জয়া চক্রবর্তী সোমা
আজ হাতে নাতে সব ব্যটাকে ধরবে অবিনাশ। সব বদমাইশের গাছ এক একটা। কেউ যদি
নিজের কাজটা ঠিকঠাক করে! একটু সুযোগ পেলেই অমনি ফাঁকি। অবিনাশের পক্ষে কি
রোজ রোজ এইভাবে দেখা সম্ভব। নেহাত পাশের বাড়ীর রেশমির মায়ের থেকে খবরগুলো
পাচ্ছে তাই।কিন্তু রেশমির মায়ের তো আর অবিনাশের বাড়ির দিকে চোখ পেতে বসে
থাকার দায় নেই। যেটুকু করে, ভালোবেসেই করে, অবিনাশের অসহায় অবস্থা দেখেই
করে।
বেশ কিছুদিন ধরেই ব্যপারগুলো রেশমির মা মারফত কানে আসছে তার। অবিনাশের
স্ত্রী মায়া প্যারালাইজড। বিছানা থেকে উঠতে পারে না আজ তিন বছর। মেয়ে এখন
ক্লাস সেভেনে পড়ে।সংসারের সবটুকু একা হাতে সামলাতে হয় অবিনাশকে। বাধ্য হয়েই
কিছু মাইনে করা লোকের উপর নির্ভরও করতে হয় তাকে।অবিনাশ বেসরকারী অফিসের
উচ্চপদে আছে।তাই টাকা দিয়ে লোক রাখাটা তার সমস্যা নয়।সমস্যা হল এই সব
ছোটলোক ক্লাসের লোকগুলোর উপর নজরদারী করা।
একটা দিনের আর একটা রাতের আয়া আছে।রাতের আয়া রাত আটটা থেকে সকাল আটটা আর
দিনের আয়ার সকাল আটটা থেকে রাত আটটা।কিন্তু রাতের আয়া সকাল সাতটা থেকে রেডি
হয়ে থাকে বাড়ি যাবার জন্য। ভীষণ বিরক্ত লাগে অবিনাশের। কাজের ব্যাপারে কোন
ডেডিকেশন নেই। দশদিন অন্তর সেন্টার থেকে টাকা নিতে আসার সময় তো এতটুকু
হেরফের হয় না। একদিন তো অবিনাশ বলেই দিল-"মৌসুমি তোমার তো আটটা অবধি থাকার
কথা। এত পালাই পালাই করলে তো মুশকিল।তুমি চলে যাও আর সবিতাদি যদি আটটার
জায়গায় সাড়ে আটটায় ঢোকে তবে আমার তো বাস মিস হয়। এর জন্য প্রতিদিন তো অফিস
লেট হয়ে যাচ্ছে।"
মৌসুমি অপ্রস্তুত হেসে বলে-" কি করব দাদাবাবু,ছেলের বাবা আমি গেলে পরে
কারখানা যাবে। ঘরে একা দুধের ছেলেকে ফেলে তো যেতি পারে না। তাই..."
মনে মনে বিরক্ত হয় অবিনাশ। তোমার দুধের ছেলে আর অসহায় বর তো আমি কি করব।
কাজ করতে এসে এসব বাহানা দেবার কোন মানে হয়। ডিসগাস্টিং। এমনিতেই তো রোজ
রাতেই প্রায় ঘুমিয়ে পরে মৌসুমি। মায়ার দরকার পরলে ডাক দিলে ধড়মড় করে ওঠে
তবে। কেন হবে এটা?রাতের আয়ার তো ঘুমানোর কথাই নয়। জেগে টুলে বসে থাকার কথা।
কোন প্রফেশানালিজম আছে এদের? সেই যদি মায়ার ডাকাডাকি তে অবিনাশের ঘুমই ভেঙে
যায় তবে মৌসুমিকে কাড়িগুচ্ছির টাকা দিয়ে পুষে লাভটা কি? রাতে ঠিকঠাক ঘুম না
হলে অফিসে গিয়ে বড্ড ঘুম পায়। টিফিন আওয়ারে তো বেশ কিছুটা ঘুমিয়েই নেন
অবিনাশ এর জ্বালায়।কিন্তু এটা তো সমাধান হতে পারে না। ফাঁকিবাজির একটা
লিমিট থাকা উচিত।
সবিতাদি তো আরেকজন। হেলে দুলে রোজই প্রায় সাড়ে আটটায় আবির্ভূত হন দেবী। তাও
যদি কাজটা ঠিকঠাক করে। রেশমির মা প্রায় রোজ দুপুরেই দেখে সবিতাদি মেঝেতে
শুয়ে ঘুমায়। একদিন রেশমির মা দরজায় কড়া নেড়েও দেখেছে। মহারানীর ঘুমের এমন
বহর যে ওঠে নি। রেশমির মা ভদ্রমহিলা ভালো বলে এইসব নজর করেন। নইলে
আজকালকারদিনে কে পরের জন্য এত করে। আজ তাই এই দুপুরেই হানা দেবে অবিনাশ।
গিয়ে যদি দেখে সবিতাদি ঘুমাচ্ছে, তবে আজই সেন্টারে রিপোর্ট করবে।
কম করেছে অবিনাশ এদের জন্য। অফিস থেকে কত সময় কত কাগজ এনে দিয়েছে, অফিসের
স্টোর থেকে পাওয়া পেন এনে দিয়েছে সবিতাদির ছেলের জন্য। সে নাকি এবছর
মাধ্যমিক দেবে। অবিনাশের আন্ডারেই পুরো অফিসের স্টোরের দায়িত্ব থাকে। তাই
অসুবিধা হয় না। কিন্তু এই সব উপকারের কি এই প্রতিদান!
রান্নার মাসী তো এদের দুজনের ওপর দিয়ে যায়।রীতিমত হাতটান আছে ভদ্রমহিলার।
মশলা আলু পিঁয়াজ সরায়। এটা অবিনাশের মেয়ে পিয়ালীই আবিষ্কার করেছে। আটপৌরে
করে শাড়ী পরে মাসী। আর তার কোঁচড়ে এই সব সরায়। একদিন বাথরুমে শুকনো লংকা
পরে থাকতে দেখে সন্দেহ হয় পিয়ালীর। একটু আগে মাসীই বাথরুম গিয়েছিল। বুঝতে
অসুবিধা হয় না তার কোঁচড় থেকেই চুরির মালের একদুখানা ঝরে পরেছে। পিয়ালীই
অবিনাশকে এসে বলে-"জানো বাবা লক্ষ্মীদিদা মশলা সরায়।" অবিনাশ মনে মনে ভাবেন
মেয়ে ঠিকই বলছে। পুরুষ মানুষ, সাংসারিক মশলা সবজির হিসেবে তত মাথা গলান না
তিনি। কিন্তু ইদানীং যেন বড্ড বেশীই খরচ হচ্ছে এসবে। হেসে পিয়ালীকে
বলেন-"এবার নতুন লোক দেখে তোমার লক্ষ্মীদিদাকে আমি সরাবো।"
ভাবতে ভাবতে বাড়ির দরজায় এসে পৌঁছে গেছে অবিনাশ। কড়া নাড়ে। ভিতর নিস্তব্ধ।
তার মানে রেশমির মা মিথ্যে বলে নি। সবিতাদি ঘুমাচ্ছে।আরো জোরে কড়া নাড়ে
অবিনাশ। একটু পরে সবিতাদির গলা পাওয়া যায়-"কে?"
অবিনাশ ভারী গলায় বলে-"আমি।"
সবিতাদি তাড়াতাড়ি এসে দরজা খোলে। ফোলা ফোলা চোখমুখ দেখে বুঝতে অসুবিধা হয়
না সে ভাতঘুম দিচ্ছিল। অবিনাশকে দেখে অপ্রস্তুত স্বরে বলে-"একি দাদা আপনি
এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন যে? শরীরটরীর... "
সবিতাদিকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েই অবিনাশ বলেন-"কেন তোমার ঘুমের খুব অসুবিধে
করে দিলাম সবিতাদি? বেশ তো জমিয়ে সুখের চাকরী করছ। খাচ্ছ দাচ্ছ পাখার নীচে
ঘুমুচ্ছ। আবার বিকেলে স্টার জলসায় সিরিয়াল দেখছ। তা সেন্টারে কি তোমার এই
সব সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য প্রতি মাসে টাকাগুলো গুনছি বল তো?"
সবিতাদি মাথা নীচু করে বলে-"দাদা...আসলে..মানে..বৌদি তো ঘুমুচ্ছিল..রাতে
একটা আয়ার কাজ নিয়েছি তো...ছেলের অনেক খরচ তো...ঘুম হয় নি.. তাই চোখ লেগে
গিয়েছিল..."
সবিতাদি হয়ত আরো কিছু বলত। আর অবিনাশও হয়ত আরো অনেক কথাই শোনাতো।কিন্তু এই
সময় অবিনাশের ফোনটা বেজে উঠল। অবিনাশ রাগ রাগ চোখে 'দাঁড়াও তোমায় দেখছি
পরে' গোছের মুখ করে পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করে।
ওপাশে অসহিষ্ণু গলা বলে ওঠে-"কি ব্যাপার সেন? কোথায় তুমি? চেয়ারে নেই কেন?"
