টরন্টো, অক্টোবর ২২, ২০২১, নভো সংখ্যা ২৫  
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি বিশেষ নিবন্ধ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল যোগাযোগ আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত

কার্তিকের কুয়াশা

সম্পাদকীয়

 

“ঐ চেয়ে দেখ, নব বধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎ কাল সমাগত।“ (‘মেঘদূত’ – মহাকবি কালিদাস)

ঋতুর রানী শরৎ কাল, বাংলার তৃতীয় ঋতু। বর্ষার সঘন ঘন বাদল শেষ হলে আগমন ঘটে শরতের। ভাদ্র - আশ্বিন মাস নিয়ে গঠিত এই ঋতু। শ্রাবণের অবিরাম বৃষ্টির শেষে প্রকৃতি সেজে ওঠে নতুন রূপে। আকাশের বুকে ভেসে বেড়ায় সাদা পেঁজা-তুলো মেঘ, রোদ্দুর হয়ে ওঠে সোনারং আর নাতিশীতোষ্ণ বাতাস ছুঁয়ে যায় এক মিঠে আমেজের ওম নিয়ে। নীল গভীরতায় দিগন্ত ছুঁয়ে থেকে থেকেই উড়ে যায় পাখির ঝাঁক। শরৎ মানেই যেন মনমুগ্ধকর এক মাধুর্য চারপাশে, ফলে পৃথিবীর পরিবেশ এক অপরূপ মহিমায় পরিণত হয়। নতুন ফসলের ঢাকা মাঠের একপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর রুপালি ধারায় সূর্যের আলো ঝলমল করে। মনে পড়ে কবির লেখা কিছু লাইন: 'পুচ্ছ তোলা পাখির মতো কাশবনে এক কন্যে,/তুলছে কাশের মযূর–চূড়া কালো খোঁপার জন্যে।‘ কাশফুলের মনোরম দৃশ্য থেকে সত্যিই চোখ ফেরানো যায় না! বর্ষা শেষের জল ভরা নদীর বুকে পাল তোলা ডিঙি বাইতে বাইতে কোনো মাঝি হয়তোবা গেয়ে ওঠে মন-কেমন-করা ভাটিয়ালি গান - “আজি মধুর বাতাসে হৃদয় উদাসে, রহে না আবাসে মন হায়…”।

প্রকৃতির এমন রূপ মহিমায় স্বাভাবিক ভাবেই যেন আমাদের সবার হৃদয়ই কী জানি এক অনাবিল আনন্দে শত শত রঙের পেখম মেলে নেচে ওঠে। “আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে কী জানি পরান কী যে চায়…”। দেশে বিদেশে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে শরতকাল মানেই যেন উৎসবের সময়। বর্ষা শেষে এবং শীতের হিম ধূসরতায় মুড়ে নেওয়ার আগে প্রকৃতি নিজেকে উজাড় করে সাজিয়ে তোলে, তার সোনালী ধনরাজি ঢেলে ছড়িয়ে দেয় চারিপাশে। আকাশের সবথেকে উজ্জ্বল তারাটির সাথে মনও বুঝি জেগে থাকে অপেক্ষাতে- “ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কী যে গায় গো…।“ যারা দূরে থাকে তারা চেষ্টা করে নিজ নিজ ঘরে ফিরতে। সকলেই চেষ্টা করে বিভিন্ন উৎসবগুলোকে ঘিরে সারাবছরের রোজনামচার বা ব্যাস্ততার দিনগুলির পাথেয় সঞ্চয়ের। মানুষ মেতে ওঠে মিলনের উৎসবে, সম্প্রীতির উৎসবে।
রঙের মেলায় বিভোর এমন কোমল স্নিগ্ধ ঋতুতে মানুষে মানুষে হিংসা দ্বেষের সংঘাত কিংবা প্রীতি ও মিলনের উৎসবকে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কালিমালিপ্ত করে তোলা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

