✍ জয়া চক্রবর্তী সোমার চারটি গল্প
একটি ভৌতিক প্রেমের গল্প
আজ রাতে কি ও আমার কাছে আসবে?ও যে কথা দিয়েছিল? বলেছিল আমাকে আর ওকে
কেউ আলাদা রাখতে পারবে না।শেষ বিদায়ের অন্তিম মুহুর্তে ওর রক্তে রাঙিয়ে
দিয়েছিল আমার সিঁথি।বলেছিল মৃত্যুও আমাদের আর আলাদা করতে পারবে
না।চিতায় শরীরটা জ্বলেছিল।কিন্তু আমি..না না আমরা জানতাম আমাদের আর কেউ
আলাদা করতে পারবে না কোনদিন।তারপর কত রাত এই ছাদে এসে দাঁড়িয়েছি যদি ও
আসে..একবারের জন্য।একবার ওর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে পারি আমি।কিন্তু ও
আসে না।
জানেন এই যে আলসে, কত পড়ন্ত বিকেলে আমরা এখানে দাঁড়িয়ে কত স্বপ্ন
বুনতাম।কিন্তু সেসব স্বপ্ন একটা বাইক এক্সিডেন্ট মিথ্যে করে দিল।
না না কিসব যা তা ভাবছি আমি।মিথ্যে হবে কেন? আমাদের ভালোবাসা কি শুধু
শরীরী ছিল? শরীরটা পুড়ে গেছে চিতায়।কিন্তু আজো ও আমার।ও যে আমায় কথা
দিয়েছিল।রাঙিয়ে দিয়েছিল আমার সিঁথি ওর রক্তে।
কতদিন ওকে দেখিনি..এক এক সময় ভয় করে হয়ত ওর মুখটাই ঝাপসা হতে হতে ভুলে
যাব।শিউরে উঠি।মাঝরাতে ছুটে আসি এই অন্ধকার ছাদে। চিৎকার করে ডাকি ওর
নাম ধরে।কিন্তু এপারের ডাক কি ওপারে পৌঁছায়? হয়ত না।না হলে আমার ডাক
শুনেও ও আসবে না এতো হতে পারে না।নাকি ওর আর আমার পৃথিবী এতোটাই আলাদা
হয়ে গেছে যে চাইলেও আমরা কাঁচের দেওয়ালের এই দুর্বিষহ অচ্ছেদ্যতাকে ভেদ
করতে পারব না..আর কোনদিন...
না তা হতে পারে না।আজ ওকে আসতেই হবে আমার ডাকে সাড়া দিতে।আজ ভূত
চতুদর্শী, আজ যে এপার ওপার দুপারের জগতের মাঝের সব বাঁধ খুলে যায়।আজ কি
দেখা হবে না?আমার এতদিনের এত অপেক্ষার...
না না ওই তো সিঁড়িতে যেন কার পায়ের শব্দ।আমি কি ভুল শুনছি? তবে কি সে
আসছে? আমার আকুল অপেক্ষা,আমার ডাক সে শুনতে পেয়েছে? সেও কি আমার মতই
আমায় একবার দেখার জন্য গোটা একটা বছর অপেক্ষা করে আছে?
সিঁড়ির দরজা ক্যাঁচ শব্দে খুলে গেল।ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে এক ছায়া
মুর্তি।আমি ছুটে যেতে গেলাম।কিন্তু না।ও তো একা নয়,আর একটা ছায়া মুর্তি
ওর সাথে..কে ও!আমি ট্যাঙ্কের ধারের আবছায়াতেই দাঁড়িয়ে গেলাম।ওই কথা বলল
প্রথম। কতকাল পর ওর গলার স্বর শুনলাম আমি।বুকের ভিতর আকুলতা দ্বিগুণ
বেড়ে গেল।
ও বলছে-"কেন আনলি বল তো আমায়?আমার এখানে আসতে ইচ্ছে করে না রে।আবার সেই
দিনগুলো আমায় কুড়ে কুড়ে খায়।"
পাশের ছায়া মুর্তি এবার কথা বলে উঠল-"ভুলতে হবে তোকে কৌশিক,সব ভুলতে
হবে।আর সেটা এভাবে এড়িয়ে গিয়ে নয় রে।মুখোমুখি দাঁড়িয়েই সেটা ভুলতে
হবে।আমি জানি এটা তোর জন্য কতবড় যুদ্ধ। কিন্তু পারতে তোকে হবেই রে।"
এ গলা আমার বড্ড চেনা!নেহা! আমার প্রিয় বান্ধবী নেহা..কি ভুলে যাবার
কথা বলছে ও? আমাকে ভুলে যেতে বলছে নাকি ও কৌশিককে? কিন্তু কেন এমন
বলছে? ওই তো আমাকে বলেছিল কৌশকের ভালোবাসার কথা।ও-ই তো চেয়েছিল আমাদের
সম্পর্কটা তৈরী হোক।তবে আজ এমন কেন বলছে ও?
কৌশিক বলছে-"আমি তো চেষ্টা করি বল।তুই তো নিজে আমায় নিয়ে ডাক্তারবাবুর
কাছে কতবার গেছিস।ওই ঘটনার পর সব সময় দেখছিস আমায়।আমি কি চেষ্টা করি না
ওই ভয়াবহ দিনগুলো মুছে ফেলতে?তিস্তার সব কিছু ভুলে যেতে?কিন্তু পারি না
তো রে।সেই যে ওর হাতটা আমার হাতের মুঠোয় ধরে হাসপাতালে নিজের আঙুল কেটে
ওর সিঁথিতে...জানিস কতসময় মাঝরাতে মনে হয় ওর ডাকে ঘুম ভেঙে যায়।জোর করে
চোখ বুজে পরে থাকি।"
কৌশিক আমায় ভুলে যেতে চায়? আমার খুব কান্না পাচ্ছে।কিন্তু আমি যে
অশরীরী। আমার তো কাঁদারও উপায় নেই।শুধু নীরবে এই দৃশ্যের সাক্ষী হতে
থাকি।নেহা কৌশিকের হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে চাপ দেয়।বলে-"পারবি
কৌশিক।ঠিক পারবি।ওই ঘটনার ঠিক পরে তোর যা অবস্থা হয়েছিল আজ তুই তার
থেকে কতটা রিকোভার করেছিস তুই নিজেই জানিস না।কিন্তু আমি জানি।আমি তো
দেখেছি বল।আমিও তো হারিয়েছি বল।আমার সেই ছোট্টবেলার বন্ধুটাকে,
তিস্তাকে।তাই তো তার ভালোবাসার মানুষটাকে তিলে তিলে মরে যেতে দেখতে
পারিনি।বার বার ছুটে এসেছি।ডাক্তার দেখিয়েছি কাউন্সিলিং করিয়েছি..
এখানে সেখান সব জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছি শুধু তোকে পুরোপুরি সুস্থ করে
স্বাভাবিক জীবনে ফেরাবো বলে।তুই পুরোপুরি সুস্থ না হলে আমার এতোদিনের
সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে মনে রাখিস।একবার তুই ঠিক হয়ে যা, তখন আমার
ছুটি।"নেহার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে কৌশিক কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠল।
বলল-"কিসের ছুটি? কোথায় যাবি তুই? না না তুই কোত্থাও যাবি না।তিস্তা
আমায় ছেড়ে চলে গেছে।আর আমি হারাতে পারবো না।কিছুতেই না।"
কৌশিক কেমন যেন অদ্ভুতভাবে হাঁফাচ্ছে।নেহা তাড়াতাড়ি বলল-"আচ্ছা ঠিক আছে
ঠিক আছে কোত্থাও যাব না আমি।তোর কাছেই থাকব সারাজীবন।ডাক্তার বাবু তোকে
উত্তেজিত হতে মানা করেছে না কৌশিক।এরকম করে না বাবু।"
কৌশিক কেমন শিশুর মত জড়িয়ে ধরেছে নেহাকে।নেহা ওর মাথার চুলে বিলি
কাটছে।নেহার চোখে জল।নেহা তুই খুব লাকি রে..তোর চোখ আছে,সে চোখে জল
আসে..আমিই ভুলে গিয়েছিলাম আমি কৌশিকের অতীত,থেমে যাওয়া স্তব্ধ হয়ে
যাওয়া অতীত।নেহা ওর বর্তমান।চলমান বর্তমান।জীবনের নামই তো চলমানতা। আমি
তো ওদের পৃথিবীর কোথাও নেই।দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে একটা।
চমকে ওঠে কৌশিক।ট্যাঙ্কের পাশের জমাট অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলে
ওঠে-"কে? কে ওখানে?" নেহা অবাক হয়ে তাকায়। বলে-"কেউ নেই কৌশিক।কেউ
থাকতে পারে না।যে যায় সে আর ফেরে না সোনা।" কৌশিক অস্ফুটে বলে-"কি
জানি, আমার যে মনে হল ঠিক ওর মত...তুই ভুল জানিস..তোরা সবাই ভুল
জানিস..ও তো যায় নি।সারাজীবন আমার বুকের ভিতর ও একই ভাবে থাকবে।"দূরে
বাজির আলোয় দেখলাম ওর গালটা চোখের জল চকচক করছে।
***
ছায়া
ওই যে লোকটাকে দেখছেন অন্ধকারে শরীর মিশিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে ওই
লোকটাই আমার স্বামী। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম আমরা। তখন আমাদের জীবনে
অনেক আলো ছিল। এখন এই অন্ধকারেই আমাদের জীবন আমাদের সংসার।
আমাকে সে বলেছিল -"কথা দিলাম ছায়া তোমায় ছেড়ে কোনদিন কোথাও যাব না।"
আমিও তাকে কথা দিয়েছিলাম "তোমার আজীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবো। "
আমি তাকে বিশ্বাস করেছিলাম। তাই তো তার হাত ধরে সব কিছু ছেড়ে অকূলে
ভেসেছিলাম। মা বাবার সম্মান ভালোবাসা পরিবারের মর্যাদা...কোন কিছুর কথা
না ভেবে রাতের অন্ধকারে তার হাত ধরে পথে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রথম দশদিন
কিচ্ছু বুঝি নি। রেললাইনের ধারে ছোট্ট ঝুপড়িতে শুরু হয়েছিল আমাদের
সংসার। জানতাম অভাব অভিযোগ অনেক থাকবে৷ কিন্তু আমি তো বলেইছিলাম যেখানে
যেমন রাখবে থাকবো, শুধু তোমার সঙ্গে থাকতে চাই।
বিশ্বাস ছিল যতই অভাব থাক ভালোবাসার অভাব হবে না। মনে মনে নিজের কাছে
প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সুখে দুঃখে সে যেখানেই যেমনই থাকুক তার সঙ্গে আমি
থাকবো।
তারপর যে রাতে সে আর ফিরল না পাগলের মত শহরের রাস্তায় রাস্তায়
খুঁজেছিলাম তাকে। কি হল তার। কোন দুর্ঘটনা ঘটল? কোথায় খুঁজবো তাকে?
অনেক রাতে তাকে না পেয়ে ফিরে এলাম ঝুপড়িতে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে
পরেছিলাম। ঘুমন্ত মনে হল সে আমায় কাছে টেনে নিল। চোখ মেলে প্রথমে
অন্ধকারে ঠাহর হয় নি। তারপরই ছিটকে সরে গিয়েছিলাম অচেনা মাতাল লোকটাকে
ধাক্কা দিয়ে। লোকটা কিন্তু আমায় ধরার জন্য এগিয়ে আসছিল। আমি ওর নাম করে
চেঁচিয়ে উঠেছিলাম-" ওগো তুমি কোথায়..বাঁচাও আমায়.."
লোকটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে জড়ানো গলায় বলেছিল-" কে বাঁচাবে তোমায়
রানী? তোমার রাজা তো টাকা নিয়ে ফুড়ুৎ। এখন থেকে আমিই তোমার রাজা।"
বিশ্বাস করিনি লোকটার কথায়। পাগলের মত ছুটে বেরিয়ে এসেছিলাম ঝুপড়ি
থেকে। পিছন থেকে তাড়া করে আসছিল লোকটা। আমি ছুটছিলাম রেললাইন এর উপর
দিয়ে..পা টা আটকে গেল লাইনের ফাঁকে..কিছুতেই বের করতে পারলাম না। ছুটে
আসা আলো আর সেই তীব্র হুইসিলের শব্দ.....
তারপর থেকে আমি ওর সাথে সাথেই থাকি। আমি যে ওর ছায়া ৷ হ্যাঁ ছায়ার মতই
তো থাকি ওর সাথে। কথা দিয়েছিলাম সুখে দুঃখে সব সময় থাকবো ওর সঙ্গে।
কিন্তু কেন জানি না ও বড় ভয় পায়। ল্যাম্পপোস্ট এর নীচ দিয়ে যেতে যেতে
নিজের ছায়ার পাশে আমার ছায়া দেখে আঁতকে পালাতে চায়। ছায়ায় ওর বড় ভয়৷
অথচ ও ছাড়া আর তো কেউ দেখতে পায় না আমায়। লোকে ওকে পাগল ভাবে জানেন। তা
ভাবুক। আমি তো জানি ও পাগল নয়। ও শুধু আলোতে ভয় পায়। তাই অন্ধকারে
লুকিয়ে থাকতে চায়। সেখানে যে ও ছায়াকে দেখতে পায় না। শুধু অনুভব করতে
পারে ওর ছায়া সঙ্গিনীকে।
***
পূর্ণগ্রাস
এই যে বিরাট বটগাছটা দেখছেন এটা শুধু বটগাছ নয়। এই গাছের নীচে দাঁড়িয়ে
শুদ্ধ ও একাগ্র চিত্তে পূর্ণগ্রাস গ্রহণের সময় যদি কিছু চাওয়া যায় তবে
তা পাওয়া যায়ই যায়। এই বৃক্ষের খোঁজ আমায় দিয়েছিল অনন্ত তান্ত্রিক।
বলতে চায় নি। কিন্তু শ্মশানের চিতার লালচে আগুণের আঁচে রক্তাভ মুখে লাল
চোখ মেলে নেশার ঝোঁকে যখন সে কথাগুলো বলেছিল আমি বুঝেছিলাম সে এক বর্ণও
মিথ্যা বলছে না। বলেছিল-"যা চাইবি তাই... একদম তাইইই। ভালো চাইলে ভালো
মন্দ চাইলে মন্দ। তাই পাবি।" পরের দিন নেশাকাটার পর অনুতাপ হয়েছিল
বোধহয়। তাই চলে গিয়েছিল অনন্ত তান্ত্রিক শ্মশানের ঠাঁই ছেড়ে অন্য
কোথাও। তা যাক। জগৎ সংসারে কেই বা চিরকাল থাকবে? জীবন... সেও তো চলে
যাবে। এ তো সামান্য মানুষ। মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। তবে আমার ভয় মৃত্যু
যন্ত্রণা, রোগ ভোগ আর শোককে।
আমার আপাত ভাবে কিছুর অভাব নেই। আমি জমিদার শিবসুন্দর চৌধুরীর একমাত্র
বাউন্ডুলে ছেলে সিদ্ধার্থসুন্দর চৌধুরী। অর্থ অঢেল। বিলাসের অভাব নেই।
আমার বাউন্ডুলে হাব ভাবের জন্যই বাবা আমার অল্প বয়েসে বিয়ে দিয়েছেন।
আমার স্রী সুপর্ণা অপূর্ব সুন্দরী। আমার পুত্রসন্তান বহ্নিমান। জীবনের
কাছে একজন মানুষের যা যা চাইবার থাকে সবই আছে আমার। কিন্তু তবু আমার
স্বস্তি নেই। ভয় আমায় সদা সর্বদা গ্রাস করে। আমার ঠাকুর্দা ব্রজসুন্দর
চৌধুরীর পক্ষাঘাতে অসার শেষ অবস্থার তার বিছানায় সাথে মিশে থাকা
শয্যাক্ষত যুক্ত শরীরটা আমায় ভয় দেখায়। ডাকসাইটে জমিদার ব্রজসুন্দর..
আমার ঠাকুরদা..যার বড় প্রিয় নাতি আমি। দিনরাত বিছানায় শুয়ে কাতরাতেন
তিনি। আর আমি জানলার বাইরে থেকে দেখতাম। উনি ডাকতেন। আমার ভয় করত।
প্রচন্ড ভয়। সেই ভয়ে পালিয়ে আসতাম। মারা যাবার দিন ঠাকুরদা সারাদিন রাত
চিৎকার করেছিলেন। এক মুহুর্তের জন্য থামেন নি। থামলেন যখন পাঁজরার
খাঁচার মৃদু ওঠা নামা একেবারে স্থির হয়ে গেল তখন। আমি পাগলের মত
কেঁদেছিলাম। সেই আমার প্রথম মৃত্যুশোক। উফফ....কি ভীষণ যন্ত্রণা।
মৃত্যুর চেয়েও শোক আরো বেশী যন্ত্রণার। তাই আমার বড় ভয়। মৃত্যুকে নয়।
মৃত্যু যন্ত্রণা, রোগভোগ... আর শোককে। তাই এগুলোর হাত থেকে বাঁচতে আমি
ঘুরে বেরিয়েছি অজস্র। সাধু তান্ত্রিক সবার কাছেই শুধু এই এক প্রশ্ন
রেখেছি। অবশেষে নেশার ঝোঁকে অনন্ত তান্ত্রিক আমায় পথ দেখালো।
আমি বহুদিন অপেক্ষায় থেকেছি। তারপর আজ পূর্ণগ্রাস। আজ আমি এসে
দাঁড়িয়েছি এই শতাব্দীর পুরাতন বৃক্ষের নীচে। সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। আজ
পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ। কিন্তু আকাশে চাঁদের দেখা নেই। ঘন মেঘ ঢেকে
রেখেছে পুরো আকাশ। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চিড়ে দিয়ে যাচ্ছে তার বুক। আমি
নদী থেকে স্নান সেরে সিক্ত বস্ত্রে এসে দাঁড়িয়েছি বৃক্ষের ঝুরি নামানো
অন্ধকার গর্ভে। আকাশ যেন ফালা হয়ে গেল। আমি বলে উঠলাম-"হে বটবৃক্ষ,
তুমি আমার মনোবাঞ্ছা পূরণ কর।" আমার নিজেত স্বরই যেন আমার নিজের কানে
কেমন অপার্থিব শোনাচ্ছে। আমি বলে চললাম -"মুক্তি দাও হে বটবৃক্ষ আমাকে
আমার সমগ্র পরিবারকে। মৃত্যুভয় থেকে, শোক থেকে, রোগ যন্ত্রণা থেকে।"
আমার শব্দগুলো যেন বৃক্ষের কোঠরে কোঠরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছে।
মৃত্যুভয় শোক রোগযন্ত্রণা.... গুম গুম শব্দে মেঘ ডাকল। যেন মহাকাল বলে
উঠল তথাস্তু।
সেরাতে ভয়ানক দুর্যোগ হয়েছিল। এমন ঝড় বহুকাল দেখে নি গ্রামবাসী।
মুহুর্মুহু বাজ পরছিল। সবাই যে যার বাড়ি কাঁটা হয়েছিল। একসময় সবাই
ভয়ার্ত হয়ে শুনেছিল একটা ভয়ানক হুড়মুড় শব্দ। ঝড় থামতে আবিষ্কার করেছিল
জমিদার বাড়ির পশ্চিমদিকের দালানে বাজ পরে তা ভেঙে পরেছে। ওদিকটা হালেই
মেরামত করা৷ তবু যে কিভাবে ভেঙে পরল। জমিদার বাবু, বৌমা আর খোকা তিনজনই
এক ঘরে ছিল। ছাদ ধ্বসে এক সঙ্গে শেষ। লোহার কড়িবরগার নীচ থেকে পরের দিন
স্তুপ সরিয়ে বার করা হয়েছিল ওদের দেহ। সবাই খুঁজছিল সিদ্ধার্থসুন্দরকে।
কিন্তু সে তো বরাবরের বাউন্ডুলে। তার হদিশ মেলে নি। কেউ জানতেও পারে
নি। সেদিন ঝড়ের ধাক্কায় ভেঙে উপড়ে গিয়েছিল শতাব্দীর প্রাচীন কল্পতরু
বটবৃক্ষটিও যার ঝুরিনামা অন্ধকার গর্ভে চাপা পরে তাৎক্ষণিক মৃত্যু
হয়েছিল সিদ্ধার্থের...রোগহীন, শোকহীন...মৃত্যুভয়হীন।
***
কুকুর
আমরা এপাড়ায় নতুন বাড়ি করে এসেছি। পাড়ার একদম শেষ প্রান্তে আমাদের
দোতলা বাড়ি। তারপর বড় পুকুরটা। পুকুরের ওপার থেকে হালদারপাড়া
শুরু।পুকুরের ওপারে প্রথম বাড়িটাও দোতলা। আমাদের বাড়ি থেকে অনেকটা দূর
হলেও মাঝে কোন বাড়ি ঘর না থাকায় বাড়িটা দেখা যায় আমার ঘরের জানলা দিয়ে।
ওদের বাড়ি একটা বাচ্চা আছে। আমার ঘরের দিকে ওদের বক্স জানলাটায় সে খেলা
করে ওদের কুকুরটার সাথে। সাদা লোমের কুকুর। ওদের পোষা কুকুর জানি। তাও
আমার বাবা ভয় করে। কী করে ওরকম এই টুকু বছর দেড়েক বাচ্চাকে একটা
কুকুরের সাথে ছেড়ে দেয়।৷ নখ লেগে গেলে বাচ্চাটা তো বলতেও পারবে না।
অবশ্য আমি যে একটু কুকুর ভীতু সেটাও সত্যি।
তবে কুকুরটা ওদের পোষা বেশ বাধ্য বোঝা যায়।ছেলেটা বক্স জানলায় উঠে
দাঁড়ালে সেও উঠে দাঁড়ায়।দুপায়ে ঘুরে যায়। ছেলেটা কান ধরে টানে। কিন্তু
কিচ্ছুটি করে না। জিভ বার করে হাঁফায়।
হালদারপাড়ায় আমার ননদ বাড়ি কিনেছে। প্রায় ছয়মাস হল আমরাও এখানে আছি।
কাছাকাছি থাকতে পারবে বলেই এই সিদ্ধান্ত। আমরা ননদের বাড়ি গৃহপ্রবেশে
এলাম। পাড়ার সবাই এসেছে।কথায় কথায় পরিচয় হল পুকুরের ধারের বাড়ির
লোকেদের সাথে।বাচ্চাটাও আছে। দূর থেকে ছেলে ভাবতাম।এখন দেখছি মেয়ে। গাল
টিপে আদর করে বললাম-"দেখি তো জানলায় কুকুর নিয়ে খেলতে।" বাচ্চাটার মা
হেসে বলল-"হ্যাঁ ওই সাদা সফট টয়ের পুতুলখানা ওর প্রাণ।নিয়ে খাওয়া
ঘুমানো সব।" আমি ভুল শুধরে দিয়ে বললাম-"না না সফট টয়ের কথা বলছি না।
সেই সাদা তুলোর মত লোমের জ্যান্ত কুকুরের কথা বলছি।" বৌটি অবাক হয়ে
হেসে বললেন-"আমাদের তো কুকুর নেই?" তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম।আমি তো রোজ
দেখি কুকুরটাকে।
বাচ্চাটার বাবা এতক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে হাসি হাসি মুখে আমাদের কথা
শুনছিলেন। এবার হেসে বললেন-"আমার ছোটবেলায় একটা সাদা লোমের কুকুর আমার
সাথে খেলত। একবার জানলা ধরে জিমন্যাস্টিকস করতে গিয়ে দোতলার কাঁচের
জানলা ভেঙে পরে মরে যায়। সেই শোক আমার বাবার খুব লেগেছিল। তাই আর কুকুর
আনতে দেয়নি কোনদিন।কুটু ওই সফট টয়ের পুতুল নিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে
মেটায়।" আমার মাথাটা ঘুরছিল। কী বলছে এরা।
সেদিন বাড়ি চলে এসেছিলাম। তবে তারপর থেকে জানলায় বাচ্চাটাকে একটা
নিস্প্রাণ সফটয়ের সাথেই খেলতে দেখেছি।
✍ রত্না চক্রবর্তীর দুটো গল্প
হারিয়ে পাওয়া অন্যরহস্য
***
আমার গল্প( অন্যরহস্য)