রত্না চক্রবর্তী
২২.১২.২১
আমার গল্পে ঝুলি ফুরাবে না কিন্তু অন্য রহস্যে যেসব গল্প লিখি বা ঘটনা
বলি সেগুলো স্টক ফুরিয়ে আসছে। এমন ঘটনা আর শুনতে পাইনা। তাই ভাবছিলাম এবার
অন্য রহস্য বুঝি আর লেখা হবে না। কিন্তু যতবারই ভাবি গল্পের জোগান ঠিক হয়ে
যায়। আমার একটি চ্যানেলে এসব গল্প করি। সেখানে এই কথা শুনে আমার এক বান্ধবী
আমাকে ঘটনাটি পাঠিয়েছে এত ভালো লেগেছে তাই আমি আপনাদেরকে জানাচ্ছি।
আমারই বান্ধবীর নাম মনি। অসমবয়সী বন্ধু আমরা। আমি আর মনি একসাথেই একটা
কিন্ডারগার্টেন স্কুলে টিচারী করতাম। সেই সুত্রেই আলাপ হয়। খুব সুন্দর যোগ
ব্যায়াম করত। অল্প বয়সে কি হবে অত্যন্ত ঠাকুর ভক্ত ছিল। নিজের ঘরে ঠাকুর
ছিল। তাদের রোজ সেবা করা ধূপধূনো দেওয়া, খাওয়ানো, সাজানো তার রোজকার কাজ
ছিল। সে প্ত্রায় থাকুরের স্বপ্ন দেখত। এমন দেখত যেন জীবন্ত। এমনিতে সে
তারামার ভক্ত কিন্তু স্বপ্ন যেগুল্য দেখত সেগুলো নানা ঠাকুর দেবতার, সে
আলাদা করে ভালো চিনতেও পারত না। এত অল্প বয়সী মেয়েদের মধ্যে এমনটি বড়
একটা দেখা যায় না। এটা আজকের গল্প না আমরা তখন দুজনে শিশুঘর স্কুলে কাজ
করতাম।
তা যাইহোক মনির ছোটবেলা থেকেই মা-বাবা ছিলনা, বড়দিদিকে মায়ের মত ভালবাসত।
মা বলি কেন, দিদি, বন্ধু, বাবার স্নেহ মমতা শ্রদ্ধা ভালবাসা সব গিয়ে
পড়েছিল তার দিদির উপরে। তাকে পাগলের মত ভালবাসত। দিদিও সন্তান সমান স্নেহ
মমতায় আগলে রেখেছিলেন বোনটিকে। তা এই দিদির মধ্যবয়সে ক্যান্সার ধরা পড়ল।
পাগলের মত হয়ে গেল মনি। প্রচুর চিকিৎসা ডাক্তার দেখানো হল কিন্তু খুব
খারাপ অবস্থায় ধরা পড়েছিল। তা আর কোন আশা ছিল না কিন্তু মনে পাগলের মত
কান্নাকাটি করতে ঠাকুরের কাছে। ঠাকুরের কাছে বসে থাকাটা সময়টা তার আরো
বেড়ে গেল।
এমন সময় সে প্রায় প্রতিরাতেই ভারী অদ্ভুত স্বপ্ন দেখত। বিভিন্ন রকম ঠাকুর
তাকে সে বলছে, "ছেড়েদে ছেড়েদে রে, বড্ড কষ্ট পাচ্ছে, অমন কেঁদে কেঁদে
আঁকড়ে রাখিস না, এভাবে আগলে রাখা যায় না, যেতেই হবে, এমন করে আকুল হয়ে
কাঁদিস না। " এ রোজের ঘটনা হয়ে দাঁড়ালো, মনি কিন্তু আশা ছাড়ত না।সে ভাবত
দিদিকে নিয়ে এত ভাবে বলে আর ডাক্তার শেষ কথা বলে দিয়েছে বলে এমন স্বপ্ন
দেখে। সে কান্নাকাটি করেই যেত কিন্তু মৃত্যুকে আটকানো গেল না। এসব সত্ত্বেও
দিদি একদিন মারা গেলেন।
মনি যেন পাথর হয়ে গেল। তার যেন সব কান্না অকস্মাৎ শুকিয়ে গেল। এমন হয়ে
গেল যে যারা ওকে খুব ভালবাসতো তারা ওর কষ্টটা বুঝে তাকে কাঁদাবার চেষ্টা
করল। কিন্তু মনি যেন কেমন হয়ে গিয়েছিল। কি হয়েছে সেটা যেন ভালো করে
বুঝতে পারছে না, বিশ্বাস করতে পারছে না। দিদি আর কখনো আসবে না, ভাবতেই
