রত্না চক্রবর্তী
অন্যরহস্যে আগে আমি রূদ্রেশ্বরের গল্প করেছি। বাবা রূদ্রেশ্বর
মহাদেব কেমন তামাক সেবন করতেন আর কেমন অবিশ্বাসীকে গড়গড়া টানার শব্দ শুনিয়ে
ছিলেন তার গল্প। আজ শিবরাত্রি তাই ভাবলাম আর একটি ছোট ঘটনা আমার আপনজন যারা
অন্য রহস্য পড়তে ও শুনতে ভালোবাসেন তাদের শোনাই।
ব্যানার্জী বাড়ির ভক্তিমতী বড়বৌমা রূদ্রেশ্বরকে মাটির তলা থেকে স্বপ্নাদেশে
তুলেছিলেন। বাবাকে খুব একটা আচার বিচার না মেনে শুধু জলবাতাসা বেলপাতা দিয়ে
ভক্তিভরে পূজো করতেন। ব্যানার্জী মশাইও ছিলেন ভীষণ ভক্ত। তিনি অল্প বয়সে
ভীষণ আর্থিক দুরাবস্থার মধ্যে কাটিয়ে ছিলেন। মনটা অল্প বয়সে খুবই উদার ছিল।
যৌথ পরিবারে ব্যানার্জীবাবুর বড়বোনের বিয়েতে ব্যানার্জীবাবু ও তার স্ত্রী
তাদের সমস্ত গয়না ঢেলে দিয়ে দিয়েছিলেন নিঃসংকোচে। কিন্তু পরবর্তী কালে
দীর্ঘকাল অর্থাভাবে কষ্ট পেয়ে তার মানসিকতার কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হয়েছিল।
পরবর্তীকালে তার আর্থিক অবস্থা ভগবানের দয়ায় খুবই ভালো হয়েছিল। কিন্তু
বোধহয় আগের কষ্টের কথা মনে করেই তিনি খুবই কৃপণ স্বভাবের হয়ে গিয়েছিলেন। সৎ
ছিলেন, যা খেতেন তা সবাইকে দিয়েই খেতেন, সেখানে নিজের নিজের করতেন না
কিন্তু টাকা পয়সা খরচ করতেই চাইতেন না। যতটা কমে চালানো যায় সেটাই ছিল তার
লক্ষ্য। খুব বড় সুন্দর বাড়ি করেছিলেন, কিন্তু পরণের ধুতি ছিঁড়ে গেলে পয়সা
খরচ করে কিনতেন না, স্ত্রীর ছেঁড়া কাপড়কেই ভাঁজ করে লুঙ্গি করে পরতেন। নোট
ভাঙাতে চাইতেন না খরচ হয়ে যাবার ভয়ে। এই নিয়ে স্ত্রী রাগারাগি ও অভিমান
করতেন। কিছু আত্মীয়স্বজন ব্যাঙ্গ করত টিটকারি দিত ৷ আবার তার স্নেহশীল নরম
মন ও সুন্দর ব্যবহারের জন্য ভালোও বাসত অনেকেই।
যখন যেমন অবস্থাই হোক ভগবানে ভক্তি কিন্তু তার অটল ছিল। পয়সা দিয়ে, কিনে
কেটে আড়ম্বরে পূজো করতেন না কিন্তু মনের থেকে বিশ্বাস আর ভক্তি ছিল। একবার
তার বোন ভগ্নিপতি ভাগ্নাভাগ্নি নিয়ে তার বাড়ি বেড়াতে এল। বোনও খুব
ঈশ্বরবিশ্বাসী কিন্তু ভগ্নিপতি একদম এই অলৌকিক ব্যাপারস্যাপার, বা ঈশ্বর
দর্শন এইসবে বিশ্বাস করতেন না। কম কথা বলতেন তাই তর্কে যেতেন না বা নিজের
