টরন্টো, অক্টোবর ২২, ২০২১, নভো সংখ্যা ২৫
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি বিশেষ নিবন্ধ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল যোগাযোগ আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত

কার্তিকের কুয়াশা

অনুগল্প / সোফিয়া লোরেন

সাইদুজ্জামান

 

 

 

শপিং কার্ট থেকে ব্রকলি, ফুলকপি, গাজর, শিম, মটরশুঁটি, বেল পেপার, বিট-মূল, আর বাঁধাকপির ব্যাগগুলো চেক-আউট কাউন্টারের বেল্টে তুলে দিয়ে নীল লক্ষ্ করলো কাউন্টার ক্লার্কের সাথে সোফিয়া লোরেনের কোথায় যেন একটা মিল আছে। ইতালীয় হবে হয়তো। বয়স বেশি নয়, বড়োজোর বাইশ। একটু ঝুঁকে ওর নেম-ট্যাগ দেখতে গিয়ে নীল দেখতে পেলো সুন্দরীর নাম মিরাবেলা এবং তার ব্লাউজের ওপর থেকে তিনটে বোতাম খোলা। মিষ্টি হেসে 'হাই মিরাবেলা! হাউ আর ইউ টুডে' বলে চোখ সরিয়ে নিয়ে পরক্ষনে আবার যখন তাকিয়েছে নীল, ততক্ষনে মেয়েটি সবগুলো বোতাম লাগিয়ে নিয়েছে। দু-মিনিট না যেতেই আবার মিরাবেলা বোতাম তিনটি খুলে দিয়েছে। নীল মৃদু হাসলো। স্পষ্টতই মিরাবেলা নিজের স্ট্রেংথ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। মিরাবেলাও হেসে বলল, "জানি না আপনি কী রান্না করবেন, তবে খুব সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর বলেই মনে হচ্ছে"। সব্জিগুলো সব স্ক্যান করে শপিং কার্টে সাজিয়ে দিল মিরাবেলা, নীল ক্রেডিট কার্ড ট্যাপ করে পে করলো। ও রিসিট হাতে ধরিয়ে দিতেই নীলও তার বিজনেস কার্ড মিরাবেলার হাতে ধরিয়ে বলল, ' হোয়াই ডোন্ট ইউ জয়েন মি ফর ডিনার?" মানুষ জাল টাকা যেভাবে পরীক্ষা করে, মিরাবেলা সেভাবে খুব মনোযোগ দিয়ে বিজনেস কার্ডটি পরীক্ষা করে সম্ভবত ভাবছিলো রাখবে না ফিরিয়ে দেবে। শেষবর্যন্ত রেখেই দিলো।

 

নীলের হন্ডা সিভিক বড়ো রাস্তায় এসে পড়তেই সোফিয়া লোরেনের কথা আবার মনে পড়লো। একা  একাই হেসে উঠলো নীল। টরন্টো থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে চমৎকার একটা গ্ল্যাম্প ক্যাম্প আছে।  মিরাবেলা যদি ফোন করে, তবে গহীন বনের ভেতর এক বনভোজন  হয়ে যেতে পারে নিশ্চয়ই এক উইকেন্ডে। নীল গুনগুনিয়ে গান ধরলো , " হেই মাম্বো, মাম্বো, ইতালিয়ানো .... 

 

 


 

 

বন্ধনহীন

রত্না চক্রবর্তী

 

১.১০.২১.
ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল অপর্ণা আর শ্যামলী শ্যামলীর অনুযোগের উত্তরে অপর্ণা তার চিরাচরিত হি হি করে হাসি হেসে বলল "আরে ধুর দারুণ আছি, এই বন্ধনহীন জীবন, এই উন্মুক্ত জগতে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবার সুযোগ, বেশ আছি ভাই। ""
শ্যামলীর কোলে তার ছোট মেয়েটা ততক্ষণে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আলসের সিমেন্টের টবের উপর রাখা একটা উড়ন্ত প্রজাপতির দিকে। খুব প্রাণবন্ত দুরন্ত হয়েছে শ্যামলীর এই মেয়েটা। ছেলেটা কিন্তু এত দুরন্ত না, ভারী মিষ্টি স্বভাবের সারাক্ষণ বাপের সাথে খেলে যাচ্ছে। কথা একটু কম বলে আর মেয়ের মুখে কথার ফুলঝুরি। হাতে-পায়ে দুরন্ত কচি কচি হাত দিয়ে দুহাতে ধরে ওঠার চেষ্টা করছে অপর্ণাকে। তার খুব ভালো লেগেছে অপর্ণাকে। হেসে বলে শ্যামলী " কি দুরন্ত হয়েছে না! " অপর্ণা শ্যামলী ছোটবেলার বন্ধু আবার কলেজে তারা একসাথেই পড়েছে। অপর্ণা খেলাধুলোয় খুব ভালো ছিল।
শুধু অপর্ণা কেন ,অপর্ণা শ্যামলী শ্যামলীর বর অরুণ তার যমজ ভাই তরুণ, বিকাশ কান্ত, শীলা মনিকা সবাই একসাথেই কলেজে পড়তো। পরে অরুণের সাথে বিয়ে হয় শ্যামলীর। বরাবরই খুব দুরন্ত চঞ্চল প্রকৃতির ছিল অপর্ণা খেলাধুলার জগতে ও যেমন, হৈ-হুল্লোড়েও তেমন সবাইকে মাতিয়ে রাখতো। লম্বা একহারা চেহারা একটু কঠিন অথচ আকর্ষণীয়। সবাই খুব ভালবাসতো আর পাঁচটা মেয়ের মতো নয় বলেই হয়তো। অপর্ণার কলেজ লাইফে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল অরুণ। সে প্রথম প্রপোজ করেছিল অপর্ণাকে। অপর্ণা বলেছিল "বন্ধুত্ব হচ্ছে একটা খোলা আকাশ, সেখানে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো যায় সোনালী রোদ গায়ে মেখে। কিন্তু প্রেম আনুষঙ্গিক ভাবেই তারপর বিয়ে, বাসা বাঁধা, ঘর সংসার,তার মধ্যে বদ্ধ হয়ে থাকা ও ভাই আমার পোষাবে না। তোকে পছন্দ করি না এমন নয় কিন্তু বিয়ের কথা আমি ভাবতে পারিনা। শুধু অরুণ নয় বিকাশ, কান্ত , রণো আড়ালে তাকে প্রপোজ করেছিল। উত্তর একই ছিল। আসলে অপর্ণা ঠিক সংসারে বাধা পড়ার মত মেয়ে ছিল না। অথচ সবাইএর বিপদে গিয়ে দাঁড়াত, এত আন্তরিক ভাবে মিশতো যে সবার সঙ্গেই একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু অপর্ণার থেকে সবাই একে একে সরে এসেছিল। হয়তো কিছুটা আহত হয়েছিল তাদের পৌরুষ। তবে একটা ভালো অপর্ণা কাউকেই বিয়ে করেনি। মেয়েরা অপর্ণাকে তেমনভাবে কেউই ভালোবাসত না। শুধু শ্যামলী ছাড়া। বন্ধুরা সবাই মোটামুটি সংসারী হয়ে গেছে অপর্ণা যাবার আগেই। অপর্ণার এখানে কি একটা প্রাইভেট জব করছিল। পরে বাইরে অফার পেয়ে চলে যায়। বেশ কিছুকাল অপর্ণা সেখানেই ছিল। সময় অনেক গড়িয়েছে অপর্ণা দেশে ফিরেছে মাস দুই হলো। তার স্বভাব এখনো তেমন রয়ে গেছে। একে একে পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
বন্ধুরা এবার তাকে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছে। কোনো পুরনো ঘটনার রেশই নেই কারো মধ্যে। সবারই ঘরভর্তি। ছেলেমেয়ে এতটাই বড় হয়ে গেছে যে অপর্ণার রীতিমত অবাক লাগলো। সবার শেষে অরুণ আর শ্যামলীর বাড়ি এসেছে কারণ ওরা মফস্বলের একটু ভেতর দিকে থাকে। এখানে এসে শ্যামলী অরুণকে দেখে, তাদের সংসার দেখে চোখ জুড়িয়ে গেছে অপর্ণার। জায়গাটা একটু ফাঁকা এখনো সবুজের ঘেরাটোপে ঘেরা, বেশ লাগছে। ছাদে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল দুজনে। ছাদ বড় ভালোলাগে অপর্ণার। মুক্ত আকাশ যেন মুক্তির স্বাদ আনে।
শ্যামলীই বলেছিল " এই অনেক বয়স বেড়েছে এবার বিয়ে করে ঘরে বোস। সারাজীবন এমন একলা ভেসে বেড়াবি নাকি? "
উত্তরে অপর্ণা বলেছিল " জানিস তো ভাই আমি তোদের মতো এত দায়দায়িত্ব নিতে পারি না, এত সংসারে মানিয়ে চলতেও পারব না, এত বন্ধন আমার সয় না। বেশ আছি মুক্ত স্বাধীন। "
একটু ভেবে সংকোচে শ্যামলী বলে "কিন্তু যখন বয়স হবে আর ঘোরাঘুরি করতে পারবি না তখন তোকে কে দেখবে? "
অপর্ণা তার চিরাচরিত উদার হাসি হেসে বলল "আরে বুড়ো বয়সে বর যে দেখবে এর কি মানে আছে? কে বাঁচে কে মরে কেউ জানে? তাছাড়া ওল্ড এজ হোম আছে চলে যাব। সেখানে আমার মত অনেক লোক আছে। কেটে যাবে। তাছাড়া তোরা তো রইলই। "
শ্যামলী তার হাতটা জড়িয়ে বলেছিল "যদি তেমন কখনো মনে হয় আসবি তো আমার বাড়ি? লজ্জা পাবি না তো? আমার কাছে চলে আসবি। দুই বন্ধু একসাথে থাকব। " হেসে ফেলেছিল অপর্ণা কিন্তু অত সুন্দর আর লাগছিল না হাসিটা। একটা ব্যথা যেন কোথায় লুকিয়ে ছিল। "এটা তোর শ্বশুর বাড়ি? একটা ব্যাটাছেলে মার্কা মেয়েকে এনে রাখলে কেউ কিছু বলবেনা? "
শ্যামলী হাসল "এটা আমার সংসার, এটা আমার ঘর, যত ছোটই হোক আমি এখানকার রানী। আগে আমার শাশুড়ি ছিলেন কিন্তু এখন তিনি আমার মেয়ের দলে পড়ে গেছেন। কাজেই এটুকু অধিকার আমার আছে। তুই নিশ্চিন্তে চলে আসিস। আর অরুণ কখনোই আমার উপর কোন কথা বলেনা। "
অপর্ণা হাসল" ঠিক আছে তেমন যদি কখনো মনে হয় চলে আসব। "
নিচ থেকে শ্যামলীকে অরুণ ডাকল " মলি নিচে এস, দেখ অপর্ণার জন্য ওর পছন্দের বড় বড় কইমাছ পেয়েছি। " একমুখ হেসে শ্যামলী বলল, "আসছি..." মেয়েটাকে রেখে শ্যামলী ছুটে নিচে নেমে গেল।
কচিকচি হাতে বাচ্চাটা অপর্ণার চশমাটা খুলে নেবার চেষ্টা করতে লাগল আর মেয়েটা অপর্ণা মুখ সরিয়ে নিলেই খিলখিল হাসি হাসতে লাগল। শেষ বিকেলের পড়ন্ত রোদে অপর্ণার চির পরিচিত সতেজ হাসিমুখটাকে কেমন যেন করুণ লাগছিল। বন্ধনহীনতায় ক্লান্ত একটা মানুষ, মুখে স্বীকার করতে পারে না ক্লান্ত পাখিটা এখন শ্রান্ত হয়ে বাসায় ফিরতে চায় কিন্তু ঘর খুঁজে পায় না। আপনজন ভালোবাসার জন, সম্মান করার জন বেড়ে গেছে অনেক কিন্তু একান্ত একজন কেউ নেই। যে বন্ধন বিদ্বেষীর মুখোশটা সে পরে ফেলেছে সেটা সে আর খুলতে পারছে না। তার সংসারী বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজন যে এই মুক্ত মানবী রূপটা শ্রদ্ধা আর সমীহ করতে শুরু করেছে। মুখটা হারিয়ে গেছে মুখোশের আড়ালে। তাই ক্লান্ত মুক্ত বিহঙ্গ আর বাসায় ফিরতে পারে না।।

