রবীন্দ্রজয়ন্তী বা পঁচিশে বৈশাখ বাঙালি জাতির একটি অন্যতম
গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উৎসব। বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে, প্রতি বছর বৈশাখ
মাসের ২৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে এই উৎসব
পালিত হয়। কার্তিকের কুয়াশার এবারের সংখ্যা, বহুবিদ্যাজ্ঞ কবিগুরু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে, বাঙালির ভাষা ও সাহিত্য,
শিক্ষা ও সংস্কৃতি, মন-মানসিকতা বিকাশে তাঁর মহীরূহপ্রতীম অবদানের
প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ ঋণস্বীকার। এই বহু বিষয়ে কৃতবিদ্য ব্যক্তি ছিলেন
অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর,
ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। আমাদের বাংলা
ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক তিনিই, তাঁর বিকল্প ছিল না, নেই এবং
হয়তো থাকবেও না।
২৫ বৈশাখ ১২৬৮ (৭ মে ১৮৬১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার এক ধনাঢ্য ও
সংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৯০
থেকে কিঞ্চিদধিক অর্ধশতাব্দীকাল বাংলা কাব্য-আসরে রবীন্দ্রনাথ একচ্ছত্র
অধিপতির মর্যাদা লাভ করেছিলেন। স্বকীয় স্বভাবজাত ও অসামান্য বুদ্ধির
দানে সমকালীন অন্যান্য কবি তাঁর পাশে মলিন হয়ে পড়েছেন। গুরুদেব তাঁর
কাব্যজীবনের আদিপর্বে কলাবৃত্ত, মিশ্রবৃত্ত এবং দলবৃত্ত, - আধুনিক
বাংলা ছন্দের প্রধান এই তিনটি ফুলে কবিতার ডালা পূর্ণ করে কাব্যদেবীর
পায়ে অঞ্জলি দিয়েছেন। নীলরতন সেন, তাঁর "আধুনিক বাংলা ছন্দ" গ্রন্থে
লিখেছেন, "রবীন্দ্রনাথ এই যুগে কলাবৃত্ত ছন্দে যে রুদ্ধদলের দ্বিমাত্রক
উচ্চারণরীতি প্রয়োগ করেছিলেন, - অধিকাংশ কবিই বিংশ শতকে না পৌঁছে সে
সম্পর্কে সচেতন হতে পারেননি। মিশ্রবৃত্ত ছন্দে রবীন্দ্রনাথ নাট্যসংলাপ
থেকে স্বতন্ত্র, কবিতার উপযোগী যে মুক্তক ব্যবহার করেছেন, এ যুগে কোনো
কবিই সে ছন্দ ব্যবহারে উদ্যোগী হননি। ১৯০০ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত
রবীন্দ্রযুগের মধ্যপর্ব ধরা হয়। এই যুগে ভাবগত দিকে তিনি যেমন প্রেম,
প্রকৃতিচেতনা, এবং ঈশ্বরপ্রেম ও আধ্যাত্মিকতার স্তর একে একে অতিক্রম
করে এক নতুন গতিময় জীবনচেতনার স্তরে পৌঁছেছেন, ছন্দের দিক থেকেও তেমনি
প্রতিটি বিবর্তনস্তর নবীনতর প্রকাশভঙ্গিতে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। ১৯১০
সালে, ভাব ও ছন্দে বৈচিত্র্যের বরণ মালা রূপে কবি পাঠক-সমাজকে উপহার
দিয়েছেন "গীতাঞ্জলি" কাব্যগ্রন্থ। ১৯১৩ সালে প্রথমবারের মতো ইউরোপের
বাইরে কাউকে নোবেল পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হলো। বাংলা সাহিত্যে সেই এক
এবং অদ্বিতীয় কবি আমাদের রবি ঠাকুর। ১৯১৮ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত রবীন্দ্র
যুগের অন্ত্যপর্ব হিসেবে বিবেচিত। এ যুগেও রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছন্দে
নতুন বিভব সৃষ্টি করেছেন। এ যুগে বাংলাছন্দে রবীন্দ্রনাথের
সর্বাপেক্ষা উল্লেখ্য নতুন সংযোজন হলো গদ্যকবিতার ছন্দ। ছন্দের
সুনির্ধারিত মাত্রার হিসাব না মিললেও কিছুটা ইঙ্গিত, কিছুটা গতি ও যতির
স্পন্দমানতা গদ্য কবিতার শব্দ বিন্যাসে রক্ষিত হয়। সেকারণেই একে
ছন্দগন্ধি গদ্য বলা হয়। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে গদ্য
কবিতা এসেছে। তবে ছন্দের এই মুক্তিকে সম্পূর্ণ না বুঝেই আজকাল অনেকে
গদ্য কবিতার নামে যা লিখছেন তা ঠিক পাঠযোগ্য হয়ে উঠছে না। ইন্টারনেটের
যুগে প্রকাশনাও হয়ে উঠেছে সহজ। স্বঘোষিত কবি সংখ্যাও বেড়েছে ভয়ানকভাবে।
ভালো কবিতা তাই খুঁজে বের করা হয়ে পড়ছে কঠিন। গদ্য কবিতা লেখার সময় মনে
রাখতে হবে গদ্য কবিতায়, শব্দধ্বনির গতি ও যতির আবর্তনজনিত
প্রত্যাশাবোধের তৃপ্তি থাকতে হয়; ভাবের প্রত্যাশিত স্পন্দনমানতা থাকতে
হয়; বাকপর্বের প্রত্যাশিত বিন্যাস থাকতে হয়। এগুলির সমন্বয়েই
গদ্যকবিতার রূপাদর্শ গড়ে ওঠে।
এবারের সংখ্যায় কবিতা নিয়ে এসেছেন ফিরোজা হারুন, অরুণোদয় কুন্ডু,
মধুবন্তী আইচ, রত্না চক্রবর্তী, তাপস কুমার দাস, সাইদুজ্জামান। ছোট
গল্প লিখেছেন রত্না চক্রবর্তী এবং আব্দুর রাজ্জাক। সাহিত্য সংবাদ
পাতায় পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখেছেন অরুণোদয় কুন্ডু। বলতেই হয় সব ক'টি
কবিতাই সুছাঁদ শব্দবিন্যাসে লেখা। কার্তিকের কুয়াশার এ সংখ্যায়
নির্বাচিত কবিতা, ছোট গল্প এবং নিবন্ধ পড়ে আমার মনে হয়েছে বাংলা
সাহিত্যের শুধু অতীতই নয়, বর্তমানটাও স্বর্ণগর্ভ। রবীন্দ্র সংগীত
পরিবেশন করেছেন সোহেলী শাহানাজ স্বপ্না। স্বপ্নার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত
আর চারপাশের নিরবচ্ছিন্ন গাছপালায় শ্যামলিমা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
গুরুদেবের কবিতা, আবৃত্তি করেছেন মধুবন্তী আইচ। আবৃত্তিতে তাঁর এক
অনায়াস সিদ্ধি। দারুণ লেগেছে।
লীমা জামান শিল্পী,
সিলেট, বাংলাদেশ