টরন্টো, জুলাই ২৭, ২০২২, নভো সংখ্যা ৩
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য সংবাদ ভ্রমণ কাহিনি বিশেষ নিবন্ধ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি যোগাযোগ

কার্তিকের কুয়াশা

গুহার অন্দরে ইতিহাস প্রান্তরে...

- অরুণোদয় কুণ্ডু

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


অউরঙ্গাবাদ কেভ

বাবাসাহেব আম্বেদকরের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ডিঙিয়ে যেতে হয় গুহার পাদদেশে। অটোই সম্বল, অবশ্য পায়ের জোর থাকলে ইউনিভারসিটি গেট থেকে মাইল খানেক হাঁটা, গেট অব্ধি সাধারন ভাড়ায় অটো পাওয়া সম্ভব। কিন্তু সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে শুধু পৌঁছলেই হল না সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হবে প্রায় গোটা পাহাড়টা। গুহা থেকে গুহায় ঘুরে ঘুরে আসতে হবে নিচে তার পর পরবর্তী জায়গা। বেশিরভাগ লোক এর পর চলে যান বিবি কা মকবারায়। পাহাড়ের উপরে গুহার চত্ত্বর থেকেই মকবারা দেখা যায় শহরের আরো দেশলাই বাক্সের আকারের বাড়িঘরের মাঝখানে। রাস্তায় দুরত্ব ২ কিমি। উতরাইয়ে এ পথ অনায়াসেই হেঁটে যাওয়া সম্ভব, সবুজের বিথি পথ, সাথে পাহাড় হাঁটতে ভালই লাগবে। কিন্তু হাতে সময় থাকা দরকার। এক দিনেই সব দেখব মানসিকতার আধুনিক সেল্ফির ব্যাকগ্রাউন্ড খুঁজে বেড়ানো টুরিস্টরা এ পথে না হাঁটলেই ভাল করবেন। আপনাদের জন্য এখানকার সুযোগ সন্ধানী অটো আর ট্যাক্সি ওয়ালা রয়েছেন তাদের আকর্ষনীয় “অফার” নিয়ে, সারাদিনে সব পয়েন্ট করিয়ে পৌঁছে দেবে হোটেলের দোরগোড়ায়। তাতে পকেট তো ফাঁকা হবেই, ক্যামেরার স্ক্রিন ছেড়ে চোখে দেখার সময় হবে না। তবে এসব ব্যাপার আপনি বুঝতেও পারবেন না। মনে হবে খুব সস্তায় হয়ে গেল ওই অটো বা ট্যাক্সি ওয়ালার দৌলতে। একেই বলে মার্কেটিং। যাহোগ, প্রসঙ্গতে ফিরি। পাহাড়ের শুরুতেই একটি বৌদ্ধ কায়দায় তোরন তার পরে গুহায় ওঠার সিঁড়ি শুরু হচ্ছে। দুপাশে হালে বানানো অসংখ্য বুদ্ধ মূর্তি। মূর্তি গুলো শেষ হলে তাদের জায়গা নেয় জঙ্গল। উঠতে উঠতে যদি হাঁপ ধরে তো একটু দাঁড়িয়ে পিছন ফিরলে পুরো শহরটাকে দেখা যায়। উচ্চতা বাড়তে বাড়তে দেখার পরিধি বাড়ে, বাড়ে সৌন্দর্য। এই করতে করতে একসময় গুহার কাছে পৌঁছে যায় পা। যদি কেউ এই জায়গার স্থাপত্যের ব্যাঞ্জনা, ঐতিহাসিক গুরুত্ব নাও বোঝে তাও সে প্রকৃতির মনোরম শোভার টানে আসতেই পারে। অবশ্য গাইডবুক বা ওয়েবসাইট বলছে উঁচু থেকে শহরের শোভা আর পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখার জন্য যেতে হবে “গোগা বাবা হিল” যেটা কিনা গুহার পাহাড়টার পাশের পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় এক মন্দির আছে। কেভ থেকে নেমে মকবারা যাবার পথের ডানদিকে পরে এই পাহাড় চাইলে চড়ে দেখে আসা যেতে পারে, তবে আমার মনে হয় কেভ এর চত্ত্বর আর গোগা বাবার মাথা থেকে শহরের দৃশ্য প্রায় এক রকমই হবে। তাই আমরা কেভ থেকে সোজা মকবারা যাবার মনস্থ করলাম।