 

.

 

নতুন সকাল

-পারমিতা কর

 

মাথায় শিরা উপশিরা দপ দপ করছে সুনিপার। এটা কি হলো! পার্থ এমন ঘর ভর্তি লোকের মাঝে ওকে ওমন অপমান করলো! ভাবতেই পারছে না। পার্থ! ওর পার্থ!

পাঁচ বছর লিভ ইন সম্পর্কের মধ্যে পার্থ আর সুনিপা। একই অফিসে কাজ করার সুবাদে পরিচয়, বন্ধুত্ব তারপর প্রেম। সুনিপার কাজের প্রতি প্রবল নিষ্ঠা। গত মাসে হেড অফিস থেকে ওর প্রমোশন হয়। তার ফল স্বরূপ পার্থ সুনিপার অধীনে চলে আসে।

কিছু দিন ধরে সুনিপা লক্ষ্য করছিল পার্থ ওকে অবজ্ঞা করছে। ও কিছু বললে টালবাহানা করে কাজটা অন্য কাউকে দিয়ে করাচ্ছে। সেদিন এই নিয়ে অফিসে বসের কাছে দু চার কথা শুনতেও হয়েছিল সুনিপাকে। তারপরই বসের কাছ থেকে আবার চেন্নাইয়ের প্রস্তাবটা এসেছিল। যেটা নিয়ে এত দিন দোনামনা করছিল, সেটা মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনও উপায় পেলো না যেন।

আজ ওদের বাড়িতে কিছু বন্ধুদের ডেকেছিল নতুন বছরের পার্টির জন্য। হঠাৎ কিছু বন্ধুর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানতে পারে পার্থ, মিত্র অ্যান্ড সরকার কম্পানিতে চাকরি পেয়েছে। শোনার পর থেকে বোঝার চেষ্টা করছিল পার্থ কবে অ্যাপ্লাই করেছিল! ওকে বলেনি কেন!

পার্থকে ড্রিঙ্ক কাউন্টারের সামনে একটু একা পেয়ে প্রশ্নটা করেছিল শুধু। আর তারপর...

ওখানেই সকল বন্ধুদের ডেকে ওকে এতো অপমান করলো, এমনকি গায়ে হাত তুলতেও গিয়েছিল। এই পার্থকে সুনিপা চিনতে পারছে না।

বেডরুমের দরজা বন্ধ করে নিজের সমস্ত জিনিস গুছিয়ে নিতে নিতে ভাবছিল... মানুষ চিনতে, ভালোবাসা চিনতে এতো ভুল করলো!

ছোটবেলার বন্ধু জয়াকে ফোন করে নিল। কিছু দিন ওর কাছে থাকবে। উবের বুক করে একটা চিরকুটে পার্থর জন্য লিখে বেরিয়ে পরলো।

রাতে ফোনটা এলো। পার্থ হঠাৎ অসুস্থ অনুভব করাতে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে বন্ধুরা।

সবে ফ্রেশ হয়ে বসেছিল জয়ার কাছে। এখন আর ইচ্ছে করল না হাসপাতালে যেতে। কাল সকালে সব ঠিক থাকলে পার্থকে কিছু কথা বলবে ভেবে ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেল। পার্থকে ফোন করলো। সৌমেন ধরল ফোন। ওর থেকে জানতে পারলো পার্থর একটা ছোটো মতো হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। এখন ঘুমোচ্ছে। সকালে যাবে হাসপাতাল, বলে ফোন রাখলো।

সারারাত আর চোখের পাতা এক হলো না। কোথা থেকে শিউলির গন্ধ ভেসে এসে শরৎ কালের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে...!
ভোরের আলো ফুটতেই গাড়ি বুক করে হাসপাতালে গেল। ডাক্তার দেখছিলেন পার্থকে। সুনিপাকে দেখে সৌমেনরা বাড়ি ফিরে গেল তখনকার মতো। ডাক্তার বের হতেই ওনার সঙ্গে কথা বলে পার্থর কাছে গেল। পার্থর চোখে মুখে বিষণ্ণতার কালো ছায়া। কিছুই কথা বলছে না। সুনিপা নিজের হাত রাখলো পার্থর একটা হাতে। অন্য হাতে স্যালাইনের চ্যানেল লাগানো।

পার্থর চোখে জল। সুনিপা বলল,
-কেমন লাগছে তোর?

