই আমার
জন্য চিন্তা করেন অতনু। তার মানে এটা তো নয় যে উনি তোমায় অপমান করেন।" অতনু
আর কিছু বলে না। কিন্তু অনুর মনে একটা অস্বস্তির কাঁটা বিঁধে থাকে। সত্যি
বৌদি একদম বোঝে না যে সে বড় হয়ে গেছে। নিজের ভালো মন্দ সে নিজে বুঝতে পারে।
বৌদি নিজে হাতে টিফিন করে পাঠায় অনুকে আর অতনুকে। বাইরে খাওয়া বৌদি একদম
পছন্দ করে না। অনুর এসিডিটি হতে পারে। সেদিন কিন্তু অনুর ভীষণ ইচ্ছা করছিল
বাইরে খেতে। অতনু আর ও ফেরার পথে একটা রেস্তোরাতে খেয়ে বৌদির জন্য খাবার
প্যাক করিয়ে নিল। ফিরতে ফিরতে একটু রাতই হল।বাড়ি ঢুকতেই বৌদি প্রচণ্ড
রাগারাগি করল।চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল বৌদি। অতনুর মনে হয় মাধবীদেবী তাকে
বিশ্বাস করতে পারছেন না।নইলে সে অনুর সঙ্গে আছে জেনেও এত চিন্তার কি থাকতে
পারে? মাধবীর সব হারানো জীবনে যে কেন এই চিন্তা অনুর জন্য তা সে বোঝাতে
পারে না। তার যে ভয় করে অতনু অনুর যদি একসাথেই কিছু হয়। সে তো খবরও পাবে
না। বাড়িতে একা থেকে থেকে অসহায়ত্ব কেমন পেয়ে বসেছে তাকে। অনুকে নিয়ে এত
ব্যস্ততায় কেটেছে মাধবীর বছরগুলো যে বাইরে মেশার সুযোগ সে পায় নি। অনু
নিজেও তার বৌদির ভাগ দিতে চাইত না কাউকে।অনু যখন বন্ধুদের সাথে হৈচৈ করত
মজা করত মাধবী বলত-"তোর তো দেখছি অনেক বন্ধু হয়েছে,এবার আমিও একটু বন্ধুদের
সাথে মজা টজা করব।" অনু গলা জড়িয়ে ধরে বলত-"না, আমিই তোমার বন্ধু তো।" হেসে
বলত মাধবী-"তবে রে দুষ্টু তোর বন্ধু থাকতে পারে,আর আমার থাকতে নেই?'" অনু
বলত-"ঠিক তাই,আমি করব তুমি করবে না।বুঝেছ। আমার দাবী।"
তাই অনু ছাড়া যে মাধবী কিছুই ভেবে উঠতে পারে না। তাই অসহায় রাগ হয় তার।
অনুর খুব বিরক্ত লাগে বৌদির অবুঝ রাগে। তার কি মিনিমাম এটুকু স্বাধীনতা
নেই। বৌদির এই জিনিষগুলো খুব বাজে। রাগ করে খাবারটা অবধি খেল না। অতনুর
মুখেও স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। হ্যাঁ সে মানছে তার ভুল হয়েছে। বৌদিকে ফোন করা
উচিত ছিল। কিন্তু না করায় এমন কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে?
মাধবীর রাগ পরেরদিন ঠান্ডা হয়। টিফিনে পোলাও করে দেন অনু আর অতনুকে। কিন্তু
অনু নিয়ে যায় না টিফিন। বৌদি যদি তার আনা খাবার না খেতে পারে,তবে তারও বা
কি ঠেকা পড়েছে পোলাও খাবার। তাদের অফিসে ক্যান্টিন আছে।
অনুর অফিসের এক কলিগের জন্মদিন ছিল সেদিন।অনুর মোবাইলের চার্জ চলে
গিয়েছিল।অনু হয়ত অফিসের ফোন থেকে খবর দিতে পারত কিন্তু হুল্লোড়ে সে কথা মনে
ছিল না।অফিস আওয়ারের পরে পার্টি হল। খুব মজা করল ওরা।অতনু এখানে নেই।
দুর্গাপুর গেছে অফিস ট্যুরে। সেদিন বাড়ি ফিরতে প্রায় রাত ১১টা বেজে গেল
অনুর। পাড়ায় ঢোকার মুখে দেখল বৌদি গলির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঢুকতে দেখে
ফ্ল্যাটে ঢুকে গেল। ফ্ল্যাটে ঢুকতেই বৌদি ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রায়। এত
কাণ্ডজ্ঞানহীন মেয়ে যে অনু সেটা সে ভাবতেও পারে নি। কি করে সে পারে এরকম
অদ্ভুত কাজ করতে।বাড়িতে যে একটা মানুষ একা আছে সেই সেন্সটুকু কি ওর নেই?
