টরন্টো, ১৯ কার্তিক ১৪২৭ বঙ্গাব্দ, নভো সংখ্যা ১৪
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি অনুবাদ যোগাযোগ আবৃত্তি

কার্তিকের কুয়াশা

বীথি

 

ফরিদ আহমেদ

 

 

“এক্সকিউজ মি।”
মিষ্টি একটা কণ্ঠ শুনে থমকে দাঁড়ায় বীথি। বিজনেজ ক্লাস থেকে মাত্র ইকোনোমি ক্লাসে ঢুকেছে সে। ঊনচল্লিশ হাজার ফুট উচ্চতায় প্লেন স্টাবল হতেই কাজে নেমে পড়েছে সে। যাত্রীদের ডিনার দিতে হবে। সেই প্রস্তুতি নিতেই এগিয়ে যাচ্ছিলো সে।
যিনি ডেকেছেন, তাঁকে আগেও দেখেছে বীথি। মাঝ বয়সী ভদ্র মহিলা। অত্যন্ত সুশ্রী দেখতে। একা একা ভ্রমণ করছেন। এক পায়ে প্লাস্টার করা। কপালে, গালে এবং হাতে ব্যান্ডেজ রয়েছে তাঁর। নিশ্চয় ভয়ংকর কোনো এক্সিডেন্ট করেছেন। বোর্ডিং-এর সময়ে তাঁকে হাতে ধরে সিটে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছে পরম যত্নে। এরকম একজন অসুস্থ মানুষের সাথে অন্য কেউ নেই দেখে অবাকই হয়েছে বীথি। কেনো নেই, এটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও পেশাগত কারণে চুপ থেকেছে বীথি। তাদের এই পেশায় যাত্রীদের প্রতি অহেতুক কৌতূহল দেখানো নিষিদ্ধ।
“কিছু লাগবে আপনার?” কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে বীথি।
“আমার না। পিছনে আমার স্বামী বসেছে। ওকে গিয়ে একটু প্রেশারের ওষুধটা খেতে বলবেন। খুবই ভুলো মন ওর। মনে না করিয়ে দিলে ওষুধই খাবে না সে। আমার পায়ের এই অবস্থা নিয়ে ওর কাছে যেতে পারছি না আমি।" অপরাধীর মতো তিনি বলেন।
“আপনার স্বামী এই প্লেনেই আছে?” বিস্ময়ের সাথে বীথি বলে।
“হ্যাঁ, পিছনের দিকে বসেছে। ফিফটি ওয়ান সিতে, আইল সীট।”
“আপনারা এক সাথে বসেন নাই কেনো? কী আশ্চর্য!!”
“এক সাথেইতো সীট চেয়েছিলাম।বিমানের লোকজন বললো পাশাপাশি দুটো সীট নাকি খালি নেই। আমরা দেরি করে এয়ারপোর্টে আসার কারণে এই অবস্থা হয়েছে।” ম্লান কণ্ঠে তিনি বলেন।
বাংলাদেশ বিমানের নিউ ইয়র্ক টু ঢাকা ফ্লাইট সবসময় ক্রাউডেডই থাকে। এরকম হওয়া সম্ভব। কিন্তু, দুজনকে পাশাপাশি বসিয়ে দিতে খুব একটা অসুবিধা হবে না বলেই বীথির ধারণা। এই ভদ্রমহিলার পাশে একটা তরুণ ছেলে বসেছে। একে অনুরোধ করলে সে নিশ্চয় সীট পাল্টাতে রাজি হবে ভদ্রলোকের সাথে। ভদ্রলোকের সাথে আগে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয় বীথি। পরে এসে একে অনুরোধ জানাবে।
“আমি যাচ্ছি আপনার স্বামীকে ওষুধ খাবার কথা মনে করিয়ে দিতে।” নরম গলায় বীথি বলে।
“নীল জামা গায়ে দিয়ে আছে সে। লম্বামতো।” স্বামীর বর্ণনা দেন বীথিকে ভদ্রমহিলা।
ফিফটি ওয়ান সিতে গিয়ে ভদ্রলোককে পেয়ে যায় বীথি। ওনারও কপালে আর গালে ব্যান্ডেজ বাঁধা। ভদ্রমহিলার মতো ওতো খারাপ অবস্থা ওনার না। দুজনেই খুব সম্ভবত এক সাথে এক্সিডেন্ট করেছেন।
সীটের সাথে মাথা হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন ভদ্রলোক। মাত্র দশ বারো মিনিট হয় প্লেন টেক অফ করেছে। এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেছেন বলে মনে হয় না।
“এক্সকিউজ মি, শুনছেন?” ভদ্রলোককে জাগানোর চেষ্টা করে বীথি। তিনি চোখ মুদে থাকেন।
কাঁধের কাছে হাত রেখে আলতো করে ঝাঁকি দেয় বীথি। ঝাঁকি খেয়ে চোখ খোলেন ভদ্রলোক। গায়ের কাছে বিমানবালাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত সোজা হয়ে বসেন তিনি। চোখে মুখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি।
“আপনার স্ত্রী আমাকে পাঠিয়েছেন আপনার ওষুধ খাবার কথা মনে করিয়ে দিতে?”
“আমার স্ত্রী?” ভদ্রলোকের চোখে বিস্ময় খেলা করতে থাকে।
“হ্যাঁ, আপনার স্ত্রী। সামনের দিকে বসেছেন উনি। আপনার কি পানি লাগবে ওষুধ খেতে? এনে দিতে পারি।”
“না লাগবে না। আমার কাছে বোতলে পানি আছে।” নিজের বিস্ময়টা সামলে নিয়েছেন ভদ্রলোক। কোনো এক বিচিত্র কারণে চোখের কোণা দুটো ভিজে গিয়েছে তাঁর। বীথি যাতে দেখে না ফেলে সে কারণে চট করে শার্টের হাতা দিয়ে চোখ দুটো মুছে নেন তিনি। বীথির চোখ এড়ানোর জন্য মাথা নিচু করে পানির বোতলটা খুঁজতে থাকেন।
ভদ্রলোক ঠিক কী কারণে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন বুঝে উঠতে পারে না বীথি। স্ত্রীর সাথে কি কোনো কারণে ঝগড়া করেছেন তিনি? এখন তাঁর প্রতি স্ত্রীর যত্ন দেখে আবেগ আটকে রাখতে পারছেন না। মনে মনে হাসে বীথি। তাঁর এমন একটা রোম্যান্টিক হাজবেন্ড থাকলে কতো না ভালো হতো। বুকের গভীর থেকে বের হয়ে আসতে থাকা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাসকে আটকে দেয় বীথি। বিমানে তার অনেক দায়িত্ব। নিজের কথা ভাবার সময় এটা না।
“আপনি চাইলে আমি আপনাদের দুজনকে এক সাথে বসার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। ব্রাসেলস, দুবাই হয়ে ঢাকা যেতে দীর্ঘ সময় লাগবে। আপনাদের এক সাথে বসাটা জরুরী।
“সেটা মনে হয় সম্ভব হবে না।” মৃদু কণ্ঠে ভদ্রলোক বলেন।
“সম্ভব হবে। আপনার স্ত্রীর পাশের ভদ্রলোককে গিয়ে অনুরোধ করে সরিয়ে দেবো আমি। উনি এসে আপনার সীটে বসবে, আপনি গিয়ে আপনার স্ত্রীর পাশে।”
“সেটা সম্ভব নয়।” আবারও একই কথা বলেন তিনি।
আচ্ছাতো লোকটা। রেগে যেতে গিয়েও রাগ করত পারে না বীথি। লোকটার চোখে মুখে অদ্ভুত একটা মায়া জড়ানো। বীথির কথার যে প্রতিবাদ করছে, সেরকম না। বিষণ্ণ কণ্ঠে শুধু নিজের কথাটা বলে যাচ্ছেন তিনি।
“কেনো সম্ভব নয়? আপনার স্ত্রীতো এই প্লেনেই আছে, নাকি নেই?” বীথি এবার পাল্টা প্রশ্ন করে।
বীথির দিকে চোখে তুলে তাকান তিনি। জলে ভরা অদ্ভুত বিষণ্ণ দুটো চোখ। মানুষের চোখে এতো বিষণ্ণতা কোথা থেকে আসে?
“আমার স্ত্রী এই প্লেনেই আছে। কিন্তু সামনে নয়। সে শুয়ে আছে আমাদের নীচে।”
“মানে কী?” হতভম্ব বীথি প্রশ্ন করে।
“আমার স্ত্রী এক্সিডেন্টে মারা গেছে। গাড়িটা আমি চালাচ্ছিলাম। পিছন থেকে এসে একটা সেমাই ট্রাক ধাক্কা দিয়েছিলো। আমি বেঁচে গিয়েছি। কিন্তু, তার ভাগ্য আমার মতো ভালো না। ওকে দেশে নিয়ে যাচ্ছি আমি।” বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন।
বের হয়ে আসা আর্তনাদকে চাপা দিতে গিয়ে নিজের মুখে হাত চাপা দেয় বীথি।
“মরে গিয়েও আমার প্রতি দায়িত্ব ভোলে নি সে। আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে আমার ওষুধ খাবার কথা মনে করিয়ে দিতে।” মেঝের দিকে মাথাটাকে নামিয়ে দেন ভদ্রলোক।
ঝটিতে পিছনে ঘোরে বীথি। প্লেনের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে সে। ভদ্রমহিলার সাথে তার কথা বলা খুব দরকার। কিন্তু, কেনো যেনো মনে হচ্ছে ওখানে গিয়ে কাউকেই দেখবে না সে। টলোমলো পায়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে বীথি। আকুল হয়ে মনে মনে দোয়া পড়ছে সে। তার মনের আশংকা যেনো সত্যি না হয়। ভদ্রমহিলা যেনো ওখানে থাকেন।

