✍ জয়া চক্রবর্তী সোমার দুটো গল্প
সে আছে
সবাই ঠিকই বলে জানেন। জন্ম মৃত্যু বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে। আমার চেয়ে এটা
আর কে ভালো জানবে। এই যে তুলতুলের জন্ম, তার কয়েক ঘন্টার মধ্যে
তুলতুলের মায়ের মৃত্যু আর তার ছয় মাসের মাথায় আমার তুলতুলের বাবার সাথে
বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে আসা সবটাই তো বিধাতার অমোঘ নির্দেশেই হয়েছে। না হলে
আমার মত মুখের একদিকে শ্বেতীর এমন বিচ্ছিরি দাগ সত্ত্বেও কে আর যেচে
আমায় বিয়ে করত। তুলতুলের বাবার সঙ্গে বিয়ের আগে আমার কথা হয়েছিল। ও
বলেছিল-" আপনাকে কিছু গোপন করব না। তুলতুলের মা আজও আমার জীবনটা জুড়ে
আছে। হয়ত আজীবনই তাই থাকবে। এই বিয়ে করার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে
পারতাম না যদি আমি একা মানুষ হতাম। আমি শুধু এই বিয়েটা করছি আমার মেয়ে
তুলতুলের জন্য। আমার স্ত্রী নয়, তুলতুলের মায়ের প্রয়োজন।" তুলতুলকে
প্রথম দেখাতেই আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ভদ্রলোকের কথার স্বচ্ছতাও আমার
ভালো লেগেছিল। মৃতা স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসায় শ্রদ্ধাও হয়েছিল৷ তাই সব
জেনেই বিয়েটা করি। বিয়ের পর থেকে তুলতুলের বাবা অবশ্য আমার প্রতি কোন
কর্তব্যে ত্রুটি করেননি। আমি জানি ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে আমাদের
মধ্যে ভালোবাসাও জন্মাবে। আমি অধৈর্য নই। আর তাছাড়া তুলতুলের মা হয়ে
উঠে আমি সুখীই হয়েছি। বাচ্চাটা ভীষণ মায়াবী। আমি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবতে
পারিনি যে তুলতুলের মত একটা মিষ্টি বাচ্চাকে নিয়ে আমার জীবনে এমন
অদ্ভুত সমস্যা সৃষ্টি হবে। ঘটনাটা প্রথম ঘটে আমাদের বিয়ের পরের পরেরদিন
দুপুরবেলা। আমাদের রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়েছিল। একটা দুর্ঘটনার পর বলে
অনুষ্ঠানের কোন আয়োজন করা হয়নি৷ ঘরোয়া ভাবে নম নম করেই সব হয়েছিল।
বিয়ের পরেরদিনেই যে দুএকজন আত্মীয় এসেছিলেন তারাও চলে গেলেন। বাড়িতে
রইলাম আমি তুলতুল আর পার্বতীদি নামের একজন মহিলা। উনি একাধারে তুলতুলের
আয়া অন্যদিকে ঘরের কাজে সাহায্যও করেন। দুপুরে আমার চোখ লেগে গিয়েছিল৷
তুলতুলও আমার পাশেই ঘুমিয়েছিল। আমি ওর গায়ে আলতো হাত রেখে শুয়েছিলাম
যাতে ও উঠে পরলে টের পাই৷ হঠাৎ তুলতুলের খিলখিল হাসির শব্দে আমার ঘুম
ভেঙে গেল৷ আমি দেখলাম কখন ঘুম ভেঙে উঠে তুলতুল উপুড় হয়ে দরজার দিকে
চেয়ে কাউকে দেখে হাসছে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকিয়ে কাউকে
দেখতে পেলাম না৷ তবে দরজায় ঝিনুকের মালার পর্দাটার দোলা দেখে বোঝা যায়
কেউ ছিল ওখানে। পার্বতীদিই হবে। কিন্তু আমি তাকাতে চলে গেল কেন? তখনই
পার্বতীদির নুপুরের শব্দ কানে এল৷ সিঁড়ি দিয়ে নামছে দোতলা থেকে। হাতে
শুকনো কাঁথাকানি জামাকাপড় এক গাদা৷ বোঝাই যায় শুকনো কাপড় তুলতে ছাদে
গিয়েছিল। কিন্তু তাহলে দরজার কাছে কাকে দেখে হাসছিল তুলতুল? এমন সময়
একটা বিড়াল হাই তুলে বারন্দা থেকে উঠোনে নেমে গেল৷ আমি ভাবলাম হয়ত
বিড়ালটাই ছিল। ওকে দেখেই তুল্পতুল হাসছিল। আর ওর ধাক্কা লেগেই পর্দা
দুলছিল। আমি ব্যাপারটা ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার একদিন পরের একটা
ঘটনায় আমি চমকালাম। আমি আমার ঘর সংলগ্ন বাথরুমে স্নানে গিয়েছিলাম।
পার্বতীদি বাচ্চাকে নিয়ে বিছানায় বসে খেলছিল৷ হঠাৎ রান্নাঘরে প্রেসার
কুকারে সিটি ওঠায় তুলতুলকে রেখেই উঠে গেল। তুলতুল গড়িয়ে গড়িয়ে
বিছানার একদম ধারে চলে এসেছিল। আমি ঠিক সেই মুহূর্তেই বাথরুম থেকে বের
হচ্ছিলাম। তুলতুলকে খাটের একদম কোনায় দেখে আমি আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলাম।
আর এক পাক খেলেই তুলতুল বিছানা থেকে মাটিতে পড়ে যাবে। আমি বাথরুম থেকে
ছুটে গিয়েও ধরতে পারবো না। রান্নাঘর থেকে পার্বতীর ছুটে আসতে আসতে
তুলতুল পড়ে যাবে আর এক পাক খেলেই। আমার চোখের সামনে তুলতুল পাশ ফিরল।
আর তখনই অবাক হয়ে দেখলাম বিছানার কোনে রাখা বালিশটা নিচে মাটিতে পড়ে
গেল। বালিশটার সঙ্গে তুলতুলের কিন্তু কোন ছোঁয়া ছিল না৷ বালিশটা নিজে
নিজেই মাটিতে পরল। মনে হল যেন কেউ বালিশটা তুলে মাটিতে রেখে দিল। না
হলে কোনার দিকে রাখা বালিশটা কিভাবে ঠিক সেই জায়গাতে এসে পড়ে যেখানে
তুলতুল মাটিতে পরল। তুলতুল পড়ে গেলো ঠিকই কিন্তু মাটিতে নয় ওই নরম
বালিশ তার ওপরে। আমি ছুটে গিয়ে তুলতুলকে কোলে তুলে নিলাম। তুলতুল
কিন্তু দিব্যি হাসছে। ওকে দেখে মনে হলো আমার কোলে উঠে ও আমার পিছন
দিয়ে কাউকে দেখে একটা হাসছে। আমি পিছন ঘুরে দেখলাম সাদা দেওয়াল ছাড়া
সেখানে কিছু নেই। আমার কেমন গাটা শিরশির করে উঠল সেই প্রথম। পার্বতীদিও
আমার আতঙ্কিত চিৎকার শুনে রান্নাঘর থেকে ছুটে এসেছে। আমাকে তুলতুলকে
কোলে নিতে দেখে হাঁফ ছেড়ে বলল-" যাক বাবা ব্যাথা পায়নি। কেমন হাসতেছে
দেখো টেডিটাকে দেখে। এবার আমি খেয়াল করলাম আমার পিছনে একটা টেডি
বিয়ার দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা রয়েছে। তুলতুল কি সেটা দেখেই হাসছিল?
কিন্তু আমার যেন ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে মনে হয়েছিল ও সাদা দেয়ালের
দিকে তাকিয়ে হাসছে। মনে একটা অস্বস্তির কাঁটা বিঁধে রইল আমার। দৃশ্যটা
আমার মন থেকে কিছুতেই যেন সরছিল না। এরপর আমি তুলতুলকে আরো আমার কাছে
কাছে রাখতে লাগলাম। বিকেলের দিকে আমি তুলতুল আর পার্বতীদি সামনের ছোট
পার্কটায় হাঁটতে যাই। তুলতুল ওখানে বাচ্চাদের খেলা করতে দেখলে খুব খুশি
হয়। আমারও ওকে হাসতে দেখলে খুব ভালো লাগে। সেদিন পার্কে আমার সাথে
মৌমিতা বৌদির দেখা হল। উনিও এই পাড়াতেই থাকেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করতে
লাগলেন নতুন এ বাড়িতে এসে আমার কেমন লাগছে। তুলতুল পার্বতীদির কোলে
ছিল। আমরা পার্কের একটা কোনার দিকে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। একটু পরে
মৌমিতা বৌদি চলে যেতে আমি পার্বতীদির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম।
তুলতুল পার্বতীদির কোলের থেকে পাঁচিলের দিকে তাকিয়ে আঙুল তুলে কিছু
একটা বলার চেষ্টা করছে। যেন মনে হচ্ছে কাউকে কিছু একটা বলছে ও। কিন্তু
কার সাথে কথা বলছে ও। তুলতুল কথা বলতে শেখেনি। কিন্তু মুখে নানা রকম
শব্দ করে। আমি আবারও ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম পার্কের কোনার
দেবদারু গাছের নিচে। যেন মনে হল কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। আমি দ্রুত
সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম আমারই মনের ভুল। গাছের ছায়াটাই গাঢ় ঘন
হয়ে পড়ে ওখানে অমন আলো-আঁধারির সৃষ্টি করেছে। ফেরার পথে পার্বতীদিকে
বললাম -"আচ্ছা পার্বতীদি তোমার চেনা জানা কোন পুরোহিত আছেন? পার্বতীদি
অবাক বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল -" তা আছেন কিন্তু কেন বৌদি?"
আমি বললাম -"বাচ্চাটা জন্মের পর দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাই ভাবছিলাম যদি একটা
মাদুলি তাবিজ দিতেন, গায়ে থাকলে ভালো হত। " পার্বতীদি ঘাড় নেড়ে বললেন
-"আমি কালই ব্যবস্থা করব। " কিন্তু পরের দিন পার্বতী দি এল না।
পার্বতীদি সাধারণত কামাই করে না। আমি একটু বিপদেই পড়ে গেলাম। একা হাতে
রান্নাবান্না ঘর সংসারের কাজ করে বাচ্চা সামলানো একটু কঠিন। তুলতুলের
বাবা বলল-" আমি বরং আজকের দিনটা ছুটি নিই।"
আমার ভারী লজ্জা করল। নিজেকে কেমন অপদার্থ মনে হলো। আমি বললাম-" না না
তার কোন দরকার নেই। আমি ঠিক সামলে নেবো। " সেদিন আর বেশি কিছু রান্না
করলাম না। তুলতুলকে নিয়ে সারাদিনই ব্যস্ত রইলাম। বিকেলের দিকে
পার্বতীদির ছেলে এসে খবর দিল পার্বতীদি নাকি কোন এক পুরোহিতের বাড়ি
গিয়েছিল। ফেরার পথে একটা গর্তে পা পড়ে বিশ্রী ভাবে পা মচকে গেছে।
ডাক্তার দেখিয়েছে। ডাক্তার বলেছে দুটো তিনটে দিন বিছানাতেই থাকতে। আমি
পার্বতীদির ছেলের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললাম ওষুধপত্র কিনে দিতে। মনটা
খারাপ হয়ে গেল। পার্বতীদি মানুষটা বেশ ভালো। হঠাৎ মনে হল পার্বতী
হয়তো তুলতুলের জন্য তাবিজটাই আনতে গিয়েছিল। তাবিজটা তুলতুলকে পড়ানো
হলো না। মনটা অস্বস্তিতে ভরে গেল। তুলতুলের বাবা ফিরতে আমি তুলতুলকে ওর
বাবার কাছে রেখে বললাম -" আমি চট করে পরের দিনের বাজারটা করে নিয়ে
আসছি।" পার্বতীদিই বাজার করে। এখন আমাকেই করতে হবে। বাজারে গিয়ে অল্প
কিছু সবজি কিনে একটা রিকশা নিয়ে চলে গেলাম পার্বতীদিদের বাড়িতে।
পার্বতীদির বাড়ি চিনতাম না। জায়গাটা জানা ছিল। খোঁজ করতে করতে অবশেষে
পৌঁছালাম। আমি খোঁজ নিতে এসেছি দেখে তো পার্বতীদি অবাক। আমায় কোথায়
বসাবে ভেবে পায় না। দেখলাম সত্যিই পাটা ফুলে ঢোল। আমি একথা সেকথার পর
কথায় কথায় জানতে চাইলাম পুরোহিতের কাছে পার্বতীদি হঠাৎ গিয়েছিল কেন।
পার্বতীদি বলল-" তুলতুলের তাবিজখানাই আনতে গেছিলুম গো বৌদিমুনি। ফেরার
পথেই এই বেপত্তি। এই দেখ আঁচলে তাবিজখানা এখনও বাঁধা।" পার্বতীদি আমার
হাতে তাবিজটা দিল। আরো একটু বসে আমি তাবিজটা নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম।
এখানে সরু গলি। একটু হেঁটে গিয়ে সামনে থেকে রিক্সা নিতে হবে। আমি
সেদিকেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে একটা সাইকেল এসে ধাক্কা মারল আমার
হাতে। আমার হাতের ব্যাগটা ছিটকে পরে গেল। আশ্চর্য আমার যত জোরে লাগল সে
আন্দাজে প্রায় ব্যথাই লাগেনি। শুধু ব্যাগটা ছিটকে গিয়ে পরেছে। আশপাশের
বেশ কয়েকজন ছুটে এলো আমার কাছে। যে ছেলেটির সাইকেলে ধাক্কা লেগেছে সে
তার সাইকেল সমেত উল্টে পড়ে আছে। সে বেচারা থতমত খাওয়াব মুখে উঠে
দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইতে লাগলো-" সরি বৌদি। আমি টাল সামলাতে পারিনি। কি
করে যে এমন হল। মনে হল কেউ যেন আমার সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে ঘুরিয়ে
দিল। আপনার খুব লেগেছে?" আমি বললাম-" না ঠিক আছে। " পথচারী একজন
ব্যাগটা তুলে এনে আমার হাতে দিলো। দেখলাম ব্যাগের চেইনটা আধখোলা ছিল আর
তাবিজটা সেখান থেকে বিপদজনক ভাবে ঝুলছে। আরেকটু হলেই ওটা হারিয়ে যেত।
আমার কেমন ভয় ভয় করলো। আমি ওটা ব্যাগ থেকে বার করে নিজের হাতের
মুঠোয় চেপে ধরলাম। সারা রাস্তা একটা অস্বস্তি মনের মধ্যে লেগে রইল।
পার্বতীদিও বলেছিল ওর মনে হয়েছিল কেউ ওকে যেন ধাক্কা দিয়েছে। না হলে
ওখানে যে গর্ত আছে সেটা পার্বতী আগে থেকেই জানত। ভীড় রাস্তায় আর কোনো
বিপদ ঘটল না। তবে মেইন রোড থেকে গলিতে ঢোকার পর গা টা শিরশির করে উঠল।
কেউ কোথাও নেই। তবু যেন মনে হচ্ছে কেউ দেখছে আমায়। মুঠো শক্ত করে আমি
বাড়ি ফিরলাম। কোথায় গিয়েছিলাম তুলতুলের বাবাকে কিছু বললাম না। হাত মুখ
ধুয়ে এসে তুলতুলকে পরাতে গেলাম তাবিজটা। তুলতুল এমনিতে হাসিখুশী
বাচ্চা। খিদে ঘুম না পেলে একেবারেই কান্নাকাটি নেই। কিন্তু আজ তাবিজটা
নিয়ে ঘরে ঢুকতেই ডুকরে কেঁদে উঠল তুলতুল। তুলতুলের বাবাও অবাক হয়ে গেল।
তাবিজটা পরাতে যেতেই বারবার হাত সরিয়ে নিল তুলতুল। তুলতুল ওর বাবার
কোলে অনবরত কেঁদে চলেছে। আমার যেন মনে হল তুলতুল ঠিক নিজে থেকে হাত
সরাচ্ছে না৷ কেউ যেন ওর হাত সরিয়ে দিচ্ছে। আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে
উঠল। তুলতুলের বাবা অবশ্য মেয়ের কান্না থামাতেই ব্যস্ত। কিছুতেই তাবিজ
পরাতে পারছি না দেখে ওর বাবা বলল-" এখন থাক পরে পরিও। " বাধ্য হয়ে আমায়
সরে আসতে হল। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না। তুলতুলের বাবা বলল-" মেয়ের মনে
হয় শরীর ভালো নেই। কাল বরং আমি ছুটি নিই। চল একবার চেক আপ করিয়ে আনি।"
আমি বললাম -" আচ্ছা।" অনেক রাতে তুলতুল ঘুমালো। তুলতুলের বাবাও মেয়ের
পাশেই ঘুমিয়ে পরেছে। আমি কিছুক্ষণ তুলতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
তারপর মনে মনে প্রাণপনে ইষ্টনাম জপ করতে করতে তাবিজটা বার করে পরিয়ে
দিলাম তুলতুলের গলায়। তুলতুল ঘুমের মধ্যেও কেঁপে উঠল। তাবিজটা পরিয়ে
আমি নিশ্চিন্ত হলাম। ঠাকুর প্রণাম করে শুয়ে পরলাম। ভোর রাতে তুলতুলের
কান্নায় ঘুম ভেঙে গেল৷ তুলতুল ঘুমের মধ্যে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে। আমি
কোলে নিয়ে ভোলাতে চেষ্টা করলাম। তুলতুলের বাবাও চেষ্টা করল। কিন্তু
তুলতুলের কান্না থামল না। একটু চুপ করে আবার কাঁদে। পরেরদিন ডাক্তারের
কাছে নিয়ে গেলাম৷ ডাক্তার অনেক পরীক্ষা করে বললেন-" ও কার কাছে থাকে?"
আমি বললাম-" আমার আর ওর আয়া পার্বতীদির কাছে। তবে পার্বতীদি আসতে
পারছেন না অসুস্থতার জন্য। " ডাক্তার বললেন-" আমার মনে হচ্ছে ও ওই
পার্বতীর জন্যই কান্নাকাটি করছে। ওর আপাত কোন শারীরিক সমস্যা নেই।
বাচ্চারা যার কাছে অভ্যস্ত হয়ে যায় তার থেকে দূরে থাকলে এমন করে। আসলে
অভ্যাসের ব্যাপার। " তুলতুলের বাবা সেদিন সারাদিনই তুলতুলের সাথে রইল।
মেয়ের অবস্থার কোন উন্নতি নেই। পার্বতীদির জন্য হেদিয়ে মেয়ের অসুখ
করেছে এটা মানতে আমার অসুবিধা হচ্ছিল। কারণ পার্বতীদি সারাদিন যখন বাড়ি
ছিল না তখনও মেয়ে দিব্যি হাসিখুশী ছিল৷ কান্না শুরু হল তাবিজ পরানোর পর
থেকে। আমি রান্না ঘরে দুধ গরম করতে করতে এসবই ভাবছিলাম। তুলতুলের বাবার
গলা পেলাম -" শুনছ, এদিকে এস। মেয়ে তোমায় খুঁজছে।" আমি তাড়াতাড়ি দরজার
কাছে এসে থমকালাম। আমার মনে হল তুলতুল দরজার দিকে হাত বাড়িয়ে কাউকে
দেখে কাঁদছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি সামনে। তাই ওর চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে
মনে হল সে যেন আমার পিছনে কারোকে দেখছে। তুলতুলের বাবা ওর পিছন থেকে
ওকে ধরে রেখেছে। তাই ওর দৃষ্টি অনুসরণ করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। তুলতুলের
বাবা বলল-" ওই তো মা এসে গেছে। চুপ কর মা।" আমার ভিতরটা কেমন কেঁপে
উঠল। তুলতুলের মা। আমি নাকি ওর নিজের মা? কে আসে ওর কাছে? আমি দ্রুত
ঘরে গিয়ে কোলে তুলে নিলাম তুলতুলকে। দরজার দিকে হাত বাড়িয়ে তুলতুল তখনও
কেঁদে চলেছে। বিকেল থেকে কেঁদে কেঁদে মেয়ের জ্বর এসে গেল। তুলতুলের
বাবা ডাক্তারকে ফোন করলেন। উনি প্যারাসিটামল দিতে বললেন। মেয়ে জ্বরের
ঘোরে ঘুমিয়ে আছে। তবু তারই মধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে। ওর বাবা সেই
ভোর রাত থেকে মেয়েকে নিয়ে জাগা। তাই তারও চোখ লেগে গেছে৷ আমি চুপ করে
মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বসেছিলাম। আজ বাইরে ঝোড়ো হাওয়া বইছে। হঠাৎ মনে
হল যেন একটা ফোঁপানির শব্দ কানে এল। তুলতুলের না। বারন্দা থেকে আসছে
যেন। কিন্তু ওখানে কেউ নেই। হয়ত হাওয়াই এমন শব্দ তুলছে। তীব্র
অস্বস্তিতে ভরে আছে আমার মন। বাইরেটা অন্ধকার। কিন্তু বিদ্যুতের
ঝলকানিতে মাঝে মাঝে ফালা হয়ে যাচ্ছে আকাশ। খুব জোরে কাছাকাছি কোথাও বাজ
পরল। তুলতুল চমকে উঠল। চেপে ধরল আমার আঙুল। বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠল
আমার। মনে হল বারন্দার ফোঁপানি যেন আরো স্পষ্ট। একই সঙ্গে একটা শিরশিরে
অনুভব হল আমার। আবার বিদ্যুতের ঝলকানি। তার তার আলোতে স্পষ্ট দেখলাম
দরজার বাইরে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে যেন এক আবছা নারীর অবয়ব। দারুণ ভয় পেলাম
আমি। মনকে বোঝালাম আমার চোখের ভুল। কলা গাছের ছায়াটাকেই অমন দেখেছি।
কিন্তু মস্তিষ্ককে বোঝালেও সেই বোঝানোয় নিজেই জোর খুঁজে পেলাম না।
একসময় নিজেকেই বললাম কেন ভয় পাচ্ছি। সে যদি সত্যিই থেকে থাকে তবে তো এত
দিনেও কোন ক্ষতি সে করেনি। ভয়ও দেখায়নি। সে শুধু তার ফেলে যাওয়া
সন্তানের কাছে কাছে থাকে। রক্ষা করে তাকে। চাইলে সে পার্বতীদির আরো বড়
ক্ষতি করতে পারত। পারত আমার ক্ষতি করতে। কিন্তু করেনি। শুধু চেয়েছে
তুলতুলের কাছে থাকতে। মা কি মৃত্যুর পরেও কখনও সন্তানের ক্ষতি চাইতে
পারে? ধীরে ধীরে আমার মন শান্ত হল। আমি ঘুমন্ত তুলতুলের গা থেকে খুলে
নিলাম তাবিজটা। রেখে এলাম আমার ঠাকুরের আসনে। একটু পরে বাইরের ঝড় শান্ত
হল। মেয়েও পরিতৃপ্ত মুখে ঘুমাচ্ছে। ঠোঁটের কোনে আলগা হাসি লেগে আছে।
পরদিন সকালে দেখলাম মেয়ের আর জ্বর নেই৷ দিব্যি হাসছে। মনটা ভরে গেল।
একটু পরে দেখি খোঁড়াতে খোঁড়াতে পার্বতীদিও হাজির। তুলতুলের বাবা হেসে
বলল-" তুমি ছিলে না৷ আর তুলতুল তো কেঁদে কেঁদে পাগল। এবার তুমি এসে
গেছ। দেখ কান্না উধাও।" পার্বতীদি একগাল হেসে কোলে নিল তুলতুলকে। আমি
ভাবলাম এমনই স্নেহে ভালোবাসায় বড় হয়ে উঠুক মেয়েটা। একজন নয়, দু'দুজন
মায়ের স্নেহে পূর্ণ হয়ে উঠুক কানায়কানায়।
***
সুমিতার সংসার
সুমিতার আজ ভালো লাগছে না। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। অথচ কেন যে ভালো
লাগছে না তার স্পষ্ট কারণ সে খুঁজে পাচ্ছে না৷ কারণের কষ্টকে দূর করা
যায় কিন্তু অকারণের কষ্টকে দূর করা বড় শক্ত। অথচ মজার কথা আজ তো
সুমিতার খুশী হবার দিন। ভীষণ ভীষণ খুশী হবার দিন। সুমিতা যা যা নিয়ে এত
বছর ধরে অভিযোগ করে এসেছে সেই প্রত্যেকটা জিনিষ আজ তার পূরণ হয়েছে।
তবু....
বাবলুর সাথে বাড়ির অমতে বিয়ে করে ঘর ছেড়েছিল আজ থেকে চোদ্দ বছর আগে
সুমিতা। সুমিতা আর বাবলুর সম্পর্কের কথাটা সুমিতার বাড়িতে জানাজানি হয়ে
যাবার পরেই সুমিতার বাবা স্থির করেছিলেন ওর বিয়ে দিয়ে দেবেন অন্যত্র৷
মরিয়া সুমিতা ছুটে এসেছিল বাবলুর কাছে। বলেছিল-" অন্য কারোকে বিয়ে করার
থেকে আমার মরে যাওয়াও ভালো। তার চেয়ে যেমন করে হোক আমাদের বিয়ে করতেই
হবে। " বাবলু বলেছিল-" কিন্তু আমার যা রোজগার আমি যদি এখন বিয়ে করি
সংসার চালাবো কিভাবে? তুমি অনেক সুখে থেকে অভ্যস্ত সুমিতা। আমি যে
তোমায় তেমন করে যত্নে রাখতে পারব না।" সুমিতা জলভরা চোখে হাত চেপে ধরে
বলেছিল-" সুখ চাই না আমার। শুধু তোমায় চাই। যেমন করে রাখবে তেমনই
থাকবো। গাছতলায় থেকে তোমার সাথে দুখের ভাত ভাগ করে খেতেও আমি রাজি।
কিন্তু অন্য কারোকে বিয়ে করা...অসম্ভব।"
বাবলু বিয়ে করে গাছতলায় রাখে নি। এনে তুলেছিল নিজের টিনের চালের
দুকামড়ার বাড়িতে। সেই সুমিতার সংসার। শ্বশুর শ্বাশুড়ি দেওর ননদ কেউই
নেই। একদম একার সংসার। প্রথম প্রথম অনেক স্বপ্ন নিয়ে সে সংসার গোছানো
শুরু করে। টিনের চালের প্লাস্টারহীন ইটের বাড়িকেই করে তুলতে চেয়েছিল
স্বর্গ। কিন্তু কয়েকদিন যেতেই সে বুঝল ' অভাব দরজা দিয়ে ঢুকলে প্রেম
জানলা দিয়ে পালায়।' কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয় তাদের মধ্যের খিটিমিটি।
শুধু যদি অভাব হত তাহলে হয়ত একরকম হত। কিন্তু বাবলুকে সুমিতার মনে হতে
থাকে মাত্রা ছাড়া দায়িত্বজ্ঞানহীন। কোন কাজই সে ঠিক মত করে না। আলমারির
দোকানের কাজ থেকে যে টাকা আসে তাতে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হয়
সুমিতাকে। বেশ একটু দূরে পাইকারী বাজার থেকে সে বাজার করে সস্তা হবে
বলে। রেশনে লাইন দিয়ে চাল তোলে। কেরোসিন তেলের লাইনে ঠ্যালা গুঁতো খেয়ে
তেল তোলে। আবার এরই মধ্যে সংসারে যাতে একটু স্বাচ্ছল্য আসে তাই নিজের
কানের দুল জোড়া বিক্রি করে সে টাকায় কিনে ফেলে একটা সেলাই মেশিন৷ শুরু
করে টেলারিং এর কাজ।
পরিশ্রম যত বাড়তে থাকে, ক্লান্তি যত বাড়তে থাকে বাবলুর প্রতি অসন্তোষও
তত বাড়তে থাকে সুমিতার। মনে হয় সে নিজে যেভাবে সংসারটাকে দাঁড় করাবার
জন্য খাটে সেই ডেডিকেশনটার বেশ খামতি আছে বাবলুর ব্যবহারে। আলমারির
দোকানের কাজের পরে সেই তো পারে চালটা এনে দিতে। কিম্বা পাইকারি বাজার
থেকে বাজারটা করে আনতে। নিদেন পক্ষে সকালের জলটুকু তুলে দিতে। কিন্তু
না। বাবলুর যেন সেসব ইচ্ছেই নেই। মাঝে মাঝেই চোখে জল আসে সুমিতার।
বাবলু কি তার পরিশ্রম দেখতে পায় না। বাবলু কি তাকে আদৌ ভালোবাসে? বাসলে
কি এভাবে তাকে খাটতে দিত? একটা ভালো চাকরির চেষ্টাও তো করত নিদেনপক্ষে।
কিন্তু সেইসব অভিমান চিরস্থায়ী হয় না। যখন রাতে সুমিতাকে কোলের কাছে
টেনে নিয়ে বাবলু বলে-" আমি জানি সুমিতা তোমার খুব কষ্ট। অনেক খাটতে হয়
তোমাকে। অনেক পরিশ্রম করতে হয় আমার জন্য, আমাদের সংসারের জন্য। কিন্তু
দেখো বেশী দিন নয়। একদিন আমি সব ঠিক করে নেব। সেদিন তুমি রানীর মত
থাকবে। পায়ের উপর পা তুলে।"
হাসি পায় সুমিতার। এক অপরিসীম মায়ায় ভরে যায় মনটা। একেই বোধহয় আক্ষরিক
অর্থে বলে -" ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখটাকার স্বপ্ন দেখা।" কিন্তু বাবলুর
এই স্বপ্নটুকু তাকে তৃপ্তি দিত৷ বাবলু তাকে আদৌ ভালোবাসে কিনা ভেবে যে
অনিশ্চয়তায় সে ভুগত তার উপর লাগিয়ে দিত শান্তির মলম। মনে হত-" আহারে,
অক্ষম একটা মানুষ। তেমন কিছু করে উঠতে পারে না। কিন্তু আমাকে ভালো তো
বাসে। আমায় সুখে রাখতে তো চায়। সাধ্য না থাক, সাধটুকু তো আছে।"
তাই সংসার চলতে থাকে...অভাব অভিযোগও চলতে থাকে। বাবলুর অল্প হলেও মাইনে
বাড়ে। সংসারের হাল হয়ত একটু ফিরত, কিন্তু তখনই বাবলু সুমিতার জীবনে
নতুন অতিথি এসে পরে। খরচও সমান তালে বেড়ে যায়। কার্যত সংসার সেই এক
জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকে।
বুকাই জন্মাবার পর সুমিতার একই সঙ্গে বেড়ে গেল সংসারের প্রতি অভাব
অভিযোগ আর মায়া। বাবলুর অবশ্য বেশ একটা দায়িত্ববোধ তৈরী হল। সে আলমারির
দোকানের কাজের পরে আরো একটা দোকানে পার্ট টাইম কাজ ধরে নিল। আগে বাবলু
আটটায় বেরিয়ে যেত আর রাত আটটায় ঢুকত। এখন সাড়ে সাতটায় বার হয় আর রাত
এগারোটায় বাড়ি ঢোকে। সংসারের আয় বাড়লো ঠিকই কিন্তু সব দায় দায়িত্ব একা
সুমিতার ঘাড়ে এসে পরল। এতদিন শুধু সংসার ছিল। এখন তার সাথে ছোট বাচ্চার
কাজটাও। সুমিতা প্রায়ই গজগজ করে-" খেটে খেটে হাড়ে মাসে কালি হয়ে গেল।
একটা সাহায্য যদি কেউ করে। সংসার যেন আমার একার। আর পারি না বাবা। "
বলে বটে তবে সে নিজেও জানে সকাল থেকে রাত অবধি বাবলুও তো আলমারি
কারখানায় আর তারপর দোকানে হাড়ভাঙা খাটুনিই খাটে। সুমিতা বাড়ির সামনের
সরু মাটিতে লঙ্কা বেগুণ পুঁইশাক কুমড়ো গাছ বসায়। বাবলু বলে-" এমনিই
তোমার খাটনির শেষ নেই। এর মধ্যে আবার এই সব গাছটাছ লাগানোর খাটুনি... "
সুমিতা বলে-" সে খেটে মরা তো আমার কপালে। এ আর নতুন কি। তবু দুটো লঙ্কা
ফললেও তো ভালো। সংসারের একটা সাশ্রয় হয়। "
বাবলু সস্নেহে ওকে কাছে টেনে নেয়-" বলে বড় কষ্ট তোমার, আমি বুঝি মিতা।
কিন্তু দেখ আমি এ কষ্ট তোমার কিছুতেই থাকতে দেব না। একদিন ঠিক আমি সব
গুছিয়ে নেব। সেদিন তুমি শুধু হুকুম করবে বসে বসে।" সুমিতা সুখী হয়
কিন্তু মুখে কপট রাগ দেখিয়ে বলে -"থাক বাপু আর আমার রানী হয়ে কাজ নেই।
এই চাকরানী আছি খিদমত খাটছি এই ঢের।"
সুমিতা জানত তার স্বামী স্বপ্ন দেখে। এমন সব স্বপ্ন যা পূরণ করার
সামর্থ্য তার নেই। তবু ওর এই স্বপ্নেও যে ও সুমিতাকে রানী করে রাখার
কথা ভাবে এতেই সুমিতা সুখী হত। তার সংসারের খাটুনি পরিশ্রম যা নিয়ে তার
নিত্য অভিযোগ তার উপর যেন একটা মমত্বের স্নিগ্ধ অনুভূতির প্রলেপ পরত।
সুমিতাও ধীরে ধীরে নিজের মত করে গুছিয়ে নিয়েছিল নিজের দৈনন্দিন জীবন।
সারাদিনের প্রচুর দৌড়দৌড়িগুলোকে নিজের রুটিন মত দিব্যি এডজাস্ট করে
নিয়েই চলছিল সে। পাড়ার লোকেও বলত -" সত্যিই বাবলু ভাগ্য করে বৌ পেয়েছে৷
ঠিক যেন দশভূজা। সংসার সামলাচ্ছে। দুটো পয়সা সাশ্রয়ের জন্য চরকি পাক
খাচ্ছে। স্বামীর যাতে সাহায্য হয় তাই আবার সেলাইএর কাজও করছে। এমন মেয়ে
আজকাল পাবে কোথায়?" সুমিতার সামনে কেউ একথা বললেই সুমিতা বলে-" মাসীমা
আশীর্বাদ করুন। শরীরে যেন সেই ক্ষমতা থাকে যে এমন হেঁপে ঝেঁপে কাজ করতে
পারি। নিজের সংসারের জন্য কাজ করব নিজের স্বামী সন্তানের জন্য সুখের
জন্য তাতে আর কষ্ট কি?" পাড়ার বয়োবৃদ্ধরা দুহাত তুলে আশীর্বাদ করত-"
একদিন তুমি রাজরানী হবে দেখো মা। "
তাদের আশীর্বাদই কি ফলে গেল? নাকি সবটাই সুমিতার লক্ষ্মীভাগ্য? বাবলু
অবশ্য উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিল সব স...অঅঅব হয়েছে সুমিতার পয়ে। না হলে
আলমারি ডেলিভারি দিতে গিয়ে দত্তবাবুরব সাথে আলাপই বা হবে কেন? সেই আলাপ
ঘনিষ্টতাতে পরিণতই বা হবে কেন? আর দত্তবাবুই বা কেন ওদের কোম্পানিতে এত
ভালো চাকরীর অফারটা দেবেন। বাবলু কখনও স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিল যে এমন
একটা মোটা অংক সে মাইনে হিসেবে পেতে পারে। না, এই টাকা দিয়ে রাজপ্রাসাদ
কিনে নেওয়া যায় না ঠিকই। কিন্তু সুমিতার জন্য অনেক খানি সুখ কিনতে
পারবে বাবলু এই টাকায়।
বাবলু বলে-" বিয়ে করে থেকে তোমায় তো কিছুই দিয়ে উঠতে পারি নি। শুধু
পরিশ্রম করে গেছ৷ যুদ্ধ করে গেছ। এবার তোমার লড়াই এর শেষ। এত বছর তুমি
করে গেছ আমি দুহাত ভরে নিয়ে গেছি। আর এখন আমি তোমায় একটু সুখ একটু
নিশ্চিন্ততা দিতে চাই। "
আনন্দে চোখে জল এসে যায় সুমিতার। এমন প্রাপ্তি যে শুধু ভাগ্যবতী হলেই
মেলে। বাবলু বলে-" শোনো আর দুটো পয়সা বাঁচাতে তোমাকে দু কিলোমিটার
ঠেঙিয়ে পাইকারী বাজার ছুটতে হবে না। এই যে এত ভারী মাল নিয়ে এতটা আসো
এতে তোমার শরীরের কতটা ক্ষতি হয় বুঝি না ভেবেছ? এতদিন কিছু করতে
পারিনি। তাই বলিও নি। কিন্তু এখন থেকে আর একদম না। আমি রতন মুদির
দোকানে কথা বলেছি। তুমি মাসের শুরুতেই লিস্ট করে দেবে। রতন ওর দোকানে
ফাইফরমাশ খাটা ছেলেটাকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবে।"
সুমিতা হা হা করে ওঠে-" আরে এ কি কান্ড। তুমি আমায় একবার জিজ্ঞেস করবে
তো। কত গুলো টাকা শুধু শুধু জলে যাবে। কোথায় রেশানের তেরটাকার চাল আর
কোথায় রতনের দোকানের বিয়াল্লিশ টাকা কেজির চাল।"
বাবলু গভীর চোখে সুমিতার দিকে চেয়ে বলে-" যাক টাকা। আমার সুমিতাকে আমি
আর খেটে খেটে হাড় মাস কালি করতে দেব না।" একই সাথে একটা সুখ বোধ আর
একটা অস্বস্তি লেগে থাকে সুমিতার মনে।
বাবলু একটা ঠিকে ঝি হঠাৎ করেই রেখে দেয়। এবার বাবলুর উপর রেগেই যায়
সুমিতা। নতুন চাকরি পেয়ে কোথায় সে দুটো পয়সা জমাবে তা নয় একের পর এক
বাড়তি খরচ করে চলেছে। সুমিতার মনে হয় তাদের তিনটি প্রানীর সংসারে কিই
বা এমন কাজ যে তার জন্য ঠিকে কাজের লোক লাগবে। অবশ্য কথাটা ভেবে সে
নিজেই অবাক হয়। এতদিন তো তিনটি প্রানীর এই সংসারের কাজকেই পাহাড় প্রমাণ
মনে হত।
মাস খানেকও যায় না, ঠিকে কাজের লোকের সাথে বনে না সুমিতার।
মেয়েটির কাজ ভীষণ অপরিষ্কার মনে হয়। ঘরের কোনের দিকে ঝাঁট দেয় না।
বাসনের পিছনের পোড়াদাগ তোলে না। সুমিতা বাসন মাজলে যেখানে সারা মাসে
দুটো সাবান লাগে এর সেখানে চারটে লাগছে। আলমারি বিছানার নীচে হাত
বাড়িয়ে মোছে না। কাজের লোকও বিরক্ত। পাড়ায় বলে বেড়ায় -" হাজার মালকিন
দেখেছি বাবা। এমন টাইপের দেখিনি। যতক্ষণ কাজ করব ছায়ার মত পেছন পেছন
ঘুরতে থাকবে আর হুকুম করতে থাকবে। " শেষে কাজের লোক একদিন মুখে মুখে
জবাব দেওয়ায় সুমিতা কাজ ছাড়িয়েই দিল। সুমিতা একটা অদ্ভুত শান্তি অনুভব
করল। রাতে বাবলু এসে শুনে বলল-" একদম ঠিক করেছ। এসব লোক রেখে কাজ নেই।"
সুমিতা ভেবেছিল আবার যেমন নিজের সংসারে নিজে গুছিয়ে কাজ করত তেমন করেই
করবে। কিন্তু পরদিন দুপুরেই সন্ধ্যা নামের একটি মেয়ে এসে হাজির হয়। এই
মেয়েটি পাড়ার মাস্টার মশাইএর বাড়ি আজ দশ বছর কাজ করছে। খুব সুনাম কাজের
লোক হিসেবে। বাবলু নাকি তাকেই ঠিক করেছে ঠিকে কাজ করার জন্য। পরেরদিন
থেকে কাজে আসবে বলে মেয়েটি চলে যায়। হঠাৎই কেন জানি না কি এক বিষন্নতায়
চোখে জল এসে যায় সুমিতার৷
মেয়ে বুকাই এর উঁচু ক্লাস হচ্ছে। আগে সুমিতাই মেয়েকে পড়াতো। অনেক খাটত
সে মেয়ের পিছনে। আগের ক্লাসের স্টুডেন্টদের থেকে পুরানো বই জোগাড় করত৷
তাদের নোটস জোগাড় করত। ঘুরে ঘুরে আগের বছরের প্রশ্নপত্র জোগাড় করত।
সবাই বলত তুমি এত মেয়েকে নিয়ে খাটো বলেই মেয়ে প্রতিবছর এত ভালো রেজাল্ট
করে৷ সুমিতা মেয়েকে সেগুলো পড়াতো, মুখস্থ করাতো। বিকেলে ব্লাউজের
ফিনিশিং এর কাজ করতে করতেই চশমা চোখে দিয়ে পড়া ধরত সে। কিন্তু এখন
মেয়ের পড়াগুলো তার নাগালের বাইরে চলে গেছে একটু একটু। সে নিজে আর্টসের
ছাত্রী। বিজ্ঞান অঙ্কটা তার বেশ অসুবিধাই হচ্ছিল৷ গত বছরই একটা অঙ্কের
কোচিং এ দিয়েছিল। তাতে সুমিতার খাটুনি বেশ বেড়েছিল অবশ্য৷ স্কুলে দেওয়া
নেওয়া, আবার হাঁফাতে হাঁফাতে কোচিং এ দেওয়া নেওয়া৷ মেয়ের বন্ধুর মায়েরা
হেসে বলত-" সুমিতা এই সারাদিন এত পরিশ্রম করো বলেই চেহারাটা এমন
ছিপছিপে সুন্দর রাখতে পেরেছ। আমরা তো সব মুটিয়ে যাচ্ছি।" বাবলু কিন্তু
আর সুমিতাকে এই পরিশ্রম করতে দিল না। দুম করে পাড়ার মাস্টারমশাই এর
সাথেই কথা বলে বাড়িতেই মেয়ের জন্য বিজ্ঞানবিভাগের টীচার রেখে দিল সে।
মেয়ে আজকাল নিজেই পড়ে। সুমিতাকে অন্য অন্য বিষয়ও পড়াতে হয় না৷ অসহায়ের
মত সুমিতা বলেছিল -" এত কাড়ি গুচ্ছির টাকা দিয়ে বাড়িতে লোক রাখার কি
দরকার ছিল? " বাবলু ওর মাথায় সস্নেহ হাত রেখে বলে-" অনেক অনেক কষ্ট
করেছ এতদিন। কিন্তু আর না। এখন তো আর সেই অবস্থা নেই। বিশাল কিছু ধনী
না হই। এইটুকু মধ্যবিত্তের সংসার ঠিক চালাতে পারবো। আমি তো রিক্সার
সাথেও কথা বলেছি। আগামী মাস থেকে মেয়েকে দিয়ে আসবে নিয়ে আসবে। " সুমিতা
যেন খড়কুটো আশ্রয় করার মত করে বলেছিল-" তাহলে আমি কি করব?" বাবলু
বলেছিল-" বিশ্রাম করবে। নিজেকে একটু সময় দেবে। সিরিয়াল দেখবে৷ গল্প
করবে।"
পাড়ার বৌ মেয়েরা বিকেলে টি.ভি সিরিয়াল দেখে। শীতের দুপুরে রোদে চুল
শুকাতে শুকাতে একে অন্যের সাথে গল্প করে৷ সুমিতার কোনকালে ওসবের সময় হয়
না। টি.ভি অবশ্য তারও আছে। সে এতকাল বলত -" আমার বাবু এত সময় নষ্ট করার
সময় নেই। নিজের সংসারের গল্পই সাতকাহন। অন্যের সাথে গল্প করব সে ফুরসত
কই?" এখন নতুন করে এসব করবে ভাবতেই যেন কেমন খাপছাড়া লাগে তার। মনে হয়
সে বোধহয় বাতিল হয়ে যাচ্ছে।
বাবলু রাতে সুমিতার শুকনো মুখ দেখে উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করে-" কি
হয়েছে মিতা? তোমার কি শরীর খারাপ?" সুমিতা কি বলবে ভেবে পায় না। তার যে
শরীর নয় মন খারাপ একথা বাবলুকে বলা যায় না৷ কারণ মন খারাপের কারণটা তার
নিজের কাছেই ভীষণ অস্পষ্ট। যেকোন মেয়েই তো এমন একটা সুখের জীবন চায়৷
তবে তার যে কোথায় আটকাচ্ছে তা সে নিজেই সঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। বাধ্য
হয়েই বলে-" না মানে শরীরটা ওই একটু আর কি।" ভীষ্ণ চিন্তিত হয়ে পরে
বাবলু। আজ বলে নয়। এ বাবলুর বরাবরের স্বভাব। সে সুমিতার সামান্য হাত
কাটলেও দিশেহারা হয়ে যায়। সুমিতা এই বিষয়টা নিয়ে লজ্জাও পায় আবার ভিতরে
ভিতরে একটা প্রছন্ন সুখ ভোগ করে। কিন্তু আজ আর বাবলু শুধু উদ্বিগ্ন
হয়েই শান্ত হল না। সে জোর করে সুমিতাকে নিয়ে গেল পাড়ার ডাক্তারখানায়।
এমনিতে এতকাল অসুখে বিসুখে সুমিতা সরকারী হাসপাতালেই দেখিয়েছে। বলতে
নেই সুমিতার শরীর-স্বাস্থ্য এতটাই ভালো যে এক বাচ্চা হওয়া ছাড়া ডাক্তার
দেখানোর মত তার হয়ও নি কিছু৷ পেটের অসুখে এক বেলা উপোস, আর জ্বর সর্দি
তে বাসকপাতার রস কিম্বা শিউলি পাতার রসেই কাজ চালিয়েছে সে। মেয়ের কিছু
হলেও সেই নিয়ে গেছে। বাবলু কোনকালেই ঠিক এভাবে নিয়ে যায় নি। অবশ্য তার
কারণ বাবলু তো বাড়িতেই থাকত না। আলমারির কারখানা বা দোকান দুটোতেই ছুটি
নেওয়ার বড় বাঁধা নিষেধ ছিল। তাছাড়া বাবলু বোধহয় সুমিতার উপর দায়িত্ব
ন্যস্ত করে নিশ্চিন্ত ছিল বলেই জ্বর সর্দি কিম্বা পেটখারাপে তেমন মাথা
ঘামাই নি কখনো। কিন্তু এখন নতুন চাকরীতে এত বেশীক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকতে
হয় না। বাড়ি ফিরে তাই সুমিতার মুখের দিকে তাকানোর অবকাশ মেলে তার।আজ
তাই সুমিতার শত সহস্র বাঁধাকে উপেক্ষা করে প্রায় জোর করেই নিয়ে গেল
ডাক্তারখানায়। রোগ অবশ্য ডাক্তার তেমন কিছু পেলেন না। প্রেসারটাই যা
একটু লো। উনি ভিটামিন লিখলেন একটা। বাবলু ডাক্তারকে বলল-" আসলে কি
জানেন, সময় মত খাওয়া দাওয়া করে না। অযথা বেশী পরিশ্রম করে। " ডাক্তার
বললেন-" না মিসেস দে। শরীর নামক যন্ত্রেরও কিন্তু বিশ্রাম দরকার হয়৷ না
হলে সেও বিকল হতে সময় নেয় না।"
চেম্বার থেকে ফেরার পথে দেখা হল পাড়ার মালা বৌদির সাথে৷ হেসে বললেন-"
কি ব্যাপার সুমিতা৷ কত্তা গিন্নি ইভনিং ওয়াক নাকি?" সুমিতা হেসে বলল-"
আর বলো কেন বৌদি৷ একটু ক্লান্ত লাগছিল। তাতেই তোমার দেওর ডাক্তারের
কাছে নিয়ে গেছিল। কোন মানে হয় বল।" মালা বৌফি হেসে বলে-" আহা, অমন বোলো
না গো৷ একটু যত্ন করছে করতে দাও৷ ভাগ্য করে এমন স্বামী পেয়েছ। আমরা তো
তাই বলি ভাগ্যবতী মেয়ে তুমি।" কানে লাগে ভাগ্যবতী শব্দটা সুমিতার।
আশ্চর্য হয় সে। কটা দিন আগেও এরা সুমিতাকে বলত বাবলু ভাগ্যবান এমন বৌ
পেয়েছে বলে। আজ কয়েকটা মাত্র দিনের ব্যবধানে সুমিতা কেমন যেন
অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে। এই ভাগ্যবতী শব্দটা যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে যে বাবলুর
মত ছেলেকে স্বামী হিসেবে পাওয়াটা আসলে তার যোগ্যতার অতিরিক্ত প্রাপ্তি।
কেমন ভারি হয়ে ওঠে তার মন।
বাবলু রাতে খেতে বসে বলল-" দেখলে তো ডাক্তারবাবুও বিশ্রামের কথা বললেন।
এবার আর আমি তোমার কোন কথা শুনবো না। সারাদিন ওই মেশিন চালানো আর চলবে
না। আমি যেমন করে পারি সংসার চালাবো।বাড়তি রোজগার দরকার নেই। " সুমিতা
দারুণ চমকায়৷ নিজেকে যেন হঠাৎ কেমন অস্তিত্বহীন মনে হয়। হঠাৎই কেমন
রেগে ওঠে সে।
বাবলু থতমত খেয়ে যায়। কি হয়েছে বুঝে উঠতে পারে না। সুমিতা বলে-" কেন
এমন করছ? আমার কি নিজের একটা ইচ্ছে অনিচ্ছে থাকতে নেই? আমার সাজানো
সংসারে আমাকেই এভাবে অতিথি করে দিচ্ছ? আমি কি এ সংসারের শোকেসে সাজানো
শোপিস? দুদিন একটু পয়সার মুখ দেখলেই সব উড়িয়ে পুরিয়ে দিতে হবে? " মেয়ে
বুকাই কিছু বুঝতে পারে না। মা আগে যে অভিযোগ করত তাতে সে বুঝত যে মাএর
পরিশ্রম হয় তাকে সাহায্য করার কেউ নেই বলে মা কষ্ট পায়। কিন্তু এখন
বাবা এত ভালো ভালো কাজ করার পরেও কেন মা রেগে গেল তা বুকাই বোঝে না।
বুকাইএর বিস্মিত দৃষ্টির সামনে সুমিতা নিজেকে সামলে নেয়৷ রাতে বুকাই
ঘুমিয়ে গেলেও সুমিতার চোখে ঘুম আসে না। খেতে বসে যে ছেলেমানুষী আবেগ সে
প্রকাশ করে ফেলেছে তার জন্য নিজেই লজ্জা বোধ করে। আবার তার যে কষ্ট
হচ্ছে তাও তো এক বর্ণ মিথ্যে নয়। সুমিতা নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে
তার সুখের অসুখ করেছে। রাত বেড়ে চলে। একসময় পিঠে হাত রাখে বাবলু।
বাবলুরও ঘুম আসে নি। সুমিতা মুখ ফেরায় তারপর অস্ফুটে বলে-" আমায় ক্ষমা
করো। খাবার সময় তখন ওরকম করে বলাটা আমার অন্যায় হয়েছে।" বাবলু সেই
ছোটবেলার মত সুমিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে -" দূর পাগলী। তুমি তো
ঠিকই বলেছ। আসলে আমিই নতুন রোজগারের আনন্দে বাড়াবাড়ি করে ফেলছিলাম। দেখ
ভেবে দেখলাম তোমার বিবেচনাই ঠিক। মেয়েটা বড় হচ্ছে। পড়াশোনায় ওর মাথা
যখন ভালো ওর পড়াশোনাটা যতদূর চায় চালিয়ে যেতে হবে। তার জন্য খরচ আছে।
তাছাড়া বিয়ে দিতেও খরচ হবে। তাই অতিরিক্ত খরচ করাটা সত্যিই ঠিক নয়৷
তাছাড়া সংসারটা তোমার। তুমি কেমন ভাবে চালাবে সে তুমিই এতদিন বুঝে
এসেছ, তুমিই বুঝবে৷ ওসব তো কোনদিনই মাথায় ঢোকে না আমার। তবে তোমারও তো
শরীর ভেঙেছে, তাই বলি কি অতিরিক্ত পরিশ্রম করার দরকার নেই। আমি বরং তার
চেয়ে যে টাকাটা কাজের লোক রিক্সা মাষ্টারমশাই কিম্বা মুদির দোকানে
বাড়তি খরচ করছিলাম সেই টাকাটাই তোমায় দিয়ে দেব। তুমি প্রয়োজন মত
বুঝেসুঝে খরচ কোরো। তোমার হাতে থাকলে তবু ভবিষ্যতের দুটো পয়সা জমবে। না
হলে আমি যা উড়নচন্ডে..." বাবলুর কথা শেষ হবার আগেই ঝর ঝর করে কেঁদে
ফেলে সুমিতা। বাবলু কিছু বলে না মুখে। শুধু সেই বিয়ের প্রথম প্রথম যেমন
সুমিতাকে কোলের কাছে টেনে নিত তেমন করে টেনে নেয়। সুমিতার নিজেকে
সত্যিই কেন জানি না রানী মনে হয় হঠাৎ।
সুমিতার সংসার এখন আগের মতই চলছে। না কাজের লোক সন্ধ্যাকে আর ছাড়ায় নি
সুমিতা। তবে পাইকারি বাজার থেকেই কেনাকাটাটা করে। তফাতের মধ্যে বাজার
সেরে এখন আর চড়া রোদে হেঁটে ফেরে না। রিক্সায় ফেরে। পাইকারী বাজারে
দামের যা ফারাক রিক্সা ভাড়া দিয়েও আগের থেকে কম হলেও সাশ্রয় হয়।চালটা
অবশ্য আর রেশনের খায় না। ওটা রতন মুদির দোকানেই বন্দোবস্ত হয়েছে। না,
মেয়েকে রিক্সায় পাঠায় না সুমিতা। নিজেই দিয়ে আসে নিয়ে আসে। তার মতে
মেয়ে বড় হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে থাকাই ভালো। তবে আজকাল দেরী হয়ে গেলে অটোতে
চলে যায় এক একদিন। মাস্টারমশাই বাড়ি এসেই পড়াচ্ছেন। সুমিতা দেখেছে তাতে
পড়া ভালো হচ্ছে। বিকেলের দিকটা অর্ডারের সেলাইটাও করে সুমিতা। তবে আগের
মত চাপ নিয়ে নয়। একটু কমিয়ে দিয়েছে। তার বদলে সন্ধ্যায় আধাঘন্টা সে
"মধুমিতার রান্নাঘর" অনুষ্ঠানটা দেখে। ভালো ভালো রান্না শেখা যায়। তবে
গজগজ করে এখনও একই ভাবে একই সুরে। বক্তব্য যদিও পাল্টেছে। আগে বলত -"
খেটে খেটে হাড়েমাসে কালি পরে গেল। একটা সাহায্য কেউ করবে না। সংসার যেন
আমার একার।" আর এখন বলে-" যত্ত উড়নচণ্ডী নিয়ে হয়েছে আমার সংসার৷ টাকা
পেলেই উড়িয়ে দিতে হবে। একটু যদি বিবেচনা থাকে। যেদিকে না দেখব.."
✍ রত্না চক্রবর্তীর দুটো গল্প
অসম্মান
***
বনমায়া মনমায়া
***
✍ প্রনব ভট্টাচার্য
::::::ডাউন মেমোরি লাইন:::::ে
মানুষের স্মৃতির নানা প্রকারভেদ আছে মনে হয়। বন্ধুদের অনেকেই মনে
রাখতে পারতো সংখ্যা, গণিতের জটিল সব সূত্র। স্বাভাবিক ভাবেই বছর শেষে
পরীক্ষার খাতা বেরোলে শিক্ষকের পিঠ চাপড়ানি ছিল তাদের জন্য বরাদ্দ। এ
প্লাস বি হোল স্কয়ার থেকে মাইনাস বি বাই টু হোল স্কয়ারের বেশি এগোনো
আমার কাছে ডিসেম্বরের শীতের রাতে ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পার হওয়ার মতো
কঠিন মনে হতো। ফলে আমারও জুটত পিঠে, তবে চাপড়ানি না; দাবড়ানি।
মহিউদ্দিন স্যার যে কতো হাতের সুখ করেছেন আমার গালে আর পিঠের উপর তার
ইয়ত্তা নেই।
সহপাঠীদের কয়েকজন ছিলেন বিশ্ব-খচ্চর। বোর্ডে অংক নামানোর মতো অথৈ জলে
কূল হারালে মহিউদ্দিন স্যারের ইশারার অপেক্ষা করত এই খচ্চরদের কয়েকজন।
ওরা ছুটে গিয়ে বেছে বেছে নিয়ে আসত স্কুল অফিসে রক্ষিত ঘন গাঁটের
কঞ্চিগুলো। তার বেশ কয়েকটি আমার পিঠে ভেঙে স্যার যখন হাঁপাতেন,
সহপাঠীদের কেউ কেউ নীরবে দুঃখ করত। আমায় ধোলাইয়ের আয়ুধ হিসেবে যারা
ঘন গাঁটের শক্ত কঞ্চিগুলো স্যারের হাতে তুলে দিত, প্রহার শেষে আমার
অবস্থা দেখে তাদেরও চোখ ছলছল করত দেখতাম।
এভাবে প্রচুর তিরস্কার, প্রবল প্রহার, প্রচুরতর কানমলা সত্ত্বেও গণিতের
দেবীর করুণা থেকে বঞ্চিত থেকে গেলাম।
যারা সহজে মনে রাখত সংখ্যা, গণিতে ফিজিক্স কেমিস্ট্রি বায়োলজিতে উচ্চ
মার্কস নিয়ে তারা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পরিসংখ্যান ইকোনমিক্সে আজ
প্রতিষ্ঠিত।
আমার স্মৃতির যেটা উল্লেখযোগ্য দিক ছিল তা হচ্ছে মানুষের মুখ মনে রাখার
ক্ষমতা। আর পঠিত কোনও ঘটনার খুঁটিনাটি নিজের ভাষায় গুছিয়ে লিখতে
পারা।
স্কুলে একটি রীতি ছিল---- পরীক্ষার এক মাসের মধ্যে উত্তরপত্র
পরীক্ষার্থীর হাতে দিয়ে দেওয়া। অভিভাবকের স্বাক্ষর সমেত সেই খাতা
ফেরত দিতে হতো সংশ্লিষ্ট বিষয়ের স্যারের হাতে।
খাতা দেওয়ার দিন পড়াশোনায় এগিয়ে থাকাদের দেখতাম বেশ হাসিখুশি মুখে
সেজেগুজে স্কুলে আসত। আর আমাদের মতো সাধারণ পড়ুয়াদের করুন মুখে হাজির
হয়ে মার খাওয়ার জন্য পিঠ পেতে দেওয়া ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। পরীক্ষার
আগে দুশ্চিন্তা থাকত একান্ত নিজের মনে, গোপন প্রেমের ব্যথার মতো সেটা
সহনীয়। অসহ্য লাগতো খাতা দেখানোর দিন। দ্বিগুণ দুশ্চিন্তার চাপ সেদিন,
আতঙ্ক তো থাকতই ;মরমে মরে যাওয়ার মতো অবস্থা হতো কো-এডুকেশন স্কুলের
নবম দশম শ্রেণির সহপাঠী মেয়েদের সামনে মার খাওয়ার সময়। সেই সঙ্গে
জুটত -- ধরণী দ্বিধা হও মাপের অপমান।
তাই পরীক্ষার পর খাতা দেখানোর দিন সেদিনের কিশোর আমার অনুপস্থিতি ছিল
অবধারিত।
প্রথম পিরিয়ড বাইরে অশ্বত্থতলায় কাটিয়ে দ্বিতীয় পিরিয়ডের শুরুতে
গিয়ে সেদিন ক্লাশে বসলাম। না বসে উপায় ছিল না। তাড়না ছিল ভেতর
বাইরে। বাড়ির পাশের সহপাঠীদের প্ররোচণা ছিল। তারা সবাই আগের দিন খাতা
পেয়ে গিয়েছে। পেয়ে কেউ আনন্দিত,কেউ বিমর্ষ। বাড়ি বয়ে এসে খবর
দিয়ে গিয়েছিল---
"হেফাজ স্যার তোকে দেখা করতে বলছেন। আমাদের সবার খাতা দিয়ে দিয়েছেন,
তুই ভয়ে যাসনি তাই তোকে "ভালোকরে খাতা দেখাবেন।" সরাসরি ভয়াবহ
বার্তা। শুনে ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল আমার। এদিকে এই দুষ্ট সহপাঠীচক্র
খবরটি বলেছে আমার মা'য়ের সামনে। কাজেই আগের দিন বলা মিথ্যে----- "খাতা
আজও দেয়নি মা" বলে যে টুকু ফাঁকি দিয়েছিলাম আজ সব গুমর ফাঁস হয়ে গেল
মায়ের সামনে।
অতএব, প্রহারের ভয়, তিরস্কৃত হওয়ার লজ্জা, অপমানের আতংক সব উপেক্ষা
করে প্রথম বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করতে করতে দেখলাম, হাতে বেত ও বোগলে
একগুচ্ছ খাত নিয়ে ক্লাসে ঢুকছেন হেফাজ স্যার। পেছনে পেছনে একঝাঁক
মেয়ে। আমি মনে মনে ভগবানকে স্মরণ করলাম। মনে হলো আজ একটু পরেই আমার
ফাঁসি কার্যকর হবে; প্রকাশ্যে আমার সহপাঠীদের সামনে।
এ কী! বিলকিস, সেলিনা, সীমা এরা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে কেন?
নিশ্চয়ই একটু পরে আমার অকল্পনীয় শাস্তির কথা ভেবে ওরা পুলকিত!
দামড়া বন্ধুগুলোর মুখেও তো দেখছি টুকরো টুকরো ফিচেল হাসি।
ভগবান,রক্ষা করো!
হেফাজ স্যার এমনিতে শান্তশিষ্ট মানুষ। পুরো নাম হেফাজতর রহ্মান
চৌধুরী। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। এমএ বিটি। বিরাট বড়োলোকের ছেলে।
স্কুলে পড়ান শখে। আসল নেশা নাটক লেখা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন গল্পের
নাট্যরূপ দিয়েছেন। অসাধারণ গান করেন, গান লেখেন। এলাকার সান্ধ্য ফাংশন
তিনি একাই মাতিয়ে রাখেন। সাহিত্যে তাঁর অসাধারণ দখল। গান ও নাটকের
প্রতি যেমন প্রখর ভালোবাসা, বাংলা ভাষার প্রতি তেমন তাঁর গভীর অনুরাগ।
দোষের মধ্যে একরোখা, এবং র্যাপিড অ্যাক্শন ব্যাটালিয়ন-এর মতো কুইক
রেসপন্স থাপ্ড়ানোতে ওস্তাদ। বাঙালির ছেলে হয়ে বাংলা ভাষায় ভুল করা
মানে তাঁর কাছে অমার্জনীয় অপরাধ।
টেবিলের উপর বেতের বান্ডিল রেখে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন হেফাজ স্যার।
বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ বিষয়টিকে তখন আমরা বলতাম বাংলা দ্বিতীয় পত্র।
মাধ্যমিক স্তরে তখন দুইশো নাম্বারের বাংলা পরীক্ষার এটি খুব
গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
উত্তরপত্র পড়া শুরু করলেন স্যার।
নুরুল সাড়ে বাহাত্তর প্লাস। সঙ্গে কানমলা। সীমা বাহাত্তর সঙ্গে
তিরষ্কার। স্যার মেয়েদের গায়ে হাত তুলতেন না। তাই সীমা বেঁচে গেল।
শেলি আটষট্টি, সঙ্গে অভিভাবক সহ দেখা করার সতর্ক বার্তা। নিয়ম ছিল
বেশি নাম্বার পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের খাতাগুলো আগে দেওয়ার। দেখছি
টেবিলের খাতা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। নাম্বার নেমে এসেছে বত্রিশে। সেটা
এক অহংকারী সহপাঠিনীর। কিন্তু আমার উল্লসিত হওয়ার অবকাশ কোথায়!
পেছনের সিরিয়াল ধরে যেভাবে স্যার এগোচ্ছেন, একটু পরে আমার ডাক পড়ল
বলে। এবং এ কথা কারও বুঝতে বাকি রইল না যে, যে-ক'টি খাতা এখনও টেবিলে
পড়ে রয়েছে তার মধ্যেই রয়েছে এই হতভাগার দুর্মর লজ্জা ও তিরস্কারের
কারণ খাতাটিও। নাম্বারের ক্রমে নিম্মগামী সিরিয়াল দেখে ক্রমশ পরিষ্কার
হয়ে উঠলো আমার প্রাপ্ত নাম্বার বত্রিশের নিচে তো বটেই আরও কম হতে
পারে। বুঝতে পারলাম স্কুল কামাই, ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে সিনেমা নাটক সবকিছু
একটু পরেই আমার পিঠের উপর থেকে হিসেব মেলাবেন স্যার।
এর মধ্যে স্যার আরও কয়েকজনের খাতা পড়ে শুনিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত উনিশ
নাম্বারে নেমেছে এক জনের নাম্বার। স্যার থামলেন। টেবিলে খাতা তো পড়ে
রয়েছে একটিই! এবং সেটা অবধারিত ভাবেই আমার। ধরে নেওয়া যায়, নাম্বার
সর্বনিম্ন উনিশের চেয়েও কম। দুঃসহ লজ্জা থেকে বাঁচতে হঠাৎ ক্লাশ ছেড়ে
ছুটে পালাতে ইচ্ছে হলো আমার। তার জন্য মোটামুটি মানসিক ভাবে তৈরি।
স্যার কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন আমার দিকে। ফাঁসির রজ্জুর শেষপ্রান্ত
আটকানো ধাতব লিভারে টান দেওয়ার আগে যেভাবে আসামীর দিকে তাকিয়ে নিজের
কৃতকর্মের জন্য ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে মন্ত্র পড়ে
ফাঁসুড়ে, সেভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন হেফাজ স্যার।
ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন স্যার আমার হাই-বেঞ্চের কাছে। এসেই জড়িয়ে
ধরলেন আমায়। আমি ভয়ে কাঁপছি। স্যার হাসছেন। তাঁর চোখে আনন্দাশ্রু।
ছোট করে উচ্চারণ করলেন "গাধা তুই একশো!"
স্তব্ধ ক্লাশরুম। হতবাক সহপাঠীরা।
স্যার আমার দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে ফিরে গেলেন তাঁর চেয়ারে।
পড়তে শুরু করলেন আমার খাতা..... পুরো খাতাটা পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে
থামছিলেন তিনি। আর মাঝে মাঝে ক্লাশসুদ্ধ সহপাঠীদের দিকে তাকিয়ে
বলছিলেন, "কী রে কেমন বুঝছিস তোরা!" শেষ পর্যন্ত থেমে থেমে বললেন "কেন
নিয়মিত স্কুলে আসিস না পাগল?"
বললেন "নিয়মিত স্কুলে আসবি। আজ থেকে তোর পড়াশোনার সব খরচ আমার!
কেন এতো স্নেহ ভালোবাসার হাতের ছোঁয়া দিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে দিয়েছিলেন
স্যার? কেন আমার পরবর্তী বাংলাভাষা নিয়ে পড়াশোনার ভার তিনি নিতে
চেয়েছিলেন তা সেদিন বুঝিনি। আজও তা অপরিজ্ঞাত। হয়তো সে সময় বাংলা
দ্বিতীয়পত্রে ও বাংলা ভাষার খাতায় তখনও অবধি অভঙ্গুর পূর্ণমান
নাম্বারের কারণে। কতো নাম্বার পেয়েছিলাম সে কথা এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
আগেই বলেছি সংখ্যা মনে রাখার ব্রেইন সেল আমার অপ্রতুল। ফলে
ইন্টারমিডিয়েট পাশ দিয়ে কলেজের বন্ধুরা যখন কেউ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার
বা বিজ্ঞান পড়তে দূরে চলে গেল, তখনও গণিতকে গুডবাই জানিয়ে পড়ে রইলাম
অতি সাধারণ কলেজের বাংলা ইতিহাস ভূগোল নিয়ে। পাশাপাশি মানুষের মুখ মনে
রাখার বিদ্যা আমার আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠলো। পাঁচ বছর এ নিয়ে পড়ে
থেকে স্মৃতিতে মানুষের মুখ এঁকে নিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম এক সময়। মনে
করতে পারতাম এই মুখ কতো বছর আগে কোথায় দেখেছি।
এখন ক্লাবে বাজারে কর্মস্তলে দেখা হওয়া চেনা চেনা মুখগুলো খুব চেনা
মনে হয়, অথচ তৎক্ষণাৎ মনে করতে পারি না ইনি কে, কখন কোথায় আমাদের
পরিচয় হয়েছিল। আশ্চর্য নয় যে, এতে এই চেনা চেনা মুখের মানুষগুলো
ক্ষুন্ন হন।
পনোরো বিশ পঁচিশ বছর আগে কলকাতা কটক অথবা শিলিগুড়িতে পরিচয় হওয়া
মানুষগুলোর দেখামাত্র নাম পরিচয় বলতে না পরাটা নিছক একটা Attitude বা
ভড়ং বা ডাঁটো দেমাগ বলে তাদের মনে কোনো সন্দেহ থাকে না।
কেউ কেউ তো আড়ালে বলে বেড়ান কালকা যোগী পয়সার টেম্পারে এখন আমাদের
চিনতেই পারে না।
সেদিন সোনারপুর মিউনিসিপ্যালিটির অফিসে দেখা হলো এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে।
তাঁর দাবি তিনি আমার ছোট মাসির বড়ো নন্দাইর বোন ঝি। আমাদের দুজনেরই
কমন ফ্রেন্ড নন্দিতার বিবাহোত্তর প্রীতিভোজ অনুষ্ঠানে নাকি আমার সঙ্গে
পরিচয় হয়েছিল। সেই ওয়েডিং রিসেপশনের গ্রুপ ফটোতে তাঁর সঙ্গে নাকি
আমি এখনও বিরাজমান। আমারও অবশ্য খুব চেনা চেনা লাগলো তাঁকে। কিন্তু
প্রাণপণে স্মৃতি হাতড়ে ভদ্রমহিলার নাম মনে করতে পারলাম না। আমার চোখে
মুখে অচেনার অসহায়তার ছায়া দেখে তিনি করুণা করা তো দূর, শুনিয়ে
মন্তব্য করলেন --- "তা এখন আমাদের চিনবেন কেন, হাই লেভেলে মুভ করেন,
প্রতিষ্ঠিত লাইফ, ইফ্লুয়েন্সিয়াল লাইফ লিড করেন, কাগজে কলাম লেখেন,
নিজে কাগজ বের করার চেষ্টা করছেন, ইত্যাদি। বুঝলাম ভদ্রমহিলা সব খবর
রাখেন। নন্দিতার বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম বহু বছর আগে। সে তো আমারও
মনে আছে। কিন্তু এই ভদ্রমহিলার সাথে গ্রুপে ছবি তোলা, তাঁর বয়ানে যে
ছবি তাঁর ড্রয়িং রুমের শোভাবর্ধন করছে আজও।
যার একটি ভার্সান নাকি সযত্নে রক্ষিত তাঁর শোয়ার ঘরেও এবং সেই গ্রুপ
ছবি যে আজ এতো বছর পর তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ের অকাট্য প্রমাণ হিসেবে
সাক্ষ্য দেবে, তা ভাবতে পারিনি। আমি যতই অসহায়তা প্রকাশ করলাম ততই
তিনি নন্দিতার রেফারেন্স উল্লেখ করে একদিন কনফারেন্স ভিডিও কলে কথা
বলিয়ে পরিচয় প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠলেন। অথবা একদিন সময় করে তাঁর
বাড়িতে গিয়ে পুরো ফটো অ্যালবাম দেখে আসার আমন্ত্রণ জানালেন।
ওঁর বাড়ি যাওয়া থেকে বাঁচতে অগত্যা হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার দিয়ে
পৌরসভার প্ল্যানিং সেকশন থেকে বেরিয়ে এলাম। এ ছাড়া উপায় ছিল না।
যাঁর কথা বললাম, তিনি মধ্য চল্লিশের। যৌবন ধরে রেখেছেন সযত্ন চেষ্টায়।
শুনেছি এখনও সংসার করেননি এবং পুরসভার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলান।
সামনের মাসে ট্যাক্স পে করতে গেলে ভদ্রমহিলার সঙ্গে আবার দেখা হবে।
পাঠিকা/পাঠক! ততদিন এই গল্পের দ্বিতীয় পর্বের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
#নমস্কার ও শুভরাত্রি।