কিছুক্ষন চুপ করে শোনার পর আজ অনুও উত্তর দেয়-"দেখ বৌদি আমি যথেষ্ট বড়
হয়েছি। বিশ্বাস কর তোমার এই রোজ রোজের অশান্তি আমার আর ভালো লাগে না।একটা
২৮ বছরের বিবাহিত মেয়ে কি খুকী যে তাকে আঁচল চাপা দিয়ে রাখবে তুমি। আমি
পারব না জাস্ট পারব না। সব বিষয়ে খবরদারিটা এবার তুমি বন্ধ কর প্লিজ।হাত
জোড় করছি। আজ অতনু নেই তাই তোমায় বলছি। এইভাবে যদি তুমি আমায় মুঠোয় ভরতে
চাও তো আমাকে বাধ্য হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতে হবে। এর চেয়ে বোধহয় সেখানে
অনেক বেশী স্বাধীন থাকতাম আমি।"
থমকে যায় মাধবী। সত্যি তো এতো তার খুকী নয়। এতো একটা দিব্যি বড় মেয়ে।
বিবাহিত নিজের ভালো মন্দ বোঝার মত বোধ বুদ্ধি যার আছে। আশ্চর্যজনক শান্ত
হয়ে যায় মাধবী।কেমন অপ্রস্তুত মনে হয় তাকে।কথাগুলো বলে নিজেও কেমন
অস্বস্তিতে পরে যায় অনু। ঠিক এভাবে বলাটা উদ্দেশ্য ছিল না। বলতে চায়ও
নি।কিন্তু হঠাৎ রাগ হয়ে গিয়েছিল তার। ছোটবেলা হলে অনু হয়ত গলা জড়িয়ে ক্ষমা
চেয়ে নিত।কিন্তু এখন সে সত্যি বড় হয়ে গেছে।সেটাও ঠিক পেরে ওঠে না।
পরেরদিন অফিস থেকে বৌদিকে ফোন করে। বৌদি সকালে নাক টানছিল দেখে গেছে সে।
ঠান্ডা লাগিয়েছে। তাই খোঁজ নিতেই ফোন করেছিল। বাড়ির ল্যান্ড ফোন বেজে বেজে
কেটে গেল। কেউ ধরল না। বার কয়েক ট্রাই করেও পেল না যখন বেশ চিন্তায় পড়ে
গেল। অফিসে তাড়াতাড়ি বলে বেরিয়ে এল। সেদিন আর বাসের জন্য দাঁড়ালো না। বৌদির
মোবাইল নেই। ল্যান্ড ফোন কি খারাপ? কি করবে সে এখন।ট্যাক্সি থেকে নেমে
দ্রুত পায়ে ফ্ল্যাটের দরজার সামনে এসে দেখল ফ্ল্যাটের দরজায় তালা। বৌদি কি
বাড়ি নেই! কোথায় গেছে বৌদি!সেই ছোটবেলায় স্কুল থেকে বেরিয়ে বৌদিকে দেখতে না
পেলে যেমন কষ্ট হত সেরকম কষ্ট হতে থাকে। সামনের ফ্ল্যাটের মিত্র কাকীমাদের
বেল বাজায় অনু। মিত্র কাকীমা দুপুরে ঘুমাচ্ছিলেন বোধহয়। ঘুম চোখে দরজা
খুললেন। তিনি জানেন না বৌদি কোথায়।অনু ভাবে সে এত ভয় পাচ্ছে কেন? বৌদি হয়ত
আশে পাশে কোথাও গেছে। এখনি এসে যাবে।তালা যখন দিয়ে গেছে তার মানে জেনে
বুঝেই গেছে। বিপদ টিপদ কিছু নয়। কিন্তু সময় যত বাড়তে থাকে মনের যুক্তিগুলো
কেমন এলো মেলো হয়ে যেতে থাকে। আচ্ছা বৌদি কি কালকের কথাগুলো মনে ধরে চলে
গেছে? কিন্তু কোথায় যাবে? দাদাদের বাড়ি? অনুর কাছে বৌদির বাপের বাড়ির ফোন
নম্বর আছে। সে ফোন করে। বৌদির ভাইএর বৌ ফোন ধরেন। অনু সৌজন্যমূলক কুশল
বিনিময় করে জিজ্ঞেস করে- "প্রতিমাবৌদি বৌদি কি তোমাদের ওখানে?"
