মধুবন্তী আইচ
বাইরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। চারপাশটা কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে আছে।
শরৎকালের রোদ্দুরটার মতো বৃষ্টিটার মধ্যেও কেমন একটা অন্যরকম মন-কেমন-করা
ছোঁয়া লেগে থাকে! তাই না? শহরতলির হাসপাতালের বারান্দার কোণে দাঁড়িয়ে
রিমঝিম দূরের শিউলি গাছটাকে দেখছিলো। হাসপাতালের গাছ বলেই বোধহয় কেউ হাত
দেয়নি। নিচটায় সাদা ফুলের চাদর বিছিয়ে আছে। রিমঝিমের খুব প্রিয়।
হাসপাতালের তার কেবিনটার বাইরে বেঞ্চটায় বসে তার মা বাবা। মায়ের কান্না আজ
কেউ থামাতেই পারছেনা। বাবা দুহাত দিয়ে মা'কে জড়িয়ে রেখেছে, রিমঝিম কতবার
চেষ্টা করেছে, কিন্তু মা কিচ্ছু শুনছেনা। খালি বলে চলেছে এই যন্ত্রণা কেমন
করে সহ্য করবে, কাকে বলবে!
তবে যে মা, দিদাই, সবাই তাকে সেই ছোট্টোবেলা থেকে শিখিয়ে আসছে মেয়েদের সব
যন্ত্রণা সব কষ্ট মুখ বুঁজে সইতে হয়! সেবার তার জ্বর হলো, কি মাথা
যন্ত্রণা। কই সে তো কাঁদেনি তার পুঁচকে ভাইটার মতো আর। মা খালি মাঝে মাঝে
এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত, আর খাইয়ে দিত।
গত পরশু তার লুকোচুরি খেলতে গিয়ে একটু দেরীই হয়েছিল। তুতুন টা যে কোথায়
লুকিয়েছিল, খুঁজেই পাচ্ছিলোনা! তাই দৌড়ে ফিরছিল বাড়ি।ভাঙ্গা মন্দিরটার
পাশ থেকে ভালোকাকু ডাকলো একটা লক্ষ্মীপেঁচা দেখতে!...
তারপর যখন জ্ঞান ফিরলো কি ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিলো, কিন্তু সে তো কাঁদেনি!
এমনিতেও ভালোকাকু মুখটা চেপে রেখেছিলো, তাই গোঙানী ছাড়া কিছুই শোনা
যায়নি। পরে ভোররাতে সবাই খুঁজে পেয়ে তাকে যখন এই হাসপাতালে নিয়ে আসে, তখন
থেকে আজ পর্যন্ত সব কষ্ট সে তো মুখ বন্ধ করেই সহ্য করেছে। মাম্মাম আর
দিদাইয়ের খুব বাধ্য যে রিমঝিম!
সে আবার আস্তে আস্তে গিয়ে মাম্মামের পাশে বসে হাত টা জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু
মাম্মাম ফিরলোনা তো তার দিকে, বুঝতেও পারছেনা! এইবার খুব কষ্ট হচ্ছে
রিমঝিমের। সকাল থেকে মাম্মাম তার সাথে কথা বলছেনা! হঠাৎ খুব জোরে চিৎকার
করে উঠলো রিমঝিম ... "মাম্মাম!!"
এই প্রথম অবাধ্যতা করলো রিমঝিম ...তবে বড্ড দেরীতে ....
ফরিদা ইয়াসমিন
সামিয়া ! প্রকৃতির মতো স্নিগ্ধ একটি মেয়ে
!! ওর সাথে আমার পরিচয় সেই চা বাগানে l বছর সাতেক এর ছোট্ট পরী সামিয়া !চা
বাগানের নীরব প্রকৃতির মাঝে সামিয়া যেন শত পাখির কাকলি হয়ে এল আমার জীবনে
lবিয়ের পর নাগরিক জীবনের ইতি টেনে স্বামীর হাত ধরে চলে যাই চা বাগানে।
প্রকৃতি যত সুন্দরই হোকনা কেন মানুষের অভাবে তার কোন সৌন্দর্যই যেন মনে দাগ
কাটেনা। দুজনের কথাও একসময় শেষ হয়ে যায় ! চায়ের কাপ পড়ে থাকে শূন্য হয়ে !!
রোমান্টিক গান
ও মনে হয় বিষ!!
ওর বাবা তখন চা বাগানের ম্যানেজার ,আর আমার হাসব্যান্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট
ম্যানেজার lসামিয়া প্রায়ই আসতো আমার কাছে ,ওর আসার আরো একটা কারণ ছিল আমার
ছেলে l আমার ছেলের বয়েস তখন ছয় মাস l আর সামিয়ার তখন কোনো ভাইবোন ছিলোনা !
তো স্বাভাবিক ভাবেই সামিয়ার আগ্রহ ছিল শিশুদের প্রতি !!
কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে কিভাবে কখন যেন দুটো অসম বয়সী মানুষের মধ্যে
বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো l সামিয়ার ভালোলাগা আমার ছেলেকে ছাড়িয়ে আমার প্রতিও
বিস্তার লাভ করলো !! সামিয়া এখন আসে আমার কাছে হাতে বই আর রং পেন্সিল নিয়ে
l খেলার ছলে চলে পড়ালেখা আর ছবি আঁকা ! কখনো আমি ওর টিচার আবার কখনো আমার
টিচার ও ! চলে ছাত্র - ছাত্রীদের সাথে কাল্পনিক কথোপকথন !! শাস্তিও বাদ পরে
না !ও নিজেই আমাকে শিখিয়ে দেয় .....আন্টি আজকে আমি পড়া পারবো না ,আপনি
আমাকে শাস্তি দিবেন !! " আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করি ' তা কি শাস্তি হবে
'?....আনন্দের সাথে বলে উঠে 'কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবেন '! আমি প্রমাদ গুনি
!! ও যখন টিচার হবে আমাকেও তো একই শাস্তি পেতে হবে !!
