-সাইদুজ্জামান
ফেসবুকের দেওয়ালে আমি যা লিখি তা যেন শৈশবে-কৈশোরে নিজবাড়ির পাঁচিলে চক-খড়ি
দিয়ে যা খুশি তাই লিখছি। সমালোচকের কান থেকে পেন্সিল এখানেও নেমে আসে - ঐ
বানানটা ঠিক হয়নি, ঐ যতিচিহ্নটি ভুল, ঐ শব্দটি অশ্লীল, কী মারাত্মক ছন্দপতন
ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার সমস্ত অক্ষমতাসমেত লিখতে বসেছি গুরুত্বপূর্ণ একটা
বিষয় নিয়ে। পাত পাত পদ্য লেখার সহজ উপায়।
লিখতে বসেই যে যুদ্ধের সাথে জড়িয়ে গেলাম তা হল কার জন্ম আগে - ডিমের না
মুরগির। মনে পড়ছে দুজন বিখ্যাত মানুষের দুটো কথা। একজন হলেন রবীন্দ্রনাথের
ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অন্যজন সৈয়দ শামসুল হক। শিল্পকর্মে
প্রধান কী ? কাঠামো, না কি অন্তর্নিহিত রস? আমার অবস্থান মাঝখানে। এ এমন এক
খেলা যেখানে দুটোই লাগে।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, "মৌচাক আর বোলতার চাক - সমান কৌশলে আশ্চর্যভাবে
দুটোই গড়া। গড়নের জন্যে বোলতায় আর মৌমাছিতে পার্থক্য করা হয় না; কিংবা
মৌমাছিকে মধুকরও নাম দেওয়া হয় না অতি চমৎকার তার চাকটার জন্যে । মৌচাকের
আদর, তাতে মধু ধরা থাকে বলেই তো! তেমনি শিল্পী আর কারিগর দুয়েরই গড়া
সামগ্রী, নিপুণতার হিসেবে কারিগরেরটা হয়তো বা বেশি চমৎকার হল কিন্তু রসিক
দেখেন শুধু তো গড়নটা নয়, গড়নের মধ্যে রস ধরা পড়ল কি না। এই বিচারেই তাঁরা
জয়মাল্য দেন শিল্পীকে, বাহবা দেন কারিগরকে। "
অন্য দিকে সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন, "অধিকাংশ শিল্পচেষ্টাই যে শেষপর্যন্ত
পৌঁছোয় না তার পেছনে, আমি মনে করি, ঐ মিস্তিরির অভাব। একটি উপমা আমি প্রায়ই
দিয়ে থাকি - চেয়ারের চারটে পা যদি মেঝেতে ঠিকমতো না বসলো তো সে চেয়ার দেখতে
যতই মনোহর হোক আমার তাতে কাজ নেই। "
ড. নীলরতন সেন লিখেছেন, "সুনিরূপিত অঙ্কের হিসাবে ছন্দের মাত্রা ও যতিবিভাগ
যখন বিশ্লেষণ করা যায় তাকে পদ্য বলা চলে - আর এমন স্পষ্ট হিসাবের নিয়মে যখন
বাঁধা চলে না তখন তাকে গদ্য বলা যেতে পারে।"
বাংলা ছন্দরীতির মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত - এই তিন নামের সাথে
আমরা সবাই পরিচিত। পদ্যছন্দের কেন্দ্রে রয়েছে মাত্রা। এই মাত্রা ব্যাপারটা
কোত্থেকে এলো, মশাই ? সীমা থেকে নাকি?
