টরন্টো, ১২ই কার্তিক, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ, নভো সংখ্যা ৩৭   
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য সংবাদ ভ্রমণ কাহিনি নিবন্ধ প্রেমপত্র বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি যোগাযোগ

কার্তিকের কুয়াশা

 

গল্পের পাতা 

 

 

 

 

 

 

 ✍ জয়া চক্রবর্তী সোমার দুটো  গল্প 

 

কারেন্ট অফ

 

আমাদের ছোটবেলায় কারেন্ট অফ ব্যাপারটা খুব ঘনঘন ঘটতো। কিন্তু ইদানিং তেমন হয় না। আর তাই এখন বেশ অনভ্যাস হয়ে গেছে। কারেন্ট গেলে আগে ছোটবেলায় আমাদের যেন একটা উৎসব লেগে যেত। ভাই-বোনেরা মিলে মোমবাতির চারপাশে ঘিরে বসে পড়াশোনা করতাম। বড়জোর থাকতো একটা হ্যারিকেন। তার লালচে আলোয় দেয়ালে লম্বা লম্বা হয়ে পড়া ছায়াগুলো কে দেখে মনে হতো তারা নৃত্য করছে। আশপাশের পাড়ার লোকেরা গরমের দিনে বেরিয়ে আসত রাস্তায়। সেখানে দাঁড়িয়ে গল্প গুজব চলত। ছিল হাতপাখা। তা দিয়ে হাওয়া খাওয়া পিঠ চুলকানো আর মায়ের পিটুনি সবই চলত। আর দীর্ঘক্ষন কারেন্ট অফ থাকার পর যখন কারেন্ট আসতো তখন একটা সম্মিলিত উচ্ছ্বসিত শব্দ কানে আসতো। মোমবাতি নেভানোর জন্য ভাইবোনদের মধ্যে হুডোহুড়ি পড়ে যেত। আজকাল সে সব আর নেই। এখন বেশিরভাগ বাড়িতেই ইনভার্টার।নিদেনপক্ষে ইমার্জেন্সি লাইট তো আছেই। তাও সে সবের প্রয়োজনও পড়ে না আজকাল।
আজ এখানে বহুদিন পর এত দীর্ঘ সময় ধরে কারেন্ট নেই। সিএসসি কে ফোন করা হয়েছে। একটা বেশ বড় রকমের গোলমাল হয়েছে লাইনে। সারাবার জন্য গাড়িও এসেছে পাড়ায়। একটু সময় লাগছে। আমার আবার আজকাল গরম একদম সহ্য হয়না। তাই ছাদে এসে দাঁড়িয়েছি। চারপাশের সবকিছু অন্ধকার। চাঁদ নেই কিন্তু আকাশের একটা আলো আছে। তাই আশপাশের সবকিছুই অস্পষ্ট চোখে পরছে।
আমাদের বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালের ও পাশে যে বাড়িটা সেটা বেশ পুরনো আমলের। বোস কাকুদের বাড়ি। সামনে এখনো অনেকখানি বাগান। বাগান পেরিয়ে দোতলা বাড়ির জানলা দিয়ে কাঁপাকাঁপা আলোটা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে ভিতরে মোমবাতি জ্বলছে। বহুদিন পর এমন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আমার ছোটবেলার কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেই সময় কারেন্ট অফ হলেই বড়দা যতসব ভূতের গল্প ঝুলি থেকে বার করত। আর আমরা ভয়ে গিয়ে সেঁদিয়ে থাকতাম পিসি কিম্বা মায়ের কোলের কাছে। রাত্রে বাথরুম উঠতে হলে সেই সব গল্প গুলো মনে পড়তো। কিছুতেই উঠতে চাইতাম না।সত্যি সেই সব দিনগুলো আর ফিরে না।
ভাবতে ভাবতে আমার চোখ গেল সামনের বাড়ির ছাদের দিকে। পুরনো আমলের বাড়িটার আলসে কয়েক জায়গায় ভেঙে ভেঙে গেছে। দেখলাম ছাদের ওপর কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে। একজন মহিলা। সাদা শাড়ী পরেছে বলেই অন্ধকারেও চোখে পরছে। পলি কি? না না, ও তো আরো একটু লম্বা।
ওদের বাড়িতে তো আর কোন মহিলা নেই। কাকিমা গত বছর পুজোর সময় মারা গেছে। আমার শ্বশুরমশাই মারা যাবার পনেরদিনের মাথায়। মনে আছে তাই খুব ভালো করে আমার। তাহলে কে ওই মহিলা সাদা শাড়ি পরে আলসে ধরে দাঁড়িয়ে আছে?
আমার হঠাৎ করেই কেমন মনে হলো দাঁড়ানোর ভঙ্গি টা বড় পরিচিত। ঠিক যেন কাকীমার মত। ভাবতেই আমার শিঁরদাড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে এলো। তাইতো... এমন থান শাড়ি পরতেন কাকীমাই। আমি খেয়াল করি নি অয়ন কখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। টের পেলাম ও আমার হাতে মৃদু চাপ দিতে। আমি ফিসফিস করে বললাম-"ওদের ছাদে ও কে? " অয়নও ফিসফিস করে বলল-" পলির মাসশ্বশুড়ি। বোস গিন্নির যমজ বোন।" ধীরে ধীরে অবয়বটা ছাদের ভিতরের দিকে চলে গেল। আমি শ্বাস ফেললাম। সত্যিই ছোটবেলার ভীতু স্বভাবটা আর আমার গেল না। হঠাৎ মনে হল অয়ন পলিবৌদি না বলে পলি বলল কেন? কাকীমাকেও বলল বোসগিন্নি। ভারী অদ্ভুত। আমি পাশ ঘুরে জিজ্ঞেস করতে গেলাম। তখনই কারেন্ট এল। নীচে একতলা থেকে অয়নের গলা পেলাম-"এই রীনা কারেন্ট এসে গেছে।এসো।"
আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম আমার মুঠোয় ধরা আমার শ্বশুরমশাই এর কাশ্মীরি শালটা। আজই দুপুরে এটা রোদে দিয়েছিলাম। মনে পরে গেল বাবা বোস কাকীমাকে বোস গিন্নি বলতেন।