প্রতিমা বৌদি আকাশ থেকে পরে-"কই না তো অনু। দিদিভাই তো সেই গতবছর ভাই
ফোঁটায় এসেছিল। তুমিও তো এসেছিলে মনে নেই ?কেন গো কি হয়েছে?"
অনু সামলে নিয়ে বলে-"না না আসলে আগে বাড়ি ফিরে এসে দেখছি বৌদি বেরিয়েছে।
তাই ভাবলাম যদি তোমাদের ওখানে..."
বৌদি দাদার বাড়ি না গেলে গেল কোথায় ! বৌদির তো কোন বন্ধুও নেই যে তার বাড়ি
যাবে।বৌদি কি বোঝে নি যে সে কথাগুলো মন থেকে বলে নি। নিশ্চয় বুঝেছে। বৌদি
অন্য কোথাও গেছে। কিন্তু সে তো এটাও জানে না সারাদিনে বৌদি আদৌ এরকম কোথাও
যায় কিনা। হঠাৎ অবাক হয় অনু। সত্যি সে তো ভেবে দেখেনি কখনও বৌদির সারাদিনের
কতটুকু জানে সে।জোর করে মনে মনে ভাবার চেষ্টা করে। বৌদি ফুলগাছ লাগাতে
ভালোবাসে,আচার বানাতে ভালোবাসে, বড়ি দিতে ভালোবাসে....কই আর তো মনে পড়ছে
না। কেমন বুকের ভিতর একটা কষ্ট হয় অনুর। বৌদিকে বড্ড অবহেলা করেছে সে।
বৌদির তো পায়ে খুব ব্যথা। আচ্ছা যদি কোথাও গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। যদি
এক্সিডেন্ট হয়ে থাকে। বৌদি তো বিশেষ বেরোয় না। কেউ তো তেমন চেনেও না। কি
করে খবর পাবে অনু।বুকের ভিতর ধকধক করতে থাকে। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায়
মানুষ মনে হয়।অতনুকে ফোন করে।কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলে। অতনু বলে-"আরে
পাগলী কাঁদছ কেন?চুপ কর প্লিজ। হয়ত আশপাশে কোথাও গেছেন।এসে পরবেন।"অনু
বলে-" বৌদি আমায় না জানিয়ে কোথাও যায় না।একটা ফোন করে তো অন্তত বলে যাবে।"
বলতে গিয়ে থমকায় অনু।বৌদি তো এটাই বলেছিল-"একটা ফোন করে তো অন্তত...."
সিঁড়িতে বসে পরে অনু। বিকেলের আলোয় টান ধরেছে। প্রায় অন্ধকার হয়ে আসা
সিঁড়িতে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকে অনু। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে। কত
অনন্তকাল অনু জানে না। একসময় নৈঃশব্দ্য ভেঙে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ ভেসে
আসে।চেনা শাড়ীর খসখস। হাতের দুগাছা ব্রোঞ্জএর চুড়িতে ঠোকাঠুকির শব্দ।উৎকর্ণ
উঠে বসে অনু।বৌদি এসে অনুকে দেখে বলে-"একি অনু তুই? কি হয়েছে। শরীর ঠিক আছে
তো?"অনু হঠাৎ যেন সেই পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়েটা হয়ে উঠে।ঝাঁপিয়ে জড়িয়ে ধরে
বৌদিকে। তারপর অঝোরে কেঁদে ফেলে।বৌদির প্রতি জমা রাগ অভিমান নোনা জলে গলে
গলে যায়। বৌদি কোন প্রশ্ন করে না। শুধু ২৮ বছরের বিবাহিত সেল্প সাপোর্ট
মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে থাকে-"পাগলী কোথাকার। "
আত্মকথন
ম্যাক আজাদ
আসিফের চোখে এখন শুধু স্বপ্ন। সারারাত ভালো ঘুম না হলেও চোখে মুখে নেই
কোন ক্লান্তির ছাপ। খানিক এপাশ ওপাশ, এঘর ওঘর করতে করতে থমকে দাঁড়ায়।
হঠাৎ কি মনে হলো, মোবাইল ফোন চার্জার থেকে ডিস্কানেক্ট করে ফটো এলবামে
গিয়ে ছবি খুঁজতে থাকে। একের পর এক ছবি দেখতে দেখতে থেমে যায় একবার।
নিজের অজান্তেই তার চেহারায় এক পরিবর্তন দেখা দিলো। কেমন যেন উজ্জ্বল
হয়ে উঠলো তার সারারাত আধো ঘুমো মুখটা। একটা ছবি প্রাণ ভরে দেখতে লাগলো।