ভয়ে ভয়ে বলি আজকে পড়া নিবোনা ছবি আঁকো !
এভাবেই চলছিল দিনগুলো !একদিন জানতে পারলাম সামিয়া America যাচ্ছে চিকিৎসার
জন্য ,মনটা খারাপ হলো !! জানতে পারলাম সামিয়া জন্মগত ভাবেই হার্ট এর
সমস্যায় ভুগছে ! আল্লাহর কাছে দুহাত তুলি ওর সুস্হ্যতার জন্য l সামিয়া
সুস্হ্য হলো তবুও হয়তো কিছু সমস্যা রয়েই যায়,তাই ওর ফ্যামিলি সিদ্ধান্ত নেয়
আমেরিকাতেই থেকে যাওয়ার !
ভাগ্যর কি পরিহাস এক সময় আমরাও আমেরিকা চলে আসি l আবার দেখা হয় সামিয়ার
সাথে ! সামিয়া এখন অনেক ভালো l পড়াশুনা করছে ,শরীর ও ভালো lএর মধ্যেই শুনি
সামিয়ার বিয়ের খবর l বিয়েতে যাই নবদম্পতি কে আশীর্বাদ করি ,খুব খুশি হই!
এর পরের ঘটনা আমি খুব একটা জানতে পারিনা lপ্রবাসের ব্যস্ততা মানুষকে অনেক
কিছু থেকে দূরে রাখে l তবুও জানতে পারি সামিয়া এক ফুটফুটে রাজকন্যার মা
হয়েছে ,সুখে সংসার করছে l খুব শান্তি পাই !!
সেদিন দুপুরে আচমকাই আমার massenger এ একটা ম্যাসেজ আসে .......Samia
passed away,may Allah grant her Jannahtul Ferdous !!
..........................
....... কিছুই না ,সুস্হ্য মেয়ে টা একটু অসুস্থতা অনুভব করছিলো !!
হাসপাতালে গেলো l ডাক্তার জানালো অক্সিজেন লেভেল নিচে নেমে যাচ্ছে
,তাড়াতাড়ি অক্সিজেন দেয়া হলো lএকটু ভালো হলো lঘরে আসার প্রস্তুতি !! আবার
খারাপ হলো !অক্সিজেন লেভেল নিচে নামতেই থাকলো ....টিক টিক ..টিক ...টিক
....টিক ........... ..
........... ..... ...... ..আহ্ সামিয়া !!
ওর মেয়ে নোরার বয়স মাত্র পাঁচ বছর !! কিছুই বোঝেনা ,শুধুই মায়ের জন্য
অস্থিরতা ! ফ্রীজে মায়ের জন্য breakfast তৈরী করে রেখেছে !! একটা বিস্কুট
,একটুকরো আপেল আর একটা ক্যান্ডি !! কখন মা আসবে এসে খাবে ! আহারে সামিয়া !!
মনে পড়ে চা বাগানে সেই ছোট্ট তুমি আমার গলা জড়িয়ে আমার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে
গেয়েছিলে ---
বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে
আয়না যা না গান শুনিয়ে
.............. .... ......
দুধ ভাত দেবো সন্দেশ মাখিয়ে !!
সামিয়া তোমার নোরা যে এখন তোমাকেই ডাকছে ...কে ওকে আদর করে ভাত মাখিয়ে
খাওয়াবে ,কে ওকে গান শুনাবে !!!
নোরার কাছে তুমি দূর আকাশের তারা হয়েই রবে চিরটাকাল !! যেখানেই থাকো আল্লাহ
যেন তোমাকে ভালো রাখেন !!!!