 

 

রুপবান ..

 

 বাদল আহমেদ

 

রুপবান - ১
দরজায় ক্রিংক্রিং বেল বেজে চলেছে, খোলার কেউ নেই। কাজের মেয়ে দুটো সবসময়ই ব্যস্ত নিজেদের মধ্যে ঝগড়া নিয়ে। তিক্ত বিরক্ত মুখে উঠে দরজা খুলে দিলেন নাসিমা আক্তার।
দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন তার ১৬ বছর বয়সী পুত্রধন বিজয়। সাথে ছোট্ট একটা মেয়ে, বয়স বছর চারেক হবে। বৃষ্টিতে ভিজে মেয়েটা কাকের মতো হয়ে আছে।
- আসো, ভেতরে আসো।
মেয়েটাকে খুব মমতার সাথে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো বিজয়। একটা মোড়া টেনে ওকে বসতে দিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
- মা, ওর সাইজের কাপড় হবে?
- তা হবে নিশ্চয়ই, তোমার বোনের ছোটবেলার সব কাপড়ইতো পরে আছে।
- দাও না মা, কিছু কাপড় দাও। মেয়েটা ভিজে একসা হয়ে আছে। নিউমোনিয়া বাঁধাবে।
নাসিমা উঠে ষ্টোর রুম খুঁজে একসেট কাপড় বের করে দিলেন। এরমধ্যে কাজের মেয়ে দুটো কাছে এসে চোখ গোলগোল করে মেয়েটিকে দেখছে। কাপড় হাতে নিয়ে বিজয়কে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসি চেপে কাজের মেয়ে দুটোকে বললেন - এই অমন হা করে কী দেখছিস।ওর গা মুছে কাপড় পাল্টে দে।শুনে ওরা মেয়েটিকে বাথরুমে নিয়ে গেল।বিজয় শুনতে পেলো ওরা কলকল করে কত কথা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করছে। সে নিজের রুমে ঢুকে গেল।
ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে মেয়েটি গুটিশুটি মেরে সোফার এক কোনায় বসে টিভি দেখছে। বিজয় একটি মোড়া এগিয়ে দিয়ে ওকে বসতে বলে। ডাইনিং রুমে মা’র গলার আওয়াজ আর টুংটাং শব্দ শুনে বিজয় গলা চড়িয়ে বলে -
- ওকে একটু খাবার দাও না মা, দেখে মনে হচ্ছে খুব খিদে পেয়েছে ওর।
নাসিমা ডাইনিং রুম থেকে এসে বললেন, তোর খাবারও রেডি করছিলাম।
- আমি খেয়েছি।
-বাইরে সব ছাইপাশ খাবি আর ক’দিন পরপরই বলবি পেট ব্যথা করছে।
নাসিমা কাজের মেয়েটাকে ডেকে ওকে রান্না ঘরে নিয়ে খাবার দিতে বললেন।গজগজ করতে করতে সে মেয়েটিকে সাথে নিয়ে যেতে যেতে মন্তব্য করতে ছাড়ল না,
- এই মেমসাহেব কেডা বিজয় ভাই? এত্তো কতা জিগাইলাম, এক্কেবারে বোবার লাহান মুখ বুইজাই থাকলো।
বিজয় উত্তর দিলো না। ওদের সাথে সাথে সেও ডাইনিং রুমে গেল। মেয়েটিকে রান্না ঘরে নিয়ে বসাচ্ছে দেখে ওকে ডেকে টেবিলে বসালো। আর নিজেও আরেকটি চেয়ার টেনে বসে পড়লো।
একটি প্লেটে ভাত, ডাল আর এক টুকরো মুরগির মাংস দেয়া হলো। বাচ্চাটা প্রায় সাথে সাথেই প্লেটের খাবার শেষ করে ফেললো। ওর এই খাওয়া দেখে কেন যেন বিজয়ের খুব ভালো লাগলো। জিজ্ঞেস করলো,
- আরও খাবে?
উত্তর না দিয়ে ভয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো বাচ্চাটা। বিজয় প্লেটটা নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে আরও খাবার দিতে বললো, ও আরেক প্লেট খাবার নিয়ে এসে বাচ্চাটাকে দিলো। বাচ্চাটা এবার আস্তে আস্তে প্লেটটা শেষ করলো। বিজয় প্লেটটা রান্নাঘরে দিয়ে আসলো।
নাসিমা ড্রইং রুম থেকে ছেলের এই কান্ড দেখছিলেন।
এবার নাসিমা মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
- মেয়েটা কে?
- জানিনা মা, ফুটপাতে বসে বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপছিল, তাই বাসায় নিয়ে আসলাম।
রাগে নাসিমার মেজাজ টং হয়ে আসলো। এমন একটা বেকুব ছেলে।
- আজ ওকে থাকতে দিচ্ছি, কাল যেখান থেকে এনেছ সেখানে রেখে আসবা।
বিজয় উত্তর দিলো না।
একটু পরে বিজয়ের ছোট বোন রুপা বাসায় ফিরে আসলো। আসলেন বাবা রহমান সাহেব। কেউই তেমন কিছু বললেন না। বিজয়কে খেপালে খবর আছে। রাতে মেয়েটাকে গেস্ট রুমে থাকতে দেয়া হল। ও শুয়েই ঘুমিয়ে গেল।
সমস্যা হল পরদিন।
ছুটির দিন, সবাই ড্রইং রুমে বসে আছে। দুপুরের খাবার পরে নাসিমা কথা তুললেন।
- মেয়েটাকে রেখে আয়, বিজয়!
- কোথায় রেখে আসবো মা?
- মানে? ওকে এনেছিস কোত্থেকে?
- এনেছি তো একটা ফুটপাথ থেকে।
- তা সেখানেই রেখে আয় তবে!
- মানুষ ফুটপাথে থাকতে পারে? ফুটপাথ কি একটা ছোট বাচ্চার জন্য কোন নিরাপদ জায়গা?
- কি বলতে চাচ্ছিস তুই? ও এখানে থাকবে?
- এই বাড়িতে একটা বাচ্চা থাকা আর খাবার জন্য যথেষ্ট আছে মা। এমন করছ কেন?
- কথা বাড়াস নে বিজয়, ওকে রেখে আয়।
বিজয়ের মাথায় যেন আগুন ধরে গেল, আজ ওকে আর কেউ আটকাতে পারবে না।
- শোনো মা। প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে তোমার আগে কেউ শহীদ মিনারে যেতে পারে না। ২৬ মার্চ তুমি মঞ্চে বসে দেশের আর দেশের মানুষকে নিয়ে বক্তৃতা কর। ১৬ই ডিসেম্বর মাঝরাতে সাভারে গিয়ে ফুল দাও। কেন মা? কেন?
-তোমার বাবা যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছিলেন, বীরপ্রতীক পদক পেয়েছিলেন। ওই যে দেয়ালে সেটা টাঙানো আছে।
-ওনি কী এই দেশের মাটির জন্য যুদ্ধ করেছিলেন নাকি মানুষের জন্য? বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে দেখো মা, ও-তো একটুকরা বাংলাদেশ। আর তুমি বলছ ওকে ফেলে দিয়ে আসতে? ঠিক আছে, তাই করছি! এই প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য প্রস্তুত থেকো মা।
রুমের সবাই মুখ হা করে বিজয়ের কথা শুনছিলেন। কারো মুখে কোন শব্দ নেই।
হঠাৎ নাসিমা আক্তার সশব্দে কেঁদে উঠে বিজয়কে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। রহমান সাহেবের চোখের চশমা খুলে পড়ে গেল।
- ছাড়ো মা ছাড়ো, আমার সহ্য হচ্ছে না।
- না বাপজান, তোকে তো ছাড়তে পারবো না, আজ এমন এক শিক্ষা দিলি! আর আমি ভাবছিলাম যে তোকে মানুষ করতে পারলাম না। আজ প্রমাণ করে দিলি যে আমি নিজেই একটা অমানুষ।
মৃদুগলায় রহমান সাহেব বললেন-
- আসলেই তো। এই ছোট্ট একটা বাচ্চা কোথায় যাবে? থাক না, এখানেই।
- নিশ্চয়ই থাকবে – সিদ্ধান্ত দিলেন নাসিমা আক্তার।
তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যে এখনই হচ্ছে সে নিয়ে কোন ধারণাই ছিলো না শিশুটির।
রুপা প্রশ্ন রাখলো,
- এই মেয়ে, তোর নাম কি?
- জানি না।
- জানিস না মানে? মানুষে কী বলে ডাকে?
- আমি কোন মানুষ চিনি না। ফুটপাতে যে যা খুশি ডাকে।
- তা তোকে একটা নাম তো দিতে হবে, তাই না?
- আফনেরাও যা খুশি ডাকিয়েন।
- নাচতে পারিস?
- দেখায়ে দিলে পারবো।
রুপা কোমরটা দুলায়ে একটু দেখালো আর মেয়েটাও ঠিক সেভাবেই ওর অনুকরণ করলো। রুপার সাথে মেয়েটির এই প্রথম কথা বলা সবাই উৎসুক হয়ে শুনছিলো। ওর নাচ দেখে সবাই হা হা করে হেসে উঠলো।
- আজ থেকে তোর নাম দিলাম রূপবান, রুপা হেসে ঘোষণা দিয়ে কোমর দুলিয়ে গেয়ে উঠলো,
রুপবান নাচে কোমর দুলাইয়া।
রূপবানও তার দেখাদেখি কোমর দুলিয়ে নেচে উঠলো।
.....................................................................
বিধাতা মুচকি হাসিলেন!

