রোমেনা লেইস
ব্রুকলিনের একটি স্কুলে কাজ করে কেলী। দুটো বাচ্চা । বড় মেয়ে লিলিয়ানা,
বয়স ষোল । ছোট ছেলে বারো বছরের মাইকেল। কেলী ইটালীয়ান বাবা মায়ের সন্তান ।
ব্রুকলিন ষ্টুডিও স্কুল থেকে গ্রাজুয়েশন করে কলেজে যাওয়ার আগেই প্রেগনেন্ট
হয়। সতেরো বছর বয়সে বড় মেয়ে লিলিয়ানার জন্ম হয়। ও ডাকে লিলি। ঝাঁকড়া চুল
মাথা ভর্তি । দারুণ আকর্ষণীয়। ওর বাবা টনি গনজালেস । তখন ‘বেস্ট বাই’ এর
অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ছিলো। পার্টটাইম জব খুঁজতে সিজার্স বে ‘বেস্ট
বাই’এ গেলো। তখন ও টেনথ গ্রেডে । ইন্টারভিউয়ে তিনজনের মধ্যে ওকেই সিলেক্ট
করলো। টনি ছিলো পোর্টারিকোর ছেলে । কেলী প্রতিদিন ব্রুকলিন স্টুডিও থেকে
ক্লাস শেষে বি সিক্স বাসে বেস্টবাইয়ে পৌঁছে একটানা ছয় ঘন্টা কাজ করতো।
ক্লোজিং থাকতো টনির। টনি বলতো কাজ শেষ করে ওর চেম্বারে বসতে। টনি ওকে
ড্রাইভ করে নামিয়ে দিয়ে যেতো বাথ এভিনিউ ওদের বাসায় । দুজনের দুজনের প্রতি
ভালবাসা যখন তুঙ্গে তখনই ওরা একসাথে থাকতে শুরু করে। লিলিয়ানা জন্ম নিলো।
লিলি নামে ওকে ডাকে টনি। কেলী বাসায় লিলিয়ানাকে নিয়ে থাকে । জব করে না আর।
লিলিয়ানার জন্মদিন । বেস্ট বাই এর কোওয়ার্কারদেরও দাওয়াত করেছে। টনি আর
সানাকে ওদের ঘরেই বেকায়দা পরিস্থিতিতে দেখে কেলী। প্রশ্ন করলে টনি বলে দেয়
-উই আর ইন লাভ।
যে কোন রক্তেমাংসে গড়া রূপসীর চেয়ে টনি তাকে তার কাছে অনেক অনেক বেশী করে
টেনে নিয়ে গেছে। বাঁধনে জড়িয়েছে। মায়ায় বেঁধে ফেলেছে। আবার ছুঁড়ে ফেলতেও
দ্বিধা করলো না।
ছোট্ট লিলিকে নিয়ে মায়ের কাছে চলে আসে। লিলিয়ানার তখন দুই বছর বয়স । টনি
ভাল জব করতো তাই চাইল্ড সাপোর্টও পেলো।
অবাধ্য, অপার্থিব আর পাগলাটে প্রেমগুলো বোধয় এমনই হয়। চুম্বকের মত টানে,
আকর্ষণে আকর্ষণে বিধ্বস্ত করে ফেলে। অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে কেলী।
তবুও কেন আর কিভাবে যেন শেষ পর্যন্ত কেলী আবার প্রেমে পড়তে বাধ্য হলো। তাকে
প্রথমে ভালো লেগেছিল খুব। কাছ থেকে দেখে, বসে, হেঁটে, সময় কাটিয়ে আর তার
স্পর্শ পেয়ে তাকে ভালোও বেসে ফেলেছে সত্যি। তখন লিলি চার বছরের। লিলিকে
স্কুলে নিয়ে যাওয়া আর আনার সময় প্রথম পরিচয় হয়। সে একজন সাইকোলজীস্ট। জনসন
হার্পার। হাসিখুশী । পরে ওরা বিয়ে করে। জনসন আর কেলীর ছেলে মাইকেল । দারুন
সুখের সংসার । সকালে একসাথে ব্রেকফাস্ট খেয়ে সবাই বের হয়। প্রথমে নামিয়ে
দেয় ছেলে মাইকেলকে ক্যাভালারো মিডল স্কুলে । তারপর কেলীকে নামিয়ে দিয়ে যায়
পিএস ৯৬ এ।
-লাভ ইউ মাম্মা বলে মেয়ে।
-লাভ ইউ বেবী। সি ইউ সুন। বাই।
তরপর বাপ আর মেয়ে ব্রংকস এ যায় । লিলি ফোর্ডহ্যাম ইউনিভার্সিটিতে একাউন্টিং