পাঁচ বছর পরের কথা।
নোরা এখন অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। কিন্তু ওর ভুবন ভরা শুধুই ওর এঞ্জেল মম।ওর
গল্পে, ওর ছবি আঁকায়,ওর কল্পনায় শুধুই ওর এঞ্জেল মম।
রোমেনা লেইস
সোনালী বর্ডার দেয়া ধবধবে সাদা প্লেটে দুটো করে ডিম পোচ।কুসুমদুটো হলদে
আর কমলারঙের মাঝামাঝি রঙের ।তার উপর গোলমরিচের গুড়ো আর লবনের গুড়ো ছড়ানো
।আরেক প্লেটে মুচমুচে পরোটা।
গতকাল দুপুরে তমার বিয়ে হয়েছে।তমার গায়ে হলুদ হয়নি।কোন সানাই বাজেনি।তমা
পুলককে পছন্দ করে।বাসায় এ নিয়ে হুলুস্থূল কান্ড।তমার বাবার ইচ্ছে ছিলো
ডাক্তার বা ইঞ্জিনীয়ার ছেলের সাথে বিয়ে দিবেন ।আর মায়ের ইচ্ছে বিরাট বাড়ি
গাড়ি ওয়ালার সাথে বিয়ে দিবেন।তমা নিজে ফেসে গেলো প্রেমের ফাঁদে।কী এক মায়ায়
জড়িয়ে গেলো।
-এই এদিকে মুখটা ফেরা।হা —কর।
চামচে কেটে ডিম আর পরোটা মুখে তুলে দেয়।এই হচ্ছে পুলক।এমনই পুলক।পুলক
ক্রিকেটার। ব্যাবসা আছে।সব সময় ওর এই কেয়ারিং ভাবটা ভীষণ ভীষণ প্রিয়
তমার।আর এজন্য সব ছেড়ে ছুড়ে বাড়ি থেকে চলে এলো রাগ করে।
এটা হোটেল ।ঢাকায় ওদের কোন আত্মীয় পরিজন নাই।বিয়ের জন্য কোন প্রস্তুতিও
নাই। তাঁতসিল্কের একটা সরু সোনালী পাড় বারগেন্ডি কালার শাড়ি আর কয়েকটা
রেশমী চুড়ি পরে ও যখন আসলো তখন পুলকের চোখে একরাশ মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়তে
দেখেছে তমা।ওরা বেবীট্যাক্সি নিয়ে কাজীঅফিস যাচ্ছে ।একটা বেলী ফুলের মালা
ওর চুলে জড়িয়ে দিলো।ওর দুই হাত পুলকের হাতে।কেন যেন একটুও কান্না পাচ্ছে না
তমার।ব্রুট কোলনের ঘ্রাণ পাচ্ছে ।অফ হোয়াইট পাঞ্জাবি আর সাদা চুড়িদার পরেছে
পুলক।বিয়ে রেজিস্ট্রি হওয়ার পর ওরা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গেলো।সেখানে সাতপাক
আর মালাবদল হলো।দুগাছি সোনার চুড়ি পরিয়ে দিয়ে ওর সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে
দিলো।
ওদের বন্ধু তিনজন বিজন, রতন , পরিমল আর ওর বউসহ প্রথমে ক্যাফে ঝিলে গেলো
খেতে।খাওয়ার পর নিদমহল’ নামের এই হোটেলে এসে দুটো রুম নিলো।বন্ধুরাও থেকে
গেলো।পরিমল আর ওর বউ চলে যাবে রাতে বনানী ।
বাসর শয্যায় সাদা ধবধবে চাদরে ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দেয়া।ঘরের দরজা লাগিয়ে
প্রথম ওকে বুকে টেনে নিলো পুলক।গভীর চুমুতে ওরা নিশ্বাস প্রশ্বাসে গ্রথিত
করলো নিজেকে।
-চুল গুলো তোর ফুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা ।
-হুম বেলী ফুলগুলোর দারুন সুরভী।
-তোর কী মন খারাপ?
-নাহ।
-এমন করে কী বিয়ে হয়?কোন সানাই বাদ্য বাজলো না বিয়ে হয়ে গেলো।
তমা দু হাতে গলা জড়িয়ে পুলকের বুকে শুয়ে থাকে চুপচাপ ।
-এখন ওসব কথা থাক।
তারপর দুজনেই কল কল করে নানান গল্প করতে থাকে।ভবিষ্যতের সব পরিকল্পনা থেকে
শুরু করে সব।দরজায় নক করে ডাকলো বন্ধুরা।ওরা তখন দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে
ওদের আরো বন্ধুরা আসলো ।শুক্রাবাদ থেকে সংসদ ভবন গেলো।সংসদ ভবনের
ফ্লুরোসেন্ট লাইটের আলোয় মালাবদল হলো।ছবি তুললো সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী
বন্ধু অলক।
পিঠে হেলান দিয়ে বসে মনের সব মাধুরী মিশিয়ে সেদিন গান গাইলো তমা।
-তমালিকা তোমার একটা ক্যাসেট বের করতে হবে।
নূপুর বিশ্বাস বলে।গানের ডালি’তে আসবে বুঝলে?
-ভাইয়া আপনি কী যে বলেন। আমার গলার কাজ ভাল না।
-কে বলেছে? আমি বলছি তুমি একটু গুছিয়ে নাও তারপর আমাকে ফোন দিও ।
-জ্বী ভাইয়া ।
-পুলক বুঝলা তুমি রতন পাইছো।গলা ওর সুরেলা।অবহেলা করবা না।আমি একটু ব্যস্ত
।তবে তোমার জন্য চিলেকোঠার ঘর
ঠিক করে দিতে পারবো সামনের মাস থেকে।
হোয়াংহো চাইনীজ রেস্টুরেন্টে সবাই গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে
এলো।রতন আর বিজন ওদের সাথে হোটেলে ফিরলো ।
এখন সকাল ।কী অদ্ভুত একটা অনুভব নিয়ে চোখ মেলে দেখে পাশে পুলক শুয়ে আছে।গত
তিনমাস কঠিন সময় পার করেছে তমা।মা রাজী না ।বাবা রাজী না।ভাই বোন কেউ না।বড়
ভাই পারলে থাপ্পর মারে।বাবা একদিন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন।ভালবাসা প্রেম
মস্ত অপরাধ।বড় বোনের কূট চালে হেরে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আর কোন পথই খোলা রইলো
না।পুলকের মা এসেছিলেন রিম পরাতে। কী যে কথা হলো উনি ফেরত গেলেন মন খারাপ
করে।
এতো কাছে এতো নির্ভাবনায় পুলককে কখনো দেখেনি আগে।পুলক ঘুমাচ্ছে।ও আর ওকে
বিরক্ত করে না।স্নানঘরে যায় ।জলের ঝর্না ছেড়ে আপণমনে গান গায়।
পৃথিবীতে সবখানেই ষড়যন্ত্র ।পরিবার, সমাজ, সম্পর্ক কিছুই নিখাদ নয়।বাবা মা
র ভালবাসা আজ প্রেমিকের কাছে হার মেনেছে।দেখা যাক পুলকের পরিবার কীভাবে
মেনে নেয়।পুলকের বাড়িতে যাবার আগেই ওর মায়ের সাথে ট্রাঙ্কলে কথা
হলো।সাদামাটা মানুষ ।ছেলের খুশীতেই উনার খুশী ।
-কখন আসবি তোরা?
