- ফিরোজা হারুন
অনাদি কালের স্রোতে নারী পুরুষ মিলেই সৃষ্টির ধারা প্রবাহিত। স্বর্গ উদ্যান
হতে যদি আদম হাওয়া একসঙ্গে বহিস্কৃত না হতেন, তবে আদম একা একা বনে বাঁদাড়ে
জীবন কাটিয়ে দিতেন। গৃহ বা সংসার হতো না। অন্য জীব জন্তুর ন্যায় তার জীবন
অতিবাহিত হতো।
নারী পুরুষ একজন আরেকজনের পরিপূরক। ‘বিশ্বে যা মহান চির কল্যাণকর/ অর্ধের
তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
নারী – মাতা, ভগ্নি, বধূ, কন্যারূপে সংসারে মায়ার বন্ধন সৃষ্টি করে । তার
হৃদয় স্নেহ ভালবাসার মনি মঞ্জুষা। তার মমতার ঝর্ণাধারা একের সঙ্গে অপরের
সম্পর্ক মধুর করে। নারী মিষ্টভাষী। কথার জালে পরিবারের এবং সমাজের সঙ্গে
সকলকে সম্পৃক্ত করে। সন্তানের মাতা হিসাবে তার তুলনা নেই। সন্তানকে স্নেহ
ভালবাসা দিয়ে, সাহস দিয়ে সকল বিপদ আপদ থেকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো আগলে রাখে।
সন্তানকে মানুষ হতে দেখে জগতের সব যন্ত্রণা ভুলে যায় এই মহীয়সী নারী – এই
মা।
মা শব্দটি যেন মধুর , বন্ধনও তেমনি নিবিড়। দেশ কাল পাত্র ভেদে পাহাড়ে
অরণ্যে কিম্বা মরু অথবা মেরু অঞ্চলে – সর্বত্র মা একজন মা –ই । সে যে তুলনা
রহিত –সন্তানের মাতা।
একটি বিদেশী গল্প প্রচলিত আছে। নাম তার ‘মাদার ট্রি’ যার বাংলা নাম ‘গাছ
–মা।’ এই বৃক্ষমাতার একটি সন্তান ছিল। সে বড় হয়ে তাকে ছেড়ে চলে গেল নিজের
জীবনের সন্ধানে। একদিন সে মায়ের নিকট এসে বলে,
- মা, আমার টাকার প্রয়োজন।
মা বললেন,
- কি দিই বাছা! আমার পত্র পল্লব ছিন্ন করে নিয়ে যাও। তোমার চাহিদা পূরণ
হবে।
পুত্র চলে গেল। কিছুকাল পর আবার সে মায়ের কাছে এলো। একই আবদার। মা বললেন,
এবার তুমি আমার ডালপালা কেটে নিয়ে যাও। তাতে প্রয়োজন মিটবে। তাই হলো। বেশ
কিছুদিন পর আবারও এলো সে। বললো, এবার কি দিতে পারো?
মা বললেন,
- গোড়া থেকে করাত দিয়ে কেটে নাও। তাতে অনেক মুদ্রা পাবে। তোমার অনেক অভাব
ঘুচে যাবে।
পুত্রের দুরবস্থা দেখে বৃক্ষ মাতা চোখের জল রোধ করতে পারে না। দীর্ঘদিন
অতিক্রান্ত হলো। পুত্রের দেখা নেই। হয়তো ভাল আছে। অকস্মাৎ একদিন পুত্র এসে
হাজির। বিধ্বস্ত, বিমর্ষ, বয়স্ক। খুঁজে পায় না কোথায় তার মা? যে নাকি মায়া
দিয়ে, ছায়া দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে নিজের সব উজাড় করে দিয়েছিলেন। হঠাৎ মায়ের কন্ঠ
শুনতে পেল ছেলে।
- কি জন্য এসেছ বাছা?
- মা, আমার তো কিছুই নেই।
মা বললেন,
- আমারও কিছুই নেই বাছা। তুমি তো বড্ড ক্লান্ত। শুকনো পাত আর শুকনো বালি
সরিয়ে দেখ, এইখানে আমি। আমার গুড়িটিতে বস। একটু জিরিয়ে নাও। তোমার ক্লান্তি
দূর হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে আজ লক্ষ লক্ষ মানুষ ইউক্রেইন থেকে প্রাণ রক্ষার্থে আশ্রয়ের
সন্ধানে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ছুটে চলছে। সেখানে আবহাওয়া কতই না
প্রতিকূল, কতই না ভয়ানক ঠাণ্ডা। সেখানে প্রতিটি মা তার এক সন্তানের হাত ধরে
আরেক সন্তানকে কোলে নিয়ে হেঁটে চলছে মাইলের পর মাইল। আহার নেই, নিদ্রা নেই,
নিশ্চিন্ত গন্তব্য নেই। এরকম একজন মায়ের ছবি দেখলাম পত্রিকায়। প্রচন্ড
ঠান্ডার মধ্যে রেল স্টেশনে ভারি গরম পোশাক পরিহিত আতঙ্কিত মা বেঞ্চে বসে
অপেক্ষা করছেন। ক্রোড়ে তার শিশু সন্তান ভারি গরম কাপড়ে তারও আপাদমস্তক
ঢাকা। ঘুমাচ্ছে নির্ভয়ে। এ দৃশ্য দেখে আমার চোখের কোল বেয়ে অশ্রু নেমে এলো।
এই –ই তো আদি থেকে অনন্ত কালের মা!
