ফরিদা ইয়াসমিন
জেসি মার্ক একজন যুদ্ধ শিশু। একাত্তরের নয় মাস যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর
আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সেই স্বাধীনতার প্রতীক এই যুদ্ধ শিশুরা।
স্বাধীনতার পর যে কজন যুদ্ধ শিশু কে অস্ট্রেলিয়া পাঠানো হয় জেসি তাদেরইন
একজন। যাদের ঠাই হয়নি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে! ওর সাথে পরিচয়টা খুবই
আকস্মিক। তখন সবে দেশ ছেড়ে আমেরিকায় এসেছি। সব কিছু অচেনা। তার চেয়ে বড় কথা
সব খানেই দেশ খুজে বেড়াই। বৃষ্টির শব্দে, তুষারপাতের দৃশ্যে, গাছপালা
-ফুলপাখী,মানুষের কথায়। সর্বোপরি দুচোখ আকুল হয়ে খোঁজে ফিরতো বাংলাদেশ
কে।জানালা দিয়ে দৃষ্টি মেলে দেই বাইরে। পাতাবিহীন ন্যাড়া গাছগুলোর ফাঁক গলে
দৃষ্টি চলে যেত বহু দূরে। আকুল হয়ে শুধু খুজতে থাকতাম পরিচিত নৃতত্ব।চলে
যেতাম বাংগালী গ্রোসারি আর রেস্তোরাঁয়। খুঁজে বের করতাম বাংলা পত্রিকা।
এমনই যখন মনের অবস্থা ঠিক তখন মধ্য এপ্রিলে একটি বাংলা পত্রিকায় দেখলাম
চেরী ফুলের সমারোহের ছবি। দেশে থাকতে এই চেরী ফুল নিয়ে অনেক রোমান্টিকতা
কাজ করতো।এন্ড্রু কিশোর তো তার এক গানে বলেছেন 'ওগো বিদেশিনী তোমার চেরী
ফুল দাও আমার শিউলী নাও....। জাপানে সাকুরা নামে পরিচিত এই চেরী ফুল।
কিমোনো পরিহিত অনিন্দ্য সুন্দর জাপানি মেয়েদের ছবি দেখতাম চেরী ফুলের মাঝে।
মন চাইতো ছুঁয়ে দেখি চেরী ফুল। জাপানি মেয়েদের কমনীয় মাধুর্য আর চেরী
ফুলের স্নিগ্ধতা মিলেমিশে অসাধারণ একটা সৌন্দর্যের আবহ সৃষ্টি করতো।
পত্রিকার পাতায় খুজে বের করলাম চেরী ব্লসম এর ঠিকানা। তার পর এই নগরীতে
নবাগতা আমি ট্রেন ধরে পৌঁছে গেলাম রুজভেল্ট আইল্যান্ডে। কল্পনায় দেখা চেরী
ফুল যেন সাগ্রহে আলিঙ্গন করলো আমাকে। সাদা রংয়ের চেরী ফুল দেখে মনে হলো
আকাশের তুলো তুলো মেঘ। তার উপর রোদের ছটায় চিকচিক করছে। লাল রং এর চেরী মনে
করিয়ে দিল আমার বাংলাদেশের কৃষ্ণচূড়ার কথা। ইস্ট রিভার এর পাশে প্রকৃতির
এমন মনকাড়া সৌন্দর্য ও কেন জানি উদাস করে তুলছিল মনকে। চোঁখ যেন অজান্তেই
খুঁজে ফেরে সেই চিরচেনা অবয়ব। শ্যামল বরন মায়াবী চোখ, কালো চুল। হঠাৎই যেন
কিছু একটা খুঁজে পেল এই উৎসুক দৃষ্টি। দেখলাম একটি মেয়ে বাংগালীদের মত
গায়ের রং এবং চেহারা। মাথায় কোকড়া চুল। মাঝারি উচ্চতা। পোষাক -আসাকে
পরিপাটি। দু'হাতে দুই বাচ্চা আগলে রেখেছে। সাথের শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোককে
স্বামী বলেই মনে হলো। দূর থেকেই লক্ষ্য করলাম। অভদ্রতা হবে মনে করে নিজেকে
সামলে নিই। ছবি তোলা আর ফুলের সৌন্দর্য দেখায় মনোনিবেশ করি। হঠাৎই' হাই
'-শব্দে সচকিত হয়ে উঠি। দেখি সেই শ্যামল বরন মেয়েটি। কিছুটা অবাক হয়ে
তাকিয়ে থেকে প্রতি উত্তরে আমি হ্যালো বলি। কিন্তু সে সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস
করে Are you from Bangladesh? উত্তরে হ্যাঁ বলি। মেয়েটি আমাকে জড়িয়ে ধরে।
সে বলে I'm also!! কিন্তু বলার সাথে সাথেই ওর চোখ বেয়ে বড় বড় ফোঁটায় পানি
পড়তে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে পড়ি। ওর স্বামী টিস্যু পেপার
এগিয়ে দেয় চোখের পানি মুছতে। কয়েকটি মুহূর্ত চুপচাপ। তারপর জেসি বলে যায়
একে একে সব ঘটনা।
জেসি নামের আড়ালে সে হচ্ছে জোসনা।'৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক হানাদার
বাহিনীর হাতে যে সব বাঙালী মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন যুদ্ধ শেষে
তাদের উদ্ধার করা হয়। সে সময় তাদের অনেকেই গর্ভবতী ছিলেন। জোসনার মাও ছিলেন
সেই ভাগ্য বিড়ম্বিত নারীদের একজন। সন্তান জন্মের পর সেই সব নারীদের স্থান
হয় পূনর্বাসন কেন্দ্রে। সমাজ এবং পরিবার কোথাও তাদের ঠাই হয় না। আর সেই সব
অনাহূত শিশুদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিদেশে। কাউকে দত্তক হিসেবে কাওকে ফস্টার
হোমে। জোসনা কে দত্তক হিসেবে নেয় নিঃসন্তান মার্ক দম্পতি। তাদের সাথে
জোসনার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু নিজের শিকড়ের সন্ধানে সদা উদগ্রীব হয়ে থাকে
মন। তাইতো একবার গিয়েছিল বাংলাদেশে। সাথে ছিল আরও কয়েক জন যুদ্ধ শিশু।
বাদল,মানিক,মাজেদা,মনিকা এবং আরও কয়েক জন । নিজের দেশে গিয়ে ওদের বুক জুড়ে
শুধু হাহাকার বাজে। কোথায় মা! মা জননী তুমি কোথায়? কত কষ্টের আর অপমানের
প্রহর পাড়ি দিতে হয়েছে তোমাকে মাগো!! একবার কি দেখা হবে মা! বাবার কথা মনে
হতে ঘৃণায় গা রি রি করে উঠে। কয়েকটি দিন অনেক ঘুরেছে। কিন্তু মাকে খুঁছে
পায়নি। তাইতো আসার আগে একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। অজানা
অচেনা মায়ের উদ্দেশ্যে। হায়রে জীবন!!
জেসির ছেলে মেয়ে দুটি মায়ের পাশে এসে দাঁড়াল। জেসিও শশব্যস্তে উঠে দাড়াল
চোখের পানি মুছতে মুছতে। আমাকে বাই বলে ওর স্বামীও এগিয়ে চললো ওদের সাথে।
আমি অপলক তাকিয়ে থাকলাম। মাথার ভেতর কেমন যেন এক শূন্যতায় ভরে গেল। কিছুই
আর ভাবতে পারছিলাম না। এই আমি প্রবাসী হয়ে দেশের জন্য মন খারাপ করছি আর
একজনের কাছে দেশ কি, নিজে কে তারই কোন উত্তর নেই!! কত প্রশ্নের অমীমাংসিত
ভাবনা নিয়েই এক জীবন কেটে যাবে! ওর অপসৃয়মান পথের দিকে তাকিয়ে মনে হলো আমার
কোনো দুঃখ নেই। যা আছে সবই দুঃখের বিলাসিতা। এক নদী রক্ত পেরিয়ে আমরা একটি
স্বাধীন দেশ পেয়েছি। কিন্তু সেই রক্তে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যাদের জন্ম তারা
কি পেল?? কি করতে পেরেছি আমরা তাদের জন্য!!! বুঝতে কি পেরেছি আমরা তাদের
বুকের হাহাকার? শুনতে কি চেয়েছি তাদের অব্যক্ত কান্নার শব্দ? রুজভেল্ট
আইল্যান্ডের লাল সাদা চেরী ফুলের গাছগুলোর উপর দিয়ে তিরতিরিয়ে বাতাস বয়ে
গেল। ইস্ট রিভার এর বুক হতে যে বাতাস বয়ে এলো সে কি শুনতে পেয়েছে এক
অভাগীনির অব্যক্ত হাহাকার?