-এইতো মা আজ রাতের ট্রেনে উঠছি।কাল খুব ভোরে নামবো।
-ঠিক আছে ।
ওরা দুপুরের খাবার রুম সার্ভিসকে দিতে বললো।লাউ চিংড়ি ,মুরগীর ভুনা,মাগুর
মাছের ঝোল।সব শেষে দই।
কমলাপুর স্টেশন থেকে এসি বার্থ রিজার্ভেশন করা ছিলো ।ট্রেন ছাড়লো একঘন্টা
দেরিতে ।কু ঝিক ঝিক কু ঝিক ঝিক করে।জানলায় তাকিয়ে তমা দেখে সবকিছুই কেমন
দ্রুত পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রেন ।
(ভেলেনটাইন ডে ২০২০ প্রথম আলোর অনুষ্ঠানে
এক কাপলের গল্পে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা)
এইচ বি রীতা
💕শুভদা-১
রাতভর চোখের পাতা এক করতে পারিনি। বার বার শুভদার মুখটা চোখে ভাসছে। আজ এতটা বছর পর.............! কি জানি একটা অশুভ সংকেত হৃদয়ে শব্দ করে ঘন্টা বাজিয়ে যাচ্ছে। বাইরে মুষল ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার কপাটটা খোলা। দমকা হাওয়ার সাথে বৃষ্টির ফোটা গুলো ভিতরে এসে মেঝেটা ভিজিয়ে দিচ্ছে। নড়তে ইচ্ছে করছেনা। ভিজুক। আজ সব ভিজে যাক। প্রকৃতি আজ বৃষ্টির পানিতে আমার সব কলংক ধুয়ে মুছে দিক। ভিজিয়ে সিক্ত করে দিক আমার যন্ত্রণা। সেই ১৯ টি বছর যে নরক যন্ত্রণা পুষে রেখেছি বন্দি খাচায়, তার দুয়ার আজ কেও খুলে দিক। উড়ে যাক সব অনুশোচনা, ধুয়ে যাক সব পাপ! আজ ১৯ টি বছর পর শুভদা কেন ফিরে এলো? সেই পুরোনো ঝড়টা বুঝি আবার ফিরে এলো আমার সাজানো বাগান তচনচ করে দিতে। চোখের পাতায় ক্লান্তি নামছে। ঘুম পাড়ানির মা যে আজ কোথায় চলে গেলো! আহ! আজ বড় ক্লান্ত লাগছে। বুয়া নাক ডেকে পাশের ঘরে ঘুমুচ্ছে। অতশী আজো সেই ছোট্ট মেয়েটির মত তার বাবার পাশে এক কাত হয়ে জড়োসরো ঘুমাচ্ছে। আলসেমীর সুখে ছেঁদ কাটিয়ে উঠে দাড়ালাম। এক কাপ লেবু চা হলে ভাল হয়। ক্লান্তি কিছুটা দূর হবে। রান্না ঘরে বাতি জ্বালাতেই জলজলে চোখে কালো বিড়ালটা দৌড়ে পালালো। বুকটা কেমন ছ্যাৎ করে উঠল। আজ এমন হচ্ছে কেন? সব কেমন অশুভ ঠেকছে! তাহলে কি আমার জন্য ভয়ংকর কিচ্ছু অপেক্ষা করছে! নাহ! আর ভাবতে পারছিনা। মাথাটা এবার সত্যি চিনচিন করে উঠছে। চা টা হলে ভাল হয়। কেটলীটা চুলায় চড়ালাম। নিজ হাতে চা বানিয়ে মাঝরাতে খাওয়ার সাধই অন্য রকম। চা'টা ছেঁকে আবারাও সেই আগের ইজি চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসলাম। চায়ে চুমুক এর সাথে সাথেই ক্লান্তি অনেকটা কমে গেল। আর সেই সাথে যেন স্মৃতিগুলো স্পস্ট থেকে স্পস্টতর হয়ে উঠছে! ক্লান্তিবোধ কি তাহলে মানুষের চিন্তা চেতনাকে গতিহীন করে দেয়? কে জানে, হয়তো! শুভদা আজ কেন এত তাড়া করছে আমায়? এতটা দিন পর আজ কেন আমায় খুঁজে পেতে হল? আজ কি ভেবে তার মন এত উতলা হল? তাহলে কি সেই পুরোণো হিসেব নিকেশ কষতে ফিরে আসা? না না.... এসব কি ভাবছি আমি! শুভদা কথা দিয়েছিল কখনো ফিরে ডাকবেনা। এখনো স্পস্ট মনে আছে....সেই মাঘের কুয়াশায় ডাকা ভোরে শুভদার ঘরে গিয়েছিলাম। কিছু ভয়, কিছু লজ্জ্বা রাঙা কম্পিত ওষ্ঠে বলেছিলাম ..... -শুভদা, তুমি চলে গেলে আমি কি নিয়ে থাকব? শুভদা দু'হাত বাড়িয়ে আমার মুখাটি চেপে ধরে কেঁদেছিল। বলেছিল, -পাগলী! তুই এমন করলে কি আমি যেতে পারি? -জানিনা শুভদা! তোমায় বড্ড ভালবাসি। এটুকুই জানি। শুভদা আমায় বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল। বলেছিলাম, -যদি আর কখনো না ফিরো! যদি আর তোমার দেখা না পাই?