মনে হলো ছবি নয়, ছবির মানুষটি তার সামনে বসে আছে। তার অবচেতন মনে ঝরছে
অজস্র কথার মালা। রত্না চক্রবর্তী ২১.৬.২২
সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে চোখে পড়লো, আজ তোর জন্মদিন। কেন জানিনা সারারাত
ভালো ঘুম হয়নি। স্বপ্নের ভিতর তুই আমি আমরা সবাই কত জায়গা ঘুরে
বেড়ালাম, আনন্দ করলাম। খুব ভোর বেলা ঘুম ভেঙ্গে গেলেও ফোন খুলে কোন
ম্যাসেজ বা ফেইসবুক দেখিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই প্রথম থেকেই তোর সাথে
বেশ ভালো বন্ধুত্ব। তোকে নিয়ে এতদিন পাশাপাশি ক্লাস করেছি, হেঁটেছি,
গল্প করেছি, কেন জানিনা তোর জন্মদিনটাই জানা হয়নি। জানিস সেই কারণে
নিজেকে মনে হচ্ছে ভীষণ অপরাধী। তোর জন্মদিন যে জানতাম না সেই কথাটা
তোকে বলাও যাবে না কোনদিন, সেই কথা বলার সাহস মনে হয় হবে না। তবে, তোর
জন্মদিনের কথা শুনে মনটা আজ বেশ ফুরফুরে। মনটা কেন ফুরফুরে হয়তো সেটাও
জানিনা। মনে হচ্ছে আজ আর কোন কাজ নেই। শুধু তোর জন্মদিন ছাড়া আর কোন
ভাবনা নেই, সব যেন ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি। জন্মদিনের দিন তোর মুখটা দেখতে
কেমন হয় অথবা দেখতে কেমন হবে, খুব জানতে ইচ্ছে করছে। আসলে ঠিক জানতে
না, দেখতে ইচ্ছে করছে। তোর আবার অন্য কোন প্ল্যান আছে কিনা সেটাও তো
জানি না! আজকে আবার ছুটির দিন, ইউনিভার্সিটি যাবার কথা না। তাহলে কি
তোর জন্মদিনে তোর সাথে দেখা হবে না? তোর আনন্দ দিনটাকে ভাগাভাগির কোন
সুযোগ পাবো না? ফেইসবুকে তোর জন্মদিনের শুভেচ্ছা দিয়ে একটা স্টাটাস
দিলে কেমন হয়? নাহ, তা' হবে না। সবাই জানুক এবং শুভেচ্ছার বন্যায়
ভাসিয়ে দিক সেটাও মন চাইছে না। কেমন যেন স্বার্থপর স্বার্থপরের মত
ভাবছি। আজ এতো বড় স্বার্থপর হয়ে গেলাম কি করে বুঝে উঠতে পারছি না। সে
যাই হোক, তুই যেখানেই থাকিস না কেন, দেখাতো করতেই হবে। এমনিতেই তোর
জন্মদিন না জানার অপরাধ, তার উপর আজ যদি তোকে উইস করতে না পারি, অপরাধ
চারগুণ হয়ে যাবে।
আচ্ছা, জন্মদিনে তোকে ফুল দিবো নাকি তোর সখের কবিতার বই? নাকি নীল
শাড়ি-রেশমি কাঁচের চুড়ি? বুঝে উঠতে পারছি না। ছিঃ ছিঃ শাড়ি-রেশমি
কাঁচের চুড়ির কথা কেন ভাবছি? আমি নির্লজ্জ হয়ে গেলাম নাকি? তোকে শাড়ি
দেবার ভাবনাটা কোথা থেকে এলো? এর আগে তোর কথা ভেবে এতোটা নার্ভাস হইনি
কখনোই। আজ কেন তবে এতো নার্ভাস লাগছে? তোর সাথে সময়ে অসময়ে ঘুরতে চলতে
ভালো লাগে। কিন্তু, তোকে নিয়ে আমার এমন অনুভূতি এর আগে কখনো হয়নি। তোর
নিশ্চয়ই মনে আছে যে, তুই আমার প্লেট থেকে ফুচকা খেয়ে ফেলেছিস কতবার, আর
আমিও তোর আধো খাওয়া আইসক্রিম নিয়ে দৌড়ে পালিয়েছি বহুবার। সেসব কথা
ভাবতে খুব ভালো লাগছে। আমরা দলবেঁধে একবার নৌকা ভ্রমণে গেলাম। মাঝারী
সাইজের ইঞ্জিন চালিত স্যালো বোট। সারাদিন আমাদের কি হৈচৈ আর ঘুরে
বেড়ানো। পদ্মানদীর নতুন ব্রীজের নিচ দিয়ে চিৎকার করে সূরে বেসুরে গান
করে আনন্দ করেছিলাম। মাঝে মাওয়া ঘাটের ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে ভাত খাওয়া ।
আহ, মনে হচ্ছিলা জীবনে আর কিছু চাই না, শুধু এভাবে ঘুরাঘুরি আর ইলিশ
মাছ দিয়ে ভাত খাওয়া ছাড়া!