রুপবান - ২
পরদিন থেকেই রূপবানকে নিয়ে একটা প্রোজেক্ট শুরু হয়ে গেল।
ওর রোদে পোড়া লালচে জটালাগা চুল কামিয়ে দিয়ে ন্যাড়া করে দিয়ে প্রজেক্টের শুভ উদ্বোধন করা হলো। এর পরে কৃমির ঔষধ খাওয়ানো হলো, সাথে সারা বাড়ির সবাইকে খেতে বাধ্য করা হলো। দ্বিতীয় পর্যায়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চেকাপ করানো হলো। মেয়েটা খুব এনিমিয়ায় ভুগছে, অবাক হওয়ার মতো কিছুই না। তবে আর কোন সমস্যা পাওয়া গেল না।
সুতরাং ওর কপালে উন্নত মানের খাবার দাবারের বিরাট একটা শাস্তি এসে পড়লো আর সে সানন্দে এতে সাড়া দিলো। মাসখানেক এর মধ্যে মেয়েটার চেহারা এমন বদলে গেল যে বাসায় কোন মেহমান আসলে ধরেই নিতো সে এই বাসার ছোট মেয়ে।
রূপবান সারাদিন এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায় আর সবাইকে সাহায্য করে। চার বছরের পিচ্চি মেয়ে হলে কী হবে, সে সবকিছুতেই খুব সচেতন আর তার বুদ্ধির মাত্রাও খুবই প্রখর। বড়রা যা বোঝে না সেটাও সে বুঝে নেয়। মানুষ চেনার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা তার। সে কারো চোখের দিকেই তাকিয়ে বুঝে ফেলে। আস্তে করে কানে কানে বলে দেয়, "মা, লোকটা ভালো না, মিছা কথা বলতেছে"।
ফুটপাতে বড় হওয়ায় এই বয়েসেই সারভাইবালের গেমটা ভালোভাবেই শিখে নিয়েছে। বিজয়কে সে অসম্ভব ভালোবাসে। তার সবকিছু সে ঈগলচোখে নজর রাখে।
রুপা তাকে কারাওকি মিউজিকের সাথে নাচ শেখায়। মেয়েটা নাচেও দারুণ। দেখে দেখে নাচের অনুকরণের ক্ষমতা ওর অবিশ্বাস্য।
প্রথমদিনের ঝগড়ার পরে নাসিমা আক্তারের মনে ঢুকেছে যে তার শহীদ বাবা হয়তো মেয়েটাকে তার কাছে পাঠিয়েছেন। সুতরাং বাবার প্রতি ভালোবাসার ইতিবাচক প্রতিফলন এর সুফল রূপবান ভোগ করতে লাগলো।
এমন করে রুপবানের দিনকাল ভালোই যাচ্ছিল। সে এই পরিবারের চোখেরমণির মতো করে দিন কাটাচ্ছিল। কিন্তু কাজের মেয়ে দুটো এটা মেনে নেবে কেন?
তারা সুযোগ পেলেই ওকে গুঁতা দেয় বা ল্যাং মেরে ফেলে দেয়। ঝামেলায় ফেলতে চায়। রূপবান কোনো নালিশ না করলেও একদিন বিজয় দেখে ফেলে নজর রাখা শুরু করলো। একদিন রূপবানকে কাঁদতে দেখে সে কারণ জিজ্ঞেস করলো কিন্তু কোনো উত্তর না দিয়ে ও শুধু ফোঁপাচ্ছিল। বিজয় তখন কাজের মেয়ে দুটোকে ড্রইং রুমে ডেকে কারণ জিজ্ঞেস করলো।
ওদের সোজা সাপটা উত্তর,
- আমরা কিছু করি নাই, সে এমনিতেই ঢঙ করে। আমাগো বকা খাওয়াইতে চায়।
- আচ্ছা ঠিক আছে। তবে আবার যদি তোমরা ওর সাথে এমন কর তবে আমি ঘুমানোর সময় তোমাদের কানের মধ্যে মাকড়সা ছেড়ে দেব। মাকড়সা ভেতরে গিয়ে তোমাদের মাথার মগজ খেয়ে ফেলবে, তোমরা তখন পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে।
এই কথা শুনে কাজের মেয়ে দুইটাই হাউ মাউ করে ওর পায়ের উপরে এসে পড়লো,
- মাফ কইরা দেন ভাইজান। জীবনে আর কোনদিন ওর লগে লাগুম না। খোদার কসম। আল্লাহ্র কসম।
- মনে থাকে যেন, হুম!
রুপবানের শেষ সমস্যারও সমাধান হয়ে গেল।
রুপা ওকে লেখাপড়া শেখানো শুরু করলো। আইপ্যাড-এ একটা অ্যাপ নামিয়ে বিভিন্ন শব্দ শেখানো শুরু করলো। ছবির সাথে শব্দ থাকায় একবার শুনেই ও মনে রেখে দিতে পারে দেখে রুপাও খুব উৎসাহ নিয়ে ওর ছাত্রীকে শেখানো শুরু করলো।
আগামী বছর রূপবান স্কুলে যাবে, তাই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল।
একদিন বিজয় স্কুল থেকে বাসায় ফিরে দেখে দরজার সামনে একটা লোক বসে আছে।
- কে আপনি, কী চান?
- আমার মেয়েটাকে নিতে এসেছি।
- আপনার মেয়ে কে?
- ওই যে, এই বাসায় একটা বাচ্চা আছে না। সে আমার মেয়ে।
- আপনি বসুন, আমি আসছি।
ভেতরে গিয়ে সে রূপবানকে জিজ্ঞেস করলো এই লোকটা কি ওর বাবা নাকি। ছোট্ট মেয়ে, কী আর বুঝাবে তবে বিজয় বুঝতে পারলো যে লোকটা রূপবানকে দিয়ে ভিক্ষা করাতো তবে ওর কেউ না।
একটু পরে সে বাইরে এসে জিজ্ঞেস করলো,
- বাচ্চাটা তাহলে আপনার?
- জী, আব্বাজান।
নূরানি এক হাসি দিলো ব্যাটা।
- তাহলে তো পরীক্ষা করে দেখতে হয়! এক মিনিট, আমি যন্ত্র নিয়ে আসছি।
- এসবের পরীক্ষাও আছে নাকি? ঠিক আছে, করেন।
বিজয় তার রুম থেকে ইয়া বড় একটা সূইওলা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ আর একটা বাটি নিয়ে বেড়িয়ে আসলো।
- এইটা কী আব্বাজান?
লোকটার গলা থেকে আওয়াজ বেরুচ্ছিল না।
- আপনার শরীর থেকে এক বাটি রক্ত নিয়ে ডাক্তারের কাছে পাঠাব, পরীক্ষা করে ডাক্তার যদি বলে যে ও আপনার মেয়ে তবে আপনি অবশ্যই ওকে নিয়ে যাবেন। আর যদি বলে যে আপনি মিছা কথা বলেছেন তবে আপনাকে কালো বোরখা পরা, কালো চশমাওলা পুলিশের হাতে তুলে দেব। ছোট বাচ্চাদের দিয়ে ভিক্ষা করানোর জন্য বারো বছরের জেল হবে আপনার।
- আপনে আমারে রেবের হাতে তুইলা দিবেন?
- হ্যাঁ, সেটাই করবো। আমার চাচা সেখানকার বড় অফিসার।
লোকটা ভীষণ ভয় পেয়ে গেল, বিজয় আর কাজের মেয়ে দুটো ওর হাত টেনে ধরে রক্ত নেয়ার ভান করার সাথে সাথে সে টেনে হাত ছুটিয়ে নিয়ে এক দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামা শুরু করলো। পিছনে বিজয় আর কাজের মেয়ে দুটো। দোতালা পর্যন্ত নেমে লোকটা এক আছাড়ে গড়াতে গড়াতে এক তলায় গিয়ে পড়লো আর উঠে কোন রকমে দৌড় দিলো।
বিকেলে ক্রাইসিস মিটিং বসলো। রহমান সাহেব পুলিশে চাকুরিরত তার চাচাত ভাইকে ফোন করে পরামর্শ চাইলেন।
- তুমি একটা কাজ করো, মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়ার ঘটনাটা লিখে থানায় একটা ডায়রি করিয়ে নাও। সাথে একটা ফটোও দিও, এতে করে সবাই নিরাপদ থাকবে। সেটাই করা হলো।
দিন যেতে যেতে রূপবান খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে এই পরিবারের সাথে মানিয়ে নিলো। মনে হচ্ছিল যে আগের কোনো স্মৃতিই ওর মনে নেই। সে হয়তো এমনই একটা পরিবারের স্বপ্ন দেখত আর এই পরিবারকেই তার পরিবার ভেবে বসে আছে।
জীবনে কোনদিন ভালোবাসা না পাওয়ায় ভালোবাসার মুল্য সে বোঝে আর সেটাই সবাইকে উজাড় করে দিচ্ছে।

