টরন্টো, মার্চ ১৪, ২০২২, নভো সংখ্যা ৩০
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য সংবাদ ভ্রমণ কাহিনি বিশেষ নিবন্ধ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি যোগাযোগ

কার্তিকের কুয়াশা

উদযাপন

রত্না চক্রবর্তী

 ৮.৩.২২

 

 বিরক্তিরর সুরে সমাজসেবিকা অম্বা শীল বললেন তার বৌমা তনয়াকে " তোমার তো রোজই পড়াতে যাওয়া, আজকের দিনটা বাদ দিলে কি তোমার খাল পাড়ের পন্ডিতানীরা মাধ্যমিকে ফেল করবে? " অম্বাশীলের একমাত্র কন্যা প্রগতি বাইরে বার হবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে লাগাতে আদুরী গলায় মাকে বলল " ডিয়ার মম সক্কাল সক্কাল এত হট টেম্পার কেন? " অম্বা বলে উঠলেন " না মাথা গরম হবে না? তোমাদের মতো আমি কি রোজ বার হই? কিন্তু আমার সভা সমিতি বা কোন অনুষ্ঠান থাকলেই সবার কাজ পরে যায়? তোমার আগে থেকে ফিক্সড করা অনুষ্ঠান, তোমার বৌদির বস্তির শিক্ষাদান, আয়া মাসীর ভাইরাল ফিবারের ছুতোয় কামাই..... যত্ত ঝামেলা আমার, আমি তোমার ঠাম্মিকে কি ভাবে রেখে যাব? "
তনয়া মৃদু গলায় বলল " আয়ামাসী অসুস্থ জানতে পারি নি তো আগে, মা আমি যাব আর দেড়ঘন্টার মধ্যে ঢুকে যাব, যেতাম না কিন্তু ওদের সামনে মাধ্যমিক দেখাবার তো কেউ নেই, যাব কথা দিয়েছি, ওরা বসে থাকবে, আপনি তৈরি থাকুন আমি ঢুকলেই চলে যাবেন।
রাগী গলায় অম্বা বললেন " হ্যাঁ সবই তো তোমাদের মর্জিমাফিক, নারীদিবসের এই অনুষ্ঠানে আমি আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে নাহয় দেরী করেই ঢুকব। এ সব সম্মানের মূল্য তোমরা বুঝবে কি? " এক গাল হেসে প্রগতি বলল " ওহ মা ভুলে যাও কেন! বৌদির ওই ছাত্রীগুলোও নারী আর আয়া মাসীও নারী....তাই বৌদিও না হয় অনুষ্ঠান বাদ দিয়েই একটু নারীদিবস পালন করুক না, কুলডাউন মম। "
প্রগতি শীল বেরিয়ে গেল টা টা করে।অম্বা মুখ লাল করে দাঁড়িয়ে রইলেন।।

 

 

 

 

সেও তো নারী........

সামিদা খাতুন

 

 

