টরন্টো, নভেম্বর ১০, ২০২১, নভো সংখ্যা ২৬
              
হোমপেজ সম্পাদকীয় পাঠক পরিষদের কথা কবিতা ছোট গল্প ধারাবাহিক পাঠাগার আর্কাইভ লেখক পরিচিতি বিশেষ নিবন্ধ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল যোগাযোগ আবৃত্তি / কণ্ঠসঙ্গীত

কার্তিকের কুয়াশা

প্রতিশ্রুতি (ভূতচতুর্দশী ৩)

রত্না চক্রবর্তী

  ২৭.১০.২১

 

অনেকদিন ধরে ভুগছিল সুধন্যদা। প্রায় আড়াই মাস আগেই খবরটা পেয়েছে বিজয় কিন্তু সে আর আসেনি। সে যেন নিজেকে লুকিয়ে ফিরছিল। এমন নয় যে বিজয় সুধন্যদাকে ভালবাসে না কিন্তু সে একটা প্রতিশ্রুতির খপ্পরে পড়ে গিয়েছিল তার থেকে সে মুক্তির উপায় খুঁজছিল। সুধন্যদার আর তার একমাত্র ছোটবোন মিতালী ছাড়া সুধন্যের কেউ ছিল না। সুধন্যদার বোনকে বিয়ে করবে সে কথা দিয়েছিল কিন্তু মিতালীকে বিয়ে করা এখন আর তার পক্ষে সম্ভব নয়।আর সেটা মুখের উপর বলতে পারছিল না সুধন্যকে। এমনিতে সুধন্যের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপই ছিল । তারপর একটা অ্যাক্সিডেন্টে একটা পা কাটা গিয়েছিল। অনেক আগে চাকরি থেকে বসে যেতে হয়েছিল। এখন হেলমেটের একটা কারখানায় কাজ করে কিছু পয়সা রোজগার করত তাই দিয়ে সংসার চালাত।
তবে মনটা খুব বড় ছিল সুধন্যদার। এককালে সুধন্য বিজয়কে পড়িয়েছে বিনা পয়সায়। খুব ভালোবাসা ছিল, আসা যাওয়া ছিল। সুধন্য বুঝতে পেরেছিল যে তার দিন শেষ হয়ে আসছে, সম্প্রতি সে জানতে পেরেছিল এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে সে ভুগছে। তাই বিজয়কে ধরে পড়েছিল তার বোন মিতালীকে বিয়ে করার জন্য। মিতালী অবশ্য বেশ ভালোমেয়েই, অন্তত বিজয়ের সাথে তো অবশ্যই মানানসই, ফর্সা ঘেঁষা রঙ, মাঝারি লম্বা, সুদর্শনা, লাজুক বা বাচাল কিছুই নয়, হায়ার সেকেন্ডারিতে মাঝারি রেজাল্ট করে, বিএ পড়ছে। সে তুলনায় বিজয়ের মুখশ্রী একদম ভালো না। বিজয় দুটো হাফপ্রেম প্রেমগোছের করার পর এখন ফ্রিই ছিল। কাজেই আপত্তি করে নি। টাকা পয়সা কিছুই ছিল না সুধন্যদার কিন্তু ভাইবোনের একটা এককামরার টিনের চালের বাড়ি ছিল। এবং ভালো পজিশনে। আর বিজয়ের একটা মোটামুটি ধরনের চাকরির হয়ে যাবার কথা এই বছরেই, কাকা চেষ্টা করছেন ধরা কওয়া করে যত তাড়াতাড়ি হয়।
কাজেই সুধন্যদার কথায় আপত্তি করে নি। তবে সুধন্যদা একটু প্রাচীণপন্থী ছিলেন। তাই কথাটা সুধন্যদা কাউকে এমনকি মিতালীকেও বলেন নি। বিয়ের কথা নাকি পাঁচকান করতে নেই, তাছাড়া এখনই জানলে মিতালীর বিয়ে বিয়ে মন হয়ে যাবে, আর পড়াশোনা যেটুকু হচ্ছে তাও হবে না। আজকালকার দিনে একটু লেখাপড়া জানা খুবই দরকার। সুধন্যদা নিজে খুব ভালো পড়ুয়া ছিলেন। তাছাড়া বিজয়ের চাকরিটা পার্মানেন্ট৷ হওয়া অবধি তো অপেক্ষা করতেই হবে অতএব চাকরিটা পেলেই সবাইকে জানাবেন।
