টরন্টো, জানুয়ারি ২১, ২০২২, নভো সংখ্যা ২৮
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য সংবাদ ভ্রমণ কাহিনি বিশেষ নিবন্ধ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি যোগাযোগ

কার্তিকের কুয়াশা

নার্সিংহোম

রত্না চক্রবর্তী

 ১৫.১.২২

 

নার্সিংহোমটা বেশি বড় নয় তিনতলা মাঝারি আকারের। ঘরোয়া ঘরোয়া দেখতে, যেন বসতবাড়ি। তেমন ব্যবস্থা ট্যাবস্থা নেই বোধকরি রিন্টু ভাবল। তা কি আর করা যাবে... বাড়িতে কেউ নেই... মিন্টু একলাই ছিল। রিন্টু একটা ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল বাইরে। হঠাৎই মামাবাবুর শরীর খারাপ হয়, মিন্টু ইলেভেনে পড়ে কিন্তু বুদ্ধি করে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকাকুকে কল করে। ডাক্তারকাকু বলেন অসম্ভব প্রেশার বেড়ে গেছে এক্ষুনি হাসপাতালে দিতে হবে। এখন এইরকম অবস্থা চলছে এর মধ্যে কে কাকে সাহায্য করবে? হাসপাতাল নার্সিংহোমের ধারেকাছে লোকে এখন যেতে চায় না কোভিডের ভয়। ক্লাবের এম্বুলেন্সটা একজন গর্ভবতী মহিলাকে নিয়ে গেছে, সেটা পাওয়া যাবে না। মিন্টু বুদ্ধি করে সবচেয়ে কাছের, মানে বাড়ি থেকে মিনিট পনেরো দূরে নবজীবন নার্সিংহোমে নিয়ে গেল পাড়ার অটোরিকশা করে, কপিলদা অটো চালায়, খুব হেল্পফুল। আগে এই নার্সিংহোমটার নাম ছিল মেডিকেয়ার। এক অবাঙালী ভদ্রলোক মালিক ছিলেন । তারপর কি হল তিনি সব ছেড়ে তার দেশে চলে গেলেন। বছরখানেক বন্ধ ছিল। তারপর আবার নতুন লোক দায়িত্ব নিয়েছে। ব্যবস্থা মন্দ নয়, নিন্দ নেই।
চিকিৎসা তৎক্ষণাৎ শুরু হল। বুদ্ধি করে যে মিন্টু এটুকু করতে পেরেছে এই অনেক, কাল বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে।
তারা দুইভাই ছোটবেলায় মা বাবা হারিয়ে এই অবিবাহিত মামার কাছেই মানুষ। এখন মামার বয়স হয়েছে, তারাই মামার সব। রিন্টুর মোবাইল অফ ছিল ইন্টারভিউ 'এর সময়। সে বিকেলে খবরটা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিয়েছে।
এই সিজন চেঞ্জের সময়টা তার সয় না, বেশ ঠাণ্ডা লেগেছে, জ্বর জ্বর মনে হচ্ছে। একটা প্যারাসিটামল থাকলে ভালো হত, কিন্তু কাছে নেই। সে গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে সে আর বাড়ি গেল না, সোজা নার্সিংহোমে চলে গেল। বাইরে দোরের কাছে একজন দারোয়ান একটা ফোল্ডিং খাট পেতে বসে আছে। বোধহয় শুয়ে থাকে এখানে রোগী এলে টেলে তখন ব্যবস্থা করে। গেটটা দেওয়া ছিল। রিন্টু দারোয়ানকে জানাল যে সে এখানে ছিল না তার ছোটভাই তার মামাকে ভর্তি করে দিয়ে গেছে, সে একটু ভিতরে গিয়ে ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলতে চায়। দারোয়ান বলল " রোগীর সাথে দেখা করা যাবে না, বড় ডাক্তারবাবু আবার কাল সকালে আসবেন, রেসিডেন্সিয়াল ডাক্তারবাবু শুধু আছেন। "
রিন্টু বলল " আমি রোগীর অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাই, তেমন হলে কাল ভোরেই অন্যত্র নিয়ে যেতে হবে তাই এখনই কথা না বললেই নয়। পরে যদি বাড়াবাড়ি কিছু হয় তখন... "
তার জোরাজোরিতে দারোয়ান একটু ভেবে উপরে ফোন করল বোধহয় ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলল। অনেক রাত হয়েছে। তারপর বলল " এই সিঁড়ি দিয়ে উপরে যান ডাক্তারবাবু আছেন।"
