টরন্টো, ২৪ শে আগস্ট, ২০২২, নভো সংখ্যা ৩৫
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য সংবাদ ভ্রমণ কাহিনি বিশেষ নিবন্ধ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি যোগাযোগ

কার্তিকের কুয়াশা

ধর্মবিমুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর 

 

 

 

- শ্রী দ্বৈপায়ন 

 

আমি লেখক নই।  সাহিত্যিক তো নয়-ই। সেই বিখ্যাত উক্তি মনে-প্রাণে   বিশ্বাস করি যে, "পা থাকিলেই হাঁটা যায় কিন্তু হাত থাকিলেই লেখা যায় না।"
অবশ্য নবীন বয়সের আর পাঁচ জনের মতো আমারও ছিল গোপন রোমাঞ্চের মতোই একান্ত গোপনীয় একটা খাতা। সেই খাতায় ছিল যুব-বয়সের ভালো লাগার ভালোবাসার কবিতা।  একমাত্র নিজের কাছেই তার আবৃত্তি, নিজের মনে মনেই তার মুদ্রণ। অন্যান্য বায়ু রোগের  মতো সময়ের ধারায় সেই রোগ প্রশমিত হয়েছে-- মুদ্রণের আলো দেখার আগে। নবীনের একান্ত গোপন সেই কাব্যেরও মৃত্যু হয়েছে।  জীবনের প্রয়োজনে পরে যা কিছু লিখেছি তা বাস্তব ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন। সেই ঝুঁকি ও আনন্দময় জগত থেকেও সময়ে সরে আসতে হয়েছে।
এখন যা কিছু লিখি তা প্রকাশ অযোগ্য ভালোলাগা কিছু অনুভূতির নিরস প্রকাশ। ফেসবুকের পাতায় তা সীমাবদ্ধ। আমার মতোই গুটিকয় বিষয়বুদ্ধিবিলুপ্ত গুটিয়ে থাকা বন্ধু তার পাঠক। যাঁরা নিজেদের পুরোপুরি প্রকাশ করতে সংকোচ বোধ করেন।অথচ তাঁদের লেখা অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকের লেখার চেয়ে কম সুখপাঠ্য নয়।
বর্তমানে আর যা লিখি তা দৈনন্দিন সংসারের - লঙ্কা - লবণের জমা-খরচ।  এখানেও শরৎবাবুর উদ্ধৃতির লোভ সামলানো গেল না‌।  

"অভাব যখন দরজায় আসিয়া দাঁড়ায় সাহিত্য ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়।"
যাঁরা অল্পবিস্তর লিখেন তাঁরাও নিশ্চিত জানেন--- ভয় ও চাপ যখন আতঙ্ক ছড়ায়, তখন মুক্ত কলম মুক্তচিন্তা স্তব্ধ হয়ে যায়। লেখকের সৃষ্টিশীলতা রুদ্ধ করে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা।

লেখালেখি ও সাহিত্যবাসর থেকে বহুদূরে সরে এলেও ইদানীং প্রবীণ ও নবীন কয়েকজন সাহিত্যিক-সম্পাদক সাহিত্য-প্রেমী মানুষের   স্নেহানুকম্পায় মাঝে মধ্যে কিছু সাহিত্য আসরে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়।
অবশ্যই শ্রোতা হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েই মাওয়া। ইতঃপূর্বের সাহিত্যানুরাগী পাঠক পরিচিতির জন্যই হোক অথবা মঞ্চে চেয়ার খালি থাকলে পরিচিত লেখক-সাহিত্যিকরা কেউ কেউ ডেকে মঞ্চের দ্বিতীয় সারির খালি চেয়ারে বসতে টসতে বলেন। তাও সম্ভবত তাঁদের লেখা গল্প উপন্যাসের পাঠক হিসেবে মতামত বা পর্যালোচনা করানোর জন্য। এই রকমই কয়েকটি সাহিত্য মজলিশ-এ আহুত হয়ে গিয়েছিলাম সম্প্রতি।