 

রুমাল

সেদিনও ও এইরকমই রুমালে ফুল তুলেছিল।S+M...শ্রীতমা আর মন্দার।মন্দারের জন্য উপহার।মন্দারও দিয়েছিল।একটা তাজা টকটকে লাল গোলাপ।
আজও ও রুমালে ফুল তুলছে।S+M...শুধু নামদুটো বদলে গেছে।বেকার ছেলে মন্দারের সাথে বিয়েটা হয়নি শ্রীতমার।বিয়ে হল রেলের বড় পদের চাকুরে সুভাষের সাথে।আর বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির রেওয়াজ অনুযায়ী শ্রীতমার নতুন নাম দেওয়া হল মানসী।
শুধু তাজা গোলাপটা আজ শুকিয়ে গেছে বন্ধ ডাইরীর ভাঁজে।

 

 

 

 

 

ডিসলাইক

✍ নীলাঞ্জনা সরকার 

 


মিতা এখন অবসরে গান গায়। গত দুবছর হলো স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা পদ থেকে অবসর নিয়েছে সে। ভোরবেলা চায়ের জল ফুটতো আর সে ভাবতো আজ কি করবে! এমন বেশ কিছু এলোপাথাড়ি ভাবনার ভিড়ে হঠাৎ একদিন তার মনে হয় সে তো ভালোই গান করে তাই জনসাধারণের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া জরুরি। সবাই শুনবে, ভালো মন্দ বলবে তবেই তো তার উৎসাহ বাড়বে নয়তো রোজ একা একা গান গেয়ে কি হবে! মিতা একটি ইউটিউব চ্যানেল খোলে আর প্রায়ই তাতে গান আপলোড করা শুরু করে। ওর এক বন্ধু বলে লিংকগুলো সোশ্যাল মিডিয়ার অন্য মাধ্যমগুলোতেও শেয়ার করতে। মিতা তাই করতে থাকে আর ধীরে ধীরে ওর চ্যানেলের ভিউয়ার বাড়ে। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই খেয়াল করে মিতা যে ওর ভিডিওগুলোতে ঠিক একটা করে ডিসলাইক। প্রথম প্রথম খুব একটা পাত্তা দেয়নি মিতা কিন্তু ক্রমশঃ ব্যাপারটা তাকে ভাবায়। ডিসলাইক পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয় কারণ তার গান সবার পছন্দ নাই হতে পারে! তবে শুধুমাত্র একটাই কেন? তবে কি কেউ জেনে বুঝে করছে! রাতে স্বামী সজলকে জিজ্ঞেস করতে সে বলে,

- এত ভেবো না। তোমার কাজ তুমি করে যাও।

- না গো। ব্যাপারটা এতটাও সহজ নয়। আমি তো আরও বেশি ডিসলাইক আশা করি তাহলে আমার গানের উন্নতি হবে কিন্তু তুমি ভেবে দেখো ঠিক একটা কেন? শুধুমাত্র একজন আমার কাজ সত্যিই পছন্দ করছে না নাকি আমার প্রতি তার বিরূপ মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে? এটাই আমায় ভাবাচ্ছে...সে কে?