বিজয়ের চাকরিটা হবার কথা ছিল একটা মাঝারি প্রাইভেট কোম্পানিতে। সেটাও এক দূর সম্পর্কের কাকার সহায়তায়। কিন্তু ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে বিজয় বুঝল চাকরিটা পাওয়া নির্ভর করছে ম্যানেজারবাবুর সিদ্ধান্তের উপর। আর ম্যানেজারবাবুর একটি অবিবাহিত শালী আছে তার উপর ডিপেন্ডেবল। তিনি তাকেই চাকরি দেবার জন্য উপরিওয়ালাকে সুপারিশ করবেন যার সাথে তিনি নিঃখরচায় তার শালীর বিয়েটা দিতে পারবেন। পরোক্ষভাবে সেটাই তিনি ঘুরিয়ে জানালেন। চেহারাপত্র, জাত, ব্যবহার, আরো নানারকম দিক থেকে বিচার করে উনি দুইজনকে পছন্দ করেছেন তার মধ্যে বিজয় একজন আর ওর দিকেই পাল্লাটা ভারী কারণ ওর কোন পিছটান নেই। এই বাজারে চাকরিটা হয়ে যাবে যদি সে রাজি হয়ে যায়।
ম্যানেজারবাবু চাকরি হবার আগেই তাকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছেন এই ছুতোয় যে বিজয়ের সেই দূরসম্পর্কের কাকা ওনার ছোট বয়সের বন্ধু। এও এক ধরনের মেয়ে দেখানো। দ্বিধাগ্রস্ত হয়েও ঘুরে এল ম্যনেজারের বাড়ি। যথারীতি শালী সেখানেই ছিল। মেয়েটা মোটামুটি। দেখতে সুন্দর নয় কিন্তু ঠাটবাট, আলগা চটক আছে। খুব সপ্রতিভ হাসিখুশি, মন্দ নয়। মিতালীও আহামরি নয়। কি করবে ভেবে পায় না। সম্বন্ধটার জন্য সেই কাকাকে দিয়ে অনুরোধ করেছেন ম্যানেজার বাবু। মানলে চাকরিটা হয়ে যাবে নয়তো এই অনিশ্চিত জীবন।
বিজয় নিজেকেই বোঝায় চাকরি না পেলে তো এমনিই মিতালীকে বিয়ে করতে পারত না। কিন্তু তাই আর যায় নি সুধন্যদার কাছে... যদি সুধন্যদা সেই বিয়ের কথা তোলে। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অস্বস্তিতে ভুগছিল বিজয়। হ্যাঁ সে ম্যানেজারবাবুর শালীকে বিয়ে করতে সম্মতি দিয়েছে, চাকরিটা আর আশীর্বাদটা একসাথেই সারতে হয়েছে। এখন বিয়ের তারিখ নেই তিনমাস, অঘ্রাণে বিয়ে।
এর মধ্যেই খবরটা পেল সুধন্যদার বাড়াবাড়ি হয়েছিল। চারিদিন হাসপাতালে ছিল, মারা গেছে গত রাতে। বুক থেকে যেন একটা চাপ নেমে গেল। যাক প্রতিশ্রুতির কথা তো আর কেউ জানে না, মিতালীও নয়। সে পারলে লুকিয়ে মিতালীকে কিছু সাহায্য করবে কিছু কাজকর্ম যদি জোগাড় করতে পারে সে চেষ্টা করবে, চাই কি তেমন সম্বন্ধ পেলে না হয় বিয়ে দেবার চেষ্টাও করবে। কিন্তু বিয়ে তো আর করতে হবে না। সরাসরি এই কথা সুধন্যদাকে বলার ক্ষমতা বিজয়ের ছিল না। খারাপও লাগল সেই ভালোবাসার মানুষটার মৃত্যুতে সে স্বস্তি পাচ্ছে ভেবে।
