-ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রাজ্জাক
ছাত্র জীবনে আমরা গ্রীষ্মের ছুটিতে দুই মাস কাজ করতাম। আমরা যারা একটু
দরিদ্র পরিবার থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলাম, গ্রীষ্মের ছুটিতে তাদের
বাড়ি আসা হত না। হয় মস্কোতে অথবা সোভিয়েত ইউনিয়নের কোন জায়গায়, যার
যার সাধ্যমত কাজ করতো, কেউবা আবার লন্ডনে গিয়ে কোন রেস্টুরেন্টে কাজ করতো।
তৃতীয় বর্ষ শেষ করে গ্রীষ্মের ছুটিতে লন্ডন যাব কাজ করতে, সেই ভাবে
প্রস্তুতি নিলাম। আমরা লন্ডন যেতাম ট্রেনে করে। যার কারণে প্রথমে ভিসা নিতে
হতো ব্রিটিশ এম্বাসি থেকে। তারপরে পোল্যান্ডের ভিসা, ইস্টজার্মানির ভিসা,
ওয়েস্ট জার্মানির ভিসা, নেদারল্যান্ডের ভিসা অথবা বেলজিয়ামের ভিসা। এইসব
ভিসা যোগাড় করতে প্রায় সাত দিন কেটে যেত।
মস্কো থেকে ট্রেনে যাত্রা করতাম, একদিন লাগতো পোল্যান্ড যেতে, সেখানে ৬
ঘন্টার যাত্রা বিরতি থাকতো, ইচ্ছে করলে যে কেউ ওয়ারস শহর ঘুরে দেখতে পারত,
তারপরে ট্রেনে ইস্ট জার্মানি হয়ে ওয়েস্ট জার্মানিতে, ওয়েস্ট জার্মানি
থেকে আবার ট্রেন চেঞ্জ করে কেউ কেউ নেদারল্যান্ডের হুক ভ্যান হল্যান্ড থেকে
আটঘণ্টার ফেরিতে, ব্রিটিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে, হারউইচ হয়ে লন্ডন যেতেন।
কেউবা আবার জার্মানি থেকে বেলজিয়াম হয়ে ইউরো চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ডোভার
হয়ে লন্ডনে যেতেন।
ট্রেনের স্লিপিং বেডে খুবই আরামদায়ক ভ্রমন ছিল, তিন দিনে লন্ডন যাওয়া,
তার মাঝে তিন চারটি দেশ ভালোভাবে দেখা, মাঝে মাঝে রেস্ট নেওয়া ,কোন কোন
দেশে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ানো, কতইনা আনন্দের ভ্রমন ছিল।
ছাত্রজীবনে এই ট্রেন জার্নি আমি খুব উপভোগ করেছি, অনেক কিছু দেখেছি শিখেছি।
এবার আসল কথা বলি, টাকা সেভ হয়েছে ৮ ভাগের ৭ ভাগ। এত বড় জার্নিতে মোটের
উপর খরচ হতো ২৫ ডলার। বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়ানো প্রকৃতি দেখা মাঝে মাঝে
ইউরো রমণীদের সাথে একই বগিতে ভাগাভাগি করে বসে, যে আনন্দ পেতাম সেটা ছিল
ফাও।
আমি লন্ডন থেকে সাসেক্সে স্টামফোর্ড লিয়া হোপ নামক একটি ছোট্ট শহরের
রেস্টুরেন্টে কাজ করতে গেলাম। লন্ডন শহর থেকে তিন পাউন্ড দিয়ে মেট্রো
রেলের টিকিট কাটলাম। মেট্রো রেলের শেষ স্টেশন থেকে, অপর প্রান্তের ট্রেনে
আধা ঘন্টার জার্নিতেই স্টানফোর্ড লিয়া হোপ শহরে পৌঁছে যাওয়া যায়। আমার
টিকিট ছিল শুধু লন্ডন মেট্রোর আওতাভুক্ত স্টেশন পর্যন্ত। আমাকে কোন একজন
বলেছিল এই কানেক্টিং ট্রেন আর ভাড়া লাগবে না, আমার কোন স্টেশন চেঞ্জ করতে
হয়নি উঠে বসলাম অপর প্রান্তের ট্রেনে। তিন স্টপেজ যাওয়ার পরে টিকিট চেকার
আসলো, টিকিট দেখাতে বলল, টিকিট দেখালাম, টিকিট চেকার বলল এত মেট্রো টিকেট
কানেক্টিং ট্রেনের টিকিট কোথায়। টিকিট চেকার বলল ১০ পাউন্ড জরিমানা। একটা
রিসিট কেটে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। আমি বললাম, আমি লন্ডনে প্রথম, আমাকে একজন