পার্থ ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো।

- আমায় ছেড়ে যাস না। আমি পারবো না তোকে ছেড়ে থাকতে।

সুনিপা বলল,
-পার্থ, আমার তোকে বলা হয়নি। গতকাল রাতেই বলতাম। আমি আগামী কাল অফিসের কাজে চেন্নাই যাবো চার মাসের জন্য। বসের সঙ্গে সব কথা হয়ে গেছে। যদি ওদিকে অফিসের ব্রাঞ্চ সেটআপ হয়ে যায় এর মধ্যে তাহলে আমাকে ওখানেই থেকে ওদিকের সব দায়িত্ব নিতে হবে। তাই আজ থেকে আমরা যে যার পথে চললেই ভালো হবে। তোর বিপদ কেটে গেছে শুনলাম ডাক্তারের থেকে। আমি এখন অফিসে যাবো কিছু ফাইনাল কাজ বাকি আছে। মন খারাপ করিস না। আমাদের সম্পর্ক এই পর্যন্ত থাকলো। তুই কখনও চাসনি যে, আমি চেন্নাই যাই। কিন্তু এখন আর উপায় নেই। যদি বন্ধু ভাবিস তবে পাশে পাবি। তার বেশি আর কিছু সম্ভব নয়।

সূর্যের আলো হাসপাতালের করিডরে পড়ে সুনিপার ভবিষ্যতের পথ আলোকিত করছে যেন! উপরে চোখ যেতেই নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘের ভেলা দেখে এতক্ষণে সুনিপার মনে হলো , আগমনীর জন্য চারিধারে সাজো সাজো রব।
মনে মনে মায়ের কাছে আগামী দিনের জন্য সাহস চেয়ে... অফিসের পথে পা বাড়ালো।


পার্থ হতবাক, ঝাপসা চোখে সুনিপার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তখনও...



 

 

বহ্নি...

নীলাঞ্জনা সরকার

 

 

 

পাড়ায় শাঁখ বেজে উঠলো কয়েক ঘরে। সন্ধ্যারতির সময়। তপন নাইট স্কুলে সেদিন সন্ধেতেই পৌঁছে গিয়েছিল। বিমল আর মনোরমাও ছিল।

গল্প হতে হতে তপন বিমলকে বলে,

-কবে যে চাকরি পাবো! স্কুলবাড়িটা পাকা করবো। ঝড় বৃষ্টি হলে বাচ্চাগুলোর অসুবিধে হবে।

বিমল উত্তরে বলে,

-হবেই তো রে। এই বাঁশ আর কাপড়ের ঘরে আর কতদিন চলবে? বাচ্চাদের বাড়ির লোক আমাদের কাছে ওদের পাঠায় এই অনেক ভাগ্য আমাদের।

ওদের মধ্যে যোগ দেয় মনোরমা,

-খুব শিগগির ভালো দিন আসবে দেখো। তপনদাদা তোমার এত বড় একটা স্বপ্ন আমরা সবাই মিলে সফল করবো।

তপন বলে,

-সে তো বুঝলাম। কিন্তু তুই আজ বিমলের সাথে কেন এলি? জানিস তো পাড়ায় গন্ডগোল চলছে। আমার দুটো বাড়ি পরেই নির্মলেন্দু জ্যাঠা থাকেন। তাকে সেদিন বাজারে রাস্তায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল দুটো ছেলে। পাঞ্জাবি ছিঁড়ে দিয়ে টাকা পয়সা এমনকি যেটুকু বাজার করেছিলেন সেটুকুও নিয়ে হাওয়া।

বিমল জিজ্ঞেস করে,

-সত্যি কেন যে এগুলো হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি মনোরমাকে বারণ করলাম। কিন্তু জানিস তো ওর জেদ! যা বলবে “জো হুকুম মহারাণী” বলে মেনে নিতে হবে...

তিনজনেই হেসে ওঠে। এরপর তপন বলে,

-এবার তোরা ফিরে পর। আমার একটু কাজ আছে সেসব সেরে একেবারে ক্লাস নিয়ে বাড়ি ফিরবো।

বিমল বলে,

-হ্যাঁ। সাবধানে ফিরিস। এই স্কুলটা তো কু নজরে আছেই। চল মনোরমা...

ওরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলে, মনোরমা জিজ্ঞেস করে বিমলকে

-বিমলদাদা, তুমি যে এত বিপদে এগিয়ে যাও তোমার ভয় করে না?

উত্তর আসার আগেই খুব জোরে বোমা ফাটার আওয়াজ হলো। রাস্তার একপাশে পাঁচিলের পিছনে কানে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো মনোরমা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দৌড়াদৌড়ি আর চিৎকার....হেঁচকা টানে মনোরমাকে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করে বিমল। উৎকণ্ঠিত বিমল বলে,

-দৌড়ো মনোরমা। যতটা পারিস।

বেশ কিছুটা পথ এসে তারা থামে। বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ে মনোরমা। বিমল রেগে বলে,

-এইজন্যই তোকে বলেছিলাম আমার সাথে আসিস না। পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে চোখে অন্ধকার দেখবি।

-আমি চোখের সামনে আমার হাতটাকেই দেখতে পাচ্ছি না। ও বিমলদাদা, চারদিক ঝাপসা, কেমন যেন জমাট অন্ধকার। তোমার ভয় করে না বুঝি!

বিমল বলে,

-এ পথে যেদিন এসেছি সেদিন থেকে চোখ বন্ধ করে হাঁটতে শিখেছি। প্রথম প্রথম খুব কান্না পেতো...বাড়ি ফেরার চেনা রাস্তাটার কথা খালি মনে পড়তো! মনে হতো মা বসে আছে আমার জন্য ভাত বেড়ে। ধীরে ধীরে বুঝেছি সুখ নামটাই অলীক। তুই এখন এসব ছাড়। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আন্দোলন তোর জন্য নয়....

মনোরমা উত্তরে বলে,

-কেন? আজ ভয় পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু পরদিন এমন হবে না দেখে নিও।

বিমল হেসে ফেলে...

-বুঝেছি আমার ঝাঁসির রাণী। এখন তাড়াতাড়ি তোকে বাড়ি পৌঁছে দি চল। আওয়াজটা মনে হচ্ছে স্কুলের উল্টোদিক থেকে এলো। একবার ফিরবো তপনের খবর নিতে।

বিমলের দিকে তাকিয়ে থাকে মনোরমা। বলে,

-আমি কিন্তু সত্যি তোমার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছি বিমলদাদা। তোমার সততা, কর্মদক্ষতা আমায় মুগ্ধ করেছে! তুমি কি কিছুই বোঝো না?

বিমল হেসে ফেলে,

-চল, চল পাকামো না করে তাড়াতাড়ি হাঁট।

বাড়ি ফিরে হাত মুখ ধুঁয়ে একবাটি মুড়ি নিয়ে বসে মনোরমা।

মা ওকে দেখেন।

-আজ দিন কেমন কাটলো মনো?

