টরন্টো, ২১ শে মার্চ, ২০২১, নভো সংখ্যা ১৮
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি প্রবন্ধ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল যোগাযোগ আবৃত্তি

কার্তিকের কুয়াশা

বাংলা ভাষা ও বানান

 হাফিজ আহমেদ




অনেকেই মনে করেন, যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত বানানবিধি অনুসরণ না করা এক প্রকার ধৃষ্টতা। তিরিশের দশকের বাঙালিদের ধারণা তাই ছিল। কারণ তখন আসাম ও বাংলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও ভাষা নিয়ন্ত্রিত হত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে। সেই অবস্থা এখন আর নাই। সেই ধারণাও আর নাই। সেইখানেও ভাষার উপর কলকাতার প্রভাব দিনদিনই হালকা হয়ে আসছে। দেশ বিভক্তির পর হিন্দি রাষ্ট্রভাষা হবার পর সেখানকার বাঙালিদের সংস্কৃতি ও কৃষ্টির পরিধি সংকুচিত না হলেও প্রসারিত হয় নাই। দূরদর্শন-এ নাটকাভিনয়ে, সংবাদ পাঠে ও বিজ্ঞাপন প্রচারে এই বাস্তবতার প্রমাণ পাওয়া যায়। উচ্চারণ আর আগের মত মধুর নয়। সাজসজ্জা উচ্চমানের নয় আর বানান ভুল আছেই। সুতরাং সত্তর বৎসর আগে প্রচলিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-এর ভাষারীতি ও বানাননীতি এই দেশে অনুসৃত হবার কথা বার বার সুপারিশ করা হলেও আমরা তেমন অনুপ্রাণিত হতে পারছি না। আমরা আমাদের স্বদেশের লেখক ও সম্পাদকদের লেখা হতে জ্ঞাতসারে নিত্যই অনুপ্রাণিত হচ্ছি। আমরা ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছি। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছি। ফলে আবির্ভাব হয়েছে এক নতুন জাতির। রক্তাক্ত সংগ্রাম ও জাতীয় সত্তার নূতন উপলব্ধি দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছে ভাষা, বানান ও গোটা সাহিত্যের উপর। তাই আমাদের লেখকদের সৃষ্ট সাহিত্যে দেশের কথা আছে, আছে আধুনিক জীবনযাত্রার কথা। আর আছে সংগ্রামের কথা, আছে গ্রামের কথা। তাই হুমায়ুন আহমেদ-এর নাটক সীমা ছাড়িয়ে ঐপারের বাঙালিদের চিত্তকে আকর্ষণ করে। অনুমান করতে পারি যে, তারা অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। আধুনিক বাংলাভাষা এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ঢাকা হতে। গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে, সাহিত্যে সমৃদ্ধ আমাদের মাতৃভাষা ক্রমপরিবর্জন ও ক্রমপরিবর্ধনের পথ ধরে দিন দিনই সম্মুখের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এইসব ভেবে আমরা যদি নিজেদের সাহিত্যের জন্য নিজেরা গর্বিত হই, তা কোনমতেই দোষের হতে পারে না। সেই সময় বর্ণমালায় ‘৯’ (লি) বর্ণ ছিল। আজ আর তা নাই। বর্গীয় ‘ব’ ও অন্তস্থ ‘ব’- এর আকৃতি ও উচ্চারণে কোন পার্থক্য নাই বলে, শিশুদের বর্ণ বইতে এখন একটি ‘ব’ই মুদ্রিত হচ্ছে। তখনকার অনেক রীতিই আজকাল ধীরে ধীরে অচল হতে চলেছে। ভাষার গতি সময়ের গতিকে দ্রুত অতিক্রম করে যে নীতিগত পরিবর্তন এনেছে তা আমাদের চেতনাকে শাণিত করছে। বুঝতে পারছি যে, এই পরিবর্জন ও পরিবর্ধনের গতিতে আর যতি আসবে না, চলতে থাকবে।