অফিসে বড্ড কাজের চাপ তাই অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হচ্ছে। সবাইকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো তখন আমি বললাম এই অর্ডারটা সম্পূর্ণ হলেই আমি আপনাদের কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবো। কাজ শেষ হলে আমার কথা রাখার জন্য সবাইকে নিয়ে পাশের একটি পার্কে গেলাম। ওখানেই একটা রেস্টুরেন্টে সবাই খাবো বলে ঠিক করলাম। পরক্ষণেই আমার মনে পড়লো আঙ্কেল এবং আন্টি আমার জন্য না খেয়ে বসে থাকবেন। আমি আঙ্কেল আন্টির সাথেই থাকি। সপ্তাহের এই একটা দিনই আমরা এক সাথে বসে দুপুরের খাবার খাই। আঙ্কেল বার বার কল দিচ্ছিলেন, তাই সহকর্মীদের সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে হালকা কিছু খেয়ে সবাই কে খেতে বলে আমি তাড়াহুড়ো করে চলে আসলাম , আর সকিনা আপা কে বলে আসলাম আমার খাবার টা প্যাকেট করে যেন বাসায় নিয়ে যান । পর দিন অফিসে আসার পর সকিনা আপা বলছিলেন, আপা আপনার খাবার টা আমি নিয়ে যাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম বাসায় তো কেউ নেই আমিও খেয়ে গেলাম তাহলে খাবার টা কি হবে। ইতিমধ্যে রাস্তায় বিলাই পাগলী র সাথে দেখা প্যাকেট টা দেখে বার বার জিজ্ঞেস করছে এতে কি আছে? আমি বললাম এতে বিরিয়ানি আছে বলা মাত্রই পাগলী প্যাকেট টা ছিনিয়ে নিলো। বিলাই পাগলী নামটা আগে কখনো শুনি নাই , সকিনা আপাকে জিজ্ঞেস করলাম কে সে ? সকিনা আপা বললেন একটা পাগলি রাস্তায় রাস্তায় থাকে ওর সাথে সব সময় একটা কুকুর আর বেশ কয়েকটা বিড়াল থাকে। তাই লোকে বিলাই পাগলী বলে ডাকে। রাস্তার লোকে কেউ কিছু দিলে কুকুর বিড়াল কে দিয়েই খাওয়ায় তবে আপনার খাবার টা পাগলীও খেয়েছে। আমি বললাম হয়তো পেটে ক্ষিধে ছিলো তাই খাবার পাওয়া মাত্রই খেয়ে নিয়েছে। এরপর একদিন অফিস যাবার পথে দেখেলাম একজন প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরের মহিলা উচ্চতায় ৪ ফিট এর মতো পরনে একটি লাল ফ্রক হাতে একটা লাঠি নিয়ে রাস্তার এ পাশ ওপাশ দৌড়াদৌড়ি করছে সাথে একটা কুকুর ও ঘেউ ঘেউ করছে এবং ওখানেই দুইটা বিড়াল একটি বস্তার ওপর সুয়ে আরামে ঘুমোচ্ছে দেখে মনে হচ্ছে ঘুমই এদের সব বাকি সব জলে যাক । রিকশা চালক গতি কমিয়ে দিলেন যেন কোন দুর্ঘটনা না ঘটে, কাছে গিয়ে উনি একজন কে বললেন কি ব্যাপার পাগলী কে ক্ষ্যাপানোর কী দরকার থাকতে দাও তাকে তার মতো। রিকশা ওয়ালার কথা শুনে আর পাগলি কে দেখে আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে এই সেই বিলাই পাগলী। কাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় সকিনা আপার সাথেই ফিরছিলাম উনাকে বললাম আজ সেই পাগলী কে দেখলাম কিছু লোক কে লাঠি নিয়ে তাড়া করছিলেন। সকিনা আপাকে জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা উনার বাড়ি কোথায়? উনার কী কেউ ই নেই, কিচ্ছু নেই? সকিনা আপা বললেন হ্যাঁ আছে। পাগলির মা বাবা মারা যাবার পর সম্পত্তির লোভে পাগলি কে এমন পাগল করে রাখছে তার কাছের মানুষ জন সবাই এমন টা-ই বলে। ওর একটা ভালো নাম ও আছে নামটা অবশ্য আমার এখন মনে পড়ছে না । বেশ কয়েক বছর হলো এই শহরের অলি গলিতে ঘোরাঘুরি করে। আর এই কয়েক বছরে যে কতবার গর্ভবতী হলো আর কে বা কারা চোখের নিমিষেই এসে নবজাতক শিশুকে নিয়ে যায় কেউ যেন টের ও পায় না, আসলে ওর কোলে ছেলে বা মেয়ে যেই আসুক মাশাল্লাহ দেখতে অনেক সুন্দর হয় আর তাই হয়তো যাদের সন্তান নেই তাদের কেউ এসে নিয়ে যায়। এই পাগলীর সুবাদে বলা যায় কিছু নিঃসন্তান মানুষ পিতা মাতা হতে পেরেছেন। আমি অবাকই হলাম আর বললাম উনার তো স্বামি নেই তাই না? সকিনা আপা বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ আমার থেকে জীবনের মানে বুঝি তিনি আরো গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারেন আর তাই হয়তো সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই একটু থেমে গিয়ে বললেন, না স্বামী নেই রাস্তার জানোয়ার গুলো যে আছে কথাটি বলেই সকিনা আপা আমাকে রিকশা নিয়ে যেতে বলে তিনি বাড়ির রাস্তা ধরে চলে গেলেন। আমি কথা গুলো শোনার পর নির্বাক হয়ে গেলাম ভাবতে লাগলাম একজন মানুষ যে কিনা মানুষিক ভারসাম্যহীন আর তার সাথে মানুষ ছিঃ ছিঃ ভাবতে ও কেমন অস্বস্তি হয় । এই মানুষ রুপি অমানুষ গুলো কি কোন দিন ও শোধরাব না? আমি হেটেই রওনা দিলাম একটু এগোতেই দেখলাম ছয় আনি পুকুর পারের সামনে একটা দোকানে পাগলী বসে আছে তার দৃষ্টি কোথায় গিয়ে মিশেছে তা বোঝা বড় দায়। পাগলি'র আশে পাশে কুকুর বিড়াল কিছুই দেখছি না হয়তো খাবারের সন্ধানে এদিক ওদিক কোথাও গেছে নির্দ্বিধায় এগিয়ে গেলাম । চোখ দুটো তার ছলছল করছে কতটা যে ক্লান্ত সেই চোখ দুটো আর তাই হয়তো আমি সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পর ও তার দৃষ্টি আমার দিকে পড়লো না। আমি নিজ থেকে জিজ্ঞেস করলাম কিছু খাবেন? কোন উত্তর আসলো না। ভাবলাম এনে দিলে হয়তো খাবে তাই পাশের দোকান থেকে একটা পানির বোতল আর কেক এনে দিলাম বললাম এটা খেয়ে নিন। উনি মাথা নাড়িয়ে না করলেন টাকা দিলাম সেটাও ফিরিয়ে দিলেন তারপর হাত দিয়ে দেখালেন রাস্তার ও পাশে পিঠা বিক্রি হচ্ছে সেদিকে। আমি আর দেরি করলাম না দৌড়ে গিয়ে পিঠা এনে দিলাম হাতে নিয়ে খেতে শুরু করে দিলেন এত কিছুর মাঝেও একটি বার আমার দিকে তাকায় নি। কত যে অভিযোগ আর অভিমান ছিলো সেই চোখে আমাকে এড়িয়ে যাওয়া সেটা আমায় চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলো। আমি আর দেরি করলাম না সামনে আমার গন্তব্য হাঁটতে শুরু করলাম উনার মুখটা দেখে সকিনা আপার কথা মনে পড়ছিলো আর ভাবছিলাম, যখন কোন নারী মা হওয়ার সংবাদ পান দুই পরিবারের কতো আদর যত্ন নিয়মিত হাসপাতালে চেকআপ করানো, পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো আরো কত নিয়ম কানুন, প্রসবের সময় হাসপাতালে নেওয়া, প্রয়োজনে সিজার করা সে কতো রকমের আয়োজন। কিন্তু এই পাগলীর বেলায় এ সমস্ত আয়োজন তো দূরে থাক পাগলী নিজেও হয়তো বুঝে না যে তার গর্বে একটি ভ্রুণ দিন দিন বেড়ে চলছে একসময় সে ভূমিষ্ঠ ও হচ্ছে কার সন্তান কে তার বাবা আর কেই বা তাকে নিয়ে গেল পাগলী তো নয় ই সেই নবজাতক সন্তান টিও হয়তো কোনদিন জানতে পারবে না তার আসল মায়ের কথা, জানতে পারবে না তার গর্ভধারিনী মা রাস্তায় রাস্তায় খেয়ে না খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে , কত জানোয়ার এর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, এ-ও জানতে পারবে না কোন নরপিশাচ এর ভুলের ফসল সে।
যেখানে নারীদের জন্য, তাদের অধিকার আদায়ের জন্য, তাদের নিরাপত্তা ও শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য এতো আন্দোলন সেখানে সত্যিই নিরাপদ আছে তো বিলাই পাগলীর মতো নারীগণ। তাদের জন্য কেউ আন্দোলন করছে তো? তারা তো নারী দলেরই অন্তর্ভুক্ত। আজ নারী দিবসে বিলাই পাগলী তার অধিকার আদায়ের কথা বলবে? সেও তো নারী, জানি না এ সকল প্রশ্ন কেবল প্রশ্ন হয়েই থাকবে নাকি আমরা পারবো কোন একদিন এর যথার্থ উত্তর তৈরী করতে?

