টরন্টো, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২, নভো সংখ্যা ২৯
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য সংবাদ ভ্রমণ কাহিনি বিশেষ নিবন্ধ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি যোগাযোগ

কার্তিকের কুয়াশা

ভ্রমণগাথা

মধুবন্তী আইচ

সিন্ধুসভ্যতার নগর - লোথাল, গুজরাট।

 

ইতিহাসগাথা এবং ঐতিহাসিক স্থানগুলি আমাকে আকর্ষণ করে সেই কোন্ ছোটোবেলা থেকে। ইচ্ছে করে সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে মানব সভ্যতার ভাঙ্গা গড়ার নিদর্শন গুলি দেখে বেড়াই, জানি সেই সব কাহিনী, ভগ্নাবশেষ গুলির পাশ দিয়ে যেতে যেতে শোনার চেষ্টা করি যদি তারা বলে কালের গর্ভে বিলীন দিনগুলির কথা! শীতের এক রবিবারে ঘুরে এলাম এক প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন স্থল - লোথাল (Lothal)।

সে অনেক কাল আগের এক সময়ের কথা। সেই সময়কার মানুষজনের মুখাবয়ব আমাদের অচেনা অজানা। জানা নেই কী ছিল তাদের নাম বা নামকরণের ইতিহাস। কোন্ সম্ভাষণে ডাকতো তারা একে অপরকে। বর্তমানযুগের মানুষের কাছে তাদের পরিচয় সিন্ধুসভ্যতার মানুষ রূপে।

সিন্ধুসভ্যতা প্রাচীন মিশরীয় এবং মেসোপটেমিয় সভ্যতার মত উন্নত সভ্যতাগুলির সমসাময়িক এবং সমমানের। সময়টা ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্ব (2500 BCE.)। সিন্ধুনদ এবং তার উপনদীগুলিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ঘন বসতি। ব্রোঞ্জযুগের সূত্রপাত হয়ে গিয়েছে এবং এই সভ্যতা তখন ব্রোঞ্জ, তামা, সীসা ইত্যাদি ধাতুর ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত। এই উন্নত জনবসতির ব্যাপ্তি ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, বর্তমান আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ভারতের উত্তর-পশ্চিমে পাঞ্জাব, গুজরাট, মহারাষ্ট্র এমনকি উত্তরপ্রদেশের কিছু অংশ পর্যন্ত। ছোটো বড় মিলিয়ে প্রায় হাজারের মতো শহর গড়ে তুলেছিল এই সভ্যতার মানুষজন।

এই সমস্ত শহর বা জন্যবসতির অন্যতম হলো হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো যেখানে পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি পুরাতাত্বিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে এবং এই দুটি শহরই বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত।
ভারতের যে'কটি স্থানে এই সভ্যতার নিদর্শন দেখা যায় তার মধ্যে গুজরাট রাজ্যের লোথাল একটি।

সিন্ধুনদ-তীরবর্তী বসতির সবথেকে দক্ষিণে অবস্থিত শহরগুলির একটি ছিল লোথাল। এর গোড়াপত্তন হয়েছিল ২২০০ খ্রীষ্টপূর্ব (2200 BCE.) সালে। বর্তমান কালে এই স্থান আবিষ্কৃত হয় ১৯৫৪ সালে এবং খননকার্য সম্পূর্ণ হয় ১৯৬০ সালে ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগ (Archeological Survey of India / ASI) দ্বারা।

লোথাল ছিল একটি বন্দর নগরী। পৃথিবীর প্রাচীনতম ফেরিঘাট বা জাহাজঘাট ছিল এই শহরে এবং ইঁট-বাঁধানো সেই ঘাট আজও রয়েছে। আজও জল (বৃষ্টিজনিত) রয়েছে তাতে। একসময় বড় বড় নালার মাধ্যমে সাগরের সাথে সংযুক্ত ছিল এটি এবং তার নাব্যতা ছিল গভীর যাতে বাণিজ্য তরী এসে ভিড়তে পারে সহজেই।

তৎকালীন একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল লোথাল এবং এই বন্দরের মাধ্যমে মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকার সাথে বাণিজ্য করেছে মানুষ ৪০০০ বছর ধরে। লোথালের কারিগরদের হাতে তৈরী পুঁতি এবং অন্যান্য দামী পাথরের গয়না পৌঁছে যেত পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে। পুঁতি তৈরীর কারখানার ভগ্নাবশেষ আজও দৃশ্যমান।

