জন্মান্তর
✍ রত্না চক্রবর্তী
১৭.৮.২২
মানুষের মনস্তত্ত্ব বড় বিচিত্র।
পরীর একটাই কথা তার বাবা তার ঘরে নাতি হয়ে ফিরে এসেছে। বাপের বড় আদুরী
মেয়ে ছিল পরী। তাই বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তারই ছেলের বৌএর কোলে নাতি হয়ে
ফিরে এসেছে। সেই রকম মুখ, চোখ, গোল গোল হাত পা, বাবার কপালে একটা কাটা
দাগ ছিল, ঠিক সেখানেই একটা বড় লম্বাটে জড়ুল। বাবার পিঠে যেমন জায়গায়
তিল ছিল তেমনি একটা তিল। আর হবে নাই বা কেন? মা মারা যাবার পর বাবা তো
তার কাছেই থাকত। শেষ বয়সে সেবা যত্ন-আত্তি তো সে কম করে নি। খুশিতে
গদগদ হয়ে সব্বাইকে গল্প করে " বাবা কখন আমায় ছেড়ে থাকতে পারে? জানতাম
ঠিক আমার কাছেই আসবে ঘুরে। " পাশের ফ্ল্যাট থেকে শুনতে পায় ঋতু, বিড়বিড়
করে গালাগালি করে "সব জানতা গুরুঠাকুর, বাবার আর খেয়ে- দেয়ে কাজ নেই,
ওই বাঙ্গাল বাড়িতে জন্মাবার জন্য হাঁকুপাঁকু করছিল। কুলিন এদেশীয় বামুন
বলে বাবার কত জাঁক ছিল, আর তিনি নাকি জন্মাতে গেলেন বদ্দিবামুনের ঘরে!
হুঁ... " রবি কাগজ পড়তে পড়তে মুখ বুজে শুনে যায়, বৌ আর বোনের ঝগড়ার
মধ্যে সে পড়তে নারাজ। দিদির ও যত অধিখ্যেতা, যা মনে হয় তা নিজের মনেই
রাখ না, তা নয় ঢাক পিটিয়ে বেড়াচ্ছে। আর বৌএর তো এমনিতে শ্বশুর নিয়ে
কোনদিন কোন মাথাব্যাথা ছিল না,পাত্তাই দিত না শ্বশুরকে, তা এখন এত কথার
কি আছে রে বাবা! যত্তসব। এর মধ্যে আবার ফুট কাটছে মাসি, " আরে বছর না
ঘুরলে তো মুক্তিই হয় না, তো জন্মাবেন কেমন করে? " মাসির সঙ্গে আবার
ঋতুর বেশ ভাবটাব আছে। মায়ের শাড়ি -টাড়ির উপর মাসির একটা টাঁক ছিল
কিন্তু পরী একটাও দেয় নি, তাই পরীর উপর একটা রাগও আছে। যত বড় হয় তত
নাতির মধ্যে পরী তার বাবাকেই দেখে, সেই সামনের চেরা দাঁত। আধো আধো বোল
ফুটলে দেখা গেল কথায় কথায় বলে " এ লাম"।বাবার কথায় কথায় বলত "এ রাম"।
ঋতুও খুব ভালোবাসে নাতিকে, দামাল ছেলে ছুটে ছুটে আসে, যত আবদার
মামীদিদার কাছে। ঋতুর ছেলের বৌএর টিউমার হয়ে ইউটেরাস - ওভারি বাদ গেছে,
তাই এদিকে নাতি হবার সম্ভাবনা নেই। পরী নাতির নাম রেখেছে রাণা, বাবার
