রত্না চক্রবর্তী
২০.৪.২২
সুচিত্রা আর তনুজা দুজনে রোজকার মত গাছটার তলায় রাখা তক্তার বেঞ্চটার
উপর এসে ধপ করে বসে পড়লেন। সাজসজ্জায় মধ্যবয়সী হলেও এনাদের প্রৌঢ়া বলা
যেতে পারে। এই দুজন মহিলা তাদের নাতি নাতনিকে রোজ স্কুল থেকে নিতে আসেন ।
ওখানেই দুজনের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তাছাড়া আপনারা একই পাড়ার
লোক। এই দিম্মা থাম্মি গ্রুপে আরো কজন আছেন আজ এখনো এসে পৌঁছায় নি।
অবশ্য তাদের নাতি নাতনিদের এখনো ছুটির ঢের দেরি আছে। এনারা আগেই আসেন,
ছেলে-বৌ, মেয়ে-জামাই যে যার অফিস স্কুলে চলে গেছে। রান্নার লোক, কাজের লোক
কাজ সেরে চলে গেছে, একা একা ভাল্লাগে না। সিরিয়াল দেখেন সন্ধ্যেবেলাটা , এই
সময়টা সমবয়সী মানুষের সাথে দুটো মনের কথা বললে প্রাণটা জুড়ায়। আর সবাই কোন
না কোন কাজে আটকে থাকে তাই ছুটির মুখোমুখি আসে। এখন লোয়ার নার্সারি আর আপার
নার্সারির ছুটির সময়। বসেই দুজনে গল্প জুড়ল, সুচিত্রা বলল, " এই কাল কেমন
কারেন্ট গেল বল? আমি তো ভাবলাম গেল 'সাতপাকে ' টা আর দেখা হবে না বুঝি,
সিরিয়ালটা ভালো হচ্ছে, কাল তো ষড়যন্ত্রটা ফাঁস হবার কথা ছিল। কি ভাগ্যি
কারেন্ট ঠিক টাইমেই চলে এল।"
তনুজা বলল হাসতে হাসতে " কালও তো দেখালো না ষড়যন্ত্র ফাঁসটা হওয়া ... উলটে
আরো সাসপেন্স বাড়াচ্ছে। আমার ছেলেটা এত্ত শয়তান বলে মা তুমি এত উত্তেজিত
হয়ে পড় সিরিয়াল দেখে কোনদিন স্ট্রোক হয়ে যাবে...! "
দুজনেই হাসতে লাগল, বলল " যাই বল সিরিয়ালগুলোয় টানটান উত্তেজনা।
দুটি আধুনিকা অল্পবয়সী তরুণী দুটো বাচ্চা হাতে বেরিয়ে এল গেট দিয়ে। একটি বড়
একটি একটু ছোট। এক পথচারী প্রৌঢ় বললেন, " আরে তোরা কত্ত বড় হয়ে গিয়েছিস,
নাত নাতনিরাই কত্ত বড় হয়ে গেল। কি মিষ্টি হয়েছে, মুখ দেখে মনে হয় খুব
বুদ্ধি। "
মেয়েদুটি মানে মা দুটি বিগলিত হেসে বলল, " জানো না কাকু পাজির পা ঝাড়া। সব
পারে সব জানে, বাইরে বলবে কিন্তু ক্লাসে ম্যামকে বলবে না। আজ তো পড়া বলেই
নি, অথচ মুখস্থ। "
বাচ্চার উদ্দেশ্যে বলল, " যশ শুনিয়ে দাও দাদাইকে 'পিটার পিটার'টা..."
ছেলে পালাবার উদ্যোগ নিতেই মা খপ করে হাতটা ধরে বলল, " না বললে কিন্তু
চিপসের প্যাকেট পেলে না। "
ছেলে থমকে দাঁড়ালো দরকষাকষির সুরে বলল, "ঠিক দেবে তো? খুচরো নেই বলবে না?
"
মা বলল, "হ্যাঁ দেবো, প্রমিস...তুমি দাদাইকে বলে দাও .. " ভদ্রলোক তখন
হাসছেন। সে বলতে শুরু করল শুরু করল কচি গলায়, "পিতার পিতার পামতিন ইতার,...
