টরন্টো, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২১, নভো সংখ্যা ২৪  
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি বিশেষ নিবন্ধ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল যোগাযোগ আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত

কার্তিকের কুয়াশা

সম্পাদকীয়

 

সাহিত্য রচনার আদিকাল থেকে নান্দনিক বিষয়গুলিই সাহিত্যের আঙিনার সিংহভাগ দখল করে এসেছে সব সময়। প্রেম ভালবাসা নাহলে প্রকৃতির বন্দনা নয়তো বা দেবদেবীর স্তুতি। রাজা বা সমাজের প্রভাবশালীদের প্রভাবে সাহিত্য চর্চায় প্রায়ই উঠে এসেছে অনেক রাজা রাজড়াদের বীরগাথা। নয়তো বা অপ্রাকৃত বা অলৌকিকের সমুদ্রে ডুব দিয়েছেন সাহিত্যপ্রেমীরা। কিন্তু যা আমরা রোজ দেখি, যে ঘটনার সাথে আমাদের রোজকার অনুভব জড়িয়ে আছে, যে মানুষগুলোর আমাদের জীবনে নিত্যদিনের যাওয়া আসা তাদের কথা সাহিত্যে ঠাঁই পাবে সেটা ভাবতেও যেন কেমন একটা লাগত। কিন্তু সেই রোজকার সুখ দুঃখ চাওয়া পাওয়া বঞ্চনা আর চোখের জল থেকেও যে কালজয়ী সাহিত্য তৈরি হতে পারে, ছোঁয়া যেতে পারে নিজের ভাষার তো বটেই বিজাতীয় ভাষাভাষীর সমস্ত স্তরের মানুষের হৃদয় সে’কথা বোধ হয় বাংলা সাহিত্যকে শরৎচন্দ্রের থেকে ভালো করে কেউ বুঝিয়ে দেয়নি। শুধু বাংলা বা ভারতবর্ষ নয় এশিয়ার জনপ্রিয়তম সাহিত্যিকদের অন্যতম এই মানুষটার চালচুলোহীন জীবনে কোনওদিন সাহিত্যিক হওয়ার কথাই ছিলোনা। জন্ম থেকেই চরম দারিদ্রের ঘাত প্রতিঘাতে ছাত্র অবস্থায় চালানো ম্যাগাজিন সাহিত্যসভা সব জলাঞ্জলি গেছে। সামান্য কয়েকটা টাকার জন্য বোর্ডের পরীক্ষায় বসা হয়নি তাঁর। তাই সাহিত্যচর্চা না হলেও জীবনজোড়া দারিদ্র আর বঞ্চনা বয়ে বেড়িয়েছেন নিজের অন্তরালে। তাই মনে হয় দুঃখীর সমব্যথী হওয়ার এত অনায়াস দক্ষতা ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়।চাকরির সন্ধানে রেঙ্গুনে থাকাকালীন তাঁর প্রথম উপন্যাস বড়দিদি প্রকাশ পায় তারই অজান্তে এক বন্ধুর বদান্যতায়। তারপর থেকেই জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে দিনে দিনে। তাঁর বইগুলি যখন অন্য ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ হয়েছে, সেই প্রদেশের মানুষদেরও সেই সাহিত্য পড়ে মনে হয়েছে শরৎচন্দ্র তাদের ভাষারই সাহিত্যিক, নাহলে তাদের মনের কথা এত সুন্দর ভাবে লিখলেন কীকরে। আসলে খেটেখাওয়া সমাজের নিচুতলার মানুষের দুঃখের ভাষাটা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একই, সেই কারণেই সকলের একান্ত আপন সাহিত্যিক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সমাজের উঁচুতলার মানুষের বঞ্চনায় অভাগীর মত চরিত্রের পোড়ানোর কাঠ না মেলা থেকে শত শত মহেশের গুমরে ওঠা দুঃখের চোরা স্রোত অনন্ত কাল ধরে বয়ে চলেছে সর্বত্র। তিনি শুধু সেই