নাম ছিল রাজা, নামের মিলটা রাখার চেষ্টা আরকি। ঋতু ইচ্ছা করে ওই নামে
ডাকে না, ও নাম দিয়েছে দেব। প্রতি কথায় বলে একদম বৌমার মত পা তুলে শোয়,
একদম ওর মার মত ভ্রু-তুলে কথা বলে। আঙ্গুল মটকানোটাও বৌমার মত। যাইহোক
ছেলে দুই দিদার আদরে বড় হতে থাকে। তবে যত বড় হচ্ছে তত রাগ জেদ বাড়ছে,
জিনিষ ছুঁড়ে ফেলা,একবার কোন কাজ করব না বললে আর তাকে দিয়ে করানোই যাবে
না। পরী বলে " একি কান্ড, আমার বাবা কত শান্ত মানুষ ছিল এ রকম রাগ ছিল
না "। ঋতু এই প্রথম বলল " দেবের জেদটা অনেকটা বাবার মত। উনি একবার যা
বলতেন তার থেকে নড়ানো যেত না। " পরী নাতির জন্য শিঙি মাছের ঝোল করে,
ছেলে খাবে না কিছুতেই, অতটুকু ছেলে ধনেপাতা বাটা দিয়ে মাছের তরকারী
দিব্বি খেয়ে নেয়। পরী ভাবে বাবা ধনেপাতার গন্ধ করতে পারত না। ঋতু ঘরে
বলে " মনে আছে বাবা শিঙি মাছের ঝোল খেতে পারত না, বলত রোগীর পথ্য। "
পরীর নাতির ফুটবল খেলায় কোন আগ্রহ নেই, পরী ভেবেছিল তার বাপের মত ফুটবল
খেলোয়াড় হবে। ছেলের যত আগ্রহ কম্পিউটারে। রোজ ইস্কুল থেকে এসেই ঋতুর
ফ্ল্যাটে চলে যায়, কম্পিউটার গেম খেলে। পরী এক সময় খুব আনন্দে ছিল,তার
আর তার ভাইয়ের পাশাপাশি ফ্ল্যাট হবার জন্য, বুড়ো বয়সে রিটায়ার হবার পর
ভাই তো এখানেই থাকবে, বদলীর আর প্রশ্ন নেই।, সারাজীবন ভাইকে দেখতে
পাবে। আজকাল মনে হয়ে একটু দূরত্ব থাকলে বোধহয় ভালোই হত।আজকাল ঋতুর মনে
হয় হবেও বা শ্বশুর মশাই ফিরে এসেছেন, ছেলেকে মেয়েকে একসাথে কাছে পাবেন
বলে। তার বৌমার তো আর বাচ্ছাকাচ্ছা হবে না। তাই ইচ্ছা থাকলেও তো তার
ঘরে ফিরতে পারলেন না। আত্মা তো সবই বোঝে, তাই দিদির নাতি হয়ে ফিরে
এসেছে। বাবার খুব নতুন নতুন জিনিষ শেখার আগ্রহ ছিল। বাবার আমলে টাইপ
মেশিনের কম্পিউটারের মত চল ছিল, বাবা নিজেই বাড়িতে একটা টাইপ মেশিন
কিনে নিয়েছিলেন। ওই নিয়ে থাকতেন। অনেক ভাষা জানতেন, মাথা খুব ভালো ছিল।
একদম শেষ বয়সে যখন প্রায় বিছানায় শয্যাশায়ী তখন নতুন উঠল মোবাইল, বাবা
শুয়ে শুয়েই ঠিক শিখে ফেললেন, তখন ও ঋতুরাও ম্যানেজ করতে পারত না।
নাতিটাও ঠিক তেমন হয়েছে। এই বয়সে কম্পিউটারে যে কি এক্সপার্ট হয়েছে!
