টরন্টো, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২, নভো সংখ্যা ২৯
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য সংবাদ ভ্রমণ কাহিনি বিশেষ নিবন্ধ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি যোগাযোগ

কার্তিকের কুয়াশা

স্বীকারোক্তি (দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়)

রত্না চক্রবর্তী

 ৭.২.২২

 

জীবনের পথ চলতে চলতে বহু বহু অন্যায় করেছি বহু মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে। না প্রাণঘাতী বা তেমন কোনো ভয়ানক অপরাধমূলক কাজ না করলেও জীবনের প্রতিপদে পদেই ছড়িয়ে আছে দরকারী, অদরকারী বহু মিথ্যা। সেগুলো স্বীকার করা ভারি মুশকিল।
যেমন আমার বাবা মার কাছেই আমি ছোটবেলায় অনেকবার মিথ্যে বলেছি। যেমন পেনসিল কামড়ে বলেছি "আমি করিনি, কি করে হলো জানিনা।" বই ছিঁড়ে গেলে কল্পিত বন্ধুর নাম করে বলেছি সে ছিঁড়ে দিয়েছে। এমন অনেক। সব চেয়ে বড় কথা স্কুল যাব না বলে অজস্রবার বলেছি "পেট ব্যথা করছে, মাথা ব্যথা করছে।" কোন লোককে পছন্দ না হলে বলেছি, " ওর বাড়ি যাব না, ও আড়ালে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। চিমটি দেয়। "
এমন যে কত কিছু সংসারে চলতে গেলে বলতে হয় তা আর বলে শেষ করতে পারবো না। তা একবার আমার দূরসম্পর্কের দুইবোন তাদের মায়ের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে এসে দুদিন ছিল। তখন কনডেন্সডমিল্ক বলে একরকম দুধ দিয়ে মা চা করত।
দুপুরে মা মাসি শুয়ে পড়লে ওরা করেছে কি চুপিচুপি হাতে একটু একটু করে ঢেলে খেয়েছে। আমাকেও একটু দিয়েছে, আমি দলে পড়ে ভয়ে ভয়ে খেয়েছি।
তবে এই ধরনের অপরাধটা আমি করতাম না। অন্তত খাবার নিয়ে কখনো করিনি। বাবা-মা যথেষ্ট যত্ন করে খেতে দিতেন দিতেন, ওই জন্য প্রয়োজনই পড়তো না, চাইলেই পেতাম। অন্য যে অপরাধ করতাম তা নিজেকে বাঁচাবার জন্য কিন্তু এটা অন্যরকম। সে বার খেয়ে আমার খুব ভাল লেগেছিল। মা মাসি বুঝতে পারেন নি। একধরনের রোমাঞ্চ বোধ হয়েছিল। অপরাধের একটা নেশা আছে বা শিশুমনে কুসংসর্গের একটা প্রভাব আছে হয়তো। তারপর একদিন ছুটির দুপুরে মা ঘুমুলে চুপিচুপি হাতে ঢেলে একটু চেটে দেখলাম, খুব ভালো লাগলো সেইটা আমার প্রথম চুরি করে খাওয়া।
আমি যে অন্যায় গুলো করতাম তার প্রতিটি আমার বাবা জানতেন, বুঝতেন। প্রচন্ড বকাবকি করতেন। বলতেন, " ফের আবার মিথ্যে কথা বলছো? এর জন্যই শাস্তি দেবো। "
কিন্তু এবার যখন কোন দুধ চুরি করে খেয়ে কৌটোটা নামিয়ে রেখে ছিলাম তখন খেয়াল করিনি যে সেটা একটা জলভরা পাত্রের উপর রাখা ছিল। মা একটা জলভরা বাটির মধ্যে রাখতেন পিঁপড়ে হবার ভয়ে। তা আমি বুঝিনি, জীবনের প্রথম চুরি তাই নার্ভাস ছিলাম নিশ্চয়ই।
মা বিকেলে চা করার সময় এসে দেখেন সেই দুধের কৌটা ভর্তি হয়ে গেছে পিঁপড়েতে । মা তো খুব বকাবকি করলেন বললেন, " কে এটা নামিয়ে রেখেছে?"
তা আমাকেই বললেন কারণ আমিই তখন ওই টেবিলে হাত পাবার মতো লম্বা। আমার ভাই খুব ছোট তখন কাঁথায়। সে তো আর এটা করতে পারে না, বাড়িতে আর কেউ থাকে না। তাই মা বললেন," তুই নিশ্চয়ই নামিয়েছিস নইলে নামাল কে? কি করে পিঁপড়ে হল? "
বাবা কিন্তু প্রতিবাদ করলেন। দৃঢ় বিশ্বাসের গলায় বাবা বললেন, "না না ও এই ধরনের কাজ করবে না, ও যেগুলো করে সেটা অন্য টাইপের। আমার মনে হয় তুমিই অন্য মনস্ক হয়ে হয়তো রেখেছ।"
মাও যেন দোটানায় পড়ে গেলেন, সত্যি কথা আমি এরকম ধরনের কাজ করি না কখনো। " তাই মা বললেন, তাই হবে বোধহয়, তাড়াতাড়িতে ভুল করেছি। "
আমি সেখান থেকে চলে এলাম। আমার এত এত্ত খারাপ লেগেছিল যে আমি জীবনে তা কখনো ভুলিনি। আমি লুকিয়ে কেঁদেছিলাম। বাবার বিশ্বাস ভরা গলাটা আমায় শান্তি দিচ্ছিল না, ভয়ানক এক মনোকষ্টে ভুগছিলাম। অপরাধবোধটোধ বোঝার মতো বয়স হয়নি তখন কিন্তু সে এক শাস্তি ছিল।
কি করব বুঝতে পারছিলাম না। বাবাকে সামনাসামনি বলতেও সাহস হচ্ছিল না। তখন আমি বুদ্ধি করে প্রথম চিঠি লিখি। ক্যালেন্ডারের বাতিল পাতায়। এর উপর আবার খাতার পাতা ছেঁড়ার মতো অপরাধ করে আবার অপরাধের বোঝা বাড়াতে চাইছিলাম না। ভুল বানানে ভরা ওই চিঠিতে সত্যি কথাই লিখেছিলাম তবে সেই বোনেদের কথাটা আর লিখিনি। শুধু আমার কথা লিখেছিলাম। আমার শিশু মনে এটাই মনে হয়েছিল সে কথা বলাটা বিশ্বাসভঙ্গের অপরাধ।
বাবা অফিস যাবার আগে বাবার জামার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। সন্ধ্যেবেলা ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করছিলাম কি জানি কি শাস্তি দেবে বাবা। বাবা রাগ করবে তা জানি কিন্তু ভগবান দুঃখ যেন না পায়, এটাই ছিল তখন আমার প্রার্থনা। ঘুরে ফিরে ঘরের ঠাকুরের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে তাই বলছিলাম।
বাবা অফিস থেকে এলেন, মুখে কোন ভাব বৈলক্ষণ বুঝিনি, ভয়ে ভয়ে ঘুরছিলাম। বাবা যেমন রোজ বাসের টিকিট এনে দিতেন, আমি জমাতাম বলে, তাই দিলেন। মার সাথে কথা বললেন, ভাইকে আদর করলেন। চা জলখাবার খেলেন, যেমন সন্ধ্যায় পড়াতে বসতেন তেমন বসলেন। আমি উৎকন্ঠায়, অস্থির, তবে কি বাবা চিঠিটা দেখতেই পান নি।পকেট থেকে হয়তো পড়েই গেছে! এখন কি করব! বিভ্রান্ত মনে পড়তে বসলাম।
বাবা যেমন ইংরাজি পড়ান তেমন পড়ালেন, রোজের মতো দশটা অঙ্ক করতে দিলেন, আমিও রোজের মতো দুটো ভুল করলাম। অন্য কোন কথা হল না। শেষে বাবা আমার প্রিয় সাবজেক্ট বানিয়ে রচনা লিখতে দিলেন।ম জার কথা এত্ত কথা এই বয়সেও সব মনে আছে কিন্তু সে দিনের কি যে সাবজেক্ট ছিল তা আমি সম্পূর্ণ ভুলে গেছি!
শুধু ভীষণ ভাবে মনে আছে শেষে বাবার রচনা দেখে মন্তব্যটুকু... " হুঁ খুব ভালো হয়েছে লেখাটা। আমিও এত ভালো করে লিখতে পারতাম না কিন্তু বানান এত ভুল করলে নম্বর কাটা যাবে যে। "অন্নাই" "খমা" বানান হবে" অন্যায় ক্ষমা" ,এত বড় মেয়ে এই বানানের ছিরি! হ্যাঁ আর শোনো কাল থেকে এই সাদাখাতা বানিয়ে দিলাম, এতে বাংলা লিখবে। সাদা জায়গায় এমন লেখ যে লাইন তো একেবারে নামতে নামতে নিচে গিয়ে ঠেকেছে, ছিঃ ছিঃ।হাতের লেখা ঠিক কর। "
তারপর আমার মাথার চুলে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কেটে হেসে বললেন, " হ্যাঁ আর যদি একটাও বানান ভুল না কর পরদিন একটা করে হজমীগুলি প্রাইজ পাবে।"
আমি চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইলাম, বাংলা কারেকশন করা খাতার পাতায় চোখের জল ঝরে ছিল। মুছতেও লজ্জা করছিল।
ক্যালেন্ডারের উলটো পিঠে সাদাপাতায় আমি ওই চিঠিটা লিখেছিলাম, আগে কখনো অঙ্ক ছাড়া সাদা পাতায় কিছু লিখিনি। ক্ষমা আর অন্যায় বানান দুয়ো ওখানেই ছিল। অন্যায় বানানটা অবশ্যই জানতাম বোধহয় উত্তেজনায় ভুল করেছি। আজ লিখতে গিয়ে বাবার মুখটা মনে পড়ে চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে প্রৌঢ় বয়সেও। সেই আমার প্রথম চিঠি। এ চিঠির আর ঘটনার কথা আমি আর বাবা ছাড়া কেউ কখনো জানত না, মাও না। আজ এতদিন বাদে আমি লিখলাম।।

