তথ্য-প্রযুক্তির এ-যুগে সাহিত্যের ভবিষ্যৎ কী ?
আজ থেকে প্রায় দুহাজার চারশো বছর আগে গ্রিক দার্শনিক প্লেটোকে উদ্বিগ্ন
করে তুলেছিল তথ্য-প্রযুক্তি। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, লেখালেখির কারণে
মানুষের ক্ষতিবৃদ্ধিই হবে। মানুষকে তার স্মৃতি বিসর্জন দিতে হবে।
লিপিবদ্ধ তথ্য থাকলে তা মনে রাখার অর্থ থাকে না। মানুষের চরিত্র
নিয়ন্ত্রিত হবে অন্যের লেখা অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে। মানুষ আস্থা
রাখবে অন্যের কথায়, প্রয়োজন বোধ করবে না নিজে কোনো কিছুতে অংশ গ্রহন
করার। প্লেটোর এ ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। প্রায় ২৩০০ বছর পর
এইতো সেদিন আইনস্টাইন বলেছেন, "যা বই থেকে দেখে নেওয়া যায়, তা কখনোই
মুখস্থ কোরো না। "
আজ আমরা তথ্য-প্রযুক্তির এক মহাবিপ্লবের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছি। এ
বিপ্লবের ফলাফল প্রতিটি মুহূর্তে নাটকীয়ভাবে আমাদেরকে আন্দোলিত করে
চলেছে। ভাষায়, সাহিত্যে, বানানে, ব্যাকরণে। আমরা কি তবুও উদ্বিগ্ন হবো
না? আমাদের পুরোনো বার্তাব্যবস্থা অধুনা লুপ্তপ্রায়। যে সামান্য আছে
তার প্রয়োগও আমাদের চোখের সামনে বদলে যাচ্ছে।
অবশ্য আমরা যাকে সাহিত্য বলতে চাই তার রূপতত্ত্ব অন্তত সত্তরের দশকের
শুরু থেকে মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে। রূপায়ণের মানদণ্ড ভেঙে টুকরা
টুকরা করা হয়েছে এবং অকারণে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। ভাষাকে
অশ্লীলভাবে নগ্ন করা হয়েছে।
আমি যে সমস্যার কথা বলতে বসেছি তা মূলত বিচরণক্ষেত্র। সাহিত্যের
অলংকারবহুল রূপতত্ত্ব কিন্তু আমাদের নিজস্ব এখনকার পরিবেশের থেকে অনেক
আলাদা সামাজিক ও প্রযুক্তিগত পরিবেশের অন্তর্গত।আমরা বর্তমানে মানব
ইতিহাসে যোগাযোগ ও বার্তাব্যবস্থার চরম রূপান্তরের সাক্ষ্য দিচ্ছি ।
ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, স্যাটেলাইট এবং কেবল অন-ডিমান্ড
টেলিভিশন, মার্কেট সেগমেন্টেশন, অ্যালগরিদমিক মার্কেটিং:দিন বদলের এমন
তালিকা শেষ হবার নয়। ভুল বুঝবেন না, আমি সামাজিক এবং
শব্দার্থবিজ্ঞানঘটিত ধ্বংসের কথা বলছি। সংস্কৃতির পুরোনো বনাঞ্চল মুছে
ফেলা হয়েছে, এবং সাহিত্য, তার পরিগ্রাহী হাত এবং বৃক্ষচারী বাহু
দিয়ে, এমন উচ্চতায় পৌঁছুতে চায় যতদূর আর আরোহণ করা যায় না এবং এতটাই
দূরে তাকিয়ে থাকে যা দেখতে সে পায় না।
অন্য কোনো প্রজন্মই সাংস্কৃতিক পরিবেশের এতটা আকস্মিক পরিবর্তন হয়তো
দেখেনি। তবু সাহিত্য কিন্তু দিব্যি বেঁচে আছে, ভালোভাবেই বেঁচে আছে।
টরন্টো, নিউইয়র্ক, ঢাকা, কোলকাতা - সারা বিশ্বেই উপচে পড়ছে লেখক।
বইমেলার অভাব নেই, বইয়ের অভাব নেই। সাহিত্য আসর বসছে যত্রতত্র। আধুনিক
লেখকের শিক্ষাগত যোগ্যতাও বেশি। অধিকাংশ লেখকই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যা
লাভ করেছেন।এখন তো ইচ্ছে করলেই রবীন্দ্র রচনাবলী অথবা শরৎ রচনাবলী
নিমেষেই আন্তর্জালে খুঁজে পাওয়া যায়, বিনামূল্যে পাঠও করা যায়। তবু
পাঠকের সংখ্যা এবং পাঠস্পৃহা ভয়ানকভাবে কমে যাচ্ছে - কেন যাচ্ছে?
আনন্দের সাথে লক্ষ করেছি অসংখ্য বিদ্বজ্জন শুদ্ধ/প্রমিত বানান চর্চার
অসংখ্য চক্র খুলেছেন, দিনরাত খেঁটে যাচ্ছেন। ক্রমবর্ধমান ভাষা ও
সাহিত্যের শিক্ষকের ব্যস্তানুপাতে কমে যাচ্ছে সাহিত্যের ছাত্র ও পাঠক।
এ সংখ্যায় বেশ কিছু নতুন গল্প-কবিতা নির্বাচিত হয়েছে। আশা করি সবার
ভালো লাগবে। শুভ হোক বাংলা সাহিত্য।
২৪ শে আগস্ট, ২০২২
সাইদুজ্জামান, টরন্টো, কানাডা।