টরন্টো, মার্চ ১৪, ২০২২, নভো সংখ্যা ৩০ 
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য সংবাদ ভ্রমণ কাহিনি বিশেষ নিবন্ধ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি যোগাযোগ

কার্তিকের কুয়াশা

সম্পাদকীয়

 

 

ভোরের আলো আঁধারির কুয়াশা ছেড়ে যখন সোনালী রোদ উঁকি মারে, তখন থেকেই তার ডাক দেওয়ার শুরু। গাছের কোন ছায়াঘন নিভৃত ডাল থেকে যে সেই কুহু কুহু গান ভেসে আসে তার হদিস মেলা ভার। কিন্তু শিল্পীকে দেখা না গেলেও তার সুরেলা শিল্প জানান দিয়ে যায় ‘বসন্ত এসে গেছে’। তবে সে শুধু ওই কুহুরবে আসেনি। এসেছে পলাশের ফুল ভরে ওঠা ডালে। পাতা ঢেকে যাওয়া আমের বকুলে কিংবা শাল বনের বিথিপথে ছড়িয়ে থাকা ঝরাপাতার মর্মরে। তার মধ্যে দিয়ে যখন ডাক দিয়ে যায় মন কেমনের হাওয়া। তখন কী যেন এক ভাবনা আসে মনে। কেউ তাকে বলে মন কেমন, কেউ বলে ভালবাসা, কিন্তু আসলে যে তা কী? তা বলার সাধ্য কোনও সাহিত্যের অক্ষরের নেই। তাই কবিতার পরে কবিতায় অনুভূতিরা দানা বাঁধে। সুর তাকে খুঁজে ফেরে নীল আকাশের অসীম থেকে শিশিরভেজা ঘাসে। সব কিছুকে জয় করতে চাওয়া মানুষ তাকে ধরতে চায় রঙ দিয়ে। আবিরের রঙ কোন দুঃস্বপ্নের ভোরে রক্তের রঙের সাথে মেশে। কিন্তু সেই না বলা কথা তার পরেও না বলাই থেকে যায়। আসলে না বলাতেই তার আনন্দ। অপ্রকাশেই তার প্রকাশ। সে শুধু সকলের মন রাঙিয়ে দিতে আসে শীতের জড়তা কাটিয়ে। লালমাটির দেশে যেমন তাঁর কথা বলে যায় পলাশ, শিমুল তেমনই হিমালয়ের বরফের আস্তরণ সরিয়ে তাঁর কথা বলে চলে রডোডেন্ড্রন।
তবে রঙের উৎসবের সুর বারবার ছিঁড়ে যায় বোমার আওয়াজ আর আর্তের চিৎকারে। আজ যখন এই লেখাটা লিখছি সেই মুহূর্তেই হয়ত যুদ্ধের ধাক্কায় নিশ্চিহ্ন হয়ে চলেছে কত শত প্রাণ। সেখানেও কিন্তু রঙ রয়েছে। সেই রঙ লোলুপতার, সেই রঙ মৃত্যুর। আজ বসন্তের খুশির দিনে তাঁদের এড়িয়ে যেতে চাইলেও কিন্তু এড়িয়ে যাওয়া যায়না। মনের শান্তির স্নিগ্ধ উঠোনে তারা পাঁক ছড়িয়ে দিয়ে যায় অসভ্যের মত। তবে সেই পাঁক মুছে আবার আনন্দে ফেরাটাই বসন্তের জয়গান। যেমন যুদ্ধের দেশ থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের জন্য আশেপাশের দেশের মানুষগুলো বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত। হিমশীতল রাতে সীমান্ত পেরোনোর পরেই মৃতপ্রায় শরীরগুলোতে প্রাণ আনে হাতে এগিয়ে দেওয়া গরম খাবার। বোমার আঘাতে বিপর্যস্ত শহরেও চলতে থাকে মানুষের নিজের উদ্যোগে খোলা ফ্রি ক্যান্টিন। প্রকৃতিই দেখিয়েছে পাথরের ফাঁকেও সবুজ জন্মায়। আর প্রকৃতি সন্তান মানুষেরাও সাড়া দিয়েছে সেই একই ভাবে, মানবতার হাত ধরে। এই মানুষগুলোর হাত ধরেই তো বসন্তের জয়। যেমন করে হিমশীতল মৃত্যুর যবনিকা টানা বরফের চাদরকে হারিয়ে প্রতিবছর জেগে ওঠে সবুজ। সেই সবুজের অভিযানেই বসন্তের সার্থকতা।
কার্তিকের কুয়াশার মার্চ সংখ্যাতেও সেভাবেই কবিতায় গল্পে অনুভূতির কলমে এঁকে দেওয়া সেই সেই ‘আধমরাদের ঘা দিয়ে বাঁচানো’র সবুজের অভিযান। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আমাদের ফেসবুক গ্রুপে আয়োজন করা হয়েছিল প্রতিযোগিতা। সেই সংক্রান্ত লেখাগুলো এই সংখ্যাকে আরও উজ্জ্বল করেছে। সে’খানে একদিকে যেমন চিরন্তন নারী সত্ত্বার নানা দিক উঠে এসেছে তেমনই উঠে এসেছে বিশ্ব জুড়ে নারীর উপর হয়ে চলা নানা অন্যায় যাকে সমাজ অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে তার প্রতিবাদ। পেলবতা আর সৃজনশীলতার প্রতিমা থেকে রুদ্র রণরঙ্গিনীরা তাঁদের আপন খেয়ালে রাঙিয়ে দিয়ে গেছেন কার্তিকের কুয়াশার দেওয়াল। সেই রংবহারের খোঁজ পেতে হলে পড়তেই হবে এই সংক্রান্ত লেখা গুলি।
সাথে রয়েছে বেশ কিছু অনুগল্প। মানুষের মনের কোনে লুকিয়ে থাকা অতিপ্রাকৃত ভয়ের খোঁজ মিলবে সেখানে। এই শহুরে জীবনের ডামাডোলের মাঝে হারিয়ে যেতে যেতে ছেলেবেলার শান্ত দুপুরের গল্পের বইয়ের পাতার অক্ষর থেকে শিরদাঁড়াতে শিহরণের স্মৃতি জেগে উঠবে। কখনও আবার উঠে এসেছে সাধারণ রোজনামচার মধ্যে লুকিয়ে থাকা অনুভূতির গল্প। এসবের সাথে আবার গহীন জঙ্গলে চোরা শিকারির পিছনে ছুটে চলার টানটান অনুভূতিতে গা ভাসানোর সুযোগও মিলবে এই সংখ্যায়।