-ভালোই তো। বেশ চমৎকার।

-তুমি আগে সাজতে এত ভালোবাসতে...নতুন নতুন ফিতে কিনে বিনুনি করতে, কাজল লাগাতে। সেসব কোথায় গেলো? ঈশ্বরকে ডাকি দেশে আর কিছু অঘটন না ঘটে...তোমার কলেজ শেষে তোমার একটা হিল্লে হলে আমার শান্তি।

-মা! তোমার খালি একই কথা! আমার অনেক কাজ বাকি জীবনে।

-প্রায়ই বিমল তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। আমার বয়স হচ্ছে আর তার সাথে অভিজ্ঞতাও বাড়ছে। তোমার চেহারা ভালো, কিছু ক্ষয়ক্ষতি হলে সে আমাদেরই হবে।

-মা, বিমলদাদার কলেজে শেষ বছর কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকায় রোজই কলেজে আসে। সে খুব ভালো ছাত্র হওয়ার দরুন ইতিহাসের পড়া বুঝতে আমার আলাপ ওর সাথে। আমরা কলেজের প্রথম বর্ষে থাকলেও ওরা সবরকম সহযোগীতা করে।

শাড়ীর আঁচলে হাত মুছে মা পান সাজাতে বসেন। মনোরমা উঠে আসে, পিছন থেকে মা ডেকে বলেন,

-তোমার ডান হাতের কনুইয়ের পিছনে ছড়ে গেছে, একটু ওষুধ লাগিয়ে নিও।

দোতলার ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে মনোরমা নিজের মনে বলে,

-মায়ের চোখ এড়ানো খুব মুশকিল। কিন্তু আর কতদিন এভাবে চলবে? বিমল দাদা ক্রমশঃ জড়িয়ে পড়ছে...।

*****************************************

পরদিন সকালে কলেজে মনোরমা ক্যান্টিনে পৌঁছলে তপন খবর দেয়,

-শোন...গতকাল রাতে বিমল আর শিশিরকে পুলিশ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে। ওই বোমাবাজির জন্য কলেজের কর্তৃপক্ষ থানায় কমপ্লেইন করেছিল। মনে হয় আমার পাড়ার ব্যাপারটাই।

মনোরমা কি করবে ভেবে পায় না! বলে,

-কলেজে ঢোকার মুখে দেখলাম ছাত্র ইউনিয়নের মিটিং চলছে। ওরা মনে হয় হরতাল করবে, কাউকে ক্লাস করতে দেবে না। এবার কি হবে তপন দাদা? তোমাদের আন্দোলনে অনেক সময় যাবে, ততদিনে থানায় ওদের জীবন তো নরক হয়ে উঠবে।

তপন বলে,

-আমিও সেটাই ভাবছি। কিন্তু আর তো কোন উপায় নেই। কলেজকে চাপ না দিলে ওরা কিচ্ছুটি করবে না। চল, একবার থানায় যাই।

মনোরমা জিজ্ঞাসা করে,

-কিন্তু বিমলদাদা আর শিশিরদাদাকে পুলিশ কেন ধরলো বলতো।

তপন বলে,

-আসলে বোমার আওয়াজের পর বিমল ফিরে আসে আমার কাছে। আমরা বাচ্চাগুলোর জন্য অপেক্ষা করি, তারপর ওরা এলে ফিরিয়ে দি বিপদের আশঙ্কায়। তারপর থানায় যাই। বিমল পরামর্শ দেয় পুলিশকে স্কুলের বিপদের কথা একবার জানিয়ে রাখতে।

মনোরমা উৎকণ্ঠিত হয়ে প্রশ্ন করে,

-তারপর! কিন্তু শিশিরদাদা! সে কিভাবে জড়িয়ে গেল?

তপন গম্ভীর হয়ে বলে,

-সেটাই আমারও খটকা লাগছে। কাল থানায় গেলে সামনের টেবিলেই যে অফিসার ছিলেন তিনি আমাদের কিছু সময় অপেক্ষা করতে বলেন। বেশ ভালোই কথাবার্তা ওনার। একটু আশ্বস্ত হচ্ছিলাম ওই অফিসারকে সবটা বুঝিয়ে কিন্তু তারপরেই বড়বাবুর ঘরে যেতে বলা হয়। গিয়ে দেখি উনি কারোর সাথে ফোনে ব্যস্ত। কথা শেষ হলে উনি আমাদের জাস্ট কড়কে দিলেন যে থানায় কেন এসেছি? কার নামে কমপ্লেইন ইত্যাদি আরও কত কি!

মনোরমা মাঝখানে জিজ্ঞাসা করে,

-শিশিরদাদাকে কি কোনোভাবে দেখেছিলেন বড়বাবু!

তপন উত্তর দেয়,

-না রে। তবে আজ সকালে যখন কলেজে ঢুকি তখন তো আমি কিছুই জানি না। হঠাৎ দেখি বসুবাবুর গাড়ি। তারপর সব কিছু জানতে পারি। জানিনা উনি কেন এসেছিলেন?

মনোরমা পাল্টা প্রশ্ন করে,

-বসুবাবু কে?

তপন বলে,

-আমাদের পাড়ার মাথা। যে প্রোমোটার আমার স্কুলবাড়ির পিছনে লেগেছে, তিনি ওনার পরিচিত।

মনোরমা বলে,

-ব্যস, তাহলে তো বোঝাই গেল তপনদাদা। শুধু বিমলদাদাকে ধরলে ওরাই ফেঁসে যাবে তাই দুজনকে ধরেছে মিথ্যে অপরাধে। এখন শিগগির চলো।

ওদিকে বিমল, শিশির একটা সেলে রয়েছে। ঠোঁটের কোণে রক্ত শিশিরের...সে বলে,

-দেখ বিমল, আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে একটা মিছিল....শয় শয় মানুষ...ওরা বুকের মধ্যে ধরে রেখেছে রক্তাক্ত স্বপ্ন। কিন্তু একটা গলির বাঁকে সবাই কেমন হারিয়ে গেল। শুনতে পেলি একটা আওয়াজ এলো মনে হলো ...অদৃষ্ট। কে? কে বলছো....অদৃষ্ট হতে যাবে কেন! সব কর্মফল।

বিমল শান্ত করে ওকে,

-পাগলামি করিস না। শান্ত হ।

-আর শান্তি। আচ্ছা বিমল, তুই শান্তি খুঁজে পেয়েছিস কোনোদিন? কেমন দেখতে সে?

-প্রায়ই দেখেছি রে শিশির। আকাশের চাঁদে, আবেগী নদীর তীরে, মায়াবী রূপকথায়। শান্তিকে আমি ভিখিরির মত চাই...তাই তো ছুটে যাই, জড়িয়ে ধরি চুরমার হয়ে যাওয়া জীবনকে, জুড়তে চাই একটা মালায় সব কিছু।

ধীর গলায় বলতে থাকে শিশির,



-"বিপ্লব, তুমি জাগ্রত যেমন আমার বুকে-

আমার অস্থিমজ্জা, রক্তসজ্জা আজ লেলিহান শিখা

প্রবহমান প্রলয় ঝড় তেমনি আমার বিবেক জুড়ে।

বিপ্লব, এই বুঝি চলে গেলে ওই সুদূরে,

আলোকগোলায় বিলিয়মান হলে...

এই ধরাতলে রয়ে গেলাম আমি-

তোমার প্রতিচ্ছবি হয়ে।"



বিমল যোগ দেয় শিশিরকে,



-"জানিস, ছোট থেকে শখ ছিল তেপান্তরের মাঠ দেখার

চারিদিক বেশ আঁধার হয়ে আসবে!

স্বপ্ন দেখতাম আশ্বাসের...

ধুলো উড়বে ঘোড়ার গতিতে,

পাতার আকুতি হবে ঝরে যাওয়ার আগে!

তবে, আজ ঘুম ভাঙলে নিজেকে পাই দ্বীপান্তরে

আকাঙ্খার আর মৌনতার হাত বাড়িয়ে

নির্জন কোনও অন্ধ গলির আনাচে কানাচে

জীবন সংগ্রামের বেনামি পথে।"



ওদের সেলের বাইরের কনস্টেবল জিগ্গ্যেস করে,

-তোমরা কি অপরাধে এখানে?

-একটু বোমা ফাটিয়ে কেউ শক্তি দেখাতে গিয়েছিল আর তার বদলে আমাদের শক্তিমান বানানো হয়েছে এই আর কি....

বিমলের কথায় ও আর শিশির দুজনেই হেসে ওঠে। হাসির আওয়াজে কনস্টেবল বলে,

-কি ব্যাপার, এত জোরে জোরে হাসি কিসের? বড়বাবু কিন্তু খুব রেগে আছেন। বেশি হট্টগোল হলে কপালে দুঃখ আছে।

বিমল বলে,

-কাল সারারাত তোমার বড়বাবুর প্রশ্নবাণে এমনিতেই হাল খারাপ! আজ আর নতুন কি হবে?