অউরংগাবাদ গুহা এলাকায় মোট গুহার সংখ্যা ১২। অবস্থান অনুযায়ী তিনটি অংশে ভাগ করা যায়। প্রথম ১-৫ নং তার প্রায় আধা কিমি পূর্বে ৬-৯ নং আর আরো কিছুটা পূর্বে গেলে ৯-১২। নম্বরগুলো অবশ্য “আরকিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া”র দেওয়া বোঝার সুবিধার্থে। এমনি নম্বর অজন্তা, ইলোরার গুহা গুলিতেও দেখা যাবে। গুহাগুলো খোঁড়া হয়েছে দ্বিতীয় থেকে সপ্তম শতাব্দীর বিভিন্ন সময়। পল্লবদের রাজধানী প্রতিশথান (পৈঠান) এবং অউরঙ্গাবাদ নিকটবর্তী তৎকালীন বাণিজ্য পথের কাছে থাকতেই এই গুহাগুলির সৃস্টি। সমস্ত গুহাই বৌদ্ধ স্থাপত্যে ভরা। হীনযান, মহাযান দুই যুগের স্থাপত্যই পাওয়া যায়। পাওয়া যায় বৌদ্ধমতের সাথে তন্ত্রমত মিশ্রিত বজ্রযান বৌদ্ধদের স্থাপত্যকলাও। তবে এখানের বেশিরভাগ গুহাই অসম্পূর্ণ। সেটা রাজনৈতিক কারনেও হতে পারে। হতে পারে কারন এর চারিদিকে সে সময়কার সব রাজারাই ছিল হিন্দু রাজা যদিও এই দুই ধর্মের মধ্য সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণই ছিল। তাই অনেকেই রাজনৈতিক এর থেকে প্রাকৃতিক কারনকেই বেশি দায়ী করেন। কারন এই পাহাড়ের মধ্য অনেক জায়গাতেই আলগা পাথর রয়েছে যা গুহা খননের অন্তরায়। আর যেটুকুওবা ছিল তার জন্য তো ওউরঙ্গজেবই যথেষ্ট ছিলেন। মকবারার থেকে হাঁটা দূরত্বে থাকা বিধর্মী স্থাপত্যের তো পোড়া কপাল হবেই। তবুও যা রয়ে গেছে তা বিস্ময় জাগায়।
প্রথম আর তৃতীয় গুহা সব থেকে প্রাচীন। প্রথম গুহার উপরের দিকে দেওয়াল দেখে মনে হয় সেখানে বারান্দা জাতীয় কিছু ছিল যা ভেঙে পড়েছে। ভিতরের খননও অসম্পূর্ণ। খালি বাইরের থামগুলোয় কিছু কারুকাজ রয়েছে।
তৃতীয় গুহাটি একটি চৈত্য গৃহ যার ভিতরে রয়েছে একটি স্তুপ। যদিও আকারে ছোট। বাইরের দেওয়ালে সপার্ষদ বুদ্ধ মূর্তি। কিছুটা ভাঙা হলেও নৈপুণ্য চোখে পড়ে। এই স্তুপটিই হীনযান যুগের পরিচয় দেয়।
দ্বিতীয় গুহাটি প্রথম অংশের গুহাগুলির মধ্য সবচেয়ে জমকালো। এটি একটি বৌদ্ধ বিহার। বুদ্ধদেবকে মূল বিগ্রহের স্থানে ব্যাখ্যান মুদ্রায়(শিক্ষাদান মুদ্রা) একটি আসনের উপর পা নামিয়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। মূল বিগ্রহের ঘরের দরজার দুপাশে পদ্মপানি(পদ্ম হাতে বুদ্ধের রূপ) আর বজ্রপাণির (বজ্র হাতে বুদ্ধের রূপ) মূর্তি। পদক্ষিনের ব্যাবস্থা আছে। দুধারের দেওয়ালে অসংখ্য ছোট মূর্তি। অধিকাংশই ক্ষয় প্রাপ্ত, সহজে বোঝা যায়না। তবে বুদ্ধেরই বিভিন্ন অবস্থা, মুদ্রা এবং জাতকের বিভিন্ন ঘটনা উৎকীর্ণ করা আছে। গর্ভগৃহের পরে থাম সম্বলিত দালান আর দালানের চার পাশে ছোট ছোট ঘর, যতদুর মনে হয় ধ্যানের ঘর। থাম গুলোয় খুব সুন্দর সুক্ষ কারুকাজ।
চতুর্থ ও পঞ্চম গুহাও বৌদ্ধ বিহার তবে অনেকটা সাদামাটা, গুহার দেওয়ালে জায়গায় জায়গায় সাদা পলেস্তারার মত দেখা যায়। এ থেকে বোঝা যায় এগুলো আগে রঙ করা ছিল, হতে পারে কোন বিস্মৃত অতীতে জায়গাটাকে অজন্তার মত ছবির ডালি দিয়ে সাজিয়ে তুলেছিল কোন নাম না জানা শিল্পী।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশের গুহার মধ্য সাত নং গুহা সবচেয়ে বেশি কারুমন্ডিত। বাকি গুহাগুলি অসম্পূর্ণ। সপ্তম গুহাটিই সমস্ত গুহাগুলির মধ্য শ্রেষ্ঠ ধরা হয়। এটি বজ্রযান আমলে তৈরি। তাই নারীমূর্তি আছে। আছে বৌদ্ধ দেবী তারার মূর্তি। হিন্দু তন্ত্রের সপ্তমাতৃকার দ্বারা প্রভাবিত সপ্ত বাদিনীর মূর্তি। আছে অবলোকিতেশ্বর যা পরবর্তী সময়ে পদ্মপাণির পরিচয়। এছাড়াও আছে জানা অজানা অসংখ্য কারুকার্য। দেখে আশ মেটে না। নিজদের অতীত গৌরবে গৌরবান্বিত হই আবার। মাঝে মাঝেই অই ওউরঙ্গজেবটাকে গালাগাল করি মনে মনে। এমনি করে বুদ্ধ গুহার অধ্যায় সমাপ্ত হয়।মনে মনে ভাবি এই দেখেই এমনি ভাল লাগছে তো ইলোরা দেখে কি অবস্থা হবে। এই সব ভাবতে ভাবতেই চলতে থাকি মকবারার উদ্দেশ্যে।

 

লেখকঃ অরুণোদয় কুণ্ডু
মোবাইলঃ 9830580357
ঠিকানাঃ 17/7/4 নরসিংহ দত্ত রোড, কদমতলা, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, পিন – 711101।
17/7/4 Narasingha Dutta Road, kadamtala, Howrah, West Bengal, India, pin-711101.