-ফিরোজা হারুন
এদিকে মামা –মামী অনেক বিয়ের প্রস্তাব পরীক্ষা করে দেখলেন। পছন্দ
করার মতো দু’একটা পেলেন, কিন্তু মামার কলিগের পাশের বাড়ির ভদ্রলোক
নাছোড়বান্দা। তার খুব ইচ্ছে তার পরিচিত ছেলেটির সঙ্গে আমার বিয়ে হোক।
ছেলে স্বপ্রতিষ্ঠিত। ভাল প্র্যাকটিস করেন। ভবিষ্যত আরও ভাল। ব্যবহার
ভাল, দেখতে খারাপ নয়। কিন্তু আমার মনের দিক থেকে কোন সায় পেলাম না।
ভাবলাম, আমি সেরকম কাউকে নির্বাচন করিনি জীবনসংগী হিসেবে গ্রহন করার
জন্য। অচেনা লোকের সঙ্গেই আমার বিয়ে হবে। সুতরাং সে যেই হোক তাকে ঠিক
করে নিতে হবে। তা আমি পারব।
সকলেই বলতে লাগলো ‘ওকালতি পেশা খারাপ কি? মানুষ তার প্রফেশনের জন্য
খারাপ হতে পারে না। যে ব্যক্তি মন্দ, সে উকিল না হয়ে অন্য পেশায়
নিয়োজিত থাকলেও মন্দলোক হবে। খারাপ যে, তাকে কোন পেশাই ভাল করতে পারবে
না। ভাল যে, সে যে কোন অবস্থানে তার চরিত্রের দৃঢ়তায় অটল থাকবে।’ এসব
বক্তৃতা শুনে আমার মন যুক্তির সন্ধান পেল। আমি সম্মতি জানালাম।
ছেলে দেখার আয়োজন হলো ঢাকা বিমানবন্দরে। রেবা ভাবীর ভাইয়ের বিলাত গমন
উপলক্ষে আমরা এয়ারপোর্টে গেলাম। তখনকার দিনে কেউ বিলেত গেলে অনেকেই
তাকে বিদায় দেয়ার জন্য এয়ারপোর্ট যেত। সেই সুযোগে বিমানবন্দর দেখা,
উড়জাহাজ দেখা এসব কাজও হতো। মামার কলিগের বন্ধুও সেই সুপাত্রকে নিয়ে
এলেন সেখানে। পরিচয় করিয়ে দিলেন। দৃষ্টিটা একটু ক্রূর মনে হলো।
কথাবার্তা হয়নি তার সাথে আমার। মামারা দু’চার কথা আলাপ করলেন। তাতে
নাকি ভালই মনে হয়েছে তাদের। সে ঘটক ভদ্রলোক তার গুণের অনেক ফিরিস্তি
দিলেন। বিদ্যা, পেশা, নির্ঝঞ্ঝাট কোন কিছু ভাবতে হবে না, একেবারে তৈরী
সংসার! কেবল একজন ঘরণী দরকার, আর কিছুই নয়। সোনায় সোহাগা হবে নাকি আমার
বিয়ে। আমার কেমন যেন মন উঠলো না বিয়েতে। তবুও রাজী হয়ে গেলাম। সকলের
যখন পছন্দ তখন আমার হয়তো ভালই হবে। যে বসন্তে আমার ভাইয়ের বিয়ে, তার
পরের বসন্তেই আমারও জীবনের পট পরিবর্তনের ক্ষণ নির্ধারিত হলো। আমি তৈরী
হলাম। তবে মনের আড়ষ্টতা রয়ে গেল। যথারীতি মা ও মামী ঝাঁপিয়ে পড়লেন
আয়োজনে। মামাতো বোনটিও একটু বড় হয়েছে। সেও যথেষ্ট সাহায্য করতে পারছে।
আমার মা মনের মাধুরী মিশিয়ে অনুষ্ঠান রচনায় মন দিলেন। আয়োজন খুব সুন্দর
হলো। তারপর পঞ্জিকা দেখে দিনক্ষণ ধার্য হলো।
বরযাত্রী এলেন মাত্র কয়রকজন! বলল, আত্মীয় –পরিজন এদিকে বিশেষ কেউ নেই।
বন্ধু বান্ধবও সংখ্যায় কম। কেননা এখানে তার বেশী দিনের বসবাস নয়। অতিথি
ছিলেন সেই ঘটক সপরিবারে। মামার কলিগ, তার বাড়ির সকলকে নিয়ে। পাত্রের
পিতামাতা সেই সুদূর সাতক্ষীরা থেকে এসেছেন তাদের ছেলেসহ। আর কোন আপনজন
এসেছে বলে শুনতে পাইনি। কিছু কাপড় –চোপড় একটা স্যুটকেসে ভরে ভদ্রলোক
বিয়ে করতে এসেছেন। গহনাপত্র অর্ডার দিয়েছেন, সেগুলো দু’চারদিনের মধ্যে
পেয়ে যাবেন। তাড়াহুড়ো করে সেগুলো তৈরীর কাজ সম্পন্ন হয়নি। আমরা
ভদ্রলোক। মানুষের মুখের কথা বিশ্বাস করি। হতেও পারে এরকম। কারণ ছেলে
একা। বিয়ের আয়োজন কিভাবে করতে হয় তা তার জানার কথা নয়।
আমার মা, তার যত অলংকার ছিল তার অনেকগুলো আমাকে দিয়ে দিলেন। আমাদের
পোশাক –অলংকার দিয়ে আমাকে সাজানো হলো। সেই সময়ে বিউটি পার্লার ছিল না।
বাড়ির বাইরে দোকানে গিয়ে কনে সাজানো, মেহেদী লাগানো, খোঁপা বাঁধানো –এ
ছিল অশ্রুতপূর্ব ঘটনা। বাড়ির মেয়েরা তখন কনে সাজানো , কবরী রচনায় খুবই
পারদর্শী ছিল। বন্ধুরা পরম উৎসাহের সঙ্গে আমাকে অপরূপ সাজে সজ্জিত
করলো। সঙ্গে ছিল আমার মায়ের শিল্পী মনের নির্দেশনা। সর্বাঙ্গ সুন্দর
রূপে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলো, বাড়িতেই। আমাদের দিক থেকে কোন ত্রুটি ছিল
না।
চলে এলাম ঘোড়ার গাড়ি চড়ে শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুর বাড়ি ঠিক নয়, বরের বাড়ি।
সেখানে সেই বন্ধুর স্ত্রী আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। হাত ধরে গাড়ি থেকে
নামালেন। সঙ্গে করে গৃহ প্রবেশ করালেন। অল্প কিছুক্ষণ থাকার পর তারা
চলে গেলেন। রয়ে গেলেন আমার শ্বশুর, শাশুড়ি আর একটি দেবর। কম বয়েসী
কাজের ছেলে একটি আছে। খুব ছোট নয়। তরুণ। কিছুক্ষণ পর সে শয্যা গ্রহন
করল।
এমন কোলাহলবিহীন নীরব পরিবেশে কতক্ষণ জেগে থাকা যায়? আমার স্বামীও
বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লেন। অগত্যা আমি একা জেগে রইলাম। রাত গভীর হলো। ধীরে
ধীরে সাজ পোশাক পাল্টে নিলাম। শোবার ব্যবস্থাটি আমার পছন্দ হয়নি।
সেজন্য একটি কাঠের চেয়ারে বসেই বিশ্রাম নেয়ার চেষ্টা করি। ঘুম এলো না
চোখের পাতায়। এমনকি তন্দ্রাও নয়।
চলবে...