আজকে ভাষার আরও সংস্কার প্রয়োজন, বিজ্ঞান সম্মত বানান ব্যাকরণভুক্ত হওয়া প্রয়োজন। আমাদের একটা অভ্যাস আছে যে, একটি শব্দ লেখা শেষ হলেই একটি ী-কার কলমের টানেই শব্দশেষে লাগিয়ে দেয়া। চেতনার তাড়নায় মানুষ এখন বুঝতে পেরেছে যে, সকল শব্দ শেষে ী-কার দেওয়া একটি ভুল অভ্যাস। সেইজন্য শব্দশেষে অপ্রয়োজনীয় ও ব্যাকরণসম্মত নয়, এমন ী-কারকে বিদায় দেওয়া প্রয়োজন।
বাংলাবাসি ও বাংলাভাষি যারাই মনযোগ দিয়ে সাহিত্যচর্চা করেন, তাদের প্রায় সকলেই এই পরিবর্ধিত বানানরীতি অনুসরণ করে আসছেন। এই ব্যাপারে পুস্তক প্রণেতাদের হতে পত্র-পত্রিকার সম্পাদকগণই অগ্রণি ভূমিকা রেখে আসছেন। তারাই আজ অগ্রসর। আজ প্রায় লেখকই সাগ্রহে সানন্দে শব্দশেষে ি -কার ব্যবহার করছেন। তাদের আগ্রহ আমাদেরকে আকৃষ্ট করছে।
একসময় আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ তুলে ধরতাম। আর আজ বাংলাদেশের আধুনিক লেখকদের লেখা তুলে ধরবার মত দৃষ্টান্তের অভাব নাই। কলকাতায় বলা হয়, আকাদেমি। আর আমরা বলি ‘অ্যাকাডেমি’। আমাদেরটাই ব্যাকরণ সম্মত। কারণ আমরা শব্দের মূল উচ্চারণের বিকৃতি হতে দেই নাই। ভাষার উৎকর্ষ সাধনে এখন আমরা কলকাতা হতে অগ্রগামি। এর কারণ বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করবার আন্দোলনে, অমর একুশেতে বাঙালি যুবকদের অকাতরে প্রাণদান আর ভাষা ও স্বাধীনতার মূল্য পরিশোধে শেখ মুজিবের অকালে আত্মদান।
পশ্চিম বংগে বাংলাভাষা বাঙালিদের মাতৃভাষা এবং ভারতে তা প্রাদেশিক ভাষা। এইখানে বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এবং এই ভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা। পশ্চিম বংগে বানানে শব্দের রূপান্তর ঘটেছে ধীরে ধীরে। বাংলাদেশে শব্দের শ্রী এসেছে দ্রুত গতিতে। আধুনিক সাহিত্যে এসেছে আধুনিক বানান। অর্থাৎ শব্দের স্বর ও সুর ক্রমশ সরল হয়ে এসেছে। তা আসতে থাকবে আগামি দিনেও। ‘শ্রেণী’ ও ‘কর্মসূচী’-তে আধুনিকতার স্রোতে আজকাল ি - কার এসেছে। এতে আমরা খুশি। তবে শত লেখালেখিতেও পুলিস বানানে কেউই ‘স’ ব্যবহার করছেন না। সেই দুঃখে আমরা মুহ্যমান। আমাদের বিশ্বাস, ‘পুলিস’ বানানটি অদূর ভবিষ্যতে সকলেই ‘স’ দিয়া লিখতে উৎসাহিত হবেন। কারণ বানানটি অভিধানে আছে এবং তা অবশ্যই ব্যাকরণের বিধান মত।
দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত আমাদের প্রথিতযশা লেখকদের নিবন্ধে আধুনিক বানানের প্রতি আমরা গভীর মনযোগের সাথে দৃষ্টি দেই। কোথায় কোথায় ী-কারের পরিবর্তে ি-কারের আর্বিভাব ঘটেছে তা লক্ষ্য করি। সেই দেখার খানিকটা এইখানে তুলে ধরতে চাই।
