লে. কর্নেল অব. ডা. হাফিজ আহমেদ
একুশ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২।
বিকেল বেলা। শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। সরকারি আদেশ উপেক্ষা করে
ছাত্ররা চতুর্দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে রশিদ বিল্ডিং এর কাছ দিয়ে, খন্ড
খন্ড মিসিল নিয়ে এগিয়ে চলেছে। পোগোজ হস্টেল থেকে আমরা ক’জন ছাত্র ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মুখ দিয়ে এসে বর্তমান মেডিক্যাল কলেজের সামনে মিসিলে
অংশ নিলাম। বর্তমানে যেখানে শহিদ মিনার, সেখানে ছিল ব্যারাক। মেডিক্যাল
কলেজের ছাত্ররা সেখানে থাকতো। খন্ড খন্ড মিসিল একত্রে এসে, একটি বড়ো
মিসিলের রূপ নিল। স্লোগান ছিল, ' রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই '।
এরই মধ্যে পুলিস-এর গাড়ি এসে মিসিলের উপর টিয়ার গ্যাস ছুড়তে শুরু করলো। আমি
চোখে রুমাল (সবুজ রং-এর) ধরে ব্যারাকের দিকে যেতে চেষ্টা করলাম। কয়েক
মিনিটের মধ্যেই গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমরা মাটিতে শুয়ে পড়লাম। তখন
দেখি একজনের মাথা ও শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে। বোধহয় ছাত্র
হবে। গুলি খেয়ে পড়ে গিয়ে ছটফট করছে। আমার হাতের সবুজ রুমাল দিয়ে ছাত্রটির
গায়ের রক্ত মুছে দেবার চেষ্টা করলাম। রক্ত বন্ধ হয়না। তার গায়ের রক্ত এসে
আমার জামা কাপড়ে লাগলো। তারপরই ক’জন লোক এসে মৃতপ্রায় ছাত্রটিকে উঠিয়ে নিয়ে
গেল।
সবুজ ঘাসের উপর দেখলাম ছোপ ছোপ রক্তের বৃত্তাকার ছাপ। আজকে আমাদের স্বাধীন
বাংলাদেশের পতাকার যে রঙ, ঠিক তাই। তখন কে জানতো, এই ভাষা আন্দোলনই একদিন
স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ নেবে? কে জানতো, সবুজ ঘাসের উপর শহিদের রক্তের লাল
দাগ একদিন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় স্থান পাবে?
সেদিনের রক্ত মোছা সবুজ রুমাল,
হারিয়ে গেছে আজ কতকাল!
কিন্তু সবুজের বুকে লাল,
সে তো উড়বেই চিরকাল!
অবাক সূর্যোদয়
শিউলী জাহান
হালকা শীতল বাতাসে শরীরে কাঁপুনি খেলে গেল। দুধসাদা ভারী কাশ্মীরি শালটি
ভালো করে টেনে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে
উবু হয়ে তাকাতেই দেখলেন বর্ণ গাড়ি থেকে নামছে। একা। বুকের ভেতর থেকে ছোট্ট
একটি নিঃশ্বাস বা দীর্ঘনিঃশ্বাস নেমে এলো।
থরে থরে জমে থাকা বরফের আলোয় অন্ধকারেও কেমন উজ্জ্বল লাগছে চারিপাশ। বেশ
অদ্ভুত এক নীরবতা। কোথাও পাখির কুজন নেই।
কোনো পলাশ নেই, শিমুল ফুলের বুনো গন্ধ নেই। মনটা কেমন আনচান করে ওঠে।
মনে মনে ঠিক করে ফেলেন সামনের বছর ফেব্রুয়ারিতে দেশে যাবেন। হেলেন খুব
আপত্তি না করলে দু’মাস থাকবেন।
প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হেঁটে
হেঁটে ঘুরে বেড়াবেন।
একবার গ্রামের বাড়িতেও যাবেন। কালিগঙ্গা নদীর পাড় ধরে খালি পায়ে খুব করে
হাঁটবেন। মজা পাটের গন্ধ তাকে আজও ভীষণ টানে।
প্রতিটা গ্রামেরই একটি নিজস্ব গন্ধ আছে। কাছে গেলেই টের পাওয়া যায়।
ঘরের ভেতর থেকে মা-ছেলের টুকরো কথা কানে আসছে --
: আম্মা বুঝতে চেষ্টা করো, বাবার বয়স হয়েছে। শরীরও আজকাল ভালো যাচ্ছে না।
এই ঠান্ডায় বাইরে গেলে আরও খারাপ হতে পারে।
: বর্ণ, তোর বাবা যাবেই, অযথা কথা বাড়িয়ে কাজ নেই। তুই খেয়ে নে। আজ ভাঁপা
ইলিশ করেছি আর নারিকেল দিয়ে মুরগির মাংস। একটু দুধপুলিও করেছি।
: আজ আমি খেয়ে এসেছি মা। কাজ থেকে ফিরে খুব খিদে পেয়ে গিয়েছিল। আর ওরাও এই
ঠান্ডায় আসতে চাইলো না। তাই একসাথে খেয়ে নিলাম।
: আচ্ছা, তাহলে শুধু একটু দুধপুলি খা। ওরা আসেনি দেখলে তোর বাবা কষ্ট পাবে,
জানিস তো।
: ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে, এখন জোর তো করা যায় না।
হেলেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেদের ব্যর্থতাকেই দোষারোপ করেন। রান্নাঘর থেকে
দুটো শাদা কাপড়ের ব্যাগ এনে খাবার টেবিলে রাখেন।
সেখানে প্লাস্টিকের বাক্সে খাবার ভরা। সেদিকে তাকিয়ে বর্ণ জিজ্ঞেস করে,
: ফাল্গুনী কি আসবে মা? ওকে ফোন দিয়েছিলাম সাড়া পাইনি।
: হুম, ছোট করে উত্তর দিয়ে চকিতে বারান্দার দিকে তাকান হেলেন। এগিয়ে যান।
: তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছ? ভেতরে এসে কাপড় পরে নাও। বর্ণ এসেছে।
রায়হান ঘরে ঢুকতেই বর্ণ বলে ওঠে, বাবা, আপনার এখন বয়স হয়েছে। বাইরে কী
ঠান্ডা বাতাস!
আর আপনি এই একটি শাল গায়ে এতোক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন?
ছেলের শাসন দেখে হাসেন তিনি। বর্ণের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ওরা বুঝি
এবারও যাবে না?
: মিলির একটু ঠান্ডা লেগেছে। আর প্রীতম আর প্রেমাও...
রায়হান হাত তুলে ছেলেকে থামিয়ে দিলেন। বুকের ভেতর থেকে যদি ভালোবাসা জমাট
না বাঁধে, একটু উত্তপ্ত হাওয়াতেই তা গলে যায়।
জোর করে হয় না। ওদের ভেতর নিজে থেকেই জমাট বাঁধতে দাও। তোমারও যদি আজকাল
ইচ্ছে না হয়...তোমার মা আর আমিই...