পারছে না।
এই অবস্থার ঠাকুরের উপর এত তীব্র রাগ, বিদ্বেষ হল। ঠাকুর সে ছোটবেলা থেকে
প্রিয়জনের মতো ভালবাসে, সেই ঠাকুর তার কাছ থেকে এমন করে তার দিদিকে কেড়ে
নিল। তার তো আর কেউ ছিল না দিদি ছাড়া।সে ঠাকুর পুজো করা একদম ছেড়ে দিল
তার বুকের মধ্যে তীব্র অভিমান।দিদি মারা গেছে দিন পনেরো কুড়ি হয়ে গেছে
মনি ঠাকুরের ধূপধুনো জল খাবার কিছুই দেয় না। ঠাকুরের সামনেই দাঁড়ায় না
কোনদিন।
রাতে ঘুম আসেনা মাঝরাত পেরিয়ে যায়। সকালে উঠতে পারেনা। ভোরের দিকে
ঘুমিয়ে পড়ে, এক আলসেমি ধরে। এমনই একদিন প্রতিভা বৌদি আসলেন বেশ সকালবেলা,
তখন প্রায় সকাল সাড়ে ছয়টা হবে। প্রতিভা বৌদি তাকে খুব ভালোবাসেন। সকালে
দরজা ধাক্কানো শুনে দরজা খুলে দিয়ে বেরিয়ে মনি অবাক হয়ে গেল।" এত সকালে
বৌদি? কারো কিছু হয়েছে নাকি? " মনি বলল।
আসলে তার ভেতরটা তখনো একটা কিছু অঘটনের ভয়ে যেন আকুল হয়ে থাকে। মনে হয়
কোথায় বিপদ ঘটবে। প্রতিভাবৌদি ঘরে ঢুকে বললেন," চল ভেতরে চল তোমার সাথে
ভীষণ জরুরী কথা আছে। "
ঢুকেই উনি মৃদু ধমকের সুরে মনিকে বললেন," এসব কি পাগলামি হচ্ছে মনি? দিদি
চলে গেছেন খুবই দুঃখের, আমি তোমার দুঃখটা বুঝি কিন্তু তা বলে ঠাকুর দের
নিয়ে এসেছ,রেখেছ, তাদের পুজো দাওনা, স্নান করাও না, জল দাও না, খেতে দাও
না, এটা কেমন কথা? কোন ছোট বেলা থেকে তুমি এসব করে যাচ্ছে বলতো? শোক বুকে
বসে থাকলে হবে? তোমাকে আবার সব ঝেড়ে ফেলে স্বভাবিক ভাবে বাঁচতে হবে। নিজকেও
তো কিছু না কিছু খেতে হচ্ছে! তবে কেন ঠাকুরের সেবা বন্ধ করে দিয়েছো? "
ভীষণ অবাক হয়ে গেল মনি! এ কথা প্রতিভাবৌদি জানলেন কী করে! তার বাড়ির আর
কেউ তো জানেনা। মনি জেদি সুরে বলল, " আর পুতুল খেলতে ভালোলাগে না বৌদি, ও
পূজো পূজো আমি আর খেলব না। মেরিটেশনও আমি করতে পারছি না গো। যে ঠাকুরের কোন
ক্ষমতাই নেই,৷ সেই যখন সব নিয়তির হাতে তখন সেই ঠাকুর নিয়ে আমি আর কোন কিছুই
করব না। ও তুমি আমায় বলো না। "
প্রতিভা বৌদি প্রচুর বোঝালেন, "তুমি কি বলছ জীবন থাকলে মৃত্যু থাকবেই। কোন
মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকে না। হ্যাঁ তোমার দিদি সময়ের অনেক আগেই মারা গেছে,
সবের পিছনে কিছু না কিছু কারণ থাকে। এভাবে জীবনকে ছেড়ে দিও না, তলিয়ে
যাবে। মনি আমি স্বপ্নে দেখেছি তিনদিন পর পর, ঠাকুর আমায় এসে বলছেন মনি
কারো কথা বুঝছে না, একটু বুঝিয়ে বল তাকে। আবার পুজোয় বসতে বল এরকম ভাবে
থাকলে ও পাগল হয়ে যাবে। ওকে বোঝাও স্থির হতে। ওর কষ্টে যে আমার কষ্ট
হিচ্ছে। তুই বললে ও শুনবে, ও তোকে ভালোবাসে, মানে। "
