রত্না চক্রবর্তী
২০.৪.২২
১৭.৫.২২
বিকাশবাবু তার আনাজের মস্ত থলিটা শঙ্কুর হাতে দিয়ে বললেন, " এই একটু ধরতো,
শোভনকে আসতে বলেছি, ভোলার সাথে পরিচয়টা করিয়ে দেব। এক্ষুনি এসে পড়বে,
বৃহস্পতিবার আর বেলার দিকে ফাঁকা থাকে বলে এই টাইমটাই ফিক্সড করেছি। "
বিকাশবাবু ভোলার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, " ভোলা মনে আছে তো, এ মালদার
পার্টি, এ দিকেই একদম নতুন, কিছু চেনেটেনে না। আমার স্কুল কলেজের বন্ধু।
রোজ চিকেন রাতে বরাদ্দ, বাজার করার সময় নেই, বাড়িতে বাজার করার লোক নেই
আবার কেনা খাবার খায় না। বুড়ো বাপ, বৌ দুটো বাচ্চা আছে। পয়সাওলা লোক পেছনে
রাঁধুনি বেঁধে ঘোরে। তাই তোমার নামটাই রেকমেন্ড করে দিলাম, বলেছি চিকেন
অনেকেই বেচে কিন্তু তোমার মতো বেস্ট মাল আর কারো কাছে নেই। "
এক চোখ ছোট করে টিপে ভোলার দিকে ঘাড় নেড়ে হেসে বিকাশবাবু আবার বললেন, "
'এক্লাস মাল, হাইক্লাস জিনিস' করে করে মরে, তাই একটু ডোজ দিয়ে দিলাম। আমি
বলেছি একদম কেটেছেঁটে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসবে বেলা দশটার মধ্যে। দাম একটু বেশি
পড়লেও জিনিস একদম একনম্বর আমি গ্যারেন্টি। তারপর তুই বুঝেসুঝে ট্যাক্স বসাস
বুছেছিস। ওই যে আসছে দেখতে পাচ্ছি, দূরে ওই নীলসার্ট দেখা যাচ্ছে। "
বিকাশবাবু একটু এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে হাসিমুখে, পিছনে শঙ্কু। শঙ্কু
এগিয়ে এসে চাপা গলায় বলল, " কাকু আপনি নান্টুর সঙ্গে ফিট করিয়ে দিতে
পারতেন, ও কিন্তু একই জিনিস অনেক কমে দিতে পারত। ভোলা এমনিই বেশী নেয়। "
বিকাশবাবু বললেন, " ধুস ছাড় তো, ইনকাম ট্যাক্সে চাকরি করে ঘুষের পয়সায় লাল,
একটু খসুক খসুক। এইসব ঘোষখোরদের পয়সা ঝরিয়ে দিতে পারলে পূণ্যই হবে। বরং
খেটে খাওয়া ব্যবসায়ী ভোলার দুটো পয়সা হোক । আর নান্টুর বড় চ্যাটাং চ্যাটাং
কথা। মাংসের সাথে একটু বেশি মেটে ফাউ চাইলে দেয় না, বলে সবাইকে তো একটু
একটু দিতে হবে, এ আপনাকে একলা দিলে হবে না তো। ভোলা হিসেব বোঝে, চুপ কর...