: আমি তো আমার দায়িত্ব পালন করছি বাবা।
একঝলক দমকা বাতাসের মতো রায়হান বলে ওঠেন, এ শুধু দায়িত্বের বিষয় নয় রে
বাপ্, আরও অনেক বেশি কিছু...আরও গভীর কিছু...এ আমাদের প্রথম পরিচয়।
গাড়িতে যেতে যেতে তার সমস্ত শরীর ও মনে কেমন বিষাদের কালো ডানা মেলে দিলো।
লোহাতে যেমন মরচে ধরে এবং ক্ষয়ে ক্ষয়ে একসময় ভেঙে পড়ে,
তার ভেতরের কঠিন মনটিও আর একভাবে থাকছে না। মেয়েটির মুখখানা বন্ধ চোখের
পাতায় বার বার ভেসে উঠছে।
বড় আদরের মেয়ে, অথচ আজ পাঁচটি বছর হয়ে গেল ওদের সাথে দেখা করেননি। তার
কষ্টটা কোথায় মেয়েটি কেন বুঝতে পারলো না?
এতো বুদ্ধিমতী মেয়ে আমার! শেষে কিনা একজন পাকিস্তানি ছেলেকেই পছন্দ করে
বসলো! তার সামনে বসে উর্দুতে তাকে ডাকবে,
পাকিস্তান সরকার নিয়ে কথা বলবে, তার জয়গান গাইবে..! কী করে মেনে নেবেন?
ভুলটা কোথায়? কার ভুল? কালিগঙ্গা নদীতে লাশের মিছিল, দাউ দাউ আগুনে জ্বলছে
গ্রামের পর গ্রাম, ভয়ার্ত মানুষের আর্তনাদ, পাকিস্তানি সৈন্যদের
নারকীয় চিৎকার, কাদাজলে মেখে হাতে অস্ত্র নিয়ে ভয়ানক সেইসব
দিন-রাত্রি...একটি যুদ্ধ। কী করে ভুলবেন এইসব স্মৃতি!
বুকে তীব্র ব্যথায় তার শ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়, গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে
দেন। শীতল বাতাসে চোখ ভিজে আসে। রাস্তার দু'পাশের জমিয়ে রাখা
বরফের উঁচু উঁচু ঢিবি। গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে বলেন,
“বাংলা মায়ের স্নিগ্ধ কোলে,
ঘুমিয়ে রব আমি!
বাংলা আমার মাতৃভাষা
বাংলা জন্মভূমি!”
হেলেন রায়হানের অস্থিরতা টের পান। তিনি রায়হানের বাম হাতটি তার হাতে নিয়ে
আলতো করে জড়িয়ে রাখেন।
: বাবা, ফয়সাল ছেলেটি কিন্তু ভালো। হি ইজ ব্রিলিয়ান্ট এন্ড এ পোলাইট
জেন্টলম্যান। ওর কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।
ড্রাইভিং সিট থেকে মাথা ঘুরিয়ে বাবার মুখের দিকে একটু তাকিয়ে বর্ণ আবার
বলে, আম্মা, তুমি কি বাবাকে বলেছ, ফয়সাল আমেরিকা থেকে
ফিরে ইউ এফ টি-তে জয়েন করেছে?
হেলেন কিছু না বলে আরেক হাতে খুব নীরবে চোখ মুছে নেন।
ড্যানফোর্থ এলাকায় আসতেই গাড়ির ভিড় বেড়ে গেল। দূরত্ব যত কমে আসছে, সম্মিলিত
কণ্ঠস্বর তত জোড়ালো হচ্ছে – “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…”
হালকাভাবে তুষার পড়ছে। ঠান্ডা বাতাসে নাকের ডগায় জ্বলছে। খুব দুর্বল বোধ
করছেন। তবুও হেলেনের দেওয়া ফুলের তোড়াটি শক্ত করে
চেপে ধরে সবার মাঝেই লাইন ধরে দাঁড়িয়েছেন। পাশে হেলেনের দিকে তাকান। কালো
শালে ঘিরে রাখা মুখটি কী শান্ত ও দৃঢ়! তিনি হাত বাড়িয়ে
হেলেনকে আরেকটু কাছে টেনে নেন। একটু অবাক হয়ে হেলেন রায়হানের মুখের দিকে
তাকায়!
সামনের দলটি গেলেই তারা যাবেন শহীদ মিনার চত্বরে। চারিপাশে সব পরিচিতজন।
সমবেত কণ্ঠে কেউ গাইছে, কেউ শ্লোগান দিচ্ছে। এই সময়ে
সবার জ্বলজ্বলে চোখ-মুখ দেখে রায়হানের ভেতরে পদ্মার স্রোতের মতো উত্তেজনা
বয়ে যায়। ভালো লাগে খুব। সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে।
হঠাৎ কাঁধে একটু চাপ পড়ে।
: বাবা, আমি, ফয়সাল। আমাদের... ক্ষমা করে দিন।
চমকে তাকাতেই দেখতে পান ঠান্ডায় লাল হয়ে যাওয়া সুদর্শন একটি মুখ তার পাশে
এসে দাঁড়িয়েছে। তার আরেক হাতে একগুচ্ছ ফুল। ফাল্গুনী দু’বছরের অক্ষরকে
কোলে নিয়ে হেলেনকে জড়িয়ে ধরে আছে। অক্ষর তার দিকে হাতের ফুলটি এগিয়ে দিয়ে
বলে, না না, নাও...যেন একটি অবাক সূর্য জ্বলছে অক্ষরের কচিহাতের মুঠোয়।
রায়হানের চোখ আর কোনো বাঁধন মানে না। প্রচণ্ড ঝড়ের আঘাতে দুলে ওঠা
বটবৃক্ষের মত টলে ওঠেন তিনি। ফয়সাল শ্বশুরকে দু’হাতে ধরে ফেলে।
পেছন থেকে তাড়া আসে এগিয়ে যাবার। ওরা ছয়জন ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় শহীদ
মিনারের পাদদেশে।
ফারজানা আক্তার
' আজকে একটু বেশি সময় থাকলে তোমার সমস্যা হবে? '
' কেন ম্যাডাম? কোন কাম আছে? '
'হ্যাঁ! তোমার স্যার কিছু মাছ পাঠাবে। ও একটা কাজে আটকে গেছে। তাই দেরি
হচ্ছে। '
'ফুলির আব্বারে আগে জিগাই লই ম্যাডাম। হেই অনুমতি দিলে তারপর থাকুম। '
নিশা অবাক হয়ে সালমার দিকে তাকালো। সালমা ওর বাসায় কাজ করে ছয় মাস ধরে।
মেয়েটা খুব ভালো আর কাজ করে খুব গুছিয়ে। সাধারণত ছুটা বুয়াদের কাজ এতো
গুছানো হয় না।
সালমা কাজ করেও পরিষ্কার পরিছন্নভাবে। আগে যতজন ছুটা বুয়া ছিলো কেউ চুরি
করতো, কেউ অপরিষ্কার, কেউ সময়মতো আসতো না ইত্যাদি। সালমার এমন কোন সমস্যা
নেই। সময়মত আসে, ঠিকঠাক কাজ করে চলে যায়। কথা বলে খুব কম। প্রয়োজন ছাড়া কোন
কথা বলে না।
সালমার আগে যে কাজে ছিলো ওই ছুটা বুয়া খুব নোংরা ছিলো। ওকে দিয়ে দুইদিন কাজ
করিয়ে নিশা পুরো মাসের বেতন দিয়ে বিদায় করে দিয়েছে। তারপর নিজেই কয়েকদিন
ঘরের কাজ করেছে। অনভ্যস্ত হাতে নিশা খুব একটা গুছিয়ে উঠতে পারে নি। সাথে
৩বছরের একমাত্র মেয়ে খুব বিরক্ত করে।
তাছাড়া নিশা অসুস্থ থাকে একটু বেশিই। দারোয়ানকে বলে রেখেছিলো যেভাবেই হোক
দ্রুত একজন ছুটা বুয়া জোগাড় করে দিতে। দারোয়ান তার এক বোনের মাধ্যমে সালমার
খোঁজ পায়। তারপর সরাসরি সালমার সাথে নিশার পরিচয় করিয়ে দেয়। পরদিন থেকেই
সালমা নিশার বাসায় কাজ করে। নিশা সালমার কাজে, ব্যবহারে খুব খুশী।
'তোমার ফুলির আব্বা অনুমতি দিলো ?'