এ মেজর করছে। আজ সকালে মেয়ে লিলিকে ব্রংকস এর ফোর্ডহ্যাম ক্যাম্পাসে নামিয়ে
দিয়ে জনসন ওর অফিসে গিয়ে ফোন করে জানালো
-আই ড্রপড লিলি এন রিচড সেইফলী ।
-ওকে। লাভ ইউ। বাই।
-লাভ ইউ টু।
কেলীর অফিসে আজ বেশ আনন্দঘন পরিবেশ। আর মাত্র তিনদিন স্কুল খোলা তারপর দুই
সপ্তাহ ক্রিসমাস এর ছুটি। সবার মধ্যে উপহার বিনিময় চলছে। পে রোলের কাগজ
পত্র জমা দিতেই পে রোল সেক্রেটারি ওকে একটা ফাইল দিয়ে বললো ভাইস
প্রিন্সিপাল মিস সিলভিয়ার সিগনেচার নিয়ে রাখতে। আর ঐ সময় আই ফোনে অ্যাম্বার
অ্যালার্ট বাজলো। পাত্তা না দিয়ে কাজে মন দিলো। এমন সময় প্যারেন্টস কো
অরডিনেটর লীরা এসে বললো:
-ডিড ইউ চেক দ্য অ্যাম্বার অ্যালার্ট ?
-নোপ। আই ডোন্ট হ্যাভ টাইম। মিষ্টি হেসে বলে।
-চেক ইট। এ গার্ল ইজ মিসিং ফ্রম ব্রংকস । ফোর্ডহ্যাম ক্যাম্পাস।
-হোয়াট ?
আবার অ্যাম্বার অ্যালার্ট বেজে ওঠে সবার আইফোনে । এবার বুকটা কেঁপে ওঠে
কেলীর।
‘এ গার্ল নেমড লিলিয়ানা গনজালেস ফ্রম ফোর্ডহ্যাম ব্রংকস ক্যাম্পাস
কিডন্যাপড বাই ফোর গাইজ। উয়িথ এ গ্রে টয়োটা সিয়েনা ভ্যান। শি ইজ দ্য
স্টুডেন্ট অব ফোর্ডহ্যাম ইউনিভার্সিটি।’
সাথে লিলিয়ানার হাসিমুখ ছবি। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে একদম থ হয়ে গেলো কেলী।
চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।
গল্প-স্বপ্ন রহস্য
রত্না-চক্রবর্তী
২৪.৪.২১
এটি ভৌতিক গল্প নয় কিন্তু এটি রহস্যময় তো বটেই। মানুষের জীবনে স্বপ্ন খুব
অদ্ভুত জিনিষ। অনেক স্বপ্ন আছে যার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা মেলে। বেশির
স্বপ্ন আমরা যা ভাবি, যা চাই, যাতে ভয় পাই বা প্রভাবিত হই এমনই সব ঘটনা
নিয়ে দেখি। অবদমিত কামনা বাসনার প্রভাব স্বপ্নের উপর খুব পড়ে। কিন্তু কিছু
অদ্ভুত স্বপ্ন আছে যার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। এমন ঘটনা একবার ঘটলে তাকে
কাকতালীয় বলা যায় কিন্তু বারবার ঘটলে তো সেটা মনে করা যায় না।
এরকমই ঘটনা বারবার আমার জীবনে ঘটেছে। অনেককে জিজ্ঞাসা করেছি কিন্তু উত্তর
মেলে নি। তাই ঘটনাগুলো সবার মাঝে জানাব ঠিক করেছি। যদি কেউ কোন কারণটা
ব্যাখ্যা করতে পারেন। প্রথম স্বপ্নটা দেখি তখন আমার বিয়ে হয় নি। আমার এক
মামা ছিলেন, মার মাসতুতো ভাই, ভালোবাসতাম তাকে কিন্তু খুব একটা যোগাযোগ ছিল
না। মাঝে মধ্যে দেখা হত, খুব একটা আলোচনা ও হত না। একদিন স্বপ্ন দেখলাম আমি
সেই মামার বাড়ি গেছি, দেখি মামীমা দাঁড়িয়ে আছেন একটা থামের গায়ে হাত রেখে,
মামী একটা ধপধপে সাদা থান পরে আছেন। আমি সবিষ্ময়ে আর্ত চিৎকার করে উঠেছি
"মাইমা", মামীমা করুণ মুখ করে কপালে হাত দেখিয়ে কাঁদছেন। ঘুম ভেঙে গেল। খুব