রুপবান - ৩
আস্তে আস্তে রূপবান নাসিমা আক্তারের সহকারী হয়ে দাঁড়ালো। আগে উনি কোথায়ও যেতে হলে সঙ্গী পেতেন না, এখন রূপবান সদা প্রস্তুত। বাসায় তার জন্য একটা গাড়ি বরাদ্দ থাকলেও একা একা কোথায়ও যেতে তার ভালো লাগতো না। এখন ইচ্ছে হলেই রূপবানকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।
খুঁটিনাটি বাজার হাটে তার যাওয়া আসা বেড়ে গেল। মেজাজ আর আগের মত খিটমিটে রইলো না। পরিবারে রুপবানের প্রভাব খুবই ইতিবাচক হওয়ায় সবারই বেশ ভালোই দিনকাল কাটতে লাগলো। এর মধ্যে খবর এলো শিগগিরিই রহমান সাহেবের ইউরোপ প্রবাসী বোন দুই মাসের জন্য দেশে বেড়াতে আসবেন এবং তিনি তাদের বাসায়ই থাকবেন।
গেস্টরুমটা তার জন্য ভালো করে ধোঁয়ামোছা করা হলো, ওনার আবার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে খুব নজর।
নির্দিষ্ট দিনে তিনি আসলেন। চমৎকার এক মহিলা ওনি। স্বামীর সাথে বিদেশে খুব ব্যস্ত জীবন কাটান, তাই খুব একটা দেশে আসা হয়ে ওঠে না। বাবা-মা গত হয়েছেন, ভাই রহমান সাহেব ছাড়া নিকট আত্মীয় কেউ নেই। তাই নাড়ির টানও নেই খুব একটা।
গেস্টরুমে ওনার জায়গা হওয়ায় রূপবান আপাতত ড্রইং রুমে থাকবে বলেই ঠিক হলো। রুপবানের এতে কোন আপত্তি নেই। ফুফুতো মাত্র কয়েকদিন থাকবেন।
প্রথম কয়দিন খুব হইহুল্লোড়ে কাটলো, এর পরে সবাই নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বাসায় নাসিমা আক্তার, রূপবান আর কাজের মেয়ে দুটো।
ফুফু নাসিমাকে নিয়ে এদিক ওদিক যেতে চাইলেই নাসিমা বলেন,
- তুমি রূপবানকে নিয়ে যাও, আমার ঘোরাঘুরি ভালো লাগে না।
তো কি আর করবেন, ফুফুও তাই করেন। সারাদিন রূপবানকে নিয়েই তার দিন কেটে যায়। এমন করতে করতে রুপবানের প্রতি তার একটা মায়াও জন্মে যায়। একদিন সবাই মিলে ড্রইংরুমে আড্ডা দেয়ার সময় রূপবান কী একটা ব্যাপারে নাসিমার সাথে কথা বলার সময় তাকে মা ডাকতে দেখে তার মনটাও খুব উদাস হয়ে গেল।
উনি রূপবানকে ডেকে বললেন,
- এই মেয়ে, আজ থেকে আমাকেও মা বলে ডাকবি। বুঝেছিস!
রূপবান ফিক করে হেসে দিলো।
- ওমা, আপনাকে মা ডাকবো কেন? আমার তো মা আছেন। ওই যে বসা! আপনে তো ফুফু।
- ফুফুকে কি মা ডাকা যায় না?
- নাহ, আমার মা তো একজনই।
এমন কাটা উত্তরে সবাই একদম থ মেরে গেল।
ফুফুর মন খারাপ হয়ে গেছে দেখে চট করে বলে উঠলো,
- আচ্ছা, আজ থেকে আপনাকে নুতন মা বলে ডাকবো।
- আচ্ছা, তাই ডাকিস।
কিছুটা হলেও শান্তি পেলেন বিদেশী ফুফু। তিনি নিজে নিঃসন্তান। এটা নিয়ে মাথাও ঘামান না। বাচ্চা হয় না, ব্যাস! কিন্তু রূপবানকে কাছে পেয়ে তার হৃদয়ে মাতৃত্বের ফল্গুধারা বইতে শুরু করলো।
রূপবান এমনিতেই তাকে সঙ্গ দিচ্ছিল, এখন সে হয়ে উঠলো তার জানের জান। ড্রইংরুমের মেঝে থেকে এখন রুপবানের আবার জায়গা হলো গেস্টরুমে, নুতন মায়ের সাথে। তিনি তাকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমান। শপিং-এ গেলে তাকে এটা সেটা বিভিন্ন জিনিস কিনে দেন। বলতে গেলে রূপবান যা-ই পছন্দ করে তাই সে পায়। নুতন মায়ের ব্যাগ ভর্তি টাকা।
তিন সপ্তাহ এভাবে কেটে যাবার পরে একদিন ডিনারের পরে বাচ্চারা নিজ নিজ রুমে চলে গেলে তিনি ভাইয়ের কাছে হালকা ভাবে তার মনের কথাটা প্রকাশ করলেন।
- আমি রূপবানকে আমার সাথে নিয়ে যেতে চাই।
- ওকে বেড়াতে নিতে চাও?
- না, দত্তক হিসেবে নিয়ে যেতে চাই। ওকে আমার মেয়ের মতো করে বড় করে তুলতে চাই।
আমাদের কোন সন্তান নেই। ভেবেছিলাম দত্তকে কাজ হবে না। এখন দেখছি মেয়েটা তিন সপ্তাহের মধ্যেই আমার মেয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমরা ভেবে দেখো।
- আচ্ছা, বিজয় আর রুপার সাথে আলাপ করে দেখি। রুপবানের মতামতও নিতে হবে। দেখি ও কি বলে।
বাচ্চাদের সামনে প্রস্তাবটা দেয়ার সাথে সাথে বাসায় কেমন যেন একটা ঝড় বয়ে গেল। বিজয় বাসার সব কাঁচের জিনিস ভেঙে ফেললো, আর রুপার ছুড়ে দেয়া রিমোট গিয়ে পড়লো ৬০ ইঞ্চি চওড়া স্মার্ট টিভির ওপরে। এমন কোন ক্ষতি না হলেও টিভির স্ক্রিনটা ফেটে গেল। রহমান সাহেব কিছুই বললেন না। কারণ তার নিজেরই ইচ্ছে করছিলো ওই ভাঙাভাঙির কাজগুলো নিজ হাতে করার।
এর পরের দিন ফুফু সবাইকে একটা আলোচনা করার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন।
- আচ্ছা, একটা কথা বলতো এই দেশে রুপবানের ভবিষ্যৎ কী?
- কেন? ও আমাদের বোনের মতোই বড় হবে।
- তারপর?
- তারপর আমাদের পরিবারের মেয়ে হিসেবেই ওর বিয়ে হবে।
- বরপক্ষকে বলতে হবে না যে ওকে তোমরা কুড়িয়ে এনেছ?
