টরন্টো, ১৯ কার্তিক ১৪২৭ বঙ্গাব্দ, নভো সংখ্যা ১৪
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি অনুবাদ যোগাযোগ আবৃত্তি

কার্তিকের কুয়াশা

সম্পাদকীয়

মানবজাতিকে এক দারুণ ঝাঁকুনি দিয়ে পথ পরিক্রমণ শেষ করতে যাচ্ছে ২০২০ সাল। ইতিহাসের পাতায় একটি মোটা দাগে চিহ্নিত হয়ে থাকবে বছরটি। যদিও পৃথিবীর ইতিহাসে মহামারি কোন নতুন ঘটনা নয়, তবুও আমাদের কাছে এই মহামারি এক করুণ বাস্তব অভিজ্ঞতা। মার্চের শুরুতে যখন কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার শুরু হলো, মানুষের ভাবনায় আসেনি এভাবে সমগ্র বিশ্ব আক্রান্ত হবে। ভাইরাসে লক্ষ লক্ষ মৃত্যু, বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি, সামাজিক ও মানসিক আতঙ্কের মধ্য দিয়ে চলতে হবে পুরো বছর জুড়ে। আমাদের অধীর আগ্রহে অপেক্ষা নিয়ন্ত্রিত মাস্কযুক্ত ‘নিউ নরমাল’ থেকে নরমাল বা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য। যদিও মহামারির এই নিয়ন্ত্রিত অবস্থানের অভিজ্ঞতা আমাদের চিন্তাজগত ও স্বাভাবিক জীবনের উপলব্ধির জায়গাটিতেও ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। আসলে স্বাভাবিক জীবন একটি আপেক্ষিক বিষয়। রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে, যে স্বাভাবিক জীবনে আমরা ফিরে যেতে চাচ্ছি সেকি আদৌ স্বাভাবিক জীবনযাপন? এ-প্রসঙ্গে কানাডীয় কবি, প্রাক্তন টরন্টো পোয়েট লরিয়েট ডিওন ব্রান্ড (Dionne Brand) তাঁর এক বক্তব্যে বলেন –“… the repetition of “when things return to normal” as if that normal, was not in contention. Was the violence against women normal? Was the anti-Black and anti-Indigenous racism normal? Was white supremacy normal? Was the homelessness growing on the streets normal? Were homophobia and transphobia normal? Were pervasive surveillance and policing of Black and Indigenous and people of colour normal? Yes, I suppose all of that was normal. But, I and many other people hate that normal.” (The Star, July 4, 2020)

নিয়ন্ত্রিত ও অবরুদ্ধ থাকাকালীন এই দীর্ঘ সময়ে এসেছে অভিনব পরিবর্তন। প্রায় বিস্ফোরণ ঘটেছে ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীলতা। মানুষের জীবনযাপনের তাবৎ কর্মকাণ্ড হয়ে উঠেছে অনলাইনভিত্তিক। শিল্প-সাহিত্য চর্চাও পিছিয়ে থাকেনি। সৃজনশীল মানুষ তাদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে এই অনলাইন মাধ্যমকে গড়ে তুলেছে শিল্প হিসেবে।

আর প্রাণের কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো “আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষসন্ধ্যায়; দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার;… আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এইসব নিভৃত কুহক” – তেমন অগ্রজ ও নবীন লেখকদের সাহিত্য নির্যাসে সিক্ত হয়ে কার্তিকের কুয়াশাও নিয়মিত কুয়াশা সরিয়ে প্রকাশিত হবার পথ খুঁজে নিয়েছে। প্রবাস জীবনের ব্যস্ত ঘড়ির কাঁটায় অনেক প্রতিভা চাপা পড়ে যায়। কিন্তু বুকের গহীনে তিরতির জেগে থাকে আবেগের ঝরনা। কোন এক পাতাঝরা বিকেলে, কিংবা নায়েগ্রা জলপ্রপাতের অপার সৌন্দর্যের পাশে দাঁড়িয়ে কবিতার দুটি পঙক্তি পাঁজরের আঁধার ছেড়ে বেরিয়ে আসে। সেই আবেগ, সেই প্রতিভা আমরা সযত্নে আগলে রাখতে চাই কার্তিকের কুয়াশায়।

এই সংখ্যার আয়োজনে আমরা পেয়েছি বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক কবিতা যেখানে আছে – ভালোবাসার গুঞ্জরন, দ্রোহ, প্রেম ও অন্তর্গত জীবন দর্শন। গল্পের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রতিফলিত হয়েছে সামাজিক ও মানবিক বোধ।  নতুন সংযুক্ত হয়েছে অনুবাদ পাতা। কানাডার বেস্ট সেলিং পোয়েট ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নন্দিত কবি রুপি কাউর-এর কবিতার অনুবাদ দিয়ে সাজানো হলো অনুবাদ পাতা। এই আয়োজন পাঠকমনকে গৃহ অন্তরীণ অবসন্নতা কাটিয়ে কিছুটা হলেও তৃপ্ত করবে এবং ভাবনার জগতকে আন্দোলিত করতে সক্ষম হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

শিল্প-শিল্পদীনতা-শিল্পহীনতা, এই শব্দগুলো পাশাপাশি থাকে। কোনো নির্মাণ একবারেই সুনির্মিত হয় না। অনেক দোলাচল, আশা-নিরাশা, ভাঙা-গড়ার অসংখ্য বিমূর্ত আঁকিবুকি দিয়ে পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে। তাই নবীন লেখকদের সহজাত মেধাকে যারা সমালোচনা ও তিরস্কারে চূর্ণ করে দিতে চায় আমরা তার বিপরীতে দাঁড়াতে চাই। আমি মনে করি, সাহিত্য চর্চা হচ্ছে অন্তরের বিকাশ ও পরিচর্যা, যা একজন মানুষকে ক্রমশ প্রাজ্ঞ করে তোলে। কার্তিকের কুয়াশাও আগামীতে আরও পূর্ণাঙ্গ, আরও সুনির্মিত হয়ে উঠবে সেই প্রত্যাশা আমাদের।

শিউলী জাহান, টরন্টো,
নভেম্বর ৪, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ
১৯ কার্তিক ১৪২৭ বঙ্গাব্দ