বলেছে, এক টিকিটেই ওখানে যাওয়া যাবে। আমি বললাম, আমি ছাত্র মস্কো থেকে
এসেছি। টিকিট চেকার আমার পাসপোর্ট দেখতে চাইল, পাসপোর্ট দেখালাম, আসলেই আমি
প্রথমবার গ্রেট ব্রিটেনে সবেমাত্র গতকালকে এসেছি। টিকিট চেকার আমার হাত
থেকে রিসিটটা নিয়ে একটা ক্রস চিহ্ন দিয়ে বলল, সরি স্যার আপনার টিকিট
লাগবে না, আপনি আমাদের দেশের গেস্ট। মনটা খুশিতে ভরে গেল, একে তো টিকিটের
পয়সাও নিলনা তারপর আবার স্যার বলে দুঃখ প্রকাশ করল। ব্রিটিশদের উপর
কৃতজ্ঞতায় আমার মনটা ভরে গেল, আসলেই তারা সভ্য জাতি, মনে মনে ভাবলাম।
বেলা বারোটার দিকে স্টামফোর্ড লিয়া হোপ শহরে পৌছালাম। সেখানে গিয়ে আমি যে
রেস্টুরেন্টে কাজ করব, সেই রেস্টুরেন্টের নাম "ওয়ে টু দ্যা রাজ" ওখানে চলে
গেলাম।
দুপুরবেলা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট কোন খাবার পরিবেশন করা হয় না শুধু রাতের
জন্য সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখে, বিভিন্ন টাইপের তরকারি কেটে, মাছ মাংস কেটে,
রেস্টুরেন্ট পরিষ্কার করে সাজিয়ে রাখে। রেস্টুরেন্টে ঢুকার পরে সালাম
বিনিময় করলাম সবাই বাঙালি, ওয়ালাইকুম সালাম বলার পরে, একজন জিজ্ঞেস করল
"খিতারে বা ভালোবুড়া আছোইনি", আমি বললাম, আমি ভালো আছি, আপনারা ভালো
আছেন?।
এক ভদ্রলোক তার শরীরের ওজন হবে মনে শূন্য ৩৮ সের, বড় বড় গোঁফ, ভদ্রলোক কে
সবাই মচুয়া ভাইসাব বলে ডাকে। মচুয়া ভাইসাব ঐ রেস্টুরেন্টের তন্দুরি সেফ।
তার পাওয়ার অনেক। মচুয়া ভাই সাহেব আমার কাছে জিজ্ঞেস করল, "সিলেটত আইছি
না ঢাকাত আইছি"। আমি বললাম বরিশাল থেকে এসেছি। মচুয়া ভাইসাব বলল, "ঐ এখই
খথা সিলোটি বাদে বেভাকগুনে (সকলে) ঢাকাইলা"। যাহোক ভালো-মন্দ কথার পরে
আপ্যায়ন করল দুপুরে খেলাম রেস্টুরেন্টের উপরে একটি রুমে থাকার ব্যবস্থা
করে দিল। রুমটিও বেশ সাজানো গোছানো, দুপুরে খাবারটা ভালো হলো খুবই আরাম
অনুভব করলাম।
সবার কথা মত কালো প্যান্ট সাদা শার্ট মস্কো থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম, ওয়েটার
জন্য যথার্থ ড্রেস। পাঁচটার সময় রেস্টুরেন্টে নামলাম, মালিক আসল। পরিচয়ের
পরে সবকিছু বুঝিয়ে দিল আমার কাজের পরিধি কি। যেহেতু আমি প্রথম তাই আমার
পদবী কমি ওয়েটার। বারে কাজ করতে হবে, বিভিন্ন ধরনের সফট এবং হার্ড
ড্রিংকস, কোন কোন গ্লাসে যায়, সেই গ্লাসে করে কাস্টমারের টেবিলে পৌঁছে
দিতে হবে এবং হিসাব রাখতে হবে ও বিলের সাথে যুক্ত করতে হবে। কাজটি আমার
কাছে খুবই সুবিধার মনে হলো, বারের মধ্যে বিভিন্ন কোলড্রিংস আছে যেমন কোক
পেপসি সেভেন আপ মিরিন্ডা এসপ্রাইস অরেঞ্জ জুস পাইনাপেল জুস গ্রেফফ্রুট জুস
ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপরে আছে হার্ড ড্রিংকস নামগুলো ও পরিবেশনার
ধারাবাহিকতা না বললেই নয়। প্রথমে দিতে হয় বিয়ার তারপরে অ্যাপিটাইজার,
ওয়াইন, তারপরে অ্যালকোহল অর্থাৎ হুইস্কি ব্রান্ডি ভদকা সাউদান কমফোর্ট,
রাম, জিন, বাকার্ডি।
খাওয়ার শেষে দিতে হয় লিকার যেমন টিয়া মারিয়া, মালভিউ কন্ট্রো, ইত্যাদি