কতবার যে তোর হাতের মার খেয়েছি বকা খেয়েছি, সেই তুই আবার আমাকে ঝাপটে
ধরেছিস জনসম্মুখে যখন তখন। আমাদের সেই দিনগুলি ছিল খুবই চমৎকার। বকা
খাওয়ার কারণগুলো যেমন সামান্য আর মার খাওয়াটাও তেমনই। এই যেমন দেরী করে
আসা, নোট ভুলে যাওয়া। একবার দল বেঁধে পিকনিকে না যাবার কারণে তোমার
হাতের মারও খেয়েছি টিএসসি'র জনসমুখে। বাকী বন্ধুরাও তোকে পুরা সমর্থন
দিয়ে আমাকে এইভাবে মার খেতে দিলো। আমাকে উদ্ধার না করে সবাই বরং তোমাকে
বাহাবা দিচ্ছিল। একবার বই মেলাতে আমি তোদের সবাইকে হারিয়ে ফেলেছিলাম।
আমার মোবাইল ফোনে চার্জ না থাকায় কারো সাথে যোগাযোগ করাও সম্ভব হয়নি।
তার পর আর কি বলবো, শাস্তি হিসেবে পুরা এক সপ্তাহ সবার স্ন্যাক্স এর
বিল পরিশোধ করতে হয়েছিল আমাকে। আজ পুরানো সেইসব দিনগুলোর কথা কেন জানি
মনের মধ্যে ভেসে আসছে বারবার! তোমাকে নিয়ে আমি এইভাবে ভাবিনি কখনো
কোনদিনও। ওমা সে কি হচ্ছে? সেই প্রথম থেকেই তুই'তে দাড়িয়েছিল আমাদের
বন্ধুত্ব। মনের অজান্তে তোকে আমি "তুমি" বলে ফেলেছি কয়েকবার। আমার সব
যেন কেন এলমেলো হয়ে যাচ্ছে।
আচ্ছা বলতো দেখি, তাহলে কি তুই আমার শুধু বন্ধু? না কি অন্য আরো কিছু?