অফিসে ম্যানেজারবাবুকে ফোনে জানিয়েই ছুটি নিল সুধন্য। আড়াইমাস চাকরিতে ছুটি নেওয়া যায় না কিন্তু সে ম্যানেজারবাবুর হবু ভায়রা কাজেই সে আউটে কাজে গেছে দেখিয়ে ছুটি পেয়ে গেল।
হাসপাতালের বাইরে দুচারজন পাড়ার ছেলে এসেছে। মিতালী পাগলের মতো কাঁদছে তাকে ধরে রেখেছে ওদের পাশের বাড়ির সাধনা বৌদি। বিজয় সময়োচিত স্বান্তনার কথা বলল। পাড়ার ছেলেরা খাট, ফুল কিনতে গেছে। বিজয় জোর করে টাকাটা গুঁজে দিল হাতে। বেশ হালকা বোধ হচ্ছে, যেন রেহাই পেয়ে গেল। সুধন্যদাকে কিন্তু সে মন থেকে ভালোবাসত।
ধীর পায়ে সুধন্যদার সবুজ পর্দায় ঘেরা বেডের কাছে দাঁড়াল। ঝুঁকে যাওয়া মানুষটাকে কি লম্বা আর সোজা দেখাচ্ছে। সাদা ঢাকা দেওয়া চাদরটা আলতো করে খুলল বিজয়। বন্ধ চোখ, যেন গভীর ঘুমে মগ্ন। বুকের উপর হাতদুটো জড়ো করা। বিজয় আরো একটু এগিয়ে গেল কাছে, আপনা আপনিই মুখ থেকে ফিসফিস করে শব্দ বেরিয়ে এল, " সুধন্যদা আমি এতদিন আসতে পারি নি, তুমি অকালে চলে গেলে? দেখতে পেলে না কিন্তু আমি এসেছি দেখ। "
হঠাৎ সবুজ পর্দা ঘেরা বেডটা যেন কেঁপে উঠল! আচমকা বন্ধ চোখের পাতাটা খুলে গেল! আঁতকে উঠল বিজয়। ঝুঁকে পড়ে কথাটা আবেগের সঙ্গেই বলেছিল বিজয় এখন সুধন্যদা তার বুকের উপর জড়ো করে রাখা ডান হাতখানা বাড়িয়ে বিজয়ের হাতটা চেপে ধরল জ্যান্ত মানুষের মতো, ঠিক যেমন বিয়ের প্রতিশ্রুতি নেবার সময় হাতটা ধরেছিল! তারপর চাপটা ক্রমাগত
বেড়ে গেল! আতঙ্কে ছিটকে বেরিয়ে এল বিজয় সেখান থেকে ঠকঠক করে কাঁপছে। সামনে দাঁড়িয়েছিল পাড়ারই শোভন বলে একটা ছেলে সে ধরে বাইরে নিয়ে এল বিজয়কে , বলল, " বিজয়দা এত দিনের সম্পর্ক আপনাদের , আচমকা খবরটা পেয়েছেন খারাপ তো লাগবেই...আপনি কাঁপছেন, বসুন এই টুলে বসুন। "
বুকের ভিতর ভয়ের কাঁপন বিজয়ের। বডি এবার নিয়ে যাবে সবুজ পর্দা সরিয়ে নিয়ে ট্রলিতে বডি তুলছে, আড়চোখে ভয়ে ভয়ে বিজয় দেখল বন্ধ চোখের পাতা তেমনই আছে কিন্তু বুকে জড়ো করে রাখা হাতের মধ্যে ডান হাতটা চাদরের বাইরে ঝুলছে! কেউ খেয়াল করল না। সবটা কি বিজয়ের মনের ভুল! তার বিবেক, তার চেতনা তাকে আঘাত করেছে, তাই সে এমন অবাস্তব ঘটনা ঘটতে দেখেছে! তার খারাপলাগা, অন্যায় বোধ তাকে এই দৃশ্য দেখিয়েছ? নিশ্চিত তাই। সবার সাথে পা মিলিয়ে সে নেমে এল নিচে। হাতটা ব্যথা ব্যথা করছে কেন? সাধনা বৌদিই বলল, " বিজয় তোমার হাতে কি হয়েছে ভাই, অমন নীল কালসিটে পড়ল কি করে? ফুলে গেছে তো! "
বিজয় চমকে তাকাল হাতের দিকে তিনটে আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে! সে শিউরে উঠল!
তবে তো...