রিন্টুর বেশ শীত শীত লাগছে অথচ দারোয়ানের পিছনে ঘ্যাঙ ঘ্যাঙ শব্দ করে একটা ছোট টেবিল ফ্যান চলছে।
বোধহয় দুশ্চিন্তায় মাথাটা ভারি হয়ে আছে। উপরে উঠে দেখল টানা করিডর, জোরালো আলো আছে একদম ফাঁকা দুপাশে কয়েকটি পরপর ঘর। করিডর বেশ সরু খুব একটা চওড়া নয়। সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটু এগিয়ে দেখল একটা গোলাপি চেকচেক ড্রেস পরা মহিলা মস্ত একটা খাতা খুলে বসে কি যেন দেখছে।এই বোধহয় রিশেপশানিস্ট। রিন্টু জিজ্ঞাসা করল " আচ্ছা ডাক্তারবাবুর সাথে দেখা করব কোন ঘরে? " মাথা না তুলে আঙুল দেখিয়ে দিল সটান, করিডোরের শেষের দিকে। খুবই ব্যস্ত আছে এই ভেবে দ্বিধা করে সে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। মহিলাটির মাথার সব চুল লাল ও কোঁকড়া , ঘাড় অবধি ছাঁটা। চোখে পড়ল হাতের আঙ্গুলে একটা গোলাপি পাথরের আংটি।
রিন্টু করিডর ধরে এগিয়ে গেল। ঘরের দরজাগুলোতে ভারি সবুজ পর্দা ঝুলছে। সব ঘরের মাথায় নম্বর লেখা আছে। কিন্তু কোন ঘরে আছেন ডাক্তারবাবু কি করে বুঝবে! শেষ প্রান্তে গিয়ে দেখল সেখানে পরপর দুটো টয়লেট।
ইস জিজ্ঞেস করতেই হবে মহিলাকে কোন ঘরে ডাক্তারবাবু আছেন... পর্দা তুলে দেখা যায় না রোগীদের একটা প্রাইভেসি আছে তো...তাছাড়া অসুস্থ মানুষেরা ঘুমুচ্ছে ...
রিন্টু সঙ্গে সঙ্গে পিছন ফিরল কিন্তু কড়িডর ফাঁকা কেউ নেই! মহিলা হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই উঠে গেছেন কিন্তু চেয়ার টেবিল... টেবিলে রাখা কাগজপত্র...
এত ভাবনা ভাবতে পারছিল না রিন্টু, তার মাথা যন্ত্রণা করছে... কাকে জিজ্ঞেস করবে! তখনই মনে হল দারোয়ান উপরে বলার সঙ্গে সঙ্গেই সে উপরে উঠে এসেছে, কিন্তু বাড়িটা তো তিনতলা দোতলা না তিনতলা তা তো সে জিজ্ঞাসা করেনি। সে এবার হনহন করে তিনতলায় উঠে গেল। উঠেই একই রকম করিডর আর সেইরকম একটু দুরত্বে সেই টেবিল চেয়ারে বসে আছে রিশেপশনিস্ট...একটু এগিয়েই চমকে উঠল রিন্টু.. সেই ড্রেস পরা লাল কোঁকড়া চুলের মহিলা! ড্রেস তো একই হবে কিন্তু মানুষ এরকম একই দেখতে হয় না কি? অবশ্য মুখটা তো তখনও দেখেনি এখনও ঠিক সেই রকম ভাবেই মাথা নিচু করে সেই মস্ত খাতার দিকে তাকিয়ে বসে আছে! রিন্টুর কেমন ভয় ভয় লাগল, মনে ভাবল যমজ বোন এরা হতেই পারে.. সে সাহসে ভর করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল " ম্যাম, ডাক্তারবাবুকে কোন ঘরে পাব? " মাথা না তুলে সেই একই রকম ভাবে আঙুল বাড়িয়ে করিডরের শেষ প্রান্তের দিকে দেখিয়ে দিল। আঙ্গুলে সেই গোলাপি পাথরের আঙটিটা। রিন্টুর মাথার মধ্যে কেমন জানি করে উঠল, সে কেমন দিশেহারা হয়ে গেল, সেই একই রকম সার বাঁধা ঘরগুলোর দিকে তাকাল, কোন একজন রুগী কেমন একটা গলায় গুঁঙিয়ে উঠল । কেঁপে উঠল রিন্টু তবু এগিয়ে গেল দ্রুতপদে করিডর ধরে তিন চার পা গিয়েই বুঝতে পারল শেষ ঘরটা অপারেশন থিয়েটর। সঙ্গে সঙ্গে সে পিছন ফিরে তাকাল আর দেখল টেবিল চেয়ার মহিলা কিছুই নেই। অসম্ভব... দুমিনিট ও যায় নি যে এখনও... সে আর ভয়ে দাঁড়াতে পারল না, সব যুক্তি ভুলে প্রায় ছুটে নামার জন্য সিঁড়ির দিকে ছুটে গেল...নামার সময় তাকিয়ে দেখল দোতলায় সেই মহিলা সেই একই ভাবে বসে আছেন " সে একেবারে দৌড়তে দৌড়াতে নিচে নেমে এল। রীতিমতো হাঁফাচ্ছে..