নাতির দুধে দাঁত পড়ে গেলে দেখা গেল চেরা দাঁতটা আর নেই। দিন দিন নাতিটা
ঋতুর খুব নেওটা হয়ে উঠল। বড় মায়া পড়ে গেছে, সারা বাড়িতে তো ওই একটাই
বাচ্ছা।কি দারুণ বুদ্ধি! পরীর নাতির লেখাপড়ায় খুব মন কিন্তু ওই
সর্বনাশা জেদ।সেদিন রাগের মাথায় হাতের খেলনা গাড়িটা এমন ছুঁড়ল যে ক্লাব
থেকে বাবাকে যে মানপত্রটা বাঁধিয়ে দিয়েছিল সেটা মাটিতে পরে ঝনঝন করে
ভেঙে গেল। এবার পরী কেঁদে ফেলল। এ তার বাবা হতেই পারেনা, সেই এতদিন ভুল
ভেবেছিল, যে চলে যায় সে আর আসে না। নাতি বিকেলবেলা স্কুলের থেকে নাচতে
নাচতে ফিরল কুইজে ফার্স্ট হয়েছে একটা দারুণ বই প্রাইজ পেয়েছে। পরী বাড়ি
ছিল না,রাণা দৌড়ে ঋতুর কাছে গিয়ে ওর হাতে বইটা তুলে দিল।ঋতুর চোখে জল
এসে গেল, রিটায়ারমেন্টের দিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে ঠিক এমনি করেই ঋতুর
হাতে তুলে দিয়েছিলেন তার পাওয়া ঘড়িটা। ঋতু হাঁটু মুড়ে বসে জড়িয়ে ধরল
নাতিকে। বাবাই ফিরে এসেছেন তাদের কাছে। রবি ভাবে কি বিচিত্র মানুষের
মনের জগৎ, একদিন কিছুতেই মানবে না ঋতু যে বাবা তাদের ঘরে ফের জন্মেছেন
আর আজ ঋতুর কাছে নাতিই বাবা হয়ে ফিরে এসেছে আর পরী বলছে এ তার বাবা
নয়।।
(নতুনদের জন্য আবার)
টেন গ্লেন এভারেস্ট রোড
✍ সাইদুজ্জামান
কী আশ্চর্য ! টেন গ্লেন এভারেস্ট রোডের সতেরোতলা
ভবনে একটা তেরো তলা আছে। সেই তেরো তলার তেরো নম্বর ঘরেই বাস করেন উপল
বাবু। উপলের ট্রিস্কাইডেকাফোবিয়া না থাকলেও এলিভেটরে চড়তে ভয় পান। তেরো
তলায় দুদুটো এলিভেটর থাকতেও তিনি সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামছেন। আজ কিশমিশ
আসছে অ্যালাস্কার অ্যাঙ্করেজ থেকে। কিশমিশ এক যুবতীর নাম। নামটা উপলই
দিয়েছেন। উপল বাবুর বয়স সাতান্ন, কিশমিশের তার অর্ধেক। দুদুবার বিয়ের
পর উপল যখন সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলেছেন খাঁচায় থাকা আর নয়, তখনি ফেসবুকে
কিশমিশের মুখ দেখা। দেখা গেলো প্রায় কুড়িতেই আঙ্গুরবালা দেবীও দুদুবার
বিয়ে করে থুড়ি থুড়ি বলে বিয়ে ব্যাপারটাকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে
চলেছেন। উপলের মধ্যরাতে পদ্য লেখার বাতিক আছে, সেইসাথে আছে প্রকান্ড
কান্ডজ্ঞানহীনতা। আনলাকি থার্টিনে থাকলে যা হয়। ভাব জমাতে আঙুরবালাকে
দুম করে একদিন পি এম করে বসলেন, "আপনার একটা ডাকনাম দিতে মন চাইছে,
দেব?" শুরুতে বানানটি অবশ্য লিখলেন KissMiss, কালের বিবর্তনে তা একদিন
কিশমিশে পরিণত হয়ে গেলো। সেই কিশমিশকে আনতেই আজ টরন্টো পিয়ারসন
ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে যাওয়া। কিশমিশ একা আসেনি, সঙ্গে চার বছরের
কন্যা অরণি। দারুন মিশুক। ভাব করে নিলো সঙ্গে সঙ্গেই। কিশমিশের চেহারা
রোগা-পাতলা, মুখখানাও শুকনো, তবে চোখ দুটো, হাত দুটো, পা দুটো, ...চোখ
ফেরানো দায়। দেখেই বোঝা যায় স্বাস্থ্য সচেতন, আমেরিকায় বসবাস করলেও
ফাস্টফুডের বদভ্যাস নেই, শরীরে যতটুকু চর্বি তা স্থান বিশেষেই জমেছে।
ক্লিফসাইড ড্রাইভ ধরে উপলের হন্ডা সিভিক সংক্ষিপ্ত গ্লেন এভারেস্ট রোডে
ঢুকতেই কিশমিশ বুঝেছে এ রাস্তায় একটিই হাই রাইজ বিল্ডিং আছে। টেন গ্লেন
এভারেস্ট রোড। কাছেই অন্টারিও লেক। গাড়ি থেকে নেমেই উপল ঝামেলাটা
বাঁধালেন। সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হবে তেরো তলায়। উপল অবশ্য এ কঠিন সমস্যার
সহজ এক উপায় বাতলে দিলেন - এতটা উচ্চতা পায়ে হেঁটে উঠতে হলে ছড়া কাটতে
কাটতে উঠতে হয়। এ প্রস্তাবে সবচে খুশি হলো অরণি। অরণি বাংলা এবং ইংরেজি
দুটোই চমৎকার বলে। উপল অন্নদাশঙ্কর রায়ের "নেমন্তন্ন" দিয়েই শুরু
করলেন। উপল এক লাইন বললে, অরণি তা রিপিট করে। দারুন খেলা।
যাচ্ছ কোথা?