এই যে দেখ, নিজের অজান্তে তোকে "তুমি" বলছি বারবার? এও বুঝতে পারছি না
যে এই ভুল কি আগেও হয়েছিল না কি? মনের ভুলে তোর চোখে কিছু আবার ধরা পরে
যাইনি তো? জানিস, এসব ভেবে আমার লজ্জাও লাগছে আবার ভয়ও লাগছে। লজ্জা
লাগছে কেন সেটাতো বুঝতেই পারছিস, কিন্তু ভয় লাগছে এই ভেবে যে বিষয়টা
তুই কিভাবে নিবি সেইটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা, তাই ভয় হয় আবার এতদিনের
বন্ধুত্ব না হারিয়ে ফেলি। ছিঃ ছিঃ আমি কিসব ভাবছি মাথা কাজ করছে না।
তোকে এতো দিনে অনেকটাই চিনেছি। তুই মাঝে মাঝে যেভাবে মারমুখি হয়ে যাস,
বাসে না রিক্সায় তোর কোন কিছু খেয়াল থাকে না, আর কিছু যায় আসেও না ।
তবে তোকে সিরিয়াসলি রাগতে দেখিনি কোনদিন। যা সব হয়েছে ওসব বন্ধুসুলভ। এ
না হলে বন্ধু কিসের বল? ইচ্ছে করে সারা জীবন এমনি করে চলে যাক। এভাবে
একসাথে পথ চলা, কথা বলা, কাছে কাছে থাকা।
তোকে হারানোর কস্ট মনে হয় সইতে পারবোনা আমি। আমাদের এতো দিনের
বন্ধুত্ব, আমাদের সুখময় দিনগুলির স্মৃতি, তোকে নিয়ে আমার ভাবনার আকাশসম
জায়গা সব যেন অটুট থাকে। নিজের ভুলে বার কোন কারনে এতটুকুও নস্ট হতে
দিবো না । "তুমি" তবে থাক, আমার কাছে তুই বরং "তুই"ই থাক। তোকে নিয়েই
হোক আমার আগামী প্রতিটি মুহুর্তের সুখময় দিন, তাঁরাভরা সন্ধালাপন,
জ্যোৎস্নায় আলোকিত ঘুমন্ত শহরে তোকে নিয়ে রিক্সায় চলা, শ্যালো নৌকায়
পদ্মা-ধলেশ্বরী-ইছামতি ভ্রমন, ক্যাম্পাসের সেই ধুলা মাখানো চটপটি আর
কন্ডেন্সড দুধের কড়ামিঠা চা, কারনে অকারনে তোর বকাবাজি, যেন সবকিছু
থাকে আগের মতো। নীল শাড়ী-রেশমি কাঁচের চুড়ি আর ফুল না হয় থাক অন্তরালে।
প্রিয় বই’ই হউক তোর জন্মদিনে আমার প্রীতি উপহার। যদি কখনো কোন দিন কোন
কবিতায় খুঁজে পাস আমার মনের কথা, যদি তুইও কখনো ভাবিস আমার মতো করে কোন
একদিন।
মেঘে ঢাকা আকাশের মাঝে মাঝে চিলতে রোদের মত হয়ে উঠলো আসিফের মুখ। খুশী
আর বিসন্নতায় মাখানো বাদামী চোখ খানিক ঝাপ্সা হয়ে আসলো কোন অজানা
আবেগে।
কথা
বিশ্বজিৎ যে মনে বড় দুশ্চিন্তার ছিল মেয়ে এত বড় হয়ে গেল এখনো কথা শিখছে
না অথচ কালা নয়। হাবাও মোটেই নয়। ডাক্তার দেখানো হয়েছে বোবা হবার মতো
কিছু নেই, বুদ্ধি খুব ভালো তবু কথা একদমই শিখছে না। হ্যাঁ না ঘাড় নেড়ে
ইশারায় সব বুঝিয়ে দেয়, কথা বলে না। গানের সাথে হাত পা নেড়ে নাচে কিন্তু
কথা বলে না। প্রায় আড়াই বছর পেরিয়ে যেতে চলল। এ বয়সের বাচ্চারা একগাদা
ছড়া, টুইংকেল টুইংকেল কবিতা পর্যন্ত বলতে পারে আর... খুব মন খারাপ তাই
বিশ্বজিতের।
কাল শর্মিলার দেওর যুধাজিৎ আসবে আমেরিকা থেকে। শর্মিলার মনে খুব আনন্দ। সে
দেবরটিকে বড় ভালোবাসে। সবচেয়ে বড় কথা এখনো দেখিনি মোমকে তার কাকা। তার
জন্মের আগে থেকেই সে বিদেশে গেছে। বিশ্বর মায়ের মানে যুধাজিতের কাকিমার
মৃত্যুর সময় ও আসতে পারেনি যুধাজিৎ, তখন ও সবে ওখানে গেছে।
শর্মিলার শাশুড়ি মানে বিশ্বজিৎ মা বিশ্বজিৎ এর থেকেও বেশি ভালোবাসতেন