এ গলা অবিনাশের চেনা। প্রমাদ গোনে মনে মনে।উপরওয়ালা আজই হঠাৎ তার খোঁজ করছে
কেন? কিছু ভাবে কি জানতে পেরেছে তার অফিস কাটার কথা? অফিসে খোচরের তো অভাব
নেই। নিজের দরকার থাক না থাক অন্যের পিছনে কাঠি না করে তাদের শান্তি হয় না।
নিশ্চয় পিওন অভয়ের কাজ এটা। শালার সাথে অবিনাশের তলায় তলায় ক্ষার আছে। মুখে
বিগলিত স্বরে বলে-"স্যার মানে আসলে আজ ওই একটু দরকারে বেরিয়ে এসেছি, কাজ
ছিল না তাই..."
ওপাশের গলা ধমকের সুরে বলে-"আপনার তো রোজই দরকার পরে সেন। কিন্তু এটা তো
অফিস। একটা প্রফেসানাল জায়গা।এখানে আপনার পারিবারিক প্রবলেম নিয়ে মাথা
ঘামাবার মত সময় কারোর নেই।"
অবিনাশ প্রায় মিউ মিউ করে কিছু বলতে যায়।কিন্তু সুযোগ পায় না। ওপাশের
কন্ঠস্বর বলে চলে-"অনেক কমপ্লেন পাচ্ছি আপনার নামে আজকাল। রোজ লেটে ঢুকছেন।
টিফিনে ঘুমুচ্ছেন, আগে বেরিয়ে যাচ্ছেন...বেশ সুখের চাকরী করছেন মশাই।
কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না। আ উইল সী ইউ টুমরো আর্লি ইন মাই কেবিন। মনে
থাকে যেন।" কাঁপা স্বরে -"ইয়েস স্যার বলার আগেই ফোন কেটে যায়।"
সবিতাদিকে আর বকে ওঠা হয় না।পরি মরি প্রেজেন্টেশন টা আজ সুচারু ভাবে
কমপ্লিট করে কাল সকাল সকাল বসের টেবিলে সাবমিট করতে হবে। কাজে খুশী হলে কম
ঝাড় খেতে হবে।
অবিনাশের নাকে আসে বেগুনী ভাজার গন্ধ।সবিতাদি সে আগে এসে গেছে বলে বোধহয়
বেগুনী চাএর ব্যবস্থা করছে। যাক গে,বকে টকে সমঝে দেওয়া গেছে। আর চেঁচামেচি
করে কাজ নেই।
অবোলার বুকের মাঝে
রত্না চক্রবর্তী
৩.৭.২১
খাঁকি পোশাক পরা খিটখিটে লোকটা আঙুলটা আলতো করে বুলিয়ে যাচ্ছিল আমাদের গায়ে।
আমরা ভয়ে আতঙ্কে চিন্তায় কাঁপছিলাম।লোকটা এগিয়ে চলছিল আরো ভিড়ের দিকে। খদ্দের
ধরার জন্য কার হাতে বেচবে আমাদের। আমার আগের পাঁচটা সঙ্গিনী একসাথে বিকিয়ে গেল
একটা চোয়ারে লোকের কাছে। তারপর আরো দুজন বিকালো একটা সাজুগুজু করা প্রৌঢ়ার
কাছে। তারপরের জন একলাই বিকোলো। এবার আমার পালা... হ্যাঁ ঠিকই আমাকে সে তুলে
দিলো একটা হাতে টাকার বিনিময়ে। ভয়ে কেঁপে উঠলাম কিন্তু যে নিষ্ঠুর হাতটা আমি
আশঙখা করেছিলাম এটা তো তেমন হাত নয়। একটা নরম স্নেহ কোমল কিশোরের হাত। হাতটাও
যেন কেমন কাঁপা কাঁপা, ও তো ক্রেতা, ওর ভয় কিসের! না বোধহয় ভয় না উত্তেজনায়।
মুখটা অল্প লালচে ঘামছে আর মোবাইলটা বারবার দেখছে।
আমার দিকে তাকালো একবার, যেন হুঁশই ছিল না যে আমি ওর হাতের মাঝে ধরা আছি। আস্তে
আস্তে সযত্নে রাখল আমায় বুকের মাঝে। আমি কেঁপে উঠলাম। উতপ্ত হৃদয়ের স্পন্দন আমি
অনুভব করছি। কি এক অদ্ভুত আবেগ আমার মধ্যে জেগে উঠল।
গাড়ি চলছে...একটা বাদে অল্প চেঁচামেচি উঠল। গাড়ি থেমে গেল।। কিশোর ব্যাকুল হয়ে
জিজ্ঞাসা," কি হয়েছে এত গন্ডগোল কিসের? গাড়ি ছাড়ছে না কেন? আমাদের তাড়া আছে
তো?"
শুনলাম পাশের একজন বলল, " এখনই গাড়ি ছাড়বে, সামনে একটা মিছিল যাচ্ছিল। "
ও অধীর হয়ে গাড়ির দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আর তখনই ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি চলতে শুরু
করল। একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে ও নিজের বুকে হাত বোলালো। আমার গায়ে হাত বোলালো।
একটু বাদেই শুনতে পেলাম রবীন্দ্রসদন রবীন্দ্রসদন " হাঁক। দুদ্দার করে কজন নামল,
আমরাও নামলাম। ওর বুকে যেন ঢাকের বাদ্দি, উঁকি দিয়ে মুখের যেটুকু দেখতে পেলাম
খুশিতে ঝকঝক করছে।
ও দ্রুত পা চালাল, কি সুন্দর জায়গাটা! চামড়া আর ঘামের গন্ধে বন্দী জীবন আমার,
পিনের খোঁচা সয়ে সারাশরীর যেন জ্বলে গেছে। আজ খোলা জায়গায় এসে বড় তৃপ্তি হচ্ছে।
হঠাৎ উচ্ছ্বসিত গলায় ও ডেকে উঠল," প্রিয়া? "
আমি চমকে উঠলাম। উঁকি মেরে দেখি একটি মেয়ে ছুটে এসে ওর হাত ধরলো। কি সুন্দর
দেখতে! কি অপূর্ব! হাসিমুখে দুজনে দুজনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইলো যেন কথা
ফুরিয়ে গেছে। আমিও অবাক হয়ে ওদের দেখছি তারপর দুজনে গল্প করতে করতে এগিয়ে
চললো। একটু দূরে সিমেন্ট বাঁধানো একটা চত্বর সেখানে ওরা বসবে। মেয়েটি বলল,
"এখানে কি একটা পোকার মত পড়ে রয়েছে বসতে ভয় করছে,এই ফেলে দাও না প্লিজ। "
উদ্যত গলায় ছেলেটি হেসে উঠল বলল," ধুর পাগলী, এই ছোট্ট একটা পোকায় এত্ত ভয়,
দাঁড়াও ফেলে দিচ্ছি। "
এদিকওদিক তাকিয়ে একটা গাছের শুকনো পাতা দিয়ে ছেলেটা পোকাটাকে সরাতে গেল।
কিন্তু পুরনো মুচমুচে পাতাটা ভেঙে গেল।
"গেল না, এখনো যায়নি। আমি এখানে বসবো না " মেয়েটা বলল।
ছেলেটা বলল, " দাঁড়াও দেখছি কি করা যায়..."
এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজতে লাগল। আমার কি ভালো লাগছিল, মেয়েটাকে কত্ত
ভালোবাসে, মুখে চিন্তার ছায়া। হঠাৎ কি মনে করে সে হাসল।তারপর বলল," পেয়েছি
পেয়েছি। এই টিকিটটা এবার কাজে লাগবে "
পরম যত্নে বুকের পকেট থেকে বার করে আনল আমায়! চারভাঁজ করল...আমার একটু লাগল
কিন্তু বিষ্মিত হয়ে ভাবলাম, কি করতে চলেছে।
ও মেয়েটির দিকে তাকিয়ে একঝলক উজ্জ্বল হাসি হাসল। তারপর আমাকে দিয়ে ছোটপোকাটাকে
ছিটকে ফেলে দিল মাটিতে। আমি ঘেন্নায় সিঁটিয়ে গেলাম। ও পা দিয়ে চাপ দিল আমার
বুকে। ওহ! কি অসহ্য যন্ত্রণা... মরা পিষ্ট পোকাটিকে বুকে নিয়ে আমি পড়ে রইলাম
ওদের পায়ের তলায়।
কি নিষ্ঠুর! কিন্তু কই নিষ্ঠুরতা ওর চোখে? কি অপরিসীম মায়া কি ভালোবাসায় আলোকিত
মুখ ও মেয়েটিকে হাত ধরে বসালো পাশে। অবোলা আমি শেষ হয়ে যেতে যেতে সেই স্বর্গীয়
মুখখানার ছবি বুকের মাঝে গেঁথে রাখলাম।।
নীলাঞ্জনা সরকার
আমি প্রতিষ্ঠিত বাংলা পত্রিকার সাংবাদিক। সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য জানি না,
হঠাৎ অফিস থেকে হুকুম এলো সুন্দরবনের ওপর একটা কিছু লিখতেই হবে আমাকে।
কিছুদিন আগেই এক ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে সেখানকার অবস্থা নাকি বেশ খারাপ তাই
আমায় সেখানে যেতে হবে। সত্যি বলতে কি শুনে খুব খুশি হইনি আমি! যতই হোক তবু
তো সুন্দরবন! অগত্যা আমি শিবদাস পাঠক আর আমার নিত্য সহচর মলিন দাস যিনি
পেশায় ক্যামেরাম্যান মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম বাঘের পেটে যাওয়ার
জন্য।মলিন দাসের নাম মলিন কেন তা গত দশ বছরে জানতে পারিনি, শুধু এটুকু
বুঝেছি তিনি সর্বদাই কিছু না কিছু শারীরিক সমস্যাতে ভোগেন। একদিন ভোরবেলা
দুগ্গা দুগ্গা বলে বাসে উঠে বসলাম। প্রথমে যাব গদখালী জেটি তারপর সেখান
থেকে নৌকাতে চেপে যাব বাঘমামার ডেরায়। মনের ভার অনেকটা কেটে গেল নৌকা
বিহারে। চারিদিকের কি অপরূপ বিস্তৃতি। মলিনবাবুর ক্যামেরা কাজ করতে শুরু
করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্য
দেখতে দেখতে কখন একটু চোখ লেগে গিয়েছিল। যদিও একজন নিষ্ঠাবান সাংবাদিকের
এমন হওয়া উচিত নয় তবুও নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম এই বলে যে সুন্দরবন আসতে
হবে ভেবে অনেক রাত ভালো করে ঘুম হয়নি। নৌকা গিয়ে সজনেখালি ঘাটে থেমেছে।
আমাদের আপ্যায়ন করতে দাঁড়িয়ে আছেন গেস্ট হাউসের ম্যানেজার স্বয়ং।
দুপুরের ভোজনটা একটু বেশি হয়ে যাওয়ায় সেদিন সূর্যাস্ত দেখার পরিকল্পনা
বাতিল করি। ম্যানেজার বাবুকে সকালের দিকে গ্রামের ভিতরের লোকালয়ে যাওয়ার
ব্যবস্থা করতে বলি আমরা। তিনি ঘাড় নেড়ে আমাদের ঘরের বারান্দা পেরিয়ে
অফিসের দিকে চলে যান। আর ঠিক সেই পথেই একজন কালো বেটে মানুষকে হেঁটে আসতে
দেখি আমাদের ঘরের দিকে।
বাবু, আমি বিশু মাইতি, আপনাদের গাইড। হলদেটে সাদা দাঁত বার করে বিশু এক গাল
হাসি হাসে। বাধ্য হয়ে আমাকেও হাসতে হয়। হঠাৎ আমার পিছনে মলিনবাবু এসে
ক্লিক করে আওয়াজ করে। চমকে গিয়ে একটু রেগেই যাই আমি, কিন্তু মুখে কিছু বলি
না। মনে মনে ভাবি কাজ নেই তো খই ভাজ -ছবি তোলার আর জিনিস পেলো না! যাইহোক
শেষমেষ ভাবলাম যে কাজে আসা সেই কাজে একটু মন দেওয়া ভালো। বিশুকে ইশারায়
ডাকতেই সে এসে একেবারে সামনে, তাকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম এতক্ষণে- বয়স
হয়তো চল্লিশোর্ধ , মাথায় কোকরানো চুল হলেও তা পাতলা হয়ে এসেছে। তবে
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো তার চোখের বাদামি তারার তীক্ষ্ম দৃষ্টি আর বা কান
ঘেঁষে গলা ছাড়িয়ে কাঁধ অবধি একটা লম্বা কিছুর দাগ। সে বিষয় জিজ্ঞেস করার
আগেই বিশু বলে উঠলো বাবু, রাতে বেরোবেন না, আমিও আজ আসি কাল সকালে দেখা
হবে। কিন্তু বিশুকে মলিন বাবু আটকে দিল, হঠাৎ সে প্রশ্ন করে বসে বিশুর ওই
অদ্ভুত দাগটা নিয়ে। তার উত্তরে বিশু যা বললো আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। বিশু
বললো সে পোচার (চোরা শিকারি) ছিল এক সময়ে, আর কোনও এক অজ্ঞাত কারণে দু বার
বাঘ তাকে মেরেও মারেনি। সেই থেকে বাঘকে দেবতা রূপে গণ্য করে সে। সাংবাদিক
হিসাবে যথেষ্ঠ নাম কুড়িয়েছি, কিন্তু এমন কাহিনীর কখনো সম্মুখীন হইনি, তাই
এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলাম না। যে কাজে এসেছি সে কাজ কাল সকালে শুরু
হবে তাই আজ রাতটা বিশুর গল্পের সাক্ষী হওয়াটাকেই সমীচিন বলে মনে করলাম।
মলিন বাবুর সাথে চোখে চোখে কথা হয়ে গেল আমার - সে বিশুকে প্রস্তাব দিল সেই
রাতটা আমাদের সঙ্গে কাটাবার জন্য। বিশু প্রথমটা রাজি না হলেও শেষে আমাদের
অধীর আগ্রহ দেখে থেকে গেল। রাতের খাবার খেয়ে আমাদের ঘরের সামনের বারান্দায়
বসলাম তিনজনে - শুরু হলো বিশুর গল্প।
বিশুর বয়ানেই পুরো গল্পটা তুলে ধরছি পাঠকের সামনে- বাবু, আমি তখন পনেরোতে
পা দিয়েছি - আমার বাবা এই জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করত। তখন সরকারের এত
বিধিনিষেধ ছিলনা। এই গ্রামের অনেকে মিলে একসাথে রোজ কাজে যেত আর সন্ধ্যে
হওয়ার আগে ফিরে আসত। তারপর সেই মধু তুলে দিত সরকারি বাবুদের হাতে, তারা
তাদের টুরিস্ট অফিসে রাখতো সেই মধু আর যারা বেড়াতে আসত তারা ইচ্ছা হলে
কিনতো। আমাদের ভাতের অভাব হতো না। রোজ নুন ভাত, পেঁয়াজ জুটতো সেই টাকায়।
কিন্তু হঠাৎ একদিন আমার বাবা জঙ্গলে সাপের কামড় খেয়ে মরল। বাবার কাজে আমি
বহাল হলাম ঠিকই কিন্তু মন ভরতো না আমার। খালি মনে হতো আরো এমন কিছু করি
যাতে আরও বেশি কামাতে পারি। ততদিনে সরকার থেকে আমাদের কাজের জায়গার পরিধি
অনেক কমিয়ে দিল। জঙ্গলের একটু গভীরে যেখানে ভালো মধু পাওয়া যেত সেটাকে
"কোর এরিয়া" বলে চিহ্নিত করা হলো কারণ সেখানে নাকি মানুষের প্রাণের অনেক
বেশি বিপদ! এতে আমাদের আরো বেশি সমস্যার মুখে পড়তে হলো। আমাদের গ্রামে
একজন ছিল তাকে সবাই চোরা শিকারি বলেই জানতো যদিও সে কোনোদিন নিজে মুখে এ
কথা স্বীকার করেনি। তবু তার সাথে একদিন আমি দেখা করতে গেলাম। তোর সাহস আছে?