 

 

 

 

'ব'- তে বর্ণপরিচয়...

নীলাঞ্জনা সরকার

 

বৃষ্টি দেখছিল সীমা.... শ্বশুরবাড়ির দোতলার এই ঘরটি তার খুব প্রিয়, এখানেই সে নিজেকে খুঁজে পায় বাকি সব আড়ম্বরতাকে পিছনে ফেলে। সীমার স্বামী একজন বিজ্ঞানী.....সরকারি চাকরি করত - কিন্তু রঞ্জন এখন বাড়িতেই একদম ছাদের ঘরে নিজের ল্যাবরেটরিতে কি সব নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত। সীমাকে মাঝে মাঝে সেই ঘরে নিয়ে যায় রঞ্জন, বোঝাবার চেষ্টা করে অনেক কিছু কিন্তু সীমার কৌতূহল তার কাজের ক্ষেত্র ছাড়িয়ে যায় অনেক দূর তখন রঞ্জন আর সীমা দুজনেই হেসে উঠে অবশেষে থেমে যায় - বেশিরভাগ দিনই রঞ্জন একটাই কথা বলে!

-দাঁড়াও, আর দেরি নেই... খুব শিগগির সব প্রশ্নের উত্তর পাবে।
সীমা তার চোখের দৃষ্টি রঞ্জন থেকে সরিয়ে নিয়ে ধীর পায়ে একটা একটা করে সিঁড়ি গোনে আর নামে... মনে মনে ভাবে এই সব প্রশ্ন তার আর রঞ্জনের জীবনের অনেকখানি সময় কেড়ে নিয়েছে। সীমা খুব ভালো আঁকতে পারে তাই যখনই সময় পায় রং তুলি নিয়ে বসে, এমনি একদিন অবসরে সে আঁকলো এক বরফাবৃত পাহাড়, নীল আকাশ আর দুটি ভালোবাসার মানুষকে... অনেকবার করে ছবিটা দেখেও সীমার মন ভরলো না! কি যেন এক অসম্পূর্ণতা গ্রাস করে আছে এই জলরঙের ছবিটিতে। সীমা যখন ভাবে বিভোর তখন রঞ্জনের চিৎকার শুনতে পেল...সীমা...সীমা...ছলাৎ করে উঠলো সীমার বুকের ভিতরটা, রঞ্জনের মুখে তার নামটা কি মিষ্টি লাগে। সীমা দৌড়ে ছাদের ঘরে যায়- দরজা দিয়ে ঢুকে দেখে রঞ্জন সামনে বসে আছে আর কে যেন তার কানের কাছে ফিসফিস করে উঠলো..."সীমা"! এ কার কন্ঠস্বর...ভয়ে ভয়ে সেদিকে তাকালো সীমা, কাউকে দেখতে পেল না! আবার সেই কন্ঠস্বর - দৌড়ে গিয়ে রঞ্জনকে জড়িয়ে ধরতে রঞ্জন মুখ বেঁকিয়ে বললো,
-কি ভীতু গো তুমি!
সীমা আরো আঁকরে ধরলে, তাকে সোজা করিয়ে সামনের টেবিলের দিকে আঙুল তুলে বললো,
-ওই যে ও কথা বলছে।
সীমা সোজা তাকিয়ে দেখে একটা বাক্স তাকে ডাকছে। রঞ্জন বাক্সের সামনে গিয়ে বলে,
-কি ব্যাপার, তোমার সীমাকে পছন্দ?
বাক্স হ্যাঁ বলে। রঞ্জন সীমাকে বলে,
-তোমার??
সীমা কপট রাগ দেখিয়ে পিছন ঘুরে বসে। সীমার গাল টিপে দিয়ে রঞ্জন বলে,
-এবার বোধহয় আমার এতদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে পারবে। জানো, কথা বলা যন্ত্রটা তৈরি করলাম, এবার ওর শরীরটা বানাতে হবে কিন্তু তার জন্য চাই ফান্ড। সীমার চোখে শুধু বিস্ময়! রঞ্জন বলেই চলেছে -সে যা প্রোগ্রামিং করে দেবে তাই বলবে এই যন্ত্র...শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক সাহায্য করতে চাই সীমা। আজ যদি মা বাবা থাকতেন খুব খুশি হতেন...বাবার চিরদিনের স্বপ্ন ছিল সাধারণ মানুষের পাশে থাকা, ছোটবেলায় সামনে থেকে দেখে বাবার আদর্শগুলো বুকের পাঁজরে মিশে গেছে সীমা। ছাদে আসে রঞ্জন। সীমা বোঝে, জানে এখন নিশ্চয়ই আকাশের গভীরতায় ওনাদের খুঁজছে তার স্বামী...তার বিয়ের পর পরই কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মা বাবা দুজনকেই হারায় রঞ্জন। অনেকবার রঞ্জনকে জিজ্ঞেস করেছে সে, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই পুলিশ কেস বন্ধ করে দেয় অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু দেখিয়ে। সবাই বিশ্বাস করলেও রঞ্জন করেনি - হয়তো কিছু জানতে পেরে সাংঘাতিক গুমরে গিয়েছিল সে। কাজে যেত - আসতো ঠিকই কিন্তু কি যেন ভাবত সারাদিন। অবশেষে একদিন চাকরি ছেড়ে দিয়ে তার এই গবেষণা, আর আবিষ্কার। মাঝে মাঝে রঞ্জন খুব অজানা হয়ে ওঠে তার কাছে, ধীর পায়ে এগিয়ে রঞ্জনের কাঁধে মাথা রাখে সীমা... তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের ঘটনা! মা বাবা মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলেন, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর আসে একটা বড় ট্রাক এসে তাদের পিষে দিয়ে গেছে। অনেকদিন অবধি রাতে ঘুমাতে পারেনি রঞ্জন, চমকে উঠতো আর নিজের মনকে প্রশ্ন করতো এত সকালে পার্কের পাশের ফাঁকা রাস্তায় ট্রাক এলো কোথা থেকে? সীমা অনেকদিন এও লক্ষ্য করেছে রঞ্জন কি যেন খুঁজতো বাবার টেবিলে! তা প্রায় তিন বছর হয়ে গেছে। নতুন সংসারটাকে নিজের করে নেওয়ার আগেই কতকিছু ঘটে গেল তাদের জীবনে...আজ আকাশে মায়াবী আলোর খেলা চলছে যেন! চাঁদও রঞ্জনের সফলতার সঙ্গী, গান গেয়ে ওঠে সীমা... চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো...রঞ্জন জড়িয়ে ধরে সীমাকে।
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে, রঞ্জন তার কথা বলা বাক্সটার আরো কিছু উন্নতি ঘটিয়েছে। তবে বাক্সটার শরীর বানাবে না এই সিদ্ধান্তও নিয়েছে সে, ওসব করলে নাকি বাক্সটাকে কোথাও নিয়ে যেতে সমস্যা হবে, তাই ওটাকেই একটু অন্যরকম রূপ দেবে সে। আজ রঞ্জন আর সীমা সকালের ব্রেকফাস্ট খাওয়ার পর বসে গল্প করছিল, সীমার যদিও রান্নাঘরে যাওয়ার তাড়া ছিল কিন্তু রঞ্জন তাকে বসায়। সীমা বোঝে রঞ্জন আজ তাকে কিছু বলতে চায় - সে বসে। রঞ্জন শুরু করে,