ওই এসে গেছে।"
শোভনবাবু হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসে বিকাশের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, " দেরি
হয়ে গেল ভাই, বেরোবার মুখে একটা জরুরী ফোন এসে গেল। "
শঙ্কু দেখল টকটকে ফর্সা, একটু ভারী চেহারা, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, ঈষৎ
টাক মানুষটার মুখে লজ্জা পাওয়া হাসি। তার বিকাশকাকুরই বয়সী। শঙ্কু
বিকাশবাবুর দূর সম্পর্কের ভাইপো। একটু কম বোধের, লেখাপড়া তেমন হয় নি, বড়ির
অবস্থা খারাপ। বিকাশবাবু কাজের সাহায্য হবে বলে নিজের কাছে রাখেন সারাদিন,
রাতে বাড়ি। খাওয়া দাওয়া তার কাছেই। দুইশত টাকা হাত খরচ দেন। বিকাশবাবুর
মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসে, ছুটির দিন বাদে সমস্ত দোকানবাজার করে, জামাকাপড়
ইস্ত্রি করিয়ে আনে, পোস্ট অফিসে লাইন দেয় আর বাড়ির যত টুকিটাকি কাজ করে
আপনজনের মতো। সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে তার কাকা আর তার বন্ধুর দিকে।
ভোলার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন বিকাশবাবু বলেন, " টাকা-পয়সার কথাটথা তোমরা বলে
নাও, আমি ও ব্যাপারটা ভালো বুঝি না। আমার শুধু পরিচয় করাবার দায়িত্ব ছিল।
তবে ভোলা একটা কথা বলে দিচ্ছি, আমি তোর নাম সুপারিশ করেছি, ঠিকঠাক জিনিস
দিবি যতটা কমে সম্ভব দামে , আমার মাথা যেন নিচু না হয়, এ আমার অনেকদিনের
বন্ধু। "
ভোলা বড় বড় করে হাসিমুখে ঘাড় নাড়ে। শোভনবাবু বলে, " বিকাশ চলি রে, আমার
গাড়ি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকবে, এখানে বাজার এরিয়া লোকের অসুবিধা বলে
ওখানেই রাখি। দেরি হয়ে যাবে আবার। "
হাত তুলে বিদায় জানায় একে অপরকে।
শোভনবাবু অদৃশ্য হতেই বিকাশবাবু বলেন, " কিরে ফিট করে দিলুম তো, বারোমাসের
ব্যাবস্থা এডভান্স করে গেল, এসব ব্যাপারে পারফেক্ট। তা এবার আমারটা তোল,
অনেক দেরি হয়ে গেল, আজ রান্না নামতে দেরি হবে। শোন একটা লেগপিস যেন অন্তত
থাকে, আর চর্বিওয়ালা দিবি না। আমার বাড়ি লোক কম এককেজিই দে। এখন আবার বেশ
কিছুদিন আসতে পারব না। আমার বাড়ি রবিবার করে পাঁঠাই চলে, মাসে একবারই মুরগী
খাওয়াস তাহলেই চলবে। "
ভোলা প্যাকেটের মধ্যে খানিকটা মেটেও দিল, তারপর হাসিমুখে শঙ্কুর হাতে তুলে
দিল।
বাদু হাঁ করে তাকিয়ে রইল। সে ভোলার দোকানে মুরগী কাটে। ওরা চলে যাবার পর
সে বলল, " এ মাগনায় খাবে নাকি বস! মাল নিয়ে দাঁত কেলাতে কেলাতে চলে গেল যে!
"
ভোলা হাত ধুতে ধুতে বলল, " মাসে এককেজি, ওই পার্টির সাপ্লাই থেকে রোজ পঁচিশ
ত্রিশ গ্রাম কম দিলে অসুবিধা হবে না, ম্যানেজ করতে হবে। এই দস্তুরি। "
বাদু দাঁত বার করে বলল, " লোকটাকে মুরগী করে মুরগী ঘুষ নিল! গুরু গুরু! কি
কায়দা মাইরি! "
"বকুল সই"
শাহনাজ শারমিন
শিশিরের দূর্বা ভেজা মেঠোপথের রাস্তা।বাবার হাত ধরে লাফাতে লাফাতে বেলা
স্কুলে যাচ্ছে । ওর বয়স চার বছর, আজ ওর প্রথম স্কুল যাত্রা। নীলাঞ্জনা সরকার বাড়ির সামনে দিয়ে ছোট ছোট বাচ্চারা লাইন করে যাচ্ছে, কি সুন্দর লাগছে
ওদের - গাঁদা ফুলের সাজে অপরূপা। মালতি জানলা দিয়ে ওদের দেখছে আর মিষ্টি
গলার গান শুনছে.....'বাংলার মাটি বাংলার জল'। আজ রবীন্দ্রজয়ন্তী, খুব
পছন্দের 'বীরপুরুষ' কবিতাটা মনে পড়লো....