ইত্যাদি, কফি বানিয়ে দিতে হতো। ব্রিটিশরা কফির সাথে বিভিন্ন ধরনের লিকার
খেত। কফির সাথে লিকার মিশিয়ে উপরে ফ্লোটিং ক্রিম দিয়ে কফি বানিয়ে দিতে
হতো। এখানে অনেক কিছু শেখার ছিল। সাদা সাহেবদের মন জয় করা কত যে কঠিন মনে
মনে ভাবলাম।
মেনু দেখে বিভিন্ন আইটেমের নাম মুখস্থ করার সাথে সাথে, কি কি দিয়ে তৈরি
হয় সেটাও মুখস্ত করতে হলো, দামটা কত সেটাও জেনে নিতে বলল,
কেননা মানি রিসিটে দাম আমাকেই বসাতে হবে, তাই মুখস্থ থাকলে তাড়াতাড়ি
এগুলো আমি যোগ করতে পারব।
বিভিন্ন কারীর নামগুলো এরকম, চিকেন কোরমা চিকেন কারি, চিকেন মাদ্রাজ, চিকেন
ভিন্ডালু, চিকেন পাল, চিকেন রোগান জোশ, চিকেন সিজলিং, বালতি চিকেন ইত্যাদি
ইত্যাদি। বীফের বেলায়ও একই রকম নাম। সাথে থাকতো পোলাও রাইস অথবা নান
ব্রেড, নানের আবার রকমভেদ আছে, যেমন প্লেন নান, বাটার নান, গার্লিক নান,
কুইলছা নান, কোকোনাট নান ইত্যাদি।
এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি বিভিন্ন খাবারের নাম, ভ্যারাইটিজ কারি ও সবজির
নামসহ মূল্যটাও মুখস্ত করে ফেলেছিলাম। অর্থাৎ আমি ওই রেস্টুরেন্টের অন্য
সবার মত একজন কর্মীতে পরিণত হলাম।
গ্রেট ব্রিটেনে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে সাধারণত বেশি লোক খেতে আসে শুক্রবার
এবং শনিবার রাত্রে। অন্যান্য দিন তেমন একটা লোক সমাগম হয় না। ওই
রেস্টুরেন্টে প্রায় প্রতিদিনই এক ভদ্রলোক খেতে আসতেন ভদ্রলোকের নাম জে আর
দত্ত বাঙালি ভদ্রলোক প্রায় পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা, মাথায় সাদা চুল
গুরুগম্ভীর চেহারা তবে খুবই উৎফুল্ল মনের মানুষ। দত্ত বাবু ছিলেন সলিসিটার।
রাত দশটার দিকে খেতে আসতেন সাড়ে ১১ টা অব্দি খেতেন। তবে পানীয় পান করতেন
বেশি, দত্তবাবুর জন্য একটি নির্দিষ্ট টেবিল ছিল। নির্দিষ্ট টেবিলে বসে খেতে
খেতে অনেক গল্প করতেন।
ভদ্রলোকের সাথে কথা বললে বোঝা যেত বেশ লেখাপড়া জানা এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল
মানুষ। প্রতিদিন উনি প্রায় ৩০ থেকে ৪০ পাউন্ডের খাবার খেতেন, অবশ্য বেশির
ভাগই ছিল পানীয় বিল। প্রতিদিন খাবার পরে ভদ্রলোক ৫ থেকে ১০ পাউন্ড টিপস
দিতেন। এক কথায় বলতে গেলে রেস্টুরেন্টের সবাই ভদ্রলোকে খুব পছন্দ করতেন।
দুই সপ্তাহ যাওয়ার পরে আমার সাথে বেশ ভাব হয়ে গেল ভদ্রলোকের। বিভিন্ন
গল্প করতাম, দেশের কথা রাশিয়ার কথা, জীবনের বহু গল্প করেছি দত্ত বাবুর
সাথে, দত্ত বাবুও আমার সাথে মন খুলে গল্প করতেন। রেস্টুরেন্টে এসে প্রচুর
টাকা-পয়সা খরচ করতেন।
আমার সাথে ভালো ভাব হওয়ার পরে আমার জীবন কাহিনী শোনার পরে ভদ্রলোক আমার
কাছে বললেন তুমি মস্কোতে পড়াশোনা শেষ করে দেশে চলে যাবে যদি বিদেশে আসতে
হয় তবে পড়াশোনার জন্য আসবে বা সাময়িক চাকরির জন্য আসবে, জীবনকে কোন দিন
বিদেশের মাটিতে স্থায়ী ভাবে বসবাসের চিন্তা নিয়ে আসবে না। আমি একটু
অপ্রস্তুত, আমি দত্তবাবুর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, আপনিতো একজন প্রথিতযশা