মতামত সদর্পে জানাতেন না কিন্তু যখন যখন তার নিজের স্ত্রী, বড়শালা ও
বড়শালাজ একজায়গায় বসে আপ্লূত হয়ে ঠাকুরের কি কি মহিমা তারা উপলব্ধি করেছেন
তার গল্প করতেন তখন ব্যানার্জীবাবু তার ভগ্নিপতির মুখের বিশেষ এক মিটিমিটি
হাসি দেখে বিলক্ষণ বুঝতে পারতেন যে এর একবিন্দুও ভগ্নিপতি মুখার্জীমশাই
বিশ্বাস করছেন না। তার বোন স্বামীর উপর রেগে যেত, বলত " ও কি বুঝবে দাদা,
নাস্তিক নাস্তিক, দিনরাত পার্টি করে করে ইউনিয়নফিউনিয়ান করে করে ওর মাথায়
আর কিছু ঢোকেই না। " ব্যানার্জীবাবু স্নেহসিক্ত হাসি হেসে বলতেন " ও দেখে
নি, শোনে নি, উপলব্ধি করে নি তাই বিশ্বাস করে না। ওরে ওর জন্য ভগবান আলাদা
পথ ঠিক করেছেন। যখন দরকার বুঝবেন, ঠিকই নিজের অস্তিত্ব বুঝিয়ে দেবেন। "
এবারে মুখার্জীবাবু শ্বশুরবাড়ি এসেছিলেন শ্রাবণ মাসের দিকে কি একটা দরকারে
কলকাতায় কদিন থাকতে হবে। ব্যানার্জীবাবু দারুণ গল্প করতে পারতেন। সারাদিন
আনন্দ, হাসি ঠাট্টা গল্পগাছা চলল। মুখার্জীবাবু ভীষণ খাদ্যরসিক ছিলেন, মস্ত
ইলিশমাছ এনেছেন। খাওয়াদাওয়াও জম্পেশ হয়েছে। শ্রাবণ হলেও কদিন হল একদম
বৃষ্টি নেই। প্রচন্ড গরম। শেষ বিকেলে সবাই গাটা ধুয়ে দরজায় তালাচাবি দিয়ে
সব আলো পাখা বন্ধ করে তাদের ছোটভাইয়ের বাড়ি গেলেন। যাবার সময়
ব্যানার্জীবাবুর স্ত্রী একটু খুঁতখুঁত করছিলেন।" বিকেল গড়িয়ে এল, যেতে না
যেতে সন্ধ্যে উতরে যাবে, ঘর অন্ধকার থাকবে, সন্ধ্যে বাতি পড়বে না। "
ব্যানার্জীবাবু হাঁ হাঁ করে উঠলেন " না না আমরা কেউ না কেউ ফিরে আসবখন,
আলোটালো জ্বেলে রাখা যাবে না, মিছিমিছি কারেন্ট পুড়বে। "
তিনি নিজে সব আলোটালো বন্ধ করে শেষে বার হলেন। ব্যানার্জীবাড়ির সবাই আমুদে,
একসাথে বোন ভগ্নিপতি, দাদাবৌদিকে পেয়ে ছোটভাইয়ের বাড়িতেও খুব জমে উঠল
আড্ডা। সেই সন্ধ্যে অনেকক্ষণ পার হয়ে গেল। বাড়ি ফেরা হল না, রাত হয়ে গেল।
বাড়ি ফিরে অন্ধকার সিঁড়ি পেরিয়ে প্রথমে ঘরের তালা খুলে ঘরে ঢুকলেন
ব্যানার্জী বাবু। তিনি দেখলেন অন্ধকারেও তার ঘরের ভিতরটা আবছা আলোয় ভরে
আছে, সেই আলোতেই স্বচ্ছন্দে আলো জ্বালালেন। তারপরই রাগে ক্ষোভে চিৎকার করে
উঠলেন " একি ভিতরের ঘরে আলো জ্বলছে কেন? কি কান্ড ভিতরের ঘরে পাখাও চলছে?