দারোয়ান চমকে উঠে বলল " কি হল স্যার? " রিন্টু বলল " ডাক্তারবাবু কই? একজন মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি উত্তর দিলেন না... " দারোয়ান বলল " নার্স হবেন তাহলে , মোট তিনজন নার্স আছেন কিন্তু বলল না কেন? " কি মনে হল রিন্টু বলল " গোলাপি ড্রেস পরা মহিলা...! " দারোয়ান কেমন যেন হাঁ করে তাকিয়ে রইল... তারপর বলল " আসুন আমার সঙ্গে। "
ওরা সিঁড়ি দিয়ে আবার উঠল...কেউ নেই করিডরে,কিছু নেই! দারোয়ান হাঁক দিল "সবিতাদিদি.. " মাঝের ঘরের পর্দা সরিয়ে সাদা নার্সের পোষাক পরা একমহিলা বেরিয়ে এসে বলল " কি হল অমল? " দারোয়ান বলল " ডাক্তারবাবু কি রেস্ট রুমে? " মহিলা বললেন " না তিনতলায় সেই বাচ্চা ছেলেটা খুব অস্থির হয়ে উঠেছে তাই দেখতে গেলেন... "
দারোয়ান উপরের তলায় উঠল রিন্টুকে নিয়ে বলল " আপনার পেশেন্টও এখানেই আছে... " সে হাঁক দিল " এই শান্তিদি?" একটা সাদা নার্সের পোশাক পরা মেয়ে বেরিয়ে এসে বললেন " কি হল? " দারোয়ান বলল " এনার পেশেন্ট সেই আজকের বুড়ো বাবু, উনি ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলবেন একটু জানাও ওনাকে... " বেজার বিরক্ত মুখে মেয়েটা তাকাল রিন্টুর দিকে... তারপর " অহ " বলে মাঝের ঘরে ঢুকে গেল।
একটু বাদেই ট্রে হাতে একজন নার্সের সাথে ডাক্তারবাবু বেরিয়ে এলেন। উনি নিচু গলায় নার্সকে কিছু পরামর্শ দিলেন। তারপর রিন্টুর দিকে তাকিয়ে বললেন "পেশেন্ট আপনার কে হন? " রিন্টু বলল " মামা হন। " ডাক্তারবাবু বললেন " ভয়ের কিছু নেই তেমন কিছু হয় নি, প্রেশারটা হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল। কোন ক্ষতি হয় নি, কয়েকটি পরীক্ষা করা হয়েছে, মোটামুটি সবই ভালো। কাল ওনার ডাক্তারবাবু এসে আরো কিছু টেস্ট করাবেন। তবে এখানে সব কটা হয় না। আপনাদের ওনাকে নিয়ে যেতে হবে। এম্বুলেন্স জোগাড় হয়ে যাবে... ভয়ের কিছু নেই তবে এমন আচমকা প্রেশার বাড়াটা তো ঠিক নয় তাই কালকের দিনটা অবজারভেশনে থাকুন... আপনি কাল এগারোটায় আসুন ওনার ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলুন..."
রিন্টু বলল " একবার দেখা করা যায়? " ডাক্তারবাবু বললেন " না, উনি ঘুমুচ্ছেন " তারপর বোধহয় রিন্টুর মুখ দেখে মায়া হল বললেন "তবে আপনি বাইরে থেকে জানলা দিয়ে দেখতে পারেন। " রিন্টু দেখল মামাবাবু ঘুমুচ্ছেন।
সে নিচে নেমে এসে বেরিয়ে যাবার সময় সুন্দর করে হেসে দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল " দেখে যেন শান্তি পেলাম.. " দারোয়ানও ঘাড় নেড়ে হাসল। রিন্টু বেরিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল "আচ্ছা ওই গোলাপি পোষাক পরা লালচুলওয়ালা মহিলা কি বাঙালি নন... কোন উত্তর দিলেন না কেন? "
দারোয়ান যেন চমকে তাকাল, দুমিনিট কোন উত্তর দিল না, তারপর বলল " এখানে নার্স তিনজন ছাড়া আর কোন মহিলা নেই.." সে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল, বোধহয় রিন্টুকে এড়াতে। রিন্টু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এত নিখুঁত সে দেখেছে যে ভুল হতেই পারে না... অথচ... সে বেশ বুঝতে পারছে তার জ্বর আছে তাবলে এমন ভুল কি সম্ভব! এরা কথা কিছু চেপে গেল..কিন্তু কে ছিলেন ওই মহিলা? জানা হল না।।