-সীমা তুমি তো জানো বাবা স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু বাবা চাইলে অনেক বড় গবেষক হতে পারতেন, কিন্তু সেসব পরিকল্পনা ছেড়ে তিনি বাচ্চাদের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রসার ঘটানোকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম যত বিজ্ঞানমনষ্ক হবে দেশ তত উন্নতি করবে। বাবার শেখার আর জানার ইচ্ছেটা খুব প্রবল ছিল, তাই উনি খুব পড়তেন - অনেক বিজ্ঞানের পত্রিকা, দেশী বিদেশী বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন আর্টিকেল। একবার বাবার স্কুল থেকে সব শিক্ষকেরা মিলে বকখালী বেড়াতে গেলেন। ফিরে বাবা খুব মনমরা হয়ে পড়েছিলেন বেশ কিছুদিন, তারপর হঠাৎ করে রোজ স্কুল থেকে ফিরে কি যেন সব লেখালিখি করতে লাগলেন! মা সব কিছু লক্ষ্য করে একদিন বাবাকে সব কিছু খুলে বলতে বললেন ...বাবা সেদিন আমাদের একটা গল্প বলেছিলেন। বাবা বকখালী গিয়ে প্রথমদিন বেশ আনন্দে ছিলেন তবে সমুদ্রের ধারে একটা মেয়ে তার চোখে পড়ে, মেয়েটি কোনো কিছু বিক্রি করতো তাও নয় আবার ভিক্ষেও চাইতো না। পরদিন সকালে সবাই যখন সমুদ্রের ধারে আনন্দে মত্ত, বাবা তখন মেয়েটির কাছে গিয়ে তার পরিচয় জানতে চান। মেয়েটি খুব সুন্দর হেসে দূরে আঙুল দেখিয়ে বলে - ওদিকে তার বাড়ি , বাবা যদি চান তার মায়ের সাথে কথা বলতে পারেন। বাবার মনে একবিন্দু সন্দেহ আসেনি, উনি বন্ধুদের বলে মেয়েটির সাথে হাঁটতে শুরু করেন। সমুদ্রের ধারে কত লোকের কোলাহল, সবাই কটাদিন সব ভুলে এই শুভ্র জলরাশির স্পর্শে নিজেদের শৈশবটা খুঁজে পেতে চাইছে যেন। কিন্তু মেয়েটি নিরুত্তাপ, সে হেঁটে চলেছে আর বাবাও। অবশেষে মেয়েটির বাড়ি পৌঁছলেন বাবা...একটা ঝুপড়ি মত, আশপাশে ওই ধরনেরই বেশ কিছু ঘর। দরজা খুললো একজন চকমকি শাড়ি পরা মহিলা, উগ্র সাজ আর গায়ে সুগন্ধির এত অতিরিক্ত প্রয়োগ যা খুব শ্বাসকষ্টের কারণ হয়েছিল বাবার। একনিমেশে সব বুঝে নিলেন বাবা, মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখেন সে তখনও কেমন যেন চুপচাপ। ওই বয়সের বাকি মেয়েদের থেকে অনেকটাই আলাদা। বাবা ঐ মহিলাকে বলেন, -মা আমায় একটু জল খাওয়াবে?
মহিলা তাকে ভিতরে আসতে বলে জল আনতে যায়। বাবা মেয়েটিকে নিয়ে ঘরে ঢোকে। ঘরে অনেক দেব দেবীর মূর্তি, ধূপ জ্বলছে। এবার মহিলা তার মেয়েকে বাইরে যেতে বললে, বাবা বলেন,
-থাক। এ তোমার মেয়ে?
মহিলা বেশ রেগে যায়, বলে,
-বাবু, শুরুতে মা বললেন বড় আজব লাগলো তবু ভাবলাম বোধকরি আপনার মতিভ্রম হয়েছে কিন্তু এখনতো দেখছি আপনি পুরো পাগল?
বাবা বলেছিলেন,
- না, মা মতিভ্রম নয়। তুমি এই ছোট মেয়েটাকে পাঠাও তোমার ব্যবসার জন্য? তুমি দেখেছ ওর চোখদুটো!
-কি করবো বাবু, ওর মুখেই তো অন্ন জোগাতে হবে, এখানে সবাই বেড়াতে আসে তার মধ্যে থেকে কখনো কখনো কাউকে নিয়ে আসে ও। ওকেও তো ব্যবসাটা বুঝতে হবে, নয়তো আমি মরলে এ বাড়ির মালিক ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে।
বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন মেয়েটা স্কুল যায় কিনা? তাতে মহিলা খুব হেসেছিল আর বলেছিল,
- বাবু! তুমি কি করতে এসেছো বলতো? এত হাড়ির খবর তো আমি তোমায় দিতে পারবো না। শুধু আমার মেয়ে কেন… এরকম কত মেয়ে স্কুল যায়না তা তুমি জানো? তবে ওরা অনেক কিছু শিখছে বাবু ছোট থেকে কি করে খদ্দের ধরতে হয়, কি করে মন ভোলাতে হয়...আর কে শেখায় জানো?? ওদের গর্ভধারিনীরাই।
কেঁদে ফেলে ওই মহিলা...
- বাবু, আমাদের বাচ্চাদের কোন স্কুলে নেবে গো বলতে পারো? একটা মাষ্টার রেখেছিলাম মেয়েটার জন্য কিন্তু সেও দুদিনের মধ্যে আমার বিছানায় আসে, তাই ঘেন্না ধরে গেছে।
বাবা সেদিন চোখের জল মুছে বেরিয়ে আসেন। তারপর বাকি দুদিন আর ওই মেয়েটির দেখা পাওয়া যায়নি... এরপর মা বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাদের যতটুকু ক্ষমতা তাই দিয়ে এইসব বাচ্চাদের জন্য কিছু করবেন।
-আচ্ছা রঞ্জন, বাবা কি আবার কখনো গিয়েছিলেন ওই মেয়েটির খোঁজে?
সীমার প্রশ্নে রঞ্জন যেন হারিয়ে যায়, বেশ কিছু বছর আগের ঘটে যাওয়া মুহূর্তগুলো ফিরে পেতে চায় সে। মনের কোণে সযত্নে লুকিয়ে রাখা কিছু কথা আজ যেন বহমান নদীর মত সবকিছু ছাপিয়ে ভাসিয়ে নিতে চায় রঞ্জনের দুঃস্বপ্নগুলোকে! রঞ্জন হাঁটু গেড়ে বসে সীমার সামনে, জিজ্ঞেস করে বলতো,
-'ব' বলতে সবচেয়ে আগে কি মনে হয় তোমার? সীমা তৎক্ষণাৎ উত্তর দেয় 'বাবা'। রঞ্জন বলে,
-আমার বাবা সেই চক্রের বিষ চোখে পড়লেন যাদের লালসা শিশুদের শেখায় 'ব' হল 'বাবু'... বলায় 'ব' তে 'বিছানা'...আর সেইখানে তিলে তিলে মরে তাদের শৈশব। বিছানার পাশে রাখা ফুলের পাপড়িগুলো দিয়ে হয় তাদের রক্তের ছোপ লাগা চাদরের মানানসই নকশা!
রঞ্জনের মুখে চাপা দেয় সীমা, কেঁদে ওঠে। বলে,
-ওমন করে বলোনা গো! আর যে শুনতে পারছিনা। -শুনতে হবে সীমা, অনেক শক্ত হতে হবে আগামী দিনগুলোয়।
রঞ্জন বলতে থাকে, মা বাবা গিয়েছিলেন আরো একবার ওই মেয়েটির খোঁজে কিন্তু না - তাদের দেখা আর পাওয়া যায়নি। সেই ঝুপড়িটাই অদ্ভুতভাবে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। আশপাশে জিজ্ঞেস করলেও কেউ মুখ খোলেনি। ফিরে এসেছিল ওরা। বাবা যখন এ পাড়ার পার্টি দলনেতার কাছে সাহায্যের জন্য যান তখন ব্যাপারটা জানাজানি হয়, অনেক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল প্রথম দিকে কিন্তু মা তার শক্ত হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাবার এই কাজে। মা বাবা হাল ছাড়েননি সেইসব মায়ের সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর। ততদিনে বাবার একটা টিম তৈরি হয়েছিল এই কাজে যারা মন থেকে আসতে চেয়েছিল তাদের নিয়ে। জানো সীমা, মা খুব ভালো লিখতেন। মা একটা কবিতা শুনিয়েছিলেন বাবার টিমের এক মিটিংয়ের দিন... সবাই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, বাবা মা কে বলেছিলেন তুমি তো আমার থেকেও ওদের আপন করেছো, মার চোখে সেদিন জল ছিল কিন্তু তার একফোঁটাও গাল ভাসায়নি। মা বোধহয় কিছু একটা আন্দাজ করেছিলেন কেন জানিনা সেদিন রাতে আমায় ওই লেখাটা দিয়ে বলেছিলেন,
- রঞ্জন আমরা যখন থাকবো না তখন এই লেখাটার মর্ম বুঝতে পারলো কিনা আমাদের আশেপাশের স্বার্থপর মানুষগুলো একটু দেখিস।
সীমার হাত ধরে রঞ্জন বাবার টেবিলের কাছে নিয়ে যায়...তার হাতে তুলে দেয় মায়ের একটা খাতা, যার বেশ কিছু পাতা মোড়া আর একদম মাঝখানে একটা ফুলস্কেপ পাতা সযত্নে ভাঁজ করে রাখা। জানো সীমা যখন রাতের পর রাত ঘুম আসত না তখন এই লেখাগুলো পড়তাম। সীমা ওই পাতাটা বের করে পড়তে শুরু করে...

