টরন্টো, জুন ১০, ২০২১, নভো সংখ্যা ২১
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি সাহিত্য সংবাদ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল যোগাযোগ আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত

কার্তিকের কুয়াশা

কালো মেঘ

অভিষেক মন্ডল

 

ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। গড়িয়াহাটের মোড় থেকে সোজা এসে রামকৃষ্ণ মিশনকে পিছনে ফেলে কিছুটা এগিয়ে রবীন্দ্রসরোবর লেকের সংলগ্ন রাস্তায় এসে থামল রোহনের গাড়িটা।রাস্তার ধারে তার সেই সদ্য ছয় মাস আগের কেনা শখের হোন্ডা সিটি গাড়িটা পার্ক করে নেমে একটা সিগারেট ধরালো রোহন। বহুদিন পর সে এলো এই জায়গাটায়। গেলো বছর পুজোর মার্কেটিং করতে এসে শেষবার এসেছিল, যথারীতি তার সঙ্গে ছিল শর্মিষ্ঠা। তারপর অফিসের কাজের চাপ ও নানান ব্যস্ততার জন্য আর আসা হয়নি। কত স্মৃতি তার এই জায়গায়। মনে আছে একবার কালবৈশাখীর ঝড়ে রোহন আর শর্মিষ্ঠা আটকে পড়েছিল এই রাস্তায়। ভয়ে সেদিন রোহনকে জাপটে ধরেছিল শর্মিষ্ঠা। আর একবার শীতের বিকেলে শর্মিষ্ঠার খোঁপায় ফুল গুঁজে দিয়েছিল রোহন এই জায়গাটায়। সাড়ে তিন বছরের প্রেমে অনেক ঝগড়া, অনেক লুকোচুরি, অনেক চিঠি আদানপ্রদান ও বাড়িতে বোঝানোর পালাপর্ব মিটিয়ে গত ডিসেম্বরে বিয়ের দিন স্থির হয় তাদের। লং ড্রাইভে যেতে দুজনেই খুব ভালোবাসে। বিয়ের পর শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাওয়ার জন্য নতুন হোন্ডা সিটি গাড়িটা কেনে রোহন। তবুও আজ একাই এসেছে রোহন। আজও বৈশাখ মাস।আকাশে কালো মেঘ। আজ সেই ঠান্ডা হাওয়ায় ঠোঁটের ফাঁকে জ্বালিয়ে দেওয়া ক্লান্তি ও ধোঁয়ার মতো উড়িয়ে দেওয়া হতাশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। চোখ বন্ধ করে হাওয়ায় গাছের পাতার শব্দ অনুভব করছে সে। সিগারেটটা শেষ হবার আগেই প্যাকেট থেকে আরও একটা সিগারেট বার করে আগের সিগারেটের আগুন থেকে ধরিয়ে নিলো। তারপর মিনিটখানেক হেঁটে ডানদিকে ঘুরে রাস্তার চায়ের দোকান থেকে মাটির ভাঁড়ে এক ভাঁড় চা নিয়ে প্রথম চুমুক দেওয়ার পর রাস্তার ওপারে সেই প্রায় ভুলে যাওয়া মুখটা দেখতে পেলো। চার বছর আগের হারিয়ে যাওয়া সেই মুখটা। আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে কলেজের প্রথমদিন প্রথমবারের মতো এই মুখটা দেখেছিল রোহন। ধীরে ধীরে রাস্তাটা পর করে রোহনের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো সেই চেনামুখ। রোহনের সেই প্রথম প্রেম অদ্রিজা। প্রথমটা অতটা খেয়াল না করলেও তারপর হঠাৎ রোহনকে দেখে থমকে দাঁড়ালো ঠোঁটের কোণে একটা হাল্কা হাঁসি নিয়ে। রোহন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো - 'কেমন আছো? আশাকরি মুখটা মনে আছে।' অদ্রিজা বললো - 'ভুলে যাবার মতো এতকিছু থাকতে শুধু শুধু তোমায় ভুলবো কেন?' রোহন - 'নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বিনিময়ে যা দিয়েছি তাতে আমায় না মনে রাখাটাই স্বাভাবিক।' অদ্রিজা - 'চার বছর আগে কি হয়ে গেছে সেগুলো আমার মনে নেই। আর আমি চাইওনা তুমি মনে করিয়ে দাও। যা হবার ছিল তাই হয়েছে। বলো কেমন আছো?' রোহন - 'ভালো আছি। খুব ভালো আছি।