 

 

 

 

জেগে দেখা স্বপ্ন

সামিদা খাতুন

 

দিনটি ছিলো ২০ শে জুলাই। সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছিলো। তুহিন ও ওর বন্ধু রিফাদ একটি চায়ের দোকানে বসে গল্প করছিলো আর বাস এর জন্য অপেক্ষা করছিলো। ওরা হঠাৎ লক্ষ্য করলো একটি মেয়ে ছাউনির নিচে আসতে চেয়েও আসলো না। ফুটপাতেই দাঁড়িয়ে রইলো বাসের জন্য। তুহিন ও রিফাদ মেয়েটির ছাউনির নিচে না আসার কারণ টা উপলব্ধি করতে পারলো। এবং একা মেয়ে বলে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেলো। তুহিন খুব লাজুক প্রকৃতির ছেলে খুবই কম কথা বলে। তাই রিফাদই জিজ্ঞেস করলো মেয়েটিকে, আপনি কোথায় যাবেন? বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছেন তো ছাউনিতে এসে দাঁড়ান। মেয়েটি ইতস্ততভাবে উত্তর দিলো "না না সমস্যা নেই এখনি বাস আসবে "। রিফাদ হয়তো আবার অনুরোধ করতে চাইলো কিন্তু তুহিন মানা করলো। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি বাসে উঠে চলে গেল। এই অল্প কথাতেই মেয়েটার প্রতি তুহিনের ভালো লাগা কাজ করলো সে রিফাদকে বললো মেয়েটা ভিজেই গেল, কিন্তু ছাউনি তে আসলো না। একদিন ঘটনাক্রমে আবার ও মেয়েটার সাথে দেখা হলো ওদের দুই বন্ধুর, সেই একই জায়গায়। তুহিন রিফাদকে বললো দেখ সেই মেয়েটা। রিফাদ এগিয়ে আসলো মেয়েটার কাছে বললো আপনি সেদিন না ভিজলেও পারতেন। মেয়েটা বললো কোন ব্যাপার না ভিজতে আমার ভালোই লাগে। রিফাদ মেয়েটির নাম জানতে চাইলো মেয়েটি বললো তার নাম জান্নাত। রিফাদ জান্নাত কে অনেক প্রশ্ন করে যাচ্ছিলো জান্নাত উত্তর দিচ্ছিলো তবে অনিচ্ছাকৃত ভাবে। হঠাৎ তুহিন বলে উঠলো আপনি বৃষ্টি খুব পছন্দ করেন তাই না, জান্নাত বললো হুমম অনেক। এরপর থেকে রিফাদ তুহিন ওই একই সময় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতো জান্নাত এর সাথে দেখা করার জন্য। আর এভাবেই ওদের তিন জনের অল্প অল্প কথার মধ্য দিয়ে ত্রিমাতৃক একটা বন্ধুত্ব সৃষ্টি হলো। তুহিন জান্নাত কে বললো কিছু মনে না করলে আপনার মোবাইল নম্বর টা পেতে পারি? সাথে সাথে রিফাদ বলে উঠলো আমরা তো এখন ভালো বন্ধু আশা করি নম্বর টা পাবো। জান্নাত নম্বর টা দিয়ে দিলো। সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটানোর পর প্রায় প্রতিদিন জান্নাত কে রিফাদ কল দিতো সারাদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ দিতো। জান্নাত কেবল শুনে যেত আর মাঝে মাঝে সম্মতি জ্ঞাপন করতো। তুহিন ও জান্নাত কে কল দিতো কিন্তু খুবই কম। কল দিয়ে বলতো.... কেমন আছেন? খেয়েছেন? আপনার শরীর ভালো আছে তো? আর এভাবেই কেটে গেল প্রায় আড়াই বছর। ওদের বন্ধুত্ত অন্যদিকে মোড় নিতে চাচ্ছে। রিফাদ তো নাছোড় বান্দা সে বার বার জান্নাতকে ভালোবাসি ভালোবাসি বলতে বলতে ব্যস্ত করে তোলে। জান্নাত এর মনে রিফাদকে নিয়ে এমন কোন চিন্তাই নেই। তার ভালো লাগা যে অন্য কোথাও। তাই জান্নাত রিফাদকে বলে, আমরা এভাবে ভালো বন্ধু হয়েই থাকতে চাই আর কিছু না। রিফাদ একদিন জান্নাত কে বললো ঠিক আছে তুমি যেভাবে চাও আমি সেভাবেই তোমার পাশে থাকবো। আমি জানি একদিন তুমি আমার ডাকে সাড়া দিবা,অপেক্ষায় রইলা। কিন্তু রিফাদ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে আবারও জান্নাতকে বিরক্ত করতে থাকে, আর তাই জান্নাত একদিন রেগে গিয়ে ওদের দুজনের নম্বরই ব্লাক লিস্টে ফেলে। হটাৎ একদিন একটা মেসেজ আসে। সেখানে লেখা