টরন্টো, আগস্ট ১৫, ২০২১, নভো সংখ্যা ২৩
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি সাহিত্য সংবাদ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল যোগাযোগ আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত

কার্তিকের কুয়াশা

পুরুষ

জয়া চক্রবর্তী সোমা

 

বাইরে এখনও গুলির শব্দ কানে আসছে। বন্ধ দরজার বাইরে অনেকগুলো পায়ের শব্দ। ক্ষীন হয়ে এসেছে যদিও। শ্রাবনী জ্ঞানহীন। ওর মুখ সাদা হয়ে আছে। নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চমকে চমকে উঠছে। শতছিন্ন সালোয়ার লজ্জা ঢাকতে অক্ষম। ওর দিকে জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে আছে সুচারু.....
ফর্সা রঙ, টিকালো নাক, টানা টানা চোখ,সরু ভুরু,লাল টুকটুকে ঠোঁট..বাঁ গালে একটা তিল,একমাথা কোঁকড়া চুল..ওকে দেখতে অনেকটা ওর মায়ের মত।মেয়ে হলে লোকে বলত রূপসী। কিন্তু দুর্ভাগ্য ও ছেলে। তাই লোকে ওকে বলে লেডিস। যখন ছোট ছিল সবাই গাল টিপে আদর করত। স্কুলের ম্যমেরা কোলে বসিয়ে আদর করত। কিন্তু সমস্যা শুরু হল একটু বড় হতে। ক্লাস ফাইভে সহপাঠীরা ও হেঁটে গেলে ওর পিছনে ওর হাঁটা নকল করত। ও কিন্তু হাঁটায় চলায় কথা বলায় কিছুতেই আস্বাভাবিক নয়। আর পাঁচটা ছেলের মত ওরও বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ আছে। তবু ওকে ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে ছেলেরা মিহি গলা করে বলত-"এই সর,আমায় নকল করবি না বলে দিচ্ছি। ভালো হবে না কিন্তু।" মুখ লাল হয়ে উঠত ওর। তখন ছেলেরা গান গাইত-"কোই হাসিনা যব রুঠ যাতি হ্যায় তো,ঔর ভি হসিন হো যাতি হ্যায়।"
একটা বুলি গোছের ছেলে খুব পিছনে লাগত ওর। ওকে দেখলেই সিটি দিত। গাইত-"তেরে গালো মে যো কালা তিল হ্যায়, ওহি মেরা দিল হ্যায়।" অতিষ্ঠ হয়ে হেড স্যারকে বলেছিল।হেডস্যার বকা ঝকা করেছিলেন। তবে তার দাম ওকে শোধ দিতে হয়েছিল অন্য ভাবে। ক্লাস সেভেনে তখন ও। বাথরুমে ওর প্যান্ট খুলে সেই বুলি গোছের ছেলেটা আর তার পাঁচ ছয়জন সাগরেদ দেখেছিল, ও মেল ফিমেল না আদার্স।নিজেকে ঘেন্না করত এরপর মাঝে মাঝে। বলার সাহস ছিল না। নইলে ক্লাসের অন্য ছেলেরা বলবে আর হাসবে তার রেপ হয়েছে বলে।