চাংড়িপোতা।
কিসের জন্য?
নেমন্তন্ন।
বিয়ের বুঝি?
না, বাবুজি।
কিসের তবে?
ভজন হবে।
শুধুই ভজন?
প্রসাদ ভোজন।
কেমন প্রসাদ?
যা খেতে সাধ।
কী খেতে চাও?
ছানার পোলাও।
ইচ্ছে কী আর?
সরপুরিয়ার।
আঃ কী আয়েস।
রাবড়ি পায়েস।
এই কেবলি?
ক্ষীর কদলী।
বাঃ কী ফলার!
সবরি কলার।
এবার থামো।
ফজলি আমও।
আমিও যাই?
না, মশাই।
তেরোতলায় দেখতে দেখতে উঠে গেছে সবাই, এর মধ্যে অরণির নেমন্তন্নও
মুখস্থ। যতক্ষণ জেগেছিলো যাচ্ছ কোথা, যাচ্ছ কোথা করে কাটালো। ঘুমোনোর
সময়ও সুর করে এই ছড়া শুনিয়ে ঘুম পাড়াতে হলো।
উপলবাবু কিশমিশকে একরকম ভয় পাইয়েই দিয়েছেন, এ ভবনে নাকি রাত দশটার পর
বাথরুম ব্যবহার করলে পাঁচ হাজার ডলার জরিমানা । এ হতেই পারে না,
কানাডায় এরকম কোনো আইন বা বিধি থাকতেই পারে না। কিশমিশ প্রথমে বিশ্বাস
করতে চায়নি। ভেবেছিলো উপল মজা করার জন্য বানিয়ে বানিয়ে এসব বলছে। উপল
বললেন যদি বিশ্বাস না হয়, লবিতে গিয়ে দেখে আসো এক পাগল সারাক্ষন বিড়বিড়
করে কী যেন বলছে, তাকে জিজ্ঞেস করো তাপগতিবিজ্ঞানের বা
থার্মোডাইনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্র কী, দেখবে সে অন্তত সাতটি উদাহরণ
দিয়ে সব বুঝিয়ে দেবে। এর নাম টেন গ্লেন এভারেস্ট রোড, কিশমিশ। এখানে সব
হয়। এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলো কিশমিশ, ভয়ে উপলের গা ঘেঁষে
দাঁড়ালো। এবার উপলবাবুই অবশ্য একটু ভয় পেলেন, সরে দাঁড়ালেন নিদেন পক্ষে
এক হাত দূরে। প্রথম দর্শনেই এতটা ঢলাঢলিতে অভ্যস্ত নন উপল। ক্লজেট থেকে
একটা এয়ার ম্যাট্রেস বের করে পাশের ঘরে চলে গেলেন দ্রুত। গুড নাইট,
ঘুমিয়ে পড়ো, কিশমিশ।
শীতের রাত। দেয়াল থেকে দেয়াল, মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত টানা স্বচ্ছ কাচের
জানালা । বাইরে তুষারফলকের তুলো উড়ছে। জানালার পাশেই ডাবল সাইজের
বিছানাটি পাম্প করে শুয়ে পড়লেন উপল। শুয়ে থাকা মানেই ঘুম নয়। নানাবিধ
দার্শনিক ভাবনা ঘুমুতে দেয় না উপলকে কিছুতেই। এ তুই করলিটা কী উপল,
আগুন নিয়ে খেলতে গেলি? আধেকবয়সী কিশমিশকে নিয়ে নতুন কোন কাব্য তুই
করবি? কিশমিশ মাইন্ড রিড করতে জানে নাকি? দুপুররাতে সে উঠে এসেছে উপলের
বায়বীয় বিছানায়। আদুরে গলায় বলেছে, "আমাকে আদর করো"। প্রথম যৌবনে
যেকারণে নারীর হৃদয় জয় করতে অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছেন উপল, এখন একই কারণে এই