আমি মরে যাব শুভদা। যাওয়ার আগে কিছু তো রেখে যাও, কিছু একটা বলে যাও! শুভদা বলেছিল, -তুই আমার একটাই পাগলী, তুকে রেখে পালাবো কোথায়? শুভদা আমায় পরম স্নেহে, আবেগে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। তারপর কি হল জানিনা। আমি হাড়িয়ে গিয়েছিলাম এক অজানা স্রোতে। পালবিহীন নৌকা ভাসিয়েছিলাম অজানার পথে; শুধু আমি আর শুভদা! শুভদাতে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলাম সেই শীতের ভোরে। কূয়াশাদানার মত শুভদা আমায় সিক্ত করে দিয়েছিল সেই ভোরে। আমি ও কি চাইনি? সবটা কি শুধু তারই চাওয়া ছিল? পরদিন শুভদা উচ্চ-শিক্ষার জন্য চলে গিয়েছিল কলকাতা। আর ফিরে আসেনি। কত দিন গেল, কত রাত গেল, শুভদা এলনা। বাবা তার সন্মান হারাতে চাইলনা। অতশীর বাবার অস্তিত্বে সিঁদ কেটে তড়িঘরি আমায় ঢুকিয়ে ছিটকিনি এঁটে দিল। কত বড় অনাকাঙ্খিত প্রতারণায় তাকে জড়িয়ে রইলাম, মানুষটা টেরই পেলনা। আজ যাকে পরম যত্নে বুকে জড়িয়ে ঘুমুচ্ছে, সে তার রক্তকনিকা থেকে সৃষ্ট নয়! সে অন্য কারো দ্বারা সৃষ্টি! কারো পায়ের আওয়াজ পেতেই আচমকা চমকে পিছন ফিরি। অতশী চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে। ভোরের প্রথম চা আমার মেয়ের হাতে! আহ! কি যে সুখের! স্নিগ্ধ পবিত্র মুখখানি ঠিক শুভদার মত। আমি অপলক তাকিয়ে থাকি, বুকটা দুমড়ে-মুচরে কেঁদে উঠে। ১৯ বছর ধরে গোপনে বেড়ে উঠা আমার এক টুকরো সুখ অতশী, কঠিন সত্যের মুখোমুখী হলে হারিয়ে না যায়! পাপ! সে তো সুযোগ বুঝে ঢুকে পড়ে মনের ভিতর! তারপর ক্যান্সার প্রক্রিয়ায় বিঁষ ছড়ায় দেহে। তবে কি এক রাতের পাপই আমাকে আজ ১৯টা বছর কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে? যদি তা পাপই হয়, তবে ভালবাসার স্থান কোথায়? পাপ তবে কোনটা ছিল! শুভদার কাছে আত্মসমর্পন? অতশী? নাকি মুখোশের আড়ালে ভয়ানক অন্ধকার ঢেকে আজকের মানুষটাকে সুখী করা? সত্যের মুখোমুখী হতে আমার বড় ভয়! অতশী আমার। অতশী ওই বুকে জড়িয়ে বেড়ে উঠা নিষ্পাপ মানুষটির। এখানে শুভদার কোন স্থান নেই; কোন পরিচয় নেই। শুভদা! তুমি চলে যাও দূরে। যে পথের বাঁকে কেবল ধূলিমাখা বিরহ, তুমি হেঁটে যাও সে পথে। আমার খোঁজ করোনা তুমি। সব ভেসে যাবে! যে হ্নদয়ে অনন্ত বিরহ জ্বলে, সেখানেই থাকো তুমি। তুমি পর্দার আড়ালে থাকো।
💕শুভদা-২
শুভদাকে কথা দিয়েছিলাম, প্রতি ভরা পূর্নিমায় তাকে নিয়ে কবিতা লিখব। হেলায় হেলায় কত বসন্ত গেল। কবিতা লিখা হয়ে উঠেনি। যে বছর সালেয়া দিদির মা হাত ভরা সোনার কাঁকন পরে বেড়াতে এলো আমাদের বাড়ী, মা এর চোখ এক ভিষণ ভাললাগায় ঝলমল করে উঠতে দেখলাম। মা'কে কথা দিয়েছিলাম চাকরীটা হলে দুটো সোনার কাঁকন গড়িয়ে দেবো। আরো কতজন কে যে এই এক জীবনে কথা দিয়েছি, হিসেব নেই। রাখা আর হয়ে উঠেনি।চাইলেও পারিনা। মন যে কত কথা বলে! জীবন চলে নিয়মের গতিতে।