এছাড়াও রয়েছে বাজার এলাকা এবং তার মাঝে উচ্চস্থানে অবস্থিত ইঁটের তৈরী একটি শস্যাগারের ভগ্নাবশেষ। নগরপ্রধানের বাসস্থান ছিল বাজার এলাকার কাছে। বাকি নগরীটি দুই ভাগে বিভক্ত ছিল - বর্তমান কালের Upper Town এবং Lower Town হিসেবে। নগরীর শেষপ্রান্তে ছিল কবরস্থান, সারা শহর জুড়ে ছিল উন্নত নিকাশি ব্যবস্থা, নালা গুলি বেশির ভাগই ইঁটের পাটাতনে ঢাকা থাকতো। পানীয় জলের জন্য ব্যবহৃত দুটি কুয়ো এখনও রয়েছে, যদিও তাদের জল শুকিয়েছে বহুযুগ আগেই।

বাড়িগুলি ছিল রাস্তার ধারে সারি দেওয়া। সেগুলির ভিতের চিহ্ন আজও বর্তমান। বাড়িগুলোর অভ্যন্তরে পৃথক কাজের জন্য যে পৃথক পৃথক ঘর থাকতো তা সহজেই বোঝা যায় সেই ভিতের কাঠামো থেকে। প্রতিটি বাড়ির থেকে পৃথক নিকাশি ব্যবস্থা করা থাকতো। সিন্ধু সভ্যতার মানুষ নিঃসন্দেহে নগর উন্নয়ন, নগর বিন্যাস এবং শহরবাসীর সাস্থ্য-সচেতনতার দিকে নজর রাখতো।

লোথালের কাছেই সবরমতী (বর্তমান স্থানীয় বাসিন্দাদের বলা নাম) নদী ছিল এবং তার জল লোথালের মানুষেরা নগরজীবনের নানা কাজে ব্যবহার করতো অথচ নগরটি তারা এমন উচ্চতায় বানিয়েছিল যেন বন্যায় প্রতিবার নগর ভেসে না যায়। একসময় শুরু হয় ভূমিক্ষয় - নদী পথ পরিবর্তন করে, সমুদ্রও দুরত্ব বাড়িয়ে নেয়, জেগে ওঠে গুজরাটের সুদূরপ্রসারী শুষ্ক কচ্ছভূমি (Rann of Kutch)। বৃষ্টিপাত যায় কমে। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে এই নগরের মানুষ সরে যায় অন্যত্র। কোলাহল মুখরিত নগরী হয়ে যায় নিঃশব্দপুরী। গুজরাতি শব্দ লোথাল (Loth - মৃত + (s)Thal - স্থান) নামের বাংলা তর্জমা হলো 'মৃতের স্থান বা নগরী'।

মধ্যাহ্ন সূর্যের নীচে, সেই ভগ্নাবশেষের মাঝে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ের সাথে ভাবতে থাকি আমি দাঁড়িয়ে আছি এমন এক জায়গায়, যা খ্রীষ্ট জন্মেরও কয়েক হাজার বছর পূর্বে মানুষের কোলাহলে মুখরিত ছিল! দিনের বেলা দূর দূরান্ত থেকে আসা বণিকেরা পসরা কেনা বেচা করতো, রমণীরা দল বেঁধে কুয়োর কিনারায় আসতো জল তুলতে, কেউ সুখ দুঃখের গল্প করতো, কোনও নগরবাসীর প্রেয়সী ক্ষণিকের আছিলায় কুয়োর জলে ঝুঁকে দেখে নিত নিজের প্রতিবিম্ব। সন্ধ্যায় রাস্তায় রাস্তায় হয়তো জ্বলতো মশাল, বাড়িগুলির অভ্যন্তরে কুলুঙ্গিতে মাটির প্রদীপ, স্থানে স্থানে দিনশেষের আড্ডার জটলা। কিছু পল যেন স্তব্ধ হয়ে যায় এখানে জাহাজঘাটায় কিংবা কবরস্থানের ঢিপির পাশে, ঝুরঝুরে বালি মাটিতে কি দেখা যায় কারওর ক্ষীণ পদচিহ্ন! কারখানার পাশ দিয়ে যেতে যেতে কি শুনতে পেলাম কর্মব্যস্ত প্রাচীন শ্রমিকদের আলোচনা! শীতের হাওয়ায় কান পাতি - যদি সে বয়ে নিয়ে আসে অতি উন্নত সেই সভ্যতার না-শোনা কোনও বার্তা! ফিরতি পথ ধরে চলতে চলতে ভাবি আমাদের আধুনিক সভ্যতার নিদর্শন এইরকমই জীবিত থাকবে তো কয়েক'শ-হাজার বছর পরে আমাদের কথা বলার জন্যে?