টরন্টো, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২০ নভো সংখ্যা ১২
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি প্রবন্ধ যোগাযোগ আবৃত্তি

কার্তিকের কুয়াশা

চোখের আলোয় দেখেছিলেম

 

মধুবন্তী আইচ

 

 

শুভদৃষ্টির পর মালাবদলের পালা শেষ করে রাতুল আর মৌবনী পাশাপাশি বিয়ের পিঁড়িতে এসে যখন বসলো, মৌবনীর বাবার সাথে রাতুলের বাবাও বিয়ের মণ্ডপের দিকে এগিয়ে এলেন। পুরোহিত মশাই সম্প্রদানের মন্ত্র পড়া শুরু করতেই উনি প্রথমে রাতুলের হাতটা মৌবনীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন "আজ থেকে আমাদের ছেলে টাকে তোর হাতেই সঁপে দিলাম রে মা। এইরকম ভাবেই তোরা দুজন দুজনের হাত ধরে সারাজীবন পথ চলিস সব বাধা কাটিয়ে।" মৌবনীর দিকে তাকিয়ে তারই দেওয়া একটা চোখ দিয়ে রাতুল দেখলো তার এতদিনকার ভরসা, ভালোবাসা, জীবনের রং রূপ সব যেন নতুন করে সম্পূর্ণতা পেয়ে তাকে ঘিরে রয়েছে । আর মৌবনীও রাতুলের চোখের দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি করলো একটা চোখ তাকে দিয়ে দিতে হয়েছে ঠিকই কিন্তু সে হারায়নি কিছুই, রাতুলের চোখে উপচে পড়া ভালোবাসার প্রকাশই তার বাকি জীবনটার পাথেয়। চোখ সত্যিই মানুষের মনের আয়না! রাতুল আর মৌবনী কোনো কথা না বলে এক দুজনের দিকে আরও একবার শুভদৃষ্টির পূর্ণতা নিয়ে তাকিয়ে রইলো। দুজনের হাতের আঙ্গুলগুলো জড়িয়ে রইলো একে অপরকে। বিয়ের মণ্ডপে শঙ্খধ্বনি জোরালো হলো তাদের নতুন পথ চলার আশীর্বাদ স্বরূপ...।

 

 

দিদির বিয়ে

 

প্রতিমা সরকার

 

আমরা তিন বোন।বিথী,বকুল,আরমল্লিকা।মল্লিকা সবার বড়।মাঝে আমি,সবার ছোট বিথী।আমাদের বাবা সারাজীবন সরকারী চাকুরি করে কয়েক বছর হলো অবসর নিয়ে কুমিল্লা শহরের এক প্রান্তে একটি ছোট খাটো বাড়ি বানিয়ে আমাদের নিয়ে বসবাস করছেন।আমাদের কোন ভাই নেই,এজন্য মায়ের একটু আফসোস থাকলেও বাবার একেবারেই ছিল না।বাবা সবসময়ই বলতেন আমরা তিন বোন হলাম ঘরের লক্ষি।কখনো কোন দিক দিয়েই আমাদের অভাব রাখেননি।আর আমাদের মা সবসময় চাইতেন আমরা যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পার করে তবেই বিয়ের পিড়িতে বসি।

 

সেই মতোই আমার বড় বোন মল্লিকাদি যখন মাস্টার্স শেষ করল,মা দু একজনকে বলতে লাগলেন যেন দিদির জন্য একটা ভাল পাত্র দেখে দেন এক পরিচিত ঘটককেও বললেন পাত্রের খবরাখবর আনার জন্য। ঘটক মশাইও এক,দুজন পাত্রকে ধরে বেঁধে এনে দেখালেন আমার দিদিকে।এভাবেই চলছিল।আমি তখন মাস্টার্স করছি।ভার্সিটিতে যাই,আসি।ছোট বোনটা স্কুলে পরে।এমন সময় আমাদের দুঃসম্পর্কের এক মামা দিদির জন্য তার এক পরিচিতের ছেলের আলাপ আনলো।যাদের বাড়ি চাঁদপুর।বাবাচাঁদপুরে সরকারী কলেজের শিক্ষক ছিলেন,এখন অবসরপ্রাপ্ত।পাত্র ভদ্রলোকের দ্বিতীয় সন্তান।সিলেটে ক্যাডেটকলেজের প্রফেসর।বড় ছেলেওবিয়ে করেনি।পাত্রের ছোট আরো দুই ভাই আছে।

 

একদিন পাত্র, আমার দুঃসম্পর্কের মামা,মামী,পাত্রের বাবা,মা আর পাত্রের ইমিডিয়েট ছোট ভাই সহ আমার বোনকে এসে দেখে গেল এবং দিদিকে পছন্দ করে গেল। অবশ্য আমার দিদি পছন্দ করার মতই মেয়ে।সহজ,সরল।যেমন দেখতে সুন্দর,তেমন কাজে কর্মে গুনবতী।আমি তখন ভার্সিটিতে।বাসায় থাকলে হয়ত মা,বাবাকে বলতাম আর না এগোতে।কারন ছেলে দেখতে ভালো হলেও হাইটে অনেক কম প্রায় আমার বোনের সমান।এমনকি কমও হতে পারে!আর আমার বোন খুব একটা লম্বা ছিল না। যাই হোক,মামার মাধ্যমে কথা বার্তা পাকা হয়ে আশির্বাদের দিন ঠিক হয়ে গেল। ছেলে পক্ষ আগে আসবে দিদিকে আশির্বাদ করতে।তাই বাবার তোড় জোর শুরু হয়ে গেল।আগেই বলেছি আমরা মেয়েরা হলাম বাবার আদরের কন্যা,তার উপর বাবার সহজ,সরল বড় মেয়েরবিয়ে।তাই বাবা কোন ত্রুটি রাখতে চাইলেন না।নির্দিস্ট দিনে প্রায় পঁচিশ-তিরিশ জনের বহর নিয়ে পাত্র পক্ষ এলো দিদিকে আশির্বাদ করতে।আমাদের পক্ষ থেকে আমারদাদু,দিদিমা আর দুই মাসী,(যারা কুমিল্লাতেই আমাদের বাসার কাছাকাছি পাড়ায় থাকতেন)দুই মেশো,মাসতুতুদাদা,বউদি উপস্থিত ছিল।আমার ছোট মেশো যিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক প্রাইমারী স্কুলের টিচার আর কয়েকদিন আগেই মাত্র কুমিল্লায় একটা স্কুলে বদলী হয়ে এসেছেন এবং ঘটনাক্রমে দিদির বিয়ের ব্যাপারে জড়িয়ে গেছেন।কথাবার্তা,কাপড় চোপড়ে একদম সাধারন খুবই হাসি,খুশি একজন মানুষ।