১। স্ত্রীবাচক শব্দের অন্তে ী-কার হয়। এইসব শব্দে লিঙ্গ পার্থক্য বুঝবার কারণেই শব্দশেষে ী-কার দিতে হয়। মনে এরূপ ভাবনা আসে যে, হয়তবা পঁচিশ বৎসর পর স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে এই ী-কার নাও থাকতে পারে। ‘নদি’ ি-কার দিয়ে লিখলে, যদি শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গই বুঝায় তা হলে এই ী-কারের ব্যবহার এইখানে নাও থাকতে পারে। কিছু কিছু শব্দ আজকাল ি-কার দিয়ে লেখা হয়। শব্দগুলি যে স্ত্রীলিঙ্গ তা বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না। যেমন গিন্নি, বৌদি, দিদি, বিবি, রানি, দাদি, নানি, মামি, মাসি, পিসি, মুরগি ইত্যাদি।
২। জাতি বাচক শব্দের অন্তে আজকাল কেবলই ি-কার ব্যবহৃত হচ্ছে। ঢাকা হতে প্রকাশিত অগ্রসর দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলিতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন পাকিস্তানি, জাপানি, মাদ্রাজি, সৌদি, কুয়েতি, বিহারি, বাঙালি ইত্যাদি।
৩। ব্যক্তিবাচক অনেক শব্দের অন্তে ি-কার ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন বন্দি, বাদি, কেরানি, আসামি, ফেরারি, সিপাই, কৌসুলি ইত্যাদি।
৪। সংস্কৃত বা প্রাকৃত হতে আসে নাই এমন সকল বংশগত শব্দের অন্তে আজকাল ি-কার ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন কাজি, গাজি, ফরাজি, নিয়াজি, জিলানি, কোরেশি, রিজভি, আলভি, গিরি, রেড্ডি, চৌধুরি ইত্যাদি।
৫। সংস্কৃত বা প্রাকৃত হতে আসে নাই এমন সকল নামবাচক শব্দের সকল জায়গায় কেবল ি- কার ব্যবহৃত হয়। যেমন চার্চিল, ক্লিনটন, কেনিডি, ইয়েলতসিন, রহিম, রশিদ, শহিদ, শফিক, মুসলিম, কামালউদ্দিন ইত্যাদি। তবে অর্ধ শতাব্দি পূর্বে রাখা নামগুলিতে ী-কার ও ূ-কার ছিল। তা আজও আছে। যেমন কাজী, সাহাবউদ্দীন, নূরউদ্দীন, আয়ূব, হুমায়ূন, ওয়াদূদ ইত্যাদি। এইসব নামে ি- কার ও ু-কার থাকলে ভাল হত।
৬। অর্জিত খেতাবেও ি-কার ব্যবহৃত হয়। যেমন ক্বারি, কবি, মৌলভি, হাজি, বয়াতি ইত্যাদি।

৭। সংস্কৃত বা প্রাকৃত হতে এসেছে এমন সকল নামের অন্তে ী-কার ব্যবহৃত হতে দেখা গিয়েছে। তা অর্ধশত বৎসর আগের কথা। আজকাল অনেকেই ঐ সকল শব্দে ি-কার ব্যবহার করছেন। যেমন চক্রবর্তি, পূজারি, সন্ন্যাসি ইত্যাদি। আরও লক্ষ্য করা যায় যে, কতিপয় উচ্চবর্ণ হিন্দু নামের অন্তে ি-কার ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন চ্যাটার্জি,ব্যানার্জি, গাংগুলি, ব্রহ্মচারি ইত্যাদি।
৮। ভাষাবাচক শব্দের অন্তে নির্দ্বিধায় ি-কার ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন ইংরেজি, ফরাসি, আরবি, হিন্দি, মারাঠি, সিংহলি, পালি, নেপালি ইত্যাদি।
৯। প্রাণিবাচক কতিপয় শব্দের অন্তে ি-কার ব্যবহৃত হয়। যেমন পাখি, হাতি ইত্যাদি।
১০। বস্তুবাচক শব্দের অন্তে ি-কার ব্যবহৃত হয়। যেমন বাড়ি, গাড়ি, শাড়ি, কড়ি, ঢেঁকি, কাঁচি ইত্যাদি।