 


যেনাহং নামৃতা স্যাং

ডাঃ পরমেশ ঘোষ


‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’-এর উদ্বোধনে ব’ললেন সভানেত্রী, “অনুমতি দিন মঞ্চে ডাকতে এমন একজনকে, যিনি তাঁর কন্যাকে হত্যা ক’রতে সচেষ্ট হ’য়েছিলেন…”
শেষ হ’লো না সভানেত্রীর কথা। দর্শকদের চিৎকারে স্তব্ধ হ’লো তাঁর কন্ঠ-
“শুনবো না খুনী পাতকীর বক্তৃতা; নীচে নামিয়ে আনুন ওকে: দেখবো কে রোখে ওকে গণ-পিটুনি থেকে?”
“আমার রক্ত দিয়ে যদি এ সমস্যার হয় সমাধান, হাসিমুখে দেবো এ অবলা নারীর প্রাণ। মরার আগে দয়া ক’রে ব’লতে দিন- সন্তানকে কেন ক’রতে চেয়েছিলাম বিলীন।“
সভানেত্রী দৃঢ় কণ্ঠে ব’ললেন, “প্লীজ, সবাই থামুন। এনার কথাগুলো শুনুন।“
পুরো হল হ’লো নিঃস্তব্ধ, শোনা গেলো খুনী পাতকীর মৃদু পদশব্দ, মাইকের কাছে গিয়ে ধীরে ব’ললেন পঞ্চাশোর্দ্ধ মহিলাটি:-
“তখন আমি দুই মেয়ের মা, তৃতীয় সন্তানের জন্যে গর্ভবতী। হাসপাতালে যাবার আগে স্বামী ব’লেছিলেন,- এবারে মেয়ে হ’লে বাড়ীতে নিয়ে এসোনা।
জন্মালো তৃতীয় মেয়ে; তাকে হাসপাতালে রেখে আসার নিয়ম নেই; তাই বাড়ীতে নিয়ে এলুম; ভর্ৎসনা ক’রলেন স্বামী, ব’ললেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ ক’রে দাও।‘
জিগ্যেস ক’রলাম, ‘কী-ক’রে?
উনি ব’ললেন, ‘আজ রাতে ঘুমন্ত মেয়েকে সামনের মাঠে রেখে দিয়ে এসো। রাতে এ-মাঠে বরফ পড়ে। কাল সকালে মরা মেয়েটাকে তুলে এনে সকলকে ব’লবো- জানিনা কি ক’রে মরে গেছে মেয়েটা।'
স্বামীর আদেশ মানতে হ’লো। ডিনারের পরে মেয়েটাকে দুধ খাওয়ালাম; চাপড়ে চাপড়ে ঘুম পাড়ালাম; চুমু খেলাম, তারপরে একটা কাঁথার ওপরে শোয়ালাম, আর একটা কাঁথা দিয়ে ঢাকা দিলাম। দুটো কাঁথায় মোড়া মেয়েটাকে ভেজা ঘাসের উপর শুইয়ে দিয়ে ঘরে ফিরলাম। আহ্লাদে আটখানা স্বামী; আমাকে আদর করার জন্যে ওঁর বুকে চেপে ধরলো; কোনমতে ওঁর হাত ছাড়িয়ে শুলাম একপাশে; ঘুমোবার ভান ক’রে শুয়ে রইলাম, গায়ের লেপ সরিয়ে দিলাম যাতে আমারও একটু ঠাণ্ডা লাগে, মাঠে রাখা মেয়েটার মতো না হ’লেও, অন্ততঃ কিছুটা।
সকালে চীৎকার বাড়ীতে- ‘পুলিশ এসেছে’, ‘কে বাচ্চাকে মেরে বাড়ীর বাইরে ফেলে দিয়েছে তাকে অ্যারেস্ট ক’রবে ব’লে’।
স্বামী নির্দ্বিধায় আঙুল তুললেন আমার দিকে। পুলিশ এগিয়ে এলো হাতকড়া নিয়ে। আমি ব’ললাম, ‘একটু দাঁড়ান; অ্যারেস্ট করার আগে একটু মেয়েটাকে দেখতে দিন’। দৌড়ে গেলাম মাঠে; কাঁথা থেকে মরা মেয়েটাকে তুলে নিয়ে বুকে ধরলাম; অতর্কিতে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। সবাই চমকে উঠলো; আমিও; ব্লাউজ খুলে প্রাণ উজাড় ক’রে দুধ খাওয়ালাম মেয়েটিকে; ব’ললুম, ‘অ্যারেস্ট করো আমাকে; রাজী আমি কয়েদ খাটতে; কিন্তু এ-মেয়ে থাকবে আমার সঙ্গে; বরফের মধ্যে শুয়ে যদি যুঝতে পারে সদ্যোজাত মেয়ে, পুরুষ-শাসিত দেশেও লডাই ক’রবে ও।
প্রতিজ্ঞা নিলাম স্বাবলম্বী হবার। যেটুকু লেখাপড়া, সেলাইবোনা, কাজ শিখেছিলাম, তাই দিয়েই শুরু ক’রলাম- লোকের বাড়ীতে কাজ ক’রে, দর্জির কাজে জোগাড় দিয়ে, জামা-প্যান্ট রিপেয়ার ক’রে। তিন মেয়েকেই লেখাপড়া শেখালাম; সবচেয়ে কাজের হ’লো ছোট মেয়ে, তিন-দিনের যে মেয়েকে আমি ফেলে দিয়েছিলাম বরফ-ভরা মাঠে। আজকের এই সভায় সেই মেয়েটিই সভানেত্রী।“
সভানেত্রী এসে জড়িয়ে ধ’রলেন তার মাকে, প্রণাম ক’রলেন দু-হাত দিয়ে। করতালিতে, জয়ধ্বনিতে মুখরিত হ’লো সভাগৃহ।
*** ***
এরপরে কিরীটির পালা; ও মঞ্চে উঠে ব’ললো, ‘গত দোসরা মার্চ্চে মেজদি আমাদের ছেড়ে চলে গেছে; ওকে স্মরণ ক’রে, আমার মেয়েকে লেখা চিঠিখানা পড়ছি:-
