টরন্টো, ১৯ কার্তিক ১৪২৭ বঙ্গাব্দ, নভো সংখ্যা ১৪
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি অনুবাদ যোগাযোগ আবৃত্তি

কার্তিকের কুয়াশা

কবিতার পাতা

 

 

ইহজাগতিকতা
সৈকত রুশদী

কেউ কী ডেকেছিল!
হয়তোবা, হয়তো না

বিনাশের শেষ বিন্দু থেকে তবু ফিরে আসি
অযুত সম্ভাবনার অনুপল আশা নিয়ে

ঘুম থেকে জেগে উঠি যতোবার, মনে হয়
স্বল্প-মৃত্যুর পর নতুন জীবন

ভোরের শিশির মুছে ফেলে ব্যর্থতার গ্লানি
কাঠঠোকরা অবিরাম খোদাই করে চলে, কালের লিখন

মায়াবী দৃষ্টিভরা মাছরাঙা যেমন
জল থেকে ফুঁড়ে নেয় আপন শিকার
সেই অন্তর্ভেদী দক্ষতার প্রত্যাশা
আজ এক অনিশ্চিত অমায়

নৈরাশ্যের শেষ বিন্দু থেকে তবুও ফিরে আসে মানুষ
অলক্ষ্যে বারবার

কেউ কী কখনও ডাকে!
হয়তোবা, হয়তো না

 

 

অপরিণামদর্শী
ইশরাত জাহান নেলী

ঝিরিঝিরি ঝরে পড়ে শ্বেত শুভেচ্ছা;
এমন শুভেচ্ছা আগেও কত শতবার
অর্থহীন হয়ে গিয়েছে ফিরে,
কতবার অপমানিত হয়েছে মানবতার খাতিরে।
আমরা অকৃতজ্ঞ বলে আশীর্বাদ নিতে জানিনা,
পায়ে দলে কর্দমাক্ত করি চলার পথ।
আমরা অন্ধ বলে আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেই।
একদিন সমস্ত বিশ্বাসের ছায়া যখন সরে যাবে,
অসহায় ক্রোধে আমরা উন্মত্ত হবো,
আমরাই তখন আঙুল তুলে
সুতীব্র বাক্যবাণে পরস্পরকে জর্জরিত করবো।
সেদিন হবে অপরিণামদর্শিতার
ঘৃণিত নির্লজ্জ বিচার।

 

সুবর্ণতট
মোরশেদ হাসান

সূর্যের আলো ছেনে একমুঠো নীল নিয়ে
ছুঁড়ে দিই তোমার পানে
কতটুকু দুঃখহরা হয়ে
বেদনা জাগাতে ভালোবাসো সরোবরের বুকে।
সাগরের বেলাভূমিতে রেখে যাওয়া ছাপ ছুঁয়ে
তোমার অলকদামের সুবাস মেখে
একদিন ঠিকই পৌঁছে যাব সুবর্ণতটে।
না বলা কথার মালা গেঁথে রেখেছি
ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা কাগজের ভাঁজে ভাঁজে,
তোমার চোখে বহু বছরের জমাট বরফ
বুকের উষ্ণতায় গলে কেবলি শর্বরী নদী হয়।
সাতনরী হার রাতের গলায় পরিয়ে দেব
আঁধারের ডায়েরিতে আমার আগমনবার্তা লিখে যাব
ঝিকিমিকি তারার আলোয় কুয়াশার আলোয়ান পরে
বহু দূর হেঁটে গেলে পর নাকি পাখিরা কূলায় ফেরে।

 

হতেই পারতো
লুবনা ইয়াসমিন

দু'জনে শরতের অরণ্যে যাওয়াই যেতো
ঝরাপাতাদের রঙ মাড়িয়ে বিকেলের পথে...
মায়া-গ্রন্থিটায় আরেকটা আলতো বাঁধন...
অভিমানকে নিখুঁত ভাঁজে খামে পুরে
পাতার ডাকটিকেট সেঁটে পোস্ট করলেই
উড়ে যেতো মাধ্যাকর্ষণ পেরিয়ে...
গ্রীষ্মের সুখস্মৃতিতে সবুজ সোনালি প্রশ্রয়!
ফটোগ্রাফস এন্ড মেমোরিজ...গুনগুন সুর...

তা নয়, কথাদের ওয়েভ লেংথ বেয়ে নৌকাবাইচ
তোমার বোহেমিয়ান পালক খসানোর খেয়াল
ভাসছে শরতমেঘে, ঝরছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে
দমকা অহমের ঝাপটায় ঝরছি আমিও
ঝরাপালকেরা কোথায় ভেসে যায়
পরিযায়ী হাওয়ায়, খোঁজ কি রাখে কেউ?

 

প্রিয়তমেষু
জেবুন্নেছা জোৎস্না

তোমার এক চোখে যুদ্ধ, অন্য চোখে প্রেম
যতোবার চেয়েছো আমায়, নিবেদিত ছিলেম!
যতোটা চিনেছ আমায় তুমি-
ততোটা তো বুঝিনি নিজেকে আমি—
যেন তোমার ছোঁয়ায় কদমের পেলবতায়
শুদ্ধতর হলেম।

গল্পে তোমার বিজয়ের ক্লাইমেক্স,
বলোনি অনাহূত দিনে হেরে যাওয়ার পটভূমি—
বণিকের লেনদেনে পরিত্যক্ত যতো অভিমান,
খারাপ দিনে ফেরি করো তুমি আনন্দের ধ্বনি!
জলজ ঘাসের নিত্য নব রন্ধ্রে জাগো তুমি
হেঁটে যাও শেষ বিকেলের সুর্যাস্ত চোখে,
যেন চে-গুয়েভার বিশ্লেষিত বিপ্লবী বন্ধনে
দুঃস্বপ্নে ভ্রান্তি জাগাও গুয়ের্নিকার চিত্রপটে।