যদিও এতটা ভালো থাকার দরকার ছিল কিনা জানিনা।' অদ্রিজা - 'হঠাৎ এই কথা? তোমার ভালো থাকার জন্যই তো আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেছে। চারবছর আগে এতো ভালো একটা চাকরি পেলে, তারপর শর্মিষ্ঠার মতো সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড বেছে নিলে জীবনের বাকি রাস্তাটা একসাথে চলার জন্য। কয়েকমাস আগে শুনলাম তোমাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে। তার মানে সে এখন তোমার স্ত্রী। খারাপ থাকার জন্যই কি করেছিলে এতকিছু?' কথাগুলো বলতে বলতে পুরো দিনগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল দুজনের। ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিক থেকে প্রেম শুরু দুজনের। কলেজ ছুটির পর পার্কে বসে প্রেম, রাস্তায় হাত ধরে হাঁটা, প্রথমবার চুমু খাওয়া সবই ভাঁজ করে রাখা ছিল স্মৃতির পাতায়। ধীরে ধীরে রোহন অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে অদ্রিজার ওপর। নিজের হাত খরচের অনেকটাই অদ্রিজা শেয়ার করতো রোহনের সাথে। তার জন্য নোটস বানানো থেকে শুরু করে তার পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়ানো পর্যন্ত সবই অদ্রিজা করতো। অদ্রিজা চেয়েছিল রোহন জীবনে অনেক বড় হোক। রোহনও বছর চারেক আগে মোটা মাইনের চাকরি পায়। প্রথমবার রোহনের চাকরি পাওয়ার খবর শুনে অদ্রিজার আনন্দ আজও চোখের সামনে ভাসে রোহনের। অনেক স্বপ্ন দেখেছিল সে রোহনকে নিয়ে। তবে তার দুমাস পর থেকেই তাদের সম্পর্কে কালো মেঘ জমতে থাকে। শর্মিষ্ঠার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে রোহনের। শেষে তাদের তাদের পাঁচ বছরের সম্পর্কে ইতি পড়ে। তারপর আবার এই প্রথম দেখা। অদ্রিজা - 'একটা কথা জিজ্ঞেস করতে খুব ইচ্ছা করছে।' রোহন - 'বলো....' অদ্রিজা - 'শর্মিষ্ঠার কাছে তুমি খুব ভালো আছো তাই না?' এরপর রোহন যা বললো সেটা শোনার জন্য অদ্রিজা একদমই প্রস্তুত ছিল না। রোহন - 'বিয়েটা হয়নি আমাদের। বিয়ের একমাস আগে ভেঙে যায় সম্পর্কটা। ও এখন অন্য কাউকে ভালোবাসে। তোমায় যেদিন ছেড়ে গিয়েছিলাম সেদিন বুঝিনি কেউ ছেড়ে গেলে কতটা কষ্ট হয়। তবে আজ বুঝি।' শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায় অদ্রিজা। রোহন জিজ্ঞেস করে অদ্রিজাকে - 'একটা সত্যি কথা বলবে?' অদ্রিজা - 'তোমাকে কোনোদিন মিথ্যে বলেছি বলে তো মনে পড়ে না। আজও বলবো না। বলো কি জানতে চাও?' রোহন - 'সেদিন আমায় আটকাওনি কেন? তুমি তো সবই বুঝেছিলে।' অদ্রিজা - 'আটকে কি লাভ? যাকে ভালোবাসি সে যদি অন্য কারোর কাছে গিয়ে ভালো থাকে তাহলে থাক না। জোর করে কি ভালোবাসা পাওয়া যায়?' রোহন - 'আর তারপর একা একা সব যন্ত্রনা সহ্য করছো এতদিন?' অদ্রিজা - 'হয়তো তাই। তবে এর বেশিদিন সহ্য করতে হবে বলে মনে হয় না। বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক করেছে। এবছরই বিয়ে। আমি মত দিয়েছি।' রোহন - 'তাহলে বোধহয় আমাকে ভোলার সময় এসেই গেছে। ভালো থেকো।' অদ্রিজা - 'ভুলতে হয়তো পারব না। তবে ভালো থাকার চেষ্টা করব। তুমিও ভালো থেকো আর নিজের খেয়াল রেখো।' অদ্রিজা হাঁটা দিলো সোজা রাস্তা ধরে। পিছনে দাঁড়িয়ে একসময়ের প্রিয় মানুষটাকে দেখতে লাগলো রোহন। আর কোনোদিন দেখা হবে কিনা জানা নেই। আকাশে কালো মেঘ জমেছিল অনেক্ষন এবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও শুরু হলো। রোহন আর অদ্রিজার সম্পর্কে চার বছর আগে যে কালো মেঘ জমেছিল তাতে আজ দেখা হবার পর বৃষ্টি হয়ে চিরকালের মতো ধুয়ে গেলো প্রেম, বৃষ্টি শেষে গাছের পাতা ও ফুলের মতো পথে পড়ে থাকলো কিছু স্মৃতি, কিছু ভালোলাগা আর অনেকখানি হতাশা।

 

 


 

 

ইভগেনি তোমায় লাল সালাম

ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রাজ্জাক

 