আকাশ ভরা প্রেম
চঞ্চল জামান
শহীদের সাথে লক্ষ্মীর পরিচয়
ফেসবুকেই। দুজনই যেমন বাঙালি তেমনি সাহেব। দুজনই টরন্টো শহরেই বসবাস করছে।
শিক্ষাগত ভাবে একজন ডাক্তার, অন্যজন এঞ্জিনিয়ার। লক্ষ্মী ডাক্তারি লাইসেন্স
পাবার জন্য শেষ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে, শহীদ প্রাইভেট কনসালট্যান্ট।
দুজনই নাকি বাঙালি কম্যুনিটি থেকে আপ্রাণ দূরে থাকার চেষ্টা করছে। এরকম
একটা মধ্যবর্তী শ্রেণী কানাডায় সত্যি আছে যাদেরকে স্থানীয় শ্বেতাঙ্গরাও
পুরোপুরি গ্রহণ করেনি, আবার বাঙালি সমাজও একরকম ত্যাগই করেছে। দুজনই এই
মধ্যবর্তী এবং উভচর বলেই হয়তো লক্ষ্মীর সাথে শহীদের ফেসবুকে বেশ ভাব হয়ে
গেলো। একথায় সেকথায় দুজনই একধরণের টান অনুভব করলো। লক্ষীর বয়স বিয়াল্লিশ,
শহীদের বায়ান্ন।
'কৌতুহলই বিড়ালকে খুন করেছিল' বলে একটা কথা আছে। লক্ষ্মী-শহীদ দুজনই ঠিক
করলো মুখোমুখি দেখা করবে, কফির টেবিলে, শহরের কোথাও। একবছর আগে হলেও
ব্যাপারটা সহজেই হতো, এখন মুখে মাস্ক পরে যেতে হয় কফি হাউসেও।
বাঙালি পাড়া ড্যানফোর্থেই কথা হলো দেখা করার। লক্ষী একটু আগেই এসে পড়েছে।
মুদিদোকান মেট্রোর পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করেই শহীদ ফোন করলো লক্ষীকে। কি
লজ্জার ব্যাপার দেরি করে এলো প্রথম পরিচয়ের দিনেই - এসব ভাবতে ভাবতেই
অন্যমনস্ক শহীদ বের হয়ে এলো গাড়ি থেকে। একটু পর বুঝলো মুখে সে মাস্ক পরতে
ভুলে গেছে। মেট্রোর সামনে বিশাল লাইন। করোনার ভয়ে মানুষ খাবার মজুদ করার
আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তারই লাইন। এই ভিড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন শহীদের
পরিচিত মতিন সাহেব, 'আরে শহীদ যে! দেখছোনা কি লম্বা লাইন - ওদিকে গিয়ে লাভ
নেই, ভাই। '
মাস্ক পরা হয়নি, লক্ষী দাঁড়িয়ে আছে, প্রথম দেখা, মতিন সাহেবের সাথে আচমকা
দেখা - এইসব মিলিয়ে শহীদ খুব অপ্রস্তুত বোধ করে। লক্ষী কিন্তু চিনতে পেরেছে
শহীদকে, হাত নাড়াচ্ছে। মাস্ক ছাড়াই সামনে যাবে? ফিরে যাবে গাড়িতে? এইসব সাত
পাঁচ ভাবতে ভাবতে শহীদ হাতের ইশারায় লক্ষীকে তাকে অনুসরণ করতে বলে গাড়ির
দিকেই ছুটলো, গাড়ির আসনেই হয়তো মাস্ক ফেলে এসেছে। না, নেই। গাড়ির ভেতর
মাস্ক নেই। ততক্ষনে লক্ষী শহীদের কাছে এসে পড়েছে।
পরনে রক্তিম প্যান্ট, গায়ে কালো জ্যাকেট, ধূসর চোখ, কালো চুল, শুভ্র
ভ্রূ-মধ্য, মুখে মাস্ক - লক্ষী রহমান। নুনে-মরিচে চুল, ধূসর চোখে চশমা, লাল