অবাক লাগল মামা মাইমার কথা ভাবিও নি কিন্তু কি বিশ্রী স্বপ্ন দেখলাম। কাউকে
কিছু বলিও নি, আমার তখন সাতের আঠের বছর বয়স। প্রায় মাস ছয়েক বাদে খবর এল
মামা মারা গেছেন, আচমকা হার্টফেল করেছেন। আমরা তখন যেতে পারি নি যখন গেলাম
তখন মাইমা ঠিক সেরকম করে থামটা ধরে কাঁদছিলেন, আমার ওই রকম দাঁড়ান টাদেখে
স্বপ্নটা মনে পড়ে গেল। অবাক লেগেছিল তবে তত কিছু ভাবিনি।
এরপরের ঘটনা আমার বিয়ের মাস ছয় বাদের কথা। আমি একদিন স্বপ্ন দেখলাম আমার
বড়পিসেমশাই মারা গেছেন আর ছোটপিসির স্ট্রোক হয়েছে। একসাথে দুটো ঘটনা। আমার
পিসি তখন খুবই অল্প বয়স আর বড়পিসেমশাইয়ের তেমন কোন অসুখ ছিলনা।উনি তখন
আসামে চাকরী করতেন। এই আবোলতাবোল স্বপ্ন ফলে যাবার আশঙখা ভুলেও করিনি। পেট
গরমের স্বপ্ন। বেশ কিছুদিন বাদে আমার বাবা একদিন আমার শ্বশুরবাড়ি এলেন খুব
বিষন্ন ক্লান্ত মুখে। আমার শ্বাশুড়ি জিজ্ঞাসা করলেন যে বাবাকে এরকম
দেখাচ্ছে কেন। বাবা তখন খবরটা জানালেন খবর এসেছে আমার বড়পিসিমশাই মারা
গেছেন তিনদিন আগে আর বিপদের উপর বিপদ, মেয়ের বিয়ে নিয়ে মেয়ের সাথে রাগারাগি
করে আমার ছোটপিসির মাইল্ডস্ট্রোকের মত হয়েছে। এইবার আমি বেশ চমকে ছিলাম।
মাইমার কথাটাও মনে পড়ে গিয়েছিল। একটা ভয় পেয়েছিলাম।
এরপর কতকত অজস্র স্বপ্ন দেখেছি কিন্তু কিছুই হয়নি। এরপর বহুদিন কেটে গেছে
এরকম কিছু ঘটে নি। হান্ডেড ডেস সিনেমা দেখে মেয়েকে ঘটনাগুলো গল্প করেছি।
(স্বপ্নগুলো দেখার সময় বইটা বেরোয় নি) এরপর আমি আমার বাবা মা, মেয়ের সাথে
দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিলাম। সুস্থ শরীর, খুশিখুশি মন। ওখানে একরাত
শিলিগুড়ি ছিলাম ফেরার আগে, তখন আমি এক ভয়ংকর ট্রেন দুর্ঘটনার স্বপ্ন দেখি।
এত ভয়ের স্বপ্ন যে আমি আজও ভুলিনি। আমি প্রায় দিন দশ বারো রাতে ভালো করে
ঘুমতে পারিনি। স্বপ্নে দেখেছিলাম মানুষ চেনা যাচ্ছে না, মৃতদেহ এমন চেপ্টে
গেছে যে কোদাল দিয়ে কেঁকে বার করতে হচ্ছে। ছড়ানো ছিটানো হাত পা শরীর। বীভৎস
দৃশ্য অথচ আমি বা আমার চেনা কেউ সেখানে নেই। কিছু মাস বাদে এই রকমই এক
দুর্ঘটনা ঘটেছিল। কাগজে ছবি দেখেছি, টিভিতে দেখেছি। ভয় পেয়েছিলাম স্বপ্নের
সাথে মিল দেখে। দৃশ্যটা ওরকমই ছিল, রুটটাও এক।
এরপর আবার অজস্র সুখ দুখের স্বপ্ন দেখছি কিন্তু কোনটাই সত্যি হয় নি। বছর
সাতেক আগে আমি একদিন স্বপ্ন দেখলাম আমার বোনের মত এক বান্ধবী রমার কি একটা
বড় অপারেশন হয়েছে। সেই সময়টা রমার সঙ্গে আমার তেমন যোগাযোগ ছিল না। অন্য সব
স্বপ্নের মত আমার মেয়েকে গল্পও করলাম। পরের দুদিন বাদে আমার মেয়ে বলল রমাকে
রাস্তায় দেখেছে মেয়ে নিয়ে স্কুল যেতে। বেশ কয়েক মাস পরে পোষ্ট অফিসে টাকা