কার্তিকের কুয়াশার আরও একটি গুরুত্বপূর্ন উদ্যোগ শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রের কালজয়ী মানুষদের স্মরণ করা। তাদের মেধা এবং সৃষ্টিশীলতার উজ্জ্বল রশ্মি ছটায় নিজেদের ঋদ্ধ করে নেওয়া। মাসিক সংখ্যায় হয়ত তা অনুপস্থিত কিন্তু সমস্ত সদস্যের নিভৃত প্রাণে সেই গুণী মানুষদের স্মরণ নতুন করে প্রেরণা জোগায় আরও সৃষ্টি করার। এই উদ্যোগে আরও যত বেশি সদস্য শামিল হবেন ততই সমৃদ্ধ হব আমরা।

আর সর্বোপরি বলতেই হবে প্রতি মাসে হয়ে চলা সাহিত্য আড্ডার কথা। কথায় বলে একটা ভালো বন্ধু একটা লাইব্রেরির সমান। এই সাহিত্যের সুতোয় বন্ধুত্বের মালায় বাঁধা পড়া আমাদের মন গুলো নিজেদের কাছাকাছি আসার সুযোগ পায় এই আসরে। আলোচনার মধ্যে দিয়ে উঠে আসে অচেনা তথ্য, না জানা ভাবের কথা। যা দিনে দিনে জন্ম দেবে এক মহীরূহের। সেই সৃজনশীলতার বটবৃক্ষের তলায় আশ্রয় পাবে লোভ আর হিংসায় ভরা পৃথিবীর মরুভূমিতে পথ হারানো পথিক। সাহিত্যের ভাব তার কাছে হয়ে উঠতে পারে তৃষ্ণার সুধা। সেই সুধার সিঞ্চনে আসুন সকলে মিলে সেই অপার করুণাময় বটবৃক্ষের এক একটা পাতা হয়ে উঠি। এই বসন্তের গন্ধ মাখা রঙিন আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে সকল পাঠকের কাছে রেখে গেলাম সেই ছায়াসুনিবিড় শান্ত সুন্দর দিনের আর্জি।


 

অরুণোদয় কুণ্ডু 
17/7/4 নরসিংহ দত্ত রোড, কদমতলা, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, পিন – 711101।