 

 

 

 

ভেলভেটের টিপ...

নীলাঞ্জনা সরকার

 

আজ একটা ভীষণ ব্যর্থতার স্বাদ পেল সজল। গভীর হতাশা বুক চিরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল বারবার। অফিসের টেবিলেই শরীরটাকে মুচড়ে প্রায় ফেলে রেখেছিল। ভদ্রতা বলতে আজকাল আর কিছু নেই। নিজের বাড়িতে পর্দার আড়ালে বউয়ের ওপর কতবার রেগে কথা বলেছে। কিন্তু মাটির ডেলার মত দাঁড়িয়ে থেকেছে নমিতা। মেয়েরা তো কাঁদে! সজল অপেক্ষা করতো নমিতাও কাঁদবে, কোনোদিন হয়তো তা সজলের চোখে পড়বে...তখন সে গর্ব করবে পুরুষত্বের। কিন্তু, না! ভিতরে ভিতরে সজল যতই ভাবুক সে স্বামী তবু নিজের অজান্তেই নিজের শূন্যতার বাড়ির ইট গেঁথেছে সে একটা একটা করে। কেমন যেন ঝিম ধরে যায় মনে, বড় একা লাগে নিজেকে। আর মাত্র কয়েকটা দিন। হয়তো তাকে চলে যেতে হবে সব ছেড়ে! সজলের পাড়ার এক বন্ধু তাকে ফোন করেছিল একটু আগে, বাড়িতে নাকি আবার পুলিশ এসেছে। সজল ঘেমে যায়। মনে মনে বলে,



-নিজের খুশির জন্য মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছি নমিতাকে। কিন্তু নমিতা জীবনে এই প্রথমবার প্রতিক্রিয়া করলো! তাকে বারণ করা সত্ত্বেও পুলিশের সাথে যোগাযোগ করলো আবারও। এ যে কতদূর সর্বনাশ নিয়ে আসবে তা কি ও বুঝলো! কথায় কথায় এবার ঘরের সব কিছু লোক জানাজানি হবে। এর চেয়ে ভালো হতো ও যদি একটা চড় মারতো আমায়। শেষে থানা পুলিশ!







দিন সাতেক আগের ঘটনা,



নমিতা প্রায় দৌড়ে এসে দরজা খুলল, এত দেরি হলো যে? লায়লা কিছু উত্তর না দিয়েই বাসন মাজতে চলে যায়। নমিতা তাকিয়ে থাকে ওর চলে যাবার দিকে- বোঝে কেন এত দেরি! এত প্রায় রোজের ঘটনা। লায়লার বর মাতাল হয়ে রাতে ঘরে ফেরে তারপর সারাদিনের সব ফ্রাস্টেশন মেটায়...এই আর কি! কিইবা উত্তর দেবে লায়লা রোজ। সে শুধু হাসে। ছোট্ট ভেলভেট টিপটা তার কপালের শ্রীবৃদ্ধি করে যদিও বাস্তবে তার উল্টোটাই। কোনোদিন ভুল হয় না লায়লার টিপ পড়তে। ওর গায়ের রঙটা একটু ময়লা কিন্তু হাসিটা মনভোলানো।