জামা, নীল জিন্স, সাদা জ্যাকেট, নগ্ন মুখ - শহীদ কায়সার।
প্যাসেঞ্জার সীটের দরজা খুলে ধরে লক্ষীকে আসন গ্রহণ করতে আমন্ত্রণ জানালো
শহীদ। চালকের আসনে বসে শহীদ একবার তাকালো লক্ষীর দিকে, বিনয়ের সাথে বললো:
দেখুন আমার ভুলো মন, মাস্কটা বোধ হয় অফিসেই ফেলে এসেছি। মাস্ক ছাড়া কোথাও
কেউ আমাকে ঢুকতে দেবে না। আমার অফিস এই কাছেই, দশ মিনিটের পথ। আপনার আপত্তি
না থাকলে চলুন, খুব বেশি সময় নেবোনা, অফিস থেকে মাস্কটা নিয়েই টিম হর্টনের
কফি হাউসে বসে আলাপ করবো।
মুখে ঠিক আছে বললেও লক্ষীর কণ্ঠ চিন্তিত শোনালো। শহীদ নানারকম হাসি ঠাট্টায়
পরিবেশ হালকা রাখার চেষ্টা করছে। মদ্যের দোকান এল সি বি ও থেকে একটা গাড়ি
হঠাৎ ডান পাশের লেনে ঢুকে পড়তেই লক্ষী দুর্ঘটনা ভেবে মাগো বলে চিৎকার দিয়ে
শহীদের গায়ের উপর পড়লো। এই আকস্মিক স্পর্শ শহীদের তো ভালোই লাগলো। লক্ষী
একটু বিব্রত। লক্ষী ড্রাইভার হলে বুঝতো পাশের লেনে হঠাৎ ঢুকে পড়া গাড়ির
কারণে দুর্ঘটনা ঘটার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও আসলে ছিল না।
অফিসের সামনে গাড়ি পার্ক করে দুজনেই প্রায় একসঙ্গে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। বাইরে
সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। সামান্য তুষার পড়ছে, রাস্তায় জমে আছে এবড়ো-থেবড়ো
কাচের মতো বরফ। লক্ষী-শহীদ দুজনের কেউই বুট পরেনি আজ। রাস্তার ওপারেই টিম
হর্টনের কফি-খানা। সেদিকেই যাবার প্ল্যান। লক্ষী শহীদের হাত ধরলো। শহীদ
ভাবলো লক্ষী বুঝি প্রেমে পড়েছে। লক্ষী ভাবলো হাত ধরে না হাঁটলে নির্ঘাৎ
রাস্তায় বরফে পা পিছলে পড়ে যাবার সম্ভাবনা।
শহীদের এক হাতে লক্ষীর হাত, অন্য হাত জ্যাকেটের পকেটে ঢুকাতেই বুঝতে পারলো
মাস্কটা আসলে পকেটেই ছিল। রাস্তা পেরিয়ে দুজন টিম হর্টনের কফি-খানায় ঢুকলো।
এখন রেস্তোরাঁয় ঢুকতে মাস্ক পরা বাধ্যতা মূলক। লক্ষী ইংরেজদের মতো দুধ-চা
খায়, শহীদ খায় ব্ল্যাক চা। শহীদ অবশ্য বাইরের কোনো খাবারই খায় না। লক্ষীর
জন্য চা-বিস্কুট কিনে রেস্তোরাঁর বাইরে পেতে রাখা চেয়ার টেবিলে বসতে হোলো।
ওরা মুখোমুখি বসেছে। এখন শহীদ লক্ষীকে ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছে। লক্ষীর
ফিগার, চোখ-মুখ-নাক সব মিলিয়ে এমন যে, কেউ যদি তাকে সুন্দরী ভাবে তাকে দোষ
দেওয়া যায়না, আবার কেউ যদি না ভাবে তাকেও না। একটা পাগল ঘুরঘুর করছে ওদের