" কচি গলা মধু গলে পড়ছে।
দাদাই বললেন, " অপূর্ব খুব সুন্দর বলেছ। একটা ক্যাডবেরি পাওনা হল যে! "
অমনি যশ ঘাড় নেড়ে বলল, " তিতাসও খুব ভালো ছড়া বলে। সব জায়গায় বলে, নেচে
নেচে বলে । "
দাদাই বললেন, "তাই নাকি দিদিভাই তুমি কি বলবে একটু শুনি। "
তিতাসের মার মুখখানা আহ্লাদে আলোকিত হয়ে উঠল বলল, " তিতাস তোমার কথা বল
দাদুকে, কোনটা বলবে চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে বলবে? ওটা বলবে না? কোনটা বলবে
বলো? বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর..."
তিতাস ঘুষ দিতে হলো না সে খুব স্মার্টলি ঘাড় নেড়ে নেড়ে মুখ ঘুরিয়ে "
ইরা ইরা ইরানি " বলে ছড়াটা বলতে শুরু করে দিল পরিষ্কার উচ্চারণ, মুখের
ভঙ্গি ও খুব সুন্দর বোঝা যায় বোধহয় এর আবৃত্তি করা বা কবিতা বলা অভ্যাস
আছে।
মা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন, দাদুও খুব হাসলেন। বললেন, " চমৎকার হয়েছে...
সত্যি এখনকার ছেলেমেয়েরা কত কি জানে...কত ব্রিলিয়ান্ট তোরা মানুষের মত
মানুষ করছিস ছেলেমেয়েদের। খুব ভালো লাগে।"
দুজনেই বলল , " একস্ট্রা কিছু করাতে পারি কই কাকু? ওদের যা পড়ার চাপ।
সামলাতেই হিমসিম খেয়ে যাই।"
ঘাড় নেড়ে হেসে বললেন, " এই তো সেদিন তোরা দুজনে বেণী দুলিয়ে ঘুরে বেড়াতিস।
তারা এর মধ্যে এত বড় হয়ে গেলি, কত দায়িত্বশীল মা হয়েছিস। আমরা বুড়ো হয়ে
গেলাম আমরা বল? " বলে হা হা করে হাসতে লাগলেন। তারপর সামনের দোকান থেকে
দুটো ক্যাডবেরি কিনে এনে দুজনের হাতে দিলেন। মায়েরা আহ্লাদে গদগদ হয়ে
বাড়ির দিকে রওনা দিলো। "দাদু টাটা,... দাদাই টাটা বাই বাই আবার যেন দেখা
পাই" বলতে বলতে মায়েদের হাত ধরে লাফাতে লাফাতে বাড়ির দিকে চলল।
চুপচাপ দেখেশুনে সুচিত্রা মুখ বাঁকিয়ে হেসে বললেন," এখনকার যুগে আদিখ্যেতা
দেখি আর ভাবি আমাদের সময় এ রকম ছিল না ভাই। বাবারে বাবা! নার্সারিতে পড়ে
বাচ্চা, তাই নিয়ে ঢং দেখ, মনে হয় যেন কি এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়েছে। বাপরে
বাপ আমাদের সময় এগুলো করলে নিন্দেয় কান পাতা যেত না। "
তনুজা বললেন, " আরে বাবা আজকাল তো ছোটবাচ্চা আছে এমন বাড়িতে গেলেই ভয় হয়,
এক্ষুণি ধরে ছেলেমেয়ের গুণপনা শোনাতে বসবে। নয় নাচ দেখাবে, নয় গান শোনাবে,
এমন কি কথা ফোটে নি এমন বাচ্চাকেও বলবে 'হেড দেখাও হেড, আই দেখাও আই, লেগ
কই দেখিয়ে দাও সোনা... "
বলতে বলতে দুজনে হেসে কুটিকুটি হতে লাগলো। সুচিত্রার বিষম খেল। তনুজা ব্যাগ
থেকে জলের বোতলটা বার করে এগিয়ে দিল। ঢক ঢক করে জল খেয়ে রুমাল দিয়ে মুছে
সুচিত্রা তনুজাকে বললো, " এই দেখো তোমাকে বলতে ভুলেই গেছি, কাল বুতুনের
'ভাবী নাম্বার ওয়ান'এর প্রোগ্রামটা আবার দেখাবে। আমাদের দলের যারা মিস
করেছে তারা দেখতে পাবে। মনে করিয়ে দিও ওরা এলে বলতে হবে। তুমি তো দেখেছ,
বুতুনকে কি লাগছিল বল! আসলে ওর তো বরাবরই ডিবেট এটেন্ড করে করে স্টেজ
নার্ভাসনেস একদম নেই। যত পার্টিশিপেন্ট ছিল ওর মতো স্মার্ট কেউ ছিল না, বল?