নমিতা চা নামায়, একটু বেশি ভিজে গেল চা পাতাটা! দু কাপ চা নিয়ে দোতলায় উঠে বারান্দায় বসে। আজকের সকালটা পূজোর সূর্যের গন্ধ নিয়ে হাজির। কদিন পরেই মহালয়া আসছে সেটা আকাশও জানান দিচ্ছে। নমিতার এক্সিকিউটিভ স্বামী, সজল... চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই ছি ছি করে ওঠে! যথারীতি বেসুরো হয়ে যায় নমিতা। সজল বলে,



-এখনো চা করতে শিখলে না! এইতো সকালে মাত্র এককাপ চা খাই।



যন্ত্রচালিত নমিতা উঠে যায় আবার চা বানানোর জন্য। লায়লা ততক্ষণে অর্ধেক বাসন মেজে ফেলেছে, মুচকি হেসে বলে,



-বৌদিমনি, আমার জন্য চা রেখেছো তো?



-আমার বানানো চা এত ভালো লাগে তোমার!



-দাদাবাবুরও ভালোই লাগে। আসলে এ সব ভান করে।



দোতলায় উঠতে কটাই বা সিঁড়ি! কিন্তু আজকাল নমিতা কেমন যেন হাঁপিয়ে ওঠে। লায়লাকে দিয়ে ওপরে চা পাঠিয়ে রান্নাঘর লাগোয়া ড্রয়িং হলে এসে বসে নমিতা। জোরে ফ্যান চলছে তাও নমিতার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ততক্ষণে নমিতা নেমে এসেছে। জিজ্ঞেস করে,



-আজ বড্ড গরম। একটু শরবত খাবে বৌদি?



-না, একটু জল খাবো।



-আচ্ছা। আনছি। ফ্রিজের জল মিশিয়ে দিচ্ছি আরাম পাবে।



-তোমার বাড়ির কি খবর লায়লা? সব ঠিক আছে?



-আর কি খবর! আসল খবর নিয়ে বলতে চাই না গো, মন কেমন করে।



-এটাও তোমারই একটা বাড়ি লায়লা। তুমি যে কোনো অসুবিধায় আমার কাছে চলে আসতে পারো।



-বৌদি, তোমার সাথে আরো আগে দেখা হলে ভালো হতো গো...



দুজনে হেসে ওঠে, কষ্টের দেওয়া নেওয়া হয়ে যায় ওই হাসিটুকুতে।নমিতা একটা স্কুলে পড়াতো, সন্তানের মা হওয়ায় পর নিজের ইচ্ছাতে সে আজ গৃহবধূ।সজল, প্রতিটি জিনিসে খুব শৌখিন যদিও এই শৌখিনতার তকমা তার নিজের দেওয়া কিন্তু বিয়ের দশ বছরের অভিজ্ঞতায় নমিতার মনে হয় সজল বড় বেশি স্বামী...’নমিতার স্বামী’, বন্ধু হিসাবে কখনো পায়নি তাকে সে। ছোট ছোট জিনিসে আনন্দ পাওয়ার বদলে সজল সারাদিন ব্যস্ত মুনির অকর্মণ্যতা নিয়ে। যাইহোক এভাবেই নমিতার সংসার চলে তার মিষ্টি আট বছরের মেয়ে তুলিকে নিয়ে। সজল আর তুলির সারাদিনের বৃত্তটা ঘিরে নমিতার দিনগুলো কাটছিল একরকম সব কিছু মানিয়ে নিয়ে।



দুদিন পর রাত এগারোটায় নমিতার ফোনটা বেজে উঠেছিল বার বার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা ধরে সে, আর চমকে যায় ফোনের ওদিকে লায়লার চিৎকারে...