(একটি জীবনের গল্প যা ২০১২ সালে সাব ম্যাগাজিনএ প্রকাশিত হয়েছিল। বন্ধু ইভগেনির সাথে ১৯৮৮ সালে তোলা ছবিটি আজও অক্ষত।)

 

 

 

মস্কোর অটোমোবাইল ইনস্টিউট থেকে ভাষা শিক্ষা শেষে, পাঁচ বন্ধু মিলে গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে কাজ করতে সাইবেরিয়া গেলাম। দুই মাস দৈনিক বার ঘন্টা করে কাজ শেষে আবার মস্কো প্রত্যাবর্তন করলাম।সবার শরীর ক্লান্ত সাইবেরিয়ার হাড়ভাঙা বার ঘন্টা খাটুনি, তারপর ওই দেশেরই খাবার অর্থাৎ তৃপ্তিসহ খাবার না খেয়ে শরীরে অবসাদ নিয়ে ভর্তি হলাম, নিজের বিষয় অনুয়ায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মস্কো পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে। আমাদের সাবজেক্ট অনুসারে দুই নম্বর হোস্টেলে সিট বরাদ্দ হল। আমার রুম নাম্বার ৬৫৫, ষষ্ঠ তালায় দুই বেডের কর্নার রুম। রুমের চাবি সহ যাবতীয় উপকরণ নিয়ে রুমে ঢুকে সবকিছু গুছিয়ে নিলাম। আমার রুমে দুইটি বেড আমি ডান পাশের বেডে যথারীতি সংসার পেতে গুছিয়ে নিলাম, মনে মনে ভাবলাম এখানে ছয় বছর থাকতে হবে। অতএব, রুমটাকে নিজের বাড়ি মনে করাই ভালো। আমার অন্য তিন বন্ধু কাজল, শম্ভু, লিটন তাদের চতুর্থ তলায় রুম বরাদ্দ হলো। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার প্রতিদিন দুই তলা বেশি উপরে উঠতে হবে যদিও হোস্টেলে লিফট ছিল তা প্রায়ই কাজ করত না। এটা ছিল অগাস্টের শেষ সপ্তাহ। সন্ধ্যার পরে আমরা চার বন্ধু একত্র মিলিত হলাম, রুম নিয়ে সবাই কথা বলতে লাগলাম সবাই চতুর্থ তলায় রুম পেয়ে খুশিতে আত্মহারা বলল তুই ব্যাটা একা, দুই তলা উপরে বুঝবি মজা, এটা তো একদিনের ব্যাপার না এখানে থাকতে হবে ৬ বছর। যাহোক বিধিবাম সোভিয়েত আইনতো আর চেঞ্জ করা যাবে না, থাকলাম এখানেই। পরের দিন আবার চার বন্ধু আমার রুমেই মিলিত হলাম সবাই বলল তাদের রুমমেটের কথা একজন বলল তার রুমমেট জর্জিয়ান, একজন বলল তার রুমমেট ইউক্রেনিয়ান, আরেকজনের রুমমেট রাশিয়ান। আমার রুমে কোন রুমমেট নাই বেডটি ফাঁকা। সবাই বলল দুই-একদিনের মধ্যে আমার রুমমেট আসবে। ১ তারিখ থেকে যখন ক্লাস শুরু হবে তখন হয়তো রুমমেট আসবে। যাহোক যেহেতু আমি একা তাই আমার রুমেই আড্ডা ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা আরম্ভ হল। ক্লাস আরম্ভ হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে কোন রুমমেট এলোনা। তখন অন্য বন্ধুদের ঈর্ষার পাত্র হলাম ফার্স্ট ইয়ারে একলা এক রুমে, এটা প্রায় অসম্ভব। যাহোক সবাই একথা সেকথা বলে, রাজ্জাকের কপাল আর কি কোন রুমমেট নাই, হয়তো কোন মেয়েকে ওর রুমে দিয়েছিল সে ভয়তে আসে নাই, আবার কেউ বলে ২-১ দিনেই আসলো বলে, হয়তো কোন আফ্রিকান নিগ্রো আসবে। আমি বললাম, ব্রাদারইনল সকল জেনে রাখ আমি হলাম জমিদারের নাতি এটা ওরা আমার চেহারার মাধ্যমে জানতে পেরেছে, তাই তো এক রুমে একলা। কিন্তু সব ব্রাদারইনলরা ঈর্ষান্বিত, এটা প্রমাণিত হলো। এইরকম দেড় মাস একলা এক রুমে, রাতে আড্ডা বসে, আমার সাথের তিনটা ও অন্যান্য বড় ভাইরা আমার রুমে আড্ডা বাসায়। মধ্য অক্টোবরে ক্লাস থেকে ফিরে দেখি খালি বেডটিতে সাদা বেডশীট বিছানো উপরে কম্বল পাশে একটা বড় রেক্সিনের ব্যাগ, ছোট একটা পলিথিনের ব্যাগ ও একটি কভার মোড়ানো গিটার । সাথে সাথে মনটা খারাপ হয়ে গেলো নিজেকে জমিদারের নাতি থেকে মাকড়সা বানিয়ে ফেললাম। রুমে বসে আছি, আধাঘন্টা পরে রুমে এসে ঢুকলো, মাথায় একেবারে বাটিকাট চুল তাও আবার সাদা উচ্চতা ৬ ফুট, মনে হল বডিবিল্ডার্স। রুমে ঢোকার পর আমার সাথে চোখাচোখি হল, সাথে সাথে বের হয়ে গেল, পাঁচ মিনিট পরে আবার আসলো। কোন কুশলাদি বিনিময় না করে