১১। স্থানবাচক সকল শব্দের অন্তে আজকাল সানন্দে ি-কার ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন করাচি, কান্ডি, রাওয়ালপিন্ডি, দিল্লি, চিলি, মালি, নাগাসাকি, পিকিং, হেলসিংকি ইত্যাদি। আমাদের দেশেও এইসব শব্দের অন্তে সাগ্রহে ি-কার ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন মহাখালি, নোয়াখালি, ধানমন্ডি, ফেনি, রাজবাড়ি, ঝালকাঠি, নলসিটি ইত্যাদি। এটা শুভ লক্ষণ। স্থানবাচক শব্দের শুধু অন্তে নয়, আদিতে ও মধ্যে সর্বত্রই ি-কার ব্যবহৃত হয়। যেমন সান্তিয়াগো, হো চিমিন সিটি, চিন, ব্রিস্টল, মতিঝিল, গচিহাটা ইত্যাদি। এইসব স্থানে ি-কার ব্যবহার করলে ধ্বনি কোমল থাকবে, শুনতে ভাল লাগবে, দেখতে সুন্দর ও লিখতে সহজ হবে।
১২। বিশেষণবাচক শব্দের অন্তে আজকাল ী-কার ব্যবহার ব্যাপক হারে কমে গেছে। ি-কার ব্যবহারের হিড়িক পড়ে গিয়েছে। আধুনিক লেখকদের নিবন্ধে, প্রায় সকল সংবাদপত্রের সংবাদের শিরোনামের দিকে লক্ষ্য করলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। যেমন দেশি, বিদেশি, বেশি, খুশি, সরকারি, কারিগরি, কর্মচারি, বহুমুখি ইত্যাদি। তবে ব্যাংকগুলির নামের অন্তে পূর্ব হতেই সরকারিভাবে ী-কার আছে বলেই ‘সোনালী’, ‘রূপালী’, শব্দগুলিতে ি- কার ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সোনালি, রূপালি, ও পূবালি লিখতে পারলে সুন্দর হত।
১৩। কতিপয় বাংলা শব্দের অন্তে ী-কার হয়। আবার ঐ সকল শব্দ পরিবর্তিত অবস্থানে ী-কার বর্জন করে ি-কার অর্জন করে। যেমন প্রতিযোগী, সহযোগী, স্থায়ী, প্রাণী, মন্ত্রী ইত্যাদি শব্দগুলি ী-কার হারিয়ে হয় প্রতিযোগিতা, সহযোগিতা, স্থায়িত্ব, প্রাণিবিদ্যা বা প্রাণিবাচক, মন্ত্রিসভা। মূল শব্দে ী-কারের পরিবর্তে ি-কার আনা যায় কিনা তা এখনই ভেবে দেখা দরকার। ‘জাতি’ কি করে ‘জাতীয়’ হয় তার ব্যাখ্যা কোথাও পাই না।
১৪। শব্দটি কিন্তু ‘কম্পানি’। আমরা লিখি ‘কোম্পানী’। আর একটি শব্দ ‘ফটোগ্রাফী’। এটিও ভুল, হবে ‘ফটোগ্রাফি’। ‘ফোন’ যেইভাবে উচ্চারিত হয় সেইভাবে। একটি মজার নিয়ম আছে যা সকলেই অনুসরণ করেন। কিন্তু এটাই যে নিয়ম তা হয়ত অনেকেই জানেন না।
বাংলায় ব্যবহৃত সকল বিদেশি শব্দের আদিতে, মধ্যে ও অন্তে কখনও ী-কার হয় না। বিদেশি হলেই শব্দটিতে কেবল ি-কার হবে। ছাত্র ছাত্রীদের এই নিয়মটি সহজ বলে সহজেই মনে থাকবে। যেমন মিলিটারি, আর্টিলারি, ইস্টার্ন, স্ট্রিট, লিমিটেড, কম্পানি, জিওগ্রাফি, ফোটোগ্রাফি, প্যাথলজি (শব্দশেষে যত-জি আছে)। ডিকশনারি , জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, প্রাইমারি, লাইব্রেরি, ব্যাটারি, নোটারি, নার্সারি, গ্যালারি, জুয়েলারি, কনফেকশনারি, সার্জারি, লটারি, ল্যাবরেটরি (শব্দের শেষে যত রি আছে)। এজেনসি, ফার্মাসি, কোতোয়ালি, অ্যাভিনিউ, অ্যাকাডেমি ইত্যাদি।
১৫। ইংরেজী অনেক শব্দের বাংলায় ‘অ্যা’ হয়। যেমন অ্যাসিড, অ্যাপোলো, অ্যাপেক্স, অ্যারোম্যাটিক, অ্যান্ড, অ্যানজেলিক, অ্যানাটমি, অ্যাস্ট্রলজি, অ্যাডভোকেট, অ্যাকাউন্টস, অ্যাকাডেমি, অ্যাভিনিউ ইত্যাদি।
১৬। বাংলায় বিদেশি শব্দ লিখতে ৃ-কার কখনও ব্যবহৃত হবে না। যেমন ব্রিষ্টল, ব্রিসবেন, ব্রিটিশ, ব্রিটেন, খ্রিস্টাব্দ, ফ্রি, প্রিটোরিয়া, গ্রিনল্যান্ড ইত্যাদি।