স্নেহের কোয়েল,
ভাবছো কী বলার ছিল মেজপিসীকে? কোন্ উপহার তাঁকে দেবে ব’লে ভেবেছিলে কিন্তু দেওয়া হয়নি? প্রিয়জন চলে যাবার আগে তাঁকে আমরা দিতে চাই স্মরণীয় কিছু।
তোমার বয়স তখন পাঁচ। কাজের শেষে বাড়ী ফিরে দেখি, তুমি ব্যস্ত- ছবির পর ছবি আঁকতে। আমি একটু দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই তুমি ছুটে এসে ব’ললে, ‘বাপী, দ্যাখো, এঁকেছি এটা মেজপিসীর জন্যে। আরও কতোকি দিতে হবে আমাকে, কাল ওঁর চলে যাওয়ার আগে। মেজপিসীকে কালই যেতে হ’বে কেন, বাপী? আরও কিছুদিন থেকে যেতে পারেনা?’
‘কী ব’ললে, কোয়েল?’, আমি হতবাক, ‘চলে যাচ্ছে মেজপিসী? কোথায় যাচ্ছে? কে ব’লেছে একথা?’
‘জানোনা তুমি? মা ব’লেছে- মেজপিসী কাল চ’লে যাবে। মা ব’লেছে, কিছু ভালো ছবি এঁকে দিতে– মেজপিসী নতুন বাড়ীতে সাজিয়ে রাখবে।‘
‘আমি চাইনা, মেজপিসী কোথাও যাক্ এখন। দেখি ওঁর সঙ্গে কথা ব’লে-‘
পাশের ঘরে গিয়ে দেখি, মেজদি জিনিসপত্র গুছোচ্ছে। মনে হ’লো, কেউ ওকে ব’লেছে, এবাড়ী ছেড়ে যেতে।
মেজদি ব’ললো, ‘খোকন, ভালো- তুই দেখতে এসেছিস্; এখানে কি কিছু রেখে যেতে পারি? সব কীক’রে নিয়ে যাবো?’
‘তুই কোথায় যাচ্ছিস্, মেজদি? কেন যাচ্ছিস্?’
‘জানিনা কোথায় যাবো? সামান্য কিছু জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়ে পড়বো? খুঁজবো গার্লস হোস্টেল।‘
‘কিন্তু কেন তোকে এবাড়ী ছাড়তে হবে? আমাকে বলিসনি কেন?’
‘সুভদ্রা ব’লেছে, তুই চাসনা আমি জীবনভর এখানে থাকি। ব’লেছে থাকার মতো কোনো জায়গা খুঁজে নিতে।‘
‘কিছুতেই না। এতবড়ো কথা তোকে বলার আগে, সুভদ্রার উচিত ছিল আমাকে জানানো। তোকে কোথাও যেতে হবেনা। কোথায় যাবি তুই? কোনো রোজগার নেই তোর; থাকা-খাওয়ার খরচ দিবি কিক’রে? সামান্য যা-কিছু আছে, নিঃশেষ ক’রে দিস না।‘
দৌড়ালাম রান্নাঘরে; সুভদ্রা চা-জলখাবার সাজাচ্ছিলো; ব’ললো, ‘তুমি এখানে ছুটে এলে কেন? আমি এখনই তোমার চা নিয়ে যাচ্ছিলাম। খিদে পেয়েছে খুব?’
‘মোটেই না। চায়ের জন্যে আসিনি; এসেছি তোমাকে জিগ্যেস ক’রতে- আমাকে না জানিয়ে কেন মেজদিকে ব’লেছো এবাড়ী ছেড়ে যেতে?’
‘আমি ব’লেছি, মেজদি অনেকদিন থাকলে ভালো দেখায় না। ওকে ব’লেছি থাকার জন্যে কোনো জায়গা খুঁজে নিতে।‘
‘যদি মেজদি অন্য কোথাও গিয়ে থাকে, তাহ’লে ওকে ভাড়া দিতে হবে। মেজদি এখন কিছু রোজগার ক’রছে না। বরং, যদি পারো, এখানে কিছু কাজ খুঁজতে সাহায্য করো ওকে। কাজ পেলে ও থাকার জন্যে ভাড়া দিতে পারবে; সেপর্য্যন্ত ওকে এখানেই থাকতে দাও। যদি মেজদি চায়, তবে ও তোমাদের কিছু উপহারও দিতে পারে। তবে ওর সঞ্চয় থেকে বেশি খরচ করা উচিত নয়।‘
‘অবশ্যই সাহায্য ক’রবো, কাছাকাছি যে কটা মেয়ে-স্কুল আছে তার ঠিকানা আর ফোন নম্বর যোগাড় ক’রবো। মেজদি অঙ্কে এম-এস-সি, শ্যামবাজার গার্লস স্কুলে পড়িয়েছে। ও নিশ্চয়ই কিছু পেয়ে যাবে।’
‘ভালো, এখন ব’লো মেজদিকে একথা। যদি কোয়েল আমাকে না জানাতো, তাহ’লে মেজদি হয়তো কালই এ-বাড়ী ছেড়ে চলে যেতো আর আমরা জানতেও পারতুম না, মেজদি কোথায় গেছে।'
‘মেজদি, মেজদি’, সুভদ্রা ছুটে গেলো মেজদির কাছে। আমিও গেলাম পেছু পেছু।
‘কাল ফ্ল্যাট খোঁজার দরকার নেই তোমার। তুমি কি কোনো স্কুলে পড়াতে চাও?’
মেজদি ব’লেছিল, 'অবশ্যই চাই, কিন্তু আমাকে চাকরি পেতে হবে'।
‘আমি স্কুলগুলোর একটা লিস্ট বানাবো, ঠিকানা আর ফোন নম্বর সমেত। আমরা ফোনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ক’রতে পারি বা হেঁটে গিয়েও দেখতে পারি। জিগ্যেস ক’রবো ওদের ম্যাথামেটিক্স টিচার চাই কিনা। তোমার সব ডিগ্রি সার্টিফিকেটের কপি আছে তো?’