 

খাওয়া,দাওয়া শেষে ওরা আমার দিদিকে একটা শাড়ি আর একটা স্বর্নের চেইন দিয়ে আশির্বাদ করল।সমস্ত আচার,অনুষ্ঠান শেষ করে সবাই মিলে লিভিং রুমে বসে আলাপ আলোচনা শুরু করল বিয়েতে দেয়া নেয়ার বিষয়ে।সহজ করে বললে যাকে যৌতুক বলে, তা নিয়ে।এখানে বলে রাখি,আমার দিদি ছিল ভয়ানক যৌতুক বিরোধী।সব সময় আমাদের বলত,যৌতুক দিয়ে যেন তাকে বিয়ে না দেয়া হয়।কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন।পাত্র পক্ষ একটা ২০’’ কালার টিভি, সোফা সেট, বেডরুম সেট, গয়না চাইলেন।বাবাও দেখি রাজী হয়ে গেলেন।বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা!এর মধ্যে পাত্রের বাবা একটা স্টীলের আলমিরা চেয়ে বসলেন।শুনে আমার বাবা হেসে দিলেন, বললেন,এত কিছু দিতে পারব আর একটা আলমিরা দিতে পারব না?কথা বার্তা যখন প্রায় শেষ,তখন পাত্রের এক আত্মীয় বলে বসলেন,আমার একটা আবদার আছে।শুনে আমরা সবাই উনার দিকে তাকালাম।তিনি পান চিবোতে,চিবোতে বললেন,আমি একটা ভি,সি,আর চাই আমার ভাগ্নের জন্য।

 

তখন যে মামা এই সম্বন্ধ এনেছিলেন,তিনি বললেন, ভি,সি,আর না ভি,সি,পি? পাত্রের মামা গভীর আত্মবিশ্বাসের সাথে বললে, ভি,সি,আর!ছোটখাটো জিনিস আমরা নেইনা।এদিকে হয়েছে কি,আমার মাসতুতু দাদা একটু পর পর গিয়ে ভিতরের রুমে আমার দিদিকে ওরা কি,কি জিনিস চাইছে সব গিয়ে বলছিল।শুনে আমার দিদি তো রেগে একাকার।আমার মাসী, বউদিরা কোন রকমে দিদিকে সামলে রাখছিল।এতক্ষন সব ঠিক ছিল,ভি,সি,আরের আবদারে আমার বাবার মুখও দেখলাম কেমন থমথমে হয়ে উঠল।বাবা, ঘটক মামাকে নিয়ে ভিতরের ঘরে এসে বলতে লাগলেন,কি ব্যাপার বলোতো,এরা এত কিছু চাইছে কেন? ওদের ঘরে কি কিছুই নেই? মামা নিজেও তখন কিছুটা বিব্রত।বাবাকে বলল, জামাইবাবু,চিন্তা করবেন না।আমি দেখছি।মামা গিয়ে ওদেরকে কি বললেন কে জানে, ওরা আর কিছু না বলে আমরা কবে গিয়ে ছেলেকে আশীর্বাদ করব তার দিন ঠিক করে চলে গেল।

 

নির্দিস্ট দিনে আমার মা,বাবা,আমি,ছোট বোন,বড় মেশো ,মাসী,ছোট মেশো আর আমার মাশতুতু দাদা মিলে একটা বড় মাইক্রো বাস ভাড়া করে ছেলের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।যেতে যেতে দুপুর হয়ে গেল।আর তাই গিয়েই খাবারের টেবিলে আমাদের বসিয়ে দেয়া হলো।দেখলাম ভালোই আয়োজন করেছে।ছেলের ইমিডিয়েট ছোট ভাই আমাদের পাতে বেশি বেশি করে খাবার তুলে দিতে লাগল।ভাবটা যেন আমরা এই খাবার কোন দিন চোখে দেখিনি।কি আর করা,খাবারকে অবহেলা করতে হয়না তাই আমরাও তৃপ্তি করে খেয়ে উঠলাম। আমাদের ছোট মেশো,যার নাম তপন,তিনি বললেন, বকুল,বেশি খেয়ে ফেলেছি,চলো বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসি।চাদপুর শহরেও আসা হয়নি কখনো।আমরা দুই বোন ও বললাম,চলেন।আমরা তিনজন বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা দূরে চলে এলাম।তখন তপন মেশো বললেন, কিছু মনে করো না তোমরা, এই বিয়েতে কিভাবে রাজী হলো তোমার মা,বাবা?বিথী বলল,কেন মেশো,আপনার ছেলে পছন্দ হয়নি?মেশো বললেন,না,চাকরী বা ছেলের পরিবার ঠিকই আছে।কিন্তু ছেলেটা ঠিক তোমার বোনের সাথে যায় না।এত শর্ট ছেলে।তখন আমি বললাম,মেশো ঠিক বলেছেন।আমারওএই ব্যাপারটাতেই আপত্তি আছে। আমি মাকে বলেও ছিলাম কিন্তু মা বলল,সব কিছু ঠিক থাকলে নাকি দু একটা ব্যাপার মেনে নিতে হয়।তাই আমিও আর কিছু বলি নাই। মেশো বললেন, তোমার দিদি কি বলে?তার ছেলেকে পছন্দ হয়েছে তো?তখন বিথী বলে,হ্যা,বড়দির কোন আপত্তি নেই।মেশো বললেন, তাহলে আর কি?মিয়া বিবি রাজী তো কি করবে কাজী?আমরাও হেসে ফেললাম।তারপর চলে এলাম ছেলের বাসায়।এসে দেখি, ছেলেকে আশীর্বাদের আয়োজন চলছে।মা ছেলেকে একটা চেইন আর আংটি দিয়ে আশির্বাদ করল।