- তা বলবো, নিশ্চয়ই। সত্য কেন গোপন করবো।
- রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েকে কি কেউ বিয়ে করবে? আর করলেও দুদিন পরেই খোঁটা খেয়ে খেয়ে সে নিজেই ফেরত চলে আসবে, তাইনা?
সবাই চুপ মেরে গেল, অকাট্য সত্য।
- লেখাপড়া করেও যদি বড় কিছু করতে পারে তারপরেও তাকে খুব একাকী একটা জীবন কাটাতে হবে। তাইনা।
সবার মুখ এখন বন্ধ।
- তা আপনার কী প্রস্তাব, ফুফু?
- আমি ওকে এডাপ্ট করে সুইডেনে আমার বাসায় নিয়ে যাব। ও বড় হলে নিজেই ওর ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
- এডাপ্ট হলে এসব সহজ হয়ে যাবে কি?
- নিশ্চয়ই, সুইডেনে কেউ এসব নিয়ে কথা বলবে না। ও নিজের পরিচয়েই বড় হবে। মানুষ হবে। কিছুদিন পরে এসে তোমাদের কাছে এসে কতদিনের জন্য থেকে যেতেও পারবে।
তিন বছরের মধ্যেই ও সুইডিশ পাসপোর্ট পেয়ে যাবে, কারন আমি সুইডিশ নাগরিক। আর তারপরে ও চাইলে একদম চলেও আসতে পারবে। আমার কোন আপত্তি থাকবে না।
সবাই নরম হয়ে গেল, কারণ রুপবানের প্রতি তাদের বিশ্বাস অগাধ। এবার ফুফুর ওপরে দায়িত্ব এসে দাঁড়ালো রূপবানকে রাজী করানোর।
ওনি রাতে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন রাখলেন,
- এই মেয়ে, আমার সাথে যাবি?
- কোথায়, নুতন মা?
- আমার বাড়িতে।
- বিদেশে?
- হুম, অনেক দূরের একটা দেশে।
- মা, বাবা, বিজয় ভাইয়া, আপু, সবাই মিলে যাব?
- না, আগে তুই আর আমি যাব। কিছুদিন পরে পরে তুই এখানে বেড়াতে আসবি। পরে তুই বড় হয়ে গেলে সবাইকে নিয়ে যাবি।
- নাহ, থাক। আমি ওদেরকে ছাড়া যাব না। আমার খুব খারাপ লাগবে। শুধু কান্না আসবে।
- আচ্ছা গো মেয়ে। আমি একা একাই যাব আর বসে বসে তোর কথা মনে করে কাঁদব।
বাচ্চা মেয়ের বাচ্চা মনটা গলে গেল।
- আচ্ছা, আমি মাকে কালকে জিজ্ঞেস করে জানাব।
পরদিন নাসিমা আর রহমান সাহেবের কাছে প্রশ্ন করলে রহমান সাহেব তাকে উল্টা জিজ্ঞেস করলেন,
- তা তোর কি ইচ্ছা?
- আমার একদম ইচ্ছা নাই। কেউ কি তার মা, বাবা, ভাই, বোনকে ছেড়ে থাকতে চায়?
নাসিমা কোনো কথা না বলে তার ঝাপসা হয়ে আসা চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেন। তার ভেতরটা কষ্টে দুমড়ে যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটির ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
রহমান সাহেব বললেন,
- হুম। তবে একটা কথা আছে, রূপবান
- কী কথা বাবা?
- আমি তো বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। এই যে দ্যাখ, আমার সব চুল পেকে গেছে। তোমার মার ও তো দেখো বয়স হচ্ছে। শরীর খুব ভালো যাচ্ছে না। এখন তুমি যদি নুতন মায়ের দেশে গিয়ে ভালো করে লেখাপড়া করে বড় কিছু হয়ে আমাদেরকে সেখানে নিয়ে যেতে পারো তবে খুব ভালো হয়। আমরা সবই ভালো থাকতে পারবো।
আর নতুন মা সেখানে একা থাকেন, ওনারও খুব ভালো লাগবে।
রূপবান তার মায়ের দিকে তাকালো। নাসিমা তাকে কাছে ডেকে জড়িয়ে ধরে ভাঙা গলায় বললেন, তোমার বাবা ঠিকই বলেছেন। তুমি তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে আমাদের নিতে এসো। রূপবান মাথা নিচু করে চোখ মুছলো। কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলো।
- আচ্ছা বাবা, আমি যাবো। তবে তোমাদের জন্য আমার মন খারাপ করলে আমাকে দেশে নিয়ে আসতে হবে।
- আচ্ছা, আমি নুতন মায়ের সাথে আলাপ করে তোমাকে জানাব। উনি রাজী হলেই তবে তোমাকে নিতে পারবেন।
রূপবান খুশি মনে রুম থেকে বের হয়ে ওর নতুন মায়ের কাছে গেল। নতুন মা কথা দিলেন।
পরদিন থেকে শুরু হলো কাগজপত্রের কাজ। যে শিশুর নাম বাংলাদেশের কোন খাতায়ই নেই সেই শিশুর সব কাগজপত্র চেয়ে বসলো মহামান্য আদালত। যাই হোক, রহমান সাহেবের একজন স্মার্ট দালাল টাকা খরচ করে সব কাজই সামলে নিল। বাংলাদেশে টাকা দিলে বাঘের দুধ তো দূরের কথা সব কিছুই পাওয়া যায়। আদালত এফিডেবিটের মাধ্যমে রূপবানকে তার নতুন মায়ের দত্তক সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন। ওর জন্য একটা বাংলাদেশি পাসপোর্ট করিয়ে এবার সুইডিশ এম্বেসিতে রুপবানের জন্য পার্মানেন্ট ভিসার আবেদন করা হলো। কোন ঝামেলা ছাড়াই তিনদিনের মধ্যেই কাজটা হয়ে গেল।
সপ্তাহ দুয়েক পরে এমিরেটস-এর একটা ফ্লাইটে নতুন মা’র হাত ধরে রূপবান নতুন জীবনের দিকে পা বাড়াল।
........................................................................
বিধাতা সশব্দে হেসে উঠে অন্য প্রোজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন! 