১৭। ইংরেজি ‘S’ বা ‘SS’ র স্থলে বাংলায় কেবলই ‘স’ হয়। যেমন স্টেশন, মাস্টার, স্টোর, স্টোন, ক্লাস, গ্লাস ইত্যাদি। দুইটি শব্দ ব্যতিক্রম আছে। শুগার ও ইশ্যু লিখতে ‘শ’ হবে।
১৮। যে সকল ইংরেজি শব্দের শেষে ‘CE’ আছে সেই সকল শব্দ শেষে বাংলায় অবশ্যই ‘স’ হবে । এটি ব্যাকরণের বিধান। যেমন পুলিস, নোটিস, অফিস, জাষ্টিস ইত্যাদি ।
১৯। বিদেশী শব্দ লিখতে ‘ষ’ ও ‘ণ’ বর্ণ দুইটি ব্যবহার করা যায় না। যেমন পোষ্ট হবে পোস্ট, ইষ্টার্ণ হবে ইস্টার্ন, হর্ণ হবে হর্ন, মডার্ণ হবে মডার্ন, কর্ণার হবে কর্নার, কর্ণেল হবে কর্নেল ইত্যাদি।
২০। ইংরেজি ST-র স্থলে বাংলায় কেবলই ‘স্ট’ হয়। যেমন স্টাফ, স্টার, অগাস্ট, স্টুডিও ফোটোস্ট্যাট ইত্যাদি।
২১। শহরের প্রায় সাইনবোর্ডগুলিতে ভুল বানানে অনেক শব্দ দেখতে পাওয়া যায়। শব্দগুলির শুদ্ধ বানান হবে স্টুডিও, স্টোর, স্টেশন, হর্ন, কর্নার, কর্নেল, অগাস্ট, ফোটোস্ট্যাট, অ্যাডভোকেট, অ্যাভিনিউ, অ্যাকাডেমি, কোতোয়ালি, পুলিস ইত্যাদি। শুদ্ধ বানানে এই সকল শব্দ লিখলে ভাষার প্রতি আমাদের ভালবাসাই প্রকাশ পাবে।
বাংলা ভাষাকে আরবি এবং পরে ইংরেজী বর্ণমালায় লিখবার এমনকি মাতৃভাষার উপর গুলি চালাবার নির্মম আদেশ এসেছিল বর্ধমান হাউজ হতে। পশ্চিমা শাসকবর্গের সেই চেষ্টা সফল হয় নাই। পরবর্তিতে বাঙালি সংস্কৃতির ও ভাষার উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যেই জন্ম হয়েছিল 'বাংলা একাডেমী'র। সেই বর্ধমান হাউজই হচ্ছে আজকের বাংলা অ্যাকাডেমির সকল কর্মকান্ডের পাদপীঠ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে, তাদের প্রকাশিত অভিধানগুলিতে অনেক বানান ভুল দেখতে পাওয়া যায়। সময়ের সাথে মিল রেখে ভাষাকে বৈজ্ঞানিক ভাবে ব্যাকরণ-নির্ভরশীল করে তুলবার কোন পদক্ষেপ এখনও নেয়া হয় নাই। আমাদের বিরাট ভলিউমের ব্যাকরণ বই ও অভিধানগুলি বহু বৎসর পর পর কেবল পুনর্মুদ্রিত হয়, কখনও সম্পাদিত হয় না। রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘আমাদের স্কুল-কলেজগুলোতে ট্রাম চলে, মন চলে না’। সেই কথাগুলি এখন আমাদের বেলায় খাটছে। আমরা সুন্দর টাই পরে, বঙ্গবন্ধুর দেওয়া উদীয়মান রক্তিম সূর্যখচিত সবুজ পতাকা লাগিয়ে ‘বাংলা একাডেমী’-তে অনুপ্রবেশ করি, বাংলা অ্যাকাডেমিতে প্রবেশ করতে আমাদের মন চায় না। দুই তিন বৎসর পরপর বাংলা অ্যাকাডেমির প্রশাসনে পরিবর্তন আসে। এইবারও এসেছে। ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, স্বদেশের বিশিষ্ট লেখক এবং পত্রিকা সম্পাদকের সাথে পরামর্শ করে বাংলাভাষা উন্নয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। বাংলা অ্যাকাডেমির বর্তমান কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে জাতি একটি যুক্তিসংগত বাংলা ব্যাকরণ এবং একটি ব্যাকরণসম্মত আধুনিক অভিধান উপহার পেতে পারে। তখন এই কথা কেউ বলতে পারবে না যে, ভাষার প্রতি আমাদের আদর নাই। ভাষার প্রতি ভালবাসা দেখালে কে না খুশি হবে?