নিজেকে পড়াশোনায় ডুবিয়ে নিয়েছিল। একটা বন্ধু অবশ্য হয়েছিল ওর। নাম অন্তরা। অন্তরা কলেজে সহপাঠিনী ছিল। এন.সি.সি করত।পুলিশে চাকরী করবে ভাবত। সুচারুর সাথে ওর প্রথম আলাপটা অদ্ভুত ভাবে। কলেজের থার্ড ইয়ারের কিছু দাদা র‍্যাগিং করছিল সুচারুকে।একটা ওড়না জড়িয়ে মিথ্যে মিথ্যে কলসী কাঁখে হল ঘরের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কোমর বেঁকিয়ে হেঁটে যেতে হবে। চোখ ফেটে জল এসেছিল সুচারুর। তখনই এসেছিল অন্তরা।বলেছিল-"ওই কি হচ্ছে এসব? প্রিন্সিপাল স্যারকে গিয়ে বললে তোদের বারোটা বাজবে। দেব এক কানের নীচে বুঝবি সব।" আশ্চর্য বিষয়,অন্তরাকে ওরা ভয় পেত। একজন বলার চেষ্টা করেছিল-"এই অন্তরা দাদাগিরি কেন করছিস?" অন্তরা তার ঘাড়ের পিছনটা খামচে ধরেছিল। সুরসুর করে ক্লাসে চলে গিয়েছিল ছেলেটা। অন্তরা বলেছিল-"এই ছেলে এত ছিঁচকাঁদুনে কেন তুই? কানের গোড়ায় বাজাতে পারিস না জানোয়ারগুলোর।"
সেই থেকে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল অন্তরাদির সাথে সুচারুর। কাঠখোট্টা অন্তরাদির নরম মন টা বুঝত সুচারুর কষ্ট। কিন্তু মুখে সহানুভূতি ছিল না। লোকে আড়ালে বলত-"অন্তরাদা আর সুচারু বৌদি।" কিন্তু আড়ালেই বলত। সামনে বলার সাহসটা চলে গিয়েছিল ওদের। সুচারুরও আর গায়ে লাগত না। অন্তরাদি ওর কনফিডেন্সটা অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। অন্তরাদি সুচারুর একমাত্র বন্ধু। অন্তরাদিকেই সুচারু বলেছিল শ্রাবনীকে ভালো লাগার কথা। শ্রাবনীকে সেই ফ্রেসার্স ওয়েলকামের দিন থেকে ভালো লাগে। অন্তরাদি শুনে পেয়ারা চিবোতে চিবোতে বলেছিল-"ন্যেকুপুসু,ভালো যখন লাগে প্রোপোজ কর। ঢঙের কি আছে?" অন্তরাদি ওরকম করেই কথা বলে। সুচারুর কান লাল হয়েছিল। হেসে মাথা নীচু করে বলেছিল-"ধ্যাৎ তেমন না। বন্ধু হলে ভালো হত।" অন্তরাদিই শ্রাবনীকে বলেছিল সুচারুর ওকে ভালোলাগার কথা। শ্রাবনী যেন আকাশ থেকে পরেছিল। বলেছিল-"কি বলছ অন্তরাদি?তুমি কি পাগল হলে।" অন্তরা অশ্চর্য হয়ে বলেছিল-"শ্রাবনী তোকে অন্তত তাদের দলে ফেলতাম না যারা ওকে 50-50 বলে হাসাহাসি করে।" শ্রাবনী চোখ নামিয়ে বলেছিল-"দেখ অন্তরাদি আমি নরম্যাল একটা মেয়ে। নরম্যাল একটা ছেলেকে নিয়েই স্বপ্ন দেখব এটাই তো ন্যাচারাল। ওকে তো আমি পুরুষই ভাবতে পারি না। ভালোবাসব কি করে। প্লিজ অন্তরাদি আমায় জোর কোরো না।"