তোমরা রজনীগন্ধা কেনো ঘর সাজাতে,
আমরা কিনি জীবন্ত চিতা সাজাতে-
আমার ছোট্ট ভ্রূণটা জন্মের আগেই বিকিয়ে যায়!

সত্যিই হয়তো, আমার জন্য খুব দামী ওই প্রশ্নটা-
ছেলে নাকি মেয়ে?
তবু আমার জন্য তফাৎ কিছু হয় কি?
মেয়ে হলে পাবে বিষ চুম্বন আর
ছেলে হবে ওই বিষের দালাল!

আমি শুধু তোমাদের মানসী হয়ে গর্ভযন্ত্রণা ভুলে
ধূপের ধোঁয়ায় ওই বিষাক্ত গন্ধটা রোজ ভুলি
আমার মা হওয়াটা কত দোষের বলো! তাইতো -
আমার ছোট্ট ভ্রূণটা জন্মের আগেই বিকিয়ে যায়।

আমি পড়তে শেখাই, আদরে জড়িয়ে ধরে
বলো সোনা - অ, আ, ই, ই...
সোনা খোঁজে পুঁথি আমার ঘরে,
পায়ে পায়ে জড়িয়ে আমার সাথে আমার আঁচল ধরে
কিন্তু বড্ড গন্ধ যে, মদ বলবো না!
তোমরা তো বলো অমৃত আমার শরীরে। তবুও -
আমার ছোট্ট ভ্রূণটা যায় বিকিয়ে!

নেই পেন্সিল নেই খাতা কিচ্ছুটি আমার ঘরে
তবু সোনা পড়তে শেখে
সোহাগ দেখে আর চাকুর ধারে...