যুধাজিৎকে। তার বড় জা মরে যাবার সময় ছেলেটাকে তার হাতে তুলে দিয়ে
গিয়েছিলেন। তার বড় জার শেষ বয়সের সন্তান। হবে না হবে না করে অনেক বয়সে
যুধাজিৎ হয়। বাচ্চা হতে গিয়ে তিনি মারা যান। একদিন বেঁচে ছিলেন । বাঁচানো
গেল না অনেক চেষ্টা করেও। বিশ্বর মা বুকে আগলে রেখেছিলেন ছেলেটাকে। তার
স্বামী আর ভাসুরও অল্প বয়সে মারা যান। অনেক যত্নে, অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন
তিনি ছেলেদের।
যুধাজিৎ বিদেশে চলে যাবার পর তার শরীর ভেঙে যায়। শেষ দিন অব্দি যতক্ষণ কথা
বলতে পারতেন জিৎ জিৎ করে গেছেন। শেষের দিকে অবশ্য কথা প্রায় বন্ধ হয়ে
গিয়েছিল। বলতে পারলেও দুই একটা অস্পষ্ট শব্দ ছাড়া আর কিছুই বার হতো না,
সেগুলো খুব মানে যুক্ত বলে মনে হয় না। আর কথা তো আর কারো সাথে বলতেন না।
শুধু শর্মিলার সাথে কথা বলতেন।
শাশুড়ি হিসেবে অত্যন্ত ভালো ছিলেন তিনি। শর্মিলাকে নিজের মেয়ের মতো আপন
করে নিয়েছিলেন।শর্মিলাও ভালবাসত তার শাশুড়িকে। অল্প বয়সে বিধবা এই মহিলা
দুই ছেলেকে মানুষ করেছেন। ধার্মিক প্রকৃতির মহিলা ছিলেন তিনি। যার জন্য তার
বনিবনা হচ্ছিল না বিশ্বর সাথে। একটু হঠাৎ বড়লোক হবার দিকে ঝোঁক ছিল
বিশ্বজিতের। ব্যবসার নাম করে মার থেকে কিছু গয়না নিয়েছিল টাকার জন্য
কিন্তু সে ব্যবসা ডুবে যায়। টাকা পয়সা খেটে রোজগারে তার মন নেই । হঠাৎ
বড়লোক হবার দিকে বড় লোভ। শেয়ার নিয়ে খুব মাতামাতি করে। শর্মিলাকে তার
শ্বাশুড়ি গয়না দিয়েছেন লুকিয়ে, মাথার দিব্যি দিয়েছেন বিশ্বকে না জানাতে।
নইলে ফাটকায়, নয় জুয়ায় খতম করে দেবে। যুধাজিতের অবশ্য এ ধরনের মানসিকতা ছিল
না। পড়াশোনা করেছে মন দিয়ে, চাকরি চেষ্টা করেছে। ভালো চাকরি পেয়ে গেছে।
মরার আগে শর্মিলা শাশুড়ি বারবার শর্মিলাকে যুধাজিতের ছবি দেখিয়েছে কিছু
বলার চেষ্টা করছে বলতে পারিনি শুধু নিজের বুকটা দেখাচ্ছিলো,গলাটা দেখাচ্ছিল
... হাত নেড়ে বোঝাবার চেষ্টা করছিল দেখা হলো না আর একদম শেষে কিছু একটা
দেবার কথা ইশারা করে বোঝাচ্ছিল শর্মিলাকে। শর্মিলার বলেছিল "মা আমি বুঝতে
পারছি না তবে তোমার যা আছে আমি খুঁজে পেতে লুকিয়ে রেখে দেবো তুমি চিন্তা
করোনা, আমি সব ভাইকে দিয়ে দেব। এর বেশি তোমার কথা তো আমি বুঝতে পারছি না
মা। "চোখ বুজে ছিলেন শর্মিলার শাশুড়ি দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছিল
কিন্তু কথা আর বলতে পারেননি।
যুধাজিৎ আসবে বলে বিশ্বজিৎ ছুটি নিয়েছে। অনেকদিন বাদে ভাই আসছে। বিশ্বজিৎ
মানুষ হিসেবে কিন্তু খারাপ নয়। টাকার নেশা থাকলেও স্ত্রীকে সন্তানকে
ভালোবাসে। ভালোবাসে ভাইকে ও নিজের ভাই বলেই জানে। শুধু ব্যবসাবুদ্ধিটাই
গন্ডগোলের। ছুটে গিয়ে দরজা খুললো শর্মিলা। একগাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে
যুধাজিৎ। সবাইকে দেখে ওর চোখ যেন জলে ভরে উঠলো। ঘরে ঢুকে সামনে বড় করে ছবি
টাঙানো আছে মার। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তাড়াতাড়ি শর্মিলা বল্লো