'জি ম্যাডাম!'
'সবকিছুতে ফুলির আব্বার অনুমতি নেওয়া লাগে ?'
' ফুলির আব্বাও তার হগল কামে আমার অনুমতি নেয়। আমিও আমার কামে হের অনুমতি
নেই। '
' তোমাদের বিয়ে হয়েছে কতবছর ? '
' পাঁচ বছর ম্যাডাম। '
' ফুলির বয়স কত ?'
'দুই বছর '
'ফুলি কার কাছে থাকে? '
'ফুলি তার আব্বার কাছে থাকে। '
'ফুলির আব্বা কোন কাজ করে না ?'
'ফুলির আব্বা অসুস্থ ম্যাডাম। '
নিশার খুব ইচ্ছে হলো সালমার জীবনের গল্প শোনার। কিন্তু হুট করে জিজ্ঞেস
করতে কেমন বিব্রত লাগছে তার। আর সালমাও এতো অল্প কথায় উত্তর দেয় নিশার মনে
হয় সালমা খুব বেশি কথা বলতে পছন্দ করে না। অথবা সে তার জীবনের গল্প হয়তো
বাহিরে কাউকে বলতে চায় না। এমন সময় ড্রাইভার মাছ নিয়ে হাজির হলো। অনেক গুলো
ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছে ড্রাইভার।
সালমা মাছ কাটতে বসলো। নিশার মনে হতে লাগলো এমনিতে আজকে সালমাকে আটকে
রেখেছে, আবার এতগুলো মাছ কাটতে ওর আরো অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাই সে নিজ থেকে
এগিয়ে গিয়ে বললো কিছু মাছ আস্ত ড্রিপ ফ্রিজে রেখে দিতে। পরদিন এসে কাটতে।
সালমা বললো তার সমস্যা হবে না। সে আজকেই কেটে যাবে।
নিশা একটা চেয়ার টেনে সালমার সামনে বসলো। নিজ থেকেই বললো সামনের সাপ্তাহে
তার একমাত্র মেয়ে তানিয়ার জন্মদিন। তানিয়ার বাবার অফিসে কিছু বিদেশী কলিগ
আছে।
তাদের জন্য দেশি খাবারের বিশাল আয়োজন করা হবে। আজকের ইলিশ মাছগুলো সেই
প্রোগামের জন্যই নিয়ে আসা। সালমা নিশার কথা শুনছে আর মাছ কাটছে। মাঝে মাঝে
নিশার কথার সাথে হ্যাঁ, হুম করছে।
'ফুলির বাবা কবে থেকে অসুস্থ ?'
'দেড় বছর হইয়া গেলো। '
'কী হয়েছে ফুলির বাবার?'
'রিক্সা চালাইতো। একসিডেন্ট করছিলো। প্রাইভেট কার ডাইন পায়ের উপর দিয়া গেছে
গা। ডাইন পায়ের অর্ধেক এখন নাই হের। '
'কি বলো! তোমার তো অনেক কষ্ট হয় এখন। সব সামাল দাও কিভাবে ?'
'ঘরের রান্নাবান্না ফুলির আব্বা কইরা রাখে। ফুলিরে রাখে। আমি আফনার বাসা
লইয়া ৪বাসায় কাম করি। বাসায় গিয়া কিছুক্ষন ঘুমাই। তারফর কোন কাম থাকলে করি।
তয় ঘরের কাম আমার করণ লাগে না। সব ফুলির আব্বা করে। ফুলিরেও রাখে। '
'বাহ্! ফুলির বাবা তো তোমাকে খুব যত্নে রাখে। '
'জি ম্যাডাম!'
নিশা হুট করে উঠে নিজের রুমে চলে গেলো। তানিয়া পেটে থাকতে একদিন রাতে তার
ঘুম আসছিলো না। খুব অশান্তি লাগছিলো। বিছানা থেকে উঠে সে কতক্ষন রুমে
পায়চারি করে। কিন্তু অশান্তি দূর হচ্ছিলো না। তখন সে আসাদকে আলতো করে ডাকে।
আসাদ চোখ খুলে খুব জোরে নিশাকে ধমক দিয়েছিলো আর বলেছিলো সারাদিন পরিশ্রম
করার পর এতরাতে নাটক দেখার সময় তার নেই। আসাদ বরাবরই একটু কেমন জানি! টাকা
ইনকাম করাই তার একমাত্র নেশা। পরিবারে আলাদা করে সময় দেওয়া, বৌ মেয়ের আলাদা
যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে বরাবরই তার অনীহা।
এই যে তানিয়ার জন্মদিন পালন করবে এটা তানিয়াকে ভালোবেসে না বা তানিয়া তার
একমাত্র মেয়ে এইজন্য নয়। অফিসে নিজের স্ট্যাটাস বজায় রাখার জন্য নিজের
মেয়ের জন্মদিন বড় করে পালন করছে। অফিসের কলিগদের জন্য সব আলাদা ব্যবস্থা
করেছে। বিয়ে করেছে, বাচ্চা নিতে হবে তাই আসাদ বাচ্চা নিয়েছে।
বাচ্চাকে আলাদা সময় দিতে হবে, বাচ্চার টানে ঘরে আসবে বা দিনে বাচ্চার খোঁজ
খবর নিবে এসব ব্যাপার আসাদের মধ্যে নেই। আসাদের মাথায় সারাক্ষণ ঘুরে টাকা
আর সমাজে, সংসারে, অফিসে তার স্ট্যাটাস কতটুকু বাড়লো বা বাড়ানো গেলো।
আসাদের এমন চিন্তা ভাবনা আর ব্যবহারে নিশার মনে অভিমান জমতে জমতে পাহাড় হয়ে
গিয়েছে। কিন্তু নিশা কখনো মুখ ফুটে এসব কথা বলে না। বিয়ের প্রথম প্রথম বলতো
কিন্তু যখন দেখলো আসাদের মধ্যে নিজেকে পরিবর্তন করার কোন লক্ষণ নেই তখন চুপ
হয়ে গেলো। উল্টা আসাদ নিজের খামখেয়ালিপনা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এইদিকে নিশা
নিজের আলাদা জগৎ বানিয়ে নিয়েছে।
কাউকে নিজের কথা বলে না। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু -বান্ধব সবাইকে এড়িয়ে চলে।
বাহিরে প্রয়োজন ছাড়া তেমন বের হয় না। আজকে সালমার কথা শুনে বহুদিনের জমানো
অভিমান কেমন উথলে উঠলো। হুট করে নিশার খুব কান্না পেলো।
ওর বিশাল বাসা টাকা পয়সা, ব্যাংক ব্যালান্স সব আছে কিন্তু পাশে বসে কাঁধে
হাত রাখার মানুষ নেই। অথচ সালমার এমন কিছুই নেই কিন্তু ভালোবাসার মানুষ