মনি এবার কিছুটা অবাক হয়ে গেল সে যে পুজো করে না সেটাতো প্রতিভা বৌদির
জানার কথা নয়। তবু সে জেদ ধরে বসে রইলো মুখে আর কিছু বলল না মাথা নিচু করে
বসে আঙ্গুল খুঁটতে লাগল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন
প্রতিভা বৌদি। যাবার আগে বলে গেলেন নিজেকে একটু ধর মনি এভাবে চলে না।"
মনি ভিতর থেকে কান্না ঠেলে বেরিয়ে আসছিল। তার মধ্যে রাগের থেকেও বেশি
অভিমান। সে কিছুতেই ঠাকুরের আসনের সামনে গিয়ে আর দাঁড়াতে পারল না।
এর কিছুদিন বাদে টুম্পা বলে একটি মেয়ে সে আসলো মনির কাছে। সেও মনিকে বড়
ভালোবাসে। আর মনির মতোই ঠাকুরের বড় ভক্ত। মনি তখন গেটের কাছে দাঁড়িয়ে
ছিল। তার বাড়ির পাশেই শিবমন্দির। সেখান থেকে বেরিয়ে এসেই টুম্পা মনির হাত
চেপে ধরলো। বললো," আমি তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম।এ কি করছো মনি, এ একদম ঠিক
নয়। তুমি আবার ঠাকুরের পুজো করো। তোমার জন্য ঠাকুর কেঁদে কেঁদে ফিরছে। আমি
পরপর কয়দিন স্বপ্ন দেখেছি ঠাকুর কাঁদছে, বলছে, "মনিকে বল আমার সামনে বসে
কাঁদতে.।আমরা দুজনে বসে কাঁদি। এমন করে না জীবন থাকলে মৃত্যু আসবে। এভাবে
থাকলে তো ও পাগল হয়ে যাবে। ওকে বল আমি ওর পুজো চাইছি আমি ওর পুজোর জন্য
কাঁদছি।"
মনি শরীরের মধ্যে যেন একটা কাঁপন ধরে গেল। হ্যাঁ, সে কদিন হল প্রতিরাতেই
শোনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেউ কাঁদছে ঘরের মধ্যে। সে ঘুমুলে দেখতে পায়
ঠাকুরের চোখ দিয়ে জল ঝরছে। সে জোর করে মনটা অন্যদিকে করে। কখনো ঠাকুরের
আসনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় না, দরকার নেই ঠাকুরের যদি তার কোনো ক্ষমতা নাই
থাকবে তবে তাকে পূজো করে লাভ কি? টুম্পা বলল," তবে কি তুমি লাভের জন্য,
পাওয়ার জন্য পূজো করতে? তোমার ভালোবাসা তবে ছিল না! "
মনি চমকালো। টুম্পারও তো এসব কথা জানার কথা না, সে যে পূজো করে না তা জানার
কথা নয়। রাতে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলো তার সব ঠাকুরের চোখ দিয়ে জল ঝরছে কোন
কথা নেই, শুধু চোখ দিয়ে জল পড়ছে। মনি আকুল হয়ে কাঁদলো... পাগলের
মত...অনেকদিন বাদে কেঁদে বালিশ ভিজে গেল ঘুমন্ত অবস্থায়।
এরপর মনি ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিল। এখন বহুদিন হয়ে
গেছে। ফোনে যখন আমায় ঘটনাটা বলছিল তখন তার আবেগে গলা কাঁপছিল। আমারও কেমন
মনটা উতালপাতাল করে উঠেছিল। তাই আমার মতো মানুষদের জন্য পাঠালাম।
কাল্পনিক
নীলাঞ্জনা সরকার
কিছু গল্প শুরু হলে যদিওবা শেষ হয় ভয়ের রেশটুকু থেকে যায়। কিন্তু
আমার মনে শুধু ভয় নয়, অবর্ণনীয় অনুভূতি থেকে গেছে এক মাকে নিয়ে।