না, আর পড়ে উঠতে পারে না সীমা। ভাজ করে রেখে দেয় কাগজটা। দুচোখ বেয়ে জলের ধারা তার, যেন কত চেনা ওই মানুষগুলো!
পরদিন সকালে রঞ্জনের জন্য একটা ফোন আসে লোকাল থানা থেকে। সীমার চোখে মুখে একরাশ চিন্তা দেখে রঞ্জন বলে, থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার তার ছোটবেলার বন্ধু, সদ্য দায়িত্ব নিয়েছে।
রঞ্জন তার কথা বলা যন্ত্রটার পারমিশন নেওয়ার ব্যাপারে একদিন থানায় যেতে ওর সাথে দেখা। তখন মা বাবার কথা ওঠায় ও আসবে বলেছিল সবটা শুনবে বলে। তাই আজ রাতে ওকে ডাকলাম কথাও হবে আড্ডাও হবে, সীমা আজ তুমি স্পেশাল কিছু বানাও। সীমার রান্না প্রায় শেষ, তখন রাত সাড়ে আটটা বাজে। একটা পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ালো বাড়ির সামনে। ডিনার শেষ করে দুই বন্ধু বারান্দায় চুপ করে দাঁড়িয়ে, ততক্ষণে রঞ্জন তার সবটা বলে দিয়েছে বন্ধু অলোককে। সিগারেটের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে যত ওপরে উঠছে তত যেন কিছুক্ষণের জন্য আঁধারটা ফিকে পড়ে যাচ্ছে, অলোকের ভ্রুযুগল ধনুকের মত বেঁকে আছে - সে যে এই কেসটা নিয়ে নতুন করে ভাবছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। নীরবতা ভেঙে রঞ্জন বললো,
-আমার যন্ত্রটা দেখবি চল।
সবাই ছাদের ঘরে যায়, যন্ত্রটা এখন আর সেই বাক্সের মত দেখতে নেই। রঞ্জন তাকে একটা পূর্ণ রূপ দিয়েছে, বেশ একটা রেডিও টাইপ তবে অনেক জোরালো আওয়াজ। ওটার বিশেষত্ব হচ্ছে যে কোনো ব্যাটারী লাগে না। ওটা সম্পূর্ণ ভাবে ইলেক্ট্রিসিটিতে চলবে আর আগে থেকে চার্জ করে রাখাও যাবে। রঞ্জন সুইচ টেপে আর যন্ত্রটা বলতে শুরু করে ...
'মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে
টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে'......
শেষ হতে না হতেই সুইচটা ঘোরায় রঞ্জন, আর যন্ত্রটা বলে ওঠে …
'অ এ অজগর আসছে তেড়ে, আমটি আমি খাবো পেড়ে, ইঁদুর ছানা ভয়ে মরে....
যন্ত্র সুর করে করে বলে যায় সহজ পাঠের কথা, আরও কিছু কবিগুরুর কবিতা। এমন অনেক কিছু যা শিশুমনে খুশির দোলা আনবেই আনবে! অলোক জড়িয়ে ধরে রঞ্জনকে, এ কি করেছিস তুই! সীমাও মনে মনে খুব খুশি। রঞ্জন বলে এখনও এর প্রোগ্রামিং শেষ হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষাটুকুও যদি সেইসব ঘরে পৌঁছে দিতে পারি তাহলে আমার মা বাবার স্বপ্নটা কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারব। অলোক জিজ্ঞেস করে এরকম কত জায়গা আছে রে, তুই সবটা কি করে কভার করবি? রঞ্জন বলে যতটা পারি, সরকারি অনুমোদন পেলে আরও বানাবো। ইচ্ছে আছে প্রতিটি এমন এলাকা খুঁজে বার করব যেখানে শিশুসন্তান সুযোগ পায়না, যাদের মায়েরা নিরুপায় লাল লিপস্টিক আর নগ্ন পিঠের আঁড়ালে...সেখানে একটা করে এই যন্ত্র দেব। আপাতত আমার যা ক্ষমতা তার সবটুকু দিয়ে গোটা তিন চারেক বানিয়ে ফেলবো খুব শিগগির। অলোক তুই আমার পাশে থাকবি তো? অলোক আর রঞ্জন হাতে হাত মেলায় সাক্ষী থাকে সীমা আর রাতের জোনাকিগুলো যাদের টিম টিম আলোয় তৈরী অদৃশ্য এক হোমের আগুনে ভস্মীভূত হয় আগামীদিনের অনিশ্চয়তা। সব প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রঞ্জন এগিয়ে চলেছে, সমাজের সব শিখিয়ে দেওয়া নিয়মের সাথে যুদ্ধে অনিবার্য আঘাত হানতে চলেছে সে। রোজের বুলিগুলো যেন সত্যি বেমানান আজ। সীমা আজ আবার খাতা খুললো সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লিখে গেছেন তার শাশুড়িমা....
আমার হাতের মুঠোয় একঝাঁক আলো
আমি হাঁটছি শুধু হাঁটছি অনেক আলোকবর্ষ ধরে
নিচে শুধু প্লাবন, আবেগগুলো ভেসে গেল যে
মুঠোটা ব্যস্ত ছিল, তাই আগলে রাখতে পারেনি
মনে হয় যদি আমার জিভটা সম্মোহিত হতো
তাহলে হয়তো আমি আজ ঐ গোলাপ ফুলটা হতাম
নিজে ঝরে যাবো জেনেও...