জীবন থেমে থাকেনা। আমার এক জীবনের দেয়া কথা ,আমার আরেক জীবনের কষ্ট! কত রজনী গিয়েছে কেটে বর্ণমালায় সুঁই সুতো গুঁজে শব্দের মালা বানাতে চেয়েছি। হয়না। ফাগুনে ফাগুনে কতবার গাছের পাতা গিয়েছে ঝড়ে, কত বসন্তে কদমের ঘ্রাণে ধরনী উঠেছে কেঁপে! ভরা পূর্নিমায় অলৌকিক ইন্দু প্রভায় মানব সভ্যতা কতবার মেতেছে উল্লাসে তবু, আমি কথা রাখতে পারিনি। ধরনীর বুকে কারো কিছু যায় আসেনা। ভ্যাপশা গরমে চারিদিক উত্তপ্ত! জ্বানালাটি খুলবো কিনা ভাবছি! অতঃপর বন্ধ জানালটি খুলে দিলাম অনেক দিন পর! সেই যে কবে খিল দিয়েছিলাম, মনে নেই। যে বছর জামাল চাচার উঠোন সোনালী ধানে ভরে গেল। নাকি যে বছর কুসুমকে ভালবাসার অপরাধে পাথর মারা হয়েছিল! ঠিক মনে পড়ছেনা। আজকাল অনেক কিছুই মনে পড়েনা।
💕শুভদা-৩
যেতে যেতে অরণ্যকে সাক্ষি রেখে বলে যাই.... এইখানটাতে একটা শহর ছিল, শহরের গা ঘেঁষে পুরণো দেয়াল ছিল মুক্তস্বরে আর্তনাদ; মানুষ পোড়া গন্ধ ছিল ঠিক এইখানটাতেই শুভদা'র বসত ছিল। নির্জন প্রহর; আকাশের বুক ফুঁড়ে শোকগাঁথা তারই মাঝে আগুন লাগা সুগন্ধি বুকে শুভদা এসেছিল গোপন অভিসারে কূয়াশা ভোরে; বিনুনী টেনে নিষিদ্ধ ঘরে জিঘাংসার অস্থির চোরাস্রোতে নাভিমূলে পুঁতে দিয়েছিল এক অদৃশ্য প্রেম! বুকের ভাজে বুকের অসহনীয় উৎকন্ঠায় আমি কপালকুন্ডলা ছুটে যাই নীল ঘরে বাস্পিভূত নীলাজলের মোহনায়! শুভদা সেদিন বিস্ময়ভরে শান্ত বিলাপে এক মুঠো অভিশাপ ছুড়ে দিয়েছিল আমার হ্নদপিন্ডে। আজ বুকের জলে হাটু ডুবালেই কেবল নিষ্পেষিত কষ্টকাঁদা! মনে হয়..... মনে হয়, বুকের ভিতর বিঁষ ঢুকেছে; বিঁষজলে মৃত্যু তরী প্রাচীর ঘেরা দম্ভ ভেঙ্গে যথন তখন সে বিঁষেতে ডুবে মরি। যেতে যেতে অরণ্যকে সাক্ষি রেখে বলে যাই, এইখানটাতে শুভদা ছিল; আমার ভেতর কি যে পেল জলতৃষ্ণায় অনাহারে; হাটু গেড়ে বসেছিল!
💕শুভদা-৪
বুক ফাঁটা ক্ষররোদে জানালায় মুষ্ঠিবদ্ধ আংগুলের চাপ, অতঃপর অদৃশ্য দহনে বুকের পোড়া দাগ নিয়ে ছুটে চলি আঁধারের বনে। অস্থির মন ছুঁটে চলে ব্যাথার রাজ্যে! পিছনে পড়ে রয় কিছু সোনালী প্রহর; নৈঃশব্দে তিরতির করে বেড়ে উঠা অভিলাশ। ইদানীং রোজ ভাবি। ভেবে ভেবে চোখের পাতায় ক্লান্তি নামে। তবু মনে হয়, বেঁচে আছি এই তো বেশী। একদিন শুভদা বলেছিল, শোন রানু, তোর সুঢৌল কলমিলতা পায়ে এক জোড়া মল গড়িয়ে দেব! মনে পরে সেদিন ছিল আমার অবুঝ মনে স্বপ্নের বীজ বপন। অজানা এক ভাল লাগায় প্রতিদিন পুকুর ঘাটে গিয়ে বসতাম। পুকুর জলে পা ভিজিয়ে জল তরঙের খেলায় হাড়িয়ে যেতাম। আজ কেবল জলজ সংসারে কাঙ্গালের মত বুকের ভেতর টের পাই রূঢ় বাস্তবতার চাষাবাদ। স্মৃতির বালুচরে আঁছড়ে পড়া ঢেউ। টের পাই শূন্যতার উঠোনে সুতীব্র ক্রন্দনের অভিবাদন। শুভদা কথা রাখেনি। কেউ কথা রাখেনি। এ শরীর, এ মন, মনের দোসর..... কেউ কথা রাখেনি। আজ শুভদার ধার করে রাখা পায়ে মল বাজে না। আজ এ পায়ে পৃথিবীর নির্মম পরিহাস জড়িয়ে থাকে শিঁকলের গিঁটে গিঁটে। বন্ধ চার দেয়ালে সফেদ আবেশে কেমন মৃত গন্ধ পাই। ওরা আমায় বেঁধে রাখে। এত বলি, ও পায়ে শিঁকল নয়, ও পায়ে মল দেবো। শুভদা বলেছিল। ওখানে ছোঁয়োনা! কেউ শুনেনা। কেউ কথা রাখেনা। শেষের দিকে কি যেন হলো আমার। কেমন চুপটি মেরে