স্রোতের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পেরেছিলেন পাঠকের মন। তাঁর নিজের মতেও সাহিত্যিক হওয়ার প্রয়োজন হয়ত ছিলোনা কিন্তু এই বঞ্চিত মানুষদের চোখের জলের কথা সকলের কাছে পৌঁছে দিতেই যেন তাঁর কলম ধরা। পথের দাবীর সব্যসাচীর সাথে আসলের স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের এক করে ফেলে পাঠক। তাঁর লেখনীতেই উঠে আসে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকার কথা। তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস শ্রীকান্ত পড়ে ফরাসী মনিষী রোমাঁ রোলাঁ বলেছেন, “শরৎচন্দ্র বিশ্বের অগ্রগণ্য সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম এবং নোবেল প্রাইজ পাওয়ার যোগ্য”। সেই প্রাইজ না পেলেও নোবেল প্রাপক রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিয়ে বলেছেন, “শরৎচন্দ্রের সৃষ্টি ডুব দিয়েছে বাঙালীর হৃদয় রহস্যে। সুখে দুঃখে মিলনে বিচ্ছেদে সংঘটিত বিচিত্র সৃষ্টির তিনি এমন করে পরিচয় দিয়েছেন, বাঙালি যাকে প্রত্যক্ষ জানতে পেরেছে। তার প্রমাণ পাই তার অফুরান আনন্দে। যেমন অন্তরের সঙ্গে তারা খুশি হয়েছে, এমন আর কারো লেখায় তারা হয়নি। অন্য লেখকেরা অনেক প্রশংসা পেয়েছে কিন্তু সার্বজনীন হৃদয়ের এমন আতিথ্য পায়নি। এ বিস্ময়ের চমক নয়, এ প্রীতি! অনায়াসে যে প্রচুর সফলতা তিনি পেয়েছেন তাতে তিনি আমাদের ঈর্ষাভাজন”। বিশ্বকবির ঈর্ষাভাজন হওয়ার ক্ষমতা যে লেখকের রয়েছে তাঁর সম্পর্কে আলাদা করে আর কিছু বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাঁর বিশাল সাহিত্য সম্ভারের মহাসমুদ্রে ডুব দিয়ে কিছু মণিমুক্তোর সন্ধানে আমাদের সামান্য সাহিত্যবুদ্ধিকে ঋদ্ধ করার অবকাশ রয়েছে মাত্র। তাই ১৪৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারের কার্তিকের কুয়াশা সাহিত্য পত্রিকা উৎসর্গ করা হল মহান কথাশিল্পীর উদ্দেশ্যে। এখানে নির্বাচিত সাধারণ রচনাগুলির সাথে রইল গ্রন্থ পর্যালোচনা অংশে কায়সার হারুনের, "শ্রীকান্ত"। এছাড়াও থাকছে মধুবন্তী আইচের কণ্ঠে শরৎবাবুকে নিয়ে কবিতার আবৃত্তি। শরৎ সাহিত্যের ধারার অনুসারী আরও এক স্বনামধন্য সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে তাঁর সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়েও থাকছে একটি আলোচনামূলক লেখা। সাথে অন্যান্য বারের মতই নানা রঙের কবিতায় এবারে রঙ্গিন হয়ে উঠেছে কবিতার পাতা। রয়েছে এক অপূর্ব গল্প মোটরবাড়ি। ছকে বাঁধা জীবন থেকে মুক্তির আস্বাদের খোঁজে পথ চলতে গেলে একবার চাপতেই হবে সাইদুজ্জামান মশাইয়ের মোটরগাড়িতে। আরও অনেক না বলা আকর্ষণ নিয়ে সাজানো রইল এবারের কার্তিকের কুয়াশা। সেই কুয়াশার পর্দা সরিয়ে মণিমাণিক্যের সন্ধান পেতে যেতেই হবে পত্রিকার সমস্ত পাতায়।

 

অরুণোদয় কুণ্ডু
হাওড়া , পশ্চিমবঙ্গ , ভারতবর্ষ