ছিলো কী করলাম বুঝলাম না তো? কেনই বা নম্বর টা ব্লক করা হয়েছে তাও জানি না। খুব জানতে ইচ্ছে করছে। তাই মেসেজ দিলাম। জান্নাতের মনে হলো সত্যিই তো তুহিন তো কোন কিছু বলে নি। সাথে সাথে জান্নাত তুহিনের মেসেজ এর উত্তর দিলো। এবং রিফাদের সমস্ত কথা তুহিনকে জানালো। সব কথা শোনার পর তুহিন একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলো আর বললো ভালো তো রিফাদ অনেক স্মার্ট, ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। সবসময় ইংরেজিতে কথা বলে ওর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। ও তোমাকে ভালো রাখতে পারবে ওর প্রস্তাবে রাজি হলেই পারতে। জান্নাত মনে মনে একটু বিরক্ত হলেও তুহিনকে কিছু বললো না। জান্নাত ও তুহিনের মনে যে কি চলে তা কেউ কাওকে বুঝতে দেয় না। সব কিছু জানার পর তুহিন আরো বেশি কথা বলতে থাকে আর ওদের কথার সূত্রই হলো রিফাদ। তুহিন ফোন দিয়েই রিফাদ এর কথা জিজ্ঞেস করে বুঝতে চেষ্টা করে জান্নাত রিফাদের প্রতি কতটা দূর্বল। আর জান্নাত ও এমন ভাবে সব কথার উত্তর দেয় যেন তুহিন বিশ্বাস করে জান্নাত রিফাদকে ভালোবাসে। একদিন তুহিন জান্নাত কে বলছিলো আচ্ছা জান্নাত কোন এক সাধারণ ছেলে সে যদি তোমায় বলে সে তোমাকে চায় তুমি কী বলবে? জান্নাত বললো কি আর বলবো, বলবো যে একজন আমায় ভালোবাসে আমিও একজন কে ভালবাসি দ্বিতীয় কেউ আমার জীবনে আসার কোন সুযোগ ই নেই। তুহিন হয়তো না বলা কোন কথা জান্নাত কে বুঝাতে চাইলো আর জান্নাত সবটা বুঝেই তুহিনকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। হঠাৎ জান্নাত খুব অসুস্থ তুহিন বিষয় টা জানা মাত্রই রিফাদকে জানালো। রিফাদ জান্নাত কে কল দিলো দেখলো জান্নাত কথাই বলতে পারছে না। রিফাদ বললো মানুষ অসুস্থ হবে এটা তো স্বাভাবিক এতে এত ভেঙে পড়ার কি আছে! জান্নাত ভাবলো এই মানুষ টা নাকি আমায় ভালোবাসে এ কেমন ভালোবাসা?? অন্যদিকে তুহিন সবসময় কল দিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে যাচ্ছে। জান্নাতের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। রিফাদ আর একটা বার ও খোঁজ খবর নিলো না। তুহিন যেন সব ভাংচুর করে জান্নাতের কাছে চলে আসতে চায় কেননা এই সময় জান্নাতের কাছে থাকা খুব দরকার। জান্নাত থাকে ওর এক আন্টির সাথে । আন্টি স্কুলের কাজে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি যতটা সম্ভব দেখাশোনা করছেন। তবুও যেন তুহিনের মন মানছে না সে জান্নাত কে বলছে জান্নাত আমি একটা বার তোমায় দেখতে আসতে চাই, তুমি কখনোই অফিস ছুটি নাও নি সেই তুমি আজ দুইদিন হলো ছুটি নিয়ে বাসায় আছো, না জানি কতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছো। আমি একবার নিজ চোখে দেখতে চাই তোমাকে। আর তাছাড়া আমার বদলি হয়েছে কিশোরগঞ্জে। আমি দুই দিন পর চলে যাবো। জান্নাত অসুস্থ এ সময় তুহিন কে আসতে বললে তুহিন ব্যস্ত হয়ে পড়বে আর জান্নাত ও তুহিনের জন্য কিছুই করতে পারবে না। জান্নাত ও যেন চাইছিলো তুহিন আসুক কিন্তু সে চায় না কাউকে বিভ্রান্তিতে ফেলতে। জান্নাত সুস্থ হয়ে আবার কাজে ফিরেছে। অন্যদিকে তুহিন এর ও বদলি হয়েছে। তুহিন নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশে একটু অসস্তির মধ্যে আছে। তার আরো বেশি খারাপ লাগছে আসার আগে একবার জান্নাতের সাথে দেখা হলো না শেষ কবে দেখা হয়েছিলো জানা নেই। ১৭ ই সেপ্টেম্বর ২০২১ তুহিনের জন্মদিন।