দ্বিতীয় যৌবনে কিশমিশকে ফিরিয়ে দিতে পারেন না। নারীর ইচ্ছেই যে আইন, এই
প্রত্যয়ের থেকেই গভীর অগ্নির জন্ম হয়।
মাত্র সাত দিনের ছুটি নিয়ে এসেছিলো কিশমিশ। টরন্টো থেকে আকাশ পথে
অ্যাঙ্করেজের দূরত্ব তিন হাজার বত্রিশ মাইল। দুদিন তো আকাশে আর বন্দরে
বন্দরে কাটলো। দর্শনীয় সেরকম কোনো স্থানে যাওয়াও হলো না কিশমিশের শুধু
ঐ নায়াগ্রার জলপ্রপাত ছাড়া। সেদিন আবার ছিল ঝড়ের দিন। চোখের সামনেই
দু-তিনটে গাছ ভেঙে পড়লো জলপ্রপাতের কাছেই। ঝড়ের তোড়ে হাঁটাই কঠিন হয়ে
পড়ছিলো। অরণির কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। নায়াগ্রার জলপ্রপাত জানে সেদিন
সত্যিকার ট্যুরিস্ট একজনই ছিল - সে অরণি।
দেখতে দেখতে ঐ অসামান্য পাঁচদিন কেটে গেলো, দুনিয়া কাঁপাতে হয়তো দশদিনই
লাগে, তবে উপলকে কাঁপাতে কিশমিশের পাঁচদিনই যথেষ্ট ছিলো। ওদেরকে
বিমানবন্দরে নামিয়ে ফেরত পথে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট পড়লো, ফুটন্ত
ওয়াটার রিয়াক্টরের মতোই বাষ্পাকুল হলো উপলবাবুর চোখ। একটা স্বপ্ন
প্রায়ই উপলকে তাড়িয়ে ফেরে, এক সুদুঃস্বপ্ন - দুর্ভেদ্য এক জালে আটকে
পড়েছেন উপল আর ছোট্ট একটি মেয়ে তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসছে। গাড়ি পার্ক
করে টেন গ্লেন এভারেস্ট রোডের লবিতে ঢুকতেই দেখা গেলো বরাবরের মতোই
স্কিজোফ্রেনিক স্টিভ আপনমনে কথা বলে যাচ্ছে। উপল বরাবরের মতোই সিঁড়িঘরে
ঢুকলেন।
যাচ্ছ কোথা, উপল?
ফেলতে চোখের জল। ....
টরন্টো, অগাস্ট ১৪, ২০২২
মায়াপুরের মায়া (অন্য রহস্য)
রত্না চক্রবর্তী
১৯.৮.২০
আজ অন্য রহস্যে আমি যে গল্পটা বা ঘটনাটা বলতে এসেছি সেটা আমার নিজের
সাথে ঘটা। আমি এই ঘটনার মধ্যে মায়াপুরের মায়ার অনুগ্রহ দেখতে
পেয়েছিলাম।
আজ থেকে বছর কয়েক আগের কথা, আমি মায়াপুর গিয়েছিলাম আমার কয়েকজন নিকট
বান্ধবীর সাথে । আগেও একবার গেছি এবার দ্বিতীয়বার। মায়াপুর তো খুব ভাল
লেগেছে আর সেখান থেকে নবদ্বীপ গিয়েছিলাম। নবদ্বীপে কিন্তু একটা
অন্যরকম মাহাত্ম্য অনুভব করেছিলাম। প্রতিটি জায়গায় যেন আমার মনে
হচ্ছিল আমি যেন ভগবানের অস্তিত্ব বুঝতে পারছিলাম। বেশকিছু ঘটনা সেখানে
ঘটে সেগুলো আমি আপনাদের অন্য একদিন গল্প করবো।
আজ যেটা বলছি সেটা হচ্ছে মায়াপুর থেকে ফেরার সময় আমরা
অটো ধরে কৃষ্ণনগর। কৃষ্ণনগর থেকে শিয়ালদা। শিয়ালদার ট্রেন ধরব।
শিয়ালদা থেকে বজবজ লোকাল ধরবো। বেসব্রীজ থেকে বাড়ি। আমি ও আমার সঙ্গিনী