আজ শ্রাবনী আর সুচারু কলেজের ৪৫ নম্বর ঘরটায় একা। পলিটিক্সের জেরে গত সপ্তাহের ভোটের রেজাল্টকে কেন্দ্র করে দুই দলের মধ্যে বচসা শুরু হয় যার জেরে বোম পরেছে একটু আগে। তখন ওরা ক্লাসে। ঘটনাটার পর যে যেদিকে পেরেছে ছুটেছে। কলেজে শুরু হয়েছে ভাঙচুর। শ্রাবনীও ছুটেছিল। কিন্তু এই সুযোগে দুটো ছেলে ওকে টেনে নিয়ে গেল ৪৫ নম্বর রুমে। ভেবেছিল এই গন্ডোগোলকে ইস্যু করে নিজেদের নোংরা ইচ্ছে মেটাবে। ভয়ে আতঙ্কে জ্ঞান হারায় শ্রাবনী। কিন্তু সুচারু দেখেছিল শ্রাবনীকে ওরা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। হাতের কাছে একটা আধলা ইট হাতে নিয়ে ছুটে গিয়েছিল। বের করে নিয়েছিল বায়োলজি বক্সের ছোট্ট ছুরিটা। ইটটা ছুঁড়ে দিয়েছিল একজনের কপাল লক্ষ্য করে।অন্যজন 'লেডিস' ছেলেটার এই অদ্ভুত মুর্তি দেখে নিজেই পালিয়েছিল। বাইরে শোর্ড আর হকি স্টিক নিয়ে বেরিয়েছে দুই পার্টির মস্তানেরা। এখন বেরোনো নিরাপদ নয়। তার উপর শ্রাবনী অচেতন। তাই ছিটকানী দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে সুচারু। শ্রাবনীর দিকে তাকিয়ে মনে পরে যায় ওর কথাগুলো-"ওকে আমি পুরুষই মনে করি না।" সুচারু পুরুষ কিনা তা সে প্রমাণ করতে পারে এখনই। এই বন্ধ ঘরে অচেতন শ্রাবনীকে বুঝিয়ে দিতেই পারে তার পৌরুষ। সারাজীবনের জমা সব অপমানের বিষ সে পারে ঢেলে দিতে। কে আটকাবে তাকে? কেউ জানতেও পারবে না।
সুচারু এগিয়ে যায় শ্রাবনীর দিকে। ওর মুখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। কেমন মনে পরে যায় ক্লাস সেভেনের বাথরুমে ওর সঙ্গে ঘটা নোংরা নির্যাতনটার কথা। শ্রাবনীকে দেখে নিজের মত মনে হয় ওর। পুরুষ হবার ইচ্ছেটা আর খুঁজে পায় না ভিতরে। উলটে খুব ইচ্ছে করে মানুষ হয়ে উঠতে। পুরুষ হতে গিয়ে পশু হতে পারবে না সুচারু। শ্রাবনীর কপালে হাত রাখে ও।নিজের উইনচিটারটা চাপা দেয় ওর শরীরে। তারপর ডাকে-"শ্রাবনী..এই শ্রাবনী ওঠো লক্ষীটি।দেখ কিচ্ছু হয় নি।সব ঠিক আছে...ওরা চলে গেছে..."
বাইরের গন্ডোগোল তখন অনেক শান্ত...ঠিক সুচারুর বুকের ভিতরটার মত...