‘ডিগ্রি সার্টিফিকেটের কপি আছে, তবে বায়োডেটা নতুন ক’রে লিখতে হবে। বিয়ের পর থেকে সাত বছর আমি কাজ করিনি।’
সুভদ্রা মেজদিকে নতুন বায়োডেটা তৈরী ক’রতে সাহায্য ক’রেছিল আর বেশ কয়েকটি ভালো স্কুলের সাথে যোগাযোগ ক’রেছিল। চার দিনের মধ্যে, মেজদি চারটি স্কুলে ইন্টারভিউ দিয়েছিল; দুটি স্কুল থেকে চাকরীর অফার পেয়েছিল, যার মধ্যে একটি- লেডী আরউইন স্কুল। দুটি স্কুলই মেজদিকে সিনিয়র ম্যাথস্ টিচার হিসেবে নিতে চেয়েছিল। লেডী আরউইন স্কুলে মাইনে কম হ’লেও, একটি নাম-করা স্কুলে কাজ করার সুযোগের জন্যে আমরা মেজদিকে এই স্কুলে যোগ দিতে পরামর্শ দিয়েছিলাম; মেজদিও দ্বিধা করেনি।
কাজে যোগ দিয়ে অনেক খাটতে হোলো মেজদিকে; সিলেবাস আর নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তকের উপর ভিত্তি করে ঠিক ক’রতে হোলো বছরের চল্লিশ সপ্তাহের কোন সপ্তাহে কী পড়াবে। সমস্ত সিনিয়র ক্লাস - নবম, দশম, একাদশ আর দ্বাদশ শ্রেণীর ম্যাথস্ পড়ানোর দায়িত্ব ছিল মেজদির। একদিন মেজদি অবাক হয়ে দেখলো, দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন ছিল দাদার মেয়ে, টুম্পাই। দাদার বাড়ীতে যাওয়া মেজদির নিষিদ্ধ; তাই ও টুম্পাইয়ের সাথে সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর দূরত্ব বজায় রেখেছিল, কখনও জানায়নি যে টুম্পাই ওর ভাইঝি।
এবারে বলি মেজদির আগের জীবনের কথা।
পাঁচ ভাইবোনেদের মধ্যে দাদা আর মেজদি ছিল ফর্সা, সুন্দর আর কথাবার্তায় স্মার্ট; একদিকে ওদের ঈর্ষা ক’রতুম, অন্যদিকে চেষ্টা ক’রতুম ওদের চাইতে ভালো হবার। তবে সবার চাইতে ছোট ব’লে সকলের কাছেই আমি আদর পেতাম। ছোটবেলায় একবার দুগ্গোপুজার সকালে পাড়ার পুজোমণ্ডপ থেকে ফিরে দেখি মেজদি বাড়ীতে নেই, শুনলাম সেজমামা এসেছিল গাড়ী নিয়ে; মেজদিকে নিয়ে গেছে ঠাকুর দেখার জন্যে; একটু পরেই মেজদি ফিরলো; ও যেই খাটের উপর ব’সে শুরু ক’রেছে ফায়ার ব্রিগেডের ঠাকুরের গল্প, আমি দৌড়ে এসে ওর পাদুটো ধ’রে টেনে ওকে মেঝের উপর ফেলে দিয়েছিলাম; মেজদির বেশ লেগেছিল; ও কেঁদে উঠেছিল; কিন্তু ও আমাকে মারেনি; বাড়ীর অন্য কেউও মারেনি; বাড়ীর ছোট ছেলে ব’লে আমাকে কেউ শাসন করেনি; তবে মেজদি বা আমি কেঊই ভুলিনি একথা।
আর এক দিনের কথাও ভুলতে পারিনি। সেদিন সন্ধ্যায় স্কুল-ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে— মেজদি পাস করেছে, বড়দি ফেল ক’রেছে অঙ্ক আর ইংরেজীতে। বড়দি কোথায় লুকিয়ে ছিল বুঝতে পারিনি, মা বললো— বড়দি নিখোঁজ। দাদা রাস্তায় ঘুরে বড়দিকে খুঁজে পেলো, ওর হাত ধরে বাড়িতে নিয়ে এলো।
বড়দিকে আশ্বাস দিলো মেজদি, ‘আমি তোকে পিছনে ফেলে এগোবো না। তুই পড়াশোনা চালিয়ে যা, আমি পাশে থাকবো, ঠিক পারবি পরের বার। আমি কলেজে ভর্তি হবো না এখন। তুই পাশ করার পরে একসঙ্গে কলেজে যাবো।‘
পরের বছর বড়দি পাস ক’রেছিল। তারপরে মেজদি শুরু করেছিল আই.এস.সি, আর বড়দি আই.এ। দু'বছর পর দুজনেই ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা দিলো। মেজদি পাস করলো সেকেণ্ড ডিভিসনে; বড়দি পারলো না; অথচ ক্লাস-এইট পর্য্যন্ত বড়দি ফার্স্ট হ’য়েছে; মেজদি থাকতো প্রথম দশজনের মধ্যে। বড়দি গিটার শিখতে শুরু ক’রলো। মেজদি বি.এস.সিতে ভর্ত্তি হ’লো। অঙ্কে ফার্স্টক্লাস অনার্স নিয়ে ডিগ্রী পেলো দুবছর বাদে।