-বৌদিমণি, ওরা এসেছে তুমি একবারটি এস।



কি হয়েছে বোঝার আগেই ফোন কেটে যায়। নমিতা ঘরে গিয়ে সজলকে ডাকতেই সে খুব বিরক্ত হয়ে কথা শুনিয়ে দেয়,”দুপয়সা কামাতে হলে বুঝতে সারাদিন কি খাটুনি...একটু ঘুমাবার উপায় নেই ইত্যাদি ইত্যাদি।“ নমিতা হলঘরে এসে বসে, খুব কষ্ট হয় তার- সত্যি লায়লার সাথে নিজের তুলনা করলে দেখা যাবে দুজনের সামাজিক অবস্থানের কোনো ফারাক নেই তবু তো লায়লা নিজে দুপয়সা কামায়। খুব অস্থির লাগছিল তার নিজের মনের মধ্যে, লায়লার বাড়ি এক দুবার গেছে কিন্তু এত রাতে একা কি করে যাবে সে? তার নিজের কোন বিপদ হতে পারে। সে স্থির করে সকাল অবধি অপেক্ষা করার। ঘুম আসে না নমিতার। মনের মধ্যে অনেক কিছু ঘোরাফেরা করে। মাথার শিরা দপদপ করতে থাকে। সে নিজেই নিজেকে অসহায় বানিয়ে রেখেছে। লায়লাকে কত বড় মুখ করে বলেছিল যেকোনো দরকারে তাকে জানাতে, অথচ আজ সময়ে কোনো উপকারে আসতে পারলো না নমিতা। অনেক পুরোনো কথা মনে এলো তার। মাঝে মাঝে অন্ধকার দিনের কথায় কষ্ট পেলে মুখ ভার করে থাকতো নমিতা, তখন লায়লা ওকে ভোলাতো। একদিন তো সরাসরি বলেছিল,



-স্কুলটা বন্ধ না করলেই ভালো করতে বৌদি।



-কেন? তিরিক্ষি মেজাজে উত্তর দিয়েছিল নমিতা।



-জানো বৌদি, বাড়ির কারোর ওপর অভিমান করে থেকো না।



-সে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না।



-অন্যের মর্জি সামলে চলাটা আমাদের নিয়তি গো। যত যাই হোক আমার দাদাবাবু তোমায় ভালবাসে খুব। রাগ লুকিয়ে রাখতে পারে না।



লায়লার এরকম কথায় আরও মাথা ঝিমঝিম হতো নমিতার। রাগ হতো...ভাবতো এ কি ধরণের অপমান! কিন্তু কিছু পরে ঠান্ডা হতো নমিতা। লায়লার ইতিবাচক কথায় সব ভুলে সজলের অফিস থেকে ফেরার জন্য আবার অপেক্ষা করতো।



কিন্তু এই একটা রাতের অপেক্ষা যে নমিতার জীবনে কত বড় ভুল তা সে পরদিন সকালেই টের পায়। লায়লা যে আজ কাজে আসবে না তা সে আগেই বুঝেছিল কিন্তু কোনোদিন আর লায়লার সাথে দেখা হবে না তা কল্পনাও করতে পারেনি নমিতা! পরদিন সকালে লায়লার বাড়ি যাবে বলে দরজায় তালা দিয়ে নমিতা বেরোতে যাবে এমন সময় পুলিশের ভ্যান তার বাড়ির সামনে।



-নমস্কার, আমি থানা থেকে আসছি। আচ্ছা, লায়লা নামে কেউ আপনার বাড়ি কাজ করতো? ইন্সপেক্টরের প্রশ্নের উত্তরে এক নিমেষে বলে ওঠে নমিতা,



-কেন! কি হয়েছে লায়লার? আমি ওর বাড়ি যাব বলেই বেরিয়েছি।



উত্তর শুনে নমিতার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে- কারা যেন কাল লায়লাকে ধর্ষণ করে খুন করেছে। নমিতার গা গুলিয়ে ওঠে ওখানেই বসে পড়ে সে, লায়লার আওয়াজটা কানে ভেসে ওঠে।







পুলিশ জানায় যে লায়লার ফোনের শেষ ডায়াল করা নম্বরটি নমিতার তাই ওরা কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়। নমিতা ঘরে এনে বসায় ওদের, সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। পুলিশের কর্তা জানায় কিছু দরকার হলে আবার ডাকবে তাকে। সজল অফিস থেকে ফিরলে, জলখাবার দিয়েই লায়লার কথা জানায় নমিতা। সজল বলে,



-এইসব পেটি কেসে জড়িও না। এইসব ঘটনা ওদের ঘরে হতেই থাকে। আর তুমি কি ভাবছো পুলিশ তোমায় পূর্ণ সহযোগিতা করবে!