বসন্ত এবং বর্ষা ঋতুর মতই শরৎ ঋতুও সাহিত্যরচয়িতাদের কাছে প্রকৃতির দান মাধুকরী স্বরূপ। বিশ্বকবি যেমন লিখেছেন “শরত-আলোর কমলবনে বাহির হয়ে বিহার করে যে ছিল মোর মনে মনে…”, কিংবা কাজী নজরুলের কলমে উঠে এসেছে "এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে/এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ রথে...”।
একই প্রকারে বিদেশি কবি ও সাহিত্যিকগণও শরৎকালকে বর্ণনা করেছেন “Season of mists and mellow fruitfulness” রূপে। কবি William Butler Yeats লিখছেন "The trees are in their autumn beauty, /The woodland paths are dry, /Under the October twilight the water mirrors a still sky”। বাংলা সাহিত্যে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই শরৎকাল বর্ণিত হয়েছে নারী রূপে; কখনও সে কিশোরীর মত উচ্ছল সোনালী শস্যক্ষেতে তার গোলাপী উড়নি উড়িয়ে ছুটে যায়, কখনও বা নিঝুম দুপুরে ঘন শটিবনের আলো আঁধারিতে লুকোচুরি খেলে, আবার কখনও বা গোধূলি শেষে ঘন নীল শাড়ি পরে নদীর তিরতিরে স্রোতে পা ডুবিয়ে চুপ করে বসে সূর্য্যাস্তের আবির মাখে দুই গালে।

অপরদিকে, অক্টোবর মাসে আমরা স্মরণ করি বাংলার কিছু বরেণ্য সাহিত্যিকদের তাঁদের জন্মদিবসে এবং প্রয়াণদিবসে। তাঁদের মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হলেন কামিনী রায় যিনি পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশের) বাকেরগঞ্জের বাসণ্ডা গ্রামে (বর্তমানে যা ঝালকাঠি জেলার অংশ) জন্মগ্রহণ করেন ১২ই অক্টোবর, ১৮৬৪। তিনি একজন প্রথিতযশা বাঙালি কবি, সমাজকর্মী এবং নারীবাদী লেখিকা ছিলেন। তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক ডিগ্রীধারী ব্যক্তিত্ব এবং একসময় "জনৈক বঙ্গমহিলা" ছদ্মনামে লিখতেন।

অতুলপ্রসাদ সেন- ঢাকা শহরে ২০শে অক্টোবর ১৮৭১ সালে জন্ম নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতবর্ষে ঊনবিংশ শতাব্দীতে আবির্ভুত একজন বিশিষ্ট বাঙালি গীতিকার, সুরকার ও গায়ক।তিনি একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতবিদও ছিলেন। তাঁর রচিত গানগুলির মূল উপজীব্য বিষয় ছিল দেশপ্রেম, ভক্তি ও প্রেম। তার জীবনের দুঃখ ও যন্ত্রণাগুলি তাঁর গানের ভাষায় বাঙ্ময় মূর্তি ধারণ করেছিল; বেদনা অতুলপ্রসাদের গানের প্রধান অবলম্বন।

অক্টোবর মাসে প্রয়াণ ঘটেছিল বাংলা সাহিত্যের এক স্মরণীয় নক্ষত্রের, তিনি হলেন অন্নদাশঙ্কর রায়। ২৮শে অক্টোবর, ২০০২ সালে তাঁর তিরোধান হয়। তিনি ছিলেন একজন স্বনামধন্য বাঙালি কবি ও লেখক। ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যে এক কায়স্থ রায় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি একজন বিখ্যাত ছড়াকারও বটে।

আমাদের কার্তিকের কুয়াশার অক্টোবরের শারদীয়া সংখ্যাও এবার সমৃদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন নতুন এবং পুরনো লেখক লেখিকা এবং শিল্পীদের সৃষ্ট মণি-মাণিক্যে। হরেক রকম কবিতা, ছোটগল্পের সাথে থাকছে পাঠপ্রতিক্রিয়া, আবৃত্তি, গানের মত নিয়মিত বিভাগ। সাহিত্যসৃষ্টির মাধ্যমে এবং শৈল্পিক ছোঁয়ায় আমাদের মননও হয়ে উঠুক শরৎকালের মতোই স্নিগ্ধ, উজ্জ্বল, সমৃদ্ধ এবং কৃষ্টির নির্মল বাতাসের স্পর্শে ভুলে যাই সকল বিদ্বেষ, বিবাদ, ব্যবধান; সম্প্রীতি এবং ঐক্যবদ্ধতাই হয়ে উঠুক আমাদের বীজমন্ত্র।

 

মধুবন্তী আইচ
গুজরাট, ভারতবর্ষ