টরন্টো, ৪ঠা কার্তিক ১৪২৭ বঙ্গাব্দ, নভো সংখ্যা ১৩
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি মার্জিনে মন্তব্য  যোগাযোগ আবৃত্তি

কার্তিকের কুয়াশা

কবিতার পাতা

 

 

নিশি লোর
ফিরোজা হারুন

নিশি লোর
ফিরোজা হারুন
রাত নিঝ্‌ঝুম, চোখে নাই ঘুম
করি কাব্যের সাধনা
ভেবে চিন্তে, রাত তিনটেয়,
কি যে লিখি করি ভাবনা।
রাত সুনসান, নেই কলতান,
দিবসের মতো ঝাঁজালো,
সারা চরাচর, নীরব নিথর,
কোথা দিয়ে রব হারালো?
বিহগেরা সব, ভুলে কলরব
ঘুমিয়ে পড়েছে নীড়ে,
ছোট তটিনীর, অভিমানী নীর,
বয়ে চলে ধীরে ধীরে।
থেকে থেকে কাঁদে, দু’প্রহর বাদে
সেই রাত জাগা পাখি,
চখা যে তাহার, হয়েছে ফেরার,
দিয়ে গেছে তারে ফাঁকি।
সেই বেদনার, ভার যে তাহার,
রয়েছে হৃদয় জুড়ে,
কোথা গেলে তারে, পাবে সে সখারে,
কোন সে অচীন পুরে?
নগর প্রান্তে, কে বা একান্তে,
বাজায় করুণ সুর,
বেদনা বিধূর, কোন বিরহির,
সেই বাঁশি সুমধর।
কেমন সে প্রিয়া, দেয়নি যে হিয়া,
হৃদয় নিয়েছে লুটে,
দেহটি তাহার, হয়েছে অসাড়
অন্তুর গেছে টুটে।
হৃদয়হীনার কাছে, প্রেম কি কভু আছে,
ছলনা তাহারই নাম,
প্রাণের মমতা, প্রেমের বারতা,
তার কাছে কিবা দাম?
গভীর নিশীথ –ঘোরে , কত ফুল ঝরে,
কত ফল যায় পড়ে,
কে করে সুমার, কে রাখে খবর,
এই সে আঁধারপুরে!

 

 

**************************************

করোটির রেখা
শিউলী জাহান


আমরা বরাবর চেনা পথেই হাঁটি
বিজন-নির্জন ঘুরে ঘুরে আবার চেনা মুখেই চোখ
আজকাল অচেনা পথ গুলো - বড় বেশি অচেনা,
অন্ধকারাচ্ছন, শ্বাপদসংকুল --
মীমাংসিত ঋতুর স্বাদ নিতে সহসাই ব্যাকুল
হয়ে ওঠে মধ্যাহ্নের নির্জনতা,
ছন্দের নিয়ম ভেঙেচুরে জীবন জেনেছে
কুয়াশাপথে এখন আর সন্ন্যাস ধর্ম নেই; নেই বৃক্ষবাড়ি
মগজের উত্তাপ নিয়ে পাখিদল নেমে এসেছে কাঁচের আলোয়।
এখন বিকেলের আনমনা বারান্দায় জীবনকে দেখতে ভালোবাসি,
সবুজ পুঁইয়ের ডগায় একফোঁটা বৃষ্টির নম্রতায় খুব ডুবে যাই,
পুরনো পকেটে রুমালের ভাঁজে চেনা সুগন্ধি
করোটির হাড়ে বিগত দিনের ক্যানভাস আঁকে।
সময় ও সভ্যতার চাকায় সচল কাঠঠোকরা
কৌতূহলও ক্লান্ত করে--ভারী চোখ; প্রত্যুষের শিশির,
অপেক্ষারত বইটির পাতা উল্টায় বিশ্বস্ত আঙুল
স্ব এবং নিজস্বতাই এখন আমাদের পরম নিরাপত্তা
মানুষ ও মনস্বিতার গুঞ্জনে কাছে ডাকি মানুষসত্তা।

 

**************************************

মেঘের দেশের মেয়ে

             ___ গোলাম কিবরিয়া

          

         

মেঘকন্যা মেঘের মেয়ে মেঘবতী নাম ।
তাঁর পায়ে সব লুটিয়ে পড়ে কি শহর কি গ্রাম ।
বলো কন্যা বলো তুমি কোথায় তোমার ধাম ?
সেই ঠিকানায় চাই পাঠাতে একটি রঙ্গিন খাম ।
সেই খামেতে দেবো পুরে আমার হৃদয়খানি ।
লুকিয়ে রেখো বুকের ভাজে না হয় জানাজানি ।
দুই হৃদয়ে বোঝাপড়া হবে পাশাপাশি ।
বলবে শেষে অনেক ভেবে তোমায় ভালবাসি ।