গেলাম। মানুষের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠতে লাগলো। চতুষ্পদ প্রাণিগুলোকে অসহ্য লাগছিল। কারো শব্দ পেলেই দৌড়ে পালাতাম। কখনো উঠোন ছেড়ে ঘরে, কখনো ঘর ছেড়ে তেপান্তরে! প্রিয় মুখগুলো কেমন গায়ে জ্বালা ধরাতে লাগলো! সব কিছু ভুলে যেতে লাগলাম। মাথার ভেতর কেবল স্বশব্দে হাতুরীর ধমধম শব্দ পেতাম। মনে হতো ভূমন্ডল বুঝি এখনই উলট-পালট হয়ে যাবে! একদিন বাবার শেভ করার ব্লেড নিয়ে দিলাম ডান কান কেটে। টপটপ করে রক্ত ঝরে পরতে লাগলো। আমি টেরই পেলাম না। মনে হলো, টুকটুকা রঙে হাতে মেহেদী পরেছি! ইশ!! শুভদা যদি দেখতো! তারপর কি হলো জানিনা। শুধু নিজেকে আবিস্কার করলাম এ বন্ধ কামরায়। বিনুদি এসেছিল কাল দেখতে। ফিসফিস করে মা'কে বলছিল,আমি নাকি আর ফিরে যাবো না। শুভদা, কোলাহল থেকে দূরে, তোমার থেকে আড়ালে আজ কতদিন এ বন্ধ কামরায় পড়ে আছি। মন্দ লাগেনা। যন্ত্রণার গাড় নীলে শোকাহত হইনা আর। বিনি সুতোয় এ শুভ্রকোণ বাঁধা হয়ে গেছে আমার অদৃস্টের সাথে। শুধু একটা আকুতি শুভদা! তুমি এসো।ভুল করে হলেও এসো।চলে এসো বৃষ্টির কোন এক সন্ধ্যায, ভেঁজা মৃত্তিকার স্যতস্যাতে গন্ধ হয়ে উড়িয়ে যেও আমার দীঘল কালো চুল। আমার বুকে লেপ্টে থাকা নোনা কান্না হয়ে এসো। জ্বোৎস্নার এক ফালি আলো হয়ে এসো, নয় বিষাদে জড়ানো ক্লান্ত রাতের পর এক টুকরো আঁধার হয়ে এসো। আমার বুকের পাঁজরের কষ্ট হয়ে এসো। পায়ের শিঁকল খুলে মল গড়িয়ে দিয়ে যাও। কত বছর ও পা কাউকে ছুঁতে দেইনি মল পড়বো বলে। তুমি এসো শুভদা! কোন এক বিরহের মধ্যরাতে হৃদয়ের আর্তনাদ হয়ে এসো। ভুল করে এসো। তবুও এসো। কথা দিয়েছিলে! ও পায়ে মল দেবে! তুমি এসো। বিনুদি'কে বকে দিয়ে যেও।
💕শুভদা-৫
আঁধারে ও সুরেলা গন্ধে চিনে ফেলি তোমায় এখানে নয়, হয়তো আমার উল্টো পথে কোন এক শহরে আতর মাখা সুঘ্রাণ,পরিপাটি চুল বগলে ছাতা না হয়, প্রিয়তীর নরম সুডৌল হাত তুমি আছো, সে আছে; শুধু আমি নেই। শুভদা, মধ্যরাতে হেঁটে যাও তুমি আমার বুকের জমিন মাড়িয়ে হাত বাড়ালেই ছিলে তুমি; আজ দৃষ্টির অলক্ষ্যে। উপবাসী মন, এক মুঠো অনুতাপ ছুঁড়ে দেই বাতাসে তবু তোমায় না পাওয়ার আক্ষেপ মেটেনা। আর পারিনা শুভদা, বুকের পাটাতনে আঘাত করে করে তোমায় ডাকি সেদিন অমন করে মুখ না ফিরিয়ে অহংকারী আমার কপালের লাল টিপ ডলে দিলে, আজ ব্যথাতুর চিত্তে মুক্ত আকাশ দেখার সাধ হতো না। কি যে ভীষণ অনুতাপে, অষ্টপ্রহর নিষিদ্ধ বিলাপে তোমায় খুঁজে মনের ভিতর হু হু করে বাতাস ঢুকে, শাশ্বত সবুজ হলদে হয়ে ঝড়ে পরে হতাশার দুর্বোধ্য খেলায় বেদনায় নীল হতে হতে কালো বর্ণ তবু মনে হয়, তুমি আছো বুকের ঠিক বাম পাশে। অন্ধ হয়ে আছো মহাকালের ঘূর্ণায়নে হয়তো এখনি ছুঁয়ে যাবে হাত বাড়িয়ে; তাই মধ্যরাত অবধী জেগে থাকি। কষ্টের দামে আমায় চেয়েছিলে,এ মন প্রেম বোঝেনি তোমার বুকে জমাট বাঁধা অভিমান;উষ্ণ আলিঙ্গনে তোমার বুকের ব্যাথা বোঝেনি। শুভদা, আজ পৃথিবীর সকল নীল আমার বুকে শতকোটি বছরের তৃষ্ণায় তোমার বিমূর্ত অবয়ব, নীলের ভিতর কালোর মিশ্রণ, বাকরুদ্ধ চিৎকারে জানান দেয়; তুমি নেই। শুভদা, একদিন এইখানটাতেই হাঁটুগেড়ে বসেছিলে জলতৃষ্ণায় অনাহারে;আমার ভিতর কি যে পেলে!