 

এরপর সবাই মিলে বসে বিয়ের দিনক্ষন ঠিক করতে কথা বার্তা বলতে লাগলেন।পঞ্জিকা দেখে বাংলা মাঘ মাসের একটা ভাল দিন ঠিক করা হলো বিয়ের দিন হিসাবে।যদিও ছেলে পক্ষের ইচ্ছে ছিল বৈশাখ মাসে কিন্তু মা বলল,আশীর্বাদের পরে বেশি দিন মেয়েকে ঘরে রাখতে চাননা।তাই মাঘ মাসেই বিয়ে ঠিক হলো।তারপর সবাই মিলে নানা বিষয়ে কথাবার্তা বলতে লাগলেন।এর মধ্যে পাত্র আমাদের দুই বোনকে তার রুমে নিয়ে গিয়ে তার চিত্রকর্ম দেখাতে লাগলেন।বলতে ভুলে গেছি আমার হবু জামাইবাবু ছিলেন ফাইন আর্টসের টিচার।আমরা এ্যালবামে রাখা উনার কাজের ছবি দেখছি।এ সময় তপন মেশোও এসে যোগ দিলেন আমাদের সাথে।তবে মনে হলো জামাইবাবু আমার এই মেশোকে খুব একটা পছন্দ করছেন না।যাই হোক,এ কথা,সে কথার পরে মেশো বললেন, আচ্ছা, জামাই বাবাজী,আপনারা তো বৌভাতে মেয়েকে শাড়ি দিবেন।তো, এমন করলে হয়না যে আপনারা দিলেন কাতান আর আমরা দিলাম বেনারসী।তাহলে আর একরকম হয়ে যায় না। অনেক সময় দুটো শাড়ি একইরকম হয়ে গেলে আর পড়া হয়না।আগেই বলেছি,মেশো ছিলেন কথাবার্তা, পোষাকে খুবই সাধারন একজন মানুষ।তাই উনি সরল মনেই কথাটা বলেছিলেন, কিন্তু দেখলাম,পাত্রের মুখটা কেমন রাগী রাগী হয়ে গেল।উনি মেশোকে বললেন,আমার বৌ,ইচ্ছে করলে আমি তিনশ টাকার শাড়ি দিবো, ইচ্ছে করলে তিন হাজার টাকার শাড়ি দিব।সেটা বিয়ের সময়ই দেখা যাবে।উনার বলার ঢংটাই এমন ছিল যে আমার শুনতে ভাল লাগল না।এমন তাচ্ছিল্য করে বলা।লজ্জায় আমার কান গরম হয়ে গেল।মেশো দেখলাম কথাটা গায়ে মাখলেন না।বললেন,তা ঠিকই।তবে বিষয় টা মাথায় রাখবেন।

 

এদিকে বিয়ের দিন এগিয়ে আসতে লাগল আর আমার,মায়ের ব্যস্ততা বাড়তে লাগল।আজ এটা কিনো,তো কাল সেটা কিনো।আত্মীয় স্বজনের কাছে চিঠি লিখে ওদেরকে আসার নিমন্ত্রন জানাতে লাগলেন বাবা।দু,একজন আত্মীয় এসেও পড়লেন।শান্ত,নীরব বাসাটা মানুষ জনে ভরে যাচ্ছে।আমার খুবই ভাল লাগছিল।ঠিক হলো পাত্র-পাত্রীর বিয়ের শাড়ি,পাঞ্জাবী ঢাকা থেকে কেনা হবে ।যেই ভাবা,সেই কাজ। একদিন খুব ভোরেএকটা মাইক্রো ভাড়া করে আমি,ছোট বোন, মা, ছোট মাসী,তপন মেশো আর দাদা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলাম।একসময় পৌঁছে ও গেলাম।চাদনী চকের এক দোকান থেকে খুব সুন্দর একটা বেনারসী শাড়ি কেনা হলো দিদির জন্য।এরপর ঠিক করলাম বরের পাঞ্জাবী কিনব আড়ং থেকে।আমার নিজেরও ইচ্ছে দিদির বিয়েতে শাড়ি পড়ব আর কিনব আড়ং থেকেই। যাই হোক, সবার জন্য কেনাকাটা শেষ হল। এবার বরের জুতো কেনার পালা।বলতে ভুলে গেছি, দিদির হবু বর বলেছিলেন উনার বাটার জুতো পছন্দ।তাই বাটা থেকেই জুতো কিনতে গেলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে উনি যে ডিজাইনের জুতো চেয়েছিলেন তা পাওয়া গেল না।ইতিমধ্যে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে,মা চাইছে না বেশি রাত করে কুমিল্লায় ফিরতে।ঢাকার যতগুলো শাখা ছিল বাটার, সব গুলি খুঁজেও সেই জুতো পাওয়া গেল না।দোকানের লোকেরা বলছিল,সেই ডিজাইনটা ওই সময় আর তৈরি হচ্ছিল না তাই স্টকে নেই।কি আর করা,নিউ মার্কেট থেকে খুব ভাল ব্র্যান্ডের বেশ দামী একটা জুতো কেনা হলো উনার জন্য।তপন মেশো যদিও বার বার বলছিলেন,আহা!বেচারা একটা আবদার করেছে,সেটাই পূরণ করা গেল না।