- আরে তুমি যেমন ভাবছো তেমন নাও হতে পারে। হয়তো প্রতিবার আলাদা মানুষের কাজ এটা।

- সত্যিই কি তাই!

শুয়ে পড়লেও ঘুম আসে না মিতার। ভাবে সে যদি চ্যানেল না খুলতো তাহলেই ভালো হতো।

মিতা খুব সহজ মানুষ কখনও সজ্ঞানে কারুর ক্ষতি করেনি বরং সবার বিপদে সবসময়ে ছুটে গেছে তাই এই বিষয়টি তার মনে তোলপাড় করে। সেদিন বৈকালিক ভ্রমণে ফোনে এক পুরনো বন্ধুর সাথে তার কথা হচ্ছিল,

-আমার কথা শুনে আর কি করবি! আজকাল এক তীব্র মনোকষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।

-এভাবে বলিস না। আমি তো আছি। পরিস্থিতির চাপে দম বন্ধ হতে দেবো না তোর। তোর জীবনে কত খারাপ দিন গেছে, এমনকি কাকিমা চলে যাওয়ার পরেও তোর চোখ থেকে সবার সামনে জল বেরোয়নি। আর আজ যা হচ্ছে তা তো একটা সামান্য ঘটনা।

-আসলে জানিস, মা চলে যাওয়ার পর নিজের বলতে আর কেউ ছিল না। সেদিন আমার কান্না আসেনি খালি মনে হয়েছিল ওই তো মা রান্নাঘরে...ওই তো মা ছাদের বাগানে... এই তো একটু পরেই মা পাশে বসে গল্প করবে। কিন্তু আজ আমি সুস্থ স্বাভবিকভাবে যখন আমার ভালো লাগা নিয়ে পথ চলতে চাইছি তখন কোনো একজনের সহ্য হচ্ছে না এটা ভেবেই কেমন অস্থির লাগছে। ভেবে দেখ ঠিক 'একটা'...



ফেরার পথে মিতার অনেক পুরনো কথা মনে পরে। মা কত কথা বলতো কিন্তু মেয়ে অনেকসময়ই তার মাকে থামিয়ে দিত কিন্তু মা চলে যাওয়ার পর মায়ের বলা কথাগুলো ভীষণ সত্যি বলে মনে হয়। নিজের মা বাবা আত্মীয়দের জন্য কত করেছে একসময় অথচ তারা হঠাৎ বিপর্যয়ের দিনে সবাই উধাও। মিতা নিজেও আর এইসব মেকি সম্পর্কে বিশ্বাস রাখে না তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যোগাযোগ বন্ধ। সজলের অফিসের খুব ঝামেলা ছিল একবার, নিজের ডিপ্রেশন কাটাতে মদ খেতে শুরু করে। এতখানি পরিবর্তন এসেছিল তখন মিতাদের জীবনে। মিতার খুশির চেয়েও নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে ব্যস্ত ছিল সজল। মিতা স্বপ্নেও ভাবেনি সজল আর কোনোদিন মদ ছাড়তে পারবে বলে। কিন্তু তারপরেও এমন একদিন এসেছিল যেদিন সজল সত্যি মদ ছেড়েছিল। তার মন চাইলেও সে অগ্রাহ্য করতে পেরেছিল। আসলে বোধহয় সবচেয়ে আনন্দ নিজের কাছে বিশ্বাস অর্জনে...আমি পারবো...আমি পারি।



এভাবে কিছুদিন কেটে যায়। মিতা আনন্দ করে গানের চর্চা চালিয়ে যায়। সে তো রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছিল কিন্তু আজ সে বিভিন্ন ধরনের গানে পারদর্শী হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে... কারণ গানের প্রতি তার ভালোবাসা। আজকাল আর সে ওই ডিসলাইক নিয়ে ভাবে না। মিতার গানের শ্রোতা এখন অনেক তাই লাইকের সাথে ডিসলাইকেরও সংখ্যা বেড়েছে। মিতা এখন বুঝতে শিখেছে কোন ডিসলাইকগুলো আশীর্বাদের মতো আসে। বাকিগুলো তো সংখ্যা মাত্র। মিতা বিশ্বাস করে - বেজায় ছোটাছুটি করলেও নিরলস পরিশ্রমের সামনে কোনো পক্ষাঘাতগ্রস্ত মন টিকতে পারে না। তারা হারিয়ে যায়। জিতে যায় আনন্দ, স্বাধীনতা, সুখ, শান্তি সকল তিক্ততার উর্ধ্বে।