পরিবেশ

 

নাসরিন চৌধুরী

 

 

আমাকে অনেকেই ফোন করে। চেনা অচেনা মানুষের ফোন।
নিউ ইয়র্কে বসত করার পর একদিনের জন্যও ফোনের রিং অফ করে রাখিনি। প্রয়োজন ছাড়া কেউ কাউকে অযথা বিরক্ত করবার জন্য ফোন করে না।
সেদিন বেশ অপরিচিত একটি কন্ঠ আমাকে ভাবনায় ফেলে।
- আপা কেমন আছেন? আমি সামাদ। দেশে গিয়েছিলাম। আম্মার সঙ্গে দেখা করলাম। আপনার ঠিকানা, ফোন নাম্বার এনেছি। আম্মা আপনার জন্য অনেক উপহার, শাড়ি ও আরো কত কিছু দিয়েছেন।
আমি অবাক হয়ে বলি, আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না, সামাদ কোন সামাদ?
- আপনাদের বাসায় ভিক্ষা করতে যেতাম। তখন আমার বয়স সাত। আম্মা আমাকে টুকরি কিনে দিলেন। বাজারে সাহেবদের মাল টানতাম। আম্মা ওনার বান্ধবীর বাসায় আমাকে কাজে দিছিলো। উনাদের ছেলে মেয়ে ছিল না। আমাকে ছেলের মতই দেখতেন। স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। এসএসসি, আইএসসি পাশ করলাম। ডিভি লটারি পেয়ে আমিরিকা আসলাম। এদেশে লেখাপড়া করলাম।
হঠাৎই জংধরা স্মৃতির পাতা হাতড়ে সামাদের কচি মুখটা খুঁজে পেলাম।
- মাগো সারাদিন কিছু খাই নাই। আমার বাপ মা নাই। আমি এতিম।
আম্মা আদর করে কাছে ডাকলেন। থালা ভরে ভাত খেতে দিলেন।
- তোর বাড়ি কোথায়?
- সিরাজগঞ্জ।
- ঢাকা এলি কেমন করে?
মামায় আনলো। কমলাপুর বস্তিতে মামা থাকে। আমারে কইলো তোরে খাওয়াবার পারুম না। নিজের পথ নিজে দেখ। আপুন মামা না। বাসাবো বাজারে আমারে একলা ফালাইয়া মামা গেছে গা। দুই দিন ধইরী ভাত খাই নাই।
- তোর বাপ মা কৈ।
- মইরে গেছে। না খাইতে পাইয়া শীতে কষ্ট পাইয়া মরলো গো। সিরাজগঞ্জে খাওন নাই। ঐখানে থাকলে আমি মরতাম।
সামাদের চোখ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরে। ময়লা শার্ট ময়লা হাফপ্যান্ট পরনে। লিকলিকে হাড্ডিসার ছেলে।
আমাদের বাসায় জোহরার মা বুয়া আছে। ফুটফরমাস খাটবার জন্য নয়-দশ বছরের রুহুল আছে।
আর কাজের লোকের দরকার নেই। রাতে সামাদ রুহুলের সঙ্গে ঘুমায়।
আম্মা চার পাঁচ দিন পর কলাবাগানে ডলি খালার বাসায় রেখে আসেন।
নিঃসন্তান ডলি খালা সামাদকে সন্তানের মত মানুষ করতে থাকেন। আমরা আর সামাদকে তুই করে বলি না। আমাদের মত সেও স্কুলে যায়। মাথায় চুপচুপ করে তেল দেয়। প্রায়ই ডলি খালা আমাদের বাসায় আসেন, সঙ্গে সামাদ। সামাদ এসেই টুপ করে আম্মার পায়ে ধরে সালাম করে। আমাদের আম্মাও সামাদের আম্মা। ডলি খালাও সামাদের আম্মা। সেই সামাদ কবে আমেরিকায় এলো!
হঠাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় আম্মার প্রিয় বান্ধবী ডলি খালা মারা যায়। সে কারণে দু'পরিবারের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
ডলি খালার মত অসাধারণ চরিত্রের মমতাময়ি মা জীবনে আমি কমই দেখেছি। পথের ধূলি মলিন অনাথ একটি শিশুকে মাতৃস্নেহে বড় করলেন। খালুও শেষ পর্যন্ত সামাদের প্রতি সদয় হলেন।
সরকারি চাকরি করেন খালু।
ডলি খালা মারা যাওয়ার পর আত্মীয়-স্বজনের চাপে পড়ে তিনি আবার বিয়ে করেন। সামাদের দুটি বোনের জন্ম হয়।
আমি আমেরিকায় এসেছি বেশ ক'বছর হলো। ফোনের ওপারে সামাদ, হ্যাঁ, তোমার কথা মনে পড়েছে সামাদ। আসো আমার বাসায় একদিন।
- হ্যাঁ আসবো, শনিবারে বাসায় থাকবেন আপা।
- হ্যাঁ থাকবো। বাসার ঠিকানা লিখে রাখো।
আম্মা দিয়েছেন, তারপরও বলছি। দেখুন মিলে কিনা।
সামাদ গড় গড় করে ঠিকানা বলে।
- ঠিকই আছে। তাহলে তুমি শনিবার চলে এসো। তুমি নিশ্চয়ই বিয়ে করেছো; বউ নিয়ে এসো।
- আপা, আগে আপনি দুলাভাই বাচ্চাদের নিয়ে আমার বাড়িতে বেড়াতে আসবেন। তারপর আমি আমার ওয়াইফ নিয়ে যাব।
- তুমি কোথায় থাকো সামাদ?
- আপসেট পকোপসিতে।
- আচ্ছা রাখি তাহলে সামাদ।
ফোন নামিয়ে রেখে কিছুক্ষণ ভাবি।
সামাদ আমেরিকায়, ওর জীবন গল্পের মত। আমার মেয়ে দুটি অবাক চোখে আমাকে দেখে।
- তোমাকে এত খুশি লাগছে কেন?
- কে আসবে?
- তোমাদের এক মামা আসবে সামাদ মামা।
ঈশিতা বলে, আম্মু বাংলা নামগুলো এমন কেন সালাম, জব্বার, বরকত, সামাদ। ঈশিতা তার গান, নাচের স্কুলের বাংলা পরীক্ষার জন্য ভাষা আন্দোলনের শহীদদের নাম মুখস্ত করছিল।
জসিমকে বলি, বাজারে যাও। আমার ভাই আসবে। সামাদ বলে কথা।
- সামাদ তোমার ভাই। কেমন ভাই? কখনো নাম শুনিনি তো!
- এখন থেকে শুনবে। দেখবে আর অবাক হবে।