আছে। ঘরে কেউ একজন সালমার জন্য অপেক্ষা করে, সালমার কেয়ার করে, সালমার ভালো
মন্দের খেয়াল রাখে। এইদিক থেকে সালমা অনেক ধনী আর সে খুব গরীব।
নিশা দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হুট করে কেঁদে উঠলো। অনেক দিনের জমানো কান্না
একসাথে বের হয়ে আসলো। নিশা সমানে কেঁদে যাচ্ছে।
'ম্যাডাম! মাছের কাম শেষ। আমি এহন বাড়ি যামু। '
নিশা তাড়াহুড়া করে দুইহাত দিয়ে চোখ মুছে মুখ না ফিরিয়ে সালমাকে যেতে বললো।
সালমাও চলে গেলো। নিশা ধীরে সুস্থে উঠে দরজা লক করলো। তারপর ভাবলো বিয়ের
আগে আসাদ কেমন ছিলো আর বিয়ের পর কিভাবে এবং কতটা বদলে গেলো। কেউ অর্থনৈতিক
সচ্ছলতার জন্য লড়াই করে, আর কেউ একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য লড়াই করে।
'তোমারে এক ম্যাডামের কতা কইছিলাম না? আমার খুব পছন্দের ম্যাডাম। ওর একটা
মাইয়াও আছে আমাগো ফুলির মতো। তার জন্মদিন সামনের সাপ্তাহে। বিশাল আয়োজন
করতাছে তারা। '
'তাইলে তোমারও কাম বাড়লো। '
'হ! তাতো বারবোই। বিদেশী মেহমানও নাকি আইবো। তাগো লাইগ্যা দেশী খাবারের
আয়োজন করবো। আজকে মেলাডি ইলিশ মাছ আনছে। সব কাইটা দিয়া আইলাম। '
'আমি সুস্থ থাকলে আমাগো ফুলির জন্মদিনও বড় কইরা করতাম। তই আমরা দেশী না,
বিদেশী খাবারের আয়োজন করতাম। '
এই কথা শেষ করে জব্বার আর সালমা দুইজনই হেসে দিলো। জব্বার মন থেকে কথাটা
বললেও একটু মজার ছলে বলেছে। সালমা মজা ভেবেই হেসে দিয়েছে। সালমার হাসি দেখে
জব্বারও হেসে দিয়েছে। দুইজন আরো কিছুক্ষন নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা শেষ করে
ঘুমাতে গেলো।
'দেখো তো সালমা এই কালারটা কেমন লাগে? '
'রংটা সুন্দর। আফনারে মানাইছে। '
'ঠিক বলছো ?'
'জি ম্যাডাম! খুব সুন্দর লাগছে আফনারে। '
'তাহলে এই কালারটা ফাইনাল। তানিয়া আর ওর বাবার জন্যও একই কালারের আর
ডিজাইনের ড্রেস নিবো। '
'সবাই এক রংয়ের পোশাক পরবেন? '
'হ্যাঁ! ভালো হবে না বলো ?'
'জি ম্যাডাম!'
'আচ্ছা সালমা শোন! তোমাকে এই কয়দিন একটু বেশি সময় দিতে হবে। আরেকটা কথা
প্রোগ্রামের দিন ফুলি এবং ফুলির বাবাকে অবশ্যই নিয়ে আসবা। সপরিবারে তুমি
আমন্ত্রিত। '
'ম্যাডাম! আফনে আমাকে দাওয়াত দিলেন ?'
'হ্যাঁ! কেন ?'
'কত বাসায় কাম করি। কোনোদিনও কেউ এমন কইরা দাওয়াত দেয় নাই। '
'এসব কথা বাদ দাও। আনন্দের সময় আনন্দের কথা বলতে হয়। মন খারাপের কথা বাদ
দাও। '
সালমা চোখ মুছে হাসলো। তানিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করলো। সেদিনের মতো কাজ
শেষ করে বিদায় নিলো।
'যে ম্যাডামের মাইয়ার জন্মদিন ওই ম্যাডামে তোমারে আর আমাগো ফুলিরেও দাওয়াত
করছে। '
'সত্যি কইতাছো ? তোমার ম্যাডামের মন অনেক বড় মনে অইতাছে। '
'ম্যাডাম অনেক ভালা মনের মানুষ। হেই লাইগ্গা তো হেরে আমি অনেক পছন্দ করি।
আমার লগে কত সুন্দর কইরা কতা কয়। '
'তোমার ম্যাডামের মাইয়ার লাইগ্গা একটা সুন্দর উপহার কিনতে হইবো। '
'কি দেওন যায় কওতো! '
'মাইয়ার কি পছন্দ হেইডা তো তুমি জানবা ভালো। তুমি কাইল জাইনা আইয়ো। '
'আইচ্ছা!'
অনেকদিন জব্বার বাহিরে যায় না। তাই জব্বারের তেমন কোন নতুন ড্রেস নেই।
সালমা ভাবছে জব্বারের জন্য নতুন শার্ট, প্যান্ট কিনতে হবে। ফুলির জন্যও
নতুন একটা ফ্রক কিনবে। তার নিজেরও তো তেমন নতুন কিছু নেই।
গ্রাম থেকে আসার পর এই প্রথম তারা কোন দাওয়াতে যাবে । তাও এতো বড়লোকের
বাড়ির অনুষ্ঠানে। এইদিকে জব্বারও ভাবছে সালমার নতুন কোন পোশাক নেই। ওর জন্য
নতুন পোশাক কিনতে হবে। দুইজনেই দুইজনের জন্য ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলো।
পরেরদিন সালমা কাজ শেষ করে নিশার সামনে কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। সালমার
দাঁড়ানো দেখে নিশা জানতে চাইলো সালমা কিছু বলবে কিনা।
'ম্যাডাম! আমার একটা কাম কইরা দিবেন ?'
'কি কাজ?'
'কইতে ডর লাগতাছে। আফনে অন্য কিছু মনে করবেন নাতো ?'
'না না! তুমি বলো। কোন সমস্যা নেই। '
'আপনি নিজের জন্য, স্যারের জন্য আর মামনির জন্য এক রংয়ের পোশাক নিবেন না ?
তেমনি এক রংয়ের পোশাক আমার জন্য, ফুলির বাপের জন্য আর ফুলির জন্য কিন্না
দিতে পারবেন ? '
নিশা অবাক হয়ে সালমার দিকে তাকিয়ে আছে। নিশা পোশাকের দামের ব্যাপারে ভাবছে
না। ভাবছে সালমার শখের ব্যাপারে, সাধের ব্যাপারে।
'পারবো না কেন? অবশ্যই পারবো। তুমি ফুলি আর ফুলির বাবার মাপ জানো ?'
'কাল জাইন্না আমু। ম্যাডাম টাহা কত লাগবো?'