শনি ঠাকুরের প্রসাদ খাওয়ার নেমন্তন্নের মতো এসব ব্যাপারে ডাক উপেক্ষা করা মানে শনির কোপদৃষ্টিতে পড়া অনিবার্য।
যাই অপেক্ষা করি, মহামহিম পণ্ডিতদের বাগবিস্তার উপভোগ করি। চা বিস্কিট প্রসাদ পাই।
বিতরণের লাইনে অনুরাগী কেউ থাকলে পাতে দুপিস আলুকচুরি বেশি তুলে দেয়। খেয়ে পেটে হাত মুছতে না মুছতেই অনেক সময় ডাক পাই
"শ্রী দ্বৈপায়ন মঞ্চে আসুন।"  
রবাহুত হয়ে গিয়েও দুএকবার মঞ্চে ডাক পড়েছে সাহিত্য সভায়।
কখনও বলার জন্য কখনও শুনে আলোচনা করার জন্য।
  মঞ্চে উঠেছি সসংকোচে। এতে প্রতিষ্ঠিত বক্তা ও সাহিত্যিকদের কেউ কেউ অনধিকার প্রবেশকারীর দিকে রোষানলে তাকালেও বেশীরভাগই বসতে টসতে বলেন। বসে বসে শুনি।  ভাল না লাগলে চলে আসি।যদিও জানি মাঝখান থেকে এভাবে উঠে যাওয়া অশোভন।  কিন্তু উপায় নেই।  ইনিয়ে বিনিয়ে নিজের কৃতিত্ব জাহির শুনলে  আমার অ্যালার্জি হয়। কাহাতক আত্মপ্রচারের সাতকাহন শোনা যায়।
যাদের বদান্যতায়  এবং সানুকম্প ভালোবাসায় বর্তমান সাহিত্য বাসরগুলিতে প্রবেশের ছাড়পত্র পাই তাঁদের নামগুলি সর্বস্তরে পরিচিত। এঁদের অনেকেরই রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে নামোল্লেখে বিরত থাকতে হচ্ছে। যদিও মানুষ হিসেবে এঁরা রাজনীতির খানিকটা ঊর্ধ্বে বলে মনে হয়। এমনই একজন মানুষ বিশিষ্ট উপন্যাসিক কথাশিল্পী শ্রী বিভূনাগেশ্বর। ইনার সম্পর্কে আমার কলম থেকে কিছু বেরোলে সেটা ভক্তিরসের মতো শোনাবে। কাজেই বিরত থাকলাম। তবে এইটুকু না বললে নয় তিনি স্নেহবশে লিখতে উৎসাহিত করেন সবসময়।
অন্য আর একজন ছিলেন যাঁর কাছে স্নেহ পেয়েছি, মর্যাদা পেয়েছি প্রশ্রয়ও পেয়েছি একদা। তিনি আমাদের রামকৃষ্ণ মিশনের সহকারী প্রধান শিক্ষক ব্যোমকেশ মাইতি। এখন আর তিনি নেই। তাঁর সম্পাদিত ক্ষীণাঙ্গী যে পত্রিকাটি একদা পাঠযোগ্য ছিল তিনি ছিলেন সেটির জনক। জন্মদাতার মৃত্যুর পর সেই পত্রিকাটি এখন সরস্বতীর কমল বনে উন্মত্তের প্রচারণায় দলিত মথিত। কাগজটি যদিও জেলার বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়, তবে সেটা এখন সাহিত্য-পত্রিকার চেয়ে রাজনীতি ও ধর্মপচারণার আয়ুধ হিসেবে বেশি পরিচিতি পাচ্ছে। তাতে সম্পাদক সহ-সম্পাদকের বাড়ির ছেলে মেয়েদের ছড়া ছাপানো হয়। গল্পের ছলে "উন্নয়নের"বার্তা ছাড়ানো হয়। বিভিন্ন লেখার উপর অচেনা ঠিকানার ছদ্মনামের পাঠকের প্রশংসা পত্র ছেপে বেড়ায় --- পাঠকের মতামত শিরোনামে।
যা বলছিলাম একজন পাঠক হিসেবে সাহিত্যের পাঠচক্রে উপস্থিত থেকে কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে। শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত থেকে কিছু শিক্ষাও হয়েছে।