নিজেকে পুতুল বানাতাম
সবার কথাগুলো বেশ বুলি হতো, পোষা তোতার মত!
কিন্তু হলোনা!
আমি যে হাঁটছি অনেক আলোকবর্ষ ধরে,
আমি যে যুক্তি, মুক্তি এই সমাজের অন্ধত্বের,
আমার অস্তিত্বে মনুষ্যত্বের অহংকার
নাইবা করলে আমায় তোমার প্রসাধন
আমি শুধু প্রশাসনের শার্সিতে আজ লিখে যেতে চাই
আমার আলোর অধিকার।।
আজ সীমা তার শাশুড়িমায়ের একটা শাড়ি পরেছে। অলোকের সাহায্যে রঞ্জন আর সীমা তাদের স্বপ্ন পূরণের প্রথম পদক্ষেপ নিতে চলেছে। রঞ্জন আজকাল রেগে যায় সীমা যদি একবারও ভুলে বলে ফেলে 'কথা বলা যন্ত্র', কারণ এখন সেটার নাম 'জাগরণ'। সীমার মা ফোন করেছিলেন কিছুক্ষণ আগে, ওনারা খুব খুশি রঞ্জনের এই সাফল্যে। মা বাবা আজ তাদের সাথে আসতেও চেয়েছিলেন কিন্তু অলোক বারণ করেছে যদি কিছু গন্ডগোল হয়। রঞ্জন আজ সেই জায়গায় যাবে বলেছে যেখানে তার বাবা কাজ শুরু করেছিলেন। আজ জাগরণ নিয়ে নিউজ চ্যানেলগুলো সকাল থেকেই সরব। পুলিশ প্রশাসন সবাই খুব ভালোভাবে নিয়েছে তাদের এই আন্তরিক প্রয়াস। কিন্তু অলোকের মনে একটা অনিশ্চয়তা থেকেই গেছে শুরু থেকে, সে বার বার রঞ্জনকে সাবধান করেছে স্থানীয় দালালগুলোর থেকে। আজ সীমা একরকম জোর করেই যাচ্ছে। সীমা বলেছে সে থাকলে সেখানকার মা আর বাচ্চাদের আপন করতে অনেক সুবিধা হবে। অলোকের খুব বিশ্বস্ত কয়েকজন পুলিশ অনেক আগেই পৌঁছে গেছে আজকের রেড জোন এ, আর তাদের থেকে যা খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে অলোকের দুশ্চিন্তা মিথ্যে নয়। রঞ্জন আর অলোক আজকের রেড জোনের নাম দিয়েছে 'প্রথমা'। এ বুদ্ধিটা সীমার, আসলে যখন এই এলাকার বাচ্চাগুলো বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে যাবে তখন তাদের ভবিষ্যত জীবনে সাফল্য এসেও তা সমাজের কিছু নিকৃষ্ট নিয়মের আঘাতে নিমেষে চূর্ণ হয়ে যেতে পারে। অলোক বিশেষ অনুমতি করিয়েছে যাতে ওখানে কোনরকম লাইভ প্রসারণ না হয়। শুধুমাত্র রঞ্জনের ইন্টারভিউ এর ওপরেই ভিত্তি করে থাকবে জাগরণের বর্তমান ও আগামী দিনের কাজ। পুলিশের জিপ এসে থামলো প্রথমাতে। চারিদিকে বেশ নিস্তব্ধতা। আসলে পুলিশ থাকায় খদ্দেরও তেমন নেই আজ এ পাড়ায়। রঞ্জনের হাত ধরে নামলো সীমা বেশ ভয়ে ভয়ে, এরকম অভিজ্ঞতা তার আগে কোনদিন হয়নি। অলোক যথারীতি পুলিশের ছোট্ট গ্রুপটার সাথে কথা বলে নিতে একটু এগিয়ে গেছে। বাড়িগুলোর কিছু কিছু জানলা খোলা কিন্তু কেউ বাইরে নেই। ওপরে তাকালো সীমা জানলাগুলোতে কৌতূহলী মুখ, আশ্বস্ত হলো সে, যাক কেউ তো আছে। অলোক এসে জানায় আজ খুব অল্প সময়ের মধ্যে সব গুটিয়ে ফেলতে হবে পরিস্থিতি ভালো নয়। ধীরে ধীরে সময় বাড়াতে হবে। দালালগুলো সব হুমকি দিয়ে গেছে আর কোথাও ঘাপটি মেরে আছে, আজ পুলিশ ফোর্স খুব সামান্য তাই ওরা যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে সামলানো মুস্কিল হবে। দিদি, হঠাৎ কে যেন ডাকলো! সীমা পিছনে তাকাতেই দেখতে পায় শীর্ণকায় চেহারার এক মাঝবয়সী মহিলা, গায়ে একটা গোলাপী শাড়ি জড়ানো তবে তার চওড়া কপালের লাল টিপটা কেমন যেন মায়াময় করে তুলেছে তার মুখশ্রী। সীমা এগিয়ে যায় তার দিকে।সে বলে,
-বাবাসাহেবকে আমি চিনতাম। আমার ছেলেটাকে পড়াতো আর এখানের অনেককেই কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি শুনেছি। আমার ছেলেটারও, জানো কলেরাতে মরলো সে আগের বছর।
রঞ্জন আর অলোক যোগ দেয় ওদের কথায়। জিজ্ঞেস করে বাকিদের কথা, এখানকার বাচ্চাদের কথা! সে বলে,
-দিদি তুমি এসো আমার সাথে সব বলছি, সবাই এলে ওরা ঝামেলা করতে পারে।