তুই জানিস এ কাজের বিপদ? তার প্রশ্নের উত্তরে আমি বললাম হ্যাঁ, আধপেটা
খেয়ে মরার থেকে অনেক ভালো। সে বোধকরি তারি খেয়ে ছিল তখন, আমার দিকে লাল
লাল চোখ দিয়ে তাকিয়ে বলল যদি কোনও সরকারি লোকের কানে যায় তাহলে সে আমার
গলার নলি আধা কেটে আর আমায় আধা বাঁচিয়ে রেখে তেনার জন্য টোপ করবে। এরকম
অদ্ভুত কথা আমি এর আগে কোনোদিন শুনিনি। তাই মনে খুব ভয় নিয়ে বাড়ি
ফিরেছিলাম সেদিন। সারারাত ভেবেছিলাম তেনাদের জন্য টোপ কথাটার মানে কি? মলিন
বাবু সেই চোরা শিকারি সম্পর্কে বিশদ জিজ্ঞেস করতে বিশু বললো ধরুন তার নাম
লক্ষণ, বলে মুচকি হাসলো। বুঝলাম এর বেশি গভীরে যাবে না সে। বিশু বলে চললো
এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে সেই লক্ষণ আমায় ডেকে পাঠালো একদিন। দেখা হলে
বললো চল, আজ দেখবো - তুই কেমন কাজের? তেনার খোজ পাওয়া গেছে, আমি জিজ্ঞেস
করলাম তেনার মানে কার কথা বলা হচ্ছে (কারণ লক্ষণ কিসের শিকার করে আমি তখনও
জানতাম না)? লক্ষণ আর তার সঙ্গিসাথীরা গোল গোল চোখ করে আমার দিকে তাকালো আর
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। পথ চলতে চলতে বুঝলাম যে এত আয়োজন যার জন্য সে আর
কেউ নয় এ জঙ্গলের অনেকের মধ্যে একজন বিশেষ- হলদে কালো ডোরাকাটা বড় বাঘ
একটা। জঙ্গলের মধ্যে ঢোকার আগে প্রথামত বনবিবির পুজো করলো লক্ষণ। এ পুজোর
কথা আমিও জানতাম বাবু - জঙ্গলে যাওয়ার আগে আমরাও করতাম, আমার বাবাও করতো।
আমাকে একটা তীর ছোড়া ধনুক দেওয়া হয়েছিল। সেটা নিয়ে আমি দলের বাকিদের
সাথে বীরদর্পে চলতে শুরু করলাম খানিকটা কাদা মাখা পথে। চারিদিকে ম্যানগ্রোভ
ভর্তি, জলে কুমির থাকাও অসম্ভব ছিল না সে সময়ে। আগে তো প্রায় খবর আসত জলের
ধারে কুমির দেখা গেছে বলে। যাইহোক আমার কাছে তীর ধনুক থাকলেও লক্ষণ আর দলের
কয়েকজনের কাছে ছিল বন্দুক আর গুলিছোড়া ধনুক। এই শেষের জিনিসটি সম্পর্কে
আমার বেশ ভালো ধারনা ছিল জঙ্গলে মধু সংগ্রহের কাজের সূত্রে, অনেককে দেখেছি
ব্যবহার করতে। গুলি ধনুক ব্যবহার করা বেশ কঠিন, পারদর্শী না হলে নিজের
গুলিতে নিজের হাতের বুড়ো আঙুল জখম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পথ চলতে চলতে
একটা কথা বার বার নিজেকে বলেছিলাম "ওরা যদি পারে,আমিও পারবো - পারতেই হবে"।
খানিকটা দূর এভাবে যাওয়ার পর দেখলাম একটা ঘন সবুজ বিস্তৃত জমি তার দুদিকে
জল আর একদিকে একটা নৌকা বাঁধা আছে, আমরা যেদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক
তার উল্টো দিকে। লক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বললো আমরা এবার আসল জঙ্গলের মধ্যে
ঢুকবো তাই আমি যদি চাই এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি কিন্তু একবার নৌকা
চালু হলে আর থামবে না। আমি ভাবলাম এখন না বলাটা খুব লজ্জার হবে, পুরো গ্রাম
জানবে কিনা সে তো পরের ব্যাপার কিন্তু আমার নিজের কাছে আমি নিজে মুখ দেখাতে
পারবো না কারণ লক্ষণের কাছে আমি নিজে গেছি। খুব সাহস নিয়ে সবার দিকে
তাকিয়ে বললাম, চল চল নৌকাতে উঠি। কিন্তু বিশ্বাস করুন বাবু, আমার এই
সিদ্ধান্ত যে কত বড় ভুল ছিল তা পরে বেশ টের পেয়েছি। নৌকা তে লক্ষণের দুজন
নিজের লোক আগে থেকেই ছিল। লক্ষণ বললো আমরা যে জলের ওপর আছি সেটা নোনা
হওয়ার দরুন জঙ্গলের অনেক ভিতরে না গেলে শিকার পাওয়া অসম্ভব, কারণ পশুরা
জঙ্গলের সর্বত্র এই জল পায়। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কৃত্রিম উপায় সংগৃহীত
মিঠা জল মাঝেসাঝে তবুও জঙ্গলের পশুরা পান করতে বাইরে আসে যখন তাদের নোনা
জলে অরুচি ধরে- আর তাতে পশু সংখ্যা গণনা করা সহজ হয়, কিন্তু শিকারের সুবিধা
হয় না। এরপর কতক্ষন কেটেছে জানিনা বাবু হঠাৎ টের পেলাম নৌকা থেমে গেছে
সবাই নিশ্চুপ হয়ে একদিকে দেখছে। আমি তাকালাম সেদিকে - দেখি একটা বাঘ
অন্যদিকে মুখ করে ঘাপটি মেরে বসে আছে। একজন হাত দিয়ে ইশারা করলো কোনো শব্দ
না করতে, আমি লক্ষণের দিকে তাকালাম - দেখি সে ইতিমধ্যেই বন্দুক নিয়ে তাক
করে তৈরি। আসলে বাঘ ওরা আগেও দেখেছে তাই ভয় পেলনা কিন্তু আমার অবস্থা খুব
খারাপ হয়েছিল। আমরা যে নদীপথে যাচ্ছিলাম তা আসলে শাখানদী, তাতে জল
যৎসামান্য। আমি এত ভয় পেয়েছিলাম বাবু যে কল্পনায় ওইটুকু মুহূর্তে অনেক
কিছু দেখে ফেলেছিলাম। মনে হচ্ছিল পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে আর বাঘ সবদিক আলো
করে যেন আমারি অপেক্ষায়। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছিলো, হৃদপিন্ডের স্বাভাবিক
গতি স্তব্ধ ছিল কিছুক্ষনের জন্য। যে পৈশাচিক শক্তির কথা গ্রামের লোকের মুখে
মুখে শুনেছি তা একেবারে আমার চোখের সামনে- সেই অনুভূতির কথা বলা আজ বড়ো
কঠিন। তক্ষুনি বাঘ যেদিকে মুখ করে বসেছিল সেদিকের লম্বা ঘাসের মধ্যে একটা
নড়াচড়া অনুভব হলো আমাদের সবার। নৌকার সব নিশ্চুপ, লক্ষণ বোধকরি কিছু
ইশারা করেছিল তা বাকি সবাই বুঝলেও নতুন হওয়ার দরুন আমি বুঝিনি। হঠাৎ সেই
ঘাসের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এলো এক চিতল হরিণ আর তার শাবক। এতক্ষণে বুঝলাম
যে বাঘ ওই শাবকটিকে চোখের আড়াল করবে না বলে সব ভুলে একদিকে চুপটি করে বসে
ছিল। মা আর বাচ্চাটি বোধহয় দলছুট হয়েছিল, আমি তো নৌকার মধ্যে খুব মনখারাপ
করছি হরিণ দুটির জন্য - বাঘের দ্বারা যে আমাদের বিপদ হতে পারে সে সম্ভাবনাও
উড়িয়ে দিতে পারছি না। সব মিলিয়ে সাংঘাতিক অবস্থা! আশ্চর্যরকম নীরবতা
আমাদের নৌকায়, এই রকম সময়ে হঠাৎ জলে বিশাল আলোড়ন- মা হরিণটি শাবকটিকে
বাঁচাবার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে ঠিকই কিন্তু চোখের সামনে দেখছি বাঘের
কি নিষ্ঠুর খেলা তার সাথে। বাঘ একসময় সুযোগ বুঝে একেবারে শাবকের সামনে।
কিন্তু সবেতে বিঘ্ন ঘটালো সেই আলোড়ন - এক বিশালকায় কুমির জল থেকে
তেড়েফুড়ে উঠে এলো। এরপর বাঘের গর্জন আর কুমিরের আস্ফালন এই দুই মিলে যা
হলো তাতে আমার কান ফেটে যাওয়ার জোগাড়। বাকি সবাই অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের
সামলে নিলেও আমি পারিনি বাবু। নিজের এবং নৌকার সবার চরম ক্ষতি ডেকে আনলাম
নিজের নির্বুদ্ধিতায়! আমি ভয়ে হাউমাউ করে নৌকা থেকে জলে ঝাঁপ দিলাম।
ভাবলাম সাঁতরে বাঘ আর কুমিরের থেকে অনেক দূরে পালিয়ে যাব। কিন্তু উল্টে
পড়ে গেলাম শাখানদীর অল্প জলে আর আমার একটা পা নৌকার খাঁজে কাদায় আটকে
গেলো। লক্ষণ বিশু বলে চেঁচিয়ে উঠলো, কিন্তু ততক্ষণে যা অঘটন হওয়ার তা ঘটে
গেছে। বাঘ আর কুমির দুজনেই জলে ঝাঁপায়, হরিণের কি হয়েছিলো জানি না বাবু -
শুধু টের পেলাম নৌকা চালু হওয়ার। আর আমার ধুতির একটা অংশ নৌকায় আটকে
যাওয়ায় নৌকা আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়েই রওনা দেয়। আমি শুধু একবার দেখলাম
এক বিশাল চেহারার বাঘ যমদূতের মত এগিয়ে আসছে, আমি বোধকরি তারপর জ্ঞান
হারিয়েছিলাম। যখন চোখ খুলি নিজেকে এক সরকারি চিকিৎসা ক্যাম্পে পাই। আমাকে
নাকি নদীর ধারে কুড়িয়ে পেয়ে গ্রামের কয়েকজন সেখানে নিয়ে গিয়েছিল,
বুঝতে পারি লক্ষণের লোকজন আমায় ফেলে পালিয়েছিল। ওরাই বা কি করবে বলুন
বাবু! আসল ঘটনা সামনে এলে গরাদে ঢুকতে হবে যে, তাই ওদের আমি দোষ দিইনা।
বিশু যে গল্পের মধ্যে দিয়ে আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল তাতে বেশ বুঝতে পারছিলাম
সুন্দরবনের মানুষদের জীবন। বিশুকে এক গ্লাস জল দি- গভীর দৃষ্টিতে ওকে দেখি
আর ভাবি কত নিরাপদ আমরা। ওদের দিনে রাতে তীক্ষ্ম নখ আর ধারালো দাঁতের ভয়ে
ভর করে জীবনযাপন করতে হয়। কিবা রোদ, কিবা ঝড় আর কিসের বা জলের ভয়, ওরা
যে পৈশাচিকতা চোখের সামনে আর মনের গভীরে পরছায়া করে রেখেছে সেখানে বাকি সব
সাহসিকতা নিমিত্ত মাত্র। মলিন বাবু বিশুকে জিজ্ঞেস করলেন ওই দাগটার কথা -
তাতে বিশু বলল বাবু, এ গল্পের শেষ এখনো হয়নি, তারপর অনেকদিন লক্ষণের দেখা
পাওয়া যায়নি। প্রতিদিন বিশু ছট্ফট করত, রাতে ভালো ঘুম হতো না শুধুমাত্র
সেদিন ঠিক কি হয়েছিল তা জানার জন্য। সে সবার জন্য কতটা বিপদ ডেকে এনেছিল
তা জানলে সে কোনোভাবে তার প্রায়শ্চিত্ত করত। এমনি এক বিকালে সূর্যাস্তের
সময় বিশু নাকি নদীর ঘাটে বসেছিল আর সামনে দুজন মানুষ গামছায় মুখ ঢেকে
কাদায় লাল লাল কাঁকড়া ধরছিল। তাদের একজনের চোখের দিকে বিশুর চোখ পড়ে,
খুব চেনা লাগে চোখ দুটি। বিশু বলে চললো, জানেন বাবু আমি মনে সাহস এনে ডেকে
ফেললাম - লক্ষণ। সাথে সাথে সেই চোখ জোড়ার মালিক আমার দিকে তাকালো, তারপর
দুজনে কাঁকড়া ধরা ফেলে আমার দিকে উঠে এসে আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে
নিয়ে যায় নদীর ঘাটের ওপরে একটা গাছের পিছনে। এ গল্পের গতি আমাকে এমন
মোহিত করেছে যে আমি তো ঈশ্বরকে ডেকেই চলেছি সূর্যোদয়ের গতি যেন বিলম্বিত
হয়, আর মলিন বাবুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখের পলক পড়ছে না, মুখ হা
হয়ে গেছে। যাই হোক বিশুর দিকে মন দিলাম আবার। বিশু বলে চললো - গাছের পিছনে
নিয়ে গিয়ে আমার টুটি এমন চেপে ধরলো সে, যে আমার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসে -
তারপর সেই লোকটি বলল কি রে, আমাদের বিষয় কাউকে বলিস নি তো? ব্যাস, আমি তার
গলার স্বরে বুঝে গেলাম সেই লক্ষণ। কোনোভাবে তার হাত ছাড়ালাম, বললাম লক্ষণ
আমি তোমাকে কত খুঁজেছি! তুমি, তোমরা সবাই ঠিক আছো তো? আমি কেঁদে ফেলি বাবু
, দু হাতে মুখ ঢেকে। লক্ষণ আমায় সোজা করিয়ে দিয়ে বলে - ওরে হতভাগা জীবন
থেকে পালানো এত সহজ নয়। তাই আমি মৃত্যুকে বন্ধু করে বার বার ওই পিশাচের
খোঁজে যাই। জীবনে কত জন্তু মারলাম কিন্তু ওই চামড়া আজও পেলাম না। নেশা
হয়ে গেছে আমার, বড়ো লোভ ওই হলদে ডোরাকাটার মুন্ডুটার। কথা বলতে বলতে
গামছাটা মুখ থেকে সরে যায় লক্ষণের শিউরে উঠি আমি বাবু, ঠোঁটটা ঝুলে গেছিলো
আর থুতনি বলতে কিছু খুঁজে পাইনি সেদিন ওর। লক্ষণের সাথের লোকটি বলল সেদিনের
ঘটনা - সেদিন নাকি আমাকে বাঘ আর কুমির দুজনেই মারতে পারতো, কিন্তু লক্ষণের
গুলিতে কুমিরটা মরে। লক্ষণ দলে সবচেয়ে সাহসী ছিল বলে জলে ঝাঁপ মেরেছিল
আমাকে তুলে নেওয়ার জন্য,তবে বাঘ একেবারে সাঁতরে নৌকায় উঠে আসায় নৌকার
মধ্যে দৌড়াদৌড়ি লাগে আর নৌকা যায় উল্টে। দু -তিনজনের সাহায্যে লক্ষণ
আমায় নিয়ে ডাঙায় ওঠে। অথচ বাবু আমি কিচ্ছুটি টের পাইনি! বাঘটাও বোধকরি
সেই ফাঁকে জল থেকে উঠে এসে কোথাও ঘাপটি মেরে বসেছিল, যখন সবাই নৌকা সোজা
করতে ব্যস্ত (তা না হলে বাড়ি ফেরা অসম্ভব) তখন বাঘটা ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে
আমার পা ধরে টান দেয় - তাই দেখে দলের একজন গুলি বন্দুক ছুঁড়তে গিয়ে
সামনে পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় আর তার বন্দুকের গুলি ছিটকে গিয়ে
লক্ষণের চোয়াল ছুঁয়ে সামনের গাছের গুঁড়িতে গিয়ে লাগে। লক্ষণের তখন
রক্তবন্যা মুখে, লোকজন তাকে নিয়ে পালাতে পারলে বাঁচে! এক নিশ্বাসে লোকটি
বলে চলেছে আর আমি শুনছি বাবু। মনে মনে ভাবছি আহা রে, আজ আমার জন্য এই
অবস্থা! তখন অবশেষে লক্ষণ বললো এত কাণ্ডের মধ্যে বাঘ শুধু তোর পা ধরে টান
দিয়েছিল, চাইলে তোকে মারতে পারতো কিন্তু সে চলে যায়। তারপর আমার ছেলেরা
আমার চিকিৎসার তাড়ায় তোকে গ্রামের নদীর ধারে ফেলে রেখে যায়, তারা
ভেবেছিল কেউ না কেউ তোকে দেখতে পাবে। বিশু বললো - বাবু, বিশ্বাস করবেন না
আমার প্রতিটি শিরায় রক্ত গরম হয়ে ফুটতে লেগেছিল তখন - মনে হচ্ছিল সেই
মুহূর্তে ছুটে গিয়ে বাঘটার গলায় আমার বাড়ির নারকেল কাটার দা এর এক কোপ
বসাই। কিন্তু সে কাজ ভাবা যতটা সহজ, করা ততটাই কঠিন। তখন লক্ষণকে অনুরোধ
করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না আমার কাছে। তার হাতে পায়ে ধরলাম অনেক
করে, তাকে বিশ্বাস দিলাম যে অমন ভুল আমি আর করবো না। অনেক কষ্টে আর একবার
সুযোগ দিল লক্ষণ, তবে তার একটা শর্ত ছিল যে আগে ছোট বড়ো অন্য জন্তু তে হাত
পাকাতে হবে আমায়। সেই পরীক্ষায় আমি যদি পাশ করি তবেই সেই অপদেবতার শিকারে
সে আমায় নিয়ে যাবে। আমার তখন একবারও মনে হয়নি চোরা শিকারে আমার জেল হতে
