একুশে
ফেব্রুয়ারি বাঙালির আনন্দ-বেদনার দিন। প্রথমত বেদনার - এ আমাদের শহীদ
দিবস, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষা সৈনিকদের
স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে এবং দুই বিশিষ্ট প্রবাসী বাঙালির
বর্তমান কালের দূরপ্রসারী যে প্রভাবের কারণে একুশে ফেব্রুয়ারি আজ
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে উন্নীত হয়েছে তাঁদেরকে সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা
জানাতে কার্তিকের কুয়াশার এই বিশেষ সংখ্যার আয়োজন। এই আন্তর্জাতিক
স্বীকৃতির যে দুর্লভ গৌরব আমরা লাভ করেছি তার মূল্য অকিঞ্চিৎকর
নয়। কার্তিকের কুয়াশা, একুশে ফেব্রুয়ারির বিবিধ বিজয়ে, একটু বেশিই
গর্ব্বোজ্জ্বল কারণ এই কানাডা থেকেই রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম
প্রথম ১৯৯৮ সালের ৯ই জানুয়ারি জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কোফি আনানকে
চিঠি লিখে একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রবর্তনের অনুরোধ জানান।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনকে স্মরণীয় করে রাখতে রফিকুল ইসলাম এই
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি "একুশে ফেব্রুয়ারি" প্রস্তাব করেন। তা
স্বীকৃত হয়েছে। এ কথাও অনস্বীকার্য, বাংলাদেশের পর কানাডাই বিশ্বের
প্রথম দেশ যেখানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি সংসদে ৫ই ফেব্রুয়ারি,
২০১৪ স্বীকৃতির জন্য প্রবর্তিত হয়েছিল। ২০১৫ সালে, ব্রিটিশ কলম্বিয়া
এবং ম্যানিটোবা ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের
ঘোষণা প্রকাশ করে। এডমন্টন ২১শে ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস পালন করেছে।
মহান ভাষা আন্দোলনের ৬৯ বছর পর পিছন ফিরে তাকালে স্পষ্টতই আমরা দেখতে
পাই বাঙালির অনেক অর্জন। আমাদের শহীদ দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি আজ
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিবেচিত এবং সর্বজন স্বীকৃত। এ গর্ব
যেমন আমাদের, তেমনি সহস্রাধিক বছর বয়সী এই ভাষা এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে
ওঠেনি সেই দুঃখও আমাদের। সব বিষয়ে প্রাগ্রসর শিক্ষা এবং গবেষণা বাংলায়
হয়না এই ক্ষত হয়তো আমার মতো অনেকেই বুকে বহন করে ফিরছেন। বাঙালি
পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুও হয়তো দুঃখ করেই একদিন বলেছিলেন,
“যাঁরা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা হয় না, তারা হয় বাংলা জানেন
না, নয় বিজ্ঞান বোঝেন না।” বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রসারের উদ্দেশ্যে
বিজ্ঞান পরিচয় নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেন তিনি। পরিতাপের বিষয় এই
যে, বিজ্ঞানীর এই মহৎ উদ্যোগ পরবর্তীতে আর বহাল রাখা হয়নি। এই ব্যর্থতা
আমাদের সকলের।
কার্তিকের কুয়াশার এই বিশেষ সংখ্যায় টরোন্টোসহ পৃথিবীর বিভিন্ন শহরের
প্রধান এবং অপ্রধান, নবীন এবং প্রবীণ, কাঁচা এবং পাকা সব ধরণের লেখকের
ভেতরই বিস্ময়কর সৃজনীপ্রতিভা লক্ষ্য করে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল
ভবিষ্যতের ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়েছি। শিউলি জাহানের ছোট গল্পের
গদ্যগন্ধী ভাষায় আমার মতো অনেক পাঠকই মুগ্ধ হবেন, এ আমার নিঃসংশয়িত
অভিমত। মধুবন্তী আইচের কাব্য-পঠন বরাবরের মতোই শ্রোতৃদেরকে আকৃষ্ট করবে
সে ব্যাপারেও আমি নিঃসন্দেহ। ফিরোজা হারুন, ফেরদৌসী বেগম, হোসনা খানম
তাঁদের কবিতায় চমৎকারিত্ব দেখিয়েছেন। সব লেখকেরই নিজস্ব লেখার ছাঁদ
থাকে। ডা. হাফিজ আহমেদ নিজের জীবন থেকে লেখা তাঁর গল্পে গদ্যেও
ছন্দস্পন্দ ফুটিয়ে তুলেছেন। ১৯৫২ সালের এই দিনে ডা. হাফিজ আহমেদও
উপস্থিত ছিলেন আন্দোলনরত ছাত্রদের ভেতর। বাংলাকে পূর্ব
পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের
ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন তরুণ শহীদ হন। ডা. হাফিজ আহমেদ তাঁর
সেই স্মৃতিই রোমন্থন করেছেন তাঁর গল্প "রক্ত মোছা রুমাল" এ। আমাদের এ
সংখ্যায় তাঁর সুললিত গদ্য ভাষায় "বাংলা ভাষা ও বানান" শিরোনামে আরেকটি
নিবন্ধও প্রকাশিত হলো। ফারজানা আক্তারের ছোটগল্পে যে প্রবহমানতা আছে তা
পাঠককে বহুদূর টেনে নিতে সক্ষম। প্রতিমা সরকারের ছোটগল্প চন্দনার
বন্দনা পাঠকের বন্দনাযোগ্য হয়ে উঠবে আশা করি। রওশন হকের একটি ছোট গল্পও
এ সংখ্যায় প্রকাশিত হলো, তিনি একদিন সুসাহিত্যিক হয়ে উঠবেন এই আশা করি।
শায়লা আজীমের ছোট গল্প "এক দুঃস্বপ্ন এবং মা" যে গদ্য ভাষায় লেখা তার
রীতি ও রূপ এক কথায় অপরূপ।
সিদ্ধকাম হোক কার্তিকের কুয়াশার নিঃসীম নভোযাত্রা।
সাইদুজ্জামান, টরন্টো, অন্টারিও, কানাডা