তুলতে গিয়ে রমার মা মাসীমার সঙ্গে দেখা রমার কথা এমনিই জিজ্ঞাসা করলাম,
মাসীমা বললেন " রমা তো মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এল, বিরাট অপারেশন হয়েছে এই তো
দিন দশ হল হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে। কুড়িদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল। " আমি
বললাম "কিছুদিন আগেও তো দেখলাম বেশ সুস্থ শরীর, হঠাৎ কি হল? " উনি বললেন "
হঠাৎ ই পেটে অসহ্য যন্ত্রণা,ব্লিডিঙ শুরু হয়,সেই রাতেই নার্সিংহোম নিয়ে
যাওয়া, খুব খারাপ দিন গেছে গো, এখন ভালো আছে, বাড়ি ফিরেছে। " মন খারাপ হয়ে
গেল, দুটো কারণে, মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি আর আবার স্বপ্নটা সত্যি হল। আমার
মেয়েকে বললাম, ও খুব অবাক হয়ে বলল " হ্যাঁ মা তুমি তো স্বপ্নটা দেখেছিলে। "
এরপর রমার বাড়ি গিয়ে দেখা করে এলাম, ওরা আমি যেতে খুব খুশি হল। ওর বর খুব
যত্ন করল,খুবই সাধারণ অবস্থা, কষ্ট করে সংসার চালায় কিন্তু জয় রমাকে খুব
যত্ন করে। ভাল লাগল পরিশ্রমী বিনয়ী ছেলেটিকে। বছর দুই আগে আমি স্বপ্ন দেখি
রমার স্বামী মারা গেছে। যত্ত কুস্বপ্ন। তবে জয় এত সুস্থ ও অল্পবয়সী আর রমার
অপারেশনয়ের ঘটনাটা ঘটার পর থেকে ওর কথা খুব আলোচনা হত, ওর বাড়িও মাঝে মাঝে
গেছি তাই কেন জানি না এই স্বপ্নটা সত্যি হবার আশংকাটা একদম করিনি। মাঝে বেশ
কিছুদিন বাড়ির প্রবলেমে একটু ব্যস্ত ছিলাম। মাস সাতেক আগে রমাকে দেখলাম
মেয়ে নিয়ে কোচিং যাচ্ছে। নিজেই এগিয়ে এসে হাত ধরলাম,"কিরে কি বিচ্ছিরি
চেহারা হয়েছে রে আবার কি অসুখ বাঁধাচ্ছিস? " বলতে বলতে ওর মুখের দিকে চোখ
পড়তে চমকে গেলাম সাদা মুখ সিঁদুরের চিহ্ন নেই সিঁথিতে.... রমা বলল" আর
বেঁচে থাকা রত্না দি.. "
আমি কোন রকমে বললাম "রমা জয়....?" ওবলল "তুমি জানতে না, ও তো আমায় সুস্থ
করে হঠাৎ ই আমায় ছেড়ে চলে গেল। পাইলস অপারেশন হল, বেশ ভালো ছিল, বাড়ি ছেড়ে
দেবে, রাতে হঠাৎ... "
ও কাঁদছিল, আমিও রাস্তায় দাঁড়িয়েই অঝোরে কাঁদছিলাম। ভাবতে ও পারিনি আবার
স্বপ্ন এভাবে সত্যি হবে।
একটা জিনিষ খেয়াল করলাম কোন ভালো স্বপ্ন আজ অবধি সত্যি হয় নি,খুব কাছের
লোকেদের নিয়ে দেখা স্বপ্ন সফল হয় নি, আর সব স্বপ্নই মাঝরাতে দেখা। আতংক হয়
আবার এমন স্বপ্ন দেখব না তো। আমার মেয়ে ছাড়া খুব কম লোকই এই কথা জানে, আজ
লিখে জানালাম। যদি কেউ কোন যুক্তি দেখান এই আশায়।।
(সম্পূর্ণ সত্যঘটনা)
ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রাজ্জাক
২৫/০৪/২১
গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন বাড়িতে দুই ভাইয়ের বসবাস। উপরে টিনের ছাউনি