নারী ভগ্নি – ভ্রাতা, ভগ্নির সম্পর্ক তুলনাহীন। স্নেহ মমতায় পূর্ণ
মণিমাণিক্যের মতো দামী, উজ্জ্বল। এ সংসারে ভাই বোনের ন্যায় আর আপন কেউ নেই।
এ সম্পর্ক কেবল বোনই তৈরী করে এবং ধরে রাখে চিরকাল। ভাইয়ের মঙ্গল চিন্তায়
বোন সারাজীবন ব্যাকুল থাকে।
‘কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি, কত বোন দিল সেবা
বীরের স্মৃতি স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কে বা।’
নারী বধূ – কেবল বধূই নহে বন্ধুও বটে। এই পৃথিবীর আকাশ – বাতাস, পাহাড় –
নদী, ঝর্ণা, ফুল –ফল, শস্য শ্যামল বিস্তীর্ণ অঞ্চল – এসবই নারী তার পুরুষ
সংগীকে নিয়ে উপভোগ করবার জন্যই প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন। পাখির কন্ঠে জেগে
উঠে প্রভুর সুমধুর জয়গান। পুরুষ রমণী মিলে এই জয়গান, নদীর কলতান, সাগরের
বিরহি গর্জন – অন্তর হতে অন্তরে সঞ্চারিত করে। তারা হারিয়ে যায় অন্য কোন
মোহময় জগতে, অন্য কোথাও মহামিলনের অন্তঃপুরে।
নারী কন্যা – বিধাতার এক অপূর্ব উপহার। একটি কন্য সন্তানের সঙ্গে হীরা,
মতি, জহরতের তুলনা চলে না। সে যে আঁধার ঘরের আলো। স্নেহ মমতার উৎস। তার
জাদুকরী হাসি, আনন্দ পদচারণা, সবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া – সে এক অপূর্ব মধুময়
অনুভূতির সঞ্চার করে।
সভ্যতার অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে নারীর অগ্রযাত্রা থেমে নেই। ঘর, সংসার
রক্ষা করা সন্তান লালন, পালন করা, মনুষ্যত্বের শিক্ষা দান করা, অফিস আদালতে
দক্ষতার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করা – কোনদিকে নয়? সর্বদিকে আজ নারীর
জয়জয়কার। তবুও স্বীকার করতেই হয় আজও নারী নিগৃহীত, নির্যাতিত। এই
নির্যাতনের কারণ নারীর অশিক্ষা। অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং অন্য নারীদের
সহযোগিতার অভাব। নারী পুরুষ উভয়কেই নিপীড়িত নারীদের রক্ষা করবার দায়িত্ব
নিতে হবে। তাদেরকে সামনে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।
প্রকৃতিগত ভাবে নারী দুর্বল। অনেক বর্বর পুরুষ এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহন
করে। নারীর উপর তাদের বাহুবল প্রয়োগ করে। মেয়েদেরকে শারিরীক ও মানসিক
অত্যাচারেরে হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য পিতা, ভ্রাতা, স্বামী ও পুত্র
হিসাবে পুরুষদেরকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
সাম্প্রতিক কালে CEDAW নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরী হয়েছে। এটি হচ্ছে
Convention on Elimination of all forms of Discrimination Against Woman.
এই প্রতিষ্ঠানটি নারী নির্যাতন নিবারনের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। আশাকরি
দিনে দিনে নারীরা একটি সুন্দর, সুশীল সামাজিক পরিবেশে সম্মানজনক জীবন
কাটাতে পারবে।
কাজীনজরুল ইসলাম রচিত ‘নারী’ কবিতা পাঠ করলে আর কিছু বলবার বাকী থাকে না।
তবুও দু’চারট পংক্তি বলা প্রয়োজন মনে করি। কবি বলেছেন, “পুরুষ হৃদয়হীন –
মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ।”
“নারীর বিরহে, নারীর মিলনে নর পেল কবি প্রাণ,
যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইলো গান।”
“এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ –রস –মধু –গন্ধ সুনির্মল।
জ্ঞানের লক্ষী, গানের লক্ষী, শস্য – লক্ষী নারী,
সুষমা –লক্ষী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি। ”
কবি আরো বলেছেন,
“সেদিন সুদূর নয় –
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়।”
আজ লক্ষ্য করা যাচ্ছে নারীর অগ্রযাত্রা। পুরুষের চাইতে নারীর যোগ্যতা ও
দক্ষতা কোন অংশেই কম নয়। জীবনের সর্বক্ষেত্রে ঘরে অথবা বাইরে নারী আজ
পুরুষের সঙ্গে সমান তালে তার নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রাখছে। নারী
ধৈর্য্যশীল, বিশ্বস্ত। ক্ষমাশীলও বটে। আজ চারিদিকে নারীর জয়জয়কার। জীবন
যাত্রার মানও উন্নত করছে। পরিবার ও সমাজে নারী সসম্মানে অগ্রসরমান।