আমার কাছে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি আফ্রিকা থেকে এসেছো?। আমি বললাম বাংলাদেশ থেকে এসেছি। প্রতি উত্তরে সে বলল ওই একই কথা বাংলাদেশ তো আফ্রিকায়। আমি বললাম বাংলাদেশ আফ্রিকা হতে যাবে কেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আমি বললাম তুমি বাংলাদেশের নাম শোনোনি। সে বলল না। পরে আমি তাকে বাংলাদেশ বোঝানোর জন্য বললাম ১৯৪৭ সালের আগে আমরা ইন্ডিয়া ছিলাম ৪৭ সালে ইন্ডিয়া দুই ভাগ হলো, ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তান সাথে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। আরো বললাম সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পক্ষ অবলম্বন করে সাহায্য করেছিল। তখনোও সে ভালো বুঝতে পারল না। তার বদ্ধমূল ধারণা বাংলাদেশ আফ্রিকায় অবস্থিত। আমি একটু বিরক্ত সহকারে প্রশ্ন করলাম তুমি বাংলাদেশকে বারবার আফ্রিকার ঠেলে দিচ্ছ কেন? সে বলল তোর গায়ের রং যে কালো। অর্থাৎ আমার গায়ের রং কালো সেজন্য বাংলাদেশ আফ্রিকায় অবস্থিত হতে হবে। বুঝলাম এই শালার কোন বুদ্ধিশুদ্ধি নাই একেবারেই বলদা গোয়ার। নামটি জানলাম ওর নাম ইভগেনি। সামান্য আলাপচারিতায় যা আমার বোধগম্য হলো হল তাহল ও আর্মি শেষ করে যেখান থেকে আর্মিতে গিয়েছিল সেখানে এসে ভর্তি হয়েছে। মস্কো থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরে গোর্কি শহরে ওর বাড়ি। এই শহরটি হল বিদেশিদের জন্য নিষিদ্ধ শহর, ওই শহরে কোন বিদেশী নাই। মনে মনে ভাবলাম নিতান্তই হাবাগোবা গ্রামের ছেলে বুদ্ধিশুদ্ধি একটু কম, যাহোক ওকে মেনে নিতে হবে। যার মত সে লেখাপড়া খাওয়া-দাওয়া আরম্ভ করলাম, বিকেলে বন্ধুরা এসে আমাকে বলল, তুই যে জমিদারের নাতি না, ভুয়া ফাঁকা আওয়াজ দিছ, কেজিবি তা জেনে গেছে। অতএব বাছাধন এই নির্বোধের সাথে ছয় বছর কাটাও। বিধির বিধান না যায় খন্ডন, বাধ্য হয়ে রুমমেটকে গ্রহণ করতে হলো। এখানে বলে রাখি, ঘুমের ব্যাপারে আমার একটা আলাদা অভ্যাস আছে, আমার রুমে কোন আলো থাকলে বা কোন শব্দ হলে আমার ঘুম আসে না। রাতে খাওয়া দাওয়া করে পড়াশুনা শেষ করে এগারোটার দিকে ঘুমোতে গেছি তার আধাঘন্টা পরে ইভগেনি রুমে আসলো, এসে কি যেন রুটি মাখন খেলো তারপরে ওর একটা গিটার নিয়ে, বাজানো আরম্ভ করলো, যদিও আস্তে আস্তে তারপরেও শব্দ কিছুটা হল এবং ওর মাথার কাছে একটি ডিম লাইট জ্বালিয়ে রাখল। আমার তো ঘুম আসেনা, মনে মনে ভাবি নিশ্চয়ই ১০ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বে কিন্তু রাত দুটোর আগে সে ঘুমোতে গেল না। যাহোক সে দুটো্য় ঘুমালো আমার ঘুম আসতে প্রায় তিনটা বাজালো। সমস্যা হল ওই ছেলে আবার ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে রুমের মধ্যে বুকডন দেওয়ার আরম্ভ করল। তারপর অন্যান্য ব্যায়াম করার পর রুটি মাখন ডিম খেয়ে চা খেল আয়েশ করে সাড়ে আটটায় ক্লাসে চলে গেল, আমার ক্লাস ছিল দশটায় ও ক্লাসে যাওয়ার পরে আমি রেডি হয়ে ক্লাসে গেলাম তবে রাত্রে মনে হয় দুই ঘন্টাও ঘুম হয় নাই। ক্লাস থেকে ফিরে বন্ধুদের কাছে বললাম ওদের মন্তব্য ও আর্মি থেকে এসেছে রাশিয়ান আর্মি তে থাকা অবস্থায় চার ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে দেয় না ওর সেই অভ্যাস রয়ে গেছে, বন্ধুরা বলল, তোর কপালে দুঃখ আছে। কিন্তু ওর একটা অভ্যাস ছিল ক্লাস থেকে এসে সবকিছু রেখে চলে যেত আসতো ওই এগারোটা সাড়ে এগারোটার দিকে এসে ওই একই কাজ গিটার বাজানো। আমি দুই একবার ওকে বলেছি আমার রাতে ঘুম আসেনা, আমার কথায় পাত্তাই দিল না ও বলল খুবই আস্তে রেওয়াজ করি, ঘুমিয়ে থাক। এইরকম ১৫-২০ দিন যাওয়ার পরে