দেওয়াল দেওয়া, কিছুটা দোতলা টাইপের সুন্দর পরিপাটি বাড়ি। দুই ভাই, দুই
পাশে থাকে। বাড়ির পিছনে নারিকেল সুপারির বাগান প্রায় পাঁচ বিঘা জমির উপরে
নিজেদের বাড়িতে দুই ভাইয়ের সচ্ছল পরিবার।
বাবা মারা গিয়েছে দুই ভাই যখন স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে সেই সময়ে। মা ছেলে
দুটোকে মানুষ করেছে, দুই ভাইকে বিয়ে-শাদী করেছেন, ভালভাবে তাদের সংসার
চলে, দুই ভাইয়ের মধ্যে ভালো সম্পর্ক। মা মারা গেছেন, দুই ভাই সংসারে
উন্নতি করার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে গছেন।
বাড়িতে দুই ভাইয়ের স্ত্রী, দুই ভাইয়ের সংসারেই এসেছে দুটো করে বাচ্চা।
খুবই সুখের সংসার, সচ্ছল পরিবার। তারপরে আবার দুই ভাই বেশ কিছুদিন যাবৎ
মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলার উপার্জনের কারণে ওই বাড়ির অবস্থা ঈর্ষণীয় ভাবেই
বেড়ে চলেছে।
দুই ভাইয়ের বউ বেশ কিছুদিন যাবৎ লক্ষ্য করতেছে, সন্ধ্যার পরে তাদের পিছনের
নারকেল বাগানে একটা লোক আসা-যাওয়া করে। তেমন ক্ষতিকর কিছুনা তবুও
সন্দেহজনকভাবে রাত নয়টা দশটার দিকে পিছনের বাগানের এবং জমির মধ্য খানের
হাল দিয়ে দুই এক বার যাতায়াত করে। প্রথম প্রথম কেউ কিছু মনে করে নাই।
বাড়িতে দুই বউ চারটা বাচ্চা, কাজের লোক আছে দুই একজন, সবাই এটা লক্ষ করলেও
তেমন একটা সন্দেহ করেনি। কয়েক মাস যাওয়ার পরে লোকটার গতিবিধি একই রকম
চলতেছিল, লোকটি যাতায়াত করে রাত দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত। মাঝে মাঝে
ভোররাতের দিকেও হয়তো যাতায়াত করে, বাড়ির সবারই এটা দৃষ্টিগোচর হওয়ায়
সাংঘাতিক রকমের সন্দেহ দানা বাঁধে, সবার মাঝে। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে
দুই ভাই বাড়িতে আসে। দুই ভাইয়ের বউ ওই লোকের চলাফেরা সম্পর্কে ভাইদের
অবহিত করে। দুই ভাই রাত জেগে পরপর কয়েক দিন লক্ষ্য করলো ভদ্র লোকের
আনাগোনা। দুই ভাইও আচার্য হয়ে গেল, কোন ক্ষতিকারক না হলেও সন্দেহজনকভাবে
এই ভদ্রলোক শুধু রাত্রে কেন যাতায়াত করে। ভদ্রলোকতো এই গ্রামের কেউ না।
হয়তো পাশের গ্রামের মতলববাজ কেউ হবে।
দুই ভাই বেশ কিছুদিন যাবৎ ভদ্রলোকের গতিবিধি লক্ষ করল। তারপরে গ্রামের
মেম্বারসহ আরো দুই এক জনের কাছে ব্যাপারটি বলল। একদিন অন্ধকার রাত্রে
গ্রামের চার পাঁচ জন লোক সহ রাত্রে পাহারা দিয়ে ভদ্রলোক ধরে ফেলল। বাড়ির
পিছনে বাগান বাড়ি সংলগ্ন জমির আলের উপর।
সবাই ভদ্রলোককে ধরে বাড়িতে নিয়ে আসলো। উঠানের মাঝে ভদ্রলোককে বসিয়ে সবাই
জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করলো, কেন সে বেশ কিছুদিন যাবৎ এই বাড়ির পিছন থেকে
রাত্রেবেলা প্রায়ই চলাফেরা করে, তার উদ্দেশ্য কি?