আরো দুবছর পরে মেজদি এম.এস.সি.-তে ফার্স্ট ক্লাস সেকেণ্ড হোলো। মেজদির ইচ্ছে- স্কুলে পড়াবে। বাবা-মার মত নেই; এখনই ওর জন্যে শিক্ষিত পাত্র পাওয়া শক্ত; চাকরী ক’রলে বিয়ে দেওয়া আরও কঠিন হবে। মেজদি কি এখন অপেক্ষা ক’রবে, কবে বাবা-মা ওর জন্য উপযুক্ত ছেলে খুঁজে ওর বিয়ে দেবে ব’লে? পাশের বাড়ির মেয়ে, জলি সাহায্য ক’রলো; শ্যামবাজার গার্লস্ হাই স্কুলে মেজদি দরখাস্ত করলো জলির ঠিকানা দিয়ে। ইন্টারভিউ লেটার এলো জলির ঠিকানায়; ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেলো মেজদি। এখন, বাবা-মার সম্মতি পাওয়ার দরকার। মেজদি বাবা-মাকে বোঝালো, ও মাসে মাসে সংসার খরচে টাকা দিতে পারবে, এছাড়া ওর বিয়েতে যৌতুক দেওয়ার দরকার হ’লেও সাহায্য ক’রতে পারবে। বাবা-মা মত না দিয়ে পারেনি।
মেজদির বিয়ে হ’লো এম.এ.এল-এল-বি পাশ দীনেশের সঙ্গে; যৌতুক দেওয়া হ’ল মেজদির সঞ্চয় থেকে; মেজদি গেলো মেদিনীপুরে শ্বশুরবাড়ীতে। শ্যামবাজার গার্লস্ স্কুলে চাকরী করাতে শ্বশুরবাড়ীর আপত্তি থাকবে ব’লে মেজদি এ চাকরী ছেড়ে দিল; বিয়ের পরে ও জানতে পারলো, এম.এ.এল-এল-বি পাশ স্বামী দীনেশ কখনও প্র্যাক্টিস করেনি, স্কুলে পড়াতো।
মেজদির বিয়ের বছরখানেকের মধ্যেই আমি জামসেদপুরে কাজ শুরু ক’রি। আমি জানতেই পারিনি মেজদির শ্বশুর বাড়িতে কি কি অসুবিধা হচ্ছে; মেজদি কখনও আমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলেনি; হঠাৎ আমি বাবার কাছ থেকে একটা টেলিগ্রাম পেলুম, যাতে লেখা আছে,- “মেজদি হাসপাতালে, মেদিনীপুরে যাও।”
তাড়াতাড়ি মেজদির সাথে দেখা ক’রতে মেদিনীপুরে গেলাম। প্রথমে ওর শ্বশুরবাড়ীতে গেলাম, সেখান থেকে হাসপাতালের ঠিকানা নিয়ে মেজদির সাথে দেখা ক’রে বুঝলাম যে তখন আর কোনো বড় বিপদের ভয় নেই। শরীর-মনের ধকল কাটিয়ে মেজদি সেরে উঠছে। আমি যখন মেজদির বিছানার পাশে গেলাম তখন দীনেশ ওর পাশে ছিল। মেজদি কেন আত্মহত্যা ক’রতে গেছিল সে ব্যাপারে কিছু বলেনি; বরং দীনেশের খুব প্রশংসা ক’রেছিল, ব’লেছিল কিভাবে দীনেশ ওকে কাঁধে করে ওদের বাড়ীর সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে ট্যাক্সি ক’রে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে, কেমন ক’রে ওর প্রাণ বাঁচিয়েছে।
হাসপতাল থেকে ফিরে আসার পরে মেজদি দেখলো শ্বশুর বাড়ীতে থাকা আরও অসম্ভব হয়ে পড়েছে; পরিবারের প্রায় প্রত্যেক লোকের কাছেই সে অপরাধী হ’য়ে গেছে, অথচ কাউকেই আত্মহত্যার চেষ্টা করার আসল কারণ জানাতে পারেনি। মেজদি আমাকে বা আমাদের বাড়ীর কাউকেও কিছু জানায়নি। কারণটা আমি জেনেছি অনেক পরে; মেজদি যখন অস্ট্রেলিয়াতে এসেছিল, তখন আমাকে ব’লেছিল।
সাত বছর পরে, আমি দিল্লীতে। মেজদি চিঠি লিখেছিল ওকে মেদিনীপুর থেকে নিয়ে আসার জন্যে। আমি আগেই শুনেছিলাম, মেজদির গলায় যন্ত্রণা হচ্ছে; অপারেশনের পরে বায়োপ্সিতে জানা গেছিল, কিছু ক্যান্সারের টিস্যু রয়ে গেছে, ক্যান্সার লিম্ফ নোডে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞেরা ব’লেছিলেন যে ক্যান্সার তেমন ছড়িয়ে পড়েনি; তখনও দিল্লীর অল ইন্ডিয়া মেডিকেল সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটে রেডিও-অ্যাক্টিভ আয়োডিন (RAI) থেরাপির চিকিত্সা দিয়ে নিরাময় করা সম্ভব। কিন্তু ওর শ্বশুর-শাশুড়ির মতে, পরিবারের অন্যরাও ওর ক্যান্সারে আক্রান্ত হ’তে পারে; ওনারা মেজদিকে অস্পৃশ্য ভেবেছিলো, চিকিত্সা করার কোনও চেষ্টা করেনি।