 

সেই সময় মোবাইলের চল ছিল না।আমাদের বাসায় ল্যান্ডফোন ছিল।কিন্তু হটাৎকরে কি কারনে যেন ফোনটা বিকল হয়ে গেল।শুধু আমাদের না,আশেপাশে অনেকেরই।তাই বাধ্য হয়ে পাত্রপক্ষের সাথে কথা থাকলে তা সারতে হচ্ছিল আমার দাদুর বাসায় গিয়ে অথবাফোনের দোকান থেকে।।যদিও ছেলেদের নিজদের কোন ফোন ছিল না।ওরা ওদের বাড়িওয়ালার ফোন ব্যবহার করত।আর দোকান থেকে করলে করত রাত ১১টার পরে।তাতে নাকি পয়সা কম লাগত।কৃপন হলে যা হয় আরকি!যাই হোক,বিয়ের এক সপ্তাহ আগে হটাৎ করে আমাদের সেই ঘটক মামা এসে হাজির।উনি বললেন,ছেলের বাবা চাইছেন বিয়ে একটু পিছিয়ে দিতে।কারন উনার ইচ্ছে উনার বড় আর মেঝ ছেলের বিয়ে একসাথে করাবেন।মেয়েও মোটামুটি ঠিক কিন্তু সমস্যা হলো উনার বড় ছেলে তখন কি এক ট্রেনিং এর জন্য দেশের বাইরে আছে।আসতে আরো দু মাসের মত লাগবে।তাই বিয়ে অন্তত দুমাস পিছাতে হবে।একথা শুনে বাবা একটু নিম রাজি হলেও মা বেঁকে বসল।মায়ের কথা হল, যখন আশির্বাদ হয় তখনই উনারা বলতে পারতেন বড় ছেলের কথা।তাহলে আমরাও আশীর্বাদ করাতাম না।অপেক্ষা করতাম।এখন বিয়ের মাত্র এক সপ্তাহ বাকি থাকতে একথা বললে আমরা শুনব কেন? তাই মা মামাকে বলে দিলেন আমরা বিয়ে পিছাতে পারব না।মামাও আর কিছু না বলে চলে গেলেন।এদিকে হয়েছে আরেক কান্ড।কয়েকদিন আগে দিদির হবু বর উনার ছোট ভাই মারফর এক চিঠি দিয়ে দিদিকে বলেছে যে,কার কাছে যেন শুনেছে দিদি শুকিয়ে গেছে,গায়ের রঙ কালো হয়ে গেছে।তাই বিয়ের আগের কয়েকটা দিনদিদি যেন ঘরের কোন কাজ না করে।বিয়ের দিন যেন বরের বন্ধুরা তাকে দেখে প্লিজড হয়।একথা শোনার পর থেকে দিদি ভীষন ক্ষেপে আছে।আমরা কোনরকমে তাকে এটা,সেটা বলে বুঝিয়ে রাখছি।মোটামুটি সব আয়োজন সম্পন্ন।শুধু ছেলের আংটি কেনা বাকিআছে।বিয়ের তিন দিন আগে দাদুর বাসা থেকে খবর দিলো যে দিদির হবু বর নাকি দিদির সাথে কথা বলতে চায়।সন্ধ্যায় কল দিবে দিদি যেন দাদুর বাসায় উপস্থিত থাকে।কিন্তু দিদিকে বলাতে সে না করে দিল যে ছেলের সাথে কোন কথা বলবে না।অগত্যা কি আর করা,আমিই গেলাম মায়ের সাথে দাদূর বাসায় জামাইবাবুর সাথে কথা বলতে।মা বলল, ভালই হলো,কথা শেষ করে একেবারে ছেলের আংটিটাও কিনে নিয়ে আসব।তাপসী মানে আমার ছোট মাসীকে সংগে করে নিয়েগিয়ে।সেই মত সন্ধ্যার দিকে দাদুর বাসায় গিয়ে হাজির হলাম আমরা মা,মেয়ে।

 

মাঘ মাস,প্রচন্ড ঠান্ডা বাইরে।বিকেল না হতেই অন্ধকার হয়ে গেছে।দাদুর বাসায় গিয়ে দেখি সবাই আছে। দিদিমার ঘরে বসে সবাই মিলে চা পান করছি এমন সময় জামাইবাবু কল দিলেন।মাসী ফোন ধরে আমাকে দিলেন।উনি কেমন আছেন,হবু তালইমশাই,মাওইমা আর বাকীরা কেমন আছে জানার পর বললাম যে দিদি আসতে চায়নি কথা বলতে।উনি মনে হলো মনঃক্ষুণ্ণ হলেন দিদির সাথে কথা না বলতে পেরে।একথা,সেকথার পর আমি বললাম,গনেশদা(হবু জামাইবাবুর নাম,নামটাও আমার পছন্দ হয়নি)আপনাদের বিয়ের পোষাক কেনা হয়েছে তবে আপনি যে জুতার কথা বলেছিলেন তা পাওয়া যায়নিঅনেক খুঁজেও।তাই অন্য ব্র্যান্ডের,ভাল ডিজাইনের জুতা কেনা হয়েছে।শুনে উনি বেশ রুক্ষ স্বরে বললেন,বাহ!বেশ ভাল।ঠিক আছে,আমার ইচ্ছাটাকে যখন তোমরা মুল্যায়ন করলেই না,এই জুতা আমি পড়ব না।আমিত শুনে অবাক।উনি হবু শালীর সাথে এমন ভাবে কথা বলতে পারেন আমি ভাবতেই পারিনি।আমি বেশ কবার তাকে বলার চেস্টা করলাম কিন্তু উনি আমার কথা শুনতেই চাইলেন না।আরো কি কি যেন কমপ্লেন করতেথাকলেন। এক পর্যায়ে বললেন,তোমাদের ওই মেশো না কে, উনি নিজেকে কি ভাবেন?উনি বোঝেন না উনার অবস্থান টা কোথায়?উনার বোঝা উচিত কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়।উনি সামান্য একটা স্কুলের টিচার আর আমি একটাকলেজের প্রফেসর।যার পোষাক আষাকের ঠিক নাই।আমার বৌকে আমি কি শাড়ি দিবো না দিবো উনি বলার কে?উনি বলে যাচ্ছেন আর আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।ঘরে পিন পতন নীরবতা।