পারে, বড় অন্যায় করতে চলেছি - কিচ্ছু নয় , কিচ্ছু নয়! খালি মনে হচ্ছিল
সেই হলদে কালো ডোরাকাটা একটা বিশাল শরীর আমার পায়ের নিচে পড়ে আছে আর আমি
বীরদর্পে লক্ষণকে বলছি দেখো, আমি আমার কথা রেখেছি। আমি বুঝতেই পারিনি আমি
কত অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাচ্ছি আর সেখান থেকে একমাত্র আমার বনবিবি আমায়
বাঁচাতে পারে! ধীরে ধীরে লক্ষণের দলের যোগ্য হয়ে উঠতে লাগলাম। সে ছিল আমার
ভগবান। সে যে আসলে একজন পোচার তা তার ব্যবহারে প্রকাশ পেত না, তার দলের
ছেলেদের সে খুব ভালোবাসতো আর আমরা তাকে মহাপুরুষ ভাবতাম - প্রতি শিকারে
যাওয়ার আগে ঘটা করে বনবিবির পুজো, সিঁদুরের তিলক সব মিলিয়ে মনে হতো আমরা
যুদ্ধে যাচ্ছি নিরীহ পশু মারতে নয়। মজে গেছিলাম বাবু সে কাজে, আস্তে আস্তে
দু পয়সা হাতে আসতে শুরু করেছিল- সব মিলিয়ে খুব গর্ব করে গ্রামে ঘুরতাম।
তবে সবাইকে বলতাম দূরসম্পর্কের এক দাদার ঠিকেদারির ব্যাবসা আছে তাতে আমার
কাজ লেগেছে, মাঝে মাঝে আমাকে ডেকে পাঠায়। কখনো যদি গ্রামে লক্ষণের সাথে
দেখা হয়ে যায় অন্যদিকে চলে যেতাম, কাউকে বুঝতে দিতাম না যে আমরা একে
অপরকে চিনি। এমন করে বেশ কিছুদিন কেটে যায় হঠাৎ খবর এল তেনাকে জঙ্গলের কোর
এরিয়ার এক অংশে দেখা গেছে। ব্যাস শুরু হলো আমাদের প্রস্তুতি পর্ব হাবভাব
এমন ছিল যে "মরবো নয়তো মারবো"। সুন্দরবনে বাঘ তো অনেক বাবু, কিন্তু কেন
জানিনা এই বাঘটা লক্ষণের আকর্ষণের কারণ হয়েছিল, আর আমাদেরও পরম শত্রু হয়ে
উঠেছিল, বোধহয় ওর বিশালকায় হওয়ার দরুন! পরে বুঝেছিলাম ওই বাঘটার চামড়ার
দাম অনেক ছিল। যাইহোক অনেক প্রস্তুতি নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলাম জঙ্গলের
গভীরে। এবার কিছুটা পথ নৌকা করে এসে বাকি পথ চলতে শুরু করলাম চারিদিকে
সতর্ক দৃষ্টি রেখে, অবশেষে এক জায়গায় লক্ষণ থামতে ইশারা করলো শুরু হলো
মাচা বাঁধার কাজ। তিনটে মাচা তৈরি হলো সারা দিন ধরে। এবার আমাদের সাথে
বাঘের জন্যে দুটি টোপ ছিল, একটা ছাগল আর একটা বাছুর। নৌকায় তাদের চারা আর
জল খাওয়ানো হয়েছিল তারপর তাদের মুখ ভালো করে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া
হয়েছিল যাতে তারা আওয়াজ করতে না পারে। বাবু, এবার যেমন ঘূর্ণিঝড় হলো
সেবারও তেমনি এক তুফানে জঙ্গলের বহু সংখ্যক গাছ উপড়ে গেছিলো। তিনটে মাচার
সবচাইতে মাঝখানের টার উল্টো দিকে একটা গাছ পড়ে ছিল, তার ডাল পালা ছিল
আমাদের দিকে আর দুপাশে ছিল বুনো ঝোঁপ যা একটা বড়ো বাঘ গুড়ি মেরে লুকিয়ে
থাকার জন্য যথেষ্ট। তাই সবমিলিয়ে এবার অনেক বেশি সাবধানতা ছিল। এতগুলো
খাদ্য চোখের সামনে দেখলে মানুষখেকো না হলেও বাঘটার জন্মগত লড়াইয়ের সব
প্রবৃত্তিগুলো পুরোপুরি জেগে উঠবে বলে আমাদের ধারনা ছিল। সবকিছু ভেবে ঠিক
হলো প্রথম টোপ হিসাবে বাছুরটি ব্যবহার করা হবে কারণ ছাগলকে মাচার ওপরে তোলা
এবং রাখা দুটিই সহজতর বাছুরের থেকে। বাছুরটি বেশ ছটপট শুরু করলো যেই ওকে
আমাদের সামনের পড়ে থাকা গাছটার একটা ডালের সাথে বাঁধা হলো, তখনও তার মুখ
খোলা হয়নি। জঙ্গলে তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে, লক্ষণের নির্দেশ অনুযায়ী যে
যার মাচায় উঠে গেছে এবং মুখ বাঁধা ছাগলটিকেও ওপরে তোলা হয়েছে। নিচে শুধু
আমি আর কানাই (আমি আর মলিন বাবু বুঝে গেছিলাম যে এ নামটিও আসল নয়, আসল
নামকে আড়ালে রেখে বিশুর দেওয়া নামেই কাজ চালাতে হবে আর কি) সে হলো গিয়ে
লক্ষণের ডান হাত - আমরা মাচার ওপরের লোকেদের নির্দেশের অপেক্ষায়। ওরা
ইশারা করলেই আমরা বাছুরের মুখ খুলেই ওপরে উঠে যাব। তখন অপেক্ষা করতে করতে
আমার শিরদাঁড়া দিয়ে রক্তের স্রোত টের পাচ্ছিলাম বাবু, মনে হচ্ছিল আমার
অন্তিম সময় এসে গেছে কিন্তু কিছুতেই নিজেকে ভয়ের কাছে সমর্পণ করাবো না
বলে ঠিক করেছিলাম। কানাই বোধকরি টের পেয়েছিল কিছু, সে আমায় বললো - বিশু
চিন্তা করিস না তোর ছিবড়ে মাংসের চেয়ে বাছুরটার নরম মাংস বাঘের বেশি
পছন্দ হবে, বলেই হে হে করে হাসতে লাগলো। এই হাসি কাল হলো বাবু, আমাদের আগেই
সে সতর্ক হয়ে বীরদর্পে এগোনো শুরু করে দিলো আমাদের দিকে। আর তা বুঝতে
পারলাম লক্ষণের ইশারার আগেই জঙ্গলের হরিণদের ভয়ের ডাকে, কারণ তখন অন্ধকার।
আর দূরের ঝোঁপগুলো এলোপাথাড়ি নড়তে থাকলো তাই দেখে কানাই দৌড়ে সোজা মাচায়
ওঠা শুরু করলো, আর আমি নিচে একা বাছুরের মুখ খুলতে লাগলাম তাড়াতাড়ি। সবে
পিছন ফিরে এগোতে যাব এমন সময় ঠিক যে দিকের বিপদের আশঙ্কা আমরা করিনি সেই
দিক থেকে একটা গরগর আওয়াজ! এমন শান্ত চারিদিক আমি আগে কখনো দেখিনি! কিছু
বুঝে ওঠার আগেই গাছের ফাঁক দিয়ে আসা রাতের আলো আঁধারিতে দেখলাম আমার
মৃত্যু তখন শূন্যে, উঁচুতে। বিশুর গল্পে আমি কল্পনা করলাম সেই মুহূর্তটাকে,
থাবার আড়ালে জ্বলজ্বলে সুস্পষ্ট দৃষ্টিতে সুন্দরবনের সেই অশুভ শক্তি কালো
চামড়ার পেশীবহুল শরীরটার লোভে লাফ দিয়েছে বিশুর দিকে। বাঘ আমাদের জাতীয়
সম্পদ ওই সময় সাংবাদিক হিসাবে আমি সেটা একবারের জন্য ভাবিনি, মনে হচ্ছিল এ
যেন বিশুর লড়াই নয় এ আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে। আমার বুকপকেটের কলমটা
হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম একবার, এ গল্পের ভার আমি নিতে পারবো তো? নিজেকে
সাংবাদিক বলে মনেই হচ্ছিলনা। জীবনে কিছুই করে উঠতে পারিনি যেন! মনে হচ্ছিল
বর্শা হাতে ছুটে যাই এই বিশুর সাথে জঙ্গল থেকে জঙ্গলে। এদিকে বিশু বলে
চলেছে মরণ নিশ্চিত জেনেও দুর্বল হইনি বাবু, দিলাম তাকে লক্ষ্য করে গুলি
চালিয়ে! কত অল্পের জন্য ওর বুক ফসকালাম জানিনা তবে দুটো জিনিস টের পেলাম -
সে আমায় একটুর জন্য স্পর্শ করে ঝুপ করে উল্টো দিকে পড়লো, আর আমার বাঁ
ঘাড় বরাবর রক্তের ধারা - তার সাথে বাঁ কাঁধ, হাত প্রায় অবশ হয়ে যাওয়া।
তখন মলিন বাবু বেশ রেগে বলে উঠলেন, তখন তোমার সঙ্গী - সাথীরা কি ওপরে বসে
মজা দেখছিল? এ তো দেখছি তোমাকেই টোপ বানিয়ে ফেললো ওরা। আচ্ছা, সত্যি বলতো