আমার প্রায় মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। শরীর খুবই খারাপ হয়ে গেল, পড়াশুনার প্রচণ্ড চাপ তার আগে দুই মাস সাইবেরিয়ায় অমানুষিক পরিশ্রম করে এসেছি। মনে মনে ভাবি শালা কোন তানসেনের পাল্লায় পড়েছি রেওয়াজ করে তাও আবার মধ্যরাতে। যাহোক নিজের অজান্তেই একদিন ও যখন বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করছে আমি রুটি কাটা চাকু নিয়ে ওর মাথা চেপে ধরে ওর গলায় চাকু বসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখালাম। মনে হল ও খুব ভয় পেয়ে গেছে তৎক্ষণাৎ বেড থেকে উঠে গেঞ্জি গায়ে দিয়ে একটা ট্রাক স্যুট পড়ে চলে গেল। আমি আমার বন্ধুদের কাছে এই কথা বলার পরে সকলেই চিন্তিত হয়ে গেল, বলল ও হয়তো ওর বন্ধুবান্ধবকে ডেকে আনতে গেছে রাত্রে তোমার ভালো দোলাই হবে। আমরা ওই আর্মি ফেরত ওদের সাথে মারামারি করে পারব না, তুই ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি, কর। আমার বন্ধুরা চলে যাওয়ার পর মনে মনে ভাবছি যা হয় হবে। একটা ভরসা ছিল ওতো সাথে সাথে আমাকে মারতে পারতো, যাহোক নানান কথা ভেবে খাটে শুয়ে আছি। ঘন্টাখানেক পরে ও রুমে ঢুকে তাড়াতাড়ি একটি বালিশ, ছোট্ট একটা ব্যাগ নিয়ে চলে গেল। আমি নিশ্চিত হয়ে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লাম। ও তিন থেকে চার দিন রুমে আসলো না। তারপর হয়তো মাঝে মাঝে রুমে আসত কিন্তু আমার সাথে দেখা হয় নাই প্রায় এক সপ্তাহ। এক সপ্তাহ পরে সুন্দরভাবে আমার কাছে বলল ও ভুল করেছে ও খুবই অনুতপ্ত আমি একটি বিদেশী ছেলে এভাবে আমাকে ওর ডিস্টার্ব করা ঠিক হয়নি । এরপরে ও বলল আমি শুধু রুমে এসে ৫-৬ ঘন্টা ঘুমাবো বাকি সময় আমার ক্লোজ বন্ধু আছে তাদের রুমে থাকবো তোর কোন অসুবিধা হবে না। যে কথা সেই কাজ ও, ওর কথা রাখলো আস্তে আস্তে ওর সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠল। আমরা একই রুমে থাকি যার যার খাবার সে খাই। একটা কথা বলে রাখি সোভিয়েত ইউনিয়নে খাবার খুবই সস্তা ছিল আঠারো কো পেক দিয়ে হাফ কেজির একটি রুটি পাওয়া যেত যা কোনক্রমেই দুই দিনে শেষ করা যেত না। আমরা গড়ে প্রতিদিন একটা রুটি কিনতাম অর্ধেক খেতাম বাকিটা ফেলে দিতাম। এটা আমরা সব বিদেশিরাই প্রায় একই কাজ করতাম। একদিন বিকেলে আমি পুরানো রুটি ফেলতে বাহিরে যাচ্ছি, হঠাৎ করে ইভগেনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। আমি মনে মনে ভাবলাম আমার এই সোজা-সরল বন্ধুটি আজ হঠাৎ দুই বছর পরে এরকম অগ্নিমূর্তি ধারণ করল কেন? আমি কিছু বলার আগেই ও বলল আমার দেশের খাবার, এই রুটি, তুমি নষ্ট করে ফেলে দিতে পারো না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমাদের কত মানুষ এক টুকরো রুটির অভাবে না খেয়ে মরেছে। এই রুটি তোমার পয়সায় কেনা হলেও এটা আমাদের জাতীয় সম্পদ, তুমি এই সম্পদ ইচ্ছামত নষ্ট করতে পারোনা। আমার মাথা লজ্জায় নত হয়ে গেল। আমি ওর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হলাম বললাম ভবিষ্যতে আর হবে না। যাকে আমি বোকাসোকা মানুষ ভাবতাম সেই ইভগেনির দেশপ্রেমের কাছে আমার মাথা নত হয়ে গেলো। আমার মস্কো জীবন শেষ করে শেষদিনে ইভগেনির সাথে দেখা করলাম ও তখন বিয়ে করেছে ওর স্ত্রীর সাথে আলাদা ভাবে থাকে। শেষ বিদায়ে ওর সাথে করমর্দন করে ওর দেশপ্রেমের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি ওকে বললাম "ইভগেনি তোমায় লাল সালাম।" আমার সোভিয়েত ইউনিয়ন জীবনের অনেক কিছুই ভুলে গেছি কিন্তু আমার বন্ধু ইভগেনির সেই দেশপ্রেমিক, বলিষ্ঠ মুখখানা আজও অম্লান, চিরভাস্বর। ভালো থেকো বন্ধু, জয় হোক তোমার দেশপ্রেমের।

