গাছ-হত্যা-করা কাগজে ছাপা সংকলনকেই অনেকে প্রকৃত পত্রিকা মনে করেন,
আবার অন্যদিকে আধুনিক জগতে ধীরে ধীরে কাগজের ব্যবহার উঠেই যাচ্ছে। নগদ
কাগজের টাকা ধরে দেখিনি দু-যুগেরও বেশি। Professional Engineers of
Ontarioর দ্বিমাসিক পত্রিকা Engineering Dimensionsও এখন ওয়েব-ভিত্তিক।
কার্তিকের কুয়াশা কাগজে সীমাবদ্ধ পত্রিকা নয় বলেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে
দেওয়া সম্ভব হয়েছে। কার্তিকের কুয়াশা ফেসবুক-নির্ভর প্রকাশনা নয় বলেই
স্বয়ংসম্পূর্ণ।
আমাদের এই উপযোগবাদী বিশ্বে আমরা যখন সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের চেয়ে
উপযোগিতার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকি, তখন কবিতা লেখা বা কবিতা
পাঠের চেয়ে বেশি অর্থহীন কিছু খুঁজে পাওয়াই হয়তো কঠিন হবে। কবিতা লিখে
বা কবিতা পড়ে কেউ বড়োলোক হয় না। কবিতা তো আর 'সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের
সর্বাধিক সুখ' নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রচিত নয়। তাহলে কেন লিখবো কবিতা,
কেন পড়বো কবিতা? ব্যবহারিক মূল্যের প্রশ্ন এসে গেলে কবিতা হয়তো একদম
অর্থহীন। তবে আমার মনে হয় যে কোনো বিষয়ই একাধিক দিক থেকে বিচার করা
সম্ভব। আরবি সংখ্যা 'নয়' অর্থাৎ 9 দেখতে যেমন নয়, তেমনি ছয়ের মতো।
নির্ভর করছে আপনি কোন দিক থেকে দেখছেন। একটু নজর রাখলে কাব্যচর্চাকেও
নয় ছয় করার অর্থাৎ অপচয়ের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব। প্রথমত কাব্যচর্চা
মানবশরীরের সেই অঙ্গটির সাথেই সম্পর্কিত যার ব্যবহার সবচে অসম্পূর্ন আর
তা হলো হৃদয়। হৃদয়ের কথা বলা, শোনা আর বোঝার নামই তো কাব্যচর্চা।
কবিতায় ছন্দ এবং ছন্দোবন্ধের আর একটি উল্লেখযোগ্য উপকরণ ‘মিল’ বুঝলেই
যে কবিতাপাঠ সম্পূর্ণ হয়ে উঠলো তা নয়। যদিও মিল মুখ্যত কাব্যালঙ্কার
শাস্ত্রের অন্তর্গত, তবে ছন্দেও তার কিছু প্রভাব রয়েছে। যাহোক কবিতা
যেহেতু প্রথমত আবেগেরই বহিঃপ্রকাশ, কবিতাপাঠে আপনি আপনার অনুভূতিকে
সংশ্লিষ্ট করতে ব্যর্থ হলে বলতে হবে আপনি কবিতা পড়েনইনি। আপনি যখন
কবিতা পড়ছেন কবিতা তখন একটি যুক্তিযুক্ত এবং কাঠামোগত উপায়ে আপনার
আবেগকে নিয়োজিত করে, নিয়োজিত করে আপনার হৃদয়কে, আপনার মস্তিষ্ককে।
কবিতায় মিশ্রিত আবেগ এবং সাধারণ আবেগ এক নয়। ধ্রুপদী কবিতায় উপস্থিত
যে আবেগ তা আপনার আবেগকে আপনার মেধার সাথে মিশ্রিত ক’রে একটি উচ্চতর
এবং মহৎ অভিজ্ঞতায় পরিণত করে।