ভদ্রলোক প্রথমে কিছু বলতে রাজি হয়নি। ভদ্রলোক বলতেছিল আমি কি কোন অপরাধ
করেছি? আমি কি এদের কিছু ক্ষতি করেছি? কেন আপনারা আমাকে খামোখা অপমান
করছেন।
তখন সবাই বলল, নিশ্চয়ই আপনার কোন উদ্দেশ্য আছে, আপনি দীর্ঘদিন যাবৎ একটি
বাড়ির পিছন থেকে সন্ধ্যার পরে এইরকম সন্দেহজনকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না।
তখন ভদ্রলোক বললেন আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়ান।
ভদ্রলোকে পানি পান কারাণো হলো তারপরও সে বলল, যে ছেলে দুইটি মধ্যপ্রাচ্যে
থাকে তারা তার ভাইয়ের ছেলে। এই গ্রামে ওর বাবা বাড়ি করেছে হয়তো পঞ্চাশ
বছর আগে, প্রথমে আমাদের বাড়ি ছিল সিংহপুর গ্রামে, আমার বাবার ছিল দুই
বিয়া। ওদের বাবা ছিল বড় ঘরের, আমি ছিলাম ছোট ঘরের।
আমাদের দুই মায়ের মধ্যে কোন বনিবনা ছিলনা। তাই আমার বাবা আমাদের দুই ভাইকে
দুই গ্রামে খুব ছোট থাকতেই প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে যায়। আমাদের মায়েদের
মধ্যে কোনো সম্পর্ক না থাকার দরুন, আমাদের মধ্যে কোনো যাতায়াত ছিল না,
ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে থাকায় কেউ কারো সাথে কোন পরিচয় দিতাম না, কোন কথা
বলতাম না।
আমারও একটি ছেলে ছিল, গত চার বছর আগে ছেলেটি মারা গিয়েছে।
ভদ্রলোক বললেন, আমার বাবার কবর এবং আমার ভাইয়ের কবর, এই পিছনের
বাগানবাড়ির এক কর্নারে। আমি প্রতিমাসে একবার এই কবর জিয়ারত করতে আসতাম,
গভীর রাত্রে লোকচক্ষুর অন্তরালে।
বছর খানেক আগে আমি একবার যখন অন্ধকার রাত্রে কবর জিয়ারত করতে আসি, তখন চার
পাঁচটা লোক, বাড়ির পিছনে বসে গুনগুন শব্দ করতেছিল, আমার সন্দেহ হয় তাদের
কথা শুনতে পেলাম তারা এই বাড়িতে ডাকাতি করবে, যখন আমার ভাইয়ের ছেলে দুটি
বিদেশ থেকে আসবে তখন এই বাড়িতে ডাকাতি করবে, আমার ভাইয়ের ছেলে দুটোকে
প্রয়োজনবোধে হত্যাও করবে।
এই কথা শোনার পরে, আমি পিছনে সরে যাই। দূরে গিয়ে ওদের উপর টসলাইট মেরে
বলতে থাকি, তোমরা পিছন থেকে ওদের গুলি করে দাও। এমনভাবে কথাটি বললাম, ওরা
যেন ভালোভাবে শুনতে পায় এবং আমি যে একলা আছি সেটাও জেনো না বুঝতে পারে।
লাইটের আলো এবং আমার সব শব্দ শুনে ওরা পালালো।
আমি আমার বাবা ও ভাইয়ের কবর জিয়ারত করে চলে গেলাম।
কিন্তু আমি আমার মায়ের আদেশ রক্ষা করতে গিয়ে আমার পরিচয় কোনদিন এই
বাড়িতে দেয়নি। আমার মায়ের আদেশ ছিল আমি যেন এই বাড়িতে না আসি এবং