'টাকা নিয়ে তোমাকে এখন ভাবতে হবে না। পরে দিও '
'যহন ফুলির বাপে কামাই করতো তখন হেই প্রতিদিন কামে যাওয়ার আগে আমার হাতে
কিছু কিছু টাহা দিয়া যাইতো। আমি হেই টাহা সব জমাই রাখছি। এহন প্রতি মাসেও
কিছু টাহা আলাদা করে রাহি। এই টাহা জমাইতেছিলাম ফুলির কানের সোনার জিনিসের
লাইগ্গা। ফুলি জন্ম নেওয়ার কয়েকমাস পরেই ফুলির বাপের দুর্ঘটনা ঘটে।
এরপর আমাদের হগল আনন্দ মাটি হইয়া গেছে। আপনি দাওয়াত দিলেন ফুলির আব্বায় খুব
খুশি হইছে। আপনি কাল কইলেন আপনি, স্যার আর মামনি একরহম পোশাক পরবেন। কাল
রাতে আমিও ভাবলাম আমি, ফুলির আব্বা আর ফুলি একরহম পোশাক পড়ুম। '
'তোমার মন খুব সুন্দর সালমা। তোমাকে এই জন্য আমার খুব ভালো লাগে। তুমি কাল
মাপ জানাও। টাকা পরে নিবো। '
বাকি তিন বাসায় কাজ করে সালমা কত পায় নিশা জানে না। তবে নিশার বাসা থেকে
মাস শেষে যতটুকু টাকা সালমা পায় তার কয়েকগুন বেশি টাকা খরচ হবে এই তিনজনের
সেইম কালার আর ডিজানের পোশাকে। এই কথাটা নিশার বলতে খারাপ লাগছিলো। দামের
কথা শুনে সালমা হয়তো পিছিয়ে যাবে। মনে মনে একই রঙের এবং ডিজাইনের পোশাক
পরার যে স্বপ্ন সালমা দেখেছে সেটা হয়তো ভেঙে যাবে।
খুশী খুশী মনে সালমা সেদিন কাজ শেষ করে মার্কেটে গেলো। তানিয়ার জন্য
জন্মদিনের উপহার কিনতে হবে। সালমা অনেক ঘুরেও তানিয়ার জন্য উপযুক্ত উপহার
খুঁজে পেলো না। যা দেখে তা পছন্দ হয় না, যেগুলো পছন্দ হয় সেগুলো টাকাতে
কুলায় না। অনেক ঘুরেফিরে খালি হাতে বাসায় ফিরে আসলো সালমা।
'তোমার ম্যাডামের মেয়ের জন্য কি কিনবা কিছু ভাবলা ?'
'আজকে কাম শেষ করে একটু মার্কেটে গেছিলাম। যা পছন্দ হয় সেগুলো সাধ্যে কুলায়
না। চাইলেই তো সবকিছু তানিয়া মামণিকে দেওন যাইবো না। '
'আমাগো মাটির ব্যাংকটা ভাইঙ্গা দেহো কত টাহা জমছে। সেই টাহার লগে আরো কিছু
টাহা মিলাইয়া সোনার কিছু দেওন যায় কিনা দেহো। '
'আইচ্ছা! দেখতাছি। '
মাটির ব্যাংক ভেঙে সালমা দেখলো খুবই সামান্য কিছু টাকা জমেছে। অনেক ভাবনা
চিন্তা করে সালমা ঠিক করলো তার ম্যাডামকে পোশাকের টাকা পরের মাসে দিবে।
পোশাকের জন্য যে টাকাটা খরচ করবে বলে ঠিক করেছে সেটা দিয়ে তানিয়ার জন্য
উপহার কিনবে। এইদিকে নিশা নিজেদের জন্য সে কালার আর ডিজাইন অর্ডার দিয়েছে,
সেইম কালার এবং ডিজাইন সালমা, তার স্বামী এবং মেয়ের জন্য অর্ডার দিলো।
জীবনে কে কবে দেখেছে নিজের মেয়ের জন্মদিনে নিজেরা যেমন ড্রেস পরবে , সেইম
একই ড্রেসের অর্ডার কেউ তার হেল্পিং হ্যান্ড এবং তার পরিবারের জন্য করে।
জীবনে কে কবে দেখেছে নিজের মেয়ের কানের দুলের জন্য জমানো টাকা দিয়ে যার
বাসায় কাজ করে তার মেয়ের জন্মদিনের উপহার হিসেবে সেই মেয়ের জন্য কানের দুল
কিনতে। ভালোবাসা ফিরে আসে। অন্যের জন্য ভালো কিছু করলে নিজের সাথেও ভালো
কিছু ঘটে।
এক দুঃস্বপ্ন এবং মা
শায়লা আজীম
অনেক বার চেষ্টা করে ও দুচোখের পাতা খুলতে পারলাম না। প্রচণ্ড ঘুমে কাতর
এই আমি পাশ ফেরার চেষ্টা করছি। মাথাটা কেমন যেন ভারী ভারী লাগছে। কিছু একটা
মাথার উপর চেপে আছে। আস্তে আস্তে করে সেটা নড়াচড়া শুরু করেছে। একটা নরম
হাত আমার কপাল আর চোখ ছুয়ে ,নাকের প্রায় কাছাকাছি। আমার শরীরটা কাপতে
শুরু করেছে , বেশ জোরালো সে কাপঁন। ঘুমের ঘোরেও আমার চিরকালের চেনা,
মায়ের শরীরে লেগে থাকা চন্দনের সুগন্ধী,আমার নাকটা কে ছুয়ে গেছে ঝাপটা
বাতাসে। মা কোনো রকম না থেমে এক নিঃশ্বাসে বলে চলছেন “এই ভর সন্ধ্যাকালে
অন্ধকারে কেউ এমন করে ঘুমিয়ে থাকে? না কেউই থাকে না, তুমি ঠিকই বলেছো মা।
!! মা বললেন -আয় আমার সংগে। আমি বেশ জোরে মা এর হাত দুটো ধরে ধড়ফড় করে
উঠে দাড়ালাম। না খুব বেশী অন্ধকার ছিলো না আসে পাশে। সব অচেনা অদেখা
মানুষগুলি ছুটে চলেছে কোন দিকে বুঝতে পারছি না। মা আমার হাত ধরে টানছেন
সিড়ির দিকে। একটা চলন্ত সিড়ি দিয়ে আমি আর মা মাটির নীচে নেমে চলেছি।
নামছি তো নামছি ,শুধু নেমেই চলেছি। আলো আধারের মাঝে আমি চিনতে পারছি
আশপাশটা! এটা একটা ট্রেন ষ্টেশন, আমার অনেক দিনের চেনা। জি ট্রেন, এই ট্রেন
ধরে আমি কতবার আজীম কে দেখতে গিয়েছি হাসপাতালে। আমি ভাবছি মা এখানে এলো
কেমন করে। মা তো সেই কবে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আমি বার বার মা কে
দেখছি। মুখটা এতো অস্পষ্ট কেন। তেমন পরিষ্কার করে দেখতে পাইনি। আমি ঘেমে
নেয়ে উঠেছি। আমার ভীষন পানির পিপাসা পেয়েছে। পিপাসা কাতর এই আমি জোর
হাতে পানি পানি করে কাদঁছি। রাতের নিস্তব্ধতা কে পিছনে ফেলে ঘড়িতে সময়