বাস, ট্যাক্সিতে উঠতে পারি না। খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমরা বেহালায় থাকি।
আর এবার তো দুদিন তো খুব টো টো করে ঘোরা হয়েছে। নিয়ম মতন ঘুম
খাওয়াদাওয়া হয় নি। কাজেই আনন্দিত মন হলেও, শরীর কিন্তু বড় ক্লান্ত।
কৃষ্ণনগর আসার সময় অটো অনেক দেরি করল ফলে আমরা যে ট্রেন পেলাম তাতে
শিয়ালদা পৌছুতে অনেক রাত হয়ে যাবে। তারপর বজবজের গাড়ি যদি বেরিয়ে যায়
তো সেই ট্যাক্সি ছাড়া উপায় নেই। অনেক রাত হবে। ভগবানকে ডাকছি যেন
বজবজের ট্রেনটা পেয়ে যাই। এই সব ঝামেলায় আমরা বেড়াতে যাইই খুব কম।
গাড়িতেও খুব ভিড়। গাড়ি মাঝেমাঝেই থামছে। বেশ লেট করছে। ট্রেন বেশ
দেরিতে শিয়ালদহ পৌঁছাল। আমার দুজন সঙ্গিনী শিয়ালদা থেকে ট্যাক্সি নিয়ে
তাদের বাড়ি রওনা হল। আর এক বান্ধবীর ছেলে নিতে এসেছিল। সে নারকেলডাঙায়
থাকে।
ছেলেটা বললো "মাসীমা আমাদের সাথে চলুন অনেক রাত হয়ে গেছে. আজকের
রাতটুকু আমাদের বাড়ি কষ্ট করে থেকে কাল না হয় রওনা দেবেন। কথাটা
যুক্তিযুক্ত কিন্তু আমার এক সঙ্গিনীর একটু অসুবিধে ছিল। তার কর্তা কাল
ভোরে একটা কাজে দুদিনের জন্য বেরিয়ে যাবে তাই তার না ফিরলেই নয়। আমরা
তিনজন আছি একে অপরকে ফেলে চলে যেতে পারি না। আর বজবজের ট্রেনটাও
বেরিয়ে যায়নি। এখনো দাঁড়িয়ে আছে এটায় গেলে পৌঁছতে পারব। ফাঁকা ট্রেন।
আমরা ট্রেনে উঠে পড়লাম। ওর সাথে গেলাম না। ট্রেনে যখন ব্রেসব্রীজে
থামল তখন রাত এগারোটা পয়তাল্লিশ। নির্জন হয়ে গেছে পথঘাট। তিনজনের
হাতে তিনটে বড় বড় ব্যাগ, জামাকাপড়ের। কিন্তু তখনও একটা রিক্সা পাওয়া
গেল। আমার দুই বান্ধবী যেদিকে যাবে সেদিক যাবে রিক্সা এটাই তার শেষ
ট্রিপ। এরপর সে আর গাড়ি না বার করবে না। ঘরে ঢুকে যাবে। পথে একটা অটোও
নেই। আমার সঙ্গিনীরা খুব দ্বিধাগ্রস্ত আমায় এত রাতে একলা ফেলে যেতে,
এদিকে রাত বাড়ছে।
রিক্সাওয়ালাও আর দাঁড়াতে চাইছে না। তাছাড়া হট করে যে আমাদেরই মতো
কোনো একজন যাত্রী এসে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে যাবে না তার কোন মানে নেই।
বেশি পয়সা দিলে রিক্সাওয়ালাও চলে যাবে। আমি তখন বাধ্য হয়ে বললাম,
"একটু বাদে গোপাল আমায় নিতে আসবে, তোমরা আর দাঁড়িও না, চলে যাও ভাই। "
তারা বলল, "গোপাল আবার কে? আমি বললাম ওই যে আমাদের পাশের বাড়ি থাকে।
আমি ফোন করে বলেছি, তোমরা নিশ্চিন্তে চলে যাও। ও ওর সাইকেল নিয়ে আসছে,
ওতেই চলে যাব। আমি একটু এগিয়ে হাঁটতে থাকি আর. আই. সি মোড়ের কাছাকাছি