এতদিন জানতাম সাহিত্যের মূল ধারা দু'টি।  

ধর্মযুক্ত ও ধর্মবিমুক্ত। ধর্মযুক্ত ধারাকে ধর্মাশ্রয়ী সাহিত্য ধারা ও বিমুক্ত ধারাটিকে বস্তুতান্ত্রিক বা পার্থিব মানবিক ধারার
সাহিত্য বলা চলে। এর মানে এই নয় যে ধর্মাশ্রয়ী সাহিত্যে মানবিকতা নেই। বরং এর মানে এই করা চলে যে ধর্মভিত্তিক মানবিকতার যে সাহিত্য সাধারণ্যে বেশি গ্রহণীয় হয়ে আছে তা অনেকটা পক্ষপাতদুষ্ট।

ভক্তের দৃষ্টিতে ভগবান যে  সাহিত্যের মূল রসায়ন, সে সাহিত্যের ক্ষীরে কিছুটা নীর থাকাটাই যেন স্বাভাবিক। এটা দোষের নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে শিল্পী অলঙ্কার  গড়তে  গিয়ে যেমন ২৪ ক্যারেট এর খাঁটি সোনাকে দু'আনা খাদ মিশিয়ে গিনিকরণ ঘটিয়ে সুন্দর অলঙ্কার গড়েন - এও যেন তাই। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে খাদের পরিমান এতো মাত্রাতিরিক্ত যে কোনটা সাহিত্য আর কোনটা স্তব স্তুতি বোঝা মুশকিল। এই ধরনের গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ নিবন্ধ থেকে ভক্তির নীরংত্যাক্তা সাহিত্যের  ক্ষীরং গ্রহণ করতে হলে আটমন সাহিত্যের দুধকে জ্বাল দিয়ে আধসেরে  নামাতে হয়। তবেই তাতে খানিক নিরপেক্ষ সাহিত্যের গন্ধ পাওয়া যায়। তথ্যের থেকে ভক্তি বেশি হয়ে উঠলে, ভক্তির প্রাবল্যে সাহিত্য রস তলিয়ে গিয়ে ফেনা এমন গেঁজিয়ে উঠে ওঠে যে সেই ফেনায় --- কথিত বৈষ্ণব পদাবলীর
"শান্তিপুর ডুবু ডুবু নৈদে ভেসে যায়" অবস্থা হয়।

কয়জনের প্রবল নির্বন্ধাতিশয্যে যোগ দিয়েছিলাম কয়েকটি সাহিত্য আলোচনায়।
বিষয়: বিদ্যাসাগর সমকালীন সাহিত্য ও সমাজ।
অসাধারণ আলঙ্কারিক প্রারম্ভের  দিশাহীন পরিসমাপ্তি দেখে চমৎকৃত হলাম।  ধর্মবিমুক্ত মানবতার মূর্তপ্রতীক বিদ্যাসাগরের কর্ম কৃতিত্বের ধারেকাছে না গিয়ে বক্তাদের বেশিরভাগই ঈশ্বরচন্দ্রের 'প্রথম ভাগ' 'দ্বিতীয় ভাগ'-এ সীমাবদ্ধ রইলেন।  বিদ্যাসাগরের কর্ম-কৃতিত্বের লঘুকরণে যাঁরা আদা জল খেয়ে নেমেছিলেন সেকালের সেইসব বাচস্পতি ও তর্কালঙ্কারদের ঢঙে অনেকেই বিদ্যাসাগর মশায়কে পরিমাপ করলেন তাঁর শিক্ষা বিস্তার স্কুল প্রতিষ্ঠা, শূদ্র ছাত্রদের বেদ ও সংস্কৃত পড়াশোনার অনুমতি দেওয়ার গড়িমসি নিয়ে।
বারংবার ঘুরে ঘুরে ফিরে এলো গোপাল অতি সুবোধ বালকের গল্প। উপেক্ষিত থেকে গেলো মানুষ বিদ্যাসাগরের ধর্মবিমুক্ত দর্শন চিন্তা।