**************************************

বোধিনিরালার সংলাপ
রওশন হাসান, নিউইয়র্ক
 
রোদের কন্ঠহারে মাটিতে নেমে আসে আলোর ফুল
নরম ঘাসের বনজ ব্যাকুল গন্ধে জীর্ণ অন্তঃপুর
পাথর পলকে ভ্রাম্যমান মেঘ মুমূর্ষের জানালায় আপন করে নেয় প্রহরের মন্থরতা
হে নিঃসীম নগরী, কি গভীর শূন্যতায় করো হাহাকার ।
বিষন্ন কোটরে বন্দী আমি, অঙ্গসঙ্গে অসীম গগনের ।
কদমে কদম মিলিয়ে হাঁটবো বদল মওশুমে
সেতু টলমল, নীচে ঝিলের ঝলমলে নিতান্ত জল
আলগা বাতাসে গা ভাসিয়ে দূরান্তে ছুটে যেতে চাই
ছুটে যেতে চাই ।
একঘেয়ে বাড়ির দেয়াল, মূর্চ্ছাবিহবল বইয়ের স্তুপ
উদাস ঝরে নির্জনতা, আপোষী তৃষ্ণার ক্ষয়
গভীর কৌতূহলে ফুটে আছে টিউলিপ, ড্যাফোডিল
যেমন ফুটেছিল অজস্র রডোডেনড্রন রঙিন গালিচার মতো, পাহাড়ের পাদদেশ জুড়ে, অনাথ বালকের অন্তর্নিহিত মায়ের গল্পে ম্যানভিল ছিলো এক অদৃশ্য মায়ের রাজ্য ।
বনানী বৃক্ষ ছেয়ে পাখিদের কোলাহল ধূসর, লাল, হলুদ
পালকে ভর করে এদেশ ওদেশ, দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া গোধূলি ওম
আকাশের শেষরেখায় চোখ রেখে শ্বাস ফুরাবার আগে অশান্ত ছুটে যেতে চাই, ছুটে যেতে চাই ।
বালিয়াড়ি ছুঁই ছুঁই পুরনো দিন, ডেজার্টেট ল্যান্ড
প্রতিটি মুহুর্তের ভেতর জীবন আঁকড়ে থাকা নিঃশ্বাস
সকালগুলো বন্দী ফুলদানিতে, সন্ধ্যা ক্যান্ডেলে পোড়ে
তুমুল খোলা তীর ঘেঁষে ছুটে যেতে চাই ছুটে যেতে চাই
স্রোতের সেতারে ঝিনুকের অনন্ত চুম্বনে
একঝাঁক অতল সৈকত গর্জন কুড়াতে চাই ।

**************************************

তোমাতেই

সীমু আফরোজা 

 

 

ঝরনা যেমন প্রবাহিত হয়
তেমনি আমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাব তোমার হৃদয় ,
প্রজাপতির মত ঘুরে বেড়াব তোমার পাশে পাশে।
প্রবাহিত হব জলপ্রপাতের মত
করে তোমায় মুগ্ধ ।
বেলি নয়তো শিউলির ডাঁট ছিড়ে
গুঁজে গুঁজে গেথে নিও মনের অধরে ।
ঘাস ফড়িংয়ের মত চপলতায়
ভেজাব পা কচি ঘাসের ডগায়
হিমেল হাওয়ায় উড়না উড়িয়ে ,
রেশমি কাঁকন রিমঝিমিয়ে
ভরে দেবো তোমার অবুঝ মন ।
পুর্নিমার আধো আলোয় ভরে গেছে
শিমুল গাছের পাশে ঈশান কোণ।
অপ্সরা এক মায়াবী রাতে ,
হাসনাহেনার আতর ঢেলে
হাওয়ায় উড়বে সোনালি আঁচল ,
তুমি পাহাড়ের পথ কেটে ধীর পায়ে
আমায় এসে করবে আলিঙ্গন ।