মাত্রা মানে যা দিয়ে মাপা হয় তার একক। মাত্রা নির্ধারণে বুঝতে হয় দল কাকে
বলে। ইংরেজিতে যাকে syllable বলে, বাংলায় সেটাই দল। বাংলায় সিলেবল শব্দটির
নানারকম নাম আছে - পাপড়ি, অক্ষর, দল ইত্যাদি। অক্ষর অবশ্য বর্ণ শব্দটিরও
প্রতিশব্দ। শব্দ হতে পারে একাক্ষরিক, হতে পারে দ্ব্যক্ষর। তবে
ছন্দবিশ্লেষণে আমাদেরকে বুঝতে হবে মুক্তদল ও রুদ্ধদলের প্রভেদ। কঠিন কিছু
নয়।
শব্দের যে অংশটুকু টেনে দীর্ঘ উচ্চারণ করা যেতে পারে সেটাই মুক্তদল। আর যে
অংশটুকু টেনে দীর্ঘ উচ্চারণ করা যায় না তাকেই রুদ্ধদল বলা যুক্তিযুক্ত। এই
'ছন্দ' শব্দটিতেই একটি রুদ্ধদল ও একটি মুক্তদল আছে। 'ছন্দ'কে ভাগ করলে তা
দাঁড়াবে ছন + দ। এখানে ছন রুদ্ধদল, দ মুক্তদল।
ছন্দোবিচারে দলের মতোই আরও একটি ব্যাপার গুরুত্বপূর্ণ - তা হল কলা। তবে
শুধু দল আর কলা বুঝলেই যে ছন্দজ্ঞানের ষোলো কলা পূর্ণ হবে তা নয়।
যাহোক একটি মুক্তদলকে উচ্চারণ করার সময়টুকুকে কলা বলা যেতে পারে ।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে আমরা নিঃসন্দেহে কলাবৃত্ত বলতে পারি। কতগুলো কলা নিয়ে
একটি পর্ব বা একটি ছত্র রচিত হল সেটাই প্রধানত এ-ছন্দে বিবেচ্য।
অক্ষরবৃত্তকে মিশ্রবৃত্ত, আর স্বরবৃত্তকে দলবৃত্ত নামে ডাকলেই বুঝতে সহজ
হবে। বলে রাখা ভালো অক্ষরবৃত্ত বা মিশ্রবৃত্ত ছন্দও কলাবৃত্তের আরেক রূপ।
শুধু স্বরবৃত্তই সম্পূর্ণ আলাদা।
তাহলে মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে কি আমরা এক কথায় সরল কলাবৃত্ত বলতে পারি না? এই
সরল ছন্দোরীতিকে জটিল করে দেখার মানে হয় না। আগেই বলেছি শব্দে রুদ্ধ এবং
মুক্ত উভয় দলই থাকতে পারে। আবার এও বলেছি একটি মুক্তদলকে স্বাভাবিকভাবে
উচ্চারণ করতে যতটুকু সময় লাগে তাকেই কলা বলে। তাহলে মাত্রাবৃত্ত বা সরল
কলাবৃত্ত ছন্দে রুদ্ধদলকে মাপব কীভাবে ? সরল কলাবৃত্তে মুক্তদল এক কলা এবং
রুদ্ধদল দুই কলা হিসেবে উচ্চারিত হয়। তাহলে কি বুঝতে হবে সরল কলাবৃত্ত
ছন্দে আমরা দল বা সিলেবলকে উপেক্ষা করে শব্দের বর্ণসমষ্টিকেই বিচার করছি ?