লক্ষণ কি এতটাই বিশ্বাসী ছিল? দাঁড়ান বাবু, বিশু তার দিকে তাকিয়ে বলল -
লক্ষণকে না জেনে তাকে দোষ দেবেন না। প্রত্যেক শিকারের কিছু নিয়ম থাকে। ওরা
ছিল মাচায়, আর এই ঘটনাটি এত তাড়াতাড়ি ঘটে যায় যে ওপর থেকে তাড়াহুড়ো
করে গুলি ছুড়লে তা বাঘের বদলে আমার লাগতে পারতো। যাইহোক আমি শুধু তখন এক
মুহূর্তে এটাই ভেবেছিলাম বাঘটার নখের ছোঁয়ায় আমার এই হাল তাহলে ও যদি
আমায় নাগাল পেত তাহলে কি হতো! আমি টলমল শরীরে পিছনে ঘুরে দেখলাম বাঘটা
শুয়ে আছে আর বাছুরটি প্রাণপণে ডেকে চলেছে আর ছটফট করছে। এই কিছু সময়ের
নিস্তব্ধতার ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই বাবু। আমি আহত হওয়ার দরুন পালিয়ে
গাছে উঠতেও পারছিলাম না আবার ওখানে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করতেও আমার
বাঁধছিল। ওপরে তাকিয়ে দেখি আমার সব সহকর্মীরা কত অসহায় হয়ে আমায় দেখছে।
ব্যাস মাত্র কিছু সময় পেয়েছিলাম আমি, একটা অবাঞ্ছিত অতর্কিত আওয়াজের সাথে
বাঘটা উঠলো - আমায় দেখলো। আমিও ওকে ভালো করে দেখলাম সে এক বিশাল চেহারার,
কি গাঢ় রঙের হলদে কালো ডোরাকাটা শরীর, চকচকে কি অপূর্ব - আমি সম্মোহিত
হয়ে গেছিলাম বাবু ওর চোখের তারাতে! ওর লেজটা দুবার উঠলো আর নামলো তারপর
ঘুরে গিয়ে পিছন থেকে বাছুরটার ওপর লাফিয়ে পড়লো। এক নিমেষে কাঁধের কাছ
থেকে উল্টে নেমে টুটি চেপে ধরলো ধারালো দাঁত দিয়ে। আমার যেন মাথা কাজ
করছিল না বাবু, মনে হচ্ছিল আমিই যেন ওর পথে বাঁধা হয়ে ছিলাম। আর ও আমাকে
তবুও ক্ষমা করে দিল। সম্বিত ফিরল গুলির আওয়াজে - বাঘটা যেই আমার থেকে দূরে
গেছে ওপর থেকে গুলি চালাতে শুরু করেছে ওরা লক্ষণের নির্দেশে। এদিকে বাঘটার
কি শক্তি ভাবতে পারবেন না বাবু - ওই বাছুরটাকে মেরে দড়ি টেনে ছিড়ে কিছুটা
দুর ঘেসটে নিয়ে গেলো তারপর তাকে ফেলে রেখে অশরীরীর মত মিলিয়ে গেলো। আমার
শরীর তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছে তবুও আমি ওদের ওপর থেকে নামতে বারণ করলাম,
বিশ্বাস নেই আবার কি বিপদ আসে! কিন্তু লক্ষণ কানাইকে নিয়ে নামে বলে সে
দেখেছে বুলেট বিঁধতে। কোথায় জখম হলো বাঘটা সেটা অনিশ্চিত কিন্তু যেভাবে
ধুলো ছিটকে হঠাৎ বাঘটা বাছুরকে ছেড়ে দেয় তার মানে বুলেটটা বাঘটার শরীরে
ঢুকেছে - এ তার এতদিনের শিকারের অভিজ্ঞতা। লক্ষণ ছোট ভাই ভাবতো আমায় সে
তার কোমরের গামছা দিয়ে আমার কাঁধ বেঁধে দেয়। একে একে সবাই নেমে আসে
ছাগলটিকে ও সাথে নেওয়া হয়। লক্ষণ বলে রক্তের নিশানা পেলে অনুসরণ করতে হতে
পারে সবাই যেন সতর্ক থাকি। তবে ও খুব বিমর্ষ ছিল। আমি জিজ্ঞেস করাতে
বলেছিল, ভাই বিশু আজ তুই নিশ্চিত মরণ থেকে বাঁচলি আগেও মনে কর সে তোকে
মেরেও মারে নি। অথচ আমার ভাইকে যে বাঁচালো আমার গুলি তাকে বিদ্ধ করলো তাই
মনটা বড় অশান্ত। এত পশু মেরেছি কিন্তু আজ দুটো হাতকে প্রথমবার লাল রঙের
লাগছে। খালি মনে হচ্ছে সে যেন বেঁচে যায়। পুরো অন্ধকার জঙ্গল খালি চাঁদের
আলো গাছের ফাঁক দিয়ে এসে পড়ে আমাদের পথ দেখাচ্ছিল। মরা বাছুরটাকে অনেক
পিছনে ফেলে এসেছি তাই সামনে যে রক্তের ছোপ গুলো পাচ্ছি মনে হচ্ছিল বাঘটার।
তবে আবার চিতল হরিণ ডাকতে শুরু করলো বেশ কিছুটা দূরে - লক্ষণ হাত দিয়ে
ইশারা করলো সেদিকে যেতে। সূর্য প্রায় উঠতে শুরু করেছে তখন বাবু, তাই
জঙ্গলের বাকি সব প্রাণীদের চলাফেরা শুরু হওয়ায় আমাদের পথ চলা একটু ধীরে
হতে লাগলো। আমার কাঁধ ততক্ষণে ফুলে ঢোল তাই নিয়েই চলেছি এতগুলো মানুষের
মুখ চেয়ে। ভাবতে পারেন হোক সে চোরা শিকারি কিন্তু কত অদম্য সাহসী লক্ষণ,
কোনো সরকারি বাবুরাও দল বেঁধে ওই আঁধারে বাঘের পিছনে জঙ্গলে যেতে দুবার
ভাববে বাবু। একসময় দেখতে পেলাম জঙ্গলের মহারাজকে - খুব খুশি হলাম না কেউ
বাবু তাকে অমন পড়ে থাকতে দেখে। এতগুলো মানুষ তার নিস্তেজ শরীরটার চারপাশে
কাঠপুতলি হয়ে দাড়িয়ে থাকলাম। তার গোঁফের ফাঁকে বেরিয়ে থাকা দাঁতে তখনও
বাছুরটার রক্তের দাগ, লক্ষণের গুলি তার পেট ফুটো করে দিয়েছিল। সত্যি তার
তো কোনো দোষ ছিলনা। কানাই বলে - লক্ষণদা তুই জিতলি, লক্ষণ বলে না রে ভাই
আমি বোধকরি জিতেও হারলাম। লক্ষণ আর বিশুর জীবনে যখন ঢুকে পড়েছি তখন আমাদের
এখানেও সুর্যোদয় হলো। দিনের আলোয় বিশুর মুখের দিকে চেয়ে দেখি পুরনো কথা
মনে করে তার চোখে জল। মলিন বাবু বললেন বিশু, লক্ষণ এখন কোথায়? তুমিই বা এ
কাজে কিভাবে এলে? বিশু বললো কিছু কথা কল্পনা করেন বাবু, আমার এই দাগের গল্প
আমি মন উজাড় করে শোনালাম কিন্তু এর বেশি কিছু আমার বলার নেই। বাকিটা তো
সুন্দরবনের রহস্য, আপনাদের মত করে শেষ করুন। ততক্ষণে চা এসে গেছে,
ম্যানেজার নিজে এসে বসলেন আমাদের সাথে - কি বিশু সারা রাত জাগিয়ে রাখলি তো
এনাদের? বলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন - গুড মর্নিং, ভাবলাম সক্কাল সক্কাল
চা লাগবে আপনাদের বিশুর সাথে রাত জেগে। আমি বললাম একদম ঠিক বললেন, চা এর
কাপ হাতে উঠে এলাম হোটেলের বাগানে - বিশু মাইতি আমাদের গাইড নাকি গল্প বলা
স্বপ্ন বুড়ো? দূরে সাঁওতালি গান ভেসে আসছে, ম্যানেজার বললেন আমাদের
হোটেলের কাজের মেয়েরা আসছে গান গেয়ে। " সুন্দরবনের মেয়ে আমরা, সুন্দরবনেই
বাড়ি".......কি মিষ্টি কথা গানের। মলিন বাবুকে বলে উঠলাম , কি চলুন এবার -
তৈরি হয়ে নিন। যে কাজে এসেছি সে কাজ ঠিকমতো না করলে এখানেই থেকে যেতে হবে
- বিশু বাদে সবাই হেসে উঠলো। বিশুর শক্ত চোয়ালে ছিল সুন্দরবনের গভীরতম
রহস্য যা অনেক রূপকথাকে হার মানিয়ে দেবে.....শুধু আমার দিকে তাকিয়ে বিশুর
চোখের বাদামি তারাটা চকচক করে উঠলো, কিসের সাথে মিল পেলাম যেন আমি - চোখের
সামনে একটা আগ্রাসী নখর থাবা এলো। তবু এগিয়ে চললাম আর এক ঝড়ের কাহিনী
লেখার জন্যে।।
মেধাবী সেই ছেলেটি
ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রাজ্জাক
২০১৭ সালের এপ্রিল-মে মাসের দিকের ঘটনা। আমি, সাথে একজন সঙ্গী নিয়ে আমার
এলাকার বিভিন্ন গ্রামে, কখনো পায়ে হেঁটে কখনো ভ্যানে বা কখনো রিকশায় করে