 

আসলে আমরা এমন ভাবে মানুষ হয়েছিযে কাউকে যেমন কটু কথা বলতে পারিনা তেমন কেউ বললেও নিতে পারিনা।উনি আমার সহজ,সরল মেসোকে অপমান করে কথাগুলি বলছিলেন আমার খুব খারাপ লাগছিল।যাই হোক,উনি আমার দিদি যেন নিজের যত্ন নেয় এই কথা বলে ফোন রাখলেন।আমি কথা শেষ করে চুপ করে বসে আছি দেখে মা জিজ্ঞাসা করল,কিরে কাঁদছিস কেন?গনেশ কি বলেছে?আমি মুখ তুলে মেশোর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বললাম, উনার জুতা পছন্দ হয়নি তাই অনেক কথা শোনালেন।মাকে তো আর সবার সামনে বলা যায় না যে, উনি মেশোর সম্পর্কে কি ধারনা পোষণ করেন।ঘরের সবাই আমার কথা শুনে বলতে লাগলেন,আরে বিয়েতে এরকম হাজারটা কথা হয়।এত ধরলে হয় না।ইত্যাদি,ইত্যাদি।কিন্তু আমি দেখলাম আমার মায়ের মুখ কেমন শক্ত হয়ে গেছে।মা হয়ত আন্দাজ করেছিল কিছু।তাই বলল,আচ্ছা চল বাসায় যাই।দিদিমা বললেন, কেন আংটি কিনতে যাবে না?মা বললেন, না মা।বাসায় গিয়ে বকুলের বাবার সাথে একটু কথা বলতে হবে।প্রথম থেকেই অনেক কিছু হচ্ছে,আমরা কেবলি এড়িয়ে যাচ্ছি।আমার কিছু ভাল লাগছে না।আংটি কালও কিনতে পারব। দিদিমা,মাসী মাকে বুঝাতে চেস্টা করলেন কিন্তু মা ওদেরকে বলে বাসায় চলে এলো।বাসায় আসার পথে আমি মেশো সম্পর্কে গনেশদার কথা গুলো মাকে বললাম।

 

বাসায় গিয়ে মা বাবার রুমে গিয়ে বাবার সঙ্গে অনেকক্ষণ দরজা বন্ধ করে কথা বলল।দিদি অনেকবার জানতে চাইল কি হয়েছে।কিন্তু আমি কিছুই বললাম না।এক সময় দরজা খুলে মা,বাবা ঘর থেকে বের হয়ে আসল।বাবা কিছু না বলে লিভিং রুমে চলে গেলেন।মা আমাদের রুমে ঢুকে দিদিকে কাছে ডেকে বলল, মারে, তোদেরকে অনেক যত্ন,আদর দিয়ে বড় করেছি।লেখাপড়া শিখিয়েছি।আমরা চাইনা জোর করে কিছু করতে।গনেশের সাথে বিয়ের কথা হবার পর থেকে অনেক কিছু হয়েছে কিন্তু আমরা তেমন গায়ে লাগাইনি।আজ গনেশ তোদের তপন মেশো সম্পর্কে,জুতা কেনা নিয়ে এমন কিছু কথা বলেছে যা শুনে আমার কাছে মনে হয়েছে এখানে সম্মন্ধ করার আগে তোকে সব জানানো দরকার।সব শুনে তুই যে সিদ্ধান্ত নিবি আমরা তাই করব।বলে মা আমাকে বলল সব কথা দিদিকে বলার জন্য। আমিও দেরি না করে সব কথা খুলে বললাম।দিদি তো আগে থেকেই গনেশদার উপর ক্ষেপে ছিল,সে সাথে সাথে বলে দিল এখানে সে বিয়ে করবে না।যে ছেলে মানুষকে তার পোষাক, চাকরি দিয়ে মুল্যায়ন করে সে ভাল মানুষ হতে পারে না।মা উঠে গিয়ে বাবাকে বলল,যেন ঘটক মামাকে সব জানিয়ে দেয়া হয়।আমি বললাম,মামাকে বলার দরকার কি? ওদের কে সরাসরি বলে দেয়াই ভাল।

 

বাবাও বললেন,সেটাই ভাল হবে।বকুল চল,বাইরে কোথাও থেকে ফোন করে বলে দেই।তোর দাদুদের আর এর মধ্যে জড়িয়ে লাভ নেই।যেই ভাবা সেই কাজ।আবার সেই শীতের মধ্যে বাপ,মেয়ে বের হলাম।তখন বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল।তাই বেশিরভাগ ফোনের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক ঘোরাঘুরি করে একটা দোকান খুলা পেলাম।কিন্তু চাঁদপুরে কিছুতেই লাইন পাচ্ছি না। অনেকবার চেস্টা করার পর লাইন পেলাম। আগেই বলেছি,গনেশদাদের নিজেদের ফোন ছিল না।বাড়িওয়ালার বাসায় করতে হতো। যাই হোক,ফোনের লাইন ত পেলাম,কিন্তু উনারা গনেশদাদের কাউকে ডেকে দিতে চাইছিলেন না।অনেক বলে কয়ে বুঝিয়ে শেষে গনেশদার মেজ ভাইকে ডেকে দিলো।বাবা নিজের পরিচয় দিয়ে বলল,আমার দিদি হটাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিন দিন পরের ডেটে আমরা বিয়ে ধরতে পারছি না।কবে হবে তা ঘটক মামার মাধ্যমে জানাবো।ওপাশ থেকে ছেলের ভাই হাহাকার করে উঠলো।কি বলেন মেশো,আমাদের সব প্রস্তুতি শেষ।কার্ড বিলি হয়ে গেছে।এখন এসব কি বলছেন? বাবা বেশ ঠান্ডা গলায় বলল, এদিকেও ত হয়েছে বাবা।তবে আমার মেয়ের শরীর, স্বাস্থ্য আগে।এখন আর কথা বলছি না।পরে কথা হবে বলে ফোন রেখে দিল।বাবা দেখলাম আমাদের দু একজন আত্মীয়কেও ফোন করে আপাতত বিয়ে স্থগিত রাখার কথাও জানিয়ে দিল।

