‘তোমাকে আমি ছুঁতে পারিনি’
সন্মাত্রানন্দ
'মার' কে মেরে মন কে ছোঁয়া
- অরুণোদয় কুন্ডু
ইতিহাসের পাতাগুলোকে রক্তমাংসের চরিত্র বানিয়ে নানা ঘাত প্রতিঘাতের চিত্রনাট্যে তাকে মনের মানুষ করে তোলা বোধহয় তাঁর নেশা। নাহলে বলতে হয় কোনও চরিত্রের ধ্যান করতে বসে নিজের মানসপটে ধিরে ধিরে একটা অক্ষর থেকে ছবি, ছবি থেকে চিন্ময় হয়ে ওঠার অনুভূতিগুলোকেই বানীরূপ দিয়ে চলেছেন লেখক। তাই বইয়ের নাম ‘তোমাকে আমি ছুঁতে পারিনি’ হলেও ইতিহাসের সাথে কল্পনার মিশেলে তৈরি সিদ্ধার্থকে ছোঁয়া যায়। নিজের মধ্যেকার ব্যাথাগুলো, অসফল হওয়ার বেদনাগুলো যেন মিলে যায় সেই বিশাল মানুষটার সাথে। নির্বাণ, মুক্তি, বুদ্ধত্ব, এসব বড় কঠিন কথা। এসবের ধারে কাছে আজকালকার সব কিছুকে ‘মেড ইজি’ করতে চাওয়া মানুষ ঘেঁসতে চায় না। তবে তারা দুঃখে বিশ্বাসী। বিশ্বাসী দুঃখ থেকে উত্তরণের গল্পে। অসফল হয়ে ভেঙে না পড়ে লড়াই করে যাওয়ার মধ্যে তারা খুঁজে পায় নিজের জীবনের ব্যর্থতা গুলোকে সাফল্যে বদলে দেওয়ার রসদ। আর সেই রসদের অফুরান ভান্ডার সিদ্ধার্থ। তাই এই উপন্যাসও যেন হয়ে উঠেছে হালের ভাষায় একটা ‘সাকসেস স্টোরি’। কিন্তু শুধুই কি তাই। এটা কি আজকের চরম অমাবিকতার সামাজিক প্রেক্ষাপটে সেই একই ইজেল থেকে উঠে আসা একটা অনুকরণের যোগ্য দৃষ্টান্ত দৃষ্টান্ত তৈরি করে দিলো না ? এই চাচা আপন প্রাণ বাঁচার যুগে যখন সমস্ত জীবন সংগ্রামই আবর্তিত হয় নিজেকে ঘিরে, তখন এমন একজন মানুষকে তুলে ধরা যার সব কিছু থাকা স্বত্ত্বেও সব ছেড়ে পথে নেমেছে সারা পৃথিবীর মানুষের দুঃখ ঘোচাতে। আর শুধু নামেইনি যতরকম ভাবে বিপন্ন হওয়া সম্ভব প্রলোভিত হওয়া সম্ভব তত রকম ভাবেই সে এসেছে ‘মারে’র কবলে। কিন্তু তারপরেও অবিচল। লোকে বলবে এ’তো বুদ্ধের দ্বারাই সম্ভব। সেই কারণেই বুদ্ধ নন সিদ্ধার্থকেই এখানে আনা হয়েছে মূল চরিত্রে। যার অনুভূতিগুলো দেবতাসুলভ নয়। একজন উন্নতিকামী মানুষের মত। কিন্তু উন্নিতির উদ্দেশ্যটা আমাদের রোজকার উদ্দেশ্যগুলির থেকে অনেক গুনে মহৎ। সেখানে তাকে সত্যিই ছোঁয়া যায়না। কিন্তু ছোঁয়ার ইচ্ছাটা পাঠকের মনে জাগিয়ে দিয়েছেন গল্পকার। আমরা আপাত ভাবে যাদের পর ভাবি তাদের জন্য এভাবে প্রানপাত করা পাঠকের অবচেতনে এক উদারতার ভূমি রচনা করে নিঃশব্দে। আর সেই অতল গভির সত্যকে হজম করার মতো করে পরিবেশন করে সুজাতা মল্লিকাদের সাথে উদাত্ত সৌদাসেরা। কথা বলে যায় জন্মজন্মান্তরের চিরন্তন প্রেম। আর সেই প্রেমময় মূর্তিগুলিকে চালচিত্রের মত আগলে থাকেন সিদ্ধার্থ। কদিন আগে পড়া ‘নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা’ও গল্পের কথন ভঙ্গিতে ছায়া ফেলে যায় বারবার। সেখানের শাওনের মত করেই গল্পের মাঝে ময়ূখ হিসাবে লেখকের প্রবেশ একই রকম ভাবে অন্য রঙে রঙিন করেছে আখ্যানটিকে। জন্মান্তর থেকে জন্মান্তরে কখন যেন জাহ্নবী আর মল্লিকা এক হয়ে যায় চিরন্তন প্রণয়িনীর চিরকালীন দাবিতে। অঙ্গুলিমালের ভিতরের ভয়ঙ্কর পিশাচকে অহিংসকে পরিণত করার ঘটনা যেন সেই তিব্বতের পথে ভয়ংকর উৎপীড়ক দস্যুকে মানবকে বদলে দেওয়ারই কাহিনী। মারের সাথে সিদ্ধার্থের দ্বৈরথ সব শেষে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায় মনকে। একজন মানুষের জীবনের চাওয়া গুলো কি হতে পারে তা যেন এই লড়াই দেখিয়ে দেয়। আমাদের চাওয়া আর সারা উপন্যাসের কথকতায় আমাদেরই একজন হয়ে ওঠা সিদ্ধার্থের চাওয়ার পার্থক্য যেন বেঁচে থাকার রসদ আসলেই কি হওয়ার কথা ছিলো তার একটা ধারণা দিয়ে যায়। পাঠকের অজান্তেই তার মনে রোপণ করে যায় এক বোধিবৃক্ষ। উদার আকাশ থেকে ক্রমশ ছ ইঞ্চির মোবাইল স্ক্রিনের সংকীর্ণতায় নেমে আসা পাঠক হৃদয়কে আবার যদি ওই আকাশের মুক্তির ডানা মেলার অবকাশ দেওয়া যায় সেই আশায়।