-বলতে পারবো না।



-তুমি ওদের সব সত্যি বলতে যেও না। নিজেই ফেঁসে যাবে।



-কিন্তু এই নোংরা কাজ কি করে মেনে নি!



-বেশি ভ্যাকভ্যাক করো না। যে কেউ বাড়িতে এলেই সব বলে দিতে হবে নাকি? ওরা যদি ওদের লোক হয়! হয়তো তোমায় পরীক্ষা করতে এসেছিল। ওরা তো আর জানে না তোমার মাথা কত নিরেট!



নমিতা ধীর পায়ে বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দেয়, দামি আয়নায় তাকায়, সত্যি কি পেটি কেস? কখনো কখনো নমিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সজল যখন জোর করে, নমিতা বারণ করলেও শোনে না সেটাও তো একধরণের ধর্ষণ! নিজের ওপর ঘেন্না হয় নমিতার, পাশের ঘরে যে নিষ্পাপ শিশুটি বসে হোমওয়ার্ক করছে সেও তো একটা মেয়ে। চোখের জলটা মুছে নেয় নমিতা। বাথরুম থেকে বেরিয়ে শান্ত হয়ে সজলের পাশে বসে টিভি দেখতে শুরু করে। পরদিন সকালে সে থানায় যায়। সেখানে খবর পায় লায়লার স্বামী অন্য পাড়ার এক গুন্ডার কাছে অনেক আগে বেশ কিছু টাকা ধার নিয়েছিল কিন্তু ফেরত দিতে পারেনি তাই সেদিন ওই গুন্ডার পোষ্যগুলো এসেছিল টাকা আদায় করতে তখন লায়লার বরকে না পেয়ে ওকে টার্গেট করে। নমিতার বুকের ভিতরটা ছটফট করে ওঠে। লায়লার শরীরটা যখন মুচড়ে ভেঙে দিচ্ছিল ওরা, ওর কপালের ছোট্ট ভেলভেটের টিপটা ওদের ঘামে নিশ্চয় খুলে হারিয়ে গেছে...নমিতার বুকটা কেঁপে ওঠে। ও ভাবে ওরা যখন মদের গন্ধ মাখা ঠোঁট দিয়ে লায়লার শরীরে রক্তের কামড় দিচ্ছিল তখন নমিতা এ.সি ঘরে আরাম করছিল!



-লায়লা, সারাজীবনেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না রে... কান্নাগুলোকে ঢোক গিলে ফেললো নমিতা।







আজ নমিতা বাড়ি ফিরল মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে। তুলি মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,



-কি হয়েছে মাম্মা? তোমার শরীর খারাপ?



-না রে। আজ লায়লা মাসির জন্য বাড়িতে আবার পুলিশ কাকু এসেছিল। ওদের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছি তাই একটু ক্লান্ত।



-মাসির কি হয়েছে মাম্মা?



নমিতা তুলির প্রশ্নের উত্তরে বলে,



-সব বলবো তোমায়। আচ্ছা তুলি, তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো? মাম্মাকে নাকি বাপিকে?



মায়ের এরকম প্রশ্নে অবাক মেয়ে ! কি বলবে বুঝে পায় না! ভাবতে বসে সে আর তাই দেখে নমিতা তাকে আদর করে বলে,



-সবার আগে নিজেকে একটু ভালোবাসিস মা ... কাউকে হিংসা করবি না কিন্তু নিজেকে এমন ভাবে তৈরি কর যাতে সবাই তোকে দেখে ভাবে, সত্যি! আমি যদি তুলি হতে পারতাম...ব্যস এইটুকুই।



এইসব শুনে তুলি হেসে কুটোপুটি হয়। সজল ফোনে বলেছে আজ অফিস থেকে ফিরতে দেরি হবে। ওর গলাটা বেশ গম্ভীর ছিল আজ।



নমিতা তানপুরা নিয়ে বসে আজ অনেকদিন পর। "আগুনের পরশমণি" গানটা খুব প্রিয় তার, ধীর লয় গানটা ধরে সে, আর তার চোখের জলে ভেসে ওঠে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে লায়লার সাথে দেখা হওয়া, তার প্রথম দিনের ‘বৌদি’ ডাকেই ছিল খুব আপন করে নেওয়া। বিয়ের সময় নমিতার শশুরমশাই অসুস্থ ছিলেন... বিয়ের চার বছরের মধ্যেই তিনি গত হয়েছিলেন। শাশুড়িমা, সজল কলেজে পড়াকালীন সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তবু সবকিছু আগলে রেখেছিল লায়লা। এবাড়িতে সে যেন মায়ের বিকল্প হয়ে ছিল। ঠিকে কাজের লোক কে বলবে? বড় মায়া ছিল ওর মনে। রাতের খাবার সার্ভ করার সময় সজল নমিতাকে জিজ্ঞেস করে,



-আজ আবার পুলিশ এসেছিল?