আমি তখন কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। আমার প্রিয় বন্ধু সূর্য এসে
একদিন আমায় বলল,
-আমি কয়েকদিনের জন্য দাদুর বাড়ি যাবো। তুইও চল।
-এখন তো কলেজ পুরোদমে চলছে! পুজোর এক সপ্তাহ পরেই তখন চল।
- কাল দিদা ফোন করে খুব কাঁদছিল। বাবা আমাকে যেতে বলেছে।
সূর্যর দাদুর বাড়ি অশোকনগরে। বুঝলাম ও আমাকে সাথে চাইছে। পরদিন পৌঁছে
গেলাম।
সূর্যর দিদা আমাদের দেখেই মনিকে ডাকলো। মনির মা দিদাকে সংসারের কাজে
সাহায্য করে। ফ্রক পরা মেয়েটি এলে দিদা বললো,
-ওর সারা গায়ে কটকটে যন্ত্রনা। মনে হচ্ছে গোটা শরীরে কেউ দাঁত বসিয়ে
দিয়েছে। কিরে! কষ্ট হচ্ছে না তো?
মনি একটু টলে যায়। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল কষ্টটা ছিল ভয় লজ্জা সবকিছু
মিশিয়ে!
সূর্য জিজ্ঞেস করে,
-ওর মা কোথায়?
দিদা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে,
- সর্বনাশী! ওইতো যত নষ্টের গোড়া। ওকে একটা ঘরে বন্ধ করে রেখেছি।
- কেন?
- 'মা' শব্দটা ওর জন্য নয় ও তো একটা ডাইনি। রাতে ওরা দুজনে এক ঘরেই
ছিল হঠাৎ মনি কেঁদে ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে। আমাদের ঘুম ভেঙে যায়
আমরা গিয়ে দেখি মনির মা শান্ত হয়ে বসে, ওর মুখে রক্ত।
- এ কি বলছো দিদা? মাসি ডাইনি! এ আবার হয় নাকি! দাদু কোথায়?
- তোর দাদু রাগ করে কথা বলছে না।
- আমি একবার মাসির সাথে কথা বলতে চাই।
- খবরদার। ও কাজ করতেও যাস না। সবাই বলছে ও ঘরে যে ঢুকবে ডাইনি তাকে
ছাড়বে না।
- তুমি তো পরশু ফোন করেছিলে সেই থেকে মাসিকে বন্ধ করে রেখেছো নাকি?
আমি রীতিমতো আঁতকে উঠি পরিস্থিতি দেখে। সূর্যর দিকে তাকাই। ইশারায় ওকে
বোঝাতে চাই ওই মহিলার কিছু হয়ে গেলে থানা পুলিশ হবে। বলি,
- সূর্য, মনির সাথে ওর মায়ের সামনেই আমরা কথা বলি চল।
সূর্য আর আমি এগিয়ে যাই দিদিমার বারণ সত্ত্বেও।
বন্ধ ঘরের দরজা খুলে যা দেখি তাতে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। ওই মহিলা
অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। মুখে রক্ত শুকিয়ে লেগে । ঘরে প্রস্রাবের গন্ধ।
মনে হয় দরজা বন্ধ বলে ঘরেই করেছে। শাড়িতে বমি মাখামাখি। কোনরকমে তাকে
দুজনে ধরে বাইরের উঠোনে নিয়ে আসি। সূর্য খুব রেগে তার দিদাকে বলে
ডাক্তারকে ফোন করতে। ততক্ষণে দিদার শোরগোলে দাদু নেমে এসেছিল। পাড়ার
লোক উঁকি মারাও শুরু করেছিল। সূর্য প্রায় কেঁদে ফেলে আমাকে জড়িয়ে।
- অবিনাশ, এ কি অবস্থা! এক মাকে ডাইনি নাম দিয়ে এত অত্যাচার! অথচ দেখ
বাইরে আর এক মাটির মা আসবে বলে কত তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে!