মেজদির শ্বশুরবাড়ীতে পৌঁছে, তফাৎটা বুঝতে পারলাম। মেজদি তার স্বামীর ঘরে ছিল না; ছিল একটা ছোট ভাঁড়ারঘরে। মেজদি নিজেই রান্না ক’রতো; আর কেউই সেখানে ঢোকার ঝুঁকি নিতো না। মনে হ’য়েছিল, শ্বশুর-শাশুড়িরা মেজদির মৃত্যুর জন্যে দিন গুনছিলো; মেদিনীপুর থেকে মেজদিকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবে ওনারা অনেকটা স্বস্তি পেয়েছিলেন। মেজদি তার সমস্ত জিনিস গুছিয়ে ফেললো, চিরদিনের জন্যে যাওয়ার জন্যে। রওনা হ’লাম দিল্লীর দিকে; ছেলেমেয়েদের ছেড়ে যেতে হ’লো মেজদিকে; বিদায় নেওয়ার অনুমতি ছিলোনা রোগ-সংক্রমণের ভয়ে।
দিল্লীতে এসে দাদাকে ফোন ক’রলাম; দাদা মেজদির ক্যানসার নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়; ধমক দিলো আমাকে মেজদিকে শ্বশুড়বাড়ী থেকে চুরি ক’রে নিয়ে আসার জন্যে; দাদা ব’ললো ও এই ব্যাপারে কোনো দায়িত্ব নেবেনা, মেজদি যেন কখনও ওর বাড়ীতে না যায়, বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্যে।
আমাদের ফ্ল্যাটে তিন মাস থাকার পরে এসেছিল সেই সন্ধ্যে, যেদিন কোয়েল তুমি আমাকে না জানালে, তার পরদিন থেকে মেজদি কোথায় থাকতো, কিভাবে থাকতো, জানিনা।
দিল্লীর এ.আই.আই.এম.এস থেকে নির্দ্ধারিত হ’লো রেডিও-অ্যাক্টিভ আয়োডিন থেরাপির দিন। তৎক্ষণাৎ সুভদ্রা জানালো, ওকে বরোদা যেতে হবে, চিকিত্সার সপ্তাহটা ওকে বরোদায় থাকতে হবে। সুভদ্রার বাবা আমাকে ব’ললেন, ‘তুমিও এসো বরোদায়, মেজদিকে ভগবানের হাতে ছেড়ে দিয়ে। হাসপাতালে দাদার ফোন নম্বর দাও। সেরকম কিছু হ’লে ওরা দাদাকে জানাবে।‘ উত্তরে আমি ব’লেছিলাম, ‘এই চিকিৎসার জন্যেই মেজদিকে নিয়ে এসেছি দায়িত্ব নিয়ে। এ সুযোগ হারাবো না।‘ থেরাপিতে মেজদি সেরে উঠলো।
নির্ভরযোগ্য শিক্ষয়িত্রী হিসাবে মেজদির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো দিল্লীতে। অল-ইণ্ডিয়া-ওয়ার্কিং-গার্লস হোস্টেলে সুযোগ না পাওয়া পর্য্যন্ত মেজদি আমাদের অ্যাপার্টমেন্টেই ছিল।
কোয়েল, তোমার নিশ্চয় মনে আছে, অস্ট্রেলিয়া থেকে বেড়াতে এসে আমরা উঠেছিলাম মেজপিসীর ফ্ল্যাটে। তোমার বয়ফ্রেণ্ডও ছিল আমাদের সঙ্গে। বছরদুয়েক বাদে গ্রেগ আর তোমার বাঙালী বিয়ে হ’য়েছিল ক’লকাতায়। সেখানে গ্রেগের মা ও দিদিকে শাড়ী পরানোর ভার নিয়েছিলো মেজপিসী। সিডনীতেও বেড়াতে এসেছিল মেজপিসী, মাসদুয়েক ছিল, ক্যানবেরা আর মেলবোর্ণেও ঘুরেছে।
মেজদির অস্ট্রেলিয়াতে থাকার সময়েই একবার ওর সঙ্গে ওর মেদিনীপুরের জীবন নিয়ে কথা হচ্ছিল; তখনই প্রথম জানতে পারলাম ও কেন একদিন আত্মহত্যা ক’রতে চেয়েছিল; একথা আগে কাউকে জানায়নি, কারণ বাবা-মা ভাইবোনেরা কষ্ট পাবে; কিন্তু প্রতিকারের কোনো সহজ উপায় ওর জানা ছিল না। মেজদির পক্ষে খুবই অসুবিধা হচ্ছিল শ্বশুরবাড়ীতে। তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ী সব সময় তার দোষ খুঁজতো। স্বামী দীনেশের ভালবাসা আর ভরসা পেলে হয়তো সব অসুবিধা সহ্য করে নিতো; কিন্তু প্রত্যেক সন্ধ্যেতেই দীনেশ ডিনারের পরে সিগারেট খেতে বেরিয়ে যেতো। মেজদি দীনেশের জন্য একাই অপেক্ষা ক’রতো। কয়েকদিন বাদেই মেজদি বুঝতে পেরেছিল, দীনেশ শুধু সিগারেট খাবার জন্য রাতে বেরোতো না, অনেকদিন ধ’রে একজন মেয়ের সাথে দেখা ক’রতে যেতো। মেজদি বুঝতে পারছিল না ওর কি করা উচিত, দীনেশের বাবা-মাকে ব’লতে পারছিল না কেননা তাহলে তারা দীনেশের দোষ না দেখে ওকে দোষী সাব্যস্ত ক’রবে। মা-বাবাকেও লিখতে চায়নি কেননা ওরা তাহলে চিন্তা করবে। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেকে শেষ ক’রে দেবার চেষ্টা ক’রেছিল।