কতোদিন দুর থেকে পাহাড়কে সমুদ্র ভেবে
বাসনার শ্রাবণে গড়িয়েছে আলিঙ্গনের ধারাপাত—
কখনও বা অলিন্দে ধবল জ্যোৎস্নায় রাহুর গ্রাসে
গোছানো শহরে আচানক এনেছো অগ্নুৎপাত।
অথচ, সুরার নেশা কাটতেই কেমন বদলে যাও তুমি
স্নানঘরে খোঁজ জীবনের অন্য রসায়ন—
যুদ্ধাহত শহরে শতাব্দীর ক্ষত মুছে
জীবনের ওষ্ঠে আঁকো আগামীর আয়োজন।

প্রিয়তমেষু—এসো ভুলি আজ যুদ্ধ শেষে
চন্দ্রাহত দ্রোহের ঘনশ্যামে—
সব অভিমান নিভিয়ে দেব তোমায়
নির্ভেজাল ফুলের ভালবাসার দামে।

 

ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আমি তোমার মেয়ে হবো
মৌ মধুবন্তী

আমারও তো মা ছিল
নামের শেষে বেগম ছিল
মায়ের বুকে আগুন ছিল
মুক্তিযুদ্ধে সাপোর্ট ছিল
নামাজেও নিয়ম ছিল
ধর্মেও তাঁর বিশ্বাস ছিল
আমাদের প্রতি কঠোর ছিল
শাসন, বারণ, আদর, সোহাগ সবই ছিল
প্রগতিশীল মা ছিল, উদার একটা মন ছিল
ধর্ম, কর্ম, পীর, মুর্শিদ তাও ছিল
গ্রামে তাহার খ্যাতি ছিল
নিজের ক্ষেতে ফসল ছিল,
পরকে দেবার হাত ছিল
ঈদে-আনন্দে গ্রামের প্রতি নজর ছিল
আমার জন্য নয়নভরা কান্না ছিল
বাপীর প্রতি অগাধ তাঁর প্রেম ছিল
খবর নিত, কার কোথায় অভাব ছিল
যুবতি মেয়ের প্রেম ছিল
যুবকটাও বেকার ছিল
তাদের বিয়েও দিয়েছিল
ননদ, দেবর সবার প্রতি নজর ছিল
বাসন্তী যেবার মরেছিল
মা ভীষণ কেঁদেছিল
হিন্দু, মুসলিম, হুজুর, আলীম, শার্ট, প্যান্ট আর শাড়ীপরা,
সবাইতো এক ছিল
আমার মাতো প্রগতিশীল মানুষ ছিল
তাঁর মাথায়ও কাপড় ছিল,
লম্বা মাপের বোরখা ছিল
তবুও মা কত উদার ছিল
মানুষ জ্ঞানে, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল
আমার মা'টাই বিশ্বসেরা কবি ছিল
তাহার মুখে আমাদের জন্য ছড়া ছিল
বিয়ে বাড়িতে গানের আসর তারই ছিল
নালিশ, সালিশ সব কিছুতেই তার বিচারই সেরা ছিল
ন্যায়-অন্যায়ের বোধ ছিল
বিবেচনায় প্রখর ছিল
সাধারণ জ্ঞানে দখল ছিল
আমার মা দক্ষ এক প্রকাশক ছিল
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সে সমৃদ্ধ ছিল
'৭১-এ নবজাতক কোলে ছিল
শিশুকোলেই রাইফেলগুলো লুকিয়েছিল
মুক্তিযোদ্ধার আশ্রয় ছিল
স্বামীর কাছে বিনীত ছিল
বাবার কাছে আদুরে ছিল
ভাইয়ের কাছে সুন্দর ছিল
বোনের কাছে তারকা ছিল
আমার কাছে মা ছিল
টর্নেডো আর বন্যাতেও ত্রাণ ছিল
দেশের সকল দুর্যোগে তাঁর মন ছিল
গোটা গোটা অক্ষরে সে লিখেছিল
পশুর ছাল গায়ে দিয়ে, মানুষের জন্য মানুষ হবে
বিপদের দিনে শত্রুকেও মোকাবেলা করবে
একা যদি লড়তে হয়, একাই তুমি লড়ে যাবে
মানুষের তুমি প্রতিনিধি হবে,
অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে
নারীর জন্য নিরাপদ আশ্রয় হবে
বন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ত হবে
তবেই তুমি আমার মেয়ে হবে।
এখনো আমি পারিনি মা, তোমার দেয়া আদেশ,
নিষেধ সব কিছুকে পালন করতে
আশীর্বাদ দিও, সাগরজোড়া সাহস দিও
নদীর মত চলতে দিও
ঝরনার মত হাসতে দিও
তোমার মেয়ে হবোই হবো
বিশ্বকবির কথা কব
ধর্ম, বর্ণ, কালো-সাদা নির্বিশেষে
মানুষ জ্ঞানে মানুষ হবো।
ওমা আমি তোমার মেয়ে হবো।

 

পদ্য প্রেম
সাইদুজ্জামান

ফের ফিরে আসা - আশায়,
কার্তিকের কুয়াশায়,
ভাসতে নতুন ভাষায়,
পড়তে ভালোবাসায়,
গড়ন-পিটন আমিই আমায়,
তুমি শুধু টানটুকু দাও,
ঘর না থাকুক, আকাশ আছে,
প্রেম ছাড়া কি মানুষ বাঁচে?
তুমি শুধু টানটুকু দাও, তোমার টানে,
আমি একাই পৌঁছে যাবো প্রেমোদ্যানে।