 

 

 

 

 

✍ রত্না চক্রবর্তীর দুটো গল্প   
 

ঝাপসা

১৫.১০.২২
লোকটাকে দেখলে কেমন ভয় ভয় করে, অস্বস্তি হয়,রোগা লম্বা হিলহলে চেহারা, একটু কাৎ হয়ে বেঁকে দাঁড়ায়,একটা চোখ কেমন স্থির মতো নড়ে না যেন, আর একটা চোখ দিয়ে হিয়াকে দেখে,যেন গিলে খায়। ঠোঁটটা ঈষৎ বাঁকা, কেমন একটা অদ্ভুত হাসি ছুঁইয়ে পড়ে। বেশ বয়স্ক লোকটা, মাথার চুল কালো সাদায় মেশানো। যখন যেখানে হিয়াকে দেখে দাঁড়িয়ে যায় আর অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে হাসে। গাটা শিরশির করে উঠে। হিয়া চারবছর অবধি এই শহরেই কাটিয়েছে। তারপর ওর বাবার বদলী হয়ে গেল শিলিগুড়ি, সেখানে ছয় বছর ছিল। তারপর বদলী হন দুর্গাপুর। এই বাড়ি খালিই পরে ছিল। বাবা বদলীর সময়ই মাম্মাম মানে হিয়ার ঠাকুমাকে নিয়ে গিয়ে ছিল। উনি বছর খানেক বাদে ওখানেই মারা যান।ওর মামার বাড়ি কটকে তাই ওরা আর কলকাতায় আসেনি। বাবার বন্ধু সমীরকাকুর কাছে চাবি থাকত, উনিই ঝাড়পোঁছ করানো বছর পাঁচেক অন্তর রঙ করানো, তদারকি করতেন। বাবা বাড়ি ভাড়া দেবার পক্ষপাতি ছিলেন না। বার বছর বাদে বাবা আবার বদলী হয়েছে কলকাতায়, ওরা সবাই তাই এখন কলকাতার বাড়িতে থাকে। ওখান থেকে মাধ্যমিক দিয়ে এসেছিল, এখানকার স্কুলে উচ্চমাধ্যমিক পড়ছে। হিয়া ভিষণ মিষ্টি মেয়ে,ওর গজদাঁত আর ঠোঁটের উপরের লালচে তিলটা ওর মুখটাকে আরো সুন্দর করেছে। কেউ একবার দেখলে চট করে ভোলে না তবে একটু ভিতু স্বভাবের। চোরে ভয়, ভুতে ভয়, বিড়াল কুকুরেও ভয়। হিয়ার মা হিয়াকে নিয়ে চিন্তায় থাকে। মোটে পাঁচ বছর হিয়ার মা কলকাতায় ছিল, এতদিন বাদের কলকাতা তার কাছে প্রায় অচেনা শহর। মেয়েকে নিয়ে সাগরিকা তাই বড়ই বাতিকে ভোগে। সদাই ভাবে কি জানি কি হয় মেয়ের। স্কুলে যায় সমীরকাকুর মেয়ের সঙ্গে, সেও ওই স্কুলেই টুয়েলভে পরে আর ফেরার সময় সাগরিকা নিয়ে আসে। সমীর কাকুর মেয়ে সিমিদিদি স্কুল থেকেই ম্যামের কোচিং যায়। হঠাৎ তাই ছুটি হয়ে গেলে হিয়া একাই ফেরে। লোকটাকে দেখে ভয় লাগলেও মা'কে কিছু বলে নি হিয়া, লোকটা তাকে কিছু বলে নি, তার সংগে কথাও বলে নি, শুধু ওই রকম হাসে আর তাকায়। মা ক্রাইম পেট্রোল দেখে দেখে এমনিতেই ভীতু আর বাতিকগ্রস্ত হয়ে গেছে এর মধ্যে এসব বললে চিন্তা ভাবনায় প্রেসার আরো বাড়িয়ে ফেলবে। সিমিদি স্কুলে যায় নি
সেদিন আর স্কুলের বিদ্যুৎ সরবরাহে কি একটা গন্ডগোল হওয়াতে সারা স্কুলে আলো ফ্যান কিচ্ছু চলছে না তাই ছুটি হয়ে গেল। তখন দুপুরবেলা, হিয়া যখন বড় রাস্তা ছেড়ে তাদের বাড়ির গলিতে ঢুকল তখন সে একলা। আপন মনেই আসছিল, হঠাৎ সামনে তিনটে চারটে কুকুর মারামারি করতে করতে প্রায় গায়ে এসে পড়ল। কুকুরে হিয়ার বড় ভয়, চিৎকার করে সামনের দোকানের উঁচু সিঁড়িতে উঠে পড়ল।পিছন থেকে কে তাড়া দিল কুকুরগুলোকে "এই দা দা, ভাক ভাক,হ্যাৎ.. হ্যাৎ।" লাঠি ঠুকে কেউ কুকুরগুলোকে তাড়া করেছে। ওগুলো কেঁউ কেঁউ করতে করতে ল্যাজ গুটিয়ে পালাল। হিয়া শ্বাস ফেলে সিঁড়ি থেকে নামল। এবার দেখল সেই লোকটাকে, হিয়ার দিকে এগিয়ে আসছে, চোখ দিয়ে হাসি গলে গলে পড়ছে,জড়ানো গলায় বলল " ইয়া নানী ভয় পেয়েছে। " আরো এগিয়ে এল। আতঙ্কে হিয়া কাঠ হয়ে গেল, তার নাম জানে! কেমন করে বলছে। ও প্রায় ছুটে লোকটার পাশ দিয়ে বেড়িয়ে গেল। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল " শয়তান একদম এগোবে না। " লোকটা থমকালো স্থির চোখটা কেমন বড় বড় হয়ে গেল, দাঁড়িয়ে গেল লোকটা কেমন ভয়াবহ চোখে তাকিয়ে রইল, বিড়বিড় করে বলল " আমি...আমি তোমায় দেতেই তো এগিয়ে এলাম তুতুরগুলো... "। হিয়া ছুট লাগালো, আর একটু এগিয়েই বাড়ি। বাড়ি ঢুকে তখন হাঁফাচ্ছে হিয়া, সাগরিকা উদ্বিগ্ন গলায় বলল " এই কি হয়েছে হাঁফাচ্ছিস কেন রে? " হিয়া জল খেল সামলে নিয়ে বলল " কতগুলো কুকুর তাড়া করেছিল।" ভাবল মাকে এখনই বলা ঠিক হবে না। লোকটা তো কুকুরগুলোকে তাড়িয়েই দিল। হয়ত তাকে ভয় পেতে দেখেই এসেছিল। কিন্তু তার নামটা কোথাও থেকে জোগাড় করেছে, কেন? বিচ্ছিরি তাকানো হলেও লোকটার কথাগুলো কেমন দুখি দুখি শোনাচ্ছিল। হিয়া ভাবল মাকে নয় কাল সিমি দিদিকে বলবে। পরদিন স্কুল যাবার পথে দেখল মোড়ের মাথায় রিক্সাস্ট্যান্ডের পাশে লোকটা উবু হয়ে বসে একটা শেডের নিচে। সিমিকে কিছু বলার আগেই সিমি বলল "এই একটু দাঁড়া আসছি।" সিমিদিদি মনু জেঠুর দোকান থেকে দুটো টিফিন কেক কিনল, তারপর লোকটার কাছে গিয়ে কাছে গিয়ে নিচু হয়ে কিছু বলল, লোকটা মুখ তুলে সিমির দিকে তাকিয়েই রইল, সিমিদি জোর করে লোকটার হাত ধরে তার হাতে কেক দুটো গুঁজে দিল। তারপর হেসে টাটা করে চলে এল। দিয়া অবাক হয়ে দেখল, লোকটা সিমির সঙ্গে তাকেও দেখল, , মুখে সেই রকম হাসি ফুটে উঠল আর চোখে কেমন একটা অভিব্যক্তি। সিমি এসে বলল " কি কষ্ট লাগে রে, নিমুকাকুকে দেখলে। ওই রকম দশাশই চেহারার লোক,কি যত্ন করে আমাদের ভ্যানে নিয়ে যেত আসত বল, বৃষ্টি হলে প্রতিটি বাচ্ছাকে ছাতা মাথায় দিয়ে কোলে করে, একটু বড়দের হাত ধরে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে আসত। এখন কি অবস্থা।সেরিব্রাল হয়ে একটাদিক আধা প্যারালাইজড হয়ে গেছে, আগে তো একদম উঠতে পারত না, ক্লাবের ছেলেরা ফিজিও থেরাপি করিয়েছে চাঁদা তুলে। এখন উঠতে পারে, হাঁটতে পারে কিন্তু কথা একটু জড়িয়ে গেছে,মুখটাও বেঁকে গেছে। এককালে কত কোলে চড়েছি বল? তুই আর পিউ তো নিমু কাকুর খুব প্রিয় ছিলি মনে আছে? কি বলে ডাকত মনে আছে 'ইয়া নানী'। " হিয়া জোর নাড়া খেল, মাথার মধ্যে যেন একরাশ অন্ধকার আর এক ঝলক আলো একসাথে খেলে গেল। নিমু কাকু.....ভ্যানওয়ালা কাকু, সেই ললিপপ দিত। শিস দিয়ে গান গাইতে গাইতে ভ্যান চালাত। কোলে করে স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে যেত। লম্বা চওড়া দশাশই মানুষ দুকোলে দুটো বাচ্ছা থাকত। হিয়া কুকুরে ভয় পেত বলে বেশির ভাগই কাকু কোলে চড়ে বাড়ি ঢুকত। দু -দুটো বছর কাকুর ভ্যানে যেত আসত। সিমি হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিল, " নিমুকাকুর ছেলে - বৌ আলাদা হয়ে চলে গেছে, বৌ ও মরে গেছে। এখন ভোরবেলা থেকে এসে রিক্সাষ্ট্যান্ডে বসে থাকে। রিক্সাগুলো মোছে পরিষ্কার করে। পাড়ার ছেলেমেয়েরা তো অনেকেই কাকুর ভ্যানে চড়েছে ছোটবেলায় সবাই খুব ভালোবাসে মানুষটাকে। সবাই দেখাশোনা করে, চলে যায় সবাইকে নিয়ে। সোজা রাস্তা শেষ হল, দিয়ারা এবার মোড় ঘুরে যাবে। পিছন ফিরে তাকাল দিয়া, নিমুকাকু বসে আছে একই ভাবে,তবে মুখটা দিয়া দেখতে পেল না, চোখের জলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে।।
(নতুনদের জন্য)