 

পরের দিন সকাল ১১টার মত হবে।শীতের সকাল তাই বাইরে বসে আমি,ছোট বোন বিথী আর বাসায় আসা কয়েকজন আত্মীয় বসে রোদ পোহাচ্ছি,এমন সময় গেট ঠেলে ভিতরে ঢুকল গনেশদার মেজ ভাই আর একজন অপরিচিত ভদ্রলোক।পরে জানলাম উনি গনেশদার বন্ধু।উনারা বাইরেই বসলেন।ঘরে আসলেন না।ছোট বোন বিথী গিয়ে মাকে খবর দিলো।মা তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসল।আমার বাবা গতকালের ঘটনায় চিন্তিত হয়ে একটু অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল।বাবাকে তাই আর ডাকলাম না।জামাই বাবুর ছোট ভাই আর বন্ধু অনেকক্ষন ধরে মা কে,আমাকে বুঝাতে চাইলেন।সব কার্ড বিলি হয়ে গেছে,আত্মীয়,স্বজনকে জানানো হয়ে গেছে ,মানুষ কি ভাববে এসব বলে।আমার মা শুধু একটা কথাই বলল,দেখো বাবা,আমরা আমাদের মেয়েদের উপর কখনো জোর করে কিছু চাপিয়ে দেইনি। ওদের স্বাধীন মতামত দেয়ার অধিকার আছে।আমার মেয়ে যথেস্ট বড় হয়েছে সে তার ভাল-মন্দ বোঝে।সে যদি রাজী না হয় তার উপর আমরা জোর করব না।আর তাছাড়া আমরা তো বিয়ে ভেঙ্গে দিচ্ছি না। কয়েকদিন সময় চাচ্ছি।মায়ের কথা শুনে গনেশদার ভাই বলল, আমি কি বউদি ভাইএর সাথে একটু কথা বলতে পারি? মা বলল, হ্যা নিশ্চয়ই। আমাকে বলল,বকুল,যা,মলিকে বল যে নরেশ এসেছে।আমি গেলাম দিদিকে ডাকতে কিন্তু দিদি ওরা এসেছে শুনেই ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে।কিছুতেই দরজা খুলবে না।আমিঅনেক ডাকাডাকি করলাম ,কোন লাভ হলো না।বাইরে গিয়ে মাকে বললাম।মা উঠে এসে কতক্ষন ডাকলো।কিন্তু সে মার ডাকেও সাড়া দিল না।আসলে আমার দিদি এমনিতে খুব সহজ সরল হলেও ছিল প্রচন্ড জেদী।যা একবার ঠিক করত তা থেকে তাকে বের করা কঠিন ছিল।

 

মা এসে ওদেরকে বলল,বাবা,আমার মেয়েটা আসলে খুব ইমোশনাল।কয়েকটা দিন সময় দাও,ওকে বুঝিয়ে আবার একটা তারিখ ঠিক করব।সেই সাথে এটাও বলল,তোমরা কিন্তু দুপুরে খেয়ে যাবে,বলেই মা ভিতরে চলে গেল।কিন্তু নরেশদারা না খেয়েই চলে গেল।আধা ঘন্টাও যায়নি আবার গেটে নক করল কে জানি। আমিই গিয়ে খুললাম,ওমা এ যে দেখি স্বয়ং গনেশদা!সঙ্গে এবার আমার মাশতুতু দাদাও আছে।বুঝলাম গনেশদাও নরেশদাদের সঙ্গে এসেছেন কিন্তু প্রথমবার ভাই,বন্ধুকে পাঠিয়েছেন।আর কাজ হয়নি দেখে নিজে এসেছেন সঙ্গে আমার দাদাকেও ধরে এনেছেন।যাই হোক,উনারা যথারীতি বাইরেই বসলেন।বলার পরেও ভিতরে আসলেন না।এবার মা গিয়ে বাবাকে বলল।বাবা বলে দিলেন,যা বলার তুমিই বলো।আমি আর কিছু বলতে চাইনা।আসলে ওদের ব্যবহারে বাবা খুব কস্ট পেয়েছিলেন।

 

মা এসে বসলো চেয়ারে।গনেশদা মাকে উঠে এসে প্রনাম করলেন,মনে পড়লো এই কাজ টা উনি করেন নি আ যখনআমরা উনাদের বাসায় গিয়েছিলাম।উনি প্রনাম করে মায়ের পাশে চেয়ার টেনে এনে মায়ের হাত ধরে প্রায় কেঁদে ফেলেন এমন একটা মুখ করে বললেন,মা আমার মান সম্মান থাকবে না যদি এই ডেটে বিয়ে না ধরি। আমার বন্ধু,কলিগ কারো সামনে মুখ দেখাতে পারব না। সব কার্ড বিলি হয়ে গেছে এখন কিভাবে বিয়ে পেছানো সম্ভব?মা আস্তে করে তার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,কি বলছো বাবা।তুমি পুরুষ,তোমার কি আর হবে? আমার মেয়ের কথা ভাবো?ওর অবস্থা তো তোমার চেয়ে খারাপ হবে।তারপরও আমি মেয়ের উপর জোর করতে পারব না।কয়েকটা দিনই ত,সব ঠিক হয়ে যাবে।গনেশদা আরো কতক্ষন মাকে বুঝালো,আমাকেও বুঝালো কিন্তু আমাদের কিছুই করার ছিল না। আসলে আমি ও মনে মনে চাইছিলাম না এখানে দিদির বিয়ে হোক,কিন্তু মুখে কিছু না বলে একটা দুখি ভাব নিয়ে রইলাম।