ব্যারিস্টার সলিসিটার, অনেক প্রতিপত্তির অধিকারী, আপনি এই কথা বলছেন কেন?
ভদ্রলোক বললেন আমি এই দেশেই বিয়ে করে ঘর সংসার পেতেছিলাম ভালো জীবনের
আশায়। প্রথম দুই চার বৎসর ভালো জীবন ঠিকই পেয়েছি, প্রতিপত্তি সহায় সম্পদ
অর্জিত হয়েছে, কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে সবকিছু বিসর্জন হয়ে গিয়েছে।
দত্ত বাবু বললেন এক ছেলে এক মেয়ে একজন থাকে ম্যানচেস্টারে একজন থাকে
ওয়েলসে, স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক নাই ১০ বছর। এই বয়সে কোন কিছুই করতে পারছি
না, সেই জন্য তোমাদের রেস্টুরেন্টে এসে রাতের খানিকটা সময় কাটিয়ে যাই।
তোমাদের মাঝে আমার এই সময়টা ভালো কাটে।
এরকম কিছু দিন যাওয়ার পরে যখন ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেল, রাতের খাবারের শেষের
দিকে উনি মনের কথা বলতে শুরু করতেন। আমি ছাত্র মানুষ মস্কোতে পড়াশোনা করি
হয়তো আমি ওনার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি ভেবে, একদিন আমাকে উপদেশ স্বরূপ একটি
কথা বললেন।
শোনো বাবা, আমার অনেক স্বর্ণালী অতীত ছিল, যার কারণে আমার প্রতিপত্তি
হয়েছে আমি এখন খরচ করতে পারি। তোমার সামনে অনেক ভবিষ্যৎ তুমি আমার মত
এইরকম জীবন এখন চিন্তা করবা না।
উনি সহাস্যে একটি কথা বললেন, "যার অতীত আছে সে খরচ করতে পারে, হিসেবে এবং
বেহিসেবেও। যার ভবিষ্যৎ আছে সে শুধু সৎ ভাবে চলবে সৎ উপার্জন করবে এবং
সংযমী আচরণ করবে"। উনি বললেন আমার অতীত ছিল আমি খরচ করছি, তোমার ভবিষ্যৎ
আছে তুমি সংযমী হবা।
সেদিন থেকেই আমি উনার কথাটাকে খুব ভালোভাবে নিয়েছিলাম, কথাটি মনে ধরেছিল,
জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে অনেক কিছুই করা যায়। প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগ
পর্যন্ত কঠোর সংযমী হতে হয়।
১০/০৭/২০
বিয়ে ভেঙে দিলাম
রত্না চক্রবর্তী
৩.৫.২১
বিয়েটা শেষে ভেঙে দিলাম। বিয়েটা প্রেমের ছিল না আবার সম্বন্ধ করেও ছিলনা।
অরিত্র আগে বিয়ে হয়েছিল একবার, স্ত্রী মারা গেছে। তারপর সে বহুকাল বিয়ে
করেনি। আমার এমএ পড়ার সময় ইউট্রাস ওভারিতে টিউমার হওয়ায় ইউটেরাস ওভারি
বাদ গেছে আমিও বিয়ে করিনি। আমরা একই অফিসে কাজ করি। দুজনের মধ্যে একটা
বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমাদের যথেষ্ট বয়স হয়েছে। আমার প্রায়
আটত্রিশ বছর আর অরিত্রের বিয়াল্লিশ বছর। একটা প্রয়োজন বোধ করছিলাম সাথীর
জন্য, একে অপরের সঙ্গে সুখে থাকতে পারবো বলে, দুজনেরই ভাগ্যচক্রে বেশ মিল
ছিল। আমার বাবা-মা সম্প্রতি মারা গেছে। অরিত্রের বাবা মা নেই। আমার এক দাদা
আছেন বিদেশে। অরিত্রের এক বোন বিয়ে হয়ে গেছে। এক জায়গায় চাকরি করি তাই
বনিবনা হবার অসুবিধা নেই। ভাবলাম আমরা বিয়েটা করব। খুব ভালবাসতাম অরিত্রকে
বা ওকে ছেড়ে থাকতে পারবো না এমন ব্যাপার নয়। আবার খুব যে প্রয়োজনে বিয়ে
করেছিলাম তাও নয় দুজনের দুজনকে ভালো লাগতো, অবস্থা গতিক মেলে তাই ঠিক
করেছিলাম... এই আর কি...