***


কবিতার মোহময় ভুবন

 সাগর জামান


আসাদ চৌধুরী ষাট দশকের অন্যতম প্রধান কবি। সামাজিক পরিপার্শ্ব তাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করে।সাহিত্যের সব শাখাতেই তাঁর পদচারণা। মনোগ্রাহী টেলিভিশন উপস্থাপনা ও দরাজ কণ্ঠের অনবদ্য আবৃত্তির জন্য তিনি সমধিক জনপ্রিয়। ষাটের দশকের নিজস্ব ভাষা ভঙ্গি থেকে তিনি নিজেকে আলাদা করতে পেরেছেন। খুব সহজে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছেন। প্রচলিত ধারার বাইরে থেকে সাহিত্য ভুবনে তার সদাপট বিচরণ। ছোটবেলায় তিনি প্রচুর কবিতা পড়তেন। স্কুলের অনুষ্ঠানে অনেক ছড়া, কবিতা পড়েছেন। পেট্রিস লুলুম্বার মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে তিনি কবিতা লেখেন,এটা ছিলো তাঁর দ্বিতীয় কবিতা। সময়টা ছিলো পঞ্চাশ দশকের শেষের দিকে। আসাদ চৌধুরীর ভাই "চিত্রাকাশ" নামেরএকটা পত্রিকা চালাতেন । ক্লাস লাইনে পড়ার সময় আসাদ চৌধুরীর উপলব্ধি হলো তিনি কবিতা লিখতে পারেন,লিখলেন একটা কবিতা। এটা ছিলো তাঁর প্রথম কবিতা। কবিতা লেখার শুরুর গল্পটা তাঁর এরকম। কবিতা ছাড়াও তিনি বেশ কিছু শিশুতোষ গ্রন্থ, ছড়া, জীবনী ইত্যাদি রচনা করেছেন। কিছু অণুবাদকর্মও তিনি সম্পাদন করেছেন। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে তার রচিত "বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ" শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ।তার কবিতা গীতিময় এবং ছন্দোদ্ভাসিত। তার ব্যঙ্গার্থক কবিতা 'সত্য ফেরারী' একটি জনপ্রিয় পদ্য। সভ্যতার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি গত কয়েক দশকে মানবিক মূল্যবোধের যে করুণ অধঃপতন, তারই প্রেক্ষাপটে একটি কবিতায় তিনি আক্ষেপ করেছেন ঃ কোথায় পালালো সত্য? দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেইতো রেষ্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে, গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে, টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে, নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো। গুড়ের কলসি, বিষের কৌটো, চিনির বয়াম, বাজারের ব্যাগ, সিগারেট কেস, পানের ডিব্বা, জর্দার শিশি, লক্ষ্মীর সরা, নকশী পাতিল, চৌকির তলা, সবি খুঁজলাম, খুঁজে দেখলাম নেই তো! সাংবাদিকের কাঠের ডেস্কে, কাগজে, কেতাবে, পুঁথিতে, কলমে, ইনজেকশনে, দাঁদের মলমে, ভ্যানিটি ব্যাগে বা পকেটে, আঁচলে ড্রয়ারে, ব্যাংকে, আয়রণ সেফে সত্য নামক মহান বস্তু নেই তো! কবিতায় নেই, সঙ্গীতে নেই রমণীর চারু ভঙ্গিতে নেই পাগলের গাঢ় প্রলাপেও নেই নাটকের কোন সংলাপে নেই শাসনেও নেই, ভাষণে নেই আঁধারেও নেই, আলোতেও নেই রেখাতেও নেই, লেখাতেও নেই, উত্তরে নেই, প্রশ্নেও নেই লেবাসে নেই, সিলেবাসে নেই পারমিটে নেই, বোনাসেও নেই হতাশায় নেই, আশাতেও নেই প্রেম-প্রীতি ভালবাসাতেও নেই এমন কি কালোবাজারেও নেই কোথায় গেলেন সত্য? তিনি সফলভাবে নিজস্ব ভাষাভঙ্গি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রকৃতি প্রেম সামাজিক অবস্থান তাঁর কবিতার বিষয় আশয়। তাঁর লক্ষ্য ছিলো পুরনো ধারায় না লেখার। নতুন ধারায় লেখার প্রবণতা থেকে তাঁর ভাষা ভঙ্গির উন্মেষ ঘটে। তিনি এগিয়ে যান নতুন ধারার পথে। নগরে বাস করার অর্থ যদি নাগরিক কবি হওয়া হয়, তাহলে তিনি নাগরিক কবিও বটে। তাঁর মধ্যে নগরের পাশাপাশি চর থাকে,গ্রাম থাকে নদী থাকে। তিনি নাগরিক জীবনের সঙ্গে গ্রামীণ জীবন সংস্কৃতিকে একাত্ম করেছেন । সহজবোধ্য শব্দ চয়নের পাশাপাশি সরল বাক্য গঠন তাঁর কবিতায় দেখতে পাওয়া যায়। এটা তাঁর নিজস্বতা হলেও তাঁর ভক্ত পাঠক শ্রোতা সবাই তাঁর বক্তব্য বুঝতে পারেন খুব সহজে,পাঠকদের কাছে সহজবোধ্য হয়, তিনি যা বলতে চান। আসাদ ধৌধুরী আন্তরিকভাবেএটাই চেয়েছেন সবসময় যে তাঁর লেখা সবাই পড়ুক,বুঝুক। তবে তিনি ইচ্ছে করে সহজভাবে লেখেন না। যা আসে ভেতর থেকে তিনি সেভাবেই লেখেন। তিনি তৈরি করেন না,যা আসে,যেভাবে আসে সেভাবেই লেখেন।