কোন মানুষকে বিচার করতে হলে সর্বাগ্রে কালের কষ্টিপাথর প্রয়োজন। প্রয়োজন সেই মানুষ সমাজ বিকাশের কোন সময়ে  দাঁড়িয়ে কি  চিন্তা মানব কল্যাণে তিনি দিচ্ছেন। দর্শন সাহিত্য বিচার করার এটাই বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতি।  বিদ্যাসাগর যে সময়ে এসেছিলেন সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ক্ষয়িষ্ণু রূপ ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ক্রমবিকাশের সেই সন্ধিক্ষণে ভারতের ধর্মভিত্তিক অন্ধকার সমাজের সামনে দাঁড়িয়ে সনাতন ধর্মীয় ব্যবস্থার অনুশাসন অগ্রাহ্য করে নারী শিক্ষা, নারী জাগরণ ও বিধবা বিবাহ প্রচলনের মতো বৈপ্লবিক বিজ্ঞান মনস্ক সমাজ ভাবনা এবং সেসব ভাবনাকে পুঁথি পুস্তকের মধ্য দিয়ে অন্যের মধ্যে প্রোথিত করার দুঃসাহসিক বুকের পাটা আর কার ছিল - বক্তাদের কেউ সেটার উল্লেখ মাত্র করলেন না। বরং তৎকালীন ব্রাহ্মণ্য সমাজের মনঃস্তরে পিছিয়ে থাকা সমাজ প্রতিভূদের মতো যারা কিনা বিদ্যা সাগরকে উপহাস করে বলেছিল---
"সবাই যদি বিধবা বিয়ে করে তবে এদেশের কুমারী মেয়েরা আইবুড়ো থেকে যাবে।"
এটি যিনি বেশি করে বলেছিলেন তিনি সর্বজনপূজ্য একজন ভূবন বিখ্যাত মানুষ।

বিদ্যাসাগর মূল্যায়নে সেদিনের বিরোধী বাচস্পতিদের সঙ্গে এখনকার বক্তাদের একাসনে দেখতে পাই।

রোমা রোলাঁ, পুশকিন, ম্যাক্সিম গোর্কি, মহাত্মা গান্ধী, এমনকি স্বয়ং গুরুদেবের লেখায় যখন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ  হয় যে, বাংলার নব জাগরণের ধর্মবিমুক্ত মানবতা বা পার্থিব মানবিক ধারার শ্রেষ্ঠতম সেনাপতি একমাত্র বিদ্যাসাগর তখন তাঁর মতো মানুষকে ধর্মের নিগড়ে বেঁধে তাঁর মূল্যায়ন সম্ভব নয়।
অবশ্য গলায় যজ্ঞসূত্র, কাঁধে উত্তরীয়, পরিধানে ধুতি ও টিকিধারী দৃশ্যত নিষ্ঠাবান গোঁড়া ব্রাহ্মণ বীরসিংহের এই বন্দ্যোপাধ্যায় তনয়। বহিরাবরণের আড়ালে সে যুগের উৎকৃষ্ট আলোকিত আধুনিক মননের আধার ছিলেন তিনি।
দুই শ বছর আগে তাঁর মননস্তর যে সেযুগের আর্থসামাজিক বাস্তবের চেয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে ছিল তিনি এ নিয়ে আজ আর দ্বিমত নেই।