পাশে, আপনমনে বিড়বিড় করে কিছু বলছে। বাইরে শীতল হাওয়া। শীত করছে শহীদের। এই
করোনাকালে রেস্তোরাঁর ভেতরে বসার অনুমতি নেই। সদ্যপরিচিত বাঙালি নারীকে
নির্জন অফিসঘরে গিয়ে বসার প্রস্তাব দেওয়াটা বড় রকমের অভদ্রতা হলেও নির্জন
গাড়ির ভেতর বসতে আমন্ত্রণ জানানো যায়। কেন যায় শহীদ জানেনা, তবে যায় বলেই
বিশ্বাস করে। তাই ঠিক হলো। ওরা গাড়ির ভেতর গিয়ে বসলো। হিটারে গরম হচ্ছে
হাওয়া। উইন্ডশিল্ডে পাতার মতো ঝরে পড়ছে বরফ।
কোথাও যাওয়ার জন্য গাড়িতে বসা নয়, বসে থাকার জন্য বসা। বাইরের আধো-অন্ধকারে
দুএকজন লোক গাড়ির পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে মাঝে মধ্যে, কেউ কেউ হয়তো তাকাচ্ছেও
ওদের দিকে। কম্প্যাক্ট ডিস্কে মাইকেল বাবল এর 'দ্য ওয়ে ইউ লুক টুনাইট'
বাজছে।
অল্প-স্বল্প কথা হচ্ছে দুজনের ভেতর। হাসি ঠাট্টার কথা নয়, বিষাদের কথাও নয়।
কেমন যেন কলা-কৌশল হারিয়ে ফেলা কথা। তুলোর মতো তুমুল বরফ পড়ছে এখন বাইরে।
এভাবে চলতে থাকলে একটু পরই তাদের গাড়ি বরফের নিচে সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে যাবে।
গেছে। এখন আর ভেতর থেকে বাইরের কিছুই দেখা যায়না। দুঘন্টা পেরিয়ে গেলো
কিভাবে যেন। মাইকেল বাবল এখনো গেয়ে চলছে সাম ডে, হোয়েন আই'ম অফুলি লো,
হোয়েন দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ কোল্ড, আই উইল ফিল এ গ্লো জাস্ট থিংকিং অব ইউ এন্ড
দ্য ওয়ে ইউ লুক টুনাইট'
কি আশ্চৰ্য - মানুষ কত তাড়াতাড়ি 'আপনি' থেকে তুমি সম্বোধনে চলে আসতে
পারে।লক্ষী হাত ব্যাগ থেকে ছোট্ট আয়না চিরুনি বের করে চুল আচড়াচ্ছে। ঠোঁটে
লিপস্টিক মাখতে মাখতে শহীদকে তাড়া দিলো, এখন রাত দশটা বাজে। বাড়ি ফিরতে
হবে। গাড়ির ট্রাঙ্ক থেকে ব্রাশ বের করে শহীদ ধুলো ঝাড়ার মতো বরফ ঝেড়ে ফেললো
উইন্ডশীল্ড আর জানালার কাচ থেকে।
মিনিট তিরিশের পথ। কথা খুব যে হচ্ছে তা নয়, তবে লক্ষী একটু পর পর খিল খিল
করে হাসছে। কেন হাসছে জানতে চাইলেও বলছে না।
কুড়ি-তলা বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করে শহীদ লক্ষীর চোখে চোখ রাখলো। ধন্যবাদ
জানালো এই চমৎকার এক সন্ধ্যার জন্য। লক্ষী কিছু বললো না। গাড়ি থেকে বেরিয়ে
দাড়িয়ে থাকলো যতক্ষণ না শহীদের গাড়ি রাস্তায় একসময় হারিয়ে গেলো। বুকের ভেতর
একধরণের ব্যথা খচ খচ করে উঠলো। দিগন্ত জোড়া সাদা বরফ ছাড়া আর কিছুই দেখা
যায় না।