কনস্টেবল উত্তর দেওয়ার আগেই জুতোর মচমচ শব্দে বড়বাবু আসেন।

-তোমরা একটু সাবধান হয়ে যাও বুঝলে। মিথ্যের সাথে আর কতক্ষণ গাঁটছড়া বেঁধে থাকবে? আজ পর্যন্ত আমার আওতায় থাকা কোনো দোষী ছাড় পায়নি। বোমা মারার প্ল্যানটা কার ছিল...এটা জানতে পারলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

বিমল বলে,

-কি সমাধান হবে? কদিন আগেই আমাদের পার্টির এক ছাত্রকে রাস্তায় এমন পিটিয়েছিলো ওরা যে হাসপাতালে চিকিৎসার আগেই সে মরে যায়। আমরা এসেছিলাম থানায় কিন্তু কোনও কেস নেওয়া হয়নি। এমনকি কালকেও বোমাবাজির খবর আমরাই আপনাকে দিতে এসেছিলাম কিন্তু শুনতেই চাননি! কেন বলতে পারেন? ওরা স্থানীয় নেতার লোক বলে!

বিমলের কথায় গর্জে ওঠে বড়বাবু।

-মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ। খুব রাজনীতি শিখেছিস মনে হচ্ছে?

শিশির তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি সামাল দেয়,

-শুনুন, কাউকে মারা আমাদের নীতির বিরুদ্ধে যায়। আপনি তো আমাদের কথা শুনতেই চাইছেন না।

বড়বাবুকে কনস্টেবল বলে,

-স্যার, কলেজের দুজন দেখা করতে এসেছে...আপনার টেবিলে বসিয়েছি।

বড়বাবু বলে,

-চলো।

তারপর ওদের দেখে বলেন...

-কি ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি?

মনোরমা খুব ভয় পেয়েছিল। তপন বলে,

-আমাদের দুই ছাত্রকে ধরে নিয়ে এসেছেন..ওদের অপরাধটা কি একটু বলবেন?

-হাসালে ভায়া। হেসে ওঠেন বড়বাবু।

বোমাবাজি করেছে জানো নিশ্চয়। তাহলে অপরাধের কথা জিজ্ঞেস করছো কেন?

-আচ্ছা, আপনি কি জানেন না যে বোমটা আদৌ ওরা মারেনি নাকি জেনেও না বোঝার ভান করছেন! আমি তো ওই পাড়াতেই থাকি। আমি জানি ওরা করেনি।

উত্তেজিত তপনকে থামায় মনোরমা।

-আচ্ছা আচ্ছা তপনদাদা তুমি থামো।

মনোরমা বড়বাবুকে বলে,

-আমি নিরপেক্ষ। কলেজ থেকে বললেও এ খবর সত্যি নয়। বিমলদাদা আমার সাথে ছিল ওই সময়ে। আর শিশিরদাদা এ কাজ করতেই পারে না। আমার বিশ্বাস কেউ ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নিতে চাইছে...আপনি দয়া করে একটু বোঝার চেষ্টা করুন।

বড়বাবু ভ্রূ কুঁচকে বলেন,

-বেশি নিরপেক্ষ থাকা মানে ভান করা, জানতো! আমার এতবছরের চাকরির অভিজ্ঞতা বলছে যে, কলেজ নয় বরং তুমি মিথ্যে বলছো। তোমার মুখ সাদা হয়ে গেছে, হাত কাঁপছে...এই মেয়ে, তোমার সঙ্গে এ ঘটনার কি সম্পর্ক? তুমি ওদের বাঁচাতে চাইছো কেন? এই লোফার ছেলেদুটোর মধ্যে কারোর প্রেমে পড়েছো নাকি!

-কিছুটা ঠিক বললেন। আসলে আমার স্বভাবটা পাল্টে গেছে আর আমি তারই প্রেমে পড়েছি। এই খারাপ ছেলেগুলোর মধ্যে চমৎকার মনুষ্যত্ব বোধের পরিচয় পাই। তাই হয়তো খানিকটা পাগল হয়েছি আমি।

মনোরমার কথায় বড়বাবু রেগে যান। চেঁচিয়ে ওঠেন,

-ছিঃ ছিঃ, ভদ্রবাড়ির মেয়ের মুখে কি কথা! যাও যাও এখন বাড়ি যাও।

যাদের অভিযোগে গ্রেফতার করেছি তাদের জন্য অপেক্ষা করতেই হবে আমাকে। এখন এখানে শোরগোল করলে সবাইকে ঢুকিয়ে দেবো।

ওরা নিরুপায় হয়ে বেরিয়ে আসে।

মনোরমার বুকের মধ্যে ঝড় ওঠে, জল ছলছলিয়ে ওঠে চোখে। তবু নিজেকে সামলে নেয়। তার বিমল দাদা খুব বলতো,

-পড়াশোনা শেষে চাকরি পেলে বাড়ির ছাদে নিজের জন্য একটা ঘর বানাবো। অনেক বই রাখবো সেই ঘরে, বাইরের কোন আওয়াজ থাকবে না শুধু মাঝেমধ্যে পাখি ডাকবে। আমি অবসরে সময় কাটাবো ওই ঘরে।

মনোরমা হেসে বলেছিল,

-হাঁপিয়ে উঠবে তো সেই ঘরে। হঠাৎ দম বন্ধ লাগলে সতেজ বাতাস দেবে কে গো?

আজ কথাগুলো মনে করে বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠলো মনোরমার। সে নিজের মনে বলে,

-সারাদিন তার বিমলদাদা পাতার সাথে রোদের লুকোচুরি দেখলো না। তার উজ্জ্বল মুখখানি এতক্ষণে শুকিয়ে গেছে নিশ্চয়।

মনোরমার এত ভাবনার মাঝে মা ঘরে ঢুকলো। মুখ নিচু করে বসেছিল মনোরমা।

-একটু চা খাবি? করে আনবো?

-না মা। থাক....তুমি একটু বসো আমার পাশে।

-দুর্বলতা ভালো মনো কিন্তু আত্মবিশ্বাস হারিয়ে যাওয়া ঠিক নয়।

-তুমি কি করে সব বুঝতে পারো মা!

-বোকা মেয়ে। তোর ভিতরটা পুড়ে গেছে সেটা আমি ভালোই বুঝি। কিন্তু এর শেষ ভেবেই ভয় লাগে। তুই চোরাগলিতে হারিয়ে গেলে আমি তোর বাবাকে কি জবাব দেবো? তোর তখন সাত বছর বয়স। তোকে আমার জিম্মায় রেখে তিনি চিরদিনের মত চলে গেলেন।

বাবার কথা মনে করে মা মেয়ে দুজনেই ঝিমিয়ে যায়। মা মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,

-অতিকষ্টে ঘুরে দাঁড়িয়েছি মনো। শহীদ হওয়া কি এতই সহজ। তোর এসবে মাথা গলানোর কি দরকার বল? এখন সমাজে সবাই সবার শত্রু। হরতাল, বিপ্লব এগুলো করলে লোকে কিছু সময় তাকাবে তারপর নিজের পথ দেখবে।

-কিন্তু মা, কত লোক তো এখনও হাহাকার করে! লড়াইয়ে হেরে যাওয়া মানুষগুলো নিজেদের খোঁজে অন্দরমহলে, কিন্তু ঠাঁই হয় ফুটপাথে। তখন বিমলদাদার মত মানুষেরা চায় বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে সব মুখোশ। সে ভাবে সে এ জগতের কেউ নয়, আসলে সে সুভাষ বোস....সে ক্ষুদিরাম.... সে বিনয় বাদল দীনেশ.....সে আসলে মানুষের।

মনোরমার মা মনে মনে ভাবেন,

-হে ঈশ্বর! মনোর জন্য যেন কোনোদিন কাঁদতে না হয়। ভয়ংকর কিছু অঘটনের আগে আলো ফুটুক। মেয়েকে বলেন,

-তুই বোধহয় ভুলে গেছিস!অনেক আগের কথা...আমাদের পাড়ায় লাইব্রেরিটার পাশে দীপেনের চায়ের দোকান ছিল। ওর ছেলেটা লেখাপড়ায় ভাল ছিল বেশ। তোর বাবা প্রায় যেত চা খেতে আর দীপেনের সাথে গল্প করে আসতো।

-মনে আছে মা। দীপেনকাকাকে শেষ দেখেছিলাম যখন, আমি তখন সেভেনে পড়ি। দেখা হলেই আমায় জিজ্ঞাসা করতেন আমার স্কুল কেমন চলছে। আমায় সেবার বললো পাড়ায় দাঙ্গা হতে পারে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে খবর এসেছিল ওর ছেলে মারা গেছে।

-ঠিক বললি। সত্যিই সেবার দাঙ্গার মত হয়েছিল এ পাড়ায়। কিন্তু কি অদ্ভুত জানিস...কারুর কোনও ক্ষতি হয়নি সেদিন। শুধু দীপেনের বাড়ির সব সুখ শান্তি ফুরিয়ে গিয়েছিল ওর ছেলেটার শেষ বাবা ডাক উচ্চারণের সাথে। তোর বাবা বলেছিল দাঙ্গার দোহাই দিয়ে কেউ বা কারা দীপেনের ছেলেটার মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিল। দীপেন কিছুদিন মড়ার মত পরে থাকতো, বড্ড মায়া হতো রে। ছেলেটা বাবার চোখের সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পরেছিল। পুলিশকে জানিয়েছিল ছেলেটি কলেজে কিছু অসামাজিক কাজে যুক্ত হয়ে পড়েছিল আর তার ফল আজও নিশ্চয় ওর বাবাকে ভুগতে হচ্ছে। জানিনা দীপেন কোথায়! বেঁচে আছে কিনা!