জান্নাত কে সে তার কাছে এনেই ছাড়বে। তার ডাকে জান্নাত কে এবার সাড়া দিতেই হবে। তুহিন এই প্রথম বারের মতো অনেক জেদ করলো জান্নাত কে তার বাসায় যাওয়ার জন্য। তুহিন বললো যদি আজ না আসো তাহলে সাড়া জীবনেও আর আমার কথা তোমায় শুনতে হবে না। জান্নাত একটা দোটানায় পরে গেল কি করবে সে? তুহিনের অনেক দিনের ইচ্ছে জান্নাতের সাথে একসাথে ছাদে বসে জ্যোৎস্না দেখবে চা পান করবে আর গল্প করবে। নদীর তীরে বসে বৃষ্টি উপভোগ করবে। ওরা দুজনেই ছিলো প্রকৃতির প্রেমি।আর প্রকৃতির টানেই দুজন দুজনকে কাছে ডাকা। জান্নাত বরাবর অজুহাত দেখিয়ে দূরে দূরেই থেকেছে কিন্তু এবার তুহিন আর ছাড়ছে না তাকে আসতেই হবে। তাই জান্নাত মন স্থির করে ফেললো এবং তুহিন কে জানিয়ে দিলো আমি আসছি। জান্নাত এর বাসা থেকে তুহিনের বাসার দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার। তুহিন জান্নাত কে বললো তুমি শিবপুর পর্যন্ত আসো বাকিটা আমি বাইক নিয়ে এসে তোমায় নিয়ে যাবো। জান্নাত যথেষ্ট সময় হাতে নিয়ে বাসে উঠলো, কিন্তু একি অবস্থা! ঘন্টা খানেক যেতে না যেতেই এত জ্যাম। গাড়ি যেন পিঁপড়ার গতিতে চলছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যাচ্ছে কিন্তু গন্তব্যে যাওয়ার কোন নাম ই নেই। দুজন দুজন কে কল দিয়ে যাচ্ছে। তুহিন এক পর্যায়ে জান্নাতকে বললো তুমি চৌরাস্তায় নেমে যাও আমি আসছি। সন্ধ্যা ৭.৩০ তুহিন ৬০ কিলোমিটার রাস্তা পার করে জান্নাত এর কাছে আসলো। কেউ কাওকে কোন কথায় বলছে না কথা বলার মতো ভাষা যেন তারা হারিয়ে ফেলেছে। কেউ কাউকে একবার চেয়েও দেখলো না তুহিন জান্নাত কে বাইকে বসতে বললো জান্নাত বসে পড়লো। রাস্তার দু পাশে গাছ পালা, ফাঁকা রাস্তা নিঝুম রাত, হালকা মৃদু মৃদু বাতাস বইছে। রাস্তার এক পাশে বয়ে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যা নদী অন্য পাশে লেবু ও পেয়ারা বাগান। কোন যানবাহনের শব্দ নেই ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। লেবু ক্ষেতে জোনাকির আলো দেখে মনে হচ্ছে এক দল রাত জাগা প্রহরী মশাল হাতে নিয়ে যেন বনে বাঁদারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পেয়ারা ও লেবুর অন্য রকম এক গন্ধ যেন চারপাশ মাতাল হয়ে আছে তুহিন ড্রাইভ করছিলো আর জান্নাত রাতের সব সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে যাচ্ছিলো। জান্নাত এই প্রথম এত রাতে কোন ছেলের বাইকে এত দূর কোথাও যাচ্ছে। তুহিনের উপর কতটা বিশ্বাস থাকলে সে এত বড় রিস্ক টা নিয়েছে। বাইক দ্রুত গতিতেই চলছে তুহিন ড্রাইভ করছে আর মাঝে মাঝে হাত ঝাকুনি দিচ্ছে তার হাত দুটো ব্যাথা হয়ে গেছে। জান্নাত জানতো একটু দূর হবে কিন্তু এতটা দূরে সে চিন্তাও করতে পারে নাই। একটা মানুষ এতটা রাস্তা ড্রাইভ করে আসছে এটা ভাবতেই কেমন লাগছে। জান্নাত ভাবছে যাওয়া আসা দিয়ে তুহিন ১২০ কিলোমিটার রাস্তা ড্রাইভ করছে। হঠাৎ তুহিন বলে উঠলো আমার কোন সমস্যা হচ্ছে না তুমি ভালো করে বসো। জান্নাত আলতো করে তুহিনের কাধে হাত দিয়ে বসে রইলো আর ভাবলো মনের কথা পড়তে জানে না কি? কিছুটা যাবার পর তুহিন গান ধরলো এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলো না...... । এত স্তব্ধতার মাঝে জান্নাত একদম নীরব ই থাকলো তুহিন হয়তো চেয়েছিলো জান্নাত দ্বিতীয় লাইন টা ধরবে কিন্তু তার আর হলো না। তুহিন অনেক চিন্তায় ছিলো কিন্তু জান্নাত কে বুঝতে দিচ্ছিলো না রাত ১০ টা বাজে ওদের বাসায় ফেরার কথা ছিলো ৭ টার মধ্যে নতুন জায়গা অচেনা মানুষ জন। তুহিন ভেবেছিলো বাড়িওয়ালা মামার মেয়েটির সাথে রাতে জান্নাত কে রাখবে সকালে ওরা ঘুরবে নদী দেখতে যাবে আর বিকেলে আবার জান্নাত চলে যাবে। কিন্তু ট্রাফিক জ্যাম সব পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিলো। নিয়ম অনুযায়ী বাড়িওলা হয়তো গেটে তালা দিয়ে এত ক্ষনে ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত প্রায় বারোটা বাজে তুহিন ওর বাড়িতে এসেছে আর ভাবছে এত রাত একটা মেয়ে সাথে না জানি মামা কি ভাববেন। এ সমস্ত ভাবতে ভাবতেই বাড়িওয়ালা কে বার বার কল দিয়ে যাচ্ছে কিন্ত বাড়িওয়ালা তো কল ধরচ্ছেন ই না। উনি হয়তো ভেবেছেন আজ তুহিন বাসায় আসবে না তাই লক করেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। তুহিনের এখানে এমন কেউ পরিচিত নেই যার বাসায় গিয়ে উঠবে ওরা দুজন একটি বাজারে এসে দাড়ালো। জান্নাত একদম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাবতেই পারে নাই তার জীবনে এমন কোন রাত আসবে। কোন অচেনা অজানা এক রাস্তার মোড়ে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে। তুহিন বড্ড ইতস্তত ভাবে জান্নাত কে বললো আমি তোমাকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেললাম। ভয় পেয়ো না এখানে বসো আমি আসছি। জান্নাত বসে আছে একটি চায়ের দোকানের ব্রেন্সের উপর, এত রাত একটি একা মেয়ে এভাবে বসে আছে এটা ভাবতেই তার কেমন লাগছে তাই তার চোখ খুঁজে যাচ্ছে কোন মেয়ে মানুষ আশে পাশে আছে কি না ইতিমধ্যে একজন ডিম বিক্রেতা এগিয়ে আসলো লোকটা ধুমপান করছিলো, কোন কথা বললো না জান্নাতের সামনের ব্রেন্সের উপর বসলো।