সেভাবেই তাইই লেখেন। বানান না কিছু। কিন্তু কখনো কখনো তিনি কবিতার জন্যে কঠিন শব্দের প্রয়োজন বোধ করেন । প্রয়োজন হলে তিনি কঠিন শব্দ প্রয়োগ করেন নির্দ্বিধায়। তবে সরলতার জন্য লেখেন না। কবিতার নতুন নতুন নীরিক্ষায় নিমগ্ন থাকেন তিনি। তাঁর অনেকদিনের চেষ্টা মন্ত্র, লোককাহিনী,লোকগীতি সংগ্রহ করার। শুধু এদেশের নয়,বিদেশেরও। সেকারণেই বোধ হয় আসাদ চৌধুরীকে বলা হয় শেকড় সন্ধানী কবি। তার কবিতায় নীরিক্ষা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ষাটের দশকের অন্য কবিদের থেকে তাকে সহজেই আলাদা করা যায়। ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে অবস্থান করেও তিনি দৃষ্টিপাত করেছেন লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতির অন্তর্গত বাউল জারি সারি লালন মুর্শিদ মাইজভারী প্রভৃতির দিকে। তিনি কখনো অব্যাহতভাবে কবিতা লেখেন,কখনো বিরতি দেন। আবার লেখেন। আমাদের দেশে শ্রেণী সংগ্রাম প্রবল মধ্যবিত্ত মধ্যবিত্তের শত্রু। নিম্ববিত্ত নিম্ববিত্তের শত্রু। বুর্জোয়া শ্রেণীতো আছেই। এর মধ্যে তাঁর বিবেচনায় তাঁর দর্শনে 'বুর্জোয়া ' এই শব্দটি এই সমাজ গ্রহণ করে না। তিনি মনে করেন, সমাজে যে অর্থে শ্রেণী বিভাগ,শ্রণী সচেতনতা তা আগেও ছিলো এখনো আছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে সহজ ভাষায় বুর্জোয়া শব্দটি ব্যবহার করা হয় পশ্চিমা ভঙ্গিতে। এগুলো আমাদের সমাজ এক্সজিট করে না। আমাদের সমাজে এক পুরুষে কোটিপতি,ওয়ান জেনারেশন কোটিপতি। তাদের মধ্যে বুর্জোয়া স্বভাবের কেউ থাকার কথা না। এমন প্রতিক্রিয়া তিনি ব্যক্ত করেন। তিনি সৃজন স্বপ্নের ভেলায় ভেসে বেড়ান। তার স্মৃতিপটে প্রথম কবি প্রথম বিদ্রোহীর ছবি দুলে ওঠে। তিনি উচ্চারণ করেন ঃ মাত্র পা রেখেছ কলেজে সেই বার, শব্দ দিয়ে গাঁথো পূর্ব সীমান্তে সাহসী 'সীমান্ত'। দ্বিজাতিতত্ত্বের লোমশ কালো থাবা শ্যামল সুন্দর সোনার বাংলাকে করেছে তছনছ, গ্রাম ও জনপদে ভীতির সংসার, কেবল হাহাকার। টেবিলে মোমবাতি কোমল কাঁপা আলো বাহিরে বৃষ্টির সুরেলা রিমঝিম_ স্মৃতির জানালায় তোমার মৃদু টোকা। রূপার সংসারে অতিথি সজ্জন শিল্পী কতজন হিসেব রাখিনি তো! স্মরণে ওস্তাদ_ গানের মমতাজ। দারুণ উচ্ছ্বাস, সামনে চা'র কাপ প্রধান অতিথি তো আপনি, বলবেন_ কিন্তু তার আগে এ ঘোর বরষায় সমানে বলছেন নিজের সব কথা। ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউটে ভাষণ, প্রতিবাদ_ যাত্রা, থিয়েটার রমেশ শীল আর আবুল ফজলের, কলিম শরাফীর সাহসী আচরণ কী হলো? কী হয়েছে? আজ তো আপনার মুখে যে খৈ ফোটে! স্বপ্ন-স্মৃতি দোলে। আসাদ চৌধুরী মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি তাঁকে আলোড়িত করে। প্রক্ষাপট ভিন্ন যেখানে মানুষ মরতে যায়,এখন সেখানে মানুষ স্বার্থপর। নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার জন্যে মানুষ মরতে গিয়েছিলো।