তখন ভোর সাড়ে তিনটা।
প্রতিমা সরকার
আমরা বাঙালি হাউজিং সোসাইটির বাতাসে হটাৎ করে শুরু হলো গুজগুজ,ফিসফাস।
কেন?না, এই সোসাইটির সর্বশেষ বিল্ডিং এর সর্বশেষ তলার বাসিন্দা মিস চন্দনা
,যে কিনা কিছুদিন আগেই এই সোসাইটিতে এসেছে এবং অনেকের মতে খুব অহংকারী কারন
সোসাইটির কারো সাথে তেমন একটা মেলামেশা করে না,কি একটা মাল্টিন্যাশনাল
কোম্পানিতে চাকরি করে। বাকি সময় নিজের মত করে থাকে।সেই তাকেই নাকি এবারের
পূজায় এক মাঝবয়সী ভদ্রলোকের সাথে দেখা গেছে পূজা মণ্ডপগুলোতে ঘুরে বেড়াতে।
সোশাল মিডিয়ায় সিঁদুরে লেপটানো তার হাসি মুখের বেশ কটি ছবিও দেখা গেছে
ভদ্রলোকের সাথে। কেউ বলছেন লোকটি চন্দনার স্বামী,আবার কেউ বলছেন না,
ভদ্রলোক চন্দনার নতুন বয়ফ্রেন্ড।
এই নিয়ে গুজগুজ,ফিসফাস বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থা হলো যে দুই,না আড়াই পক্ষ
দাঁড়িয়ে গেল।শুধু দাঁড়ালো বললে ভুল হবে।রীতিমত ঝগড়া শুরু হলো।এক পক্ষ বলে
ছবির মানুষটি চন্দনার স্বামী এবং সে বোধহয় স্বামীর সাথে পুরনো ঝগড়া মিটিয়ে
ফেলেছে।আরেক পক্ষ বলছে না, তা নয়।এটি আসলে চন্দনার প্রেমিক,যে কিনা অচিরেই
চন্দনাকে বিয়ে করবে।এই দুই পক্ষের বাইরে যে আধা পক্ষটি আছে, তারা মিনমিন
করে বলছে, বর হোক আর বয়ফ্রেন্ড, আমাদের কি আসে যায়? এটা চন্দনার সম্পুর্ন
ব্যাক্তিগত ব্যাপার।কিন্তু এরা সংখ্যায় খুবই ক্ষুদ্র বলে এদের কথায় কেউ কান
দিচ্ছে না।
এভাবেই কথা বাড়তে বাড়তে সোসাইটিতে একটা বিশৃংখল অবস্থার সৃষ্টি হোল।তখন
সোসাইটির সভাপতি দেখলেন বিপদ।তারাতারি তিনি এক সভার আয়োজন করলেন।সভায় এই
পক্ষ,ওই পক্ষ,দুই পক্ষকেই ডাকা হলো ।সভার শুরুতেই সভাপতি এক নাতীদীর্ঘ
বক্তব্য রাখলেন সোসাইটির পরিবেশ ভাল রাখার উপরে।তারপর ডাকলেন এই পক্ষের
নেতা মিসেস ঝকঝকে তকতকে ম্যাডামকে।এখানে বলে রাখা ভাল, উনার এই উপাধির কারন
হলো,উনার একটু শুচিবায় আছে।যাই হোক,উনি এসেই কোন রকম ভনিতা না করে সভাপতির
দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন,দেখুন,আমরা একটা ভদ্র সমাজে বাস করি।এখানে এরকম
বেলাল্লাপনা করা চলবে না। একথা শুনে সভায় উপস্থিত সবাই এ ওর মুখের দিকে
চাইতে লাগলেন।ঘটনা কি? উনি কার কথা বলছেন? সভাপতিও একটু অবাক হয়ে
বললেন,মিসেস ঝকঝকে,একটু ঝেড়ে কাশলে আমাদের বুঝতে সুবিধা হয়। একথা শুনে
মিসেস ঝকঝকেও কিছুক্ষন হুম হাম করে কেশে নিয়ে বললেন, না মানে দেখুন ,আমরা
সবাই জানি মিস চন্দনা তার স্বামীর সাথে থাকেন না।ঠিক আছে,এটা তার
ব্যাপার।আমরাও কিছু মনে করিনি।কিন্তু এবার পূজায় যে সে স্বামীকে নিয়ে ঘুরে
বেরালো ,ছবি তুলল ।এটা তো ঠিক হলো না।
এই কথা শুনে আবার সভায় একটা মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়েগেল।কি বলছেন উনি? কেন ঠিক
হলো না? এতে সমস্যা কি? ইত্যাদি ইত্যাদি। সভাপতি দেখলেন বিপদ।উনি তাই
অর্ডার ওর্ডার বলে হাক মারলেন।সবাই থেমে গেল। সভাপতি তখন মিসেস ঝকঝকে কে
জিজ্ঞাসা করলেন, মিস চন্দনা যদি স্বামীর সাথে ঘুরে বেড়ান, পূজায় যান তাতে
সমস্যা কেন হবে? সমস্যা তেমন নেই ।তবে চন্দনা যদি ওর স্বামির কাছে ফিরে যান
বা ওদের মিটমাট হয়ে যায় তাহলে আমরা কথা বলব কাকে নিয়ে? আমার বাপু পিএন পিসি
না করলে বদহজম হয়। সভায় এবার একটা হাসির রোল উঠল।সভাপতি ভ্রু কুচকে
জিজ্ঞাসা করলেন, পি এন পি সি? সেটা আবার কি? মিসেস ঝকঝকে বলে উঠলেন,কেন
জানেন না, পিএন পি সি হলো, পর নিন্দা,পরচর্চা। আবার একটা হাসির বাতাস বয়ে
গেল সভা জুড়ে। সভাপতি কিছুক্ষন মুখ ঝুলিয়ে বসে থাকলেন।তারপর হুম, বুঝলাম
বলে ওই পক্ষের দলনেতা মিস উঁকিঝুঁকি(উনার এই উপাধির কারন হলো,উনার অন্যের
ব্যাপারে নাক গলানোর অভ্যাস আছে)কে ডেকে বললেন, আপনার কিছু বলার আছে?
নিশ্চয়ই আছে। আমি দৃঢ় কন্ঠে বলতে চাই, মিস চন্দনার সাথে দেখা লোকটি মোটেও
তার স্বামী নয়।সে আসলে চন্দনার প্রেমিক।যার সাথে কিনা অচিরেই চন্দনার বিয়ে
হবে।এই কথায় আবার সভায় একটা গুঞ্জন উঠল।ও,লোকটি তাহলে চন্দনার স্বামী
নয়,প্রেমিক।তা সে কি করে? থাকে কোথায়? দেখতে তো খারাপ না।চন্দনা কি লাকি ।
ইত্যাদি ইত্যাদি।সভাপতি এবার ও হাক দিলেন অর্ডার,অর্ডার।সবাই শান্ত হয়ে
চুপচাপ বসুন।মিস উঁকিঝুঁকি, মানলাম, মিস চন্দনার সাথে থাকা লোকটি তার
প্রেমিক।তাতে আপনাদের সমস্যা কোথায়? সে তার মত আছে ,আপনারা আপনাদের মত
থাকুন।মিটে গেল।সাথে সাথে মিস উঁকিঝুঁকি ক্ষেপে গেলেন।কি বলছেন আপনি?