সীমা অলোক আর রঞ্জনের বারণ অগ্রাহ্য করেই যায় জাগরণকে সাথে নিয়ে। অলোক দুজন পুলিশকে সাথে দিতে চাইলে ওই মহিলা আটকায়, ওদের ওখানেই অপেক্ষা করতে বলে। সীমা ওই মহিলার সাথে এগিয়ে চলে এক অজানার পথে, প্রথমে একটা বাড়ির দরজার মধ্যে দিয়ে ঢুকে বিপরীত দিকের এক দরজা দিয়ে বেরিয়ে সোজা একটা গলিতে পড়ে তারা। সীমার এবার একটু ভয় করতে শুরু করেছে, মহিলা এত দ্রুত গলির ডানদিকে - বাঁদিকে ঢুকে পড়ছে যে সীমা এবার রাস্তা গুলিয়ে ফেলছে। মহিলা কোনো কথা বলছে না, চোয়াল শক্ত করে হেঁটেই চলেছে। অবশেষে থামলো সে, ঘুরে তাকালো সীমার দিকে - একটু হাসলো, বললো ভয়ে পেয়েছো? সীমা ঢোক গিলে বললো না তো! সীমার পিছনে কাদের যেন আওয়াজ! আশপাশে পর পর ঘর কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না, শুধু পিছনে একটা অদ্ভুত আওয়াজ ঠিক যেন সাপের লালা ঝরা পিচ্ছিল মুখের হিস্ হিস্, সীমার মনে হলো কেউ তাকে পেঁচিয়ে ধরবে আর ফেরার উপায় নেই। তার কাঁধে কেউ হাত রাখলো! কি সাংঘাতিক হাসি, মনে হলো যেন অন্ধ হয়ে গেছে সে! কই সামনে যে মহিলা দাঁড়িয়ে ছিল তাকে তো আর দেখতে পাচ্ছে না? এভাবে ঠকতে হলো! নিজের ওপর ধিক্কার জাগলো সীমার। তিন তিনটে আধা মাতাল তাকে ঘিরে, চিৎকার করে উঠতে গেল সীমা কিন্তু মুখ চেপে ধরলো একজন...একটা ঘরের সামনে খাটিয়া পাতা ছিল সেখানে টেনে হিচড়ে নিতে থাকলো তাকে, তবু একচুলের জন্য জাগরণকে বুক থেকে ছাড়েনি সীমা। যখন মনে হচ্ছিল সব আশা শেষ ঠিক সেই সময়ে ওই মহিলা গালাগালি দিতে দিতে একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, আর সুড় সুড় করে ওই মাতাল তিনটে কেমন যেন প্রায় কুকুরের মত লেজ দোলাতে লাগলো!
-ময়না রাগ করিস না রে, এই আমরা যাচ্ছি। কখন আসবো বল খালি!
ময়না তাড়াতাড়ি এসে সীমার শাড়ী সামলায়,
-বলে ভাগ শালারা। পুলিশ এসেছে বাঁচতে চাইলে পালা।
ময়না সীমাকে ঘরে নিয়ে আসে। বলে,
- রাগ করো না দিদি। ওরা নিছকই মাতাল খদ্দের, ওরা ভেবেছে তুমি নতুন বুঝি এ পাড়ায়! আমি একটু খানি তোমায় ছেড়ে ঘরে গেছি বসার জায়গা করতে তার মধ্যে এই কান্ড।
সীমা বিদ্ধস্ত, কি বলবে বুঝে পায়না। ওর মনে হয় এই নোংরা হাতগুলো যেখানে যেখানে স্পর্শ করেছে সেগুলো শরীর থেকে বাদ দিয়ে দি- কিন্তু চমকে যায় ময়নার কথায়! সে বলে,
- একদিকে ভালো হলো গো দিদি এই বুনো কুকুরের জাত চিনলে শুরুতেই তুমি। এতে তুমি আরও আমাদের কষ্টটা বুঝবে, আমাদের কোলের শিশুগুলো কিভাবে প্রতিদিনের বাসর রাতের সানাইয়ের শব্দে দিশাহারা হয়, কিন্তু পালাবার পথ নেই। একমাত্র তোমাদের মত কিছু লোক পারে একটু আলোর পথ দেখাতে। কই রে তোরা আয়! যে কটাকে পেরেছি আমার ঘরে লুকিয়ে এনে রেখেছিলাম দিদি তোমরা আসবে শুনে। ওদের মায়েরা ভয়ে ছাড়তে চাইছিল না কিন্তু আমি বললাম- আমায় দেখে তোদের শিক্ষা হয় না! আমি যদি সব হারিয়েও তুফানের সামনা করতে পারি তাহলে তোরা কেন পারবিনা রে, তোদের তো পেটের বাচ্চা! আমার ছেলেটার বড় আশা জন্মেছিল দিদি, ওই যবে থেকে বাবাসাহেব পড়াতেন তবে থেকে। ও বলেছিল মা, আমি অফিসে কাজ করে তোমায় এখান থেকে নিয়ে যাবো। আমাকে নাকি আর বাবার পরিচয় বলতে হবে না সেই আমায় দেখবে, কিন্তু আমি খুব হাসতাম বলতাম দূর পাগল লুকাবো কেন? আমি নিজেই জানি না তোর বাবা কে!
বুকটা মুচড়ে উঠলো সীমার লজ্জা হলো- এই মানুষটাকে সন্দেহ করার জন্য। ততক্ষণে ময়নার ঘরে ছোট বড় মিলিয়ে দশ বারোটা বাচ্চা... সবচেয়ে ছোট একটা মেয়ে নোংরা ফ্রক পড়ে সীমার একদম কাছে। ময়না বলে,
-ও ফুলি, এই তোর দিদিমনি। সীমার দু চোখে আনন্দের ঝিলিক। শাড়ির আঁচলে চোখ মুখ পুছে নিয়ে নতুন উদ্যোম সে বাচ্চাগুলোকে কাছে টেনে নেয়। ময়নাকেও বসতে বলে জাগরণ চালায় সে। বলে,
- চলো আজ তোমাদের কবিতা শোনাই। ঘরে গিয়ে মাকে শোনাবে... একে একে বাজতে থাকে -
কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি
বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি
গাড়ি চালায় বংশীবদন,
সঙ্গে যে যায় ভাগ্নে মদন।
হাট বসেছে শুক্রবারে..............