কি আরম্ভ করেছ তোমরা সবাই মিলে... রক্ত জল করা পয়সা আমার এই ভাবে নষ্ট
করা...দেব না কারেন্টের বিল আমি... কেটে দিয়ে যাক কানেকশন। " তার ছিল বিশাল
গলা। চেঁচামেচি শুনে সবাই এসে দেখল ভিতরের ঘরের একটা ছোট টেবলফ্যান ছিল
সেটা চলছে আর সেই ঘরের আলোটা জ্বলছে। রাগ করারই কথা, ওনার স্বভাবের কথা
সবাই জানত। হাল ধরলেন ওনার স্ত্রী... উনি বললেন " তুমিই তো সবার শেষে
বেরিয়েছ, তুমিই তো সব আলো পাখা বন্ধ করলে, কেমন কাজ করেছ তাহলে তুমি? তোমার
পর তো কেউ ঢোকেই নি। " রাগে জ্বলে উঠে উনি বললেন " আমি কি করে জানব আলো
থাকতে থাকতেই তোমার ছেলে মেয়েরা কেউ ভিতরের ঘরের আলো জ্বেলে রেখেছে? এ ঘরে
আমি ঢুকিনি। "
গোলমালের মধ্যে ওনার ভগ্নিপতি মুখার্জীবাবু ভিতরে এসে দাঁড়িয়েছেন। উনি
খেয়াল করলেন ঘরটা এক অপূর্ব সুবাসে ভরে আছে। তার সাথে একটা তামাক তামাক
গন্ধ। সে সময় লোকে বিয়েবাড়ি ছাড়া সেন্ট ব্যবহার করত না। রাস্তার একদম মোড়ে
বাড়ি, আশপাশের বাড়ির থেকে তাই দূরত্বটা এমন যে গন্ধটা এত চড়া আসার কথা নয়।
বড়জোর বৃহস্পতিবার বা পূজাপার্বণে হাল্কা ধূনোর গন্ধের রেশ আসে এত চড়া
সুবাস আসে না। আর মুখার্জীবাবু জানেন তার শ্যালক খুব কম দামী সাধারণ ধূপ
ব্যবহার করেন, তাও তো পূজো কোন ভোরে হয়ে গেছে। তিনি উৎসুক হয়ে এদিক ওদিক
তাকাতে লাগলেন। তার সুইচ বোর্ডের দিকে চোখ পড়ল। তিনি অবাক হয়ে গেলেন।
ব্যাপারটা তিনি জানতেন কিন্তু এতক্ষণ মনে পড়ে নি। এই পাখাটা সেকেন্ড
হ্যান্ড, প্ল্যাক পয়েন্টে তার ঢুকিয়ে সুইচ মেরে চালাতে হয়। প্ল্যাগ নেই,
শুধু দুটো তার কেমন করে ব্ল্যাকটেপ দিয়ে জড়িয়ে পয়েন্টের দুটো গর্তে ঢুকিয়ে
দেওয়া হয়। বহুবার সবাই বলেছে " যে কোনদিন কারেন্ট খেয়ে মরবে, একটা প্ল্যাগ
ক 'পয়সা দাম লাগাতে পারছ না? " কিন্তু ব্যানার্জীবাবু কিছুতেই কিনতেন না,
বলতেন " চলে তো যাচ্ছে, কিচ্ছু হবে না, ওটা তো আমি ছাড়া কেউ চালায় না,
ছেলেপুলে ছোট হাত পায় না। " মুখার্জীমশাই অবাক হয়ে ভাবলেন, তিনি নিজে তো
এটা করেন নি, বাড়ির মেয়েরা এই প্ল্যাগপয়েন্টকে ভয় পায়, বাচ্চারা পারে না আর
কেউ তো আসে নি। ব্যানার্জী মশাই ভুলে ভুলে চালাবেন তা তো হয় না। তাহলে! "
তিনি শান্ত গলায় সেই কথাই বললেন। থমকালেন ব্যানার্জীবাবু, তাই তো। তিনি
বিষ্মিত ভাবে পাখার দিকে তাকালেন। পাখার হাওয়াটা যেখানে পৌঁছাচ্ছে সেখানে
ঠাকুরের আসনে বসানো আছে রুদ্রেশ্বর মহাদেব। জানলা দরজা বন্ধ থাকায় ঘরে খুবই
গরম। ব্যানার্জীবাবুর স্ত্রী আবেগের গলায় বলে উঠলেন " ওগো তখনই বললাম
সন্ধ্যে হয়ে যাবে ঘরে আলো থাকবে না, তা সেই তুমি শুনলে না তাই বাবা আলো তো
আলো, পাখাটাও জ্বালিয়ে নিয়েছে। "
মুখার্জীমশাইয়ের স্বভাবসিদ্ধ মুচকি হাসি বা এই অদ্ভুত কথায় হো হো হাসিটা
কিন্তু আসলো না। তার যুক্তিবদ্ধ মন পাকা গোয়েন্দার মতো কার্যকারণ
অবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যেতেই লাগল। কিন্তু কিছুতেই রহস্যটা ভেদ করতে
পারলেন না। আর ব্যানার্জীবাবু থতমত খেয়ে বললেন " এ..হে বড় অন্যায় হয়ে গেছে
গো... "