কোনদিন এদের পরিচয় না দেই।
আমার মৃত্যু মায়ের নির্দেশ মোতাবেক কোনদিন আমাদের পরিচয় হয় নাই।
তখন উপস্থিত সবাই একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি আরম্ভ করলো।
ভদ্রলোকের নাম এবং বাবার নাম জিজ্ঞেস করল। গ্রামের সবচেয়ে মুরুব্বি লোককে
ডেকে নিয়ে আসলো, এই সম্পর্কে কিছু জানে কিনা। পাশের বাড়ির সবচেয়ে বৃদ্ধ
লোক আসমত আলী ঘরামিকে ডেকে নিয়ে আসলো। আসমত আলী ঘরামির কাছে সবাই জিজ্ঞেস
করল, এই ভদ্রলোকের কথা সঠিক কিনা।
আসমত আলী ঘরামি বললেন সাহেবা আলী বড় মিঞার দুই ছেলে ছিল, একজন নোয়াব আলী
একজন তালেব আলী।
নওয়াব এই বাড়িতেই থাকতেন। তালেব আলীকে ছোটবেলায় দেখেছি সে তো অন্য
গ্রামে থাকে, এবাড়িতে কোন সময় আসে নাই। তখন ভদ্রলোক বললো, চাচা আমি তালেব
আলী। আসমত আলী ঘরামি তখন তালেব আলীকে চিনতে পারলেন।
তালেব আলী তখন দুই ভাইয়ের ছেলেকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, পারিবারিক
বিরোধের কারণে, তোদের সাথে কোনদিন দেখা হয়নি।
আমি রাতের আধারে এইভাবে ধরা না পড়লে হয়তো কোনদিন আমার পরিচয় তোমরা জানতে
পারতা না।
তোমরা আমার রক্তের প্রবাহ ধরে রেখেছো, আমার ছেলেটি মারা গেছে, তোমরাই আমার
বংশধর আমার বংশের বাতি ঘর। তোমাদের রক্ষা করার জন্য আমি সিংহপুর থেকে চার
মাইল হেঁটে অন্ধকার রাত্রে তোমাদের বাড়ি পাহারা দিতাম, তোমাদের যেন কোনো
ক্ষতি না হয়।
আজ যখন এইভাবে তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ হলো, এখন যে সম্পত্তির কারনে আমার মা
আমি, তোমার বাবা, তোমার দাদির কারণে আলাদা হয়েছিলাম, আজ থেকে আমার যত
সম্পত্তি আছে তোমাদের দুই ভাইকে দান করে গেলাম। আমার মৃত্যুর পরে আমার
কবরটি তোমার বাবার কবরের পাশে রাখিও।
দুই ভাই সবকিছু শুনে তাজ্জব বনে গেল, চাচার পায়ে সালাম করে, বাড়ির ভিতরে
নিয়ে গেল, দুই ভাইয়ের বউদের সন্দেহ দূর করে, সালাম করতে বলল।
দুই ভাই বলল, তোমাদের শশুর লোকচক্ষুর অন্তরালে আমাদের দুই ভাইয়ের জীবন
রক্ষা করেছেন। আমাদের পরিবারটিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
কোন কিছু বাহির থেকে দেখে সন্দেহ করা ঠিক না, অসংলগ্ন চলাফেরা, কথায়
সামান্য গড়মিল হলেই, সন্দেহবশত কোন মানুষকে অপমান করা, মিথ্যা অপবাদ
দেওয়া ঠিক না। সবকিছু জেনে শুনে বুঝে যাচাই করেই, সঠিক সিদ্ধান্তে আসা
উচিত, সব সময়।