আমি হোস্টেলে থাকি তাই অরিত্র আমার এখানে খুব কমই আসে, ফোনে কথা হতো। আমি
বরং মাঝেমাঝে অফিস ফেরত অরিত্রর বাড়ি যেতাম। ছুটির দিনে আমরা বাইরে কোথাও
একটু ঘুরে আসতাম, এই আশেপাশে। ওর বাড়ি গেলে আমি তার সমস্ত বাড়িঘর ঘুরে
দেখতাম। ভবিষ্যতে কোন ঘরটা কি হিসাবে ব্যবহার করব সেই নিয়ে মনে মনে
পরিকল্পনা করতাম। প্রথম যখন বাড়ি যাই তখন ওর স্ত্রীর একটা ফটো দেয়ালে
টাঙানো দেখেছিলাম। পরেরবার যখন যাই তখন সেটা আর দেখিনি। অরিত্রর খারাপ
লেগেছিল যদি আমি কিছু ভাবি। ধ্যুৎ এসব আবোল-তাবোল ভাবার মতো আমাদের তত অল্প
বয়স আর নেই। আমি জেনেশুনে বিয়ে করছি অতএব এত মন ছোট করার মত কিছু নেই।
যাইহোক আমি ঠিক করেছিলাম এই শোবার ঘরটার বদলে পাশের ঘরটা শোবার জন্য
ব্যবহার করব। এই ঘরটা বড় কিন্তু পাশের ঘরটা একটু ছোট কিন্তু জানলা আছে
বেশি, হাওয়া বাতাস খেলবে।
রান্নাঘরটা একটু ঘুরিয়ে সাজাবার ইচ্ছা ছিল। যদি মডিউলার কিচেন করে নি তো
বেশ হয়। এই কথাটা আমি ওর সাথে আলোচনা করেছিলাম বসার ঘরে বসে। অরিত্র কফি
করে এনেছিল, আমি করতে যাচ্ছিলাম, অরিত্র বলল "তুমি যখন পার্মানেন্টলি এ
বাড়িতে এসে থাকবে তখন আমি একদিনও করব না এখন তুমি আমার কফি খেয়ে দেখো। "
আমরা কাজু কফি খেতে খেতে কথা বলছিলাম। আমি বললাম "সমস্ত তাকগুলো খুলে ফেলে
দিতে হবে, আমি মডিউলার কিচেন করার ব্যবস্থা করব, জায়গাটা অনেক বেড়ে যাবে। "
আমরা যখন এসব আলোচনা করছি ঠিক তখনই রান্নাঘর থেকে হুড়মুড় করে একটা শব্দ
হলো, সঙ্গে সঙ্গে বাসন পড়ার ঝনঝন শব্দ। আমি অরিত্র দুজনেই চমকে গেলাম।
প্রায় ছুটে রান্নাঘরের কাছে এসে দেখি কিভাবে যেন বাসনের তাক থেকে সমস্ত
জিনিস নিচে পড়ে গেছে। বড় ইঁদুর আছে নাকি! আমি ভাবলাম। অরিত্র অবাক হয়ে
বললো "কি করে পড়ল! আমি তো তাকে হাতই দিইনি। গ্যাসের পাশেই কাপ রাখা ছিল।"
যাইহোক কিছু ভাবে একটা পড়েছে। আমরা জিনিস গুলো গুছিয়ে রাখলাম। সেদিনের মত
আর রান্নাঘর নিয়ে কথা হলো না। দুই দিন বাদে আমি আবার ও বাড়ি গেলাম। আমি
ওকে বললাম, "একটা দড়ি বা ফিতে নিয়ে এসো খাটটা মেপে দেখতে হবে, ওঘরে রাখলে
কতটা জায়গা ফাঁকা থাকে। সেই জায়গাটায় ছোট আলমারি রাখলে পাল্লাটা খোলা
যাবে কি? "
মাপার ফিতে পেলাম না বাধ্য হয়ে একটা দড়ি দিয়েই মাপটা নিলাম। মনে হল খাট
ঢুকে যাবার পর আলমারি হয়তো ঢুকবে না। আমরা আবার আলমারিটা আলাদা করে মেপে
পাশের ঘরে দুজনে গেলাম পেন্সিল দিয়ে মেঝেতে দাগ দিয়ে দেখবো কতটা জায়গা