********************************

নীল পালক

 লীমা জামান শিল্পী

জানালার চতুর্ভূজে একখন্ড আকাশ
কিছুটা ঝুকে রুপোলী চাঁদের বুকে বিষন্ন মেঘ, প্রতিবেশী কয়েকটি তারা।
নক্ষত্র মানেই নষ্টালজিয়া। যে দুঃখের
জলে ভেসে চলেছে জীবনের ছিদ্র নৌকো
ক্লান্ত হাতে জল সেঁচে সেঁচে যেটা আজো বহমান। সে দুঃখ সে অভিমান সে নির্বাসন চন্দন! চন্দন সন্ধ্যার ঘাষে হেঁটে হেঁটে আমাকে নক্ষত্র চেনাতো। বলতো "মৃত্যু মানুষকে তারা বানিয়ে দেয়। ওদের ভালোবাসলে মৃত্যুকে ভালোবাসা যায়.....!" হায় ঈশ্বর! তুমি যদি ওর আয়ুর প্রতি আর একটু যত্নবান হতে তবে এতোদিনে সময়ের পথ পার হয়ে ওর
সব কথার একটা বটগাছ মস্তিষ্কের মাটি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে যেতো। হয়তোবা কল্পনার
সেই আত্মজের কবলে পড়ে, বিপরীতে অবস্থানের অনিবার্যতায় বার বার রোপিত হতো না কষ্টহীন রাতের শেষে
একটি ভোরের তীব্র আকাংখার বীজ।
আকাশের ছোট্ট উজ্জ্বল নক্ষত্রটির দিকে চেয়ে ভাবছি মৃত্যুর অন্য নাম যদি নক্ষত্র
তবেতো ভরাট হয়ে যাবে ঐ মহাকাশ।
যুক্তি ঝাপসা সুতোয় জাল বুনছে
ওলোট পালোট।
ইউনিভার্স কি বেড়েই চলেছে...
ধুত্তোরি ঐ তারাটি যে ঝরে পড়লো!
কষ্টে চোখে জল এলো কী? যদিও দূরত্ব
তবুতো মুখোমুখি চেয়ে থাকা।
আরে কী আশ্চর্য তারা কোথায়
ওটা তো একটা নীল পাখি
অবিকল যেন ছোট্ট ময়ূর!
ময়ূর কি উড়তে পারে আকাশে? চতুর্ভূজ আকাশটাই বা এতোটা বিশালতা
পেলো কেমন করে?
অপূ্র্ব জোসনায় মেলেছে পেখম
অদ্ভূত ছন্দে উড়ছে নীল পাখি
নীল ডানায় সোনালী ছবি আঁকা।
এ তো দেখছি ম্যাজিক,পাখি ধরা দিল আমার জানালায়। একটি পায়ে ধরে আছে অচেনা একটি ফুল।
চন্দনের গন্ধে ভরা সে ফুল।
সুন্দর পালকে আমার আঙ্গুলের অক্টোপাস। আহ্ আহ্লাদী পাখিটির
ভেঙ্গে গেল ডানা। সেই সাথে অপরাধে ভেঙ্গে চূর এ ফাটা মানবিক হৃদয়।
বৈদ্যূতিক পাখার শশ্রূষা কার্পেটের শয্যা
পেয়েও কেন সে নিস্তব্ধ নিথর?
ভাবনার প্লাবিত শেকড় বাকড় দু 'পায়ে ঠেলি। বন্ধ চোখে টের পাই পাথর কুচির ছুঁড়ে দেয়া অভিশাপ।
চোখ মেলেছি ঘর ভর্তি অসংখ্য শালিখ কবুতর একঝাঁক বুনোহাঁস টুনটুনি চড়ুই
এমনকি মুরগীও ছানা সমেত।
শোক সভায় ব্যথিত হলাম
তিরস্কারে বিদ্ধ করি ...
সুন্দরের মৃত্যু যদি তবে তুমি কুৎসীত ঈশ্বর! অসাবধানে বাম চোখের এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে নীল রঙ্গা
লাশের মাথায়। নীল পাখি উঠে এলো বুকের অলিন্দ জুড়ে। ভেঙ্গে গেল শোকসভা। ভাবছি দেরাজে লুকোনো
চন্দন কাঠের মালাটি দেবো ওকে। কিন্তু পোড়া চোখে যাদুকরি ঘুম। না চোখ মেলতে পারছি না
চাঁদটার যে আড়ি আছে ভারি কেন সে বিলোয় অমন দাউ দাউ আলো
যে আলোয় চোখ পুড়ে যায়।
কে অমন ভারী হাতটা রেখেছে মাথায়?
"লক্ষী মেয়ে জলদি ওঠো নাস্তা খেয়ে নাও আমি চললাম। "
চোখ মেলি, চাঁদ তো নয় সূর্যের আলো ঘরদোর বিছানাময়।
তেতোমুখে জলের ঝাপটা। টলোমলো পায়ে দীর্ঘ আয়নায় মুখোমুখি নিজের।
আজ চোখ দুটোকে পড়তে হবে। এ চোখে স্বপ্নে গল্পের প্লট সাজায় কোন সে গল্পকার? রং বেরং স্বপ্নে ধোয়া এ চোখ মহাকাল ব্যেপে জ্বলবে কি? (স্বপ্ন তো অবাস্তব মিথ্যে। মিথ্যের আয়ু তো সুদীর্ঘ নয়। )হঠাৎ চোখে পড়লো,
একেবারে সত্যি, বাস্তব
আমার এলো খোপায় গোঁজা
একটি সোনালী ছবির নীল পালক!
~১৯৯৬~
সিলেট