 

 


 

 

নতুন সকাল

-পারমিতা কর

 

মাথায় শিরা উপশিরা দপ দপ করছে সুনিপার। এটা কি হলো! পার্থ এমন ঘর ভর্তি লোকের মাঝে ওকে ওমন অপমান করলো! ভাবতেই পারছে না। পার্থ! ওর পার্থ! পাঁচ বছর লিভ ইন সম্পর্কের মধ্যে পার্থ আর সুনিপা। একই অফিসে কাজ করার সুবাদে পরিচয়, বন্ধুত্ব তারপর প্রেম। সুনিপার কাজের প্রতি প্রবল নিষ্ঠা। গত মাসে হেড অফিস থেকে ওর প্রমোশন হয়। তার ফল স্বরূপ পার্থ সুনিপার অধীনে চলে আসে। কিছু দিন ধরে সুনিপা লক্ষ্য করছিল পার্থ ওকে অবজ্ঞা করছে। ও কিছু বললে টালবাহানা করে কাজটা অন্য কাউকে দিয়ে করাচ্ছে। সেদিন এই নিয়ে অফিসে বসের কাছে দু চার কথা শুনতেও হয়েছিল সুনিপাকে। তারপরই বসের কাছ থেকে আবার চেন্নাইয়ের প্রস্তাবটা এসেছিল। যেটা নিয়ে এত দিন দোনামনা করছিল, সেটা মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনও উপায় পেলো না যেন। আজ ওদের বাড়িতে কিছু বন্ধুদের ডেকেছিল নতুন বছরের পার্টির জন্য। হঠাৎ কিছু বন্ধুর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানতে পারে পার্থ, মিত্র অ্যান্ড সরকার কম্পানিতে চাকরি পেয়েছে। শোনার পর থেকে বোঝার চেষ্টা করছিল পার্থ কবে অ্যাপ্লাই করেছিল! ওকে বলেনি কেন! পার্থকে ড্রিঙ্ক কাউন্টারের সামনে একটু একা পেয়ে প্রশ্নটা করেছিল শুধু। আর তারপর... ওখানেই সকল বন্ধুদের ডেকে ওকে এতো অপমান করলো, এমনকি গায়ে হাত তুলতেও গিয়েছিল। এই পার্থকে সুনিপা চিনতে পারছে না। বেডরুমের দরজা বন্ধ করে নিজের সমস্ত জিনিস গুছিয়ে নিতে নিতে ভাবছিল, মানুষ চিনতে, ভালোবাসা চিনতে এতো ভুল করলো! কলেজের বন্ধু জয়াকে ফোন করে নিল। কিছু দিন ওর কাছে থাকবে। উবের বুক করে একটা চিরকুটে পার্থর জন্য লিখে বেরিয়ে পরলো। রাতে ফোনটা এলো। পার্থ হঠাৎ অসুস্থ অনুভব করাতে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে বন্ধুরা। সবে ফ্রেশ হয়ে বসেছিল জয়ার কাছে। এখন আর ইচ্ছে করল না হাসপাতালে যেতে। কাল সকালে সব ঠিক থাকলে পার্থকে কিছু কথা বলবে ভেবে ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেল। পার্থকে ফোন করলো। সৌমেন ধরল ফোন। ওর থেকে জানতে পারলো পার্থর একটা ছোটো মতো হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। এখন ঘুমোচ্ছে। সকালে যাবে হাসপাতাল, বলে ফোন রাখলো। সারারাত আর চোখের পাতা এক হলো না। ভোরের আলো ফুটতেই গাড়ি বুক করে হাসপাতালে গেল। ডাক্তার দেখছিলেন। সুনিপাকে দেখে সৌমেনরা বাড়ি ফিরে গেল তখনকার মতো। ডাক্তার বের হতেই ওনার সঙ্গে কথা বলে পার্থর কাছে গেল। পার্থর চোখে মুখে বিষণ্ণতার কালো ছায়া। কিছুই কথা বলছে না। সুনিপা নিজের হাত রাখলো পার্থর একটা হাতে। অন্য হাতে স্যালাইনের চ্যানেল লাগানো। পার্থর চোখে জল। সুনিপা বলল, -কেমন লাগছে তোর? পার্থ ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো। - আমায় ছেড়ে যাস না। আমি পারবো না তোকে ছেড়ে থাকতে। সুনিপা বলল, -পার্থ, আমার তোকে বলা হয়নি। গতকাল রাতেই বলতাম। আমি আগামী কাল অফিসের কাজে চেন্নাই যাবো চার মাসের জন্য। বসের সঙ্গে সব কথা হয়ে গেছে। যদি ওদিকে অফিসের ব্রাঞ্চ সেটআপ হয়ে যায় এর মধ্যে তাহলে আমাকে ওখানেই থেকে ওদিকের সব দায়িত্ব নিতে হবে। তাই আজ থেকে আমরা যে যার পথে চললেই ভালো হবে। তোর বিপদ কেটে গেছে শুনলাম ডাক্তারের থেকে। আমি এখন অফিসে যাবো কিছু ফাইনাল কাজ বাকি আছে। মন খারাপ করিস না। আমাদের সম্পর্ক এই পর্যন্ত থাকলো। তুই কখনও চাসনি যে, আমি চেন্নাই যাই। কিন্তু এখন আর উপায় নেই। যদি বন্ধু ভাবিস তবে পাশে পাবি। তার বেশি আর কিছু সম্ভব নয়। সূর্যের আলো হাসপাতালের করিডরে পড়ে সুনিপার ভবিষ্যতের পথ আলোকিত করছে যেন! পার্থ হতবাক ভাবে সুনিপার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে... ।

 


নির্জনে একাই

রত্না চক্রবর্তী

 