"
তনুজা হাসি মুখে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন," সেটা খাঁটি কথা বলেছ ।" তারপর
ব্যাগ খুলে একটা রোল করা ম্যাগাজিন করে বললেন, "এই দেখো তোমায় বলেছিলাম
চাঁদনীর লেখাটা বেরিয়েছে। দেখো চেষ্টা করলে ও কিনা করতে পারে, কিন্তু
কিছুতেই কোথাও লেখা পাঠাবে না। আমিই তো জোর করে পাঠাই। এটা তো বেশ নামকরা
পত্রিকা। লেখাটা দেখো কেমন বেরিয়েছে, তোমাকেই দেখাচ্ছি, সবাইকে বলি না
সবার বোঝার মত ক্ষমতা নেই। তুমি একটু লেখা-টেখা ভালোবাসো, এসব দিকে একটা
ন্যাক আছে, রুচিটা আলাদা তাই জন্যেই বলা। এরা সবাই তো বোঝে না। তাছাড়া
হিংসে আছে। আসলে চাঁদনির জুটি মেয়ে তো ওদেরও তিনজনের আছে, চাঁদনির উন্নতি,
সুনামটা নিতে পারে না। "
মুগ্ধ হলেন সুচিত্রা তার নিজের সাহিত্য জ্ঞান সম্পর্কে বান্ধবীর মুখে
প্রশংসা শুনে। তিনি যে হিংসুটে নন এটা জেনেও আনন্দ পেলেন। আগ্রহভাবে নিয়ে
লেখাটা খুলে দেখতে লাগলেন। চাঁদনির নামটার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন তনুজা
আলো আলো মুখে।
দলের অন্য বান্ধবীরা তখন একে একে আসতে শুরু করেছে। তারা বলল," কিগো দুই
বন্ধু মিলে এত কি দেখা হচ্ছে? কত্তার ছবি? ও পত্রিকা! আনন্দলোক নাকি?
হাসতে হাসতে সুচিত্রা বললো, ওমা জানো না ওই " চব্বিশ পঁচিশ" পত্রিকায় একটা
লেখা বেরিয়েছে চাঁদনীর। সেটাই দেখাচ্ছিল তনুজা। "
ওর বলল, " তাই নাকি " এই বলে একে একে হাতে নিয়ে দেখল কিন্তু তেমন আগ্রহ
কারো নেই. বলল, " হ্যাঁ বেশ ভালো লাগে বল। এই কি সেল দিচ্ছে দেখছো, আসার
সময় দেখলাম আমাদের ছোট বাজারের দোকানগুলোতেও সেল দিচ্ছে। এই চল একদিন দল
বেঁধে গড়িয়াহাট যাই, কি ভালো লাগে সেল দেখতে... "
তারা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। সুচিত্রা আর তনুজা গোপনে চোখ তাকাতাকি করলেন৷
পিছিয়ে এসে খুব চাপা গলায় বললেন, " আনকালচারড, এসবের মর্ম বোঝে না। "
ঘণ্টা বাজল ছুটি হল। নাতি নাতনি, ছেলে মেয়ে নিয়ে যে যার বাড়ির পথে রওনা হল।
গল্প খুঁজে পাই
রত্না চক্রবর্তী
৮.৪.২২
গল্প খুঁজে বেড়ানোটা আমার একটা নেশা এটা আমার বহুদিনের নেশা আমি
যেখানে যাই সেখানে থেকে গল্প খুঁজে পেতে চাই।
আমি রেলস্টেশনে গিয়েছি সেখানে বসে থাকতে থাকতে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা
করতে করতে অনেক গল্প শুনেছি। আমি চোখ দেখাতে হাসপাতালে গেছি দিনের পর
দিন সেখানে কত যে গল্প আমার ঝুলিতে জমা হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না।
আপাতত আমি নাতিকে স্কুল দিতে যাই আর নিয়ে আসি। এই যাওয়ার পথে আমি যে
কতগুলো গল্প কুড়িয়ে পেয়েছি তা আপনাদের বলে বোঝাতে পারবো না। আজ তারই
একটা ছোট মজার ঘটনা বলি
আমাদেরই পাড়ার এক দাদা আছেন। আমি ছোটবেলায় মানে যখন বছর সাতেকের ছিলাম
তার সাথে বেশ কথটথা বলতাম। দাদা বছর সাতেকের বড় ছিলেন। বড় দাদার মতো
খুব দুষ্টু দুষ্টু পিছনে লাগতেন। মজা করার মতো আর কি! এই পিছন থেকে টুক
করে চুল টেনে দেওয়া । মেয়ে পুতুল লুকিয়ে দিয়ে বলা যে আমার মেয়ে
শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। আমি খুব রেগে যেতাম । আমার ডাক নাম বিকৃত করে তাই
নিয়ে মজা করা, কালীপূজোয় শব্দ বাজি ফাটয়ে ভয় দেখানো, এইসব আর কি।
তারপর আমরা বড় হতে থাকলাম সাত থেকে চোদ্দ হয়ে বদলে গেলাম আর দাদা চোদ্দ
থেকে একুশ হয়ে বদলে বিদেশে পাড়ি দিলেন। দেখা, কথাবার্তা আর হত না কোন
এক অলিখিত কারণে।
তারপর দিন গড়াল আমি সংসারে নাজেহাল মাঝবয়েসী নারী আর উনি প্রতিষ্ঠিত
চাকুরে, বেশ ব্যক্তিত্বময় চেহারা হয়েছে।
কিন্তু দেখা হলে কখনো মাথা ঝাঁকিয়ে পরিচিতির স্বীকৃতি বা হাসিমুখে ঘাড়
নাড়া এই অবধি। দুর্গাপূজার সময় বা পাড়ার কোন ফাংশন টাংশন হলে তাও
দু-চার কথা হতো। আমি ততদিনে সংসার যুদ্ধে হেরে যাওয়া সৈনিক হয়ে খুব
ঈশ্বর ভক্ত হয়ে পড়েছি। অবলম্বন করার মত কোন আশ্রয় না পেয়ে আঁকড়ে
ধরেছি ঈশ্বরকেই। পূজোর কাজ করতে বেশ ভালো লাগে। পূজোর আনন্দ সবাই করে
কিন্তু ঠিক মন্ডপে কাজ করার মতো লোক পাওয়া যায় না।
পূজোর ছুটিতে সবারই একটু মন ভালো থাকে। দীর্ঘদিন অফিস ছুটি থাকে,
বেরোতে হয় না। বন্ধুবান্ধব আড্ডাবাজি ভালই চলে। মুড তাই খুবই ভালো
থাকে। সবাইকে মোড়ের মাথায় দেখা যায়। তিনি তখন আবার সেই ছোটবেলার মতো
একটু সংযত ভাবে আমার পিছনে লাগেন। উচ্চস্বরে হাঁক পেড়ে বলেন, " হাঁরে
তুই তো গিন্নিবান্নি হয়ে গেলি , একেবারে সাত বুড়ির এক বুড়ি হয়ে
গেছিস। হ্যাঁ এত পূজো আচ্ছার বাতিক এই বয়সে! সন্ন্যাসিনী হয়ে যাবি
শেষে? "
আবার পরের বছর দেখা হলে বলতেন, " কিরে তোর আজ আর বারবেত্ত নেই? মেয়ে
নিয়ে ফুচকা খাচ্ছিস যে ? তোর ধম্মকম্ম সব গেল তো রে?"