জসিমকে সামাদের ভিক্ষা করার কাহিনী বলি না। ঈশিতা ও ময়ুরকেও বলা যাবে না।
এখনও কানে বাজে, মাগো সারাদিন কিছু খাই নাই। আমার বাপ মা কেউ নাই।
শনিবার ছুটি। রান্না শেষ। বাড়ি ফিটফাট।
দুপুরে সামাদ আসে।
এ যেন রাজপুত্র। কোথায় ওর রোদে পোড়া তামাটে ত্বক! রীতিমত ফরসা। মনে হলো এইমাত্র বাথটাবের সাবানের ফেনায় গোসল করেছে। ক্লিন শেইভ। নীলাভ গাল।
দু'ঘন্টার লম্বা পথ গাড়ি চালিয়ে এসেছে। ক্রিম কালারের স্যুট, নীল টাইয়ে অসম্ভব স্মার্ট লাগছে সামাদকে।
- আপা। নাসরিন আপা কত বছর পর দেখা। কোথায় ঈশিতা, ময়ুর। আমার মামনিরা কোথায়? দুলাভাই বাসায় নেই?
- আছে উপরে। বসো তোমাকে দেখি।
জসিম বাচ্চাদের নিয়ে নেমে আসে। জসিমকে সামাদ হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করে।
- দুলাভাই, আমি আপনার শালা, একমাত্র শালা। সামাদ খান।
- একা কেন বউ আনা উচিত ছিল।
- আনবো দুলাভাই। অবশ্যই আসবে। আগে আপনাদের যেতে হবে আমার বাড়িতে।
বড় সোফায় জসিম আর সামাদ পাশাপাশি বসে। সামাদ হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠে বলে, আপা দেখো তো আমার আনা উপহারগুলো তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা। ঢাকা থেকে বাজার করে এনেছি।
মুগ্ধ হয়ে উপহারগুলো দেখি। আম্মাও দিয়েছেন।
সামাদ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। একটা খ্যাতনামা কোম্পানির ডাইরেক্টর। প্রতি বছর একমাস ছুটি পায় বিভিন্ন দেশে বেড়াতে যাবার পরিবারসহ। সে বাংলাদেশে যেতেই আগ্রহী।
হাসি আনন্দে দিনটি বেশ কাটে।
সামাদকে খাইয়ে ভাল লাগছিল। বোঝা যায় আমেরিকায় প্রাচুর্যের ভেতর থেকে ও খুব আমুদে স্বভাবের হয়েছে।
যাবার বেলায় শেষ কথা হলো আসছে শনিবার আমরা পোকিপসিতে যাব, রাতে থাকবো। রবিবার ফিরবো। আমার খুবই আগ্রহ যাওয়ার। সামাদ এক বিস্ময়। এত আপন মনে হলো ওকে। আপসেটে যাবার আগে জ্যাকসনহাইটসে গোল্ডের দোকান থেকে একজোড়া কানের দুল কিনি, সামাদের বউকে প্রথম দেখব। একটা শাড়িও কিনেছি। সাথে মিষ্টি।
হাইওয়ে ধরে গাড়ি ছুটছে। দু'পাশে সবুজ বনবনানী। প্রকৃতির অপরুপ শোভা আমাকে মাতাল করে দিচ্ছে। ডলি খালার হাতের স্নেহের পরশ পেয়ে প্রায় মৃত একটি চারা গাছ কেমন লকলকিয়ে বেড়ে উঠেছে। ডিভি লটারি সামাদের ভাগ্যকে আরো দশ ধাপ উপরে তুলে দিয়েছে।
দেখতে দেখতে ছবির মত সুন্দর পোকেপসিতে সামাদের বাড়িতে পৌঁছে যাই। এমন সুন্দর চমৎকার বাড়ি। এর আগে যেন এমনটি দেখিনি; বিশাল এলাকা নিয়ে বাড়ির আয়তন। গেটের সামনে লন। বসন্তকালের বাহারি ফুল ফুটে আছে লনের বেডে।
সামাদ আর যুথি এগিয়ে আসে। বাড়ির ভেতর ঢুকে হতবাক হলাম। এত চমৎকার। অভিভুত আমি।
যুথি আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমরা যেন কত পরিচিত।
- আপা বসুন। ঈশিতা, ময়ুর, তোমরা ভাল আছো?
ওরা দুবোন মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ
ময়ুর জানতে চায়, আন্টি তুমি আমাদের নাম জানো কেমন করে?
- তোমার নানুর বাসায় গিয়েছিলাম। তোমাদের ছবি দেখেছি, নাম জেনেছি। তাই তোমরা আমার অপরিচিত নও।
সামাদের দু'বছরের ছেলে অর্ককে বেবি সিটারের কোলে দেখে হৈচৈ করে উঠলাম, সামাদ তুমি তো বলো নি তোমার রাজপুত্র বাবু আছে।
- জানতে চাওনি যে।
- খুব অন্যায় করেছো। খালি হাতে আমি অর্ককে কোলে নেব কেমন করে।
সামাদ বলে, আপা তুমি শুধু দোয়া করবে।
উপর নিচে মিলিয়ে বাড়িটায অনেকগুলো রুম। বাড়ির পেছন দিকে ব্যাকইয়ার্ড। সুইমিং পুল। ঝকঝকে তকতকে বাড়ি। যুথি ব্যস্ত হয়ে যায় আপ্যায়নে। এত মিষ্টি আর লক্ষি মেয়ে যুথি। যুথি ডাক্তার। তিন বছর বয়সে বাবা মায়ের সঙ্গে আমেরিকায় এসেছে। ডাক্তার আলমগীরের একমাত্র মেয়ে যুথি। দেশে খুব যায় সামাদ।
সিরাজগঞ্জে একটি শিশু আশ্রম কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। দরিদ্র অনাথ শিশুরা সেখানে শিক্ষা পায়। সামাদ তার আশ্রয় কেন্দ্রের নাম দিয়েছে ডলি মা আশ্রম।
দুপুরের খাবার টেবিলে সাজানো হচ্ছে তখনই মোতাহার খান ও মিসেস খান আসেন। সঙ্গে তাদের ছোট মেয়ে মিথিলা। জানতাম না ডলি খালার স্বামী এদেশে আছেন। এত বছর পর ডলি খালার বরকে দেখে চিনতে পারি। রিটায়ার্ড করেছেন। খালুকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি। খালু ভাল আছেন?