 

***

গুছুনে


১১.১০.২২
রাঘববাবু ঘোরতর সংসারী। বিয়ের সময়ই
প্রতিভার শ্বাশুড়ি গর্ব করে বলেছিলেন প্রতিভার মাকে, " আমার ছেলের যে বউ হবে জীবনে তাকে কোন কষ্টে পড়তে হবে না, ছেলে যেমন গুছুনে তেমনই সংসারী। "
তা সত্যি এতবছর বিয়ে হয়েছে প্রতিভা মনেপ্রাণ ঢেলে সংসার করে গেছে কিন্তু কোন কিছু নিয়ে ভাবতে। রাঘব শাসনে রেখেছে কিন্তু বৌকে যত্নে রেখেছে। যখন কেরোসিন পাওয়া যেত না তখন তার ঘরে আগে থেকে গুছোনো কেরসিনের টিন, গ্যাস ও তিনটে সিলিন্ডার নিয়ে রেখেছে রাঘব, যে বছর খবর পায় ভোজ্যতেলের বা ডালের দাম বাড়বে সে বছর সারা বছরের তেল ডাল তুলে রাখে। ডাল, ভোজ্যতেল জমানোই থাকে।
শ্বাশুড়ি প্রতি মূহুর্তে শোনাতেন, " অনেক ভাগ্য হলে তবে এমন স্বামী পাওয়া যায়। এমন সংসারী ছেলে হাজারে একটা মেলে। তোমার মা আর তোমার অনেক জন্মের তপস্যা যে এমন উদোমাদা বোকার বস্তা মেয়ে হয়েও আমার ছেলের মতো এমন গুচ্ছুনে স্বামী পেয়েছ।"
তা সত্যি সামান্য রেশন দোকানে কাজ করে এমন রাজার হালে সুন্দর করে সংসার করতে রাঘবের মতো আর কেউ পারবে না। অবশ্য নামেই কর্মচারী, এই রেশন দোকানের মালিক শয্যাশায়ী, ছেলেদের এদিকে মন নেই৷ তারা ভাগের টাকা নিয়েই খালাস। সব দায় দায়িত্ব, হিসাবনিকাশ সব রাঘবের, তাই ইনকামও দুহাতে কিন্তু ভীষণ কাজের চাপ। বুদ্ধি করে চলতে হয়। তাই মেজাজটাও এক একসময় ঝট করে গরম হয়ে যায়।
যেমন আজ মাথা ভীষণ গরম, ছেলের কারণে।
ছেলেকে ভালো ইংলিশ মিডিযাম স্কুলে দিয়েছেন, প্রচুর খরচ, কিন্তু রাঘব কার্পণ্য করেন না। যখন যা চায় তাই দেন। ছেলের পেছন পেছন ছোটার তার সময় নেই। সব ছেলে নিজেই করে। তবে ছেলেকে কষ্ট করতে দেন নি। ছোটবেলায় ছেলে স্কুলের গাড়িতে যেত আর প্রচুর কোচিং দিয়েছেন, সেগুলো অটো বা রিক্সায় যেত। টেনে উঠতেই বাইক কিনে দিয়েছেন। মাধ্যমিকের পর ছেলের ঝোঁক হয়েছিল ইংরাজির টিউশন করবে। তাদের বাড়ি গ্রামে। বিশাল জায়গাজমি অবশ্য, গ্রামের সবচেয়ে বড় পাকাবাড়ি তার। এখানে যদি বাড়িতে ইংরাজি কোচিং ক্লাস খোলে তো ভাল চলবে। আশপাশে ইংরাজি পড়াবার টীচার কম কিন্তু রাঘব ছেলেকে এসব করে সময় আর এনার্জি নষ্ট করতে দেবে না। অনেক গুলো কোচিং-এ পড়ে, পড়ার টাইম পাবে না। ছেলেকে তিনি ইঞ্জিনিয়ার বানাবেনই। নিজের নির্দিষ্ট হিসেবের ছকেই তিনি সংসার চালাচ্ছিলেন।