এই পূজো নিয়েই হাসাহাসি করতেন প্রতিবারই যখন দেখা হতো। উনি আমার বাবার
কাছে ক্লাবের কি একটা দরকারে এসেছেন, আমি বাথরুমে স্নান শেষ করে
বেরিয়েই খেয়ে ইস্কুলে যাব। সময় কম তাই আমি রোজই স্নানসেরেই দ্রুত
আদ্যাস্তোত্র বলতে শুরু করি। সময় কম তারই মধ্যে এই পরিছন্ন বোধটুকু
নিয়ে যতটুকু বলা যায় আর কি!
উনি বাবার সঙ্গে কাজ মিটিয়ে হয়ে যাবার আগে আমায় হাসিমুখে বললেন, "
আস্তে আস্তে, ধীরে ধীরে...এ হে কি যে বলিস ... ঠাকুর তো একটা উচ্চারণও
বুঝতে পারবে না, ভাববে গালাগালি দেওয়া হচ্ছে...! "
সবাই হাসছে, আমিও। এখন আর রাগ হতো না স্নেহটা উপলব্ধি করতাম, তার সাথে
একটু লজ্জা লজ্জাও হতো।
তারপরও দিন কেটে গেছে। মাঝে বেশ কিছু বছর উনি কোথায় গিয়েছিলেন,এখানে
বোধহয় ছিলেন না। আমার খেয়াল করার মত মনও ছিলোনা। উড়ে এসে কানে কথাটা
গিয়েছিল বটে সুরাট না কোথায় যেন আছেন। তারপর জানি না আমি জীবনের পথে
এগিয়ে চলেছি, উনিও জীবনের পথে এগিয়ে গেছেন।
অনেকদিন বাদে দেখা হল। আমি জীবনে এখন একটু স্থিতু হয়ে গেছি। দেখা গেল
দাদার মাথায় সেই ঘন চুলের বদলে একটা চকচকে টাক। ভূঁড়ি বেশ বড় হয়ে
গেছে। এখন আমি নাতিকে স্কুলে দিতে যাই ওই সময় উনিও ওখান দিয়ে ফেরেন
কোথাও থেকে। পুরনো জায়গাতেই আছেন শুধু ঠাকুরদার আমলের বাড়ি ভেঙে
ফ্ল্যাট করিয়েছেন। আমার আর জিজ্ঞেস করা হয়নি, দাঁড়িয়ে কখনো কথা
হয়নি। সেদিন ফিরছি পায়ের ব্যথায় হাঁটতে পারছি না, ধীরে ধীরে চলছি।
উনি কথা বলতে বলতে চললেন। ছেলে কানাডায় আছে, স্ত্রী খুবই অসুস্থ, ওনার
হাই সুগার, সকালে হাঁটতে বার হন। ভালো লাগছিল, ছেলেবেলার টুকটাক মজার
কথা পাড়ার পুরনো কথা হচ্ছিল।
পথে প্রথমে একটা শনি ঠাকুরের মন্দির পড়ল, আমি আমার স্বভাব অনুযায়ী
মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে জোড় হাত করে কপালে ঠেকালাম তারপরে হাঁটতে
যাবার আগেই খেয়াল করলাম দাদা তখন মাথাটা একটু ঝুকিয়ে শরীরটা সামনে
ঝুঁকিয়ে বুকের মধ্যে ডান হাতটা চেপে ধরে বিড়বিড় করে কিছু বলছে। ভালো
লাগলো বুড়ো বয়সে একটু ভক্তি রয়েছে দেখে। আমি একটু দাঁড়ালাম তারপর
আবার একসাথে দুজনে চলতে শুরু করলাম।
দাদা বলছিলেন দাদার মেয়েও চেন্নাই থাকে, জামাইয়ের ভীষণ টানের ধাত
চিন্তায় আছেন, মেয়ের আবার বাচ্চাকাচ্চা হবে। সেই নিয়ে তিনি খুব
চিন্তায় আছেন।বৌদি মেয়ের কাছেই থাকেন বেশীর ভাগ এই বলতে বলতে তিনি
আবার থামলেন।পাশে একটা অশ্বত্থ গাছের তলায় অনেকগুলো সিঁদুর লাগানো
নুড়ি আর শীতলমায়ের পূজো আগের বছরের রঙচটা মূর্তি আছে, সাথে আরো কটা
