- অরুণোদয় কুণ্ডু
১৯৭১এর ১৬ই ডিসেম্বরের বিকেল, পাক সেনাপ্রধান আমির আবদুল্লা খান নিয়াজি
আত্মসমর্পণ করলেন মুক্তি বাহিনি আর ভারতীয় সেনার যৌথ শক্তির কাছে। ৯৩ হাজার
পাক সেনার এই আত্মসমর্পণ বাংলাদেশের মাটিতে এক নতুন যুগের সূচনা করল। তবে
এই বিজয়ের সলতে পাকানোর শুরু কিন্তু ভারতের সীমান্তে থাকা বয়রা অঞ্চলের
গরিবপুরের জুদ্ধজয় থেকে। আজ সুবর্ণ জয়ন্তীর দোরগোড়ায় এসে সেই গরিবপুরের
যুদ্ধজয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছেও এক লুকিয়ে থাকা সোনালি অধ্যায়। তখনও ৩
ডিসেম্বর আসেনি।শুরু হয়নি মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনার অংশগ্রহণ। ভারতের পক্ষ
থেকে নীতিগত সমর্থন আর পরোক্ষ সাহায্যই তখন মুক্তিবাহিনীর হাতিয়ার।
তবে ২১ নভেম্বরের গরিবপুর পালটে দিয়েছিল পাক রননীতির হিসেবনিকেশ। সাধারণত
বড় যুদ্ধে ব্যাবহার না হওয়া হালকা এবং কম প্রতিরোধ ক্ষমতার পিটি৭৬ টাঙ্ক
দিয়ে পাক বাহিনীর আমেরিকায় তৈরি আধুনিক প্রযুক্তির যুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য এম২৪
চ্যাফি ট্যাঙ্কের সাথে লড়েছিল ভারতীয় সেনা।
একই সাথে আছে পরবর্তী পর্যায়ে যখন পাক প্রতিরোধ প্রায় অদম্য হয়ে উঠেছে তখন,
ভারতীয় বিমান বাহিনীর দাপটে তিন পাক বিমানের বাধ্য হয়ে অবতরণ। যার ভয়
পরবর্তী অনেক যুদ্ধেও পাক বিমানচালকদের পিছু ছাড়েনি। একাত্তরের মার্চ মাসে
মুক্তিযুদ্ধের উষালগ্ন থেকেই এলাকার পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিল স্বাভাবিক
কারনেই। দাঙ্গার পরিস্থিতি শুরু হল অক্টোবর মাস থেকে। সেই সুযোগে
পাকিস্তানি বন্দুকবাজ বাহিনী ভারতের সীমান্ত এলাকায় কখনো বা সীমান্তের
ভিতরে ভারতীয় এলাকায় ঢুকে গুলি লুটতরাজ শুরু করে।
তাদের এই নিরর্থক অত্যাচারই মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর এক হয়ে
প্রতিরোধের ভিত্তিভূমি তৈরি করে। নিজেদের প্রতিরক্ষাকে মজবুত করতেই গোপনে
গরিবপুরে ঢুকে পাকিস্তানি সেনাদের গতিবিধি রদ করার সিধান্ত নেওয়া হয় ভারতীয়
সেনার পক্ষে। দায়িত্ব পড়ে চতুর্দশ ব্যাটালিয়ন পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং সি
স্কোয়াড্রনের উপর। ৪৫ জন অশ্বারোহীর একটি বাহিনীও চলতে থাকে সাথে। ২০
নভেম্বর রাতে শুরু হয় অভিযান।
মূল বাহিনীর আগে একটি টহলদার বাহিনী এগিয়ে এগিয়ে চলছিল। এই নিঃশব্দ
পদচারনার মাঝেই অতর্কিতে সামনে চলে আসে একদল পাকিস্তানী টহলদার। শুরু হয়
বুলেটের ভাষার বাদানুবাদ। পাক বাহিনীর কয়েকজন লুটিয়ে পড়ে। বাকিরা পালায়।
আক্রমণের খবর ছড়িয়ে পড়ে নিমেষে। দায়িত্বে থাকা লেফটেন্যান্ট কর্নেলের
তৎপরতায় আর সময় নষ্ট না করে চার কোম্পানি ব্যাটেলিয়ন এবং ট্যাঙ্ক ঝাঁপিয়ে
পড়ে সন্মুখ সমরে।
এক হিংস্রতায় ভরা যুদ্ধের শেষে রাত তিনটের গরিবপুর দখল করে ভারতীয় সেনা।
এবার পালা পাল্টা আক্রমণ সামলাবার।এক আর্টিলারি পর্যবেক্ষক কে সাথে নিয়ে
এগিয়ে যান ক্যাপ্টেন এমএস গিল। সেই কুয়াশাঘেরা শীতের রাতের যবনিকার ওপারে
শোনা যায় পাকিস্তানী ট্যাঙ্কের পদধ্বনি। তিন স্কোয়াড্রন এম২৪ চ্যাফি
ট্যাঙ্ক তখন মাত্র নয় কিলোমিটারের ব্যাবধানে।
প্রথম আক্রমণের দামামা বেজে উঠল সকাল ছটায়। মেজর ডি এস নারাং তখন আগে থেকে
পাওয়া খবর মত তার ৪৫ অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত শত্রুকে অভিবাদন
জানানোর জন্য। দখল করা এলাকায় ইতিমধ্যই সুচারুভাবে সাজানো হয়ে গেছে
রিকয়েলবিহীন মেশিনগান এবং উভয়চর পিটি৭৬ ট্যাঙ্ক। তাদের সন্মিলিত পরিকল্পিত
ধাক্কায় থেমে যায় পাকিস্তানী প্রতিআক্রমন। আরও তিনবারের আক্রমণেও ভারতীয়
সেনার দুর্গে দাঁত ফোটাতে পারেনি পাক ফৌজ। প্রায় ৬০-৭০ জনের মৃত্যু সাথে
শতাধিক আহত এবং এগারোটি ট্যাঙ্কের মাশুল গুনতে হয় তাদের। ভারতকে হারাতে হয়
তিনটি ট্যাঙ্ক। সাথে দিতে হয় সাত সৈনিকের আত্মাহুতি যার মধ্যে মরণোত্তর
মহাবীর চক্রপ্রাপ্ত মেজর ডি এস নারাংও রয়েছেন। ভূমিতে প্রতিহত হয়ে আকাশে
আক্রমণ শানায় পাকিস্তান। সকাল সাড়ে নটার পরেই শুরু হয় আক্রমণ। খড়ক নদীর
জলসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়।
তাদের আটকাতে ২২ শে নভেম্বর আসরে নামে বায়ুসেনা। তাদের জিনাট এবং মিগের
সমরকৌশলের সামনে তাদের থেকে অনেক নতুন এবং উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরি
পাকিস্তানের এফ৮৬ সাবরে বিমান আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। বিমানচালকেরা
মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দি হন। ভূমি এবং আকাশে পাকিস্তানের এই চূড়ান্ত পরাজয়
তাদের সেনার মনোবল ভেঙে দেয় যা সামগ্রিক মুক্তিযুদ্ধের জয়ের পথ প্রশস্ত
করে। ভারতের পক্ষ থেকে চার বিমানের চালকদেরই বীরচক্র সন্মানে ভূষিত করা হয়।
আজ পঞ্চাশ বছরের ধুলো ঝেড়েও সেনাবাহিনীর বিজয়ের ইতিহাসে ঝলক দিয়ে ওঠে এই
গরিবপুরের যুদ্ধ।