রুদ্ধদল 'ছন' দুই বর্ণে গঠিত ছ + ন। ছন্দ শব্দটি তিন মাত্রার [(ছ + ন =২
মাত্রা) + (দ = ১ মাত্রা)]
আরেকটি জটিল শব্দ 'পর্ব' সহজ করে বলতে গেলে সমপরিমাণ মাত্রাযুক্ত বাক্যাংশ,
পাঠের সময় যার পরে নির্দিষ্ট সময় ব্যয়ে কিঞ্চিত বিরাম আসে, তাকেই পর্ব
বলে।সরল কলাবৃত্তে সাধারণত চার, পাঁচ, ছয় এবং সাত মাত্রায় একেকটি পূর্ণপর্ব
গঠন করা হয়। মূলপর্ব থেকে ছোট পর্ব যা পঙক্তির শেষে বসে, তাকে অপূর্ণপর্ব
বলে। লিখিত লাইনকে ছত্র বলা হয়। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ১১৮ টি ছত্রে লেখা
'কবর' কবিতাটির ছন্দ বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। এই কবিতাটি ৬+৬+৬+২ মাত্রায়
লেখা হয়েছে। প্রতিটি ছত্রে ছয় মাত্রার তিনটি পূর্ণ পর্ব এবং দুই মাত্রার
একটি অপূর্ণ পর্ব রয়েছে।
এইখানে (৪) তোর (২) /দাদির (৩) কবর (৩) /ডালিম (৩)-গাছের (৩)/তলে (২),
তিরিশ (৩) বছর (৩) / ভিজায়ে (৩) রেখেছি (৩)/ দুই (২) নয়নের (৪) / জলে
(২)।
কবর কবিতায় ১১৮টি লাইন মানে ১১৮টি উদাহরণ। উপরে প্রথম লাইনটির মাত্রাবন্টন
যেভাবে দেখিয়েছি আপনিও ১১৮ টি লাইনের সবগুলো ওভাবে মার্কআপ করে দেখলে আপনার
যে প্র্যাক্টিস হবে তারপর বাংলা ছন্দ কঠিন মনে হবার কোনো কারণ দেখছি না।
আমি কি কিছু ভুল বুঝলাম? আর ভুল বুঝলাম বলেই আধুনিক বাংলা ছন্দ সহজ মনে হল
? তাছাড়া শুধু বুঝলেই চলে না, প্রয়োগ করাটাই আসলে কঠিন। তাই বলে কঠিনেরে কি
ভালোবাসব না?
কবর
– জসীমউদ্দীন
এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!
সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি
লাঙল লইয়া ক্ষেতে ছুটিলাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।
যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত
এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত শত।
এমনি করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে
ছোট-খাট তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।
বাপের বাড়িতে যাইবার কাল কহিত ধরিয়া পা
আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।
শাপলার হাটে তরমুজ বেচি পয়সা করি দেড়ী,
পুঁতির মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি।
দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,
সন্ধাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে!
হেস না হেস না শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে,
দাদি যে তোমার কত খুশি হত দেখিতিস যদি চেয়ে!
নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, এতদিন পরে এলে,
পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখিজলে।
আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়,
কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝঝুম নিরালায়!
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়,
আমার দাদীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।
তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি
যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।
শত কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি,
গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।
এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে,
গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।
মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে মিশায়ে বুক,
আয়-আয় দাদু, গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ।
এইখানে তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা,
কাঁদছিস তুই? কী করিব দাদু! পরাণ যে মানে না।
সেই ফালগুনে বাপ তোর এসে কহিল আমারে ডাকি,
বা-জান, আমার শরীর আজিকে কী যে করে থাকি থাকি।
ঘরের মেঝেতে সপটি বিছায়ে কহিলাম বাছা শোও,
সেই শোওয়া তার শেষ শোওয়া হবে তাহা কী জানিত কেউ?
গোরের কাফনে সাজায়ে তাহারে চলিলাম যবে বয়ে,
তুমি যে কহিলা বা-জানরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে?
তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে,
সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে!