লাগছে। এমন সময় আবার একটা ধুপধাপ করে কিছু পড়ার শব্দ হলো। আমরা শোবার ঘরে
এসে দেখি আলমারির পাল্লাটা খুলে গেছে আর ভিতরে অ্যালবাম, কিছু বই আর প্রচুর
কাপড়-জামা মাটির মধ্যে পড়ে গেছে। অরিত্র মুখ নিচু করল। জামা কাপড়গুলো
সবই শাড়ি ব্লাউজ। এ আলমারিটা অরিত্রকে ব্যবহার করতে দেখি নি। ও বাইরের ঘরে
আলমারিতেই নিজের জিনিস রাখে বুঝলাম এটা ওর আগের বউয়ের আলমারি ছিল। শাড়ি
জামা কাপড়গুলো অরিত্র ফেলেনি বা কাউকে দেয়নি। সে যে বউকে ভালোবাসতো তা
আমি জানি, বিয়ের বছর দুই পরে সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায়।
তখন সে ছয়মাসের প্রেগন্যান্ট ছিল। এত অবস্থা খারাপ হয় যে বাঁচানো যায়নি।
এসব কথা অরিত্র আমায় বলেছে, সেই জন্যেই সে এতদিন বিয়ে করেনি। মেয়েটির
সুন্দরী ছিল, বেশি লেখাপড়া শেখেনি। মাধ্যমিক পাশ করে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল,
খুব গরীব ঘরের মেয়ে ছিলো। খুব যত্ন করতো অরিত্রকে, সংসার করতে খুব
ভালোবাসত। অনেকটাই বয়সের পার্থক্য ছিল ওর সঙ্গে কিন্তু ওরা সুখী ছিল। তাই
ও মারা যাবার পর বিয়ে করতে পারিনি কিন্তু এখন বয়স বাড়ার পর মনে হয় একটা
অসুস্থ হয়ে পড়লেও দেখার লোক নেই। নিজের লোক ছাড়া সেটা হয় না। আমারও তাই
অবস্থা। তাই আমরা বিয়ের কথা ভেবেছি।
আমি জিনিসগুলো যত্ন করে গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললাম ওর আপনজন কেউ নেই? থাকলে
তাকে দিয়ে দিও। নয়তো কত গরীব দুঃখী মানুষ আছে পেলে তোমায় আশীর্বাদ করবে,
তার আত্মা শান্তি পাবে। অরিত্র কিছু না বলে ঘাড় নাড়লো।
এরপরে বেশ কিছুদিন আমাদের আসা যাওয়া হয়নি। অফিসে অডিট চলছিল চাপ যাচ্ছিল
দুজনেরই। একটু রিল্যাক্স হতে একদিন আমরা ঠিক করলাম দক্ষিণেশ্বর বেড়াতে
যাবো। দক্ষিনেশ্বর থেকে আনন্দ করে ঘুরে এসে অরিত্র বলল, "তুমি এখানে খেয়ে
যাও। "
আমরা খাবার কিনে বাড়ি ঢুকলাম। অরিত্র খাবার কিনে এনে টেবিলের ওপর রাখল।
টেবিলটা বেশ ছোট, দুটো চেয়ার। খাবার ঘর সে তুলনায় বেশ বড় । আমি বললাম, "
অরিত্র এ টেবিলটা বদলে ফেলতে হবে। আমি একটা বড় টেবিল দেখে এসেছি,ছয়টা
চেয়ার রাখব লোকজন এলে... কথাটা আমার শেষ হলো না.... কিভাবে যে টেবিলে
ধাক্কা লাগল আর টেবিল থেকে সব খাবার ছড়িয়ে পড়ে গেল বুঝলাম না। আমরা অবাক
হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। ফয়েল মোড়া প্যাকেট খুলে মেঝেতে খাবার ছড়িয়েছে।