যেতে না যেতে ও এসে যাবে। তোমাদের চিন্তা নেই।"
তারা খুব মন খারাপ করে গেল, বাধ্য হয়েই চলে গেল।
আমি ঠাকুরের নাম করে হাঁটা শুরু করলাম। মনে মনে বললাম শ্রীকৃষ্ণ তোমায়
দেখে এসেছি চলো দেখি বাবা আমার সঙ্গে। হাতের ব্যাগটা ও ভারী, হয়তো
ততটা ভারী নয় কিন্তু আমার পায়ের একটু অসুবিধা আছে বলে আমি হাঁটতে
পারিনা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটতে লাগলাম। যতদূর চোখ যায় কোন লোক নেই।
না পিছনে না সামনে। আমার তো আমার গল্প লেখার রোগ। এই রাস্তা নিয়ে অন্তত
গোটা তিনেক ভূতের গল্প লিখে প্রকাশ করা হয়ে গেছে। তবে অবশ্য সে সব ভয়
করছিল না। গায়ে গয়নাগাটিও নেই, কাজেই চোরডাকাতের ভয়ও পাচ্ছি না তবে
নির্জন পথে কেমন একটা অস্বস্তি হয়। তাছাড়া মায়াপুরে আমাদের ঘরটা ছিল
অনেক ভেতর দিকে ফলে আশ্রম থেকে রাস্তায় আসতে গেলে অনেকটা হেঁটে আসতে
হতো। হাঁটাহাঁটি আমার সহ্য হয় না, বারবার রিকশায় উঠেছি বিভিন্ন
মন্দির দেখেছি নেমে নেমে, পায়ে খুব ব্যথা হয়েছে। যদিও একটা পেইনকিলার
খেয়ে নিয়েছি তবুও হাঁটতে আর পারছিনা। হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু
বাড়ি তো পৌঁছাতে হবে। বাড়িতে খবর দেবার উপায় নেই, ফোনের চার্জ নেই। ছবি
তুলে তুলে শেষ। কি আর করি মনে মনে কৃষ্ণ কৃষ্ণ মধুসূদন বলতে বলতে
বিড়বিড় করতে করতে আসছি। এমন সময় দেখি একটা তীব্র আলো পিছন থেকে
আসছে। আমি একপাশে সরে দাঁড়ালাম। চোখ কুঁচকে পিছনে তাকালাম। রাস্তা যদি
সোজা আমাকে দেখা যাচ্ছে চাপা দেবে না। দেখলাম একটা অটো আসছে। রুটের অটো
বলে মনে হলো না। আমি এই রুটটা খুব ব্যবহার করি, যেহেতু বাসে গাড়িতে
উঠতে পারিনা, তাই এই পথেই সব জায়গায় যাই। মোটামুটি চিনি অটোগুলোকে।
আমি আবার হাঁটতে শুরু করলাম এমন সময় অটোটা আমার পাশে এসে ঘ্যাঁচ করে
ব্রেক কষে দাঁড়াল। আমি তাকিয়ে দেখি ছেলেটি আমার দিকে মুখ বাড়িয়ে
বলছে," মাসিমা কতদূর যাবেন? কোথায় যাবেন?"
আমি বললাম," বাবা রবীন্দ্রনগর যাব।" আমার মনে তখন একটু আশার আলো যদি
একটু এগিয়ে দেয়, আমার নামিয়ে দেয়।
সে বলল, "তবে উঠে আসুন আমি অবশ্য অতদূর যাব না, এয়ারপোর্ট মোড় অবধি যাব
, আপনাকে এগিয়ে আর.আই. সি মোড়ে নামিয়ে দেব। আমার ওখানে গাড়ি রাখি।
আরো এগিয়ে দিতে পারতাম রবীন্দ্র নগর আবধি কিন্তু আমাকে গ্যারেজ তাড়া
দিচ্ছে। যেখানে গাড়ি রাখি তারা দরজা বন্ধ করে দেবে তাই..."