অবসর নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ফিরলো মেজদি; একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনলো শ্রীরামপুরে, ছেলেমেয়েদের পড়ানো শুরু ক’রলো। নিজের ছেলেমেয়েদের খোঁজ-খবর নিলো; ওর বড় মেয়ে পরীর বিয়ে তখনও হয়নি, অথচ ওর ছোটো দুই ভাইবোনের হ’য়ে গেছে। শ্রীরামপুরেই পরীর বিয়ে দিয়েছিল মেজদি। স্বামী দীনেশও অনেকদিন কাটিয়ে গেছে মেজদির অ্যাপার্টমেন্টে; মেজদির উপরেই তার সবচেয়ে বেশী ভরসা।
অশীতিপর হ’য়েও মেজদি ওর শ্রীরামপুরের অ্যাপার্টমেন্টে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়ে গেছে। ওর মেয়ে পরী ব’ললো, ‘এই বয়সে একা থাকা ঠিক নয়; রাত-বিরেতে কোনো অপঘাতে কেউ দেখার সুযোগ পাবেনা।‘ মেয়ে শ্রীরামপুরেই থাকে; সেখানে গিয়ে উঠলো মেজদি, অ্যাপার্টমেন্টে তালা দিয়ে।
২০২১এর ফেব্রুয়ারীতে মেজদিকে ফোন ক’রে জানলাম, ওর পেসমেকারের ব্যাটারী পাল্টানো হবে ক’লকাতার এক হাসপাতালে; বাড়ী ফিরে আসবে বুধবারে। বৃহস্পতিবারে মেজদিকে ফোন করাতে উত্তর দিল মেজদির মেয়ের ননদ – উনি ব’ললেন, ব্যাটারী পাল্টানো হ’য়ে গেছে, কিন্তু মেজদি তখনো আই-সি-ইউতে, কারণ ও নাকি ভুলভাল ব’কছে।
২৬শে ফেব্রুয়ারীতে মেজদির ফোনেই রিং ক’রলাম; জবাব এলো মেজদির নিজের গলাতেই। তখন ওখানে দুপুর আড়াইটে, ও খেতে ব’সেছে; স্বাভাবিক ভাবেই কথা ব’লতে শুরু ক’রলো; আমার গলা শুনে চিনতে ওর অসুবিধে হয়নি। ও ব’ললো, “সাতদিন আমার ব্ল্যাকআউট হ’য়েছিল সার্জেনের দোষে; ডাক্তারকে ব’লেছিলাম,- আমার থাইরয়েডের সমস্যার জন্যে পুরো অ্যানাসথেসিয়া করা চলবে না; তা সত্ত্বেও সার্জেন পুরো অ্যানাসথেসিয়া ক’রেছে। এখন আমার অবস্থা ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই’। আমি প্রমাণ ক’রতে পারছিনা যে কিছু ভুল ব’কছিনা, সব ঠিক বুঝতে পারছি।
বলতো (a+b)^5 = কত?
a^5+5(a^4)b+10(a^3)(b^2)+10(a^2)(b^3)+5a(b^4)+b^5
আমি বুঝলাম, সাধারণ লোকের চেয়ে ও বেশীই বুঝতে পারছে। আনন্দের সঙ্গে ফোন ছাড়লাম, যাতে ও নির্বিঘ্নে খেয়ে নিতে পারে; আমি নিশ্চিত, শীগ্গিরই সুস্থ হবে ও।
২৮শে ফেব্রুয়ারীতে মেজদির মেয়ের ফোন পেলাম- মেজদিকে কোন্নগরের এক নার্সিংহোমে ভর্ত্তি করা হয়েছে; ওর সেপ্টিসেমিয়া হ’য়েছে সম্ভবতঃ, পেসমেকারের ব্যাটারী পাল্টানোর পর থেকেই। এর পরের খবর- ২রা মার্চে সকাল আটটায় মেজদির দেহাবসান হ’য়েছে। ওর মেয়ে জানালো, ওরা দুই বোনে মেজদিকে বিয়ের বেনারসী পরিয়ে সাজাবে; হাসপাতাল থেকে যাবে পরীর বাড়ীতে, তারপরে মেজদির ফ্ল্যাটে, তারপরে শ্মশানঘাটে।
৫ই মার্চ মেজদির মেয়ে ফোন ক’রেছিল শ্রাদ্ধ করার অনুমতি চাইতে; তখন ও জানালো একশোরও বেশী ছাত্র-ছাত্রী আর তাদের বাবা-মায়েরা এসেছিল শ্রদ্ধা জানাতে, যদিও শ্রীরামপুরের কোনো স্কুলে মেজদি কখনও পড়ায়নি, কেবল প্রাইভেটে পড়িয়েছে। ও আরও বললো, চিকিৎসার সমস্ত খরচ মায়ের টাকাতেই হ’য়েছে; এছাড়া মায়ের কথামতো কটকের ক্যানসার হাসপাতালে একলাখ টাকা জমা ক’রবে। স্থানীয় সাঁইবাবার মন্দিরের প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই মেজদি ওখানের মেম্বার ব’লে, মন্দির থেকে মেজদির জন্যে বিশেষ পুজোর ব্যবস্থা ক’রবে। মেজদির ছেলেও আমাকে ফোন ক’রে জানালো, ১৫দিন পরে মেজদির শ্বশুরবাড়ীতে শ্রাদ্ধের পূর্ণ অনুষ্ঠান হবে।
কোয়েল,
কয়েক বছর দিল্লীতে কাটানোর পর তুমি অস্ট্রেলিয়াতেই বড় হ’য়েছো। তুমি কি পারবে বুঝতে মেজপিসীর সংগ্রামের কথা?
……বাপী