সন্তান

রত্না চক্রবর্তী

 

৮.৬.২১

আজকের অন্য রহস্যের এ ঘটনাটি আমার এক অতি পরিচিত মাসীমার। তার মেয়েরা প্রায় আমার সমবয়সী ছিল। বড় মেয়েটি আমার বয়সী, সে আমার বন্ধু ছিল। ছোটটি আমার থেকে দুই বছরের ছোট। মাসীমা আমায় খুব ভালোবাসতেন। মেয়েদের তিনি লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন কিন্তু বিয়ে দেবার দিকেই ঝোঁক বেশি ছিল। বড় মেয়ে পাস করার অনেক আগে থেকেই তিনি তার বিয়ের সম্বন্ধ করছিলেন।।পরীক্ষা দিয়েই বিয়ে হয়ে গেল মীনার। বড় হুড়োহুড়ি করেছিলেন। তাদের বাড়ি ছোট বয়সে বিয়ে দেবার চল ছিল। তাও মাসীমা তো যুগের তালে মেয়েদের পড়াশোনা করিয়ে বিয়ে দিচ্ছেন। মীনার বিয়ের পর তার সাথে আর বিশেষ যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়নি। তখন আমরা পড়াশোনায় খুব ব্যস্ত। টিনাও পড়াশোনা করছে। মীনা কেমন আছে জিজ্ঞাসা করলে মাসিমা হেসে বলতেন ভালই আছে কিন্তু ততো বেশি শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে গল্প করতেন না। তার স্বভাব ছিল খুব গল্প করতে ভালোবাসতেন। তবুও মীনার কথা তেমন বলতেন না। তবে টিনার বিয়ে নিয়ে যে তখনই দৌড়াদৌড়ি শুরু করেননি এটা দেখে ভারী আশ্চর্য হলাম। মাসীমারা 'বেশি বয়সে মেয়ে ঘরে রাখবেন না' এই ধরনের মানসিকতার ছিলেন। টিনা চাকরির চেষ্টা করছে দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম। তারপর একদিন আমি টিউশন সেরে ফিরছি মাসিমার সঙ্গে দেখা হলো। মনে হলো কান্নাকাটি করে চোখমুখ ফোলা। আমি গিয়ে গায়ে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলাম, " ও মাসীমা কি হয়েছে গো? এমন দেখাচ্ছে কেন? " জিজ্ঞাসা করতেই উনি ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন। তখনই জানতে পারলাম যে মীনা বড় কষ্টে আছে। তখন খোঁজখবর ভালো করে নেওয়া হয়নি এখন দেখা যাচ্ছে মীনার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ভারী বদলোক। তার মধ্যে তিন বছর বিয়ে হয়েছে এখনো ছেলে মেয়ে হচ্ছে না বলে অত্যাচার করে। বাঁজা বাঁজা বলে ভীষণ কষ্ট দেয়। এমনকি ভালো করে খেতেও পর্যন্ত দেয় না। মেয়েকে নিয়ে আসার উপায় নেই আত্মীয়স্বজন পাঁচটা কথা বলবে। ( যুগটা প্রায় চল্লিশ বছর আগের) এছাড়া মেয়ে নিজেও সেখান থেকে মোটেই আসতে চায় না। যদি বরের আবার বিয়ে দিয়ে দেয় সেই ভয়ে। এই নিয়ে খুব মনোকষ্টে আছেন। আমার মনটা এত খারাপ হয়ে গেল কি বলব। মীনা আমার বড় প্রিয় বন্ধু ছিল। বড় শান্তশিষ্ট , নিরীহ ধরনের মেয়ে। মাসিমা আমার গায়ে হাত বুলিয়ে কাঁদতে লাগলেন বললেন, " তোকে দেখলে মীনার কথা মনে পড়ে। কেন যে তখন হুড়োহুড়ি করে বিয়ে দিলাম। " এইজন্যই আর টিনার বিয়ে দেওয়া নিয়ে জোরাজুরি করেননি। টিনা চাকরির চেষ্টা করছে। লেখা পরীক্ষায় পাশ করে গেছে ইন্টারভিউ হলে