সেদিন রাতে মনোরমার ঘুম আসে না। বিমলদাদা যা করছে তার ভবিষ্যৎ যে কি তা ভেবে শিহরিত হয়ে ওঠে মনোরমা। মনে আসে পুরোনো কিছু কথা। তার বিমলদাদা একদিন গল্পের ছলে বলেছিল নিজের মনের কথা,

-মনোরমা, আমি মাঝেমাঝে ভিড় বাঁচিয়ে গা ঢাকা দিতে চাই। মনে হয় একটু একা থাকি, নিজেকে চিনি...এখনো তো এটাই জানি না একফালি রোদ মুখে এসে পড়লে আমি খুশি হই কিনা! ভাবনাগুলোর মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার সময়ে আমার বুকের ভিতরটা জ্বলে, বড় অভিমান হয় আমার মনের। কি যেন আমায় ক্রমাগত আঘাত করছে, আমি তলিয়ে যাচ্ছি...আমার নিজের অহংকারী চোখগুলো আমায় গিলে খায়। আমার চাওয়া পাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়ে গেলো রে...

মনোরমার চোখে জল আসে। সে নিজের মনে বলে,

-আসলে বিমলদাদা শুধুই লড়তে জানে, আত্মরক্ষার হিসেব নিকেশ করতে শেখেনি তার ছেলেমানুষ মন।

একদিন পর মনোরমা কলেজ পৌঁছেই দেখে বিমলকে,

-বিমালদাদা তুমি? শিশিরদাদা কোথায়?

বিমল বলে,

-আবার বুঝি ভয় পেয়েছিলি? আমার বন্ধুগুলোর তৎপরতায় কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের ছাড়িয়ে এনেছে।

মনোরমা জিজ্ঞাসা করে,

-এখন কোথায় যাচ্ছো?

বিমল বলে,

-তপনের বাড়ি। শান্তি কি সহজে আসবে রে? আমরা ছাড়া পেলাম কিন্তু তপন কাল রাতে বাড়ি ফেরার সময় কে যেন পিছন থেকে সজোরে মাথায় আঘাত করে, সেখানেই লুটিয়ে পড়ে সে। আজ কলেজে এসে খবর পেলাম। শিশির আর আমি যাচ্ছি। কিরে শিশির আয়...। মনোরমা আজ তুই কলেজ শেষে সোজা বাড়ি ফিরে যাস।

তপন একটু কাতরায় তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে,

-কি শিশির! আজ রাজনৈতিক তরজা কিছু হবে না? প্রতিদিনের মত হাসি ঠাট্টা আলোচনা হলে তাড়াতাড়ি সেরে উঠতাম।

শিশির বলে,

-তুই সেরে ওঠ। কলেজে মুখোমুখি বসে সব হবে। কলেজের এক একটি দিন আমাদের কাছে গভীর আনন্দের। কিন্তু কে এমন কাজ করতে পারে বলে তোর ধারনা?

-জানি না। তবে আন্দাজ করতে পারি। আমাদের পাড়ার ঠেকে কিছুদিন হলো একটা নতুন ছেলে আসছিল কিন্তু কোথায় থাকে বলেনি। তার কথা আর আচরণে বেশ দ্বিচারিতা উপলব্ধি করেছি। মনে হচ্ছে তাকে আমার ওপর নজর রাখার জন্য পাঠানো হয়েছিল।

বিমল এতক্ষণ সব শুনছিলো। এবার সে প্রশ্ন করে,

-ওই প্রোমোটারের লোক নাকি রে! তোদের রাতের স্কুল এই দুদিন কেমন চললো? বাচ্চারা আসছে এত কিছুর পর!

তপন বলে,

-আমারও সেটাই মনে হচ্ছে! এই স্কুলবাড়ির জন্যই বোধহয় এত কিছু। গোটা দশেক ছেলে মেয়ে আসছে পড়তে। তবে সারাদিন খেটে ওরা খুব ক্লান্ত থাকে। কিন্তু ওই এক চিলতে ছাদ কতক্ষণ বাঁচাতে পারি দেখ! ওখানে তো একটা অফিস হবে শুনছি। অথচ কবেকার জমি...খালি পরে আছে বলে আমরা নাইট স্কুল করলাম। আমার কি মনে হয় জানিস বসুবাবুর কোনোভাবে হাত আছে এতে...আমি সেদিন ওনাকে আমাদের কলেজেও দেখেছিলাম।

বিমল বলে,

-আসলে জমির মালিক মারা যাওয়ায় বহুদিন খালি পড়েছিল। ওদের নজর ছিলই আগে থেকে তোরা মাঝখানে ঢুকে গেলি বলেই অশান্তি। একটা ঠিকঠাক পারমিশন চাইরে স্কুলের জন্য। চল একদিন থানায় যাই।

তপন আঁতকে ওঠে,

-আবার থানা! ঠিক কিছু একটা কেসে ফাঁসিয়ে দেবে।

তিনজনে হেসে ওঠে ওরা। শিশির বলে,

-ভয় পাস না তপন। এই সব মানুষগুলো কিছু ক্ষেত্রে অন্ধ। খিদে পেলে খায়, দেখে না সামনে কে! ঘোর অন্ধকার পৃথিবীতে কোনো কিছুর গভীরে না গিয়েই এরা তৃপ্ত। আছে শুধু অন্ধ, উন্মত্ত শ্রেণীভেদ। আমরা যারা পাগল তাদের ওরা মার খেতে দেখতেই পছন্দ করে। উঠে দাঁড়াতে গেলে শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়ার ভয় থাকবেই... তবু দাঁড়াতে তো হবেই। এক কাজ করি থানায় যাওয়ার আগে তোদের পাড়ার মাথা বসুবাবুর বাড়ি চল কাল। ওনার মনোভাবটা বোঝার চেষ্টা করি।

তপন বললো,

-এই মার খাওয়াটাই জীবনে সাহসের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেকে খুব অন্যরকম লাগে, মনে হয় আমার আগে পরে বলে কিছু নেই। আছে শুধু দায়িত্ব। চারপাশে সরীসৃপ...আলো নেই, জোয়ার নেই, জীবন নেই! আছে মৃত মনের শরীর। আমি হাতড়ে বেড়াচ্ছি জন্মান্ধ সবকিছুতে জোৎস্না আনবো বলে।

ওরা তিনজন চুপ করে থাকে কিন্তু অনুভূতির দেওয়া নেওয়া চলে।

***************************************

পরদিন বেশ বর্ষা ছিল। বসুবাবুর বাড়িতে আসে ওরা তিনজন এবং সাথে মনোরমাও। বসুবাবু ওদের দেখেন একঝলক। তারপর বলেন,

-নাম মনে পড়ছে না। আসলে পাড়ায় তো কম লোক নেই।

তপন বলে,

-আমার নাম তপন। আমাদের নাইট স্কুল নিয়ে একটু অসুবিধায় পড়েছি।

আপনি আশাকরি সব জানেন। আমাদের যদি একটু সঠিক পথ দেখাতেন তাহলে এতগুলো ছেলে মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার থেকে বাঁচে।

বসুবাবু মনোরমাকে দেখেন একঝলক। তারপর হেসে ওঠেন,

-লেখাপড়া! আমি তো ভাবলাম পুতুল খেলবে তোমরা! তা নাইট স্কুলে কি ইনিও পড়ান!