কুঁকড়ানো কালো চুলে ঝুটি বাঁধা । সাদা একটা ফ্রক গায়ে দেখতে মনে হচ্ছে
যেন সাদা পরী । এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর হাসিতে গড়িয়ে পরছে।।
বাবা পরম যত্নে মেয়েকে আগলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ।
"
বকুল গাছটা এক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে , ওদের চলার পথের দিকে।
রাস্তা থেকে প্রায় পঁশিচ ত্রিশ গজ দুরে একটা বিশাল বড় পরিত্যক্ত ভিটি ।
সেই ভিটির ঢালে অযত্নে অবহেলায় বেড়ে উঠেছে বকুল গাছটি।
,,
বকুলের মনে খুব কষ্ট । সারা বছর কতো কষ্ট করে খেয়ে না খেয়ে অনেক যত্ন
করে নিজের বুকে ফুল ফুটায় কিন্তু কেউ কখনো সেই ফুল তাকিয়েও দেখে না ।
বকুল কিন্তু রোজই ছোট বড় অনেক লোকজনকে তাকিয়ে দেখে আর মনে মনে ভাবে এই
বুঝি ওরা ফুল কুঁড়াতে আসবে কিন্তু না, প্রতি দিনই হতাশ হয়ে বকুলের
দিন গড়িয়ে আবার রাত শুরু হয়।
বেলাকে দেখে বকুলের খুব ভালো লাগে।তাই ওর চলার পথের দিকে তাকিয়েই থাকে
আবার ফেরার অপেক্ষায়।এভাবে কেটে গেলো এক বছর।
এখন বেলা একটু বড় হয়েছে। ওর বাবা এখন আর ওর সাথে স্কুলে যায়না।ওর অনেক
বন্ধু হয়েছে, তাদের সাথে বেলা স্কুলে যায়।
,,
একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে বেলা বন্ধুূদের বলে,এই দেখ অনেক সুন্দর গন্ধ
নাকে লাগছে।
বেলার সাথে থাকা মালা বলে,হ বকুল ফুলের গন্ধ।
আয় মালা আমরা বকুল ফুল তুলে আনি।যেই কথা সেই কাজ।
সাথে সাথে ওরা আট দশজন ঝুপঝাড় ভেঙে বকুল গাছের নিচে চলে গেলো।
কুচরো ভর্তি করে ফুল কুড়াল সবাই।
এবার বকুলের খুশি দেখে কে।বকুল যেন খুশিতে আত্মাহারা।
,,
এভাবেই প্রতি দিন ওরা ফুল কুঁড়াতে যায়।এখন আর আগের মতো ঝোপঝাড় নেই।
একদিন বেলা দেখে গাছের তলাটা শুকনো। নিজের খাবারের পানির বোতল থেকে
সবটুকু পানি গাছের গোড়ায় ঢেলে দেয়।
তা দেখে মালা বলে,কি রে বেলা তুই গাছের গোড়ায় সব পানি ঢেলে দিলি কেন।
বেলা বলে,শুনিসনি স্যার বলেছে গাছের জীবন আছে। ওদেরও খাবারের প্রয়োজন।
বকুল মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলে,আহা আমার সাদা পরীটার আমাকে নিয়ে কতো
ভাবে।
প্রতি দিনের মতো আজোও ওরা গাছ তলায় ফুল কুঁড়াতে যায় কিন্তু কোন ফুল না
পেয়ে অভিমানে বেলা বলে,ওগো বকুল সই তুমি আমার জন্য একটা ফুলও আজ রাখনি।
বেলা মুখে সই কথাটা শুনে বকুল খুব খুশি হয়ে বাতাসকে বলে,ও বাতাস ভাই
তোমার যত শক্তি আছে তাই দিয়ে আমার বুকে থাকা ফুলগুলো ঝরিয়ে দাওনা।
বাতাস বকুলের কথা রাখে।
টপটপ করে ঝরে পরে গাছের ফুল।বেলারা মনের আনন্দে ফুল কুঁড়াতে থাকে।
,,
প্রকৃতির নিয়মে সময় গড়াতে থাকে। এখন বেলা দশ ক্লাসে পড়ে।
,,
পাশের বাড়ির রতন কলেজে পড়ে।বেলা যে স্কুলে পড়ে সেই স্কুলেই আবার কলেজও
আছে। তাই দুজনে একাত্রই যায়।
একদিন বেলা আর রতন দুজনে মিলে বকুল গাছের তলায় এসে বসে। ওরা ওদের মনের
কথা বলে।
বেলা বলে,রতন আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবনা।বেলা আমিও
তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।
রতন,আমার বকুল সইকে সাক্ষী রেখে বললাম, তুমি আমাকে ভুলে গেলে আমি
আত্মহত্যা করবো।
রতন,বেলার মাথাটা ওর বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে।
এভাবেই দিনের পর দিন কাটতে থাকে আর ওদের ভালোবাসা আরো গভীর হতে থাকে।
বকুল ওদের সব কথার নিরব সাক্ষী হয়ে থাকে।
,,
প্রতি দিনের মতো আজোও ওরা কথা বলছে,এমন সময় হঠাৎ রতনের বাবা সাথে আরো
পাঁচ ছয়জন এসে হাজির।
রতনের বাবা এসেই বেলাকে বকুল গাছের সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধে।বেশ কয়েকটা চর
থাপ্পড় মারে।ছেলেকেও মারে।
,,
খবর শুনে বেলার বাবা আসে,।সাথে সাথে গ্রামের অনেক লোকজন। শুরু হয় তুমুল
কান্ড।
রতনের বাবার অশ্রাব্য ভাষা সহ্য করতে না পেরে বেলার বাবা বকুল গাছের
একটা ডাল ভেঙে বেলাকে হাতে পায়ে পিটাতে থাকে।
বেলার আত্ম চিৎকারে চারপাশ ভার হয়ে উঠে।বকুল চিৎকার করে কেঁদে বলে আমার
সইকে আর মের না কিন্তু গাছের কথা কারো কানে পৌছায় না।
ওরা টেনে হিঁচড়ে বেলাকে নিয়ে যাচ্ছে আর বেলা চিৎকার করে বলছে, আমি
রতনকে ভালোবাসি।
,,
রতন এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যায়।
,,
চারিদিকে ফজরের আজান হচ্ছে। তখনো অন্ধকার কাটেনি। বকুল খেয়াল করলো,
বেলা এদিকে এগিয়ে আসছে।গাছ তলায় এসেই তরতর করে গাছের উপর উঠে বসলো।বকুল
হটাৎ করে বেলাকে গাছে উঠতে দেখে ভয় পেয়ে গেলো।
,,
বেলা কোমরে গুজা ধরিটা বের করে গলায় পেচিয়ে নিলো।কান্না জড়িত কন্ঠে
বেলা বলে,ও বকুল সই তুমি তো জানো আমি রতনকে কতো ভালোবাসি।ওরা কেউ আমাকে
আর রতনকে এক হতে দিবে না।রতনকে ছাড়া আমিও যে বাঁচতে পারবোনা।
এ জীবনে আমি রতনকে পেলাম না। ঐ জীবনে আমি ওর অপেক্ষায় থাকবো তুমি ওকে
বলে দিয়।কথা শেষ করে দড়ির আর একটা অংশ গাছের সাথে পেচিয়ে বেলা ঝুলে
পড়লো।,
,,
বকুল চিৎকার করে কাঁদতে থাকে আর ওদিকে বেলা ছটফট করে হাত পা নাড়তে
থাকে। একটা সময় বেলার ছটফটানি বন্ধ হয়ে নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
বকুল বুঝতে পারে ওর বেলা সই আর নেই।
সেই থেকে আর বকুল গাছে কোন ফুল ফুটেনা।
,,
প্রতি নিয়ত বকুল বেলার শোকে কাঁদে।এভাবে কেটে গেছে প্রায় তিন যুগ।
,,
তখন বেলা প্রায় দুপুর। হঠাৎ লাল রং এর একটা গাড়ি রাস্তার পাশে এসে
থামে।কাঁচাপাকা চুলের মধ্য বয়সী একটা লোক সেই গাড়ি থেকে নেমে ঝুপঝাড়
ভেঙে বকুল গাছের দিকে এগিয়ে আসে।
কাছে আসতেই বকুল চিনতে পারে রতনকে।চুখ থেকে চশমাটা খুলে হাউমাউ করে
কাঁদতে থাকে রতন।
ও বকুল সই, তোমাকে তো আমার বেলা বড্ড বেশি ভালোবাসতো।সেদিন তুমি কি
আমার বেলাকে বাঁচাতে পারনি।বকুল তার কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে নিরবে কাঁদতে
থাকে।
,,
ও বকুল সই আমার বেলা তোমাকে খুব ভালোবাসতো তাই এই বাগান বাড়িটা আমি
কিনে নিয়েছি।তোমার কাছে একটা ঘর তুলে আমি বাকি জীবনটা এখানেই কাটাবো।আজ
থেকে তুমি আমারও বকুল সই,,,।
ভালোবাসার রবীন্দ্রজয়ন্তী.....
মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে
টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে.......
কবিতাটি মালতির কাছে এখন অনেকটাই স্মৃতি, শুধু বিগত বছরের প্রতিটিক্ষণ মনের
সাথে দিন - রাত লুকোচুরি খেলছে। মালতি নিজের গর্ভ- কে স্পর্শ করে, চোখ টিপে
রাখে যাতে একফোঁটা জল বেরিয়ে না আসে। ভালোবাসার বিয়ে হয়েছিল মা হারা
অতনুর সাথে। সবাই খুব খুশি হয়েছিল এই বিয়েতে। বিয়ের তিন বছর কেটে যায়
নিমেষে আর মনের মধ্যে মা হওয়ার বাসনা আঁকরে বসে। অতনুকে তখন রোজ আঠেরো
ঘণ্টারও বেশি ডিউটি দিতে হচ্ছে....হবেই... মনকে শান্ত করেছিল মালতি, অতনু
যে ক্রাইম ব্রাঞ্চ এ আছে সেকথা ভুললে চলবে না। জীবন তখন রূপকথার দেশ থেকে
বাস্তবের মাটিতে পা রেখেছে, মালতি জানতে পারে সে মা হতে চলেছে, তখুনি ফোন
করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলতে চেয়েছিল অতনুকে কিন্তু তার আগেই ফোন
এসেছিল ওর অফিস থেকে। পাগলের মত রাস্তাতেই বসে কাঁদছিল সেদিন মালতি আর
অতনুর বাবা হন্যে হয়ে ট্যাক্সি খুঁজছিলেন, ছেলে যে বোম্ব ব্লাস্টে
সাংঘাতিক ভাবে আহত! আজ সেই ঘটনার ছয় মাস কেটে গেছে, অতনু পা হারিয়ে তার
বীরপুরুষ তকমা খুইয়েছে নিজের কাছে, একসময়ের ডাকসাইটে পুলিশ আজ ক্লার্কের
কাজ করে অফিসে বসে। এ বড় যন্ত্রণার !অতনুর দু চোখের দিকে তাকালে মালতি ভয়
পায়, তবু তাকে বুকে জড়িয়ে আগলে রাখে রোজ....যখনই রাত হয় - আঁধারের
বিভীষিকা অতনুকে মানসিক ভাবে গ্রাস করার আগেই মালতি খুলে বসে তার জিওন
কাঠির বাক্স। আজও তার ব্যাতিক্রম নয়, যখন সবাই সারাদিন রবীন্দ্রনাথকে
সন্মানের উচ্চ শিখরে নিয়ে গেল, তখন রাত নামলে মালতি তার আবেদনের পুষ্প
বিছিয়ে অতনুর হাতটা নিজের মধ্যের ছোট্ট সোনাটার ওপরে রাখল আর দুজনে গেয়ে
উঠলো...
"বিপদে মোরে রক্ষা করো,
এ নহে মোর প্রার্থনা
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।।"