চাকরি পেয়ে যাবে। যাইহোক টিনার কথা শুনে মনটা তবু ভালো হল। এরপর আমার বিয়ে হয়ে গেল, টিনা চাকরি পেয়ে গেল। দিন গড়াতে লাগল। মাসীমা মাঝে মাঝে আমার মার কাছে এসে সুখ-দুঃখের গল্প করতেন। আমি শ্বশুরবাড়ি থাকাকালীন খবর পেলাম মীনা মারা গেছে! বেশ অনেকদিন নাকি অসুখে ভুগছিল, শেষে বাড়াবাড়ি হল। কলকাতায় আনার চেষ্টা করেছিল কিন্তু বাঁচানো যায় নি। শুনে এত কষ্ট পেলাম কি বলব! আমার মা তো কেঁদেই মরেন কারণ আমিও তখন শ্বশুরবাড়ি। মা বললেন, "শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ইচ্ছা করে অবহেলা করে মেরে ফেলেছে। " এরপরের বছরে টিনার বিয়ে হল।সময় যুগের তুলনায় একটু বয়সেই বিয়ে হয়েছে। টিনার বিয়ে ভালোই হয়েছে। স্বামী স্ত্রী দুজনেই চাকরি করে। কলকাতায় থাকে। ছুটিছাটায় শ্বশুরবাড়ির দেশে যায়। আমার বাচ্চা হবার পর কিছু বছর বাদে টিনার মা এসে আমার মার কাছে খুব কান্নাকাটি করলেন। তখন টিনার অনেকদিন বিয়ে হয়েছে, তখনো বাচ্চা হচ্ছে না। জামাই খুব ভালো। শ্বশুর বাড়ির লোকে খারাপ কিছু বলছে না মীনার শ্বশুর বাড়ির মতো। জামাই পরীক্ষা করিয়েছে তার কোন দোষ নেই। মেয়েরও টেস্ট করিয়েছে তেমন দোষ পাওয়া যাই নি। একটা ছোট টিউমার হয়েছে কিন্তু একদম বাইরের দিকে তাতে বাচ্চা হবার কোন প্রবলেম নেই। কিন্তু সবাই বলছে মাসীমার মেয়েদের কোন গন্ডগোল আছে, তাই বড় বোনের বাচ্চা হয়নি ছোট বোনের বাচ্চা হচ্ছে না। অনেক দিন আগের কথা কাজেই মেয়েদের দোষ খুঁজে বার করা তখন যেন একটা মানুষের স্বভাব ছিল। মাসীমার আবার দুই বোনের একজনের বাচ্চা হয়নি আর একজনের বাচ্চা হয়ে মারা গেছেন আর হয়নি। সবাই বলতে লাগল মাসীমাদের নাড়ী দোষ আছে। সেই সূত্রেই এই দুই মেয়ের বাচ্চা হয়নি। মীনা তো বাচ্চা জন্ম দিতে পারল না মারা গেল। আর টিনারও বাচ্চা হবে না। মন খুব খারাপ মাসীমার। কেউ এটা বলল না যে মাসীমা তাহলে দুটো মেয়ের জন্ম দিলেন কথা করে? এমনকি জামাই বললো, "এই নিয়ে মন খারাপ করো না। মনে হয় না সে সৌভাগ্য আমাদের হবে। আমরা একটা দত্তক নিয়ে নেব যদি দরকার পরে। কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখি। " আরো অনেক বড় বড় ডাক্তার দেখাতে লাগল কিন্তু ডাক্তাররা বলছেন কোনো গন্ডগোল পাওয়া যাচ্ছে না। কেন হচ্ছে না সেটা বোঝা গেল না। তাও কিছু ওষুধ চলল। পেটব্যথার আর টনিক জাতীয়। মাসীমা আমার মার কাছে এসে কাঁদতে লাগলেন। মা বললেন, " আমার বাপের বাড়ির মঙ্গলচন্ডী ঠাকুরের ফটো দেখুন আপনি এখানে মনের দুঃখ জানিয়ে যান যদি টিনার সুস্থসবল বাচ্চা হয় এসে পূজো দিয়ে যাবেন। নিজের মনের ব্যথা মাকে বলে গেলে মা নিশ্চয়ই মনোবাসনা পূর্ণ করবেন। আপনি চিন্তা করবেন না। " মাসিমা মানত করে গেলেন টিনা নিজে সুস্থ থেকে সুন্দর সুস্থ সবল বাচ্চা হলে তিনি এসে পূজো দিয়ে যাবেন বাচ্চা নিয়ে।" এরপর