 ২.৮.২১
নির্জন খাঁখাঁ রাস্তা! কলকাতার রাস্তা যে কখনো এমন হতে পারে তা কখনো মিনতি। ভাবেনি মার কাছে গল্প শুনেছিল কবে যেন যুদ্ধের সময় লাইটপোষ্টের চারপাশে কালো আবরণ দিয়ে রাখত যাতে আকাশ থেকে প্লেনে শহরটাকে ঠিক বোঝা না যায়। তাকে নাকি ব্ল্যাকআউট বলত। মিনতি সে সব দেখেনি। কিন্তু আজ যে ভয়াবহ অবস্থা হয়েছে সেটা সে কেন, তার মাও কখনো দেখেনি। বৃদ্ধা মা বাড়িতে আছেন। টিভিতে মোবাইলে রাস্তাঘাটে ছবি দেখে তিনি খুব অবাক হয়ে গেছেন! এমন হয় এই কলকাতায়, সন্ধ্যে রাতেই নির্জন, নিস্তব্ধ! শহর যেন অজ্ঞান হয়ে গেছে... এখন মিনতি এই রাস্তায় প্রানপণে দৌড়াতে চেষ্টা করছে, চটিতে সেফটিপিন আটকানো, পায়ে লাগছে। ছুটতে ছুটতে উঁচু করে রেখেছে হাতের প্রেসক্রিপশনটা।যদি পুলিশ ধরে! কাছের ওষুধের দোকানে সে কালকে বলে রেখেছিল ওষুধ দেবার কথা কিন্তু কোন এক অজানা কারণে এসে পৌঁছায়নি দোকানে। কাল পরশুর মধ্যে এনে দেবে। মিনতি দক্ষ আয়া। সে কিন্তু ওষুধ থাকতে থাকতেই দোকানে খবর দিয়েছিল তাই চলে গেছে কাল আর আজ সকাল অবধি। বিকেলে দিতে গিয়ে হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল নিচে আর দাদুর থুতু ফেলার যে পাত্র রাখে তার মধ্যে পড়ে গেল। চোখ ফেটে জল এসে গেল মিনতির। এখন বুড়ো হার্টের রুগী মানুষটা কে সে কি করে ওষুধ দেবে? ফোন করল ওষুধের দোকানে নাম্বারটা লেখা আছে কিন্তু বাপ্পাদা অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করে বললেন যে ওষুধটা এখনো আসেনি। তবে এর কাছাকাছি কম্বিনেশনে ওষুধ আছে। মিনতি নিতে পারে। সে আয়া আত্মীয় নয়, ছেলেমেয়েরা কেউ কাছে নেই, একটা রোগীকে নিজের ডিসিশনে অন্য ওষুধ খাওয়াতে সাহস পেলো না সে। যদি কিছু হয়ে যায় তো লোকে তাকে ছাড়বে না আর মিনতি নিজেই কি শান্তি পাবে। এই ভুবন দাদুর কাছে সে ঠায় পাঁচবছর আছে। বড় মায়া পড়ে গেছে। পাশের ফ্ল্যাটের যে বাচ্চাটা রাতদিনের কাজ করে তাকে ডেকে দোরে বসিয়ে তাই ছুটে চলেছে মোড়ের মাথায়। বিমলদাদুর বাড়ি। উনি ভুবনদাদুর বন্ধু। হাঁটাচলা করতে পারেন। এখনো এসে দাদুর খোঁজ নেন। না এখন বলতে এই লকডাউনে তিনি আসছেন না। ফোন করেন। বিমল দাদুর কাছে এই ওষুধটা থাকে। বিমলদাদু ব্যবহার করেন। যদি পাওয়া যায় তাহলে আজ রাতের মতো খাইয়ে দিতে পারবে। ফোন করে বিমল দাদুকে পেল না। দাদুর এই এক দোষ মোবাইলে ঠিকমতো চার্জ দেন না। ওনার কাছে ওষুধ থাকবেই। একবার বিমলদাদু বলেছিলেন "দুই বন্ধুর কি মিল দেখ অসুখ আর ওষুধ ও একই।"
মিনতি বিমলবাবুর বাড়ির বেল বাজালো। ওপর থেকে মুখ বাড়ালেন দাদু "কে?" জিজ্ঞেস করলেন। মিনতি বলল ব্যাপারটা নিচের থেকেই। ওষুধের খোলাটা হাতেই ছিল। দাদু বললেন " ওরে এ মাস থেকে ওই ওষুধটা আমার বাতিল হয়ে গেছে। তাই তো আর জানানো হয়নি রে। কি মুশকিলে পড়লি বলতো। এখন কি করবি? "মিনতি খুব চিন্তায় পড়ে গেল. সে বলল" দাদু আমি বাড়ি চলে যাই পাশের বাড়ির বাচ্চাটাকে বসিয়ে এসেছি। দেখি কি করা যায়।" মিনতি বাড়ির দিকে ফিরে চলল।