-আমি মনোরমা। ইতিহাসের ছাত্রী। আমি রাতে এসে না পড়ালেও এই স্কুলের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।

- তা কিভাবে জানতে পারি কি?

-এই স্কুলের বাচ্চারা সবাই খুব গরিব। এরা প্রত্যেকে দিনের বেলা কিছু না কিছু কাজ করে, নয়তো এদের সংসার চলবে না। আমি এদের সবার বাড়ি গিয়ে কথা বলে রাজি করাই এদের রাতের স্কুলে পাঠাবার জন্য। নয়তো রাতে সহজে কেউ নিজের বাচ্চাকে বাইরে ছাড়বে না। আমি ওদের আশ্বস্ত করি, তপনদাদার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানাই। এটাও যে একটা স্কুল বাড়ি সেই সচেতনতা বাড়াই ওদের মধ্যে। আমায় দেখে খুশি হয় ওরা। যাতে আরও বেশি ছেলে মেয়ে স্বাক্ষর হয় সেই চেষ্টা চালাই।

-তোমায় দেখে খুশি তো হবেই। তা আমায় বাদ দিলে কেন? একটা স্কুলবাড়ি হচ্ছে, এত সুন্দর দিদিমণি! আমার অভিমান হয় না বুঝি!

বিমল রেগে যায়। বলে,

-আমরা কেন এসেছি জানেন?

বসুবাবু বলেন,

-আরে, জানি জানি। এরা তোমার বন্ধু। তোমার নাম শুনেছি, কলেজে তো ভালোই গুন্ডাগিরি করো। ওরা ভয় পাচ্ছে, তাই সবাই আমার কাছে এসেছো।

বিমল বলে,

-এসেছিলাম অন্য কিছু ভেবে। কিন্তু এখন জানিয়ে গেলাম বাইরে যে দালালগুলো আছে তাদের দিন শেষ।

বসুবাবু বোকা সাজেন...বলেন,

-বাইরে কারা আছে বলতো? উফ্ ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। তবে আমার দলের ছেলেরা যখন তখন আমার হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা জানতো! এ পাড়ায় আমায় পাত্তা না দিলে পা থেকে মাথা পর্যন্ত অসহনীয় ভয় নিয়ে ঘুরতে হবে।

বিমল রেগে গিয়ে বলে,

-একটা জমির জন্য পুরো পাড়াটাকে বিপদে ফেলছেন কেন? আপনার তো অনেক টাকা সেগুলো এই স্কুলটাকে বড় করার জন্য একটু কাজে লাগালে পারতেন। আর আমায় আর শিশিরকে জেলে ঢুকিয়ে ভয় দেখাতে পারবেন না। আমরা তপনের পাশে থাকবোই।

মনোরমা তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,

-আপনাকে কেউ ভুল বুঝিয়েছে। বিমলদাদা আসলে কারোর পা চাটে না। ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র তবু সব কিছুর ওপরে ও সাচ্চা বিপ্লবী। এ সেই মিটিং মিছিলের বিপ্লব নয়, এ হলো তথাকথিত নিয়মের বিপক্ষে গিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আজ আমরা আসি। ভালো থাকবেন।

বসুবাবু রেগে চিৎকার করে ওঠেন,

-চিনবে...আমাকেও খুব শিগগির চিনবে। আজ দেমাক নিয়ে চলে যাচ্ছো যাও, বুঝতে পারবে আমার মায়া দয়া কতটা কম...

ওরা বেরিয়ে আসে। সেদিন মনোরমা বলে,

-তোমরা আজ আমার বাড়ি চলো। মায়ের সাথে আলাপ করাবো।

দরজা খোলার পর মনোরমার মা ওদের দেখে একটু অবাক হয়। বলেন,

-বসো বাবা তোমরা। মনো আমাকে আগে বলবি তো ওরা আসবে...

-না মা, এত ভেবো না। ওরা আলাপ করতে এসেছে। এই শিশিরদাদা, তপনদাদা আর...

-বুঝেছি। ও বিমল তাই তো! তোমাদের কথা অনেক শুনেছি মনোর কাছে। বসো একটু চা করে আনি।

বিমল বলে,

-না মাসিমা। আপনি বসুন একটু কথা বলি।

মনোরমার মা প্রশ্ন করেন,

-এতগুলো তরতাজা প্রাণ...সহজ জীবন ছেড়ে বিপ্লবের পথে কেন বাবারা! জেদি স্বভাব তোমাদের কিন্তু মানুষের ভয়ঙ্কর প্রবৃত্তি সহ্য করার ক্ষমতা আছে তো? সমাজের ভালো করতে গিয়ে অনেক মানুষের অভিশাপ কুড়োবে তখন...

বিমল শান্ত গলায় বলে,

-মাসিমা, আমাদের খুব মনে হয় একটা শান্ত শিশু ঘুম থেকে উঠে এদিক ওদিক তাকালেই যেন পরিবারের সবার হাসি মুখটা দেখতে পায়। প্রবৃত্তি অবস্থার চাপে জেগে ওঠে। সেটাকে খুঁটিয়ে দেখে দিগন্তে মিশিয়ে দিতে হবে প্রতিকূলতা।

মনোর মা মুগ্ধ হয় বিমলের ব্যক্তিত্বে। বলেন,

-আসলে সব মা-বাবাই সন্তানের ভালো চান। তাই গল্প শুনিয়ে সেই ছোটটি বানিয়ে রাখতে চান তাদের সুরক্ষার কথা ভেবে।

সবাই হেসে ওঠে আনন্দে...ওরা গলা ছেড়ে গান ধরে সবাই,



“কারার ঐ লৌহ-কপাট

ভেঙ্গে ফেল্‌ কর্‌ রে লোপাট রক্ত-জমাট

শিকল-পূজার পাষাণ-বেদী!

ওরে ও তরুণ ঈশান!

বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ! ধ্বংস-নিশান

উঠুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি’।।

গাজনের বাজনা বাজা!

কে মালিক? কে সে রাজা? কে দেয় সাজা

মুক্ত-স্বাধীন সত্য কে রে?

হা হা হা পায় যে হাসি, ভগবান প’রবে ফাঁসি? সর্বনাশী-

শিখায় এ হীন্‌ তথ্য কে রে?

ওরে ও পাগ্‌লা ভোলা, দেরে দে প্রলয়-দোলা গারদগুলা

জোরসে ধ’রে হ্যাঁচকা টানে।

মার্‌ হাঁক হায়দরী হাঁক্‌ কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক ডাক ওরে ডাক

মৃত্যুকে ডাক জীবন-পানে।।

নাচে ঐ কাল-বোশেখী, কাটাবি কাল ব’সে কি?

দে রে দেখি ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি’।

লাথি মার, ভাঙ্‌রে তালা! যত সব বন্দী-শালায়-

আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা, ফেল্‌ উপাড়ি।।“



মনোরমার মায়ের বুক কাঁপে। মনে মনে বলেন,

-যে নৌকা ঘাট ছেড়ে ভেসে গেছে, ঝড়ে সে কি আর ফেরার পথ পাবে? মোনো আমায় দেখে হাসতো, আমায় দেখে কাঁদতো, ভয় পেলে জড়িয়ে ধরতো আর আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম। আজও সেই মাতৃত্বে আচ্ছন্ন আমি, কিন্তু মোনো... সে তো ওই নৌকায়! ঘুরপাক খাচ্ছে। ভয় হয় কোনো তান্ডব না হয়...

চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে মনোরমার মায়ের তবু উনি হাসিমুখে বসে থাকেন।



দিন দুয়েক ঠিক চললো সব। তারপর একদিন কলেজের ক্যান্টিনে ওরা যখন চা খাচ্ছে তখন তপন এসে খবর দেয়,

-শিগগির চল। বিশু খুন হয়েছে।

শিশির আঁতকে ওঠে,

-কি বলছিস? কি করে হলো? কখন?

তপন বলে,

-জানি না রে। কাল রাতেও ক্লাসে এসেছিল। সকালে খবর পেয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখি ও কেমন পুঁটুলি হয়ে পরে আছে স্কুল ঘরের পাশে। পুলিশ এসে বডি নিয়ে গেছে। তোদের তো বলেছি বসুবাবুর হুমকির পর থেকে একজন করে রাতে স্কুল বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য ওখানে থাকি। কাল বিশু নিজেই থাকতে চেয়েছিল।

কেঁদে ফেলে তপন...