আমার সাথে টিনার দেখা হয়েছিল আমি যে গাইনোকোলজিস্টকে দেখাতাম হাজরা মোড়ের থেকে এগিয়ে গিয়ে তিনি বসতেন,নাম ডাক্তার বিশ্বনাথ দাস তার কাছেই নিয়ে গেলাম। এবার ডাক্তারবাবু দেখেই বললেন," বাচ্চা না হবার মতো কোন দোষ নেই, ছোট টিউমারটাও বাইরের দিকে, বাচ্চা হবার সময় অপারেশন করে দিলেই হবে। তিনি সামান্য কিছু ওষুধ দিলেন। টিনা ডাক্তার দেখাতে এসে আমার মার কাছে এসে ক্যামেরায় ছবি তুলে নিয়ে গেল মঙ্গলচণ্ডীর। ঠাকুরের ফটো নিজের ঘরে রাখবে বলে। এরপরে ও ওর বাড়ি চলে গেল, আমি আমার শ্বশুরবাড়ি চলে গেলাম। কিন্তু মার কাছে খবর পেয়েছিলাম ওর শরীর নাকি খুব খারাপ, খুব বমি করছে, বিছানা থেকে উঠতে পারছে না,এত মাথা ঘুরছে। হয়তো ওষুধটা সহ্য হচ্ছে না। ওর বর ভাবছে আর একবার বিশ্বনাথ দাসকে দেখাতে যাবে। আমিই এই ডাক্তারের কথা বলেছিলাম গভীর বিশ্বাসে , এখন আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম। কিন্তু ভাবলাম কি করব আমার তো আর যাওয়া সম্ভব নয়। যাই হোক ওর বর ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তারবাবু একটা সামান্য পরীক্ষা করতে দিলেন, ইউরিন টেস্ট। এবার খবর এলো যে টিনা মা হতে চলেছে। এই যে খবরটাতে কি আনন্দ হয়েছিল বলে বোঝানো যাবে না। অদ্ভুত লেগেছিল কারণ ব্যাপারটা বোঝা যায়নি। টিনার সাধারণ যা উপসর্গ হয় তা হয় নি, নর্মাল স্বাভাবিক যেমন চলে টিনা তেমনই ছিল। যদি বমি করে অসুস্থ বোধ না করতো তাহলে কোন মতেই ডাক্তার দেখাতে যেত না। কিন্তু এমন নাকি অনেকেরই হয়। ডাক্তারবাবু ভালো করে পরীক্ষা করলেন। তার পরের মাসে সোনোগ্রাফি করালেন। বেবি ভালো আছে রিপোর্ট খুবই ভালো। টিনার মেয়ে হয়েছিল, সুস্থ-সবল অতি সুন্দর মেয়ে। নাম রেখেছিল দুর্গারই অপর একটি আধুনিক নাম। মঙ্গলচণ্ডীর দোর ধরা মেয়ে ৷ এখন সে মেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছে তারও বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়েটির যেমন লেখাপড়ায় ভালো হয়েছে তেমন সবদিক দিয়ে ভালো হয়েছে। মোটামুটি জীবনে সুখী হয়েছে বলা যায়। টিনার মা টিনাকে আর বাচ্চাকে নিয়ে এসে পূজো দিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের বাড়িতে মন্দির নেই শুধু ঠাকুরের ফটো। তার সামনেই বাচ্চাকে মাটিতে নামিয়ে দিয়েছিলেন। খুব আনন্দ করেছিলেন। এখনো ওরা মঙ্গলচন্ডীর মহিমা খুবই মানে। তবে মায়ের প্রাণ তো যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন দুঃখ করতেন, মীনার কথাটা যদি ঢেকে না রেখে জানাতেন, মায়ের স্মরণ নিতেন তবে হয়তো মেয়েটা তার মরে যেত না। আমার মাও তখন বেঁচে ছিলেন, মা বলতেন," গ্রহ, অশুভ, অমঙ্গল কাটানো যায়, ভগবানের নাম নিয়ে উদ্ধার পাওয়া যায় কিন্তু আয়ু যা মাপা আছে তা বদল করা সম্ভবই নয়। তাই ওনাকের মেয়ের কথা জানাতে দেয় নি।"