মন খুব খারাপ মিনতির. ভুবনদাদুর মনটা বড় ভালো, গরীব দুখীর জন্য এখনো অনেক করেন। ছেলেমেয়েরা কেউ এখানে বড় একটা থাকে না, মিনতিকে তাই বড় ভালোবাসেন। মোড়টা পার হয়ে নতুন আধ তৈরি হওয়া ফ্ল্যাটের কাছে এসে মিনতি একটু থমকালো। পিছন পিছন কে একজন আসছে বলে মনে হলো। একদম জনশূন্য পথ-ঘাট। একটু ভয় পেল মিনতি কে জানে দুষ্টুলোকের এটাই আবার সুযোগ হতে পারে। পিছন ফিরে তাকাল এক রোগা মতন ভদ্রমহিলা আসছেন। একটু নিশ্চিন্ত হয়ে মিনতি পথ চলতে লাগলো। তারই মত কেউ কোন বিপদে পড়ে পথে বার হয়েছে। একটু এগিয়ে ভদ্রমহিলা তাকে ডাকল "এই মেয়ে শুনছো? " মিনতি থমকে দাঁড়ালো। ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে বললেন "তুমি ওই সেন বাড়িতে মানে লাল রঙের বাড়িটাতে ওষুধ চাইতে গেছিলে না? আমি তোমায় দেখলাম। ওই ওষুধের প্যাকেট টা দেখে বুঝতে পেরেছি ওটা আমার কাছে আছে। তাই পেছন পেছন এসেছি যদি কোন উপকার হয়। "
"আপনি কোথায় ছিলেন মাসিমা " জিজ্ঞাসা করল মিনতি। " মহিলা বললেন "আমি নীচের ঘরেই ছিলাম জানলা দিয়ে তোমায় দেখতে পেয়েছি। এই নাও তিনটে ওষুধ আছে। " মিনতি দেখল ফাইলের বাকী ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছিল। তিনটে বোধহয় ছিল। রাস্তার আলোয় পড়ার চেষ্টা করল। এক্সপায়ারি ডেটটা ঠিক মতো দেখতে পেলো না। ভাবলো বাড়ি গিয়ে দেখবো। চেষ্টা করল ভদ্রমহিলার হাত ধরে কৃতজ্ঞতা জানাতে। তা বুঝতে পেরে পিছনে সরে গেলেন মহিলা বললেন" যাও তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও আর দাঁড়িয়ে থেকো না।" মিনতি ভুলেই গিয়েছিল গ্লাভস ছাড়া কারো হাত ধরা উচিত নয়।
বাড়ি এসে দেখল ওষুধের ডেট এক্সপায়ার হতে দুমাস বাকি। মিনতি শান্তি পেয়ে গেল। দুদিন বাদে ফোন করলেন বিমল দাদু। মিনতি বলল "দাদু আপনার নিচের ঘরে যিনি থাকেন তিনি কে হন আপনার? " বিমল দাদু চিন্তা করে বললেন "এখন তো কেউ থাকে না ওই ঘরে আমার এক ভাইঝি এসে থেকেছিল কিছুমাস। " মিনতি বলল " কিন্তু সেদিন আপনার বাড়ি থেকে আসার সময় ওই নিচের ঘরের ভদ্রমহিলা আমায় ডেকে ওষুধ দিয়েছিলেন তারপরে আমি দাদুকে খাওয়াই। কি যে উপকার হয়েছিল সেদিন। এখন আমি ওষুধ পেয়ে গেছি।" অবাক গলায় বিমলদাদু বললেন " আমার নিচের ঘরে ভদ্রমহিলা মানে! আমার নিচের ঘরে এখন কেউ থাকেনা তো! তুই ভুল করছিস " মিনতি বলল " উনিই তো বললেন যে নিচের ঘরে থাকেন, থুতনির কাছে একটা কাটা দাগ! " বিমলদাদু চুপ করে রইলেন পরে বললেন "তোকে একটা ছবি পাঠাচ্ছি, দেখ তো এই ভদ্রমহিলা কিনা! " খানিকবাদে একটা ছবি পাঠালেন। মিনতি দেখল সেই মহিলা।বিমলদাদু বললেন " এই আমার ভাইঝি। তোর দাদুর মতোই হার্টে রোগ ছিল। মারা গেছে আট মাস আগে। বড় মায়াবী মেয়ে ছিল। মনটাও নরম ছিল। " বিশ্বাস করতে পারল না মিনতি। এও কি সম্ভব! না কি তার ভুল হয়েছে! কিন্তু এখনো রয়েছে সেই ওষুধের খালি ফাইলটা ওয়েস্টপেপার বক্সে। সম্ভবত করুণাময়ী হয়ে একজন অসুস্থ মানুষকে বাঁচাতে এসেছিলেন তিনি এই দুর্দিনে।।