- হ্যাঁ মা ভাল আছি। তোমরা ভাল তো। তোমার আম্মা ভাল আছেন? শুনেছি তোমার আব্বা মারা গেছেন।
ডলি খালা খালুর পাশে নেই। সামাদের নতুন মা। মিসেস রাহনুমা খান। তাকেও আমরা সালাম করি। মিথিলা ও মিথিলার বর চমৎকার জুটি। দু'জনই ডাক্তার। সবাইকে দেখে খুব ভাল লাগে। মোতাহার খানের সাফল্যময় জীবন। সামাদ স্পন্সর করে সবাইকে এনেছে। খালু পুরানো স্মৃতিচারণ করেন।
ডলি সামাদকে নিজের ছেলের মত মানুষ করেছে। সামাদ আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে।
মুগ্ধ হয়ে সবাইকে দেখি।
টেবিল ভর্তি থরেথরে সাজানো খাবার। যুথি চমৎকারভাবে পরিবেশন করছে। সঙ্গে মেইড সার্ভেন্ট খাবার টেবিলে আনছে। এত পদের খাবার।
মিথিলা ও ওর বর শুভ‌ ঈশিত, ময়ুর আমার দুই মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। আমরা লনে গার্ডেন চেয়ারে বসি। অর্ককে সারাক্ষণ কোলে রাখছেন রাহনুমা খালা। দাদু ভাই দাদু ভাই বলে আদর করছেন। সারা বাড়ি ঘুরে দেখি। রুচি আর আভিজাত্যের ছাপ সর্বত্র। সুখে থৈ থৈ সাজানো সংসার। লাইব্রেরি রুম তিন তলায়। প্রচুর বই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্তের ছবি দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। যুথি বলে, সামাদ বই পাগল। যুথি আরো জানায়, সামাদ তার আত্নজীবনী লিখছে ইংরেজীতে। তার শৈশব থেকে এপর্যন্ত উঠে আসার সমস্ত কাহিনী। আমার শাশুড়ি বেঁচে নেই তাই সামাদ আপনার আম্মা আমিনা খাতুনের কাছ থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছে।
ভয়ের সঙ্গে সংকোচ নিয়ে বলি, যুথি তুমি কি জানতে সামাদ ছিন্নমূল পথ শিশু। ভিক্ষা করেছে শৈশবে।
যুথি হেসে বলে, হ্যাঁ, ও আমাকে সব বলেছে কিছু লুকোযনি। আমাদের বিয়ে প্রেমের। বিয়ের আগেই সামাদ সব বলেছে। আসলে আপা জানেন কি সবই পরিবেশ। আমরা বাংলাদেশের যে শিশুগুলোকে দত্তক এনে এডাপ্ট প্যারেন্টসদের দিয়েছি দেখবেন এক একটা শিশু কেমন চমৎকার জীবন পায়। কত মেধাবী ওরা।
রাতের ডিনার শেষে রাহনুমা খালা-খালু মিথিলা, শুভ চলে যায়। যাবার আগে মোতাহার সাহেব, ডলি খালার স্বামী বলেন, শোন মা
আমেরিকায় এসে নতুন জীবন পেয়েছি। বাংলাদেশে অবসরে যাওয়া মানুষগুলো অথর্ব হয়ে যায়। কোথাও যাবার জায়গা নেই, করার কিছু নেই। অথচ আমেরিকায় এখনও আমি কর্মঠ আছি। সপ্তাহে তিন দিন যুথির হাসপাতালে কাজ করি। তোমার খালা রাহনুমা আপসেটেটে বাংলা সংস্কৃতি শিক্ষা স্কুলে বাচ্চাদের বাংলা শেখায়। আবৃত্তি শেখায়। স্কুল শিক্ষক ছিল দেশে, শিক্ষা দানে তার অশেষ আগ্রহ। দেশে থাকলে মনে হতো ফুরিযে গিয়েছি। এখানে তা মনে হয় না। জীবন অফুরান।
ধীরে ধীরে রাত গভীরে যায়। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। লনের ঘাসে জোনাক পোকা জ্বলে আর নেভে। আগষ্টের ভ্যাপসা গরম। অন্য রকম একটি দিন গেল। আমি, জসিম, সামাদ বসে থাকি লনে গার্ডেন চেয়ারে।
যুথি বাচ্চাদের ঘুমের ব্যবস্থা করতে দোতলায় গেছে। সুইমিংপুলের নীল পানিতে দু'একটা শুকনো পাতা ঝরে পড়ে। সামাদ হঠাৎ নিরবতা ভঙ্গ করে বলে, আপা মানুষের জীবন বড় অদ্ভুত! আমি যদি বাসাবোতে আপনার আম্মার চোখে না পড়তাম। তাহলে আমার জীবন কেমন হত। কোথায় থাকতাম আমি। সামাদের চোখ ভিজে ওঠে। ভেজা কন্ঠে সামাদ বলে, আপা আজও আমার চোখে ভাসে আমার বাবা মা খেতে না পেয়ে শীতে কষ্ট পেয়ে মারা গেছে। আহারে উত্তর বঙ্গের শীত যে কেমন ভয়ঙ্কর!
- তুমি তোমার উত্তর বঙ্গে যাবে। এখনও সেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন অসহায়। শীতে কষ্ট পায়। যাকাতের দান আনতে যেয়ে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মারা যায।
- আপা আমি যাই সাহায্য করি। তা না করতে পারলে আমার ঘুম হয় না।

রাতের বয়স বাড়ে। অদ্ভুত নিরবতায় পোকেপসি ঘুমিযে আছে। দুরের বাড়িগুলোর আলো নিভে গেছে। সামাদ তার লাইব্রেরিতে যায়। এবার সে লিখবে। আমি ঘুরে ঘুরে সারা বাড়ি দেখি। দেখি হলওয়ে। মুগ্ধ হই। বিশাল লিভিংরুমের দেয়ালে তৈল চিত্র ডলি খালার, সারাদিন চোখে পড়ে নি। ছবির সামনে আমি হাঁটু গেরে বসি। অনন্য অসাধারণ মহীয়সী নারী। আনন্দে আমার চোখ ভিজে যায়। কেন জানি না আমি হুহু কাঁদছি। কাঁদতে ভাল লাগছে।
শুভ কাজ, সাফল্যের সামনে দাঁড়ালেও মানুষ বোধহয় কাঁদে।