মূর্তি ওই কেউ কিনে এনে পূজো করতে না পারলে নামিয়ে দিয়ে যায়, আমাদের
এখানে শীতলা বিসর্জন দেওয়া হয় না , গাছের তলায় নামিয়ে দিয়ে যায়।
আমি এখানে দাঁড়াই না চলতেই কখনো চোখ পড়লে কপালে হাত ঠেকিয়ে নিই, দাদা
দখি সেখানে দাঁড়িয়ে হাত জোর করে অনেকক্ষণ ধরে কিছু বললেন।
এবার আমার একটু অবাক লাগল সেই ভট্টচার্জি মশাইয়ের সাথে মজার মুখ করে
তর্ক করতে থাকা মানুষটার এই বিশাল পরিবর্তনে। আবার আমরা চলতে শুরু
করেছি, এখন আমরা এই হোয়াটসঅ্যাপে বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের সাথে
যোগাযোগের সুবিধে নিয়ে জমিয়ে গল্প করছি। এমন সময় হঠাৎ দেখি দাদা
নিশ্চুপ! আমি বকবক করেই চলেছি।
একটু দূরেই আমাদের পাড়ায় একটা খুব সুন্দর কালী মন্দির আছে। সেটা দেখা
যাচ্ছে পুকুরের পাশ দিয়ে। আমি পিছনে তাকিয়ে দেখলাম কালীমন্দিরটা দেখে
দাদা চলার গতি শ্লথ করে দিয়ে সেখান থেকে কিছু প্রার্থনা করতে করতে
চলেছেন। মিনিট চারেকের পথ ওইভাবেই চলে তিনি মস্ত গেট খুলে মন্দিরে ঢুকে
সিঁড়িতে মাথা ছোঁয়ালেন। আমি এই মন্দিরে
প্রায়ই আসি। আমিও হাত জোর করে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করলাম। একটু বাদে
অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। দাদা আর ওঠেই না!
বেশ খানিক বাদে তিনি দাঁড়িয়ে ডান হাতের তর্জনীটি দ্রুত একবার বুকে
একবার কপালে ঠেকাতে লাগলেন, মৃদু গলার একবার বোধহয় 'বাবাই' কথাটা কানে
এল। ওনার ছেলে। উনি বোধহয় পরিবারের প্রত্যেকের নাম করে করে ওই ভাবে
মঙ্গলকামনা করছিলেন।
অনেকক্ষণ বাদে আবার চলার শুরু। দাদা বললেন, "ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি সব
বাইরে থাকে তো, সারাক্ষণ একটা টেনশনে থাকি বুঝেছিস। ভগবানের দয়ায় সব
ভালো থাকলেই ভালো। "
আমার বাড়ির মোড় এসে গেল। আমি, " আসি দাদা "বলে ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।
সময় অনেকটাই চলে গেছে। দাদা ভুলেই গেছেন, আমার সেই পূজো করা আর দাদার
সেই নিয়ে মজা ঠাট্টা করা, কিন্তু আমি ভুলিনি। একটা মানুষের জীবনে এত
পরিবর্তন হয় কি করে এটাই বিষ্ময়! এতটাই পরিবর্তন যে আমার যেন একটু
নর্মালিটির অভাব বোধ হল। আসলে ভয়, অনিশ্চয়তা, অবলম্বনের অভাবে আমি সেই
সময় যেভাবে একটা বিশ্বাসকে আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম, আজ দাদাও সব থাকা
সত্ত্বেও বোধহয় সেই জায়গায়এসে দাঁড়িয়েছেন। দিনগুলো মনে পড়ে হাসিও
পাচ্ছিল আবার খুব মায়াও হল।।
(গল্প করি গল্প নয়)