জান্নাত তুহিনকে খুঁজতে ছিলো দেখলো তুহিন একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জান্নাত তুহিন কে মেসেজ করলো বললো আপনি তারাতাড়ি আসেন আমার ভীষণ ভয় করছে। তুহিন হাতে কিছু আপেল নিয়ে দ্রুত চলে আসলো বললো এই তো এসে পড়েছি। এই আপেল গুলো পেলাম অনেক রাত হয়েছে সব দোকান বন্ধ খেয়ে নিন বলে বললো আমার একজন সহকর্মী আছে এখানেই সামনে বাসা উনার। ওখানে রাত টা থাকতে পারি। অনেক ভালো মানুষ আমাদের সমস্যা টা বুঝবে। সারাদিন অফিস শেষে অনেকটা ভ্রমণের পর অনেক টেনশনে দুজনেই খুব ক্লান্ত। জান্নাত বললো ঠিক আছে চলেন, তবে আপনি আপনার বাড়িওয়ালা কে আগের থেকে সব বলে রাখলেই পারতেন। তারপর তুহিনের সেই সহকর্মীর বাসায় গেল । তাকে সবটা খুলে বললো সে বিষয় টা বুঝতে পারলো ছেলেটির নাম ছিলো শহিদুল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরে তার বয়স ২৯ / ৩০ হবে। শহিদুল ভাই বললেন আপনারা এখানে এই ঘরে থাকেন আমি পাশের রুমে নিজের থাকার ব্যবস্থা করছি, বলে তার জায়নামাজ আর একটা চাদর নিয়ে চলে গেল। একা মানুষ তাই ছোট একটা রুম ছোট একটা খাট ওরা দুজনেই ভাবছে কিভাবে থাকবে এই বিছানায় দুজনেই অনেক ক্লান্ত। জান্নাত ফ্রেশ হয়ে আসলো আর তুহিন কে বললো আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি বিছানা করে দিচ্ছি। তুহিন ফ্রেশ হয়ে আসলো এসে জান্নাত কে বললো আপনি ঘুমিয়ে পড়েন আমি বসে আছি। জান্নাত বললো না না তা কী করে হয় বাইক চালিয়ে যাওয়া আসা দিয়ে আপনার অনেক পরিশ্রম করত হয়েছে আপনি বরং ঘুমিয়ে পড়েন আমি বসে আছি।