**************************************

প্রত্যয়
শাহরিয়ার রুবাইয়াত

______________

একবার মুগ্ধ হবার প্রত্যয়ে
শব্দ বাহকের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম গোধূলি অবধি,
স্পষ্ট দেখেছি-
ইচ্ছের কৌশলে আঁকা অভীষ্ট নিনাদ।
তোরঙ্গের চোখে দূরবীন লাগানো নৈসর্গিক প্রহেলিকা
জ্যোতির্ময় আকাশে জোনাকির পিদিমের মত।

প্রথম শব্দে চিনে নিয়েছি প্রবঞ্চনা;
পরগাছার অঙ্গনে দিগন্ত বিস্তৃত পরাগায়ন
মাতালের মত অন্তকের ছেড়ে আসা প্রবৃত্তির ভ্রূণ।

আকাঙ্খার দূর্গে জমা হয়েছে অসহিষ্ণু শৈবাল।
পীতাভ পুস্পের পরাগত কামনায়
ভিজে গেছে শব্দের মলাট;
জৈবিক নৈবেদ্যর অক্ষর বুননে।

আর একবার মুগ্ধ হতে পারি-
যাপিত প্রান্তরের পড়ন্ত রোদ্দুরে,
শব্দ বাহকের ধমনি ছিঁড়ে দিয়ে
সন্ধ্যার নির্জনে সম্বিত সমাপ্তির বিষণ্ন অসাড়ে।

__________________
২৭ জুলাই ২০২০

***

এ পৃথিবী আমাদের নয়

সাগর জামান

 

অচেনা  পৃথিবী আমাদের চেনা পৃথিবীকে গিলে ফেলেছে একেবারে । 
উন্মোচিত সড়কে মানুষের শোরগোল নেই,হাওয়া আর রোদ্দুরের সাথে সংস্রব নেই। 
বন্ধুত্বের সেতুবন্ধ গুড়িয়ে গেছে।
শূন্যতা বেড়ে গেছে বেয়াড়া করোনা কবলিত পৃথিবীতে । 
এ পৃথিবী আমাদের নয়,আমাদের পৃথিবীর চেহারা এমন  ছিলো না কোনোকালে। 
আমাদের কল্লোলিত জীবনে এখন  রাতের নিঝুমতা। 
আতঙ্ক আর উদ্বেগের নিদারুণ নিপীড়নে কোলাহল মুখর  ছক থেকে আমরা সরে গেছি, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। 
ক্রমশঃ একা হয়ে গেছি। 
এমন একাকীত্বের শূন্যতাময় পৃথিবী আমাদের নয় ।

 

 

***

যে অরণ্যে
সাইদুজ্জামান

আমিতো নই সত্যিকারের কবি,
বুকের ভেতর তবু, রেখেছিলাম তোমার রঙ্গিন ছবি,
ভেবেছিলাম তুমিই বুঝি আমার শশী, আমার রবি,
তুমিই আমার হারিয়ে যাবার বিরাট অটবি।

হঠাৎ দেখি আকাশ ঘন কালো,
হারিয়ে গেলো চাঁদের মৃদু আলো,
ঠিক যখনি কথা ছিল বাসতে তোমায় ভালো,
এবার তুমি চোখের তারা জ্বালো,
ডাকো আমায় আরও একটু নম্র, তবে দীর্ঘস্বরে,
লণ্ডভণ্ড বুকের ভেতর - দীর্ঘদিনের ঝড়ে,
সমগ্র দাও শরীরে উত্তাপ – বড় শীত করে,
মৃদু দাও ঢেউ জলে, আনন্দ সরোবরে।
টরন্টো, জুলাই ২৪, ২০২০