প্রতিটি পাড়া-মহল্লা গ্রাম ইউনিয়নে ভ্রমন করছি। আমার নিজের ইউনিয়ন এর বাইরে
অন্য একটি ইউনিয়নের একটি বাজারে একটি চায়ের দোকানে বসে চা বিস্কুট খাচ্ছি।
ইচ্ছে করেই ওই দোকানে ঢুকলাম, যে দোকানে ১৫-২০ জন মানুষ বসে আড্ডা দিচ্ছে। বেলা
তখন সাড়ে এগারোটা কি বারোটা বাজে। সবার জামা কাপড় কথাবার্তা শুনে মনে হল
শিক্ষিত মানুষ সবাই। নির্দিষ্ট কোন পেশায় নিয়োজিত।
আমার পরনে লুঙ্গি, গায়ে হাফ শার্ট, হাতে একটি ফোল্ডিং ছাতা। সবার কথাই শুনছি,
ইলেকশন নিয়ে কথা হচ্ছে। আগামী ইলেকশন সম্পর্কে বিভিন্ন কথা, কে নমিনেশন পেতে
পারে, কোন পার্টি ক্ষমতায় আসবে, অত্র এলাকায় ভালো, মন্দ মানুষ কে?, এলাকার
উন্নয়ন ও মানুষের মঙ্গল কে বেশি করতে পারবে? এইসব নিয়েই আলোচনা।
এই ঘটনার আগে আমার কিছু পোস্টার এলাকায় সাটা হয়েছিল সেখানে আমার ছবি ছিল টাই
কোট পরা। লুঙ্গি পরা অবস্থায় আমাকে কেউ চিনতে পারলো না। একপর্যায়ে আমার
নামটাও ক্ষীণ আলোচনায় এলো। দু'একজন বললো শুনেছি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বিদেশে
পড়াশোনা করেছে, মানুষ হিসেবেও নাকি ভালো, তবে উনার পরিচিতি খুবই কম।
এমন সময় আমার সাথী, বলে বসলো, এইতো রাজ্জাক ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। সবাই আমার সাথে
কথা বলার জন্য এগিয়ে আসলো। আমি দু চার কথা বললাম আমার পরিচয় দিলাম। চা
খাওয়ার শেষ সময় একজন ভদ্রলোক এসে আমার কাছে বলল, স্যার আমাকে কি চিনতে
পেরেছেন?। আমি বললাম আমি সাধারণত কোন মানুষকে একবার দেখলে অনেকদিন মনে রাখতে
পারি, আপনাকে আমি দেখছি বলে মনে হয় না। ভদ্রলোক বললেন, আমাকে আপনি বহুবার
দেখেছেন আপনার অফিসে ও বাসায়। আমার মাথায় যেন বাজ পড়লো এইরকম স্মৃতিভ্রম
আমার তো হওয়ার কথা না। খুবই চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার কি স্মৃতিশক্তি লোপ
পেয়েছে?। ভদ্রলোক বললেন স্যার আপনার কোন দোষ নাই আমার চেহারার আমূল পরিবর্তন
হয়েছে আমার এই লাল চুল বাদ দিয়ে অভয়বের এই পরিবর্তন বাদ দিয়ে চিন্তা করুন
আমাকে চিনতে পারবেন। ভদ্রলোক বললো, স্যার আপনার টেলিফোন নম্বর দেন আমি আপনার
কাছে টেলিফোনে সব বলবো।
আমার খুবই প্রিয়, কাস্টম সার্ভিসের আলী আহমেদ সাহেব, আমার সাথে সম্পর্ক ছোট
ভাই বড় ভাইয়ের মতো। একদিন আলী আহমেদ সাহেব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে আমাকে ডেকে
পাঠালেন বললেন রাজ্জাক, তুমি কি ২৫ হাজার টাকা জোগাড় করতে পারবে, যদি পারো
তাহলে আমরা একটা মহৎ কাজ করি। এটা ১৯৯৮ সালের কথা। বললাম ভাই ২৫ হাজার টাকা কোন
ব্যাপার না, তবে কাজের কথাটা বলেন, বললেন তুমি অনেকদিন বিদেশে, আমাদের অঞ্চলের
একটা ছেলে নাম শাহিন সে বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি
হয়েছে,ছেলেটি খুবই গরীব যদি পারো এই টাকাটা জোগাড় করো, মাসে এক হাজার করে ওকে
টাকা দিলে, ওর পড়াশোনাটা ভালো ভাবে চালিয়ে নিতে পারবে।
যে কথা সেই কাজ আমরা টাকা যোগাড় করলাম শাহীনকে ডেকে আমরা প্রথমে এক হাজার টাকা
দিলাম।মনটা খুব ভরে গেল এরকম ইউনিভার্সিটি পড়ার সময় প্রতি মাসে এক হাজার টাকা
পাওয়া কতযে সৌভাগ্যের ব্যাপার, আমি চলে গেলাম ১৫ বছর আগের আমার বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনের প্রথম বর্ষে। ছেলেটা আমার বাসায় আসে, অফিসে আসে, মাঝে মাঝে কথা বলি।
ওকে একটা কথা বললাম বিশ্ববিদ্যালয় একটি বড় ক্যাম্পাস এখানে নিজের জীবন নিজেই
গড়ে নিতে হয় নিজের বন্ধুবান্ধব, চলাফেরার স্থান তুমি সাবধানে সিলেক্ট করবা,
গরিব ঘরের ছেলে কোনরকম বিচ্যুতি যেন না হয়। কিছুদিন পরে আমি একটি ভালো দোকান
থেকে ওকে প্যান্ট শার্ট কিনে দিলাম ক্যালকুলেটর সহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনে
দিলাম। ছয় মাস পরে শুনলাম ও প্রথম সেমিস্টারে ওর বিভাগে প্রথম হয়েছে। খুশিতে
মনটা ভরে গেল। আলী আহাম্মদ ভাইয়ের কাছে বললাম, আলী আহমেদ ভাই খুশিতে একেবারে
আত্মহারা। বলল রাজ্জাক, আমাদের শ্রম সার্থক হতে চলেছে, যদি তিন বছর আমরা ওকে
এভাবে সাহায্য করি তারপর ও নিজের ব্যবস্থা নিজেই করতে পারবে। আমাদের অঞ্চলের
একটি ছেলে একদিন অনেক বড় হবে। আমরা দুজনেই আমাদের শিক্ষা জীবনের পিছনের কথা
ভেবে কিছুটা বিমর্ষ হয়ে, আবার সুখ অনুভব করলাম।
সাত-আট মাস পর থেকে শাহিনের কোন খবর নাই আলী মাহমেদ ভাইয়ের কাছে আমি শুনলাম,
শাহিনের খবর কি? বললেন, জানিনা তবে বোধহয় ভালো কোন টিউশনি পেয়েছে, ভালো আছে,
ভালো না থাকলে তো আমাদের কাছে আসতো। মনে মনে খুশি হলাম শাহিন মানুষ হোক। বছর
গেল দুই বছর পরে আবার আলী আহমদ ভাইয়ের সাথে ওর ব্যাপারে কথা হল, আলী আহমেদ ভাই
বললেন, ওর ব্যাপারে কিছুই জানিনা তবে শুনেছি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই, কোথায়
গেছে কেউ জানেনা।তারপরে মাঝে মাঝে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু আর কোনো
হদিস করতে পারিনি। আমি ও আলী আহমেদ ভাই ,শাহিনকে ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি এবং আলী
আহমেদ ভাই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে একটি মেধার অপমৃত্যু হয়েছে।
দোকানে বসা অবস্থায় মাথায় মেহেদী মাখা লাল চুলের ভদ্রলোককে চিনতে
পারলাম।প্রথম জীবনের শাহিনের চেহারা স্মৃতি পটে ভেসে উঠলো, আমি জিজ্ঞেস করলাম
তোমার নাম কি শাহিন ? হাঁ সূচক উত্তর দেওয়ার সাথে সাথে, আমি ফোল্ডিং ছাতা
দিয়ে এক বারি মারলাম।শাহিন আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো বলল, আমি
নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলাম, আমার এই অবস্থা ও শিক্ষা পাওনা ছিল। ওকে জড়িয়ে
ধরে জিজ্ঞাসা করলাম এখন কি কর? বলল, এইচএসসি পাস করার সনদ নিয়ে এই চাকরি করি।
এখানে উপস্থিত সবাই আমার সহকর্মী। উপস্থিত সবাই আমার পরিচয় জানল।অবিকাশিত
মেধাবী মানুষকে ফেলে, ভারাক্রান্ত মন নিয়ে, পরবর্তী গন্তব্যে যাত্রা শুরু
করলাম ।
শাহিনের অবস্থার কথা বিবেচনা করে এখনকার ছাত্র ছাত্রীরা, শাহিনের জীবন থেকে
শিক্ষা নেবে কি?