ওদিকে জীপে তখন সীমার চিন্তায় রঞ্জন। আর অলোক বলছিল এই মহিলা হয়তো কাকুর কেসটায় কিছু সাহায্য করতে পারবে। ঠিক তখন তাদের কানে ভেসে আসে দুর থেকে খুব চেনা একটা শব্দ.....
আয়রে ভোলা খেয়াল খোলা
স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়,
আয়রে পাগল আবোল তাবোল
মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়।
অলোক খুব হেসে জড়িয়ে ধরে রঞ্জনকে বলে তুই সত্যিই একটা পাগল। জাগরণ সত্যিই বোধহয় পরিবর্তন আনতে চললো।।

 


অনলাইন-অফলাইন

অরুণোদয় কুণ্ডু

 

 

‘দাদা আজ দেরি করে এলেন যে?’ মাছওয়ালা জিজ্ঞাসা করে হেসে।
‘আরে আজ থেকে তো ছেলের স্কুল খুলে গেছে গো। তাই খানিক সময় পেলাম দেরি করে আসার’। চারচাকার চাবিটা পকেটে পুরতে পুরতে উত্তর দেয় সুবীর।
‘ওর স্কুলের সাথে তোর দেরির কী সম্পর্ক?’ পাশ থেকে আশিসের প্রশ্ন।
‘আরে এতদিন তো অনলাইন ক্লাস চলছিল। তাই আগে থেকে বাজার করেই বসে যেতে হত। সে’কী কম ঝক্কি! বাবুর মা আর আমি মিলে হিমসিম খেয়ে যেতাম। ওদের তো আবার ভিডিও অন করে ক্লাস হয়’।
‘সে হোক না, তুই কী করতিস সে’খানে। ক্লাস তো করত তোর ছেলে’।
‘তুই আর কী বুঝবি ভাই, তোর মেয়ের তো স্কুল যাওয়ার বয়স হয়নি। হলে বুঝতিস। ছেলেটাকে একটু আনসারের হিন্ট দিতে হবে না। না হলে ক্লাসে ভালো রেসপন্স করবে কেমন করে’।
‘সেটা স্কুল অ্যালাও করত!?’
‘সে আবার করে। ‘মিস’দের কড়া নজর। আমি তো ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়ে বই খুলে, ওকে ইশারায় দেখিয়ে দিতাম উত্তরগুলো। আর যদি ক্লাসটেস্টের দিন হত, তাহলে তো আর কথাই নেই’।
‘তোদেরই তার মানে পরীক্ষা চলত আসলে’। আশিসের মুখে হাসি।
‘তা যা বলেছিস’।
‘তাহলে এখন স্কুলে ওকে কে হিন্ট দেবে?’
‘ওটাই তো চিন্তা ভাই। ছেলের তো অফলাইনে পরীক্ষা হবে শোনার পর থেকেই জ্বর চলে আসছে টেনশনে। কাল রাতেই ডাক্তারকে ফোন করতে হয়েছিল। কী অবস্থা করে দিয়ে গেল এই করোনা’। বলতে বলতেই ঘড়ি দেখে সুবীর।
‘এই রতনদা আর দেরি করোনা আমাকে অফিস বেরোতে হবে। ওই কাতলাটা দিয়ে দাও। ভালো করে কেটে বেছে দিও। জানোই তো তোমার বৌদি আবার মাছের রক্ত পছন্দ করেনা’।
‘সে আপনাকে চিন্তা করতে হবেনা’।
মাছওয়ালা ওজন করতে থাকে। পাশের ঝুপড়ি চায়ের দোকানটায় দাঁড়িয়ে মাটির ভাঁড়ে একচুমুক দেয় সুবীর। আজ অনেক দিন পরে এখানে দু’দন্ড দাঁড়ানোর সুযোগ পাওয়া গেছে। ‘আচ্ছা চৌধুরীদাকে দেখছি না। আজ আসেননি?’
‘আরে সে তো গেছে ছেলের সাথে কলেজে। বিশাল ঝামেলা চলছে তো’। আশিস বলে।
‘কীসের ঝামেলা?’
‘ছেলেরা বলছে অনলাইনে পরীক্ষা দেবে। অফলাইন হলে পরীক্ষা বয়কট। এদিকে কলেজও মানছে না’।
‘না মানারই তো কথা। তুই জানিস, আমাদের কোম্পানিতে বলেই দিয়েছে লাস্ট দু’বছরের পাস আউটদের যেন না নেওয়া হয় কোনও পোস্টে। ইঞ্জিনিয়ারিং কী আর অনলাইনে পড়ে হয়। হাতে কলমে না শিখলে কিছুই কাজে আসবে না’।
‘ঠিকই বলেছিস। কিন্তু ছেলেরা একবার টুকে অনলাইন পরীক্ষার স্বাদ পেয়ে গেছে। আর অফলাইন দিতে চায়! তুই ভেবে দেখ অনলাইন পরীক্ষা দেবে বলে বিক্ষোভ হচ্ছে। অথচ সেটা কিন্তু অফলাইনে! পোস্টার ঝান্ডা নিয়ে। এই সুযোগে কোনও পার্টি ঢুকে পড়লে তো আর কথাই নেই। ওরা নিজেরাও জানে অনলাইনে প্রতিবাদ করে হয় না। যত সব হিপোক্রিটের দল’।
‘তা যা বলেছিস। এই রতনদা এবার বলো কত লাগবে। তোমার ছেলেটাকে দেখছি না অনেকদিন। কোথায় গেল সে’।
‘তারও তো স্কুল বন্ধ ছিল দাদা। দেখলাম বখে যাচ্ছে বাড়িতে বসে। ওকে মুম্বই পাঠিয়ে দিয়েছি। সোনার কাজ শিখল কিছুদিন। এখন একটা দোকানে কাজ করে। আমার এক চেনা ভাই আছে সেখানে। ওর সাথেই থাকে। এখন ওই ফোনে ফোনে দেখা হয়, কথা হয়’। পকেট থেকে একটা স্মার্ট ফোন বার করে দেখায় মাছওয়ালা রতন। ‘প্রথম মাসের মাইনের টাকায় কিনে দিয়েছে ছেলে। ওই যে কী বলো গো তোমরা, অনলাইনে অর্ডার করে’। রতনের মুখে চওড়া হাসি।
কোনও উত্তর না দিয়ে চুপচাপ টাকা মিটিয়ে পার্কিংয়ের দিকে এগিয়ে যায় সুবীর। পকেটের আইফোনের থেকে ওই রতনের পাতি ফোনটা বেশি দামী মনে হচ্ছে এখন। রতনের ছেলেটা বাবুর থেকে দু-তিন বছরেরই বড় হবে। আর বাবুকে এখনও স্কুলের ব্যাগটা গুছিয়ে দেয় অনিতা। হিসেবটা মিলতে চায় না। ‘দোকানে কাজ করছে? ছ্যাঃ!’ বলে হয়ত ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেবে বাড়ির লোক। কিন্তু সুবীর জানে, মোটা অঙ্কের মাইনে দিয়ে ওই চওড়া হাসিটা কেনা যায় না। তাহলে কী তাদের পরিশ্রম জলে গেল? নাকি সবটাই নিয়তি?