 

গনেশ দা মনে হলো একেবারে ভেঙ্গে পড়েছেন।কিন্তু উনার কারনেই যে এত কিছু হলো সে ব্যাপারে তিনিকোন রকমের দুঃখ প্রকাশ করলেন না।উনার শুধু একটাই চিন্তা,উনার কলিগ,বন্ধুদের সামনে উনার মান সম্মান থাকবে না।উনার যে বন্ধু সাথে এসেছিলেন,উনি সম্ভবত কিছুই জানতেন না।উনি আমাকে বুঝাতে এসেছিলেন।আমিও সুযোগ বুঝে উনাকে গনেশদার ফোনে বলা সব কথা বলে দিলাম।সেই সাথে উনাদের যৌতুক চাওয়ার ব্যাপারটাও বললাম।।শুনে উনি আর তেমন কিছু না বলে নরেশদার কানে কানে কি যেন বল্লেন।নরেশ দা উঠে গিয়ে দাদার কাছে বসে নীচু গলায় কি যেন বললেন,দেখলাম গনেশদা হতাশ ভাব নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন,তারপর আস্তে করে হেঁটে গে্টের বাইরে চলে গেলেন।তাকে অনুসরন করলেন নরেশদা, আমার দাদা আর সেই বন্ধুটি।আমার তখন কেন যেন মনটা খারাপ হয়ে গেল।ব্যাপারটা ভাল হলো না মন্দ হলো কিছুই বুঝতে পারলাম না।

 

ঘরে গিয়ে দিদির রুমের দরজায় নক করে আস্তে আস্তে বললাম,বড়দি,এবার দরজাটা খোল।ওরা চলে গেছে। কোন সাড়াশব্দ নেই।এবার একটু জোরে নক করলাম।একটু পরে দিদি দরজা খুলে বের হলো।ইস!কেঁদে কেটে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে দেখি।হাত ধরে তাকে বাইরে টেনে নিয়ে এসে ডাইনিং রুমের খাবার টেবিলে বসিয়ে এক গ্লাশ জল এগিয়ে দিয়ে বললাম,খা।সেও এক ঢোকে সব টুকু জল খেয়ে ফেলল।এর মধ্যে মা,বিথীও এসে বসেছে পাশে।আমাদের এক আত্মীয়া,যিনি বিয়ে উপলক্ষে এসেছিলেন,রান্নার দায়িত্বে ছিলেন তিনিও এসে দিদির পাশে দাড়িয়ে দিদির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,মলির মা একটা কথা বলি,বিয়ে যেহেতু পিছিয়েই দিয়েছো,আমি বলি একেবারে ভেঙ্গেই দাও।কারন এখানে বিয়ে হলে পরে মলির সাথে ওরা ভাল ব্যবহার করবে না।আমি মুখ্যু সুখ্যু মানুষ,কিন্তু কেন জানি ছেলেটাকে ভাল লাগল না।আমি চমকে পিসির দিকে তাকালাম।এই কথাটাই আমি ভাবছিলাম।কিন্তু আমি বলার আগেই উনি বলে দিলেন।মা একটা বড় করে শ্বাস ফেলে বললেন, আচ্ছা, দেখি মলির বাবা কি বলে।

 

এর মধ্যে আমার মাশতুতু দাদা ওদেরকে বিদায় দিয়ে ফিরে এসেছে।সেও একটা চেয়ার টেনে বসে বিথীকে বলল,বিথী,যা আমার জন্য চা করে নিয়ে আয়।বলে দিদিকে বলল,কিরে কেঁদে চেহারার কি অবস্থা করেছিস বলতো।এত ভেঙ্গে পড়ার কি আছে?তুই না চাইলে কিছুই হবে না।তবেভাল করে ভেবে দেখ,তুই কি চাস?বিয়ে ভেঙ্গে দেয়া কি ঠিক হবে?বুঝিসই তো আমাদের সমাজে মেয়েদের অবস্থান।মানুষজন যখন কথা বলা শুরু করবে নিতে পারবি তো?দিদি কিছুই বলল না।মায়ের দিকে তাকালো শুধু।মা বলল,আমিও ভেবেছি এই কথা গুলি।কিন্তু দেখ বাবা,মানুষ যে কোন ব্যাপারেই কথা বলতে ছাড়ে না।এটা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই।আমি আমার মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছি।কোনটা ওদের জন্য ভাল,কোনটা নয় তা ওরা ভালোই বুঝে।তোদের মেসোও সারাজীবন সৎভাবে জীবন কাটিয়েছে।কোন অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি।তুই তো দেখেছিস,শুরু থেকেই এই পরিবারের সবাই কেমন আচরন করেছে।আর বিশেষ করে যার সাথে আমার মেয়ে সারা জীবন কাটাবে তার ব্যবহারই যদি এমন হয় তাহলে কোন ভরসায় এখানে সম্মন্ধ করা যায়?আজ না হয় ওরা সরি বলে,দুঃখ প্রকাশ করে মলিকে নিয়ে গেল।কাল যে এর জন্য ওরা মলির উপর কোন ধরনের অত্যাচার করবে না তার কি গ্যারান্টি?না,না।আমি জেনে,বুঝে এখানে মেয়ে দিতে পারব না।

 

দাদা ঠিক আছে যা ভাল মনে করো বলে চলে গেল।আমরাও মন খারাপ করে বসে থাকলাম।পরের দিন আমাদের ঘটক মামা এলেন সন্ধ্যার দিকে।বাবার রুমে গিয়ে বাবার সাথে কথা বলে চেস্টা করলেন বাবাকে রাজী করাতে।কিন্তু বাবা বলল যে এই ব্যাপারে মা ই সব জানে।উনি যেন মায়ের সাথে কথা বলে।মামা বুঝেছিলেন মায়ের সাথে কথা বলে খুব একটা লাভ হবে না।তাই কথা না বাড়িয়ে কাজটা ভাল হলো না,ইত্যাদি ইত্যাদি বলে চলে গেলেন।