-তুমি কি করে জানলে? আমি তো এখনো বলিনি তোমায়!



-আমার শুভাকাঙ্খী কম নেই। তোমাকে এসব থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম। কিসের শোধ নিচ্ছো তুমি আমার ওপর?



-আমার ওপর নজরদারি করছো করো কিন্তু লায়লার সাথে যা হয়েছে তাতে আমি চুপ করে থাকতে পারবো না। তুলিকে কি শেখাবো তাহলে যদি আমার নিজের বিবেকটাই শেষ করে দি!



তুলিও এক টেবিলে। জীবন প্রায় আঁতকে ওঠে, মুনিকে বলে,



- এই কথাগুলো তুলির সামনে না বললে চলছিল না তোমার!



নমিতা খুব কঠিন আজ,



- কেন সজল! তুলি তো খুব ছোট তার মনের কথা এত ভাব তুমি, তাহলে তার সামনে তার মাকে কেন এত অপমান কর?



সজল চমকে ওঠে! নমিতা বলে চলে,



-সজল, আমি চাই তুলির চোখে আমাদের দুজনের জন্য সমান শ্রদ্ধা থাকুক। আজ ও যা দেখবে তাই শিখবে। লায়লা মাসির প্রতি ওর যে অকৃত্তিম ভালোবাসা, তাতে মরচে পড়তে দেব না আমি। ও জানবে ঠিকই লায়লা মরে গেছে, কিন্তু তার কারণটা! তুলি বড় হচ্ছে আসল বাস্তবটা যদি লুকিয়ে যাই তাহলে ঐ বিকৃত গলির বন্ধ মুখের চাবির সন্ধান ওর কাছেও থাকবে না। তুমি কি চাও না তোমার মেয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচুক.. ওর অস্তিত্বের গ্যারান্টি ও নিজে নিক?



সজল আজ নিশ্চুপ। কোন কথা খুঁজে পায় না। সে আজ নিজের কাছেই কোণঠাসা হয়েছিল। নমিতা আজ অপ্রতিরোধ্য...তাকে ভালো করে দেখে সজল। নমিতার চোখ দুটো ফোলা, চোখের কাজল ধেবড়ে গেছে। আজ খুব রাগ হয় সজলের নিজের ওপর। কে যেন একটা ভারী পাথর বসিয়ে দিয়েছে বুকের ওপর...অপরাধবোধের পাথর।



সজল শুধু নমিতার হাত দুটো জড়িয়ে বলে,



- তুমি আমাকে আর ভালোবাসো না- তাই না?



নমিতা সজলের হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে আসে, সাথে তুলিকেও, রাতের নিস্তব্ধতায় সজলের কোলে তুলি আর পাশে নমিতা, এ যেন সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত।



পরদিন সকালে নমিতা চোখ খুলেই দেখে সজল হাসি মুখে বসে, সে বলে, -চলুন ম্যাডাম আজ আমার হাতের চায়ের টেস্ট কেমন দেখুন!



নমিতা হেসে ওঠে। বলে,



- আসছি।



তার চোখে ভালোবাসায় জেতার আনন্দ আজ, পিছন থেকে সে ডাকে সজলকে,



- শুনছো, আমাদের লায়লা...



সজল ঘুরে দাঁড়ায়। বলে,



- আজ থানায় যাব কেসটা নিয়ে কথা বলতে। তোমার লায়লা চলে গেলেও তার সম্মান এভাবে বিসর্জন হতে দেব না।



নমিতার সামনে ভেসে ওঠে লায়লার হাসি মুখ, ‘বৌদি অভিমান করে থেকো না গো’...নমিতার রান্নাঘরটা বড় শূন্য কদিন ধরে।।