তুহিনের অনেক মাথা ব্যাথা করছিলো তুহিন তাই সুয়েই পড়লো আর জান্নাত কে বললো ভয় নেই আমার দ্বারা তোমার কোন ক্ষতি হবে না। তোমাকে যেমন সম্মানের সাথে নিয়ে এসেছি তেমন সম্মানের সাথেই দিয়ে আসবো। জান্নাত কেবল একটা কথাই বললো এই বিশ্বাস টুকু আছে বলেই তো আজ আমি এখানে এত দূর। আমায় নিয়ে ভাববেন না আপনি ঘুমিয়ে পড়েন। তুহিন ঘুমিয়ে পড়েছে জান্নাতের চোখ দুটো ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে সেও ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে যখন জান্নাতের ঘুম ভাংলো জান্নাত দেখলো জান্নাতের ডান হাতটা তুহিনের বুকের ভেতর। তুহিন এমন ভাবে হাতটা জরিয়ে ধরে ঘুমোচ্ছ যেন জান্নাত তাকে রেখে পালিয়ে যাবে। জান্নাত হাতটা আস্তে করে ছাড়িয়ে নিলো, ফ্রেশ হয়ে এসে তুহিন কে ডাকলো বললো সকাল হয়েছে উঠেন আমাদের চলে যেতে হবে তো। তুহিন উঠে পড়লো শহিদুল ভাই এর থেকে বিদায় নিয়ে জান্নাত কে নিয়ে তার বাসায় গেল। সকালের নাস্তা তৈরী করলো আর জান্নাত এই ফাঁকে তুহিনের জন্য আনা উপহার টি তুহিনের টেবিলের এক কোনায় রেখে দিলো আর একটি কাগজে লিখলো ছোট্ট এই উপহার টি গ্রহণ করলে অনেক খুশি হবো। দুজন গল্প করলো তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে। তুহিন সবকিছুর জন্য সরি বললো। জান্নাত বললো আমি কিছু মনে করে নি। তবে আমি এখন ফিরতে চাই। তুহিন জান্নাত কে আর বারন করতে পারলো না। হয়তো বারন করার মতো সাহস তার আর নেই। একটা লোকাল বাসে উঠে তুহিন জান্নাত কে নিয়ে গেল একটা বাস স্ট্যান্ড এ সেখানে গিয়ে কিছু খাবার আর একটি পানির বোতল কিনে জান্নাতের ব্যাগ এ রাখলো বললো দুপুরে খেয়ে নিতে। টিকিট কাটলো বাস ছাড়ার অপেক্ষায় দুজন দাঁড়িয়ে আছে কেউ কোন কথা বলছে না। কেমন জানি একটা বিচ্ছেদ এর যন্ত্রণা দুজনকেই নিরব করে রাখছে। বাস ছাড়বে তুহিন জান্নাত কে সিটে বসিয়ে দিলো তারপর বাস থেকে নেমে গেল। জান্নাত কেবল একবার জানালা দিয়ে তাকিয়ে তুহিনকে দেখলো তারপর তার দৃষ্টি পড়লো গন্তব্যের দিকে। মোবাইলটা বের করে তুহিনকে একটা মেসেজ দিলো এতক্ষনে তুহিন ফেরার জন্য একটি বাসে উঠে পড়েছে। মেসেজ পেয়ে মোবাইলটা হাতে নিতেই দেখে জান্নাত এর মেসেজ সেখানে লেখা আছে। খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো সামনের স্টেশন পর্যন্ত সাথে যাবে কি? মেসেজটি পড়ার পর তুহিনের ইচ্ছে করছিলো যেন এখনি লাফ দিয়ে নেমে এক দৌড়ে জান্নাতের কাছে চলে যেতে কিন্তু ততক্ষণে জান্নাতের বাস টা চোখের অগোচরে চলে গেছে। তুহিনের সব কিছু যেন মুহুর্তে এলো মেলো করে দিয়ে গেলো দমকা এক হাওয়া এসে সে ভাবছিলো কী হলো এসব আমার সাথে তবে কি এটা ছিলো আমার জেগে দেখা স্বপ্ন?