অরিত্র বলল, "আমি একদমই ধাক্কা দিই নি। "
তার গলায় অবিশ্বাস! আমি সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি কথাটা যখন বলছিলাম তখন
সামনের বেশিনে দাড়িয়ে হাত ধুচ্ছিলাম সাবান দিয়ে। আমি আয়নায় দেখেছি
অরিত্র দূরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে! টেবিল থেকে খাবার পড়ার কোন প্রশ্নই আসে
না! কোন বেড়াল ইঁদুর কোন কিছুই নেই। আমি অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম ঘটনা একটা না
পরপর তিনদিন ঘটলো।
ব্যাপারটা অরিত্র বোধহয় খুব অদ্ভুত লেগেছিলো। আগেই বলেছি আমরা যতটা না
প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলাম তার চেয়ে বেশি বন্ধু ছিলাম। অরিত্র একটু লাজুক
প্রকৃতির ছেলে তবু সে বলল "আমি ভাবছি বাড়িটা চেঞ্জ করা দরকার, এই বাড়িতে
নাই বা থাকলাম. অন্য বাড়ি, অফিসের কাছাকাছি হলে ভালো হয় এমন জায়গায়,
আরেকটু ছোট বাড়ি নিলেও তো আমাদের চলে যাবে। "
এবার আরেকটা ঝনঝন শব্দ আমরা দুজন শোবার ঘরে ঢুকলাম। আলমারির মাথা থেকে একটা
ছবি নিচে পড়ে গেছে। কাঁচ ছড়িয়ে মেঝেময়। ছবিটা উলটে পড়ে আছে । দেয়াল থেকে
খুলে স্ত্রীর ছবি আলমারির মাথায় রেখে ছিল অরিত্র। সেটা পড়ে ভেঙে টুকরো
টুকরো হয়ে গেছে। আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। ওর হাত ধরে বললাম "অরিত্র
বিয়ে আমরা করব না। সে সংসার পেতে ছিল, এই সংসার ঘরবাড়িকে বড় ভালোবাসে। আমি
বুঝি আমাদের দেখাশোনার লোকের অসুবিধে। বিয়ে না করেও আমরা সারা জীবন বন্ধু
হয়ে থাকতে পারি। এতগুলো কাকতালীয় ঘটনা ঘটতে পারে না এই ছবি ভেঙে যাওয়ায়
আমার মনে বড় কষ্ট হয়েছে। প্রতিটি কথাই যখন সে শুনতে পায় তাই আমি বলছি
তোমার অসুখ-বিসুখে আমি তোমার দেখাশোনা করব, তুমিও আমার অসুখ-বিসুখে পাশে
থেক। বিয়ে করলেও কে আমরা আগে মরে যাব, কে বাঁচব তার ঠিক আছে কি? আমি এ
বাড়ি আসবো তবে এ বাড়ি যেমন আছে তেমন থাকবে। কোন জিনিসের পরিবর্তন করা হবে
না। কালই ছবিটা আমি বড় করে বাঁধিয়ে আনবো। যার সংসার তারই থাক। কাউকে দুঃখ
দিয়ে সংসার করার ইচ্ছা আমার আর সেই বয়সে নেই। আমার কোন রাগ অভিমান নেই।
নির্মল ভালোবাসাটাই না হয় থাক আমাদের মধ্যে। তাতে দেখবে আমরা সবাই ভালো
থাকবো।"
হঠাৎ থেমে আমি বললাম " কি ভাই ঠিক বলেছি তো? "
আমাদের চমকে দিয়ে কোথা থেকে একটা টিকটিকি বলে উঠল " ঠিক ঠিক ঠিক। " আমরা
হেসে ফেল্লাম।।