চন্দনা বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঢ্যাংঢ্যাং করে ঘুরে বেড়াবে ,আর আমরা চেয়ে চেয়ে
দেখব।কভি নেহি। আমি আজ পর্যন্ত একটা বয়ফ্রেন্ড জুটাতে পারলাম না আর সে নতুন
বয়ফ্রেন্ড—এটুকু বলে মিস উঁকিঝুঁকি আর কিছু বলতে পারলেন না।তিনি তার উদগত
কান্না সামলাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন।তার কজন সখিকে দেখা গেল তাকে সান্তনা
দিতে।
সভায় আবার তুমুল হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। এই পক্ষ বলছে ,চন্দনার স্বামীর সাথে
ঘুরে বেড়ানো চলবে না। তো ওই পক্ষ বলছে চন্দনার বয়ফ্রেন্ড থাকা চলবে না।
সভাপতি হাজার চেষ্টা করেও ওদের কে থামাতে ব্যর্থ হয়ে সভা বরখাস্ত বলে ঘোষণা
করে চলে গেলেন।সভাপতিকে চলে যেতে দেখে বাকি যারা এসেছিল তারাও কি করলে কি
হতো,কি করলে কি হবে এই সব বলাবলি করতে করতে সভাস্থল ত্যাগ করল। ওদিকে যাকে
নিয়ে এত কিছু সেই চন্দনা তখন অফিস থেকে ফিরে ফ্রেস হয়ে বড় এক মগ কফি নিয়ে
তার প্রিয় বারান্দায় বসে ভাবছে সামনের ছুটির দিনটি কিভাবে কাটানো যায়। আমরা
বাঙালি হাউজিং সোসাইটির মানুষদের তাকে নিয়ে এত জল্পনা,কল্পনার কোন কিছুই
তাকে স্পর্শ করছে না।
রমিজউদদীনের লালবানু
রওশন হক
প্রচন্ড রোদ । বাড়িঘর গাছপালা জ্বলে পুডে চৈত্রে খরতাপে দুপুর এগোতে
থাকে।জীবজন্তুর মত মানুষের ও জান টা গলার কাছে থাকে।এই সময়ের রোদ্দুর কে
যমদূত মনে হয়।ছায়ায় বসে মানুষ হাসপাস করে।
তমিজউদ্দিন ঘাম আর ধুলোয় মাখা চটচটে চামড়া চুলকায় খসখস করে।ঘামে ভেঁজা
শরীর নিয়ে ঝুপড়ি থেকে আসে।সারা বস্তি জুডে একটা মাত্র দেবদারু গাছ জীবিত
আছে । ছায়ার আশায় সে তার নীচে যেয়ে দাঁড়ায় । কোন বাতাস নেই একটা পাতা ও
নড়ে না।
এই রইদে কেউ বাঁচব না।তমিজ নিজের সাথে কথা বলে।রাস্তা দিয়ে চারিদিকে বালি
ছডিয়ে গাড়ি যায় ।তমিজ গামছা দিয়ে মুখ চেপে রাখে । গামছার কোনা দিয়ে নিজেকে
বাতাস করার চেষ্টা করে।একে গরম তার উপর ধুলা তার মেজাজ গরম হয়।
কিনতু মেজাজ গরম করে সুখ পায় না রমিজ।পুরা বস্তি খালি । এই সময়ে একটা লোক ও
নেই যে চরম অশান্তির বিরুদ্ধে তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলাবে।
জোয়ান মেয়ে মরদ সব বাইরে । কিশোর কিশোরী এমন কি রমিজের ত্রিশ বছরের
সঙ্গিনীটি পর্যন্ত ।রমিজ রোগ কাতর বুডো হবার কারনে মনে কষ্ট পায়। দু একবার
কাজের চেষ্টা করেও পায় নি । কেউ কাজ দেয় না। ঠ্যলাগাডি ঠেলার জোর নাই।তাই
কখনো ঝুপড়ির ভিতরে বা কখনো ঝুপড়ির বাইরে বসে ঝিমাতে থাকে।নিজের ঝুলে থাকা
হাতের পেশিতে হাত বুলায়।জীর্ণ পেশি কে ফুলাতে ব্যর্থ চেষ্টা করে।
লালবানুর বিড়াল টা তার দিকে অপলক দৃষ্টি তে চেয়ে থাকে ।সবার মত বিড়ালের
চোখে ও তমিজউদ্দিন তার জন্য সহানুভুতি দেখতে পায়।
যাহ্ দুর হ ।
বিড়াল টা সরে না । ঠায় দাড়িয়ে রইল ।মুখটা ফিরিয়ে অন্য দিকে চেয়ে
আছে।দাঁড়ানোর ভঙীমায় তাকে পাত্তা না দেয়ার আভাস স্পষ্ট ।রমিজের মাথায় রক্ত
উঠে যায়।
এই হালার বেডি রে কত কইরা কইলাম এই বিলাই রে ঘরে ঢুকাবি না । হারমী মাইয়া
মানুষ শুনলো না ।উল্টা আমার লগে বইয়া ভাত তরকারি খাওয়ায়।
রমিজউদদীন মনে অজান্তেই পাশে রাখা ইটের টুকরা টা ছুঁড়ে মারে। ঠীক ঠীক
বিড়ালের গায়ে লাগল ।তবে বিড়াল টা গোঙানির মত আওয়াজ লাফিয়ে দৌডে পালায়।
রমিজউদদীন ঝুপডির নীচে বইসা বিড বিড করে । ইট দিয়ে বিড়াল কে আঘাত করতে
পেরে কিছুটা শান্তি পায়।খুশি হয় নিশানা এখনো ফুরিয়ে যায় নি।
রমিজের লালী কে সন্দেহ করে ।লালবানুর চালচলন আজকাল ভালো ঠেকায় না।নতুন
কাপড় গায়ে দিয়ে কামে বের হয়। দুইটা বাসায় ঠিকা ঝিয়ের কাজ করে সন্ধায় ঘরে
ফিরে। কোন সাবে তারে মোবাইল ও দিছে ।কানের লগে তার ঝুলায়ে কথা কয়।লালীর
কাছে রমিজের কোন মুল্য নেই।বিড়ালের সমান মর্যাদা তার চেয়ে বেশি।রমিজউদদীন
সবই বুঝতে পারে।
রমিজের প্রতিবেশি এসে হাজির হয় । বলে ,কি চাচা ,কি কও বিডবিড কইরা।বিলাই
টারে খেদাইলা নাকি !?এমন ইট ছুইডা মারনের কি দরকার ছিল ?
রমিজ বিরক্ত হয়ে তাকায় । শুকনা চোখে তাকিয়ে বলে , খাইবার আইলি?
হু, কালাম মাথা ঝাকিয়ে উত্তর দেয়।
বৈকালে কি আবার বারইবি?
খ্যাপ পাইলে।
আমারে লইয়া যাইছ।
কালাম কোন উত্তর করে না।
হুন আমারে লগে নিস কইলাম
আচ্ছা দেহুমনে । কালাম তার নিজের ঘরে যায়।
রমিজ ঝুপডিতে ঢুকে আবার শোয়।কিছুই করার নেই , সে ঘুমাতে চেষ্টা করে।
তন্দ্রা আসতেই হঠাৎ চেচামেচিতে তা কেটে যায়। বাইরে লালবানুর গলার আওয়াজ
শোনা যায়।
হায় ,হায় রে , আমার সর্বনাশটা করল ক্যাডারে! আমার কইলজার টুকরার পা টা
ভাঙলো কেডায় রে ।কোন হারমির পুতে এমন কাজ টা করল রে ।আমি কি করমু গো ।এই
বিলাই কার কোন ক্ষতি টা করল রে । এই হারামীদের লগে কোন মানুষ থাকবার পারে
না ।বিড়াল বুকে নিয়ে লালবানু বিলাপ করে।
লালবানুর চিৎকার শুনে পড়শিরা উঁকিঝুকি দেয়। কিন্ত কেউ কিছু বলে না।রমিজ
দুর্বল শরীর টা নিয়ে দরজার কাছে এসে মারমুখো স্ত্রীকে দেখে।বলে , সারা দিন
কাম কইরা আইয়া এমন চিল্লান দিবার লাগছস কিসের লাইগা।
স্বামীর কথায় লালবানুর শোক উথলে উঠে।দেখো, দেখো কোন হারামি বাচ্চায় আমার
বিলাইয়ের পাও টা ভাইঙ্গা দিছে।
রমিজের মেজাজ আবার খারাপ হয় । বলে, মানা করছিলাম না বিলাই পালতে।নিজে খাইতে
পারছ না বিলাই পালা লাগব না।
এবার লালবানু ক্ষিপ্ত হয় । ঐ ঐ বুইডা আমার বিলাই রে আমি খাওয়াই , আমি পালি
তোমার এত জ্বলে কেরে । হারা দিন হুইয়া থাহো বিলাইটার কোন খোঁজ খবর রাখো না।
লালবানু বিডালের পা হলদি গুডা লাগায়। বিড়ালের পা শাড়ির আচঁল দিয়ে বেধে
রাখে। রমিজ লক্ষ্য করে স্ত্রীর বুকের মধ্যে থেকেও বিড়ালের চোখ রমিজের দিকে
।
কি করবি এখন ?বিলাপ করবি ? না কি খাওন দিবি ? আমি কামে যাইমু ।
স্ত্রী মুখ ঝামটা দিয়ে বলে , হু হাত দিয়া তুইলা বুইডা ভাত খাইতে পারে না ,
তাইনে আবার কামে যাইব!?