-ওর বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না রে।

বিমল তপনকে বুকে টেনে নেয়। বলে,

-কাঁদ তপন কাঁদ। বুকের মধ্যে কান্না জমিয়ে রাখিস না। কান্না ঝেড়ে ফেলে জ্বালাটাকে বাঁচিয়ে তোল নয়তো স্কুলটাকে বাঁচাতে পারবি না।

মনোরমা বসে পরে,

-চোখ বন্ধ করলেই বিশুর মুখটা ভাসছে। ছুরি দিয়ে স্কুলের পাশের আগাছা সাফ করতো। এই ছুরিটা ঢুকিয়ে দিতে পারলো না কেন ও। সরল, নিরীহ হওয়ার ফল ভোগ করলো বিশু। কিন্তু আর নয়, আমাদের সরব হওয়ার সময় এসেছে। মনে হচ্ছে আজ রাতে কিছু ঘটবে!

শিশির বললো,

-হ্যাঁ। আমারও তাই মনে হচ্ছে। এবারও বোধহয় তপনই টার্গেট ছিল আগের বারের মতো। আজ আমরা সবাই থাকবো স্কুল বাড়িতে। মনোরমা তুই বাড়ি ফিরে যাস কলেজ শেষে।

মনোরমা বলে,

-কেন শিশিরদাদা! আমায় তোমাদের থেকে আলাদা করো না। পায়ে পড়ি।

এই সময়ে আমি যদি পিছিয়ে আসি তাহলে এত বড় অপরাধবোধ নিয়ে বাঁচবো কি করে!

তপন বলে,

-বড় বিপদ আসতে পারে। মাসিমাকে কি বলবি?

-সে আমি বুঝে নেবো। তোমরা আমায় নিয়ে নিও বিমলদাদা।

রাতে স্কুল বাড়ির মধ্যে ওরা চারজন। শিশির বলে,

-মনে আছে তপন, কিভাবে এই ঘর দুখানি হয়েছিল। সত্যি কত মজার ঘটনা ছিল সব। একদিন তো তোদের পাড়ার এক মাতাল ঢুকে নিজের ঘর ভেবে শুয়ে পড়েছিল আর চিৎকার করছিল যে কোনো শালা ওকে বের করতে পারবে না।

তপন খুব জোরে হেসে ওঠে, বলে...

-খুব মনে আছে। কিন্তু সে ব্যাটা যাতে মাতাল তালে ঠিক ছিল।

বিমল খুব গম্ভীর ছিল সেই রাতে। আকাশ দেখছিল...মনোরমা পাশে এসে জিজ্ঞেস করে,

-কি এত ভাবছো বিমলদাদা? দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।

বিমল উল্টে জিজ্ঞেস করে,

-মাসিমাকে কি বলে এলি!

-ও নিয়ে তুমি ভেবো না। মা খুব চিন্তা করে ঠিকই কিন্তু কারো সর্বনাশ হোক এ কোনোদিন চাইবে না। বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যৎ ভেবে মা নিজেই বললো সকালে যেন ভালো খবর দি। ফুল ফুটবে, পাখি গান গাইবে নিজের নিয়মে এই স্কুলে।

কিছু বোঝার আগেই একটা আগুনের গোলা এসে পড়লো স্কুলবাড়িতে!

শিশির চিৎকার করে ওঠে,

-ওরে আগুন...আগুন! বেরো শিগগির... বাড়িটা কাপড়ের বলে দাউ দাউ করে নিমেষে শেষ হবে। পালাআআআ...

বিমল মনোরমার হাত ধরে টান দিলো,

-তুই দৌড়ে যা। পাড়ায় খবর দে।

চিৎকার করে ওঠে মনোরমা,

ধোঁয়ায় কিছু দেখতে পাচ্ছি না! তপনদাদা..........শিশিরদাদা..........তোমরা কোথায়.......

ধোঁয়ায় কাশি ওঠে মনোরমার।

বিমল আবার ঢোকে ওই জ্বলন্ত ঘরে। হাহাকার করে ওঠে,

-শিশির...............কি হলো তোর? শিশির.........

তপনকে বাইরে নিয়ে আসে। বিমল মনোরমাকে বলে,

-তপন অচৈতন্য। শিশির দাউদাউ করে জ্বলছে।

-কি বলছো বিমলদাদা?

-তোর ব্যাগটা কোথায়! জল ছিল ওতে।

-সে সব শেষ।

মুহূর্তে বিমল লুটিয়ে পড়ে কোথা থেকে উড়ে আসা এক বুলেটের আঘাতে।

পুলিশের গাড়ির আওয়াজ আসে।

হতবাক মনোরমা...বিভ্রান্ত।

-বিমলদাদা...........কথা বলছো না কেন? কষ্ট হচ্ছে তোমার? তুমি কি করে আমায় ফেলে এভাবে চলে যাবে! এ হয় না। ওঠো বলছি শিগগির।

বিমল ফিসফিসিয়ে বলে,

-আর সময় নেই রে। আমার সময় হয়ে এলো। আসলে তো আদি অনন্ত কাল থেকেই পুড়ছি...শিরা উপশিরা বিষে পুড়েছে কবেই, মিথ্যের বিষে!

আজ শুধু সেই আগুনে শরীরটা বিলীন হবে।

মনোরমা হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে,

-নাআআআআ... বিমলদাদা চলো সব ছেড়ে আমরা ভিনদেশে যাই। স্বপ্নের ঘর বাঁধবো। আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।

বিমলের সাড়া মেলে না। পুলিশ এসে তপনকে হাসপাতাল পাঠায়। মনোরমাকে গ্রেফতার করে অসামাজিক কার্যকলাপের জন্য। জীপে তোলার সময় অফিসার বলেন,

-বসুবাবু ঠিক সময়ে জানিয়েছিলেন বলে এ পাড়াটা আজ রক্ষা পেল। ওনার নির্দেশ আছে আপনি যদি চান তাহলে থানার বদলে ওনার বাড়ি ড্রপ করতে পারি। তবে তপন ছোড়ার মুক্তি নেই।

পাগলের মত হেসে ওঠে মনোরমা,

-আগুন তো আমায় পুড়িয়ে ফেলেছে। আপনি গন্ধ পাচ্ছেন না? গায়ের কাপড় খুলে ছাই ছাড়া কিছু পাওয়া যাবে না। আপনারা কেউ দেখেননি আমি এই ধোঁয়ার পথে যাত্রা করেছি উলঙ্গ সভ্যতার উপত্যকা ছেড়ে...........

পুলিশের জীপ চলতে থাকে অন্ধকার ভেদ করে, মনোরমার কানে ভেসে আসে বিমলের সেই আবৃত্তি...

বিমল কলেজে পাঠ করেছিল একবার।



“আমি কখনো আকাশকে কাঁদতে দেখিনি

বৃষ্টি দেখেছি বটে...তবে সেগুলো এক এক পশলা পিছুটান

ঘুমন্ত উঠোন জেগে ওঠে...রঙ্গন ফুল ঝরে পড়ে...

অপেক্ষায় থাকি, কিন্তু না কখনো কাঁদতে দেখিনি, অনুভবও করিনি।

গভীর অভিমানে ফিরে গেছি নিজের ছেলেমানুষীতে-

আমি বুঝি তাহলে একাই কষ্ট পাই!

আমার বুকেই থাকে সমস্ত আগ্নেয়গিরি!

আকাশ শুধু হাসে, আমার কল্পনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই হাসে।

হাতছানি দেয়, ক্ষত চিহ্ন ছুঁয়ে চলে...তবু হাসে।

সত্যিই কখনো কাঁদতে দেখিনি তাকে!

শুধু মনে হয়, আমাকে বদলাবে বলে মাঝে মাঝে,

আঁকাবাঁকা মেঘেরা ডাকে সময়ের ব্যবধানে”



......ডুকরে কেঁদে ওঠে মনোরমা, “বিমলদাদা তোমার আমার গল্পের শেষটা পাল্টে দাও না গো...একবার ফিরে এসে পাল্টে দাও”...

********************************************