আমি ওকে শান্ত করি। সূর্যর দিদা ততক্ষণে দোতলার ঘরে চলে গেছে। আমি পিছন
ফিরে প্রতিবেশীদের ভিতরে ডাকি আর জিজ্ঞেস করি এই মাসিকে নিয়ে ওরা তেমন
কিছু জানে কিনা? কিন্তু প্রত্যেকেই বলে ডাইনি না হলে নিজের মেয়েকে এমন
কেন করলো! আমি খুবই অবাক হই। সূর্যর দাদুর বাড়ি অশোকনগরে একটু ভিতর
দিকে। কিন্তু আশেপাশে স্কুল আছে। চারপাশের মানুষ মোটামুটি শিক্ষিত বলা
চলে তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ কি করে এত বুদ্ধিহীনতার পরিচয় দিল?
বিশেষ করে সূর্যর দিদা! আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল সূর্যকে দেখে। ম্লান
মুখে বসেছিল সে। আমি ব্যাগ থেকে জলের বোতল নিয়ে দিলাম,
- একটু জল খা সূর্য।
-কিছু ভালো লাগছে না রে। দাদুর কি অবস্থা দেখেছিস! দিদার এমন ভিমরতি কি
করে হলো ঠিক বুঝতে পারছিনা! এখন শেষরক্ষা হলে হয়!
- দাদুভাই, এসব আমারই ভুল। তোর দিদা কিছুদিন হল পাড়ার দক্ষিণ কোণে যে
শনি মন্দির আছে সেখানে যাচ্ছিল। ওখানকার পুরোহিতটি নাকি দিদার দীক্ষার
ব্যবস্থা করবে। প্রথমে বারন করেছিলাম কিন্তু পরে আর আটকাইনি। ভেবেছিলাম
পুজো নিয়ে থাকলে দিদার মনটা ভালো থাকবে। তখন বুঝিনি এ পুজো ভক্তকে
চায় না আসলে এ হলো ভক্তির আড়ালে চরম ভন্ডামী। ওই মানুষটাই বোধহয়
দিদার মাথায় এসব কুসস্কার ঢুকিয়েছে। নয়তো তোর দিদা হুট করে কেন বদলে
গেল!