"দেখো ভাই এটাকে দেখেছো। দেখো কত বড় হয়ে গেল। তারপর মোমকে বলল" দেখো
কাকা। বলো কা..কা...। কাকা কাকিমা কই জিজ্ঞাসা করো তো?" ডাক্তার বারবার
বলেছেন বাচ্চাটাকে অনবরত কথা বলার চেষ্টা করতে। বাড়িতে একটা কথা বলা পাখি
ও পুষতে বলেছেন। অনবরত বলতে বলতে ও কথা শিখবে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল
তার দিকে মোম অদ্ভুত ভাবে। মোমের দিকে হাত বাড়াতেই শর্মিলা তার কোলে
মেয়েকে দিয়ে মজার গলায় বললো "এতদিন আসো নি আমি তো ভেবেছিলাম একেবারে মোমের
জন্য একটা মেম সাহেব কাকিমা নিয়ে আসছে।" আসলে যুধাজিৎকে ভোলাবার জন্য এইসব
কথা বলা। যুধজিৎ হাসল।
মোম ততক্ষনে এক অদ্ভুত কান্ড করছে, যুধাজিতের গালটা কচি কচি হাতের তালু
দিয়ে ধরেছে, এমন ভাবে মুখের দিকে চেয়ে আছে যেন কত চেনা। সে দুবার ঠোঁট
নাড়িয়ে শব্দ বার করার চেষ্টা করছে আপ্রাণ। বিশ্বজিৎ উদগ্রীব হয়ে মেয়ের
দিকে তাকিয়ে আছে। মোম হঠাৎ অদ্ভুত গলায় বলল "তোর ঘরে তোর পাশ বালিশের
মধ্যে হারটা আছে। " কথাটা পুরোপুরি স্পষ্ট বোঝা গেল না। কেবল 'তোর ঘরে ''
'বালিশ' আর ' আছে' একথাটা বিশ্বজিৎ পরিষ্কার বুঝল স্তব্ধ হয়ে গেল
বিশ্বজিৎ। যে মেয়ে আড়াই বছর অব্দি প্রচুর ডাক্তার দেখানো সত্ত্বেও একটা
কথা বলতে পারেনি সে হঠাৎই একটা অদ্ভুত বাক্য বলল। তার আনন্দে চোখে জল এসে
গেল। সে মেয়েকে কোলে নিয়ে বলল "বল মা আর একবার বল কাকাকে, কিছু বলো! "
মোম হাসল তারপর বলল "কাকা... কাকাকে বলব.." সেই মোমের কথা বলা শুরু। সব কথা
সে বলতে পারে, এতোকাল বলেনি বলেই বোধহয় কথার ঝড় তার মুখে। বিশ্বজিতের
আনন্দের সীমা নেই। সে বলে "ভাই তুই আর ফিরে যাস না তোর জন্য আমার মেয়েটা
কথা বলতে পারলো।" আর শর্মিলা সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে গিয়েছিল যুধাজিতের ঘরে
তারপর পাশবালিশটা এনে বলেছিল" এই পাশবালিশটাই তোমার ছিল তো ভাই? " যুধাজিৎ
বলেছিল " হ্যাঁ কেন বলতো বৌদি? "কোন কথা না বলে কাঁচি দিয়ে পাশ বালিশের
ওয়ারটা খেরোটা কেটে ফেলল শর্মিলা। ভিতরে হাত ঢুকিয়ে নাড়াচাড়া করতেই
বেরিয়ে এলো একটা চওড়া বড় বিছে হার। শর্মিলা চোখে জল এসে গেল সে শাশুড়ি
ছবির দিকে তাকিয়ে বলল "মা এটা তোমার জন্য রেখে গেছেন এই হারটা তোমায় দিতে
বলে গেছেন। " যুধাজিৎ হারটা বুকে চেপে ধরে আবার কাঁদলো। মোম কাকার গলা
জড়িয়ে বলল "কাকা এটা তোর হার, ভালো ছেলে কাঁদে না। "
এই মোম সারা জীবন নরমাল জীবন কাটিয়ে গেছে। ভালো কথাবার্তা বলত। ভালো কবিতা
আবৃত্তি করত, গান গাইতো আর বছর তিনেক হয়ে যাবার পর হার সংক্রান্ত কোনো
কথাই আর কখনো বলেনি। এই অদ্ভুত ঘটনার ব্যাখ্যা কিন্তু সহজে মেলে না।
ডাক্তারবাবুও এর ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। মোম হারটার কথা জানলো কি করে সেটাই
ভারী আশ্চর্য, যেটা শর্মিলা নিজেও জানতো না...! শ্বাশুড়ির না বলা কথা মোমের
মুখ দিয়ে বেরিয়েছিল। তবে অতদিন কথা বলে নি কেন তা শর্মিলা বুঝতে পারে নি।।