এখন হঠাৎই ধরে ফেলেছেন ছেলে যে সব কারণে টাকা নেয় সেগুলো সব জেনুইন কিন্তু যে অঙ্কের টাকা নেয় সেটা ধাপ্পা। প্রায় সবের পিছনেই একটা করে শূন্য বসিয়ে বাড়িয়ে নেয়। এ বহুদিন ধরে চলছে। আজ ধরা পড়ে ছেলে হাঁড়িমুখ করে নিজের ঘরে দোর দিয়ে বসে আছে। আর ছেলের বাপ চেঁচিয়েমেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছে।
বাপ-ছেলের লড়াইয়ের মধ্যে প্রতিভা নেই। ছেলের এ কান্ডটা তিনি পুরোপুরি না জানলেও আন্দাজ করেছিলেন। ছেলে বড়লোকদের কোয়েট স্কুলে পড়ে, বাপ স্কুলের প্রতিটি প্রয়োজনীয় জিনিস, এমনকি টীচার্স ডের গিফট, ফেয়ার ওয়েল গিফট, ডোনেশন সব দেয় কিন্তু বন্ধুবান্ধবদের বার্থডে পার্টি, ফেস্ট, পিকনিকের জন্য দিতে চায় না, আর দিলেও যা দেয় তাতে ছেলের চলে না । ছেলের এক গার্লফ্রেন্ড ছেলেকে একটা একহাজার টাকা দামের বিদেশী পারফিউম গিফট করেছে সেখানে ছেলে কি করে শ'চারেকের মধ্যে গিফট দেয় বান্ধবীকে! এক বন্ধু জন্মদিনে একটা সানগ্লাসই দিয়েছে কত্ত দামী!
কিন্তু বাবা সে কথা বুঝবে না। জন্মদিনের জন্য শ'চারেকের গিফট যথেষ্ট না হলে দিতেই হবে না,যেতেও হবে না। প্রতি মাসে একবার বা দুইবার করে বন্ধুবান্ধবদের জন্মদিন , তার পক্ষে এর থেকে বেশী দেওয়া সম্ভব নয়। রাঘবও কমার্স গ্রাজুয়েট, কলেজে পড়েছেন, এরকম অনাছিষ্টি কান্ড ভাবতেও পারেন না। প্রতিভা মানুষটাকে বলতে পারে না তাদের স্কুল কলেজ মধ্যবিত্তের ছিল এইসব বড়লোকদের নয়। প্রথম প্রথম ছেলে কান্নাকাটি করত, তারপর যেতই না। কিন্তু তাতেও শান্তি নেই। স্কুলে 'কিপটে', 'অমিশুক, 'বাড়ির লোক আসতে দেয় না না কচিখোকা ' এসব শুনতে শুনতে অতিষ্ট হয়ে উঠত। তাছাড়া সে নিজেও এইসব মজা হুল্লোড় ভালোবাসে।
তারপর একদিন ছেলে বদলে গেল। নর্মালি যেত আসত কিছুই বলত না। বোকাসোকা প্রতিভা তখনই জানে, অন্যপথের সন্ধান পেয়ে গেছে ছেলে।
তার ইচ্ছা ছিল না এইরকম স্কুলে ছেলেকে দিতে, কারণ তাদের স্ট্যান্ডার্ড ওদের মতো নয়। পয়সা আর স্ট্যান্ডার্ড এককথা নয়। তার যেমন আয়, যেমন তার পারিপার্শ্বিক তেমন চলার ইচ্ছা। কিন্তু রাঘব অনেক বেশী বুদ্ধিমান ও হিসেবী। সে কাজ জানে, খাটতে জানে, মালিকের তিনটে লোক যা কাজ করত তা সে একা করে কাজেই সে শুধু মাইনেতে সন্তুষ্ট নয় আর ছেলেকে এলেবেলে সাধারণ স্কুলে দিয়ে পড়াবার পাত্র নয়। কিন্তু ছেলের সমস্যা রাঘব বুঝবে না। কি আর করা যায়, যত্ত জ্বালা প্রতিভার...!