💕শুভদা-৬
দেয়াল ফেটে গড়িয়ে পড়ছে জল, বল্কল ভেদে অকষ্ট-বদ্ধ বৃক্ষের ক্বাথে ভিজে যায় পথ নিরন্ন মনে যে পথ গিয়েছে বেঁকে সরলরেখা ছেড়ে রক্তিম ভূমধ্যে বিশুদ্ধ দুঃখ গোপনলীলায় আঁছরে পড়ে সেখানে। শুভদা, বলেছিলে শঙ্খচিলের ডানায় করে নিয়ে যাবে সমুদ্রস্নানে বৃষ্টিজলে ভেসে আসা ভ্রমরা মাতাল কদমের ঘ্রান, খুঁজে নেয় আদিগন্ত আকাশে বাষ্পীভূক নদীর জল প্রাপ্তীর স্বরলিপি লিখা হলে সময়ের ভাস্কর্য্যে; সবুজ অরণ্য ডানা মেলে উড়ে যায় আকাশে। পরিশেষে একাকী বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত, নাগালের বাহির থেকে নিঃসঙ্গতা জুড়ে গেলে আমার কপালে। শুভদা! বুক বেয়ে হামাগুড়ি দেয়া আমার নির্বিকার জীবন প্রত্যুষে জানান দেয় বিবর্ন সুখের খোঁজে নীলাকাশ কাঁদে একা একা জ্বলে যাই অন্ধকার রাতে, জমা হলে বোবা কান্না বুকের গহীনে; স্মৃতিরা বুক ফুঁড়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
💕শুভদা-৭
খর-কুটো পাতা যেখানেই পড়ে থাকে চুপিসারে জীবন বিনম্র বিষাদে চেখে দেখে নোনাজল আচমকা বাতাসে নড়ে উঠলে পত্রপল্লব; জেনে নেই এখনো নিঃশ্বাস সন্চালিত হয় বিদগ্ধ প্রাণে। অতশী ডেকে গেলে মমতার আবেশে বিস্মৃতির আড়ালে সেই নীল খাম মুখ খুলে দেয় দুঃখ জলের লহরীর। স্বস্তি খুঁজে নিতে বৃষ্টির প্রত্যাশায় বিভ্রান্তি খেয়ে যায় হ্নদয়ের পুরোটা। গল্পটা লুকাতে গেলেই পথ সরলতা হারায় দৃষ্টিসীমায় বিষাক্ত সাপ ফনা তুলে নির্বিকার অনুশোচনার মত কঠিন মৃত্যু বোধকরি ঈশ্বরের সংবিধানে কোথাও নেই। শুভদা, যে সবুজ হারিয়ে যায় কালের স্রোতে; তা কি ফিরে পাওয়া যায়?
💕শুভদা-৮
শুভদা, আজ জ্বানালার পাশে দাঁড়িয়ে দুটো হলদে পাতা বৃক্ষ তলে ঝড়ে পড়তে দেখলাম। দেখলাম, সবুজগুলো কেমন বুড়িয়ে যাচ্ছে। যতদূর চোখ গেল, শীতের বারান্দা জুড়ে শীর্ণ রোদ বেহায়া আলাপ জুড়ে গেল। খুপটি ঘরে একা একা কত সকাল,দুপুর,রাত এলো-গেলো। সবার অলক্ষ্যে সিঁড়ি ঘরে আরশোঁলা টিকটিকি সন্তান প্রসব করে গেল। এ ঘরে রৌদ্দুর পৌছেনি বহুদিন, জোৎস্না গিলে খাওয়া আঁধারের গল্প তবে বলি তোমায়, শোন। প্রদীপ জ্বেলেছি কবে ঘরে মনে নেই, ফুল-পাতা-শাখা স্পর্শের সঞ্চারে তোমায় খুঁজেছি কবে, তাও মনে নেই। যতটা মনে পড়ে, শিরিষের ডালে হিম ছোঁয়ায় মুখোমূখী দুটি আহত পাখী, বৃষ্টি জলে ভিজিয়ে দিল শ্রাবনের পুরো বিকেলটা। তেত্রিশ বছর আগে যেদিন পুঁতে দিয়েছিলে বীজ মাটি খুঁড়ে, সেদিন বাতাস ছিল, আলো ছিল, তাপ ছিল। তবু অঙ্কুরোদগমের আগেই সে মাটি খুবলে খেল কীট-পতঙ্গ। বাতাস থেমে গেল, আলো নিভে গেল, শৈত্য প্রবাহ তাপ গিলে খেল। কাল্পনিক স্বপ্নে আশা জাগানিয়া প্রেম, উবে গেল শূন্য উপত্যকায় জলজ জলীয় বাষ্প হয়ে। শুভদা, সব সময় প্রেমের কথা না বলে এসো আজ আঁধারের কথা বলি। এসো বলি আঁধারের নগ্নতায় বিষাদের ছাপের কথা। কফিনে বন্ধি উড়ে যাওয়া চিলের নৈঃশব্দিক পদচারণার কথা। শুভদা, তোমাকে আসল কথাই বলা হলোনা। আমার কথা, আমাদের কথা। এই বিছানার চাদরে পড়া চটচটা দাগের কথা। ভাঙ্গা কাপটায় এক হাজার দুইশত নয়বার শুষ্ক ঠোট ছুঁয়ে যাওয়ার কথা। তোমাকে বলা হয়নি, কতদিন খোলা মাঠ দেখা হয়নি। কতদিন আকাশ তলে ঘাসের ঘ্রাণে নিঃশ্বাস টানা হয়নি। কতদিন কল চেপে শীতল জলে মুখ ভেজানো হয়নি। তোমাকে আসল কথাই বলা হয়নি। শুভদা, এখানে আমার কেবল রাত হয়ে যায়।