বেশি কথা কইস না কইলাম ।ভালা হইছে তোর বিলাইর পা ভাংছে।বেশি বার বারছোস
এবার তোর ঠেং ভাংঙ্গা লাগব।
লালবানু ভয় পায়।বুডোকে সে চেনে । বলে, বুইডা হইছো অহনতরি মেজাজ গেল
না।আবারো বিলাপ ধরে আল্লারে আমার বাচ্চা টারে কে এমন করল রে। খোদা তুমি তার
বিচার কইরো।
লালবানুর চোখে পানি। বুকে আঁকড়ে ধরা বিড়াল । মুখে অকথ্য গালি তা দেখে
রমিজের মাথায় আগুন ধরে যায়। চুপ করবি মাগি ! বলেই , গোয়াডের মত দরজা
আটকানোর বাঁশ টা এক টানে হাতে নেয় । লালবানুর মাথায় বাডি দিতে গেলে
প্রতিবেশি কালাম এসে রমিজের হাত ধরে ফেলে।
বলে , চাচা করো কি ! ওদের স্বামী স্ত্রীর কলহ কালাম এসে মেটায়। চাচা তুমি
এত মাথা গরম করো কিয়ের লাইগা।লও যাইবা নি কামে ।বলে ,রমিজউদদীনের হাত থেকে
বাঁশ টা কেরে নেয়।
লও যাইবা নি কামে ? দুর আছে । হাঁটতে পারবা তো।
পারুম ।আমি যামু।
কালাম বিরক্ত হয়ে লালীর দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি চুপ মাইরা থাকলেই
পারো।দেখতাইছ গরমে বুইডার মাথা বিগডাই গেছে।তোমার বিলাই রে আমি কাম থেকে
আইয়া ডাক্তার এর কাছে নিয়া যামু নে ।চাচা রে খাওন দেও বলে কালাম তার ঘরে
গেল।
লালবানু শান্ত হয় । বিড়াল টাকে রমিজের চাটাইর পাশেই ছালার উপরে রাখে।
বিড়াল রমিজের দিকে সেই কখন থেকে তাকিয়ে আছে।মুখে কথা বলতে পারলে লালীকে সব
বইলা দিত।
রমিজউদদীন কে লালবানু বাসা বাডি থেকে আনা ভাত তরকারী বেডে দেয়।মাটির বাসনে
বিড়াল কে খেতে দিয়ে তার মাথায় হাত বুলাতে থাকে।বলে, চিন্তা করিস না আমি
সকালেই তোরে ডাক্তার দেখামু। যে তোর পা ভাঙ্গছে আল্লাহ তার পাও ভাঙ্গব। তার
উপরে আল্লার গজব পড়ব।
রমিজউদদীন আবারো রাগ হলো । ক্ষুধা থাকার পর ও রাগে তার ক্ষিদা কমে
গেল।ভাতের থালা টাকে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে কোন মতে কোমর টা নিয়ে উঠে দাডাল।
লীলা তাকে লক্ষ্যই করল না ।
চাচা আইয়া পরো ।যাইতে পারবা নি ? বহুত দুরে যাওয়া লাগব।
পারুম না কেন !। আইতাছি। বলেই গামছা টান দিয়ে কোমরে বাঁধে । আড় চোখে লালীর
দিকে তাকায় । সে বিড়ালটিকে তার কোলের উপর নিয়ে ব্যস্ত । রমিজ খাইলো কি
খাইলো না তাতে তার কিছু যায় আসে না।
রমিজঊদদীন বের হয়ে গেল ।ইতিমধ্যেই কালাম অনেক দুর চলে গেছে।
কালাম খাড়া । আমি আইতাছি ।কালাম দাঁড়ায়। রমিজউদদীন একটু জোরে পা ফেলে
ঠ্যলার পেছনে হাত লাগায়। কালাম ঠ্যলা গাড়ি টানতে থাকে রমিজ ও পা চালায়।
কালাম বলে, চাচা তুমি মাথা গরম করো কেন !? সে একটা জোয়ান মাইয়া মানুষ হইয়া
তোমার লগে সংসার করে। আমরা জোয়ান মরদ হইয়া বউ সামাল দিবার পারি না।আর তুমি
করো মেজাজ।সে যদি চইলা যায় তোমারে দেখবে কে ?
রমিজউদদীন শুনে আর ঠ্যলা ঠেলে। কথা কইতে মন চায় না। মনে মনে বলে সে আর আছে
কই ! কবেই গেছে গা ।কাজের বাসার সাহেবের লগে লটর পটর আমি ঠিকই বুঝি। সেদিন
নতুন ব্রেসিয়ার পরা দেইখাই বুঝছি লালি আর আমার নাই।রমিজের মাথা বেয়ে ঘাম
নেমে আসে। চোখে অন্ধকার দেখে তবুও হেটে চলে।ঠ্যলা থেকে কখন হাত ছুটে
রাস্তায় পরে গিয়েছে কালাম টের পায় নি। কালাম ছুটে চলছে।
রমিজউদদীনের চোখ বুজে আসে । চোখের সামনে ভেসে আসে লালবানু লাল শাড়ি পরা ।
তার বিড়াল কোলে নিয়ে ঝুপডির দরজায় সামনে পা মেলে বসে আছে ।
রমিজের মনে আছে ,সে রাতে লালী কে কারা যেন ধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে গেছিল ।
রমিজ ডাক্তার হাসপাতাল দৌড়া দৌড়ি করে সুস্হ করে তুলেছিল।পরে লালী আর
গ্রামে ফিরে রাজি হয় নি বলে সে বিয়ে করে ঘরে তুলেছিল।তারপর থেকেই তাকে
নিজের সন্তানের মত মায়া করেছে।মেজাজ করে গালমন্দ করেছে তবে তার গায়ে কখনো
হাত তুলে নি ।আজ পেটের ক্ষিদা আর অতি গরমে মাথায় রাগ উঠে গেছিল বলে মারতে
গেছিল।রমিজের দম বন্ধ হয়ে আসে। ক্ষীন শুনতে পায় কালাম এসেছে । চাচা কইছিলাম
তুমি পারবা না ।আরো মানুষের হট্টগোল কানে আসে। রমিজে বলতে লালী কে দেখতে
ইচ্ছা করে।লালী লালী লালবানু তর বিলাই রে আর মারতাম না ।