 

আরো একটা দিন চলে গেল।আজ দিদির বিয়ের নির্ধারিত দিন ছিল।বিয়ে উপলক্ষ্যে যে কয়জন ঘনিস্ট আত্মীয় এসেছিলেন,তারা চলে গেছেন।আমরা খাচ্ছি,কথা বলছি।দিদিকে হাসি খুশি রাখার চেস্টা করছি। কিন্তু বুঝতে পারছি কোথাও একটা সুর কেটে গেছে।মা যদিও বলেছে যে কে,কি বলল তাতে কিছু আসে যায় না,তারপরো তাকে একটু চিন্তিত মনে হচ্ছে।বেশির ভাগ সময় বাবার সাথে ফিসফাস করে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে।রাতে খেয়েদেয়ে টিভি দেখছি,এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে দাদা ঢুকল বাসায়।এসেই ধপ করে সোফায় বসে পরলো,তারপর হো,হো করে হাসতে লাগল।আমি আর বিথী ছিলাম রুমে,আমরা এ,ওর মুখ চেয়ে চোখে চোখে কথা বললাম যে,বিয়ে ভাঙছে দিদির,আর মাথা খারাপ হয়ে গেল দাদার?ঘটনা কি?দাদার হাসি শুনে দিদি আর মাও ভিতরের রুম থেকে চলে আসলো।মা জিজ্ঞাসা করল,কিরে পাগলের মত হাসছিস কেন?কি হয়েছে?দাদা কোন রকমে হাসি থামিয়ে বিথীকে বলে যাতো দাদা,আমার জন্য এক গ্লাশ জল নিয়ে আয়।বলে আবার হাসতে লাগলো।বিথী দৌড়ে গিয়ে জল এনে দিলে দাদা এক ঢোকে জলটুকু খেয়ে দিদিকে বলল,ভালো করেছিস মলি,এখানে বিয়ে করিসনি।ওরা সব পাগল।মাসি কি হয়েছে জানো? আজ তো বিয়ের দিন ছিল,আর ওরা বলছিল না, সবাইকে নিমন্ত্রন করা হয়ে গিয়েছে? তাই নিজেদের মান বাঁচাতে ওদের যে মেয়েটি দ্বিতীয় পছন্দ ছিল,তার সাথে বিয়ে ঠিক করেছিল।কিন্তু ছেলে হয়ত মলিকেই বেশি পছন্দ করেছিল।তাই সে বিয়ে করতে না গিয়ে পালিয়ে গেছে।

 

শুনে আমরা পুরাই থ!হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না।বিস্ময় কাটিয়ে বললাম, কি বললে,ছেলে পালিয়ে গেল মানে কি?আর পালিয়ে গেলইবা কোথায়?দাদা বলল,তার আমি কি জানি।শুধু এটুকু খবর পেয়েছি সকালে ছেলে কাজ আছে বলে বাইরে গিয়ে আর ঘরে ফিরেনি।সন্ধ্যায় কাকে দিয়ে যেন খবর পাঠিয়েছে সে এই বিয়ে করবে না।দেখো তো কান্ড! ওই মেয়েটিরআর তার পরিবারের কি অবস্থা এখন ভাবতেই পারছি না।আমরা আর কি বলব,সবাই চুপ করে বসে থাকলাম।দিদির দিকে তাকয়ে দেখি তার মুখটা কেমন দুখী,দুখী।এটা কি গনেশদা বিয়ে না করে পালিয়ে গেছে তার জন্য,নাকি সেই মেয়েটির জন্য বোঝা গেলনা। দাদা আরো কিছুক্ষন বসে, খেয়ে দেয়ে চলে গেল।

 

আরো কয়েকটা দিন চলে গেল।আমরা খাই,দাই কিন্তু আগের মত কেন যেন স্বাভাবিক লাগে না কোন কিছু।দিদির বিয়ের জন্য কেনা কাপড়,চোপর আর অন্যান্য জিনিষগুলি ধরে ধরে দেখি আর খুব মন খারাপ হয়।মনে মনে ভাবি,কাজটা কি ঠিক হলো?দিদি একেতো মেয়ে তার উপর হিন্দু।যদি আর দিদির বিয়ে না হয়?মা,বাবাকেও দেখি সব সময় চিন্তা করে।কি একটা আশঙ্কায় দিন গুলি কাটতে থাকে আমাদের।একদিন দুপুর বেলা খেয়ে দেয়ে বিছানায় শুয়ে আছি।দিদি গেছে তার এক বান্ধবীর বাসায়,মা ই পাঠিয়েছে।মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকার চেয়ে একটু বাইরে গেলে মন ভাল হবে তাই।মা ঘরের কাজ সেরে আমার পাশে এসে শুয়েছে।টুকটাক কথা বলছি,হটাৎ বললাম,মা,যা হবার হয়ে গেছে।এভাবে হাত গুটিয়েবসে থাকার কোন মানে হয়না।এক কাজ করো না,ঘটক মামার বাসায় গিয়ে উনাকে সব খুলে বলে উনাকে বলো দিদির জন্য একটা ছেলে দেখতে।মা ঠিক বলেছিস,বলে বিছানা থেকে উঠে বসল।যা হয় ভালোর জন্যই হয় বলে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেল মামার বাসার উদ্দেশ্যে।

 

তারপর কি হলো জানেন? কিছুদিনের মধ্যে আমার দিদির খুব ভালো একটা পরিবারে,ভালো একজন মানুষের সাথে বিয়ে হয়ে গেল।দিদি এখন খুব ভালো আছে,সুখে সংসার করছে।