-তুমি চিন্তা করো না দাদু আমি একটা ব্যবস্থা করবো। সবচেয়ে আগে মাসির
ঠিক হওয়া প্রয়োজন।
সূর্য জল খায়। ওপরে তাকায়। দিদাকে দেখতে পায় না। দাদুর চোখে মুখে
অপরাধবোধ। একদিন কেটে গেছে। মাসিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সে এখন
বেশ খানিকটা সুস্থ। কিন্তু মনির মুখ থেকে একটা কথাও বের করা যায়নি। কি
লুকোচ্ছে সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। এখন মাসির জন্য অপেক্ষা করা
ছাড়া কোনো গতি নেই। দিদা এরমধ্যে নিচে নামেনি। ওপরেই তার খাবার দেওয়া
হয়েছে। আমি আর সূর্য ওই শনি মন্দিরেও গিয়েছিলাম পুরোহিতের খোঁজে
কিন্তু তাকে পাই না। মন্দিরের ঠিক উল্টোদিকের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানতে
পারি মন্দির কয়েকদিন খোলেনি। একটা আশঙ্কা কাজ করেছিল মনের মধ্যে ঠিক
যেদিন মনির সাথে এমন হলো তারপর থেকেই কি মন্দির বন্ধ? কিন্তু উত্তর
অজানা! দুদিন পর রাতে দিদার কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে যেতে সূর্যকে
ডাকলাম। দুজনে ওপরে গিয়ে দেখি দাদুর বুকে মাথা রেখে দিদা খুব কাঁদছে
আর দাদু সান্ত্বনা দিচ্ছে। আমাদের দেখে দাদু সূর্যকে বলে,
-তোর দিদাকে ক্ষমা করবি তো দাদুভাই, না বুঝে একটা ভুল করে ফেলেছে।
সূর্য তার দিদার দিকে তাকায়। দিদা বলতে থাকে,
-আসলে মনির মায়ের জ্বর কমছিল না। তোর দাদু জানে ওকে আমি ডাক্তার
দেখিয়েছিলাম কিন্তু কোনো ওষুধে কাজ হচ্ছিল না। তারপর দাদুকে না
জানিয়ে ওই পুরোহিতকে বলেছিলাম সে কথা। উনি বললেন সেদিন রাতে এসে
দেখবেন ওকে। বিশ্বাস কর আমি বুঝিনি ও কত বড় ভন্ড। মনিকে দেখে বলল ওর
মায়ের সারা শরীরে বিষ আর তার প্রভাব পড়ছে মনির ওপরেও। আমি ঘাবড়ে
গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম এর থেকে বাঁচার উপায় তখন সে বলেছিল মনির মা
আসলে একটা ডাইনি, তোর দাদুকেও ছাড়বে না। আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম।
তখন বলল মনির শরীর থেকে এই বিষ বার করতে হবে। আমার তো বয়স হয়েছে বোধ
বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। তারপর ওই লোকটা মনিকে জড়িয়ে ধরে ওর জামা ছিঁড়ে
কামড়াতে শুরু করেছিল। মনির মা অসুস্থ ছিল কিন্তু তাও বাচ্চাকে লালসার
স্বীকার হতে দেখে সহ্য করতে না পেরে ওকে বাঁচাতে এসেছিল। কিন্তু ভন্ডটা
ওর মুখে সজোরে ঘুষি মারে, ও ওখানে পড়ে যায়। লোকটা আমাকে শাসায়, বলে
আমি যদি মুখ খুলি তাহলে তোর দাদুকে মেরে দেবে।
সূর্য দিদার হাত ধরে বলে,
- মাসি তো আগে থেকেই জীবনে বঞ্চনার স্বীকার। শুধু মনির মা হয়ে বেঁচে
আছে। এক মা হয়ে আর এক মাকে তুমি এমন করলে কি করে দিদা! ভাবো যদি মাসির
কিছু হয়ে যেত!
- আসলে পরিবারকে বাঁচাতে 'ডাইনি' শব্দটাকেই আশ্রয় করেছিলাম।
- ওরা আমাদের পরিবারেরই দিদা! এই ডাইনি আখ্যান তো কাল্পনিক, মানুষের
নিজের স্বার্থে।
দিদা মনিকে জড়িয়ে ধরে। মনির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বাইরে যখন মায়ের
আবহনের জন্য সবাই প্রস্তুত হচ্ছিল আমরা আর এক মাকে ফিরে পাওয়ার জন্য
প্রার্থনা শুরু করেছিলাম। এই ঘটনার একবছর কেটে গেছে। মাসির মত কত
মহিলার এমন দুর্দশা হয় ভেবে শিউরে উঠি আজও। ভক্তি ভক্তকে কখনোই পাষাণ
তৈরি করে না বরং তাকে বিনম্র করে। এখনও সেই পুরোহিতের খোঁজ চলছে আর
সূর্যর কাছে খবর পেয়েছিলাম সেই মন্দিরে অন্য এক পূজারী পুজো
করেন...আরতির সময় নাকি অনেকে আসেন পূজারীর মন্ত্র উচ্চারণে মুগ্ধ
হয়ে।