দেশের জন্য, দেশের সংস্কৃতির জন্য,দেশের সাহিত্যের জন্য,দেশের মঙ্গলের জন্য। দেশের মানুষের ভালো হবে,শোষণ বঞ্চনার অবসান হবে এই ভেবে। যারা গণহত্যা করেছে,লুটপাট করেছে,গণধর্ষণ করেছে,অগ্নি সংযোগ করেছে। প্রতিদিন মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে তাদেরকে শাস্তি দেবে, বিচার হবে। এসব মানুষের স্বপ্ন ছিলো। প্রচণ্ড দুঃস্বপ্নের মধ্যে তারা স্বপ্ন দেখেছে। গোটা জাতির জন্য এটা বড়ো ব্যাপার। নিকোলাস, কিউবার কবি,তিনি বলেছিলেন 'সাবধান মানুষ স্বপ্ন দেখছে'। একাত্তর সালে মানুষ স্বপ্ন দেখতেন, এখন দেখেন না। তরুণরা বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। দেশের জন্য বড় ত্যাগের স্বপ্ন এখন নেই। একাত্তর সালে ছিলো।এমন ভাবনা থেকে তিনি উচ্চারণ করেন ঃ নদীর জলে আগুন ছিল আগুন ছিল বৃষ্টিতে আগুন ছিল বীরাঙ্গনার উদাস করা দৃষ্টিতে। আগুন ছিল গানের সুরে আগুন ছিল কাব্যে, মরার চোখে আগুন ছিল এ কথা কে ভাববে ? কুকুর-বেড়াল থাবা হাঁকায় ফোঁসে সাপের ফণা শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায় জ্বলে বালির কণা। আগুন ছিল মুক্তিসেনার স্বপ্ন-ঢলের বন্যায়- প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে কাঁপছিল সব অন্যায়। এখন এসব স্বপ্নকথা দূরের শোনা গল্প, তখন সত্যি মানুষ ছিলাম এখন আছি অল্প। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালী জাতির সব থেকে বড় গৌরবদীপ্ত ঘটনা। একাত্তরে জাতিগত অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বাঙালীরা পাকিস্তানী হায়েনাদের বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধে অংশ নেয়। এবং অনেক রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করে স্বাধীনতা। গৌরবময় এই অর্জন যেমন আনন্দের তেমন বেদনার। মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িয়ে আছে বিজয়গাঁথার পাশাপাশি নির্যাতন নিপীড়ন গণহত্যার বীভৎসতা। স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবকে ধরে রাখার জন্য ষাটের দশকের কবিরা তাদের কবিতার মাধ্যমে বাঙালী সত্তার পরিচয়ের অনন্য এই সময়কে কবিতাবদ্ধ করেছেন নানা ব্যঞ্জনায়। আসাদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের দীপ্ত চেতনায় করুণ কথকতা তুলে ধরে তার অনুভূতি ব্যক্ত করে হিরণ্ময় আহ্বান জানান তার শব্দমালায় ঃ বারবারা এসো, রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুমূর্ষু মানবতাকে গাই বিবেকের জংধরা দরোজায় প্রবল করাঘাত করি অন্যায়ের বিপুল হিমালয় দেখে এসে ক্রুদ্ধ হই, সংগঠিত হই জল্লাদের শাণিত অস্ত্র সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে আহত করার পূর্বে, দর্শন ও সাহিত্যকে হত্যা করার পূর্বে এসো বারবারা বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে। কবিতার ভবিষ্যত নিয়ে অনেকে হতাশ হলেও আসাদ চৌধুরীকে কখনো হতাশাগ্রস্ত হতে দেখা যায় না। আশাবাদী তিনি সবসময়। তিনি আকালকে স্বীকার করার পাশাপাশি মনে করেন বাংলা কবিতায় শুধু নয়,গোটা পৃথিবীতে কবিতা যেন ফ্যাকাশে,রক্তহীন। কবিতা ছকের মধ্যে চলে আসছে। ছক থেকে বের হতে পারছে না। এরকম ব্যাপার বেশিদিন থাকবে বল মনে হচ্ছে না। নতুন কবিরা আসবে,ঠিক করবে সব। রবীন্দ্রনাথের পর কত বছর রবীন্দ্র অনুসরণ চলেছে। এখনো চলছে। মফস্বলে এখনো কতজন চব্বিশ পঁচিশ বছরের ছেলেরা রবীন্দ্রনাথের গানের ভঙ্গিতে কবিতা লেখেন। আবার পরিবর্তন আসবে গোটা কবিতাই,বাংলা কবিতাইতো বটেই।আসাদ চৌধুরীর কাছে পাঠকরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আসাদ চৌধুরী মনে করেন পাঠকরা এক অর্থে হচ্ছে,মূল পেট্রোন। পাঠকরা শুধু জমি দিয়ে দেবে,বাড়ি, গাড়ি করে দেবে, ঝাকায় ঝাকায় মাছ মাংস পাঠাবে কবির বাড়িতে এটা ঠিক না।পাঠক যদি কবিতার বই কেনে কবিতার রয়েলিটি কবি পাবে। পাঠকরা কবিতার প্রাণ।পাঠকদের কাছে তিনি ধৈর্য্য, ও সহনশীলতা প্রত্যাশা করেন ।