আমি বললাম, " তাই চলুন বাবা আমার অনেক উপকার হবে। আমি উঠে পড়লাম।"
আমি তো একটু বকবক করি তার মধ্যে এই রকম একটা উপকার আমি গদগদ হয়ে
বললাম, "আপনি বোধহয় এই রুটের নন তাই না? "
সে বলল "হ্যাঁ আমি অন্য এক জায়গায় একটা কাজে গিয়েছিলাম। তাই ফেরার
সময় আপনাকে দেখছি দূর থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খুব কষ্ট করে হাঁটছেন।
ভাবলাম একটু এগিয়ে দিয়ে এই আরকি! "
সে হাসলো আমিও খুব কৃতার্থ হয়ে গেলাম। আর আই সি মোড়ে এসে সে আমাকে
নামিয়ে দিল। তাকে একটু পিছনে গিয়ে আবার তার এয়ারপোর্টে ঢুকতে হবে।
আমি নেবে বললাম, "বাবা আমি কত..?"
সে বললো, "মাসীমা আপনি হাঁটতে পারছে না বলে এগিয়ে দিলাম এসব বলে লজ্জা
দেবেন না। "
সে গাড়ী ঘুরিয়ে নিল। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম শুধু একবার বললাম," বাবা
তোমার নামটা? "
সে বলল "গোপাল। "
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, ও গোপালই আমায় তাহলে নিতে এল। এখান থেকেও আমার
বাড়ি বেশ অনেকটা পথ। আমি হয়তো মনের তৃপ্তিতেই শক্তি পেয়েছি। পথ তো
অর্ধেক মেরেই এনেছি। হাঁটছি আবার এবার পিছন থেকে প্যাঁক প্যাঁক শব্দ,
একটা রিক্সা। বয়স্ক লোকটি বলল, " যাবেন নাকি? " আমি তখন বিদ্যামন্দির
স্কুলের সামনে, আরো পথ বাকি... এককথায় বললাম, " হ্যাঁ ভাই চলুন
রবীন্দ্রনগর। " রিক্সা চলতে লাগল। এও আমার পাড়ার রিক্সাওয়ালা নয়। সে
রিক্সা চালাতে লাগল। আমি মনে মনে ভাবলাম কি ভগবানের মায়ার খেলা এত
রাতে কোন দিন এখানে রিক্সা পাওয়া যায় না। আর তাছাড়া রবীন্দ্র নগরের
রিক্সা সম্বন্ধে একটু বদনাম আছে। একটু বৃষ্টি পড়লে, একটু সন্ধ্যা হলে
আর গাড়ি চলবে না। সেখানে এত রাতে প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে রিক্সা
পাওয়া একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। রিক্সাওয়ালা রিক্সা চালায় আর গুনগুন
করে হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ গান গাইছে। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। জানি
এগুলো অতি সাধারন ঘটনা কিন্তু আমি সেদিন বুঝেছিলাম মায়াপুরের মায়া
আমাকে নির্বিঘ্নে বাড়ি পৌঁছে দিল। বাড়ি এসে মোবাইল চার্জে দিয়ে যখন
বন্ধুদের ফোন করে জানালাম আমি বাড়ি পৌঁছে গেছি তারা বলল তারাও এও সবে
পৌঁছেছে। সে যে আমার কি ভাল লেগেছিল বলে বোঝাতে পারব না আমি আজও সেই
ছেলেটির কথা ভুলতে পারি না আর কখনো তাকে কোথাও দেখিনি। বছর ত্রিশের
অন্য অটোচালক দেখলেই মুখখানা দেখি কিন্তু তার দেখা আর পাই নি।সে তো
নিশ্চয়ই একজন অটোচালক, নিশ্চয়ই ফেসবুকে আছে, যদি এই ঘটনা পড়ে বা শোনে
কোনদিন তবে সে জানতে পারবে সেই অপরিচিত মাসীমাকে সে সেদিন যে সাহায্য
করেছিল তার সেই মাসীমা এখনো তাকে গোপালের পাঠানো গোপাল বলেই মনে প্রাণে
বিশ্বাস করে।।