তোমার বাপের লাঙল-জোয়াল দুহাতে জড়ায়ে ধরি,
তোমার মায়ে যে কতই কাঁদিত সারা দিনমান ভরি।
গাছের পাতার সেই বেদনায় বুনো পথে যেতো ঝরে,
ফালগুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো-মাঠখানি ভরে।
পথ দিয়া যেতে গেঁয়ো পথিকেরা মুছিয়া যাইত চোখ,
চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক।
আথালে দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি,
হাম্বা রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি।
গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা,
চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ।
ঊদাসিনী সেই পল্লী-বালার নয়নের জল বুঝি,
কবর দেশের আন্ধারে ঘরে পথ পেয়েছিল খুজি।
তাই জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ,
হায় অভাগিনী আপনি পরিল মরণ-বিষের তাজ।
মরিবার কালে তোরে কাছে ডেকে কহিল, বাছারে যাই,
বড় ব্যথা র’ল, দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই;
দুলাল আমার, যাদুরে আমার, লক্ষী আমার ওরে,
কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে।
ফোঁটায় ফোঁটায় দুইটি গন্ড ভিজায়ে নয়নজলে,
কী জানি আশিস করে গেল তোরে মরণব্যথার ছলে।
ক্ষণপরে মোরে ডাকিয়া কহিল আমার কবর গায়
স্বামীর মাথার মাথালখানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়।
সেই যে মাথাল পচিয়া গলিয়া মিশেছে মাটির সনে,
পরাণের ব্যথা মরে নাকো সে যে কেঁদে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে।
জোড়মানিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরুছায়,
গাছের শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে গায়।
জোনকিমেয়েরা সারারাত জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো,
ঝিঁঝিরা বাজায় ঘুমের নূপুর কত যেন বেসে ভালো।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, রহমান খোদা! আয়;
ভেস্ত নসিব করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়!
এখানে তোর বুজির কবর, পরীর মতন মেয়ে,
বিয়ে দিয়েছিনু কাজিদের বাড়ি বনিয়াদি ঘর পেয়ে।
এত আদরের বুজিরে তাহারা ভালবাসিত না মোটে,
হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে।
খবরের পর খবর পাঠাত, দাদু যেন কাল এসে
দুদিনের তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে।
শ্বশুর তাহার কশাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে
অনেক কহিয়া সেবার তাহারে আনিলাম এক শীতে।
সেই সোনামুখ মলিন হয়েছে ফোটে না সেথায় হাসি,
কালো দুটি চোখে রহিয়া রহিয়া অশ্রু উঠিছে ভাসি।
বাপের মায়ের কবরে বসিয়া কাঁদিয়া কাটাত দিন,
কে জানিত হায়, তাহারও পরাণে বাজিবে মরণবীণ!
কী জানি পচানো জ্বরেতে ধরিল আর উঠিল না ফিরে,
এইখানে তারে কবর দিয়েছি দেখে যাও দাদু! ধীরে।
ব্যথাতুরা সেই হতভাগিনীরে বাসে নাই কেহ ভালো,
কবরে তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো।
বনের ঘুঘুরা উহু উহু করি কেঁদে মরে রাতদিন,
পাতায় পাতায় কেঁপে উঠে যেন তারি বেদনার বীণ।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়।
আমার বুজীর তরেতে যেন গো বেস্ত নসিব হয়।
হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুপু, সাত বছরের মেয়ে,
রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে।
ছোট বয়সেই মায়েরে হারায়ে কী জানি ভাবিত সদা,
অতটুকু বুকে লুকাইয়াছিল কে জানিত কত ব্যথা!
ফুলের মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে,
তোমার দাদির ছবিখানি মোর হদয়ে উঠিত ছেয়ে।
বুকেতে তাহারে জড়ায়ে ধরিয়া কেঁদে হইতাম সারা,
রঙিন সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা।
একদিন গেনু গজনার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে,
ফিরে এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায় পথের পরে।
সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে।
কী জানি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গেছে।
আপন হস্তে সোনার প্রতিমা কবরে দিলাম গাড়ি,
দাদু! ধরধর বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি।
এইখানে এই কবরের পাশে আরও কাছে আয় দাদু,
কথা কস নাকো, জাগিয়া উটিবে ঘুমভোলা মোর যাদু।
আস্তে আস্তে খুঁড়ে দেখ দেখি কঠিন মাটির তলে,
দীনদুনিয়ার ভেস্ত আমার ঘুমায় কিসের ছলে।
ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিয়ে ঘন আবিরের রাগে,
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।
মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সুকরুণ সুরে,
মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দূরে।
জোড়হাত দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা! রহমান।
ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যুব্যথিত প্রাণ।
টরন্টো, ৯ অক্টোবর, ২০২২