সেই সকাল থেকে প্রতিভা একটা বড় লাইলনের থলি হাতে একবার এঘরে ঢুকছে একবার বরের পেছন পেছন ঘুরছে। কাল দশ বস্তা চাল তার নিজের ঘরে ঢোকানো হয়েছে, একটুবাদে আবার রেশনে দোকানে ঢুকে যাব। এর মধ্যেই চালের ব্যবস্থা করা হয়। এসব কাজ রাঘব নিজেই করে কিন্তু আজ যা চটেছে বলতে সাহস হচ্ছে না প্রতিভার।
অবশেষে দোকানে যেতে হবে বলে রাঘব নিজেই এগিয়ে এল, বস্তার মুখ সামান্য খুলে কায়দা করে কিছু চাল ঢেলে দিতে লাগল থলিতে। থলি ভরে গেলে বড় ড্রামে প্রতিভা ঢেলে রেখে এল। দশ বস্তা অনেকটা চাল কিনা...।
ব্যাগ ভালো করে সিল করে দিল। বাইরে ভ্যানরিক্সা এসেছে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে যত্ন করে মাল তুলিয়ে রাঘব ভ্যানের সাথেই রওনা দিল। এ চুরি বহুদিন চলছে, কেউ টের পায় না কিলো প্রতি ওজনে পঞাশ গ্রাম করে কম দিলেই মেকআপ হয়ে যায় কেউ বোঝে না। চাল চিনি গমটা তাই কোনদিন কিনতে লাগে না, জমানোই থাকে।
রাঘবের যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রতিভা। একটু বাদে জামাকাপড় পরে তৈরী হয়ে এসে ছেলে বাইক বার করে। গম্ভীর মুখে বলে, " মা পাঁচ লিটারের একটা তেলের টিনের ক্যান বার করে দাও, ওই সুন্দর দেখতে যে প্ল্যাস্টিকের ব্যাগটা আছে তাতে ভরে নেব বাইরে থেকে বোঝা যাবে না। যাবার সময় চৌরাস্তায় পল্টুর দোকানে নামিয়ে দিয়ে যাব। বলা আছে। "
প্রতিভা একবার বলে, " বাবু ঘরের জিনিস এভাবে বেচে দিলে অলক্ষ্মী ধরে বাবা। "
ছেলে বলে, " মা এটা সেপ্টেম্বর.. সামনে অক্টোবর আর নভেমম্বর দুমাস হাতে পাব। পুরো ডিসেম্বর জানুয়ারীতে মোট চারটে আউটিং, আর কত আসবে কে জানে! বুঝে গুছিয়ে না চললে হবে কি করে? বাবা তো দেবে না। একটা পিকনিক আমি কিছু একটা বলে কাটিয়ে দেব যাব না কিন্তু বাকি তিনটেতে তো যেতে হবে... এখন থেকে না গুছোলে সামলাতে পারব না। খাওয়ার জিনিসে হাত দেব না বলেই টাকাটা অন্য ভাবে তুলছিলাম, তা হল না। এসবের বাবার কোন হিসেব নেই, দিনে কত তেল লাগে, চাল লাগে, চিনি লাগে বাবা খোঁজ রাখে না। বস্তা বস্তা জমিয়ে যাচ্ছে। ইঁদুরে খাবে। সামনের মাসে পল্টু এসে চালের বস্তা নিয়ে যাবে। বাবা সেপ্টেম্বরে দোকানের মালিকের বাড়ি যাবে থাকবে না দুদিন তখন আসবে। আজ আমার লাগছে না কিন্তু সংসারে গুছিয়ে না চললে হয় না মা , মান সম্মান সব দিকই বজায় রাখতে হবে তো। "
ছেলে চলে গেল প্রতিভা আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, সত্যিই ছেলে তার বাপের মতোই গুছুনে হয়েছে।।