"কবিতা পড়া কঠিন, কিন্তু কবিতা লেখা আরও কঠিন। এবং চলুন শুরু থেকেই এই
মুক্তছন্দ জিনিসটি বাদ দেওয়া যাক। রবার্ট ফ্রস্ট বলেছিলেন, 'মুক্তছন্দে
লেখা নেট ছাড়া টেনিস খেলার মতো।' মুক্তছন্দে লেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ
কাজ। সপ্তম শ্রেণীর মেয়েরাও আকছার লিখছে । আপনাকে যেমন পঁচিশ বছর ধরে
তপস্যা না করা পর্যন্ত সন্ন্যাসী হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না, তেমনি
আপনি সবগুলো নিয়মানুগ ও যথাযত ছন্দ আয়ত্ত না করা পর্যন্ত আপনার সত্যই
মুক্তছন্দে লেখা উচিত নয়।" এ কথা আমার নয় এ কথা বলেছেন আমেরিকান কবি
ডোয়াইট লংগনেকার।
অন্টারিও বিল্ডিং কোড অনুযায়ী সিঁড়ির প্রতিটি ধাপের উচ্চতা ৭.৮৭৫
ইঞ্চি। কারো মনে হতে পারে প্রতিধাপে ইঞ্চি খানেক কম বেশি হলে কী আর
ক্ষতিবৃদ্ধি হবে! কোনো ধাপে ৭ ইঞ্চি কোনো ধাপে আট ইঞ্চি আবার কোনো ধাপে
ছয় ইঞ্চি এরকম কোনো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দেখেছেন কখনো? আপনার পা চলবে
না - হোঁচট খাবেন। ঠিক একই কারণে নির্দিষ্ট মাত্রায় একটি কবিতা রচিত না
হলে পাঠক হোঁচট খাবেন এইতো স্বাভাবিক। মনে রাখবেন পৃথিবীর সব বিখ্যাত
কবিই মাত্রা গুনে কবিতা লিখেছেন, লিখতে লিখতে একদিন এতটাই অভ্যস্ত এবং
পারদর্শী হয়ে ওঠেন যে তাঁদের কলম থেকে অনায়াসে বেরিয়ে এসেছে নিখুঁত
কবিতা। তা একদিনে হয়নি। আর একটি কথা - কবিতায় অন্ত্যমিলের মূল্য অনেক
হলেও যে দোলার টানে পাঠকের মনপ্রাণ দুলে ওঠে তা কিন্তু 'মাত্রা' । আর
ভাবের কথা, দর্শনের কথা কেউ তুললে আমি বলবো সেজন্য 'দর্শন' নিজেই
রয়েছে। দর্শন তো সব বিজ্ঞানের বিজ্ঞান। দর্শনশাস্ত্র পড়লেই আমাদের
ক্ষুধাতৃষ্ণা সম্পূর্ণভাবে মেটে না। এই দর্শন ছন্দের নিপুন কৌশলে ধরা
পড়লেই আমাদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য মনে হয়।
কার্তিকের কুয়াশার 'পাঠক পরিষদ' এ সংখ্যার জন্য যে লেখাগুলো নির্বাচন
করেছেন তা আমাকে বিশেষভাবে চমৎকৃত করেছে, চমকিত করেছে । কার্তিকের
কুয়াশার দীর্ঘদিনের কবিবন্ধু জয়া চক্রবর্তী সোমা নির্ভুল মাত্রাবৃত্তে
লিখেছেন দুটি কবিতা আর স্বরবৃত্তে একটি। স্বরবৃত্তে অভ্যস্ত কবি
তনুশ্রী সামন্ত দুটো অসাধারণ ছড়ার সাথে অক্ষরবৃত্তে লিখেছেন একটি
অসাধারণ চতুর্দশপদী কবিতা। রীনা ঘোষের 'ঝর্ণা হবো' কবিতায় স্বরবৃত্তের
দোলা পাঠক-হৃদয়কে আন্দোলিত করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
গদ্যের পাতাগুলো বরাবরের মতোই অসাধারণ। আছে ছোটগল